#এরই_মাঝে
#পর্ব-১৮
নিজেকে ব্যস্ত রাখতে দু’টো টিউশনির জায়গায় চারটা টিউশন শুরু করেছে শায়লা। চারটা টিউশন করায় সপ্তাহের ছয়দিন। সপ্তাহে তিনদিন করে অল্টারনেট ডেতে বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি পড়ানো আর সকাল থেকে দুপুর অবধি ক্লাস করা। মোটামুটি সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত নিজেকে গাধার মতো খাটিয়ে নেয় শায়লা। তারপর হলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই ঘুম। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে পড়তে বসা। ঠিক এইরকম কঠিন নিয়মে জীবনকে আবদ্ধ করে ফেলেছে শায়লা। ছয়দিন তুমুল ব্যস্ততা শেষে শুক্রবার দিনটা রেখেছে নিজের বিশ্রামের জন্য। শুক্রবার সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় কিংবা নিজের টুকটাক কাজ থাকলে করে। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে শায়লার।
এই একঘেয়ে জীবনে হুট করে এক শুক্রবার সকালে মহুয়ার ফোন-“আপা, তুমি কোথায়?”
সাতসকালে বোনের ফোন পেয়ে শায়লা বিরক্ত হয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো-“কোথায় আর থাকবো হলে আছি। সাতসকালে ফোন দিয়েছিস কেন?”
মহুয়ার উত্তেজিত গলা শোনা গেলো-“আপা, তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসো। আমি তোমার হলের গেটের সামনে আছি।”
নিমেষেই ঘুম ছুটে যায় শায়লার। হতবিহ্বল গলায় জানতে চাইলো-“কি বললি? কোথায় তুই!”
“তোমার হলের গেটের সামনে।”
মহুয়ার ফিরতি উত্তরে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো শায়লার-“মানে কি? তুই ঢাকায় আসছিস? কার সাথে?”
মহুয়া বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো-“একা আসছি আপা। দাদাজান রাতের গাড়িতে তুলে দিছিল।
আপা, এখন কি তুমি নিচে আসবা? এতো জিনিসপত্র হাতে নিয়ে দাঁড়ায় আছি আর তুমি পুলিশের মতো প্রশ্ন করতেছ।”
শায়লার মেজাজ ভীষণ খারাপ হলো। এতটুকু মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিছে মানে কি? যদি কোন ধরনের এক্সিডেন্ট হতো? দাদাজান তাকে একা ঢাকায় ছাড়বে না বলে বিয়ে করিয়ে দিলো আর এদিকে আরেকজনকে একা একা গাড়িতে তুলে দেয়। দুইজনের জন্য দুইরকম নীতি কেন হবে? পুরনো রাগটা নতুন করে ফিরে এলো শায়লার মাঝে। কিন্তু এখন রাগ দেখানোর সময় না। আগে মহুয়াকে নিয়ে আসা যাক তারপর বুড়োর বিচার হবে। কেন মহুয়াকে একা একা ছেড়ে দিলো এর জবাব চাইবে। শায়লা কোনরকমে মুখ ধুয়ে গায়ে ওড়না চড়িয়ে হাতব্যাগটা নিয়ে নিচে নেমে এলো। গেটের সামনে আসতেই আরেক সারপ্রাইজ পেলো। মহুয়ার সাথে রিদওয়ান দাঁড়িয়ে আছে। শায়লা দূর থেকে দু’জনকে একসাথে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো। মহুয়ার সাথে রিদওয়ান কেন? রিদওয়ান কি বাড়ি গেছিল? কিন্তু মহুয়া যে বললো সে একা এসেছে? শায়লার মনে প্রশ্নের ঝড়।
“আপাআআআআ।”
দূর থেকে বোনকে দেখেই মহুয়া ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়লো শায়লার বুকে। মহুয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে চোখ নাচালো-“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বলো তো?”
শায়লা জবাব না দিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। বোনকে নিয়ে এগিয়ে এলো রিদওয়ান এর কাছে। মহুয়া ভীষণ রকম খুশি। সে বকবক করছে-“বুঝলে আপা, দাদাজান তো কিছুতেই একা পাঠাবে না কিন্তু ভাইয়ার জন্য বাধ্য হয়ে পাঠালো। ভাইয়া দাদাজানকে অভয় দিয়ে বললো আমাকে গাড়িতে তুলে দিলে সে ঢাকায় রিসিভ করবে। গাড়ি ঢাকা পৌছানোর অনেক আগে থেকে ভাইয়া কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছিলো। আর সারারাত কিছুক্ষণ পর পর ভাইয়া ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে আমার।”
শায়লা নিজের ভাবনায় কিছুটা লজ্জা পেলো। সে কৃতজ্ঞ চিত্তে রিদওয়ানের দিকে তাকালো-“আপনার অনেক কষ্ট হলো ওর জন্য।”
রিদওয়ান হাসলো-“ছোটবোনের জন্য একটু কষ্ট করাই যায়। তাছাড়া সত্যি বলতে কষ্ট তেমন হয়নি। আমার রাতে ডিউটি ছিলো, সারারাত সজাগই ছিলাম। এখন ডিউটি এক্সচেঞ্জ হয়েছে। হলে ফিরে লম্বা একটা ঘুম দেব।”
“তবুও আপনাকে ধন্যবাদ দেব নিজের ব্যস্ত শিডিউল থেকে ওকে সময় দিয়েছেন বলে।”
রিদওয়ানকে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ দেখায়-“বারবার ধন্যবাদ বলে আমাকে ছোট কোর না শায়লা। মহুয়ার প্রতি আমারও কিছুটা কর্তব্য আছে। টেক ইট ইজি। আমার ঘুম পাচ্ছে আসছি আমি। ওকে মহুয়া, আপুর কাছে থাকো। কাল তোমাকে নিয়ে কোচিং এ যাব। আমি কথা বলে রেখেছি কোচিং এ।”
মহুয়া ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে বললো-“ঠিক আছে ভাইয়া। খুব কিন্তু জ্বালাবো আপনাকে আমাকে পরে বকা দিতে পারবেন না।”
রিদওয়ান হাসল-“যত খুশি জ্বালিয়। আজ আসছি।”
রিদওয়ান চলে গেলে শায়লা গম্ভীর হলো। রুমে আসতেই শায়লা মহুয়াকে বকলো-“আমাকে না জানিয়ে ওকে জানিয়েছিস কেন মহুয়া? আমি জানলে কি তোকে ঢাকায় আসতে বাঁধা দিতাম?”
“বাঁধা দেওয়ার কথা আসছে কেন আপু? ভাইয়া ছাড়া কে দাদাজানকে কন্ট্রোল করতে পারতো আপু। তুমি তো জানো দাদাজান কেমন। আমরা বললে কি রকম হতো আর ভাইয়া বলাতে কেমন হলো সেটা তো বুঝতে পারছো নাকি?”
শায়লা মাথা নাড়লো-“না বুঝতে পারছি না। তুই জানিস আমি অন্যের থেকে সাহায্য নেওয়া পছন্দ করি না। নিজের লড়াই নিজে লড়া ভালো।”
“কিন্তু আপু ভাইয়া তো অন্য কেউ না।”
“তোর কাছে নিজের বোনের চাইতে দুইদিন আগে আসা মানুষটা আপন হলো?”
মহুয়া মাথা নাড়ে। শায়লা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো-“তাহলে আমাকে না জানিয়ে তাকে জানালি কেন? কোচিং এ ভর্তির ব্যাপারেও ওকে বলেছিস।”
“কারণ ভাইয়া ডাক্তার আপু। তুমি আমাকে ভুল বুঝছো কেন?”
