এরই মাঝে পর্ব-২২+২৩

0
109

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২২

মহুয়ার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় রেজাল্ট সবার আগে দেখেছে রিদওয়ান। প্রথম খবরটা গ্রামে থাকা মহুকেই জানালো রিদওয়ান। রেজাল্ট শুনেই মহুয়া ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করেছে। রুবিনা যত ব্যাকুল হয়ে মেয়ের কাছে কান্নার কারণ জানতে চায় মহুয়ার কান্না তত বাড়ে। বিকেল হতে হতে তৈয়ব মাওলানার বাসায় মহুয়ার কলেজের শিক্ষক, পত্রিকার লোকজনে ভরে গেলো। জানা গেলো মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় মহুয়া সর্ব্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। তৈয়ব মাওলানা এই খুশি কিভাবে উৎযাপন করবে ভেবে পাচ্ছে না। শায়লা থাকলে হয়তো বুদ্ধি পাওয়া যেত কিন্তু শায়লার পরীক্ষা নিকটে বলে সেও আসতে পারছে না। তৈয়ব মাওলানা এলাকা জুড়ে মিষ্টি বিতরণ করলো। এতিমখানায় একদিনের ভোজনের দায়িত্ব নিলেন। জমিজমা থেকে যা ইনকাম হয় তাতে এই খরচ বেশ কষ্টকর হলেও সে হাসিমুখে খরচ করলো। এই গ্রামে তার ছেলে মুকুল ছিলো প্রথম ডাক্তার। আজ তার নাতিন একই খুশি উপহার দিলো। এ এক অন্যরকম আনন্দ যা অন্য কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। তৈয়ব মাওলানার চোখ মুখ জুড়ে বিশাল কিছু পাওয়ার আনন্দ।

রাতে ঘুমাতে এসে রুবিনা টের পেলো মহুয়া তার বিছানায়। মাকে জড়িয়ে ধরে মহুয়া বললো-“বিশ্বাস করো মা, আমি ডাক্তারি পড়তে চাই শুধুমাত্র তোমার জন্য। আমি তো তোমার মেয়ে মা। তোমার মুখ উজ্জ্বল করতে চাই আর কিছু না। ওই লোকটার কথা আমি একবারও ভাবি নাই। তুমি কি আমাকে ভুল বুঝবা মা?”
রুবিনার চোখ দুটো জলে টইটম্বুর। অন্ধকারে মেয়েকে বুঝতে দিলো না নিজের হাল। সন্তোর্পণে নয়নের জল মুছে নিয়ে মেয়ের মাথায় হাত দিলো-“তোরে ভুল বুঝি নাই মা। তোর যেটা ভালো লাগে কর আমি রাগ করবো না।”
মহুয়া মায়ের বুকে মাথা রাখে-“জানো মা, আমি চাই সবাই বলুক ওই যে রুবিনার মেয়ে যাচ্ছে। রুবিনা যেমন ভালো মেয়েটা তেমনই ভালো ডাক্তার হইছে। আমি লোকটাকে দেখাই দিতে চাই ডাক্তারি পড়লেই সবাই অমানুষ হয় না তার মতো।”
“ছিহ মা, এমন করে বলতে হয় না। হাজার হোক লোকটা তোর বাবা।”
মহুয়া তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো-“আমি তোমার মতো এতো মহৎ হতে পারবোনা মা। যে অমানুষ তাকে অমানুষ বলবো।”
রুবিনা ভাঙা গলায় মৃদুস্বরে বললো-“এভাবে বললে সবাই আমার শিক্ষা দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করবে। আমি তো তোদের বেয়াদবি শিখাই নাই। যে যত খারাপ কাজ করুক তার সাথে তুই খারাপ ব্যবহার করবি না। উপযুক্ত সময়ে আল্লাহ তার বিচার করবে।”
মহুয়া আর কোন কথা বললো না। চুপচাপ মায়ের বুকে পড়ে রইলে। সে বলতে পারলো না লোকটা এসেছিল তার কাছে। বাপের অধিকার নিয়ে। কিছু টাকা পয়সা দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করার নামে মায়ের অহং ভাঙতে। মহুয়া সে টাকা নেয়নি। লোকটাকে বলেছে আর কোনদিন যেন তাদের সামনে না আসেন। এতোদিন যখন তার টাকা পয়সা ছাড়া চলেছে বাকী জীবনও পারবে। লোকটার মুখ দেখার মতো হয়েছিল। মহুয়া বুঝতে পারছে আপা কেন লোকটাকে এতো ঘৃনা করে। লোকটা আসলে ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকে। আদতে চরম অভদ্র।

*****

“এই শায়লা, খবর শুনেছ?”
শায়লা নাকমুখ গুঁজে পড়ছে। সামনে তার ইয়ার ফাইনাল তাই অন্য দিকে সময় দেওয়ার মতো সময় তার নেই। এমন সময় রিদওয়ানের ফোন পেয়ে কিছুটা বিরক্ত হলো-“না জানিনা। কি হয়েছে বলেন।”
“মহুয়ার মেডিকেল রেজাল্ট দিয়েছে। এন্ড গেস হোয়াট?”
“গেস করতে পারছি না তাড়াতাড়ি বলুন।”
শায়লা তাড়া দিলো।তাতে অবশ্য রিদওয়ানের আনন্দ কমলো না। সে উচ্ছ্বাস নিয়ে বললো-“তোমার বোন একটা জিনিয়াস। সে ভর্তি পরীক্ষায় সর্ব্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে প্রথম হয়েছে।”
শায়লা কিছুটা চমকালো। মহুয়া ভালো ছাত্রী, মেট্রিক, ইন্টার দু’টোতেই ভালো রেজাল্ট করেছে। শায়লা জানতো মহুয়া মেডিকেলে চান্স পারে কিন্তু একেবারে প্রথম হবে এটা জানতো না। সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো-“সত্যি? আপনি কিভাবে জানলেন?”
শায়লার বোকা বোকা কথায় রিদওয়ান বিরক্ত-“আজব কথা বলে? আমি ডাক্তার না? এটা জানা এমন কি ব্যাপার?”
শায়লা কোন জবাব খুঁজে পায় না। রিদওয়ান বললো-“চলো সেলিব্রেট করি।”
“মহুয়া তো নেই। কিভাবে সেলিব্রেট করবো? এখন আবার দয়া করে বাড়ি যাওয়ার কথা বলবেন না। সামনে আমার এক্সাম আমি কোথাও যেতে পারবোনা।”
রিদওয়ান রাগ হয়ে গেলো-“তোমার এক্সাম আছে আমার নেই? মনে রাখবে পড়ার চাপ তোমার চাইতে আমার অনেক বেশি। তুমি একটা বোরিং মেয়ে বুঝলে? ধুর তোমার যেতে হবে না কোথাও। তুমি পড়ো।”
বলেই রিদওয়ান দুম করে ফোন কেটে দেয়। শায়লা বোকা বনে যায়। কি এমন বললো সে? না হয় একটু পড়ার কথাই বলেছে তাই বলে এভাবে ফোন কেটে দিতে হবে? আর সে বোরিং মেয়ে এটা এতোদিনে বুঝলো রিদওয়ান? কিছুটা অভিমান হলো শায়লার। পরক্ষণেই অভিমান কিছুটা ম্লান হলো। আসলেই সে বোরিং মেয়ে। কোথায় বোনের মেডিকেলে চান্স পাওয়া উপলক্ষে আনন্দ করবে তা না বসে বসে পড়া গিলছে। শায়লার মনে হলো রিদওয়ান রাগ করেছে ওর রাগ ভাঙাতে হবে। সে দ্রুত রিদওয়ানের নাম্বারে ডায়াল করলো।
“কি চাই?”
“সেলিব্রেট করতে।”
“তোমার পড়ার ক্ষতি হবে না?”
রিদওয়ান এর কন্ঠে বিদ্রুপ। শায়লা দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-“হলে হবে। সেলিব্রেশনটা ভীষণ জরুরি।”
“ঠিক তো?”
