#ওগো_বিদেশিনী
#পর্ব_২২
#সারিকা_হোসাইন
______
প্রখর রোদের তেজে ঘরের ভেতর টেকাও দায় হয়ে পড়েছে।
উত্তপ্ত রোদের তেজের কাছে হার মেনে সমীরণ ধরণী থেকে বিদায় নিয়েছে বহু আগেই।
কোনো পাখপাখালীর দেখা পাওয়া তো দূর তাদের ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না।
থেকে থেকে অদূরে দুই একটা কাক কর্কশ স্বরে কা কা করে যাচ্ছে।
শরীর বেয়ে লবণাক্ত স্রোত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে সকলের।
ভীত সন্ত্রস্ত সুজানা ড্রয়িং রুমের এসির পাওয়ার কমিয়ে উনিশ করে এক কোনে গিয়ে দাঁড়ালো।
মাহতাব চৌধুরীর বিশাল বড় ড্রয়িং রুমে বাড়ির সকল সদস্য দাঁড়িয়ে আছে।
শুধু মাহতাব চৌধুরীর বাড়ির মানুষ ই নয় নাবিল হাসানের বাড়ির মানুষও এখানে উপস্থিত রয়েছেন।
দুতলায় উঠার প্রথম সিঁড়ির ধাপের উপর হাঁটুর উপর দুই হাত ঝুলিয়ে মেঝের দিকে শান্ত দৃষ্টি পেতে নীরব হয়ে বসে আছে মাহাদ।
পাশে তার ময়না পাখি সমেত খাঁচা রাখা।
পিন পতন নীরবতায় ছেয়ে আছে পুরো ড্রয়িং রুম।
বাড়ির সকল সদস্যকে মাহাদ কেনো এই সময়ে এভাবে ডেকেছে এটা কারোর ই বোধগম্য হচ্ছে না।
মাথা নিচু করে মাহাদ ভেবে চলেছে সকালের কথা।
*******
“টুটুল আমাকে আমার বউয়ের কাছে নিয়ে চলো।
“স্যার আপনার শরীরের কন্ডিশন ভালো না আপনি,,,,,
টুটুলকে কথা শেষ করতে না দিয়েই গর্জে উঠে মাহাদ।
“হাউ ডেয়ার ইউ টুটুল?
“আমার মুখে মুখে কথা বলার সাহস কে দিয়েছে তোমাকে?
“কোনো কথা শোনার অবস্থায় আমি নেই।
“জাস্ট ফলো মাই ওর্ডার।
অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে টুটুল বলে উঠে
“সরি স্যার।না বুঝে লিমিট ক্রস করে ফেলেছি।
লিফট ধরে টুটুল আর মাহাদ কার পার্কিং এরিয়াতে চলে আসে।
গাড়িতে উঠেই টুটুল কে তাড়া দেয় দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিতে।
হসপিটাল থেকে রিজভীর বাসার দূরত্ব মিনিট বিশেকের রাস্তা।
রিজভীদের বাড়িতে যখন মাহাদ গিয়ে পৌঁছায় তখন সকাল ন’টা বেজে পাঁচ মিনিট।
লাগাতার কলিং বেল টিপার শব্দে বিরক্ত হয়ে নাজনীন সুলতানা দরজা খুলে মাহাদকে দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যান সাথে চিন্তিত হয়ে পড়েন।
উদ্বিগ্ন হয়ে নাজনীন সুলতানা বলে উঠেন―
“মাহাদ রে তুই এই অবস্থায় কেনো এসেছিস এখানে?
“তোর ক্ষত গুলো এখনো কাঁচা।তুই হসপিটাল থেকে কিভাবে রিলিজ পেলি?
নাজনীন সুলতানার কথার উত্তর না দিয়েই মাহাদ ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে ক্যামেলিয়া বলে ডেকে উঠে।
বার দুয়েক ডেকেও যখন ক্যামেলিয়ার সারা না পায় তখন মাহাদ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে
“খালামণি আমার বউ কোথায়?
এদিকে মাহাদের ডাকাডাকি তে বাড়ির সকল সদস্য যার যার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছে।
মাহাদের এমন ব্যান্ডেজ করা উদাম শরীর দেখে ভীত হয়ে পড়েন নাবিল হাসান আর রিজভী।
সকলেই মাহাদকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করলেও মাহাদ সেসব শোনার পাত্র নয়।
রিজভী সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নীচে নেমে এসে বলে উঠে
“ভাই প্লিজ শান্ত হও।ক্যামেলিয়া টুসীর রুমে ঘুমুচ্ছে।
“কতো ঘুমাচ্ছে ও?আমার ডাক শুনেও কেনো আসছে না?
বলেই সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে টুসীর রুমে চলে গেলো মাহাদ।
বাড়ির প্রত্যেক সদস্য মাহাদের এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো।
ক্যামেলিয়া যদি মাহাদকে দেখে আমার উত্তেজিত হয়ে যায় তাহলে কি উপায় হবে?
টুসীর রুমে এসে মাহাদ ঘুমন্ত ক্যামেলিয়া কে দেখে থমকে দাঁড়ায়।
মলিনতায় ঢেকে গিয়েছে পুরো মুখশ্রী।মনে হচ্ছে কতো জনমের কাহিল।
শরীর শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।
ক্যামেলিয়ার এহেন করুন অবস্থা সহ্য করতে পারলো না মাহাদ।
দৌড়ে ক্যামেলিয়ার কাছে গিয়ে ঘুমন্ত ক্যামেলিয়া কে জড়িয়ে ধরে চোখে মুখে চুলে কানে অজস্র চুমু খেলো।
মাহাদ তার বুকের সাথে ক্যামেলিয়ার মাথা চেপে ধরে প্রাণ ভরে নিঃশাস নিলো।
ঘুমের মধ্যেই ক্যামেলিয়া মৃদু ককিয়ে উঠতেই মাহাদ আলতো হাতে বালিশে শুইয়ে দিলো।
হঠাৎই মাহাদের নজর যায় ক্যামেলিয়ার হাতে।
ভ্রু কুঁচকে মাহাদ হাত ভালো করে ধরে দেখতেই টুপ করে দুফোটা অশ্রু বিন্দু খসে পড়ে মাহাদের চোখ থেকে।
দুটো হাত পুড়ে গিয়েছে এরকম মনে হচ্ছে।বড় বড় ফোস্কা গলে দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
অনুসন্ধিৎসু হয়ে মাহাদ দৃষ্টি গত শরীরে নজর বুলাতেই গলার কাছেও এরকম দগদগে ক্ষতের দেখা মিললো।
বসা থেকে চট করে উঠে গেলো মাহাদ।
ধীরপায়ে দরজার কাছে এসে দরজা বন্ধ করে আবার ক্যামেলিয়ার বেডের কাছে এসে দাঁড়ালো।
কাপা কাঁপা হাতে ক্যামেলিয়ার শার্টের বাটন খুলে গলা পিঠ আলগা করতেই বাকশূন্য হয়ে গেলো মাহাদ।
পুরো গলা ঘাড় বীভৎস এক ভয়ানক অবস্থা ধারণ করেছে।
যেই ধবধবে সাদা মসৃণ ত্বক গুলো মাহাদ উষ্ণ পরশে ভরিয়ে দিতো বারংবার সেগুলো এখন দগদগে ক্ষততে পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
এই ক্ষত গুলো ক্যামেলিয়া কে কতোটা যন্ত্রনা দিচ্ছে ভেবেই মাহাদের বুক ফেটে কান্না এলো।
তবুও নিজেকে সামলে ক্যামেলিয়ার কাপড় ঠিক করে বাইরে বেরিয়ে এলো মাহাদ।
এলোমেলো পায়ে নাজনীন সুলতানার কাছে গিয়ে কান্না ভেজা ভাঙা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো
“খালামণি ওর শরীরে এতো ঘা কিসের?”
নাজনীন সুলতানা আমতা আমতা করে কি বলবেন কিছুই গুছিয়ে উঠতে পারলেন না।
রিজভী এগিয়ে এসে শান্ত কন্ঠে বললো
“এগুলো গতকাল আমরা দেখতে পেয়েছি ভাই,এ কদিন ওর কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেয়নি।শরীরে বড় বড় ফোস্কা ছিলো সেগুলো গলে এরকম হয়েছে।কিন্তু এগুলো কিভাবে হয়েছে আমরা কেউ জানিনা।
“তোরা কেউ এগুলোর জন্য ওকে ডক্টর এর কাছে কেনো নিসনি?
“ভাই ও কাউকেই ওকে ধরতে দেয়নি।আর তাছাড়া ও পাগলের মতো বিহেভ করছিলো।সাইকিয়াট্রিস্ট এসে ইনজেকশন দেবার পর একটু ঘুমিয়েছে।এর পর থেকে তো আমরা তোমাকে নিয়েই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি।
ঘটনা কি হয়েছে কিছুই মাহাদের বোধগম্য হচ্ছে না।একটু চিন্তা করার জন্য মাথা ঘাটাতেই টনটনে ব্যাথায় মস্তিষ্ক চনমনে হয়ে উঠলো।
নিজের রাগ কোনোমতে কন্ট্রোল করে দাঁতে দাঁত পিষে মাহাদ বলে উঠলো
“যেখানে ঘটনার শুরু হয়েছে সেখানেই শেষ করবো”
“ক্যামেলিয়া কে আমি নিয়ে যাচ্ছি ,তোমরা সবাই আমাদের বাড়িতে এসো”
বলেই সিঁড়ি বেয়ে দুতলায় উঠে ক্যামেলিয়া কে কাঁধে তুলে নীচে নেমে এলো।
ওজন বহনের কারনে মাহাদের বুকের ক্ষ/ত থেকে তাজা র/ক্ত বেরিয়ে ব্যান্ডেজ লাল হয়ে গেলো।
তবুও মাহাদ আমলে না নিয়ে ক্যামেলিয়া কে কাঁধে তুলে ছুটে চললো নিজের বাড়ির দিকে।
পেছনে ফেলে গেলো অবাক ভীত মুখমন্ডল।
বর্তমান
________
এসির ঠান্ডা বাতাসের শিহরনে কাঁপুনি ধরে যাবার উপক্রম হচ্ছে।
র/ক্তা/ক্ত এলোমেলো ব্যান্ডেজ নিয়েই মাহাদ বসে আছে।
মাহাদের তুলতুলে নরম বিছানায় ঘুমকুমারীর ন্যায় গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে ক্যামেলিয়া।
হঠাৎই খাঁচার ময়না পাখি ডানা ঝাপটে অস্থিরতা শুরু করলো।
মেঝে থেকে দৃষ্টি তুলে ভ্রু কুঁচকে পাখির দিকে তাকালো মাহাদ।
সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে পাখি চিল্লিয়ে উঠলো
“ফুপু,ফুপু,ফুপু”
কিছুক্ষন মৌন থেকে রক্তবর্ণ চক্ষু নিয়ে শাহানা বেগমের দিকে দৃষ্টি পাতলো মাহাদ।
এরপর হো হো করে হেসে পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে ফেললো।
সেই হাসিতে কেঁপে উঠলো বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য।
কাঁপুনি ধরানো ঠান্ডা বাতাসেও শাহানার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে।মাথা বেয়ে চিবুক পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ল সেই ঘাম।
এরপর ধীর কন্ঠে বলে উঠলো মাহাদ―
“বলো ফুপু কবে গিয়েছিলে আমার ঘরে?
মাহাদের এমন প্রশ্নে মাহতাব চৌধুরী আর মিতালি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে
শাহানার দিকে তাকালো।
ভীত শাহানা মুখের ঠাট বজায় রেখে প্রথমে আমতা আমতা করলেও নিমিষের ব্যাবধানে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলো
“ক ক কিসের তোর রুমে গিয়েছি?
“পাখি আবোল তাবোল কথা বললো আর তুই মেনে নিলি?
মাহাদ গর্জে উঠা কন্ঠে বলে উঠলো
“এই পাখি দুটো নামই শিখেছিলো এই পাঁচ বছরে।
একটা আমার বউয়ের নাম আরেকটা আমার নাম।
বউয়ের নাম শেখাতে আমার দুই বছর চার মাস বাইশ দিন সময় লেগেছিলো।
পাখিকে কেনো ক্যামেলিয়া নাম শিখিয়ে ছিলাম জানো?
“আমার কানের শান্তির জন্য,মনের শান্তির জন্য।
পাখি ক্যামেলিয়া বলতো আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে চোখ বুঝে ক্যামেলিয়া কে অনুভব করতাম।
মনে হতো ক্যামেলিয়া আমার ঘরে আছে,আমার বুকে আছে।
আর আমার নাম শিখিয়ে ছিলাম যাতে আমার বউ আমার অবর্তমানে পাখির সাথে আমাকে নিয়ে কথা বলতে পারে।
তোমার মেয়ের আর তোমার শয়তানির নমুনা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম কোনো মতলব নিয়েই এখানে এসেছো।
আমার বউকে যখন তোমার মেয়ে একের পর কষ্ট দিচ্ছিলো সব আমার কাছে পূর্ণিমার চাঁদের মতো ফকফকা হয়ে গেছিলো।
এতো অপমানের পর ও যখন এ বাড়ি ছাড়লে না তখন আরো বুঝেছি যে,
“আমি চলে গেলেই তুমি তোমার কুৎসিত হাত আমার বউয়ের দিকে বাড়াবে।
এজন্য পাখিকে আমি তোমার নাম শেখানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিন্তু ঘটে গেলো এক চমৎকার ঘটনা।
একবার ফুপু বলতেই পাখি নতুন বুলি শেখা বাচ্চার ন্যায় ফুপু ফুপু করে আমার কান ভারী করে ফেললো।
“একদম কষ্ট বিহীন শিখিয়ে ফেললাম তোমার নাম।”
আমি জানতাম আমার বাড়ির মানুষ সর্বক্ষণ আমার বউকে গার্ড দিয়ে রাখতে পারবে না।
“কারন চোর পাহারা দিয়ে রাখা যায়না।
এজন্য গার্ড হিসেবে পাখিকেই ব্যাবহার করেছি আমি।
আর আমার বউকে বলেছিলাম যে কদিন আমি বাড়ি না ফিরবো ঘর থেকে বাইরে না বের হতে।
“কিন্তু সে তো সরল,তোমার মতো কুটিলের তোপে টিকতে পারলো না।
হাঁটুতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে খাঁচা হাতে নিয়ে শাহানা বেগমের দিকে এগিয়ে এলো মাহাদ।
ভয়ে শাহানা দুকদম পিছিয়ে যেতেই স্মিত হেসে মাহাদ বলে উঠলো
“বলো শাহানা ফুপু কি করেছো আমার বউকে”?
শাহানা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলার আগেই কোহিনুর ডেকে উঠলো
“ভাইজান?”
মাহাদ অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে কোহিনুর এর দিকে তাকাতেই কোহিনুর তার হাতে থাকা ক্যামেলিয়ার জামার টুকরো মাহাদের হাতে দিয়ে বলে উঠলো
“এই টুকরা ডা আমি রান্না ঘরের কেবিনেট এর হুকে পাইছি ভাইজান।
মাহাদ ভ্রু কুঁচকে অবাকের সহিত জামার টুকরো নিয়ে জহুরী নজরে পরখ করতে লাগলো।
এরপর কোহিনুর আবার বলে উঠলো
“আরেকটা জিনিস ভাইজান।
বলেই একটা ট্রে তে করে বিছিয়ে রাখা নষ্ট পোড়া পাবদা মাছের ছবি মাহাদকে বের করে দেখালো।
মাহাদ তেজী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো
“মাছ গুলো কোথায়?
“ভাইজান মাছ পইচ্ছা গন্ধ ছড়াইছে,আমি ছবি তুলে ফালায় দিছি।
হঠাৎই কুহু চিল্লিয়ে ঝাঁজ দেখিয়ে বলে উঠে
“এসব জামার টুকরা,পোড়া মাছ এগুলোর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
একটা পাগল মেয়ে নিয়ে এতো বিচার শালিস সন্দেহের কি আছে আমি কিছুই বুঝিনা।
চলো মা এখানে দাঁড়িয়ে অপমানিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই।
মুহূর্তেই মাহাদের পায়ের রক্ত মাথায় ছলকে উঠে।
নিজের ক্রোধ কন্ট্রোল করতে না পেরে কুহুর গলা চে/পে ধরে গর্জে উঠলো–
“কাকে পাগল বললি তুই?
“যখন এতো অপমান করে বেরিয়ে যেতে বললাম তখন গেলিনা এখন কি চাইলেই যেতে দেবো?
“তোর মা কি করেছে আমার বউয়ের সাথে সেটা না শুনেই যেতে পারবি?
মাহাদের বৃহৎ হাতের থাবায় কুহুর দম যায় যায় অবস্থা।
চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ছে সমানে।
গলায় চেপে ধরার কারনে কাশি এসে স্বাস রোধ হয়ে যাচ্ছে।
শাহানা বেগম মেয়ের এমন অবস্থা দেখে ভয়ে কেঁদে ওঠে সকলের সাহায্য চাইছে।
কিন্তু মাহাদের হাত থেকে কেউ কুহুকে ছাড়াতে পারছে না।
গগন বিদারী চিৎকার করে শাহানা বলে উঠলো
“আমার মাইয়ার কোনো দোষ নাই সব দোষ আমার।আমি ডর দেহাইয়া এবাড়ি ছাড়া করবার চাইছি বৈদেশীরে।
আমার মাইয়া মইরা যাইবো, ছাইড়া দে মাহাদ”
শাহানার এমন কথায় চমকে উঠলো সবাই।
“আমার বউ কি এমন ভয় পেয়েছিলল তোমাকে দেখে ফুপু?
বলেই অসহায় নজরে মাহাদ শাহানার দিকে তাকালো।
শাহানা মাথা নত করে কেঁদে কেঁদে বলে উঠলো
“অনেক ডরাইছিলো,আমি বুঝবার পারি নাই সামান্য গরম তেল দেইখা বৈদেশী এমন ডরাইবো”
মিসেস মিতালি আর নাজনীন ঘৃণা পূর্ন দৃষ্টি দিয়ে শাহানাকে সমস্বরে বলে উঠলো
“আপনি কি কোনো মানুষের কাতারে পড়েন?
মাহতাব চৌধুরী রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পুলিশে ফোন দিয়ে বসলেন।
শাহানা কুহুকে ছাড়ানোর জন্য কেঁদেই চলছে।
কুহু নিজেকে বাঁচানোর জন্য মাহাদের বুকের ক্ষততে খামচে ধরেছে।
তবুও মাহাদের কোনো অনুভূতি নেই।
দাঁতে দাঁত পিষে মাহাদ আবার বলে উঠে
“কি শত্রুতা আমার বউয়ের সাথে তোমার আর তোমার মেয়ের?
“কুহু তোরে ভালোবাসে মাহাদ,আমার মাইয়া তোরে অনেক চায়।হেই জন্য বৈদেশীরে সহ্য করতে পারি নাই।মাফ কইরা দে।
মইরা যাইবো আমার মাইয়াডা।
রাগে মাহাদ কুহুকে এক প্রকার আছাড় মেরেই ফেলে দেয়।
মেঝেতে পড়ে উপুড় হয়ে কাশতে থাকে কুহু।
নিজেকে ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো মনে হলো তার।
এই বুঝি প্রাণপাখি উড়ে যায়!
নিজেকে স্বাভাবিক করার আগেই মাহাদ হাটু গেড়ে কুহুর সামনে বসে জিজ্ঞেস করলো
“কবে থেকে ভালোবাসিস তুই আমাকে?
গলার ব্যাথায় কুহু উত্তর দিতে পরলো না।
কিন্তু মাহাদ আবার গর্জে উঠতেই কুহু খুব কষ্টে বলে উঠলো
“চা চা চার বছর ধরে”
“আর আমি আমার বউকে আঠারো বছর ধরে ভালোবাসি।একদম ওর জন্মের দিন থেকে।
“কি করে তোরা ভাবলি ওকে সরালেই তোকে মেনে নেবো?
শাহানা আর কুহুর এমন নোংরা পরিকল্পনায় বাক শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সকলে।
ঘেন্নায় থুথু ছিটাতে চাইলো সুজানা আর টুসি।
রিজভী ধমকে বলে উঠলো
“আমার বোনের যদি কিছু হয় সারা জীবন জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়বো বলে দিলাম।
হঠাৎই মাহাদের চোখ যায় দূতলার করিডোরে।
করিডোরের পিলারের সাথে ঠেস দিয়ে ভয়ার্ত চোখে মাহাদের দিকে তাকিয়ে আছে ক্যামেলিয়া।
মাহাদ সব কিছু ফেলে দৌড়ে ক্যামেলিয়ার কাছে আসতেই
ক্যামেলিয়া কান্না জড়িত নিচু কন্ঠে বলে উঠলো
“আপনি কে?
“আপনি এই বাড়িতে কি করছেন?
“আপনি মানুষ খু/ন করেন?
#চলবে
#ওগো_বিদেশিনী
#পর্ব_২৩
#সারিকা_হোসাইন
***********
ঝড়ের পরে যেমন সবকিছু থমথমে হয়ে যায় কিন্তু ঝড়ের তান্ডব এর চিহ্ন রয়ে যায় ঠিক তেমনি অবস্থা হয়েছে মাহতাব চৌধুরীর ড্রয়িং রুমে।
ক্যামেলিয়ার মুখে এমন আতঙ্কপূর্ণ কথা শুনে সবাই কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।
মাহাদ শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে অশ্রুভেজা চোখে ফ্যালফ্যাল করে ক্যামেলিয়ার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
মিসেস মিতালি নাজনীন সুলতানার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঝে ধীর স্বরে বিলাপ করে কাঁদছে।
সুজানা কোনোভাবেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না।
মাহতাব চৌধুরী ছেলের কষ্টপূর্ন ভবিষৎ চিন্তা করে বুকের ব্যাথায় সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন।
কতক্ষন এভাবে কেটে গেলো কেউ ঠাহর করতে পারলো না।
হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে সকলের ধ্যান ভাঙলো যেনো।
রিজভী তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে কয়েকজন পুলিশ ঢুকে পড়লো।
সুদর্শন ,লম্বা চওড়া বডির নব্য পুলিশ অফিসার মাহতাব চৌধুরীর কাছে এগিয়ে এসে বলো উঠলো
“হ্যালো স্যার আম অনিম চৌধুরী অফিসার ইনচার্জ অব এয়ারপোর্ট পুলিশ স্টেশন”
গমগমে ভরাট স্বর অনুসরণ করে পুলিশ অফিসারের দিকে দৃষ্টি দিলো সকলে।
পুলিশ দেখেই ক্যামেলিয়া দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে মাহাদের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে উঠলো
“অফিসার হি ইজ এ কিলার।প্লিজ এরেস্ট হিম”
অনিম ক্যামেলিয়ার দেখানো মানুষটির দিকে দৃষ্টি দিতেই বিস্ফারিত চোখে বলে উঠলো
“মাহাদ”!
নিজের প্রাণ প্রিয় বউ তাকে চিনতে পারছে না,এমনকি পুলিশ কে নির্দেশ দিচ্ছে তাকে এরেস্ট করতে।
এমন করুন দৃশ্যে মাহাদের পুরো পৃথিবী দোলে উঠলো।
মাথায় তার প্রচন্ড ব্যাথা অনুভূত হলো।
বুকের ক্ষত থেকে এখনো চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝড়ছে।
এদিকে মাহতাব চৌধুরী নিজেকে কোনো মতে ধাতস্থ করে ধীর গতিতে উঠে দাঁড়ালেন।
বুকে হাত রেখেই ঘটনা সব খুলে বললেন অনিম কে।
এরপর শাহানার দিকে আঙ্গুল তুলে আহত কন্ঠে বলে উঠলেন―
“অফিসার প্লিজ এরেস্ট হার।”
“সে আমার বোন কিন্তু সে আমার ছেলের বউকে আঘাত করেছে,মেন্টালি সিক করে ফেলেছে।
“শুধু তাই নয় আমার ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছে।
“এই কুৎসিত মনের মানুষটিকে আমার সামনে থেকে দ্রুত সরানোর ব্যাবস্থা করুন অফিসার।
“প্লিজ”!
বলেই টিস্যু দিয়ে চোখের জল মুছলেন মাহতাব চৌধুরী।
যেই বোনের ছায়াতলে মা বাবা হীন মানুষ হয়েছেন সেই বোনকে এভাবে নিজে পুলিশের হাতে সোপর্দ করবেন এমন নিষ্ঠুর ভাবনা স্বপ্নেও চিন্তা করেন নি মাহতাব চৌধুরী।
পুলিশ দেখে কুহু আর শাহানা ঘাবড়ে গেলো।
দুজন লেডি কনস্টেবল কে অনিম ওর্ডার করলো
“এরেস্ট হার”
শাহানা ক্যামেলিয়া সহ মাহতাব চৌধুরীর পুরো পরিবার কে নানান অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে ক্ষান্ত হলো।
কিন্তু কুহু দমে যাবার পাত্রী নয়।সে মাহাদ আর ক্যামেলিয়াকে যা তা বলে গালি দিয়ে কন্ট্রোল লেস হয়ে গেলো।
শুধু তাই নয় রাগের বসে খপ করে অনিমের কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল কেড়ে নিয়ে ক্যামেলিয়ার দিকে তাক করলো।
ক্যামেলিয়া কুহুর এমন হিংস্র রূপে ভয়ে পলক ফেলতে ভুলে গেলো।
মিতালি আর নাজনীন চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
সুজানা আর টুসি ভয়ে নিজেদের মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠলো।
মাহতাব চৌধুরীর বুকের ব্যাথা আরো বেড়ে গেলো।
এদিকে মাহাদ দৌড়ে এসে ক্যামেলিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে তেজী কন্ঠে বলে উঠলো
“আমাকে তো অর্ধেক মে/রে/ই ফেলেছিস এবার পুরোপুরি মেরে ফেলা”
“ক্যামেলিয়া যখন আমাকে চিনতে পারেনি তখনই আমার হৃদয়ের মৃত্যু হয়েছে।দেহের মৃত্যু বাকি রয়েছে।
“গুলি চালিয়ে আমার দেহটাকে এবার তুই মে/রে ফেল কুহু।
কুহুর এমন আকস্মিক আক্রমণে দ্রুততার সহিত কনস্টেবল গুলো তাদের হাতের বড় বন্দুক কুহুকে তাক করলে অনিম হাতের ইশারায় বন্দুক নীচে নামাতে ওর্ডার দিলো।
এই দৃশ্য দেখে প্রত্যেকে আরো ঘাবড়ে গেলো।
মুহূর্তেই পরিস্থিতি দাবার চালের মতো পাল্টে গেলো।
অনিমের মুখভাবের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো না।
মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে অনিম কুহুকে উদ্দেশ্য করে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো
“পিস্তল টা ভালো করে ধরে তারপর পয়েন্ট করুন।নাহলে গুলি আপনার বুকে গিয়েই লাগবে”
এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে অনিমের এহেন তামাশা কারোর ই পছন্দ হলো না।
নিমিষেই টুসি গলার সমস্ত তেজ ঢেলে বলে উঠলো
“আসামি ধরতে এসেছেন নাকি মশকরা করে আমাদের মারতে এসেছেন অফিসার?
রিনরিনে তেজী কন্ঠস্বর অনুসরণ করে অনিম পিছনে ফিরে তাকালো।
শীর্ন দেহের ছোট মানবীকে দেখে মুহূর্তেই হার্টবিট মিস করলো অনিম।
আরে এতো চমবলের ফুলনদেবী !
টুসীর কুচকুচে কালো বড় মনির গহ্বরে হারিয়ে গেলো অনিম।
কন্ঠ রোধ হয়ে সকল ভাষা ভুলে গেলো অনিম।
এখনই মেয়েটাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে না করলে অনিমের বুকের যেই উত্তাল ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে তা থামবে না।
টুসীর দ্বিতীয় দফার ঝটকা খেয়ে ধ্যান ফিরলো অনিমের।
নিজেকে ধাতস্থ করে কুহুর কাছে এগিয়ে এলো অনিম।
এরপর ভ্রু বাকিয়ে মুখে প্রশস্ত হাসি ঝুলিয়ে রসিকতা করে বলে উঠলো
“মাহাদ কে গুলি করে দিন মিস।
অনিমের এমন কথায় মাহাদ মুখ তুলে অনিমের দিকে তাকিয়ে আহত দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো।
মুখে কিছুই প্রকাশ করল না।
এই মুহূর্তে অনিমকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না মাহাদের।
বেঁচে থাকলে অবশ্যই সে ঠিক অনিম কে দেখে নিবে।
কুহু ট্রিগার চাপতেই অনিম হো হো করে হেসে উঠলো
তা দেখে কুহুর কপাল কুঁচকে এলো।
এরপর অনিম পকেট হাতড়ে কিছু বের করে আনলো।
একটা একটা করে গুলি গুনে গুনে কুহুকে দেখিয়ে ফিচেল হেসে আবার গুলি গুলোকে পকেটে পুরলো অনিম।
এরপর কুহুকে উদ্দেশ্য করে অনিম বলে উঠলো
“আসামিদের সাথে রসিকতা করতে খুব ভালো লাগে আমার।”
“আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে আমার'”
“জেলে পুড়ে স্পেশাল খাতির করবো যা জীবনেও ভুলবেন না।”
মাহাদ বা ক্যামেলিয়ার কারো কোনো ক্ষতি করতে না পেরে উপরন্তু নিজেই আসামি হয়ে ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে রইলো কুহু।
মুহূর্তেই অনিমের হাসিখুশি মুখটা রাগে লাল হয়ে গেলো।
রক্তবর্ন চক্ষু নিয়ে অনিম লেডি কনস্টেবল কে ওর্ডার দিলো
“এরেস্ট দেম”
“বোথ আর ডেঞ্জারাস”
মা মেয়ে দুজনকেই হ্যান্ডকাফ পরিয়ে টেনে হিচড়ে বের করে নিয়ে গেলো কনস্টেবল।
অনিম যাবার আগে মাহতাব চৌধুরীকে কেসের প্রসেস বুঝিয়ে দিলো এরপর মাহাদের কাছে এসে বলে উঠলো
“জানি তোকে শান্তনা দেবার পারফেক্ট সময় এখন নয়,তবুও বলছি নিজেকে সামলা।
মাহাদ অনিমের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে ক্যামেলিয়ার পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
অনিম ধীর কন্ঠে ক্যামেলিয়ার উদ্দেশ্যে মিষ্টি করে হেসে বলে উঠলো
“ভাবি হি ইজ ইউর হাজব্যান্ড নট এ মার্ডারার”
“হি লাভস ইউ লাইক ক্রেজি।”
অনিমের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো ক্যামেলিয়া।
অনিম যাবার আগে টুসীর দিকে তাকিয়ে সকলের অগোচরে চোখ টিপে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো।
এদিকে টুসি একজন পুলিশ অফিসারের এমন ফ্লার্টিং লেভেল দেখে রাগে ফুঁসে উঠলো।
_____
পেরিয়ে গিয়েছে দুটো দিন।কিছুই স্বাভাবিক হয়নি মাহাদের জীবনে।
মাহাদ কোনোভাবেই ক্যামেলিয়ার ভুল ভাঙাতে পারেনি।শুধু তাই নয় তাদের শত শত ছবি বিয়ের স্মৃতি কোনো কিছু দেখিয়েও মাহাদের প্রতি ক্যামেলিয়ার ইন্টারেস্ট তৈরি করা যায়নি।
ব্যার্থ নাবিকের ন্যায় জীবনের উত্তাল সমুদ্রে মাহাদ নিজেকে সপে দিয়েছে।
জীবনের বেসামাল ঢেউ তাকে যেদিকে নিয়ে যাবে সে সেখানে যেতেই প্রস্তুত।
____
আজ ক্যামেলিয়া ফিরে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ডে।
সেখানে সে বাস করে তার বাবা মা ওখানে আছে এই বিশ্বাসেই সে ফিরে যাচ্ছে।
মাহাদ ক্যামেলিয়া কে কোন প্রকার জোর জবরদস্তি করেনি।
মাহাদের বিশ্বাস একদিন ঠিক ক্যামেলিয়া ফিরবে।
যদি নাও ফিরে তবে মাহাদ নিজেই তার বউকে ফিরিয়ে আনবে।
#চলবে