শায়লা কিছুক্ষণ মহুয়াকে দেখলো তারপর বললো-“ফ্রেশ হয়ে নে আমি খাবার এর আয়োজন করি।”
থমথমে মুখে শায়লা কথাটা বলতেই মহুয়ার বুকটা হুহু করে উঠলো। ঢাকায় আসা নিয়ে খুব উত্তেজিত ছিল সে। অথচ এখন শায়লায় মুখ দেখে কান্না পেয়ে গেলো। সে কান্না আঁটকে জবাব দিলো-“এখন খাবো না আপা। ঘুমাবো এখন পরে খাব।”
শায়লাও আর সাধলো না। মহুয়া ঘুমিয়ে গেলেও শায়লার আর ঘুম আসে না৷ দু’দিন হলো জীবনে আসা রিদওয়ান এতো আপন হলো যে তার বোন তাকেই কিছু জানালো না? ভাবনাটা মাথায় আসতেই তার পুরোটা দিন তেতো হয়ে গেল।
পরদিন কোচিং এ ভর্তি করানোর জন্য রিদওয়ান নিতে এলো মহুয়াকে৷। শায়লা ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে ওদের সাথে এলো না। এবার মহুয়া সত্যি সত্যি মন খারাপ করলো। বোনের ব্যবহার কেন যেন মেনে নিতে পারলোনা। সে রিদওয়ানকে অনুরোধ করলো কোচিং এর কাছাকাছি একটা হোস্টেল এ সিট ম্যানেজ করে দিতে। সে কয়দিনের মধ্যে হোস্টেলে উঠে গেলো দ্রুত। শায়লা সব দেখলো চুপচাপ। ওর মহুয়াকে কিছু বলার ইচ্ছে হলো না। করুক যা ইচ্ছে, বড় হয়েছে নিজের ভালো মন্দ বোঝার জ্ঞান তো আছে।
পরের কোন এক শুক্রবার বিকেলে শায়লার ফোনে ফোন এলো। পরিপাটি হয়ে নিচে নামতেই রিদওয়ানকে দেখলো শায়লা। পান্জাবি আর জিন্স পরিহিত রিদওয়ানকে দেখে অন্যরকম লাগে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, মনে হলো কিছুটা মনখারাপ ভাব। দু’জন চুপচাপ হাটলো কিছুক্ষণ। শায়লা বারবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে তাকে। রিদওয়ান একটা রিকশা ডেকে উঠে বসলো। অগত্যা বাধ্য হয়ে শায়লাও উঠলো।
রিকশা চলতে শুরু করেছে কিন্তু তবুও রিদওয়ান চুপচাপ। শায়লা বাধ্য হয়ে জানতে চাইলো-“আপনার কি মন খারাপ?”
রিদওয়ান একঝলক তাকিয়ে দেখলো শায়লাকে-“আজ আমার জন্মদিন।”
শায়লা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো-“শুভ জন্মদিন।”
“থ্যাংক ইউ।”
“বাসায় যাননি আজ?”
“গেছিলাম। সারাদিন বাসায়ই ছিলাম।”
“ওহহহ।”
শায়লা ভাবছে কি গিফট দেবে রিদওয়ানকে। ওদের বাড়িতে ঘটা করে কারো জন্মদিন পালন হয় না। তাদের তিনবোনের কারো জন্মদিন হলে মা নিজ হাতে কিছু বিশেষ খাবার রান্না করে এই যা। তবে ঢাকায় আসার পর থেকে দেখছে জন্মদিন মানেই আনন্দ। তার দুইজন ছাত্রীর জন্মদিন পালন হয়েছে কেক কেটে, বড় অনুষ্ঠান করে। ক্লাসের কয়েকজন বন্ধুর ক্ষেত্রেও দেখেছে। কেক কাটা হয়, গিফট দেওয়া হয়। রিদওয়ানও নিশ্চয়ই বাসায় কেক কেটেছে। শায়লার কেন যেন মন খারাপ হলো।
“নামো।”
শায়লা সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা রেস্টুরেন্ট। রিদওয়ান রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ডাকলো-“এসো।”
“এখানে?”
“হুমমম। একসাথে খাবো আমরা। জন্মদিনের ট্রিট।”
শায়লা চুপচাপ রিদওয়ান এর পিছু নিলো। কোনার দিকে একটা টেবিলের কাছে এগিয়ে যেতেই মহুয়ার চিৎকার শোনা গেলো-“শুভ জন্মদিন আপা।”
শায়লা ঘাবড়ে গেলো। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকে। মহুয়া হিহি করে হাসছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিদওয়ানও দাঁত বের করে হাসছে। ওর দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাচ্ছে। যেন বলতে চাইছে, কি কেমন চমকে দিলাম?
©Farhana_Yesmin