“একশোভাগ ঠিক।”
রিদওয়ান খুশি হয়ে গেলো-“চলো আজ ধানমন্ডি যাই।”
“আমি কিন্তু আপনাদের বাসায় যাব না।”
শায়লা ফট করে কথাটা বলেই জিভ কামরায়। ধ্যুত, কেন যে একথা বলতে গেলো? রিদওয়ান গম্ভীর হলো-“আজব মেয়ে তুমি? বাসায় কেন যাব? ওখানে নতুন একটা রেস্টুরেন্ট হয়েছে সেটায় যাব।”
“আচ্ছা। আমি তৈরি হয়ে নামছি আধাঘন্টার মধ্যে।”
“ঠিক আছে।”
শায়লা যেন বন্ধ করে রাখা শ্বাসটা এতোক্ষণে ফেললো। রিদওয়ান মাঝে মাঝে মুগ্ধ হওয়ার মতো আচরণ করে। এই যে শায়লা বাসায় যেতে চাইলো না একবারও জানতে চায়নি কেন যেতে চায় না। এইজন্যই রিদওয়ানকে ভালো লাগে। ভালো লাগে! প্রশ্নটা বারকয়েক মনে মনে আওড়ালো শায়লা৷ সত্যি রিদওয়ানকে ভালো লাগে? ভাবতে ভাবতে কাপড় পড়লো শায়লা।

আধাঘন্টা পর নিচে নামতেই রিদওয়ান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। অসস্তি বোধ করে। তাকে কি দেখতে খুব খারাপ লাগছে এই পোশাকে? রিদওয়ান এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?
“কি হয়েছে? এভাবে কি দেখছেন?”
রিদওয়ান কিছু বলতে যেয়ে একবার থামলো তারপর শায়লাকে ভীষণ অপ্রস্তুত করে দিয়ে বলে ফেললো-“তুমি জামাটা উল্টো পরেছ শায়লা।”
শায়লা হতবাক হয়ে নিজের গায়ের জামা দেখলো। সে এমনই লজ্জা পেলো, মনে হলো এই মুহূর্তে ধরনী দ্বিধা হও আমি লুকিয়ে পড়ি। তার মুখচোখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। রিদওয়ানের প্রচন্ড হাসি পেলেও সে হাসলো না। অনেক কষ্টে হাসি দমিয়ে রেখে বললো-“মনেহচ্ছে আমার সাথে দেখা করার ভীষণ তাড়া ছিলো তোমার। তাইতো জামা সোজা পরছো না উল্টো টের পাওনি।”
শায়লার আরক্ত গালে যেন আরও খানিকটা লালিমা লাগলো। সে মাথা নিচু করে রাগত স্বরে জবাব দিলো-“মোটেও না।”
“তাহলে নিশ্চয়ই আমাকেই ভাবছিলে।”
শায়লা মাথা নাড়ে। রিদওয়ানের ঠোঁটের কোনে প্রচ্ছন্ন দুষ্ট হাসি-“মিথ্যে বলছো কেন শায়লা? আমি জানি তুমি আমাকেই ভাবছিলে।”
শায়লা বুঝলো রিদওয়ান তাকে ইচ্ছে করে জ্বালাতন করতেই এসব বলছে। রাগে কটমট দৃষ্টিতে সে রিদওয়ানকে দেখলো। রিদওয়ান গম্ভীর হয়ে ওকে দেখছে। শায়লা মনে মনে দমে গেলো, দূর্বল গলায় নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো-“আমি মোটেও আপনাকে নিয়ে ভাবছিলাম না। অনেক পড়া জমে আছে কিভাবে সেগুলো শেষ করবো তাই ভাবছিলাম। নিজেকে ইমপর্টেন্স দেওয়া বন্ধ করুন জনাব।”
“করলাম বন্ধ। এবার তুমি দ্রুত জামাটা ঠিক করে এসো। আমি দাড়াচ্ছি এখানে।”
রিদওয়ান এর বলতে দেরি শায়লার ছুটতে দেরি হয় না। এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি শায়লার জীবনে আগে আসেনি। সে যত দ্রুত সম্ভব রিদওয়ান এর চোখের আড়ালে যেতে চায়। শায়লা একবার পিছু ফিরলে দেখতে পেতো, শায়লার দৌড় দেখে রিদওয়ান কিভাবে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২৩

মহুয়া ঢাকায় এসেছিল ভর্তি হতে। শায়লার কিছু করতে হয়নি, যা দৌড় ঝাপ করার রিদওয়ান করেছে। এমনকি এক দুই দিন পর পর মাকে ফোন দিয়ে খোঁজ নেওয়া, বিনার পড়ালেখার খবর নেওয়া, দাদা দাদীর শরীরের হালচাল সবই করছে নিষ্ঠার সাথে। রুবিনা রিদওয়ানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শুনে ধন্ধ লাগে শায়লার। রিদওয়ান এতো কিছু কেন করছে? সে কি শায়লাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে? নাকি বিয়ের পর শুধুমাত্র দায়িত্ব পালন করছে? শায়লা অনেক ভেবেও এর সুরাহা করতে পারে না। যতদূর শুনেছে রিদওয়ান বিয়েতে রাজি ছিলো না তাহলে হুট করে কি হলো যে এরকম পাল্টে গেল? কেন ওর পরিবারের জন্য এতো আন্তরিকতা দেখাচ্ছে? শায়লা ঠিক করলো রিদওয়ান এর কাছে কারণ জানতে চাইবে। জানতে চাইবে এতোকিছু রিদওয়ান দায়িত্ব ভেবে করছে নাকি ভালোবেসে?

‘ভালোবাসা’ শব্দটা বারকয়েক আওড়ায় শায়লা। রিদওয়ান কি ওকে ভালোবাসে? গাল লালচে রঙ ধারণ করে। কান দু’টো অকারণে উত্তাপ ছড়ালো। শায়লা টের পায় আজকাল অহেতুক রিদওয়ানকে নিয়ে ভাবছে সে। কারণে অকারণে সময়ে অসময়ে ভাবছে আর টের পাচ্ছে রিদওয়ানকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে তার। সে কি তবে রিদওয়ান এর প্রেমে পড়লো? নাহ, কিছুতেই না। এমন কাজ কখনো করবে না শায়লা। ডাক্তারের প্রেমে পড়বে না কিছুতেই। মনের ভাবনার দিক পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়ে পড়ায় মন দিলো সে। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলোনা। ফোনটা বেজে উঠলো। ওয়াহেদের নাম্বার দেখে মনটা ছটফট করলো। এই মানুষটা অনেকদিন পরে ফোন দিলো। কিন্তু কেন ফোন দিলো? এর আগে মানুষটা কেবল তাকে নিতে আসার আগে ফোন দিয়েছে। আজও কি তাই করবে? কিন্তু ও বাড়িতে শায়লা আর এভাবে যেতে চায় না। নিজেকে বড্ড অনাহুত লাগে। ফোন ধরবে না করতে করতে কেটে গেলো। হাফ ছেড়ে বাঁচে শায়লা। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবারও ফোন বাজতে লাগলো। শায়লা এবার বাধ্য হয়ে ফোন রিসিভ করলো-“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম মামনী। কেমন আছো তুমি?”
“ভালো আছি আঙ্কেল। আপনারা সবাই ভালো?”
ওয়াহেদ হাসলো-“ভালো আছি। তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?”
“ভালো চলছে।”
“শুনে খুশি হলাম। যে জন্য ফোন দিলাম শায়লা মামনী, কাল বাসায় ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান আছে। তোমাকে কিন্তু আসতেই হবে।”
শায়লা আঁতকে উঠলো। ও বাড়িতে যাওয়ার কথা মনে এলেই তার চোখের সামনে জাকিয়ার মুখছবি ভেসে ওঠে। শায়লা দুইবার ঢোক গিললো। ও কিছু বলার আগেই ওয়াহেদ মোলায়েম স্বরে বললো-“তুমি বাসায় আসাটা পছন্দ করো না জানি। এইজন্য এতদিন বলিওনি। কালকের জন্য মানা করো না মামনী। বাসার সবাই থাকবে, তুমি না থাকলে অনুষ্ঠান অসমাপ্ত লাগবে।”
এরকম কথা শোনার পর আর কি বলা যায়? শায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“আচ্ছা আঙ্কেল, আমি আসবো।”
ওয়াহেদ খুশি হয়ে জবাব দিলো-“আমি রিদওয়ানকে বলে দেব যেন তোমাকে সাথে নিয়ে আসে।”
“জ্বি।”
“ভালো থেকো। কাল দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।”
ওয়াহেদ ফোন নামিয়ে রাখলো। শায়লা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে রিদওয়ানকে ফোন করলো-“আপনি কি বিকেলে ফ্রি আছেন? একটু দেখা করা প্রয়োজন।”
রিদওয়ান ফিক করে হাসলো-“ঘটনা কি শায়লা? আমাকে একটু বেশি বেশি মিস করছো না? একটু ঝেড়ে কাশো তো।”
শায়লা রেগে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“হুমম, ভীষণ মিস করছি। এখন বলুন বিকেলে ফ্রি আছেন কিনা।”
“ফ্রি নেই কিন্তু তোমার জন্য সময় বের করে নেব। বলো কোথায় আসবো?”
এ কথা শুনে শায়লার মন খানিকটা উচাটন হলো। সে প্রগলভ হয়ে বললো-“খেলার মাঠের সামনে আসুন।”
“ঠিক আছে।”

দূর থেকে রিদওয়ানকে দেখলো শায়লা। হালকা আকাশী রঙের শার্ট আর জিনসের প্যান্ট পরা রিদওয়ান মন দিয়ে মাঠের ছেলেদের খেলা দেখছে। চোখের চশমাটা ঠিক করলো কয়েকবার। এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে ব্যাকব্রাশ করলো৷ শায়লার ভ্রু কুঁচকে গেলো। আজ পর্যন্ত রিদওয়ানকে ওর সামনে ডাক্তারি এপ্রোন গায়ে দেখেনি কখনো। রিদওয়ান কি ইচ্ছে করে এপ্রোন পড়ে না? কারণটা কি সে নিজে? পেটের মধ্যে ওলটপালট হলো, বুকটা অকারনে মুচড়ে উঠলো। শায়লা টের পেলো রিদওয়ানকে নিয়ে ভাবতে আর দেখতে যেয়ে নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে গেছে সে। হুশ ফিরে পেয়ে লজ্জিত হয়ে পা বাড়ায়। রিদওয়ান তাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লো। শায়লাও হাত নাড়িয়ে হাসলো। পাশে বসে জানতে চাইলো-“অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন নাকি?”
“হুমমম। যুগ যুগ ধরে, অপেক্ষার প্রহর যেন ফুরায় না।”
রিদওয়ানের কন্ঠে দুষ্টামির আভাস। শায়লা বুঝতে পেরে হাসলো মৃদু। এই ফাঁকে রিদওয়ান ওকে দেখলো একঝলক৷ অবাক কান্ড হলো শায়লাও আজ আকাশী রঙের সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে। রিদওয়ান আড়চোখে নিজের গায়ের কাপড় দেখলো। ওর ঠোঁটের কোনে হাসি এসেও মিলিয়ে গেলো। মুখে গাম্ভীর্যতা এনে জানতে চাইলো-“হঠাৎ ডাকলে যে?”
“আঙ্কেল ফোন দিয়েছিল। কাল আপনাদের বাড়িতে কোন একটা অনুষ্ঠান আছে। যেতে বললো খুব করে। কিসের অনুষ্ঠান জানেন?”
রিদওয়ান মাথা দুলিয়ে বললো-“জানি। তুমি কি যাবে বলেছ?”
“হুমম। আঙ্কেল এমনভাবে বললো যে মানা করতে পারিনি। কিসের অনুষ্ঠান বলুন তো?”
“তার আগে বলো, তোমাকে বলে কি পাবো?” শায়লা আকাশ থেকে পড়ে-“কি চান আপনি? আশ্চর্য! আপনাদের বাড়ির অনুষ্ঠান, গিফট নেব কিনা সেজন্য জানতে চাইছি।”
রিদওয়ানের মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন হলো না। সে শায়লার মুখপানে তাকিয়ে বললো-“আমাদের পড়ালেখার জীবন শেষ হতে চললো। তাই বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছি বেড়াতে যাব কুয়াকাটা, দুই দিনের জন্য। তুমি যাবে?”
শায়লা বিস্ময় নিয়ে রিদওয়ানকে দেখছে। হা করে থেকে নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। রিদওয়ান বিরক্তি নিয়ে বললো-“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমি কি খুব আজব কিছু বলেছি? বন্ধুরা সবাই গার্লফ্রেন্ড নিয়ে যাবে। তো আমি বিয়ে করেছি যখন বউ নিয়েই তো যাব, নাকি?”
শায়লা দম ফেলে জানতে চাইলো-“কালকে কিসের অনুষ্ঠান তাই বলুন।”
“তুমি যাচ্ছ তাহলে?”
“কোথায়? ওহহ, আপনার সাথে? সে পরে দেখা যাবে। আগে কালকেরটা বলুন।”
“উহু, তুমি আগে বলো যাচ্ছ আমার সাথে?”
শায়লার হাসফাস লাগে। রিদওয়ান হুট করে এমন জেদ কেন করছে ওর বোধগম্য হলো না।
“আচ্ছা ঠিক আছে যাব আপনার সাথে। এবার বলুন কাল কিসের অনুষ্ঠান?”
রিদওয়ান ফিক করে হাসলো-“বাবা মায়ের ৩৫তম বিবাহবার্ষিকী।”
“৩৫তম!” শায়লা বিরবির করলো। ওর কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকলো ব্যাপারটা। দুটো মানুষ ৩৫ বছর একসাথে! কিভাবে সম্ভব হলো? তার বাবা মা কেন পারলোনা? আর শায়লা, সে কি পারবে? রিদওয়ানের সাথে তার দাম্পত্য জীবন কি ৩৫ বছর পার করতে পারবে? শায়লা আনমনা হয়ে রিদওয়ানকে দেখলো। রিদওয়ান মাথা ঝাকালো-“কি দেখছো?”
“ভাবছি।”
রিদওয়ান অবাক হলো-“ভাবছো? কি ভাবছো?”
“৩৫ বছর একসাথে থাকাটা বিস্ময়কর বটে। কিভাবে পারলেন ওনারা?”
রিদওয়ান মোলায়েম একটা হাসি দিলো। নরম রোদের আলোয় হাসিটা বড়ই সরল লাগলো শায়লার কাছে। রিদওয়ান কোমল কন্ঠে বললো-
“শোন, ভালোবাসা থাকলে পয়ত্রিশ কেন সত্তুর বছরও একসাথে থাকা যায়। আর ভালোবাসা না থাকলে একদিনও নয়।”
শায়লা চুপ করে শুনলো, রিদওয়ান এর কথা শেষ হতেই বললো-“একটা প্রশ্ন করবো?”
রিদওয়ানের ভ্রু কুঁচকে গেলো, তবুও জানতে চাইলো-“কি বলবে বলো।”
“যতদূর জানি হুট করে বিয়েটাতে রাজি ছিলেন না। তবুও কি করে আমার পরিবারের সবার জন্য দায়িত্ব পালন করছেন? এটা কি মন থেকে করেন? দায়িত্ব ভেবে করেন নাকি ভালোবেসে?”
একটা প্রশ্নের জায়গায় অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে করে শায়লা জড়সড় হলো। কিছুটা অসস্তি ফুটে উঠলো ওর চেহারায়। রিদওয়ানের চেহারায় গাম্ভর্যের আভাস-“সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় হয়নি শায়লা। কিন্তু উত্তর সময়ের সাথে সাথে পেয়ে যাবে তুমি। এখন কোন মিথ্যে স্তুতি গাইতে চাই না আমি। শুধু এটুকু বলবো, কাজগুলো করতে খারাপ লাগছে না। লাগলে আমি করতাম না।”
দু’জনের মাঝে নিরবতা নেমে এলো। অনেকটা সময় চুপচাপ বসে থাকার পর রিদওয়ান তাড়া ছিলো-“এখানেই বসে থাকবে নাকি অন্য কোথাও যাবে?”
শায়লা উঠে দাঁড়ালো -“চলুন যাই। আঙ্কেল আন্টির জন্য গিফট কিনবো। কি পছন্দ করে আপনার মা?”
রিদওয়ান বিরক্ত হলো-“গিফট কি মায়ের পছন্দে দেবে? তুমি নিজে কিছু পছন্দ করে কিনে দাও তাহলেই হবে।”
শায়লা ভাবনায় ডুবে যায়। কি দেবে, কি পেলে খুশি হবে মহিলা? টিউশন করিয়ে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছে শায়লা সেটা আজ খরচ করতে হবে। কি ভেবে আচমকা রিদওয়ানকে প্রশ্ন করলো-“আপনার জন্মদিন কবে?”
রিদওয়ান থতমত খেল-“কেন? হঠাৎ আমার জন্মদিন নিয়ে পড়লে কেন?”
“এমনিতেই। বলুন না কবে?”
“এ বছরেরটা চলে গেছে বহু আগে। আগামী বছর আবার।”
“আমাকে বললেন না কেন?”
রিদওয়ান ফিক করে হাসলো-“কিভাবে বলবো? তোমার সাথে তখন দেখা হতো নাতো।”
শায়লা চুপ করে গেলো। এসব দিবস টিবস পালনের অভ্যাস নেওর তাই মনে রাখারও প্রয়োজন মনে করেনি। কিন্তু এখন দেখছে মনে রাখতে হবে। বিশেষ দিনগুলো আনন্দে কাটলে খারাপ হয় না।

সন্ধ্যায় শায়লাকে হলের সামনে নামিয়ে দিতে এসে একটা প্যাকেট ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো রিদওয়ান। শায়লা হতবাক হয়ে বললো-“এটা কি?”
“তোমার জন্য গিফট।”
“কখন কিনলেন? আমি দেখতে পাইনি তো? তাছাড়া গিফট কিনলেন পয়সা পেলেন কোথায়?”
একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে রিদওয়ানের দিকে সন্দেহের নজরে তাকায় শায়লা। রিদওয়ান রাগলো না বরং শান্ত গলায় জবাব দিলো-“টিউশনি কি শুধু তুমি করতে পারবে? কোন রুল বুকসে এই কথাটা লেখা আছে?”
শায়লা থতমত খেলো-“না মানে এমন কিছু বলতে চাইনি আমি। আপনি তো কখনো বলেননি আপনি টিউশন করেন।”
“তোমাকে কখনো কিছু দেওয়া হয়নি তাই দিলাম। তোমার যখন মন চাইবে পরবে।”
“থ্যাংক ইউ।”
শায়লা ছোট্ট করে জবাব দিলো। হাজারো প্রশ্ন করলেও কেন যেন গিফট পেয়ে ভালো লাগছে তার। বাবা ছোট বেলায় এমন হুটহাট গিফট আনতো। এই এতোগুলা বছরে গিফট দেওয়া নেওয়া ভুলেই গেছে শায়লা৷ আজ রিদওয়ান নতুন করে পুরনো অনুভূতি জাগিয়ে তুললো যেন। ভীষণ ভালো লাগার মন আছন্ন হয়ে যায়। গুনগুন করতে করতে রুমে ঢুকলো শায়লা। কৌতুহলের অতিশায্যে প্যাকেট খুলে দেখলো একটা আকাশী জমিনে নীল পাড়ের মনিপুরি শাড়ী দিয়েছে রিদওয়ান। শাড়ীটা এপাশ ওপাশ করে কয়েকবার গায়ে ধরে শায়লা। মুগ্ধ নয়নে আয়নার ওপাশের মেয়েটাকে দেখে। চোখ বুজে কল্পনা করে শাড়ী পরা শায়লাকে। চেহারা জুড়ে খুশির দ্যুতি ছড়িয়ে যায়। হুট করে অস্থিরতা গ্রাস করে শায়লাকে। শাড়ী পরা নিজেকে রিদওয়ানের চোখে দেখায় তাড়া তার মধ্যে। অস্থির পায়চারি করে ঘরময়। বারে বারে ঘড়ি দেখে। পড়াশোনা শিকের উঠলো। সামনে বই থাকার পরও বারে বারে কেবল শাড়ীটার দিকে তাকাচ্ছে। প্রতিটা ক্ষনকে মনেহচ্ছে একযুগ। ওর রাত যেন ফুরাতে চায় না। শায়লা জীবনে এই প্রথমবারের মতো এক সন্ধ্যা নামার অপেক্ষায় ছটফট করতে লাগলো। একটি অস্তগামী সূর্যের অপেক্ষায় উদগ্রীব হলো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin