এরই মাঝে পর্ব-২৪

0
103

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২৪

আজ শায়লা তৈরি হয়ে রিদওয়ান এর জন্য অপেক্ষা করছিল। নিজেকে রিদওয়ান চোখে দেখার তাড়া ছিলো ভীষণ তাই সে ফোন দেওয়া মাত্রই শায়লা দৌড়ে নিচে নেমে এলো। শায়লাকে দেখে রিদওয়ান অনেকটা ধাক্কা মতো খেলো। খুব সাধারণ সাজ শায়লার। রিদওয়ানের কেনা শাড়ীটা শায়লার পরনে। ওর লম্বা চুলগুলো বেনী করে আঁটকে রাখা। চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক এর ছোঁয়া, এতেই শায়লাকে অনন্য লাগছে। সবচেয়ে বড় কথা আকাশী রঙের শাড়ীতে শায়লাকে অনেকটা রোদ ঝলমলে আকাশের মতো লাগছে। রিদওয়ান প্রথমবারের মতো নিজের মুগ্ধতা না লুকিয়ে শায়লার দিকে তাকিয়ে থাকলো নির্নিমেষ।

রিদওয়ানের মুগ্ধ দৃষ্টিতে লাজে সিক্ত হলো শায়লার তনুমন। সে খুব ধীর পায়ে হেঁটে এসে রিদওয়ানের সামনে দাঁড়াল। লালিমা ছড়ানো গাল নিয়ে অস্ফুটে বললো-“কি দেখছেন?”
“তোমাকে। ইউ লুক বিউটিফুল। সাজো না কেন মেয়ে?”
রিদওয়ান স্বাভাবিক কন্ঠেই উত্তর দিলো। ওর মধ্যে কোন জড়তা নেই, দ্বিধা নেই। মনের ভাব প্রকাশে স্পষ্ট ভাষী সে। তার কথা শুনে শায়লার লাজ গাঢ় হলো। সে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে উত্তর দিলো-“সাজতে ভালো লাগে না আমার। আমি পারিও না সাজতে। আজকে রুমমেট আপু সাজিয়ে দিলো।”
শায়লার সরলতায় আরেকদফা মুগ্ধ হলো রিদওয়ান। সে মুচকি হাসলো-“তা কার জন্য সাজলে? শাড়ীটা কার জন্য পরা হলো?”
শায়লার বলতে ইচ্ছে করলো, “আপনার জন্য পরেছি।” কিন্তু তা না বলে বললো-“ওমা, কার জন্য পরবো আবার? আপনি বলেছেন যখন ইচ্ছে হবে শাড়ি পরবে। আপনার বাবা মায়ের ম্যারিজডে, অনুষ্ঠানে যাব। শাড়ীটা পরতে ইচ্ছে হলো তাই পরেছি।”
উত্তর শুনে রিদওয়ানকে কিছুটা ম্লান দেখায়। সে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললো-“চলো যাওয়া যাক নয়তো দেরি হবে।”
শায়লা বিনাবাক্যে মেনে নিলো। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। অনেকটা সময় দুজনে চুপচাপ। শায়লা বারকয়েক আড়চোখে দেখেছে রিদওয়ানকে। অফহোয়াইট পান্জাবি পরা রিদওয়ানকে হ্যান্ডসাম লাগছে। হঠাৎ রিদওয়ানের নজর গেলো শায়লা বা হাতে। একটা সোনালী বেল্টের ঘড়ি বাঁহাতে। অনামিকায় চকচক করছে সাদা পাথর বসানো সোনার আংটিটি। রিদওয়ানের মুখের হাসিটা ফেরত এলো। সে উৎসাহি হয়ে প্রশ্ন করলো-“এটা কি বিয়ের আংটি?”
শায়লা চমকে উঠলো, নিজেকে সামলে নিয়ে ম্রিয়মান গলায় বললো-“হুমমম। আপনাদের বাসায় গেলে এটা পরি।”
“কেন? আমি তো শুনেছি বিয়ের আংটি খুলতে হয় না।”
“ওহহহ। আমার আসলে লজ্জা লাগে। অযথা প্রশ্ন এড়াতেই পরা হয় না।”
রিদওয়ান আর কিছু জানতে চায় না। পরের রাস্তাটুকু দু’জনাই চুপচাপ বসে রইলো দু’জন।

জাকিয়া আর ওয়াহেদের পয়ত্রিশতম বিবাহবার্ষিকীর আয়োজন জমকালো না হলেও কম নয়। তাদের তিনছেলের পরিবার, মেয়ে জামাই বাচ্চা কাচ্চাসহ জনা বিশেক লোক হবে। শায়লা সবাইকে সালাম দিলো, কুশল বিনিময় করলো। জাকিয়ার আর ওয়াহেদের জন্য কাপল ঘড়ি উপহার হিসেবে এনেছে শায়লা। ওয়াহেদ বেশ খুশি হলো শায়লার গিফট পেয়ে। যদিও বারবার বলছিল গিফটের কোন প্রয়োজন ছিল না। তবে শায়লার দেওয়া ঘড়িটা পড়ে নিলো সে। ঘড়ি হাতে দিয়েই কেক কাটলো। শায়লার খুব ভালো লাগলো ওয়াহেদের আচরণ। মানুষটা একদম শুরু থেকে ওর প্রতি আন্তরিক। ওয়াহেদের কাছ থেকে বাবাসূলভ আচরন পায়। এজন্য মনে মনে ভীষণ কৃতজ্ঞতা বোধ করে শায়লা।

এদিকে এতদিন পরে চাচীকে পেয়ে রোদেলা ভীষণ খুশি। ভাগ্যিস রোদেলার জন্য টেডি এনেছিল শায়লা। টেডি পেয়ে সে চাচীর দু’গালে চুমু দিলো। তা দেখে রিদওয়ান ভ্রুকুটি করে-“বাহ রে রোদু, আদর পাওয়া এতো সহজ জানতাম না?”
শায়লা চোখ পাকিয়ে জানতে চাইলো-“কি বলতে চাইছেন আপনি?”
শায়লার আক্রমনত্বক ভাব দেখে ভরকে গেলো রিদওয়ান-“কি বলবো? এমনিতেই বললাম আর কি। বাচ্চাদের মন কত পরিস্কার। সামান্য উপহার পেয়ে কতটা খুশি হয় ওরা। ভালোবাসা প্রকাশে একদমই দেরি করে না। আর বড়দের কথা কি বলবো?”
শায়লা ক্রদ্ধ নয়নে তাকালো রিদওয়ানের দিকে। রিদওয়ান ঢোক গিললো-“আরে বাবা, আমাকে এভাবে দেখছো কেন? কিছু বলেছি তোমাকে?”
“আপনার ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর ফর্মুলা খুব জানা আছে আমার।”
রিদওয়ান ফিক করে হাসলো-“বাহ, বুদ্ধি আছে দেখছি তোমার মাথায়। আমি তো ভেবেছি তোমার মাথায় ঘিলু বলতে কিছু নেই।”
শায়লা তেড়ে আসছিলো কিছু বলতে এমন সময় মুনিয়া এলো-“তোরা সেই তখন থেকে আলাদা হয়ে কি গুজগুজ করছিস? সবার মধ্যে থেকে আলাদা থাকাটা খারাপ দেখায় জানিস না?”
রিদওয়ান বিরক্ত হয়ে বোনকে দেখলো একনজর। শায়লা কাচুমাচু হলো। মুনিয়া শায়লার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচায়-“তুমি শুধু রোদেলার জন্য খেলনা এনেছ? আমার ছেলেদুটোর জন্য কিছু আনোনি?”
শায়লা কিছু বলার আগেই রিদওয়ান পাশ থেকে বললো-“সবার জন্য এনেছে আপা। এই যে তোর দুই ছেলের জন্য খেলনা। শায়লা নিজে কিনেছে।”
“যাক, তাও ভালো এনেছ। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ওদের ভুলেটুলে যাবে।”
কথাটা বলে মুনিয়া সামান্য হাসলো, যেন হাসি দিতে কষ্ট হচ্ছে। শায়লাও প্রতিউত্তরে হাসলো।
“তা গিফট কেনার টাকা পেলে কোথায়? রিদওয়ান দিলো?”
আচমকা এমন প্রশ্নে শায়লা চমকিত। সে রক্তশুন্য দৃষ্টিতে রিদওয়ানকে দেখলো। শায়লার এমন অবস্থা দেখে রিদওয়ান রেগে গেলো, বোনের উপর চেচিয়ে উঠলো-“এসব কি ধরনের কথা আপা?”
মুনিয়া হাসলো-“ওমা, কি ভুল বললাম? ও সবার জন্য উপহার কিনে এনেছে। ও ছাত্রী মানুষ, এতগুলো টাকা কোথা থেকে পেলো জানতে চাইবো না?”
“না চাইবি না। এটা অভদ্রতা।”
শায়লাকে কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না রিদওয়ান। মুনিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো-“বাহ, তোর কাছ থেকে এখন ভদ্রতা শিখতে হবে? দারুন বললি।”
রিদওয়ান ভীষণ রেগে বললো-“আপা, কাউকে অপমান করার শিক্ষা কোত্থেকে পেয়েছিস বলতো? আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোকে দেখে।”
মুনিয়া একরোখা স্বরে বলে উঠলো-“আমিও অবাক হচ্ছি তোকে দেখে। এই তুইনা বিয়েতে রাজি ছিলি না। ছয়মাস তো বউয়ের খবরও নিসনি। হুট করে এতো ভালোবাসা উথলে উঠছে কেন?”
“বউয়ের প্রতি ভালোবাসা উথলে উঠবে নাতো কি পর মেয়ের প্রতি ভালোবাসা উথলে উঠবে?”
রিদওয়ান চেচিয়ে উঠলো। শায়লার কাঁদো কাঁদো হাল দুই ভাই বোনের অবস্থা দেখো। ভীষণ অপমান লাগছে তার। কতটা শখ করে শাড়ী পরে অনুষ্ঠানে এসেছিল আজ অথচ কি হয়ে গেলো। সে কম্পিত কন্ঠে অনুরোধ করলো-“প্লিজ তোমরা থামো না। এরকম করছো কেন?”
মুনিয়া চেচিয়ে উঠলো-“তুমি চুপ করো। সব তোমার জন্য হয়েছে। গ্রামের মেয়ে মানেই পেচুক। দেখে তো মনেহয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানো না অথচ আমার ভাইয়ের মাথা খেয়ে বসে আছো।”
শায়লা অপমানে নীল হলো। এরকম আচমকা আক্রমনে দিশেহারা হয়ে সে কাঁপছে। মুখ দিয়ে একটা কথাও এলো না। ওদের চেচামেচিতে জাকিয়া আর ওয়াহেদ ছুটে এলো। জাকিয়া তিনজনের উপর তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে জানতে চাইলো-“কি হয়েছে মুনিয়া, রিদওয়ান চেঁচাচ্ছে কেন?”
মুনিয়া ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে-“সেটা তোমার গুনধর ছেলেকে জিজ্ঞেস করো। সে আমার সাথে কি পরিমান অভদ্রতা করলো আজ আমি ভাবতেও পারছি না।”
ওয়াহেদ রিদওয়ানের দিকে তাকালো-“কি হয়েছে রিদু? মুনিয়া কি করেছে?”
রাগে রিদওয়ানের মুখচোখ লাল। সে ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বললো-“সেটা তুমি তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো বাবা। আমার বোন যে মানুষকে সন্মান দিতে পারে না তা আজ জানলাম আমি।
এবং জেনে আমি ভীষণ কষ্ট পেলাম।”
ওয়াহেদকে হতবিহ্বল দেখায়। রিদওয়ান সর্বদা শান্ত শিষ্ট, কখনো রেগে যায় না। এর আগে একবার রিদওয়ান এর এমন রাগ দেখেছিল। নিশ্চয়ই মুনিয়া সাংঘাতিক কিছু করেছে। ওয়াহেদ বেশ কড়া গলায় মুনিয়াকে বললো-“তুই কিছু বলেছিস ওদের? কি বলেছিস? কেন রেগে গেলো ওরা?”
বাবার কন্ঠ শুনে ভয় পেলো মুনিয়া। বাবা সহজে রাগে না তবে রাগলে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। মুনিয়া ভয় পেয়ে গেলো। কি বলবে বাবাকে? পুরো ঘটনা শুনলে বাবা কি করবে তাকে? দোষ তো আসলে তারই। মুনিয়া আমতা আমতা করে শায়লার দিকে তাকালো। দু’জনার চোখাচোখি হলো। শায়লার মুখে ঘন মেঘের ছায়া। চোখ দুটো জলে টইটম্বুর হয়ে আছে। যখন তখন বৃষ্টি নামবে। নিজেকে সামলে নিতে সে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো। ঘরে উপস্থিত সকলেই হতবাক। রিদওয়ান রাগে চৈতন্য হারিয়ে বলে বসলো-“আজ যা করলি খুব খারাপ কাজ করলি আপা। আজ থেকে চিরদিনের জন্য তুই আমার নজরে ছোট হয়ে গেলি। আর তোর সাথে সম্পর্কটাও আর আগের মতো রইলো না। আজ থেকে আমি ভুলে যাব আমার কোন বোন আছে। ভালো থাকিস।”
বলে রিদওয়ান আর বসে থাকলো না। শায়লার মতোই ছুটে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকালো। শায়লা কোথায় গেলো? মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে। ভীষণ আত্মাভিমানী মেয়ে, স্ব অভিমানে আবার কোন দূর্ঘটনা না ঘটিয়ে ফেলে। ভাবনা মাথায় আসতেই ভয়ে বুক কাঁপে রিদওয়ানের। এমন কিছু হলে কি জবাব দেবে রুবিনাকে? চিন্তায় রিদওয়ান ঘামতে শুরু করে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin