এলো প্রেমের মৌসুম পর্ব-০১

0
6

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#সূচনা_পর্ব

‘ আমার বসের ছেলেকে তোর বিয়ে করতে হবে মেঘনা, নাহলে আমার এতো কষ্টে করা এই বাড়ি হাতছাড়া হয়ে যাবে ‘

একটু আগে ভার্সিটি থেকে ফিরেছে মেঘনা, সেমিস্টারের ফি লাগবে সেই কথাটা বাবাকে বলতে এসেছিলো। উল্টে বাবার কাছে এমন কথা শুনে চমকে উঠলো মেঘনা!

‘ এসব কি বলছো আব্বু? তোমার বসের ছেলেকে আমি কেনো বিয়ে করবো? আর তার সঙ্গে এই বাসার সম্পর্ক কি?’

‘ দেখ মেঘনা, তুই তো জানিস আমি কয়েকমাস আগে বড় অঙ্কের একটা লোন এনেছিলাম আমার বসের কাছ থেকে। ওই টাকাটা একটা জায়গায় ইনভেস্ট করে দিয়েছিলাম কিন্তু, সেখানে বড়সড় লস হয়ে গেছে। এতগুলো টাকা এখন আমার পক্ষে ফেরত দেওয়া সম্ভব না। এই বাসাটা আমাদের মাথা গোঁজার একমাত্র জায়গা সেটাও তুই জানিস। এটাও আমার বসের কাছেই মর্গেজ রেখেছিলাম ‘

মেঘনা লক্ষ্য করলো ওর বাবা ভীষণ চিন্তিত, কথাগুলো বলতে গিয়েও যেনো জড়িয়ে যাচ্ছে। কয়েকমাস আগে একটি প্রজেক্টে সোলো ইনভেস্ট করার জন্যে দু কোটি টাকার মতো লোন এনেছিলেন মেঘনার বাবা, কিন্তু প্রজেক্টটা বাজেভাবে লস করে। এখন সব খোয়ানোর অবস্থা হয়ে গেছে! মেঘনা ওর বাবার পাশে বসলো…

‘ আব্বু, তুমি একটু শান্ত হও আগে। আজ না হয় কাল আমরা টাকাটা ফেরত তো দিতে পারবো তাইনা?’

‘ এতগুলো টাকা কোত্থেকে জোগাড় হবে? তাছাড়া এতো টাকা জোগাড় করা এখন অসম্ভব!’

স্বামীকে এতো উত্তেজিত হতে দেখে মেঘনার মা বললেন…

‘ তুমি একটু শান্ত হও, এরকম করলে তো তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। তারপর আরেক ঝামেলা হবে ‘

‘ কিভাবে শান্ত হবো আমি? ভেবেছিলাম ওই প্রজেক্টের লাভটা দিয়ে আস্তে আস্তে লোন মিটিয়ে ফেলবো কিন্তু এখানে আরেক ঝামেলা হয়ে গেলো ‘

‘ আব্বু, তুমি এত বছর ধরে ওনার আন্ডারে কাজ করছো, উনি কি তোমাকে কিছু সুযোগ দেবেন না? দরকার পড়লে আমি না হয় ওনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা…’

‘ এতগুলো টাকার ব্যাপার এটা মেঘনা, আর টাকার ক্ষেত্রে কেউই কাউকে ছাড় দেয় না ‘

‘ কিন্তু আব্বু, পরিস্থিতি খারাপ বলে আমি ওনার ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না। ওনার ছেলে আর যাই হোক হাসবেন্ড হওয়ার উপযুক্ত না ‘

‘ আমিও সেটাই বলছি, উপায় একটা না হয় বের করা যাবে তাই বলে মেয়েটাকে এভাবে ভাসিয়ে দেবো নাকি আমরা? মেঘনার মুখে শোনোনি ও কেমন ছেলে? দুজনে তো একইসঙ্গে পড়াশুনা করছে’

স্ত্রীর কথা শুনে কিছুটা বিরক্ত হলেন মেঘনার বাবা জামাল সাহেব…

‘ একটা ছেলের সবদিক কখনো ভালো হয় না সায়রা, বড়লোক বাড়ির ছেলেরা অমন একটু বিগড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছুনা। বিয়ে হলে ও ঠিক হয়ে যাবে’

‘ কি বলছো তুমি এসব, মাথাটা খারাপ হয়ে গেলো নাকি তোমার? ছেলের টাকা আছে বলে লোভে পড়ে বিয়ে দেবো?’

‘ সায়রা, বাড়াবাড়ি করো না। ও বিয়েতে রাজি না হলে আমাদের ঘরছাড়া হতে হবে, বহু কষ্টে করা এই বাড়ি আমাদের সেটা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে?’

‘ হ্যা, কিন্তু…’

‘ কোনো কিন্তু নেই এখানে আর, আমার বস নিজেই এই প্রস্তাব দিয়েছেন যে আমার মেয়ে যদি ওনার ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয় তাহলে উনি আমার এই লোনের টাকা আর নেবেন না। এখন সিদ্ধান্ত মেঘনাকে নিতে হবে ‘

‘ আব্বু, তুমি এই মুহূর্তে চিন্তিত আছো। একটু ঠাণ্ডা হও, আমরা সবাই মিলে বসে আরেকটু ভেবে দেখি তারপর না হয়…’

‘ এখন আর ভাবার সময় নেই মেঘনা। তাছাড়া তোর এই বিয়েতে শুধু আমার লাভ হবে সেটা কিন্তু নয়। তুই ভেবে দেখ ওরকম একটা বাড়িতে বউ হিসেবে যাওয়া কতো মেয়ের স্বপ্ন থাকে, সেই সুযোগ নিজে এসে তোর হাতে ধরা দিয়েছে। আমরা তোর জন্যে ছেলে খুঁজলেও বা, এমন বড়লোক ঘরের ছেলে পেতাম না!’

জামাল সাহেব যেনো নাছোড়বান্দা সেজে বসলেন, মেয়েকে রাজি করিয়েই ছাড়বেন। কিন্তু মেঘনা যে বিয়ে করতে চায়না, সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো ও…

‘ টাকার লোভ আমার নেই আব্বু, আর ওকে বিয়ে করার ইচ্ছাও আমার নেই। বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার, আমি এভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না। তুমি প্লিজ অন্তত এই বিষয়ে আমাকে জোর করো না’

মেঘনা ওখান থেকে চলে আসতে যাচ্ছিলো, তখনই জামাল সাহেব বলে উঠলেন…

‘ বিশ বছর ধরে তোর সব প্রয়োজন মিটিয়ে আমরা তোকে মানুষ করেছি মেঘনা, আর আজ আমাদের বিপদের দিনে তুই এভাবে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবি অকৃতজ্ঞের মতো?’

‘ এই! এসব কথা তুলছো কেনো এখন তুমি!’

‘ কেনো বলবো না? আমরা ওকে এতো বছর লালন পালন করেছি, বিনিময়ে ও কি এইটুকু আমাদের জন্যে করতে পারবে না? তাছাড়া এতে তো ওর ভালোই হবে, ক্ষতি তো আর হচ্ছে না। ছোটবোনের ভবিষ্যতের কথাও একটু মাথায় রাখা কি ওর উচিত নয়? মাইশারও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। ও এই বিয়েতে রাজি না হলে আমাদের হাত থেকে সব চলে যাবে তারপর? ওদের দুজনকে কিভাবে বিয়ে দেবো? ‘

বাবার কথা শুনে থেমে গেছিলো মেঘনা, এতো বছর ভুলে থাকলেও আজকে আবারো মনে করিয়ে দেওয়া হলো যে ও এই বাড়ির পালক মেয়ে। অন্য কেউ বললেও হয়তো ওর এতো কষ্ট লাগতো না কিন্তু যে মানুষটাকে আব্বু বলে ডাকে সেই যে এভাবে কথাটা মনে করিয়ে দেবে ভাবেনি মেঘনা। ওই মুহূর্তে মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিলো না ওর, মেঘনা আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। দৌড়ে চলে গেলো নিজের ঘরে, কষ্টে বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে ওর। সায়রা বেগমও মেয়ের পিছু পিছু ছুটলেন, জামাল সাহেব যে মেঘনাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্যে হুট করে এমনকিছু বলে বসবেন সেটা উনিও কল্পনা করেননি!
_________________________________________

বন্ধুদের সঙ্গে পিজ্জা খেতে গিয়েছিলো আরিশ, খাওয়া শেষে বিল দিতে গিয়ে জানা গেলো ওর ক্রেডিট কার্ড ফ্রিজড হয়ে গেছে। আরিশ ভালোভাবেই জানে এই কাজ কে করেছে, বাড়ি ফিরেই ও সোজা বাবার ঘরে আসে…

‘ আমার ক্রেডিট কার্ড তুমি ফ্রিজড করে দিয়েছো?’

ছেলের কথা তেমন পাত্তা না দিয়ে কিছু কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আলফাজ সাহেব…

‘ হ্যা, আমিই করেছি’

‘ কেনো?’

‘ কারণটা তুই ভালোভাবেই জানিস ‘

কিছুদিন ধরেই ওর বাবা ওকে বিয়ের জন্যে জোর করছে, আরিশ অবশ্য তখন ওসব কথায় পাত্তা দেয়নি কারণ বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ওর নেই! আর ছাত্রজীবনেই সংসার নামক ঝামেলায় জড়াতে চায়না আরিশ…

‘ ভালো ছেলের মতো বিয়েটা করে নে, সব আবার আগের মত হয়ে যাবে। বিয়ে করলে তুই যা চাইবি আমি তাই দেবো, আগের থেকে বেশি দেবো ‘

‘ আই এম নট অ্যা কিড ওকে? আমাকে এসব লোভ দেখিয়ে লাভ নেই ‘

‘ লোভ দেখাচ্ছি না, তোর ভালোর জন্যে বলছি। এইযে আয়েশ করে টাকা উড়িয়ে বেড়াচ্ছিস এগুলো কিছুই পাবি না। একটা কানাকড়ি পাবি না যদি বিয়েটা না করিস ‘

‘ বাবা প্লিজ! আমি কোনো বিয়ে টিয়ে করতে পারবো না, জীবন আমার এমনিতেই অনেক শান্তিতে কাটছে। এর মধ্যে আমি আর অশান্তি টেনে আনতে চাইনা ‘

‘ তোকে কে বললো বিয়ে করলে অশান্তি হবে? তোর মা আর আমার মধ্যে কখনো অশান্তি দেখেছিস?’

‘ আমাকে তুমি যতোই বোঝাও, আমি বিয়ে করবো না। আগেও অনেকবার বলেছি আবারো বলছি। তুমি আমাকে জোর করো না ‘

‘ ফাইন, ক্রেডিট কার্ডও ফেরত পাবি না তাহলে ‘

‘ আমি আম্মুর থেকে টাকা নেবো তাহলে ‘

‘ তোর কি মনে হয় আমি অ্যালাও না করলে তোর মা তোকে টাকা দিতে পারবে?’

বাবার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বাকবিতণ্ডা চললো কিন্তু ফলাফল শূন্য, আলফাজ সাহেব নিজের জেদ বজায় রেখেছেন। এমন ব্যবস্থা করেছেন যে আরিশ কোনো অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা নিতে বা তুলতে পারবে না। বিরক্ত লাগছে আরিশের, বাবা কি শুরু করলো এসব? আরিশ ও মেঘনা দুজনেই কাকতালীয়ভাবে একই ইউনিভার্সিটিতে একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। মায়ের অতি আদরে বিগড়ে গেলেও পড়াশুনায় আরিশ ভীষন সিরিয়াস, ডিপার্টমেন্টের টপার সে। প্রোফেসর এবং ক্লাসমেট উভয়ের কাছেই আরিশের বেশ ডিমান্ড, এদিকে মেঘনা ছাত্রী হিসেবে মোটামুটি। প্রচুর চেষ্টা করে কিন্তু সে অনুযায়ী সফলতা পায়না, তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছে। আরিশের পড়াশুনার বিষয়ে অভিযোগ না থাকলেও ছেলের এমন উশৃঙ্খল জীবনযাপন অপছন্দ আলফাজ সাহেবের, এমন নয় যে ছোট থেকে শাসন করেনি। আসলে ওনার অতি শাসন এবং মায়ের অতি আদর উভয় মিলেই আরিশকে আরো বিগড়ে দিয়েছে। এই ছেলেকে কিভাবে শৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করা শেখানো যায় সেই ভাবনা ভাবতে ভাবতে একসময় আলফাজ সাহেব ঠিক করলেন ছেলের বিয়ে দেবেন। কিন্তু মেয়ে কোথায় পাওয়া যাবে? আর আরিশও সহজে রাজি হবেনা। এরই মাঝে মেঘনার বাবার এই লোনের বিষয়টার জন্যে আলফাজ সাহেব যেনো হাতের মুঠোয় সুযোগ পেয়ে বসলেন। আরিশের বাবার কোম্পানির পুরোনো কর্মকর্তা মেঘনার বাবা, জামাল সাহেব পুরোনো বিশ্বস্ত লোক হওয়ায় এতগুলো টাকা লোন দিতে দ্বিধা করেননি আলফাজ সাহেব। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন তৈরি হয়েছে যে জামাল সাহেব এই টাকা আর ফেরত দিতে পারবে না বুঝে আলফাজ সাহেব প্রস্তাব রাখেন যে মেঘনার সঙ্গে আরিশের বিয়ে হলে এই লোনের টাকা উনি আর ফেরত নেবেন না। এমতবস্থায় জামাল সাহেব নিজের লাভ এবং মেঘনার ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রস্তাবে রাজি হন এবং এই মুহূর্তে মেঘনাকে একপ্রকার বাধ্য করছেন বিয়েটা করার জন্যে কিন্তু মেঘনা যে কিছুতেই মনকে মানাতে পারছে না। তার ওপর আজ জামাল সাহেবের বলা কথা শুনে ভীষন কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা, রাতেও না খেয়েই শুয়েছিল তখন সায়রা বেগম মেয়ের জন্যে খাবার এনে নিজের হাতে খাইয়ে দেন। খাওয়ায় এক পর্যায়ে মেঘনা প্রশ্ন করলো…

‘ আচ্ছা আম্মু, টাকাগুলো কোনোভাবে ফেরত দেওয়ার কি কোনো উপায় নেই?’

‘ এতগুলো টাকা কিভাবে একসঙ্গে ফেরত দেবো বল? তোর বাবা তো অ্যাকাউন্টে যা ছিলো তাও ওই লোনের টাকার সঙ্গে যোগ করে নিয়ে গেছিলো। আমার সঙ্গে একবার কথা অব্দি বলেনি এতবড় একটা কাজ করার আগে, তারপর এই অঘটন ঘটে গেলো ‘

‘ বিয়ে করবো না বলেছি বলে আব্বু আমার ওপর রেগে আছে তাইনা?’

‘ তোর আব্বুর কথায় কিছু মনে করিস না মা, চিন্তায় আছেন তো। কি থেকে কি বলে ফেলেছে ভেবে দেখেনি। আমি রাতে কথা বলবো তোর আব্বুর সঙ্গে ‘

‘ কিন্তু আব্বু তো ঠিকই বলেছে, সত্যিটা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। আমার জন্যে তোমরা এতকিছু করেছো আর বিনিময়ে আমি কি করেছি? কিচ্ছু না!’

কথাগুলো বলতে গিয়ে মেঘনার চোখদুটো পানিতে টইটম্বুর হয়ে উঠলো, মুখে থাকা ভাতগুলো যেনো আর গলা দিয়ে নামছে না। মেয়েকে দেখে সায়রা বেগমেরও ভীষন কষ্ট হলো, পেটে না ধরলেও এতগুলো বছর নিজের মেয়ে হিসেবেই তো বড় করেছে। তাই স্বভাবতই মেয়ের চোখে পানি দেখে মায়ের মন উতলা হয়ে উঠলো…

‘ মেঘনা তুই এসব নিয়ে ভাবিস না, আমি..’

‘ আম্মু, তোমরা আর আমাকে নিয়ে ভেবো না। আর আব্বুকে বলে দিও যে আমাকে একটু সময় দেওয়ার জন্যে, আমার এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে সময় প্রয়োজন ‘

‘ তুই কি বিয়েটা করতে চাইছিস?’

মায়ের প্রশ্ন শুনে মিনিট দুয়েক চুপ রইলো মেঘনা, নীরবে কিছু একটা ভেবে বললো…

‘ আমি এই বিয়েটা করলে যদি তোমাদের সমস্যা দূর হয় তবে, করবো!’

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন!! ]