এরই মাঝে পর্ব-২৭+২৮

0
219

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২৭

গাড়িতে উঠেও রিদওয়ান এর কোন বন্ধুকে না দেখতে পেয়ে শায়লা জানতে চাইলো-“কাউকেই তো দেখছি না। আপনার বন্ধুরা যাবে না?”
“যাবে তো। ওরা কাল আসবে, আমরা একদিন আগে যাচ্ছি।”
রিদওয়ান স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো। কিন্তু শায়লা প্রশ্নবিদ্ধ নজরে তাকালো-“আমরা আগে যাচ্ছি কেন? ওদের সাথে যাওয়ার কথা ছিলো না?”
রিদওয়ান তীব্র আশ্লেষে বলেই ফেললো-“ওরা যাক বা না যাক তোমার কি সমস্যা? তুমি ওদের সাথে যেতে চাও নাকি আমার সাথে?”
শায়লা থতমত খেয়ে বললো-“রাগ করছেন কেন? কি হয়েছে কি আপনার?”
সাথে সাথে রিদওয়ান শান্ত হয়ে গেলো। নমনীয় কন্ঠে বললো-“কিছু হয়নি। দয়া করে একটু চুপ থাকো। মাথা ধরেছে আমার।”
শায়লা কিছু বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। জানালা দিয়ে বাইরে অন্ধকারে তাকালো। গাড়ি ছুটছে তুমুল বেগে। শায়লার মনটা উদাস হলো। এই যে অনাহুতের মতো জীবনে এসে রিদওয়ান তার জীবনে জড়িয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটাই যেন কেমন। রিদওয়ান চায় ওর ভালো মন্দ সব বিষয় যেন তাকে জানায় শায়লা। হয়তো এটাই স্বাভাবিক বিষয় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। কিন্তু শায়লা কেন যেন পারে না? কেন সবসময় ভয় লেগে থাকে তার মনে? কেন বারবার মনেহয় সে রিদওয়ানের উপর নির্ভরশীল হলেই রিদওয়ান তাকে দূরে ঠেলে দেবে? তার বাবা আর মায়ের মধ্যেও তো কোন সমস্যা ছিল না। সুখী জীবন ছিলো মায়ের। বাবার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলো মা। হুট করে একদিন মানুষটা অন্যের হয়ে গেলো কেন তবে? চোখের সামনে মাকে কাঁদতে কাঁদতে পাথর বনে যেতে দেখেছে শায়লা। দাদু তার মাকে মেয়ে বানিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলো, মায়ের নামে সম্পদ লিখে দিল বলে ফুফুরা নাখোশ হলো। কত কথা শুনিয়েছে মা আর তাদের। ফুফুরা রাগ করে বাপের বাড়ী আসে না। মা থাকলে নাকি আসবেও না কোনদিন। মা নাকি তাদের হক নষ্ট করেছে। পুরনো দিনের কথা ভেবে শায়লার হৃদয় আর্দ্র হলো। চোখ দুটো ভিজে ওঠে অজান্তেই।

কিভাবে সেই দিনগুলো কেটেছে সেসব আর মনে করতে চায় না শায়লা। কেউ জানে না সেই বয়ঃসন্ধির সময়টাতে শায়লা একটু একটু করে ভেঙেছে। ভেঙে চুরমার হয়েছে। স্কুলে ঘরে বাইরে সব জায়গায় বাবার নতুন জীবন জানার জন্য মানুষের রসালো আলাপ, মাকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা সব মিলিয়ে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল শায়লা। বন্ধুবিহীন জীবনে পড়ালেখাকে আপন করে নিয়েছিল। মানুষের প্রশ্ন থেকে বাঁচতে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে লাগলো।
কোন আনন্দ ছিলো না তাদের জীবনে। ছিলো কেবল গঞ্জনা আর গুঞ্জন। সেসব মনে করে শায়লা কেঁপে উঠে। চোখ বুজতেই ওর দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো।

রিদওয়ানও চোখ বুজে ছিলো। মন ভীষণ খারাপ তার। আজ ডিউটিতে থাকাকালীন এক রোগী এলো। রোগীর অবস্থা ভীষণ সিরিয়াস ছিলো। রিদওয়ান ডিউটি ডাক্তার হিসেবে তাড়াহুড়ো করে ট্রিটমেন্ট দেওয়ার পরও রোগী বাঁচলো না। রোগীর স্বজনরা ভীষণ হৈচৈ করছে, গালাগাল দিচ্ছে। রিদওয়ান তখন ডিউটিতে বলে সব ঝড় রিদওয়ানের উপর দিয়ে গেলো। স্যারেরাও অকারণে ঝাড়লো রিদওয়ানকে। এরমধ্যে শায়লার ইউনিতে গন্ডগোলের কথা শুনেছে। শায়লার ফোনের অপেক্ষায় থেকেছে। কিন্তু শায়লা ফোন করলো না সারাদিন। ভীষণ রাগ হচ্ছিল রিদওয়ানের। এতোকিছু করার পরেও মেয়েটা তাকে ভরসা করে না বিশ্বাস করে না। নিজেকে কেন যেন ব্যর্থ লাগছিল। পৌরুষে আঘাত লাগে তার। সে কি কারো বিশ্বাসের যোগ্য না? কেন কেউ তাকে পছন্দ করে না? শায়লার উপর রাগ বাড়ছিল ক্রমশ। এর মধ্যে শায়লার এতো প্রশ্ন শুনে রিদওয়ান মেজাজ ধরে রাখতে পারে না। এখন চোখ বুজে থাকার পর মনেহচ্ছে শায়লা কি কষ্ট পেলো ওর আচরণে? হুট করেই চোখ খুলে শায়লার দিকে তাকালো রিদওয়ান। মেয়েটা জানালা দিয়ে অন্ধকারে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে থাকা দোকানের আলো এসে ওর মুখে পড়ছে। রিদওয়ান আবিস্কার করলো শায়লার দু’চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। শরীর কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। রিদওয়ানের বুক কেঁপে উঠলো। সে ব্যস্ত হয়ে শায়লার দিকে ঝুঁকে গেলো-“এই মেয়ে, কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? আমি বকেছি বলে মন খারাপ হয়েছে? আমি সরি, ভীষণ সরি। প্লিজ কেঁদো না। মাফ করে দাও আমাকে।”
শায়লা হতচকিত হলো। রিদওয়ান একের পর এক বলেই যাচ্ছে। শায়লা দ্রুত হাতে চোখ মুছলো, নাক টেনে স্বাভাবিক গলায় বললো-“আমি ঠিক আছি। আপনি ব্যস্ত হবেন না।”
রিদওয়ান ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইলো-“কাঁদছো কেন তবে?”
শায়লা মৃদুস্বরে জবাব দিলো-“এমনি।”
রিদওয়ান কোমল কন্ঠে বললো-“আমি বকেছি বলে মন খারাপ?”
শায়লা জবাব দিলো না। রিদওয়ান আচমকা শায়লার ডান হাতটা নিজের মুঠোয় পুরো নিলো-“আজ আমারও খুব মন খারাপ জানো। কিন্তু আমি ছেলে বলে কাঁদতে পারছি না।”
শায়লা চমকে তাকালো, রিদওয়ান চোখ বুঝে সিটে মাথা রেখেছে।
“আপনার কেন মন খারাপ? কি হয়েছে?”
রিদওয়ান চোখ খুললো। নিস্প্রভ দৃষ্টি মেলে কৌতুকের স্বরে বললো-“তাও ভালো নিজ থেকে জানতে চাইলে। আমি তো ভেবেছি তুমি কখনো আমার খবর নেবে না।”
শায়লার দৃষ্টি নত হলো, ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কিছুটা রুক্ষ স্বরে বললো-“হেয়ালি না করে বলুন কি হয়েছে। মন কেন খারাপ আপনার?”
রিদওয়ান আঙুল দিয়ে চুলগুলো ব্রাশ করলো, মৃদুস্বরে ফিসফিস করলো-“হয়েছে তো অনেককিছুই। তবে সবচেয়ে বেশি মনখারাপ হয়েছে তোমার জন্য। সারাদিন তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম অথচ তুমি ফোন করোনি। নিজেকে অযোগ্য ভেবে মনটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।”
শায়লা অসস্তিতে মাথা নত করলো, শোনা যায় না এমন গলায় বললো-“সরি। আমি আসলে আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।”
“তুমি কি জানো তুমি ফোন করলে আমি বিরক্ত না হয়ে খুশি হবো? প্রিয়জন ফোন করলে কেউ বিরক্ত হয়?”
রিদওয়ানের এমন কথায় শায়লা চমকে উঠলো। ওর গাল দু’টো ঈষৎ লাল হলো। লজ্জা থেকে বাঁচতে তাড়াহুড়ো করে বাইরে নজর দিলো। রিদওয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে চাইছে শায়লার নিরবতার আসল কারণ। ওর লাজুক মুখভঙ্গি দেখে খানিকটা আন্দাজ করে মন খারাপ দূর হয়ে গেলো। চটুল গলায় বললো-“তুমি কি লজ্জা পাচ্ছ শায়লা? একটু তাকাও তো এদিকে, দেখি লজ্জা পেলে কেমন লাগে তোমায়?”
শায়লা তার ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরলো, মুখ ফিরালো না ভুলেও। রিদওয়ান ওর ভাব দেখে হাসলো মনে মনে। মুঠোর মাঝে থাকা শায়লার হাতটা খানিকটা উঁচু করে আচমকা ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। হুট করে এমন কাজে শায়লা বোকা বনে গেলো। শরীরে অচেনা শিহরণ টের পেলো। সে বিস্মিত হয়ে রিদওয়ানের দিকে তাকালো। ভাঙা গলায় বলেই ফেললো-“এটা কি হলো?”
রিদওয়ান মোহময় একটা হাসি ঝুলিয়ে ফিসফিস করলো-“বউকে সামান্য ভালোবাসা দেখালাম৷ সেই সাথে তার লাজরাঙা মুখখানাও দেখে নিলাম।”
শায়লা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। হাতটা মোচরাতে মোচরাতে বললো-“আপনি খুব খারাপ কাজ করলেন। আর করবেন না এসব। আমি পছন্দ করি না।”
রিদওয়ান হাসলো, শায়লার দিকে খানিকটা চেপে এসে ওর হাতটা আরও শক্ত করে মুঠোয় পুরলো। নিচু গলায় জানতে চাইলো-“আর কি কি পছন্দ করো না বলবে?”
শায়লা চোখ পাকিয়ে তাকায়-“কি হচ্ছে কি? বাসে জার্নি করছি আমরা, এটা ভুলে গেছেন? সরে বসুন।”
“ভুলিনি বলেই তো চুপচাপ বসে আছি নয়তো অন্য কিছু হতো।”
রিদওয়ানের বেফাঁস কথায় শায়লা হাসফাস করে উঠলো। চোখ দুটো বড় বড় করে প্রশ্ন করলো-“কি হতো? হয়েছে কি আজ আপনার? এরকম ওলট পালট বকছেন কেন?”
“বকতে ভালো লাগছে তাই বকছি। আচ্ছা ঠিক আছে যাও আর কথা বলবো না। আমার কথা যেহেতু তোমার ভালো লাগছে না সেহেতু এই মুখে তালা দিলাম।”
রিদওয়ান শায়লার হাত ছেড়ে দিয়ে গাল ফুলিয়ে চোখ বুঝলো। শায়লা বারবার তাকিয়ে দেখছে। রিদওয়ান সত্যিই কি রাগ করলো? শায়লা উসখুস করে৷ কিছুক্ষণ পরে ডাকলো-“শুনছেন, আপনি কি সত্যিই রাগ করলেন?”
রিদওয়ান চুপ করে রইলো যেন শুনতে পায়নি। শায়লা বাধ্য হয়ে রিদওয়ানের বুকের উপর ঝুকলো-“এই শুনছেন, রাগ কেন করছেন? কথা বলেন না।”
রিদওয়ান শায়লাকে বুকে জড়িয়ে নিলো হুট করে-“এখনটায় থাকো চুপটি করে তাহলে রাগ করবো না।”
শায়লা কথা বলতে যাচ্ছিল রিদওয়ান ওর ঠোঁটের উপর হাত রেখে মৃদুস্বরে বললো-“শশশশ, কথা বলো না। ঘুম পাচ্ছে আমার একটু ঘুমাতে দাও।”
শায়লা চুপ করে গেলো। ভীষণ অসস্তি নিয়ে রিদওয়ানের বুকে পড়ে রইলো সে। কান পেতে শুনলো রিদওয়ানের হার্টবিট। শায়লা টের পেলো রিদওয়ানের সংস্পর্শে তার শরীরের রক্ত সঞ্চালন বাড়ছে। মন চঞ্চল করা শীতল এক অনুভূতি শরীরে শিহরণ বয়ে দিচ্ছে বারংবার। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, শায়লার ভালো লাগছে এই ব্যাখ্যাহীন অনুভব।

চলবে—

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২৮

কুয়াকাটা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল দশটা বেজে গেলো। হোটেলে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ওরা বেড়িয়ে এলো। উদ্দেশ্য সাগরের পাড়ে আসা। দূর থেকে সমুদ্র দেখে শায়লা অবাক। যতই সমুদ্রের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে ততই বিস্ময় বাড়ছ তার। অনেকটা পথ হেঁটে এসে তীব্র রোদের আলোয় ক্লান্ত হয়ে রিদওয়ান একটা ছাউনির নিচে বসলো। এখান থেকে কয়েক কদম দূরে সাগর। বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। শায়লার অপার বিস্ময় নিয়ে সাগর দেখতে দেখতে বললো-“জানেন আমি কখনো সমুদ্র দেখিনি?”
কথাটা শুনে রিদওয়ান পাশে বসে থাকা শায়লাকে দেখে হাসলো-“তাহলে তো তোমাকে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। কক্সবাজারের সৈকতের কাছে এই সৈকত কিছুই না।”
শায়লা হতবাক রিদওয়ানকে দেখলো-“সত্যি? অবশ্য বইয়ে তথ্যটা পড়েছি অনেকবার কিন্তু নিজ চোখে দেখা আর বইতে পড়া অনেক পার্থক্য আছে। মানে অনুভূতি ব্যাখ্যা করার মতো না। সামনে বিশাল জলরাশি আর তার গর্জন। আর এই বিশালতার মাঝে ক্ষুদ্র আমি বসে আছি। অন্যরকম অনুভূতি।”
রিদওয়ান মুগ্ধ হয়ে তাকালো শায়লার মুখপানে। বাচ্চা মেয়ের মতো আনন্দ শায়লার মুখ জুড়ে। এই মেয়েটাকে খুশী দেখলে মনও উচ্ছ্বসিত হয়ে যায়। এখনও হচ্ছে, শায়লা যত আনন্দিত হচ্ছে রিদওয়ানের মন তত প্রশান্ত হচ্ছে। সে হুট করে উঠে দাঁড়ালো। শায়লার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো-“পা ভেজাবে চলো।”
শায়লা আতঙ্কিত হয়ে বললো-“আমার ভয় লাগে যে? যদি ভেসে যাই?”
রিদওয়ান হেসে দিলো-“ভয়ের কি আছে? আমি আছি না? আমি থাকতে চিন্তা কিসের?”
কথাটা শোনামাত্র রিদওয়ানের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরলো শায়লা। দু’জন হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলো। সমুদ্রের ঢেউ এসে শায়লার পায়ে আছড়ে পড়তেই শায়লা ভয় পেয়ে রিদওয়ানের শক্তপোক্ত বাহু আঁকড়ে ধরলো। রিদওয়ানও তাকে দু’হাতে আঁগলে নিয়েছে। লজ্জা পেয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো শায়লা। আবার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ার আগেই সে রিদওয়ানকে ধরলো। রিদওয়ান মুচকি হেঁসে ওর কানে ফিসফিস করলো-“সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তার কল্যানে তোমার ছোঁয়া পেলাম।”
শায়লা লাজেরাঙা হলো, দৃষ্টি সমুদ্রের জলে নিবন্ধিত। আর রিদওয়ানের দৃষ্টি নিবন্ধিত তার ব্যক্তিগত মানুষের পানে। ক্ষনে ক্ষনে শায়লার নানারুপ তাকে বিমোহিত করে দিচ্ছে। কিন্তু
রিদওয়ান নিজের মুগ্ধতা আড়াল করতে চায়। কারণ শায়লাকে নিজের অনুভূতির চাপে ফেলতে রাজি নয় রিদওয়ান। সে চায় সে যেমন একটু একটু করে শায়লাকে অনুভব করেছে ঠিক তেমনি শায়লাও তাকে করুক। তাকে বুঝে এই সম্পর্কটাকে পরিনতি দিক। তার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি আছে সে যদিও আজকাল অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে প্রায়ই। শায়লাকে কাছে পেতে উদগ্রীব হয়ে উঠছে মন। রিদওয়ান শায়লার উপর থেকে নজর সরিয়ে নিলো। অনেকটা সময় পার হওয়ার পর শায়লাকে ডাকলো রিদওয়ান-“চলো হোটেলে ফিরে যাই। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে একটা ঘুম দেই। শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।”
শায়লা মাথা দুলিয়ে সায় দিলো-“হ্যা চলুন। আমারও খারাপ লাগছে।”

ওদের ঘুম ভাঙলো তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। খিদেয় পেট চো চো করছে দু’জনারই। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো ওরা। ওদের হোটেলটা ফাইভ স্টার মানের হলেও কক্সবাজারের মতো শানশৌকত নেই। এখানে এখনো এর চাইতে ভালো হোটেল গড়ে ওঠেনি। খাবারের ব্যবস্থা পাঁচ তলায়। ওখান থেকে চমৎকার ভাবে সাগর দৃশ্যমান। ওরা কোনার দিকে টেবিলে বসলো। রাতের সাগর দেখতে দেখতে পেট পুরে খেলো। চা পান করতে করতে রিদওয়ান জানতে চাইলো-“এখন আবার যেতে চাও সাগরে?”
“শায়লা উৎসাহিত হয়ে বলে ফেললো-” চলুন হেঁটে আসি। বসে থেকে কি করবো?”
রিদওয়ান মানা করলো না। এবার অবশ্য বেশি হাঁটতে হলো না। জোয়ার আসার কারনে পানি চলে এসেছে অনেক কাছে। কিছুক্ষণ বসে থেকে রিদওয়ান বললো-“আমার কিছু কাজ আছে শায়লা। তোমার আপত্তি না থাকলে তোমাকে হোটেল রুমে রেখে আমি বেরুব একটু।”
“আপনার বন্ধুরা আসবে? ওদের রিসিভ করতে যাবেন?”
“আরে না। ওরা রওনা দিয়েছে, কাল সকালে পৌঁছাবে।”
“তাহলে?”
রিদওয়ান উসখুস করছে-“এমনিতেই একটা কাজ পড়ে গেছে। এখন মনে পড়লো।”
শায়লা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলো, তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো-“চলুন যাই। বাসায় মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। কাল থেকে ফোন দেওয়া হয়নি মাকে। টেনশন করবে।”
রিদওয়ান কিছু বললো না। শায়লাকে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে ও নিজের কাজে চলে গেল। শায়লা মাকে ফোন দিলো-“হ্যা মা, কেমন আছো?”
“এতোক্ষণে তোর আমাকে মনে পড়লো? ঘুরতে গিয়েই মাকে ভুলে গেলি শায়লা?”
শায়লা এবার হতবাক-“তুমি জানো আমি বেড়াতে এসেছি?”
রুবিনা হাসলো-“জানবোনা কেন? রিদওয়ান তো আমার থেকে অনুমতি নিলো।”
“কি বলো মা? কিসের অনুমতি?” শায়লা যেন আকাশ থেকে পড়লো।
“এই যে তোকে নিয়ে এতোদূর গেলো সেইটার অনুমতি। আমি তো বলেদিছি, তোমার বউ তুমি যেখানে খুশি নাও এতো বলার কি আছে। বলে কি জানিস, কি বলেন মা? মেয়ে আপনার আমি কেন আপনাকে না জানিয়ে ওকে যেখানে খুশি নিব? আর যেখানে খুশি নেওয়ার অনুমতি আপনি দেবেন কেন? যদি আমিও অনুমতি চাই তবুও দেবেন না। যাই বলিস শায়লা রিদওয়ানের মতো ছেলে হয় না। কাউকে সন্মান কিভাবে দিতে হয় তা রিদওয়ানকে দেখে শেখা উচিত।”
মায়ের মুখে রিদওয়ানের এতো প্রশংসা শুনে শায়লার মধ্যে মিশ্র অনুভূতি হলো। সে পাল্টা জবাব না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলো-“মা, এখন ফোন রাখছি। পরে কথা বলবো।”
রুবিনা কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু শায়লা ফোন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। রিদওয়ান কি সত্যিই এতোটা ভালো নাকি সবার কাছে ভালো থাকার অভিনয় করছে? রিদওয়ান কেনই বা এতো ভাবে তাকে নিয়ে? তাকে কি ভালোবাসে রিদওয়ান? কিন্তু এই ক’দিন আগেও তো ওকে সহ্য করতে পারতোনা। এতো দ্রুত কি কারো প্রতি ভালোবাসা জাগে? ভাবনার অতলে হারিয়ে যায় শায়লা। কতোক্ষণ এভাবে বসে ছিলো জানেনা। কলিংবেলের আওয়াজে ধ্যানভঙ্গ হলো ওর। দরজা খুলে রিদওয়ানকে দেখলো। দু’হাত ভরে জিনিস এনেছে।
“এতো কি এনেছেন?”
রিদওয়ান জিনিসগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখলো। ঘুরে জবাব দিলো-“রাতে গল্প করতে করতে খিদে পেলে কি খাব? তাই কিছু খাবার নিয়ে এলাম। কথা হলো মায়ের সাথে?”
“হুমম।”
শায়লা এসে বসলো। রিদওয়ান ওর লাগেজ খুলে বসলো-“শায়লা একটু এদিকে আসবে?”
“জ্বি, বলুন।”
“বসো এখানে।”
বিছানায় নিজের পাশে বসার নির্দেশ দিলো। একটা প্যাকেট বের করে ওর হাতে দিলো-“এগুলো তোমার। তুমি কি একটু কষ্ট করে এগুলো পরে আসবে? প্লিজ মানা করো না।”
“কি এগুলো?” শায়লা জানতে চাইলো।
“খুলে দেখো কি।”
রিদওয়ান চুপ করে গেলো। শায়লা প্যাকেট খুলে দেখলো একটা শাড়ী। একটা সবুজ রঙের বেনারসি শাড়ি। হুট করে পিছনের দিনে ফিরে গেলো শায়লা। সেদিন অনিচ্ছায় গায়ে চাপানো শাড়ীটাই আজ চোখের সামনে দেখছে। যতই অনিচ্ছায় পরুক চিনতে ভুল হলো না। সে বিস্মিত হয়ে রিদওয়ানের দিকে তাকালো। রিদওয়ান মাথা চুলকে বললো-“মহুকে বলেছিলাম ও কুরিয়ার করে দিয়েছে। প্রথমবার বেড়াতে এলাম তোমার সাথে। ভাবলাম বিয়ের পরে বউরুপে তোমাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি রাগ করে চলে এসেছিলাম বলে। মাঝে মাঝে আফসোস জাগে জানো। তোমাকে বউ সাজে দেখার আফসোস। যদি আপত্তি না থাকে তাহলে শাড়ীটা পরে আসবে? তোমাকে বউ সাজে দেখবো।”
শায়লা অবাক, কেমন যেন স্থবির হয়ে গেছে। রিদওয়ান আসলে কি করতে চাইছে? অন্য কোন প্ল্যান নেই তো? ভাবনা মাথায় আসতেই পালাতে মন চাইছে শায়লার। যদি সত্যিই তেমন কিছু হয় তাহলে কি করবে শায়লা? রিদওয়ানকে মানা করবে? ফিরিয়ে দেবে? কিন্তু তার কনসেন ছাড়া রিদওয়ান এতো বড় স্টেপ নেবে এটা বিশ্বাস হয় না শায়লার। দ্বিধায় দোদুল্যমান শায়লার মন। তার পা চলছে না যেন। কি একটা পরিস্থিতি এলো সামনে। শায়লা ছটফটিয়ে উঠলো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin