ওগো বিদেশিনী পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

0
289

#ওগো_বিদেশিনী
#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#ক্রস_ওভার_পোস্ট
#অন্তিম_পর্ব
#সারিকা_হোসাইন

******
সময় ও স্রোত দুটোই তার আপন গতিতে চলে।সময় শুধু আমাদের পেছনে ফেলে সামনের দিকে ছুটে চলে।ভালো সময় সুন্দর একটা স্মৃতি রেখে যায় আর খারাপ সময় রেখে যায় হতাশা,গ্লানি,আফসোস।চাইলেও হৃদয়ের মনিকোঠা থেকে সেই আফসোস মুছে ফেলা যায়না।

মাহাদ ক্যামেলিয়া, সুজানা-রিজভী,অনিম-টুসি প্রত্যেকের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে খারাপ আর ভালোয় মিলিয়ে দুটো বছর।
এই দুই বছরে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুর।
মাহাদ তার কঠিন ধৈর্য আর ভালোবাসার বলে ক্যামেলিয়া কে পুরোপুরি কিউর করতে সক্ষম হয়েছে।ক্যামেলিয়া এখন আর পাঁচ দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক সুন্দর,চঞ্চল।

ক্যামেলিয়া সুস্থ হবার পর মাহাদ আবার বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার হিসেবে যোগদান করেছে।

রিজভী তার বাবার ব্যাবসায়টিকে ধীরে ধীরে নিজের আয়ত্তে নিয়ে পুরোদমে বিজনেস ম্যান হয়ে গিয়েছে।
অনিম পেরেছে তার ভালোবাসার বন্ধনে টুসীকে বেঁধে ফেলতে।
ক্যামেলিয়ার দাদু আশফিক হাসান বার্ধক্যজনিত কারন আর পুত্র শোকে বছর খানেক আগেই ইন্তেকাল করেছেন।

সকলের জীবন ছুটে চলেছে নিময় মাফিক হাসি,কান্না ,আনন্দ বেদনায়।
নাবিল হাসানের বাড়িতে আজ একসাথে দুটো খুশি।
একদিকে ছেলে বিয়ে করিয়ে মেয়ে আনবেন।অন্যদিকে মেয়ে বিয়ে দিয়ে ছেলে আনবেন।
নাজনীন সুলতানার খুশি যেনো আর ধরছে না।
এদিকে ক্যামেলিয়া পড়েছে বিপাকে।

সে নিজের বাড়িতে আনন্দ ফুর্তি করবে নাকি বড় ভাবি হিসেবে সুজানার বিয়ের দায়িত্ব সামলাবে?
কিছুই যেনো ভেবে কুলাতে পারছে না ক্যামেলিয়া।
বিছানায় বসে বসে মাহাদ ক্যামেলিয়ার চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে ভ্যাবলা কান্তের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে শুধু।
ক্যামেলিয়ার এমন সিদ্ধান্তহীনতা দেখে মাহাদের ই যেনো হাঁসফাঁস অনুভূতি হচ্ছে।

ক্যামেলিয়ার এহেন অস্থিরতা মাহাদের আর সহ্য হলো না।
হাতের ফোন বিছানায় ফেলে ক্যামেলিয়া কে উদ্দেশ্য করে আদুরে স্বরে ডেকে উঠলো

“ক্যামেলিয়া!
চিন্তার জগৎ থেকে মাহাদের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে উত্তর দিলো ক্যামেলিয়া

“হু”?

“এতো কিসের চিন্তা হচ্ছে তোমার বউ?
তোমার যেখানে থাকতে ভালো লাগবে সেখানেই তুমি যাবে।আমার পক্ষ থেকে বা আমার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই।

এবার যেনো ক্যামেলিয়ার মন থেকে ভারী বোঝা কিছুটা আলগা হলো।

সহসাই মাহাদের গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদে মিন মিন করে ক্যামেলিয়া বলে উঠলো;―

“আমার বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে মাহাদ।
টুসি তো অন্য বাড়িতে চলে যাবে,আর বাড়িতেও ওর পাশে কেউ নেই।
আমি থাকলে ওর ভালো লাগবে।

মাহাদ কিছুক্ষন মৌন থেকে ব্যাপারটা বুঝলো।এরপর ক্যামেলিয়ার নাক টেনে বলে উঠলো

“তৈরি হয়ে নাও, আমি তোমাকে ও বাড়িতে দিয়ে এসে জরুরি কাজে অফিসে যাবো।

মেকি রাগ দেখিয়ে ক্যামেলিয়া বলে উঠলো
“বিশেষ দিনেও তোমার অফিসে যেতে হয়?

“ওসব তুমি বুঝবে না হানি,ঝটপট রেডি হয়ে নাও, আমি নিচে আছি।

কথা গুলো বলেই মাহাদ দ্রুত পদে কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এলো।

ফুঁস করে দম ছেড়ে রেডি হতে চলে গেলো ক্যামেলিয়া।

_______
এদিকে টুসীকে মেহেন্দি পড়ানোর জন্য পার্লার থেকে মেয়ে এসে বসে কিন্তু আছে টুসীর কোনো খবর নেই।
নাজনীন সুলতানা কটমট করতে করতে মেয়ের রুমে এসে দাড়ালেন।
রুমে এসে উনার চক্ষু চড়ক গাছ হবার উপক্রম।
বিছানায় কাত হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে টুসি ,পাশেই একটা বইয়ের সাথে হেলান দিয়ে রাখা মোবাইল।সেখানে স্পষ্ট ঘুমন্ত অনিমকে দেখা যাচ্ছে।
ঘটনা বুঝতে এক মিনিট সময় ও লাগলো না নাজনীন সুলতানার।
চুপ করে ফোনের লাইন কেটে ধীর কন্ঠে ডেকে উঠলেন টুসীকে।

মিনিট দুয়েক ডাকার পরে বহু কষ্টে চোখ মেলে তাকালো টুসি।
ঘুম জড়ানো বিরক্তি কন্ঠে বলে উঠলো

“এতো সাত সকালে কেনো ডাকছো মা?মাত্রই ঘুমিয়েছি”

নিজেকে স্বাভাবিক রেখে নাজনীন বলে উঠলেন
“বেলা প্রায় এগারোটা বাজতে চললো।পার্লার থেকে মেয়ে গুলো এসেছে আরো ঘন্টা দুই আগে।
বিয়ে করার ইচ্ছে না থাকলে তুই ঘুমা।আমি ওদের বিদেয় করে দিচ্ছি।

কথা গুলো বলেই কোমরে আঁচল গুঁজে বেরিয়ে যেতে উদ্দত হলেন নাজনীন সুলতানা।

বিয়ের কথা শ্রবনিন্দ্রীয় হতেই ধড়ফড় করে উঠে বসলো টুসি,এরপর ঘুমে দুর্বল হওয়া শরীর নিয়ে কোনো মতে বাথরুমে ঢুকে গেলো ফ্রেস হতে।।
দাঁত ব্রাশ করতে গিয়েও মুখে ব্রাশ সমেত দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো টুসি।

******
এদিকে গায়ে একটি ল্যাভেন্ডার রঙের জামদানি শাড়ি জড়িয়ে,চুলগুলো খোঁপা করে তাতে সাদা বেলির গাজরা পেঁচিয়ে নিলো ক্যামেলিয়া।নীল মনি যুক্ত চোখে মোটা করে লেপ্টে দিলো কালো কাজল।ঠোঁটে একটা নুড কালার লিপস্টিক লাগিয়ে হালকা সাজে শাড়ির আচল ঠিক করতে করতে সিঁড়ি ধরে নামতে লাগলো ক্যামেলিয়া।

সবেই মাহাদ একটা জুসের গ্লাস নিয়ে মুখ ভরে চুমুক দিয়েছে।
ক্যামেলিয়ার এমন মারাত্বক রূপে বিষম খেয়ে নাকে মুখে উপচে উঠলো সেই জুস।
পাশেই মাহাদের বোন হৃদিতা তার বেবি হ্যাভেন কে খাওয়াচ্ছিলো।
মাহাদের এমন দুরবস্থা দেখে খাওয়ানো বন্ধ করে হৃদি হালকা করে মাথায় আর পিঠে চাপড় মারলো।

মাহাদের সেসবে কোনো খেয়াল নেই।সে সামনে এগিয়ে আসা মানবীকে দেখতে ব্যাস্ত।চোখের পলক ফেলতেও যেনো ভুলে গিয়েছি সে।
দূর থেকে মাহাদের এমন অবস্থা খেয়াল করে দৌড়ে এলো ক্যামেলিয়া।
উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো

“তুমি ঠিক আছো?

“না বউ আমি ঠিক নেই।তুমি আমাকে কোরবান করে ফেলেছো”

মাহাদের হেঁয়ালি বুঝতে পেরে হৃদি কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে মাহাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
এরপর পিঠে জোরে এক কিল বসিয়ে বলে উঠলো
“নির্লজ্জ্ব ছেলে কোথাকার”
মাহাদের এমন ঠোঁট কাঁটা স্বভাবের জন্য ক্যামেলিয়া লজ্জায় এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো।

মাহাদ আগেই সবাইকে ক্যামেলিয়া ও বাড়িতে যাবে বলে রেখেছিলো।
যাতে ক্যামেলিয়া এই মুহূর্তে কোথায় যাচ্ছে এই প্রশ্ন করে তাকে কেউ বিব্রত না করে।
আর বিয়েটা যেহেতু কমিউনিটি সেন্টারে হবে তাই এটা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথাও নেই।
যদিও সুজানা একটু মন ভার করেছিলো।
কিন্তু মিসেস মিতালি সুজানাকে বুঝিয়ে বললেন

“বাবারে তুই তো ওই বাড়িতে বউ হয়ে যাবি।আর টুসি দূরে অন্যের বাড়িতে চলে যাবে।তাছাড়া এখানে তোর বড় বোন উপস্থিত আছে।টুসীর তো মা ছাড়া কেউ নেই।ক্যামেলিয়া যাক।টুসীর একটু হলেও ভালো লাগবে।

সুজানাও অবস্থা বুঝে আর না করেনি।
ক্যামেলিয়া ড্রয়িং রুমে আসতেই মিসেস মিতালি হাসি মুখে ক্যামেলিয়ার কাছে এসে কপালে চুমু খেলেন।

“তোকে অনেক সুন্দর লাগছে শাড়িতে ক্যামেলিয়া।

ক্যামেলিয়া মাথা নিচু করে মুচকি হেসে বলে উঠলো

“এর ক্রেডিট কিন্তু তোমার মা।তুমি আমাকে ধৈর্য ধরে না শেখালে আমার পক্ষে এমন বাঙালি সাজসজ্জা করা কখনো সম্ভব হতো না।

মিসেস মিতালি ক্যামেলিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন
“তোর আজকের এই বিশেষ দিনে মা হিসেবে কিছুই……..

মিতালি আর ক্যামেলিয়ার কথার মধ্যে মাহাদ ফোড়ন কেটে বলে উঠলো

“এক কাজ করো ক্যামেলিয়া তুমি একেবারে কমিউনিটি সেন্টারেই চলে যাও।এখানেই দুপুর করে ফেললে টুসীকে সময় কে দেবে শুনি?

মিসেস মিতালি ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দ্রুত তাড়া দেখিয়ে দরজা পর্যন্ত টেনে নিয়ে এলেন ক্যামেলিয়া কে।
কিন্তু যেই কথাটা বলতে চেয়েছিলেন তাগাদায় পরে সেটা আর বলতেই পারলেন না।

তার আগেই মাহাদ আর মাহতাব চৌধুরী হাউকাউ শুরু করে দিলেন।

সুজানা বসে বসে তার মেহেন্দি শুকানোর অপেক্ষা করছিল।
ক্যামেলিয়া সুজানার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে মুচকি হাসতেই লজ্জায় রাঙা হলো সুজানার গাল।
ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে মাহাদের পিছু পিছু বেরিয়ে এলো ক্যামেলিয়া।

গাড়িতে বসতেই হুড়মুড়িয়ে ক্যামেলিয়া কে জাপ্টে ধরলো মাহাদ।
হঠাৎই এমন পরিস্থিতিতে হকচকিয়ে উঠলো ক্যামেলিয়া।

“আরে করছো কি?কেউ দেখে ফেলবে।

“দেখুক।আমার বউকে আমি ধরেছি কার কি?

“হঠাৎ এতো আদর উথলে উঠার কারন জানতে পারি?

“তুমি জানোনা বউ শাড়ি আমি কত্তো পছন্দ করি।আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো তোমাকে এমন বাঙালি রূপে দেখার।আমার স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে।কবে থেকে শিখলে এভাবে সাজা?

লজ্জায় মাথা নিচু করে ক্যামেলিয়া বলে উঠলো

“তুমি প্রায়ই বলতে আমাকে এভাবে সাজলে ভালো লাগবে।তাই মার থেকে শিখে নিয়েছি।কিন্তু তোমাকে দেখাতে পারিনি।ভেবেছিলাম ম্যারেজ ডে তে সারপ্রাইজ দেবো।

মাহাদ ক্যামেলিয়ার গালে টুপ করে চুমু খেয়ে বলে উঠলো
“তাহলে আজ পড়লে কেনো?ম্যারেজ ডে তেই পড়তে?

“মাহাদের কানে হালকা স্লাইড করে ক্যামেলিয়া বলে উঠলো

“আজ ই তো আমাদের ম্যারেজ ডে বুদ্ধু।সব ভুলে গিয়েছো?

ক্যামেলিয়ার কথায় মাহাদ থমকে গেলো।
“তার জীবনের এমন বিশেষ একটি দিন আজ অথচ সে এটা ভুলে বসে আছে?আর মেয়েটি এটা নিয়ে রাগ না দেখিয়ে হেসে যাচ্ছে?

মাহাদের মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে ক্যামেলিয়া বলে উঠলো

“কি মশাই কোথায় হারালে?

ক্যামেলিয়ার কপালে গভীর চুমু একে মাহাদ ক্যামেলিয়ার দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরলো।এরপর আহত অপরাধী কন্ঠে বলে উঠলো

“সরি জান একদম ভুলে গেছি।নেক্সট টাইম ঠিক তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো।

মাহাদের মুখমন্ডল দুই হাতের আজলায় ভরে ক্যামেলিয়া নাকে নাক ঘষে বলে উঠলো

“এইকদিন তুমি প্রচুর ব্যাস্ত ছিলে।অফিস সামলে সুজানার বিয়ের কেনাকাটা বিভিন্ন বিষয়ে অনেক ধকল গিয়েছে তোমার উপর।তাই আমি আর চাপ দিতে চাইনি তোমাকে।
সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী শ্রাবণ মাসে আমরা এই দিনটি আবার পালন করবো।
আর এটা তো এমন কোনো বাধ্যতামূলক বিষয় নয় যে পালন করতেই হবে তাই না?

ক্যামেলিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়ালো মাহাদ।
এরপর ক্যামেলিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে আদরের সহিত বলে উঠলো

“তোমাকে আমি অনেক তপস্যা করে পেয়েছি ক্যামেলিয়া।এই জন্য আমি এতটা ভাগ্যবান।তোমাকে না পেলে আমি সত্যি মরে যেতাম।

মাহাদের বুকে আঁকিবুকি করতে করতে ক্যামেলিয়া বাচ্চাদের মতো করে বলে উঠলো
” আমরা যাবোনা?”

মাহাদ ক্যামেলিয়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠলো
“যাবো বউ।এক্ষুনি যাবো।”

********
কমিউনিটি সেন্টারে আত্মীয় স্বজনে পরিপূর্ণ হয়ে হাসি কোলাহলে মেতে উঠেছে।
সকলে অধীর আগ্রহে বিয়ে কখন শুরু হবে সেই অপেক্ষা করছে।
কিছুক্ষণ বাদে কাজী আসতেই সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়লো বিয়ে দেখতে।
সুজানা রিজভী ,অনিম টুসীকে দেখে মনে হচ্ছে মেইড ফর ইচ আদার।
সকল আত্মীয় স্বজন এই দুই জুটির খুব প্রশংসা করলো।
আত্মীয় স্বজনের খুনসুটি, আনন্দ,নাচ গানে জমে উঠলো বিয়ের আসর।

সুন্দর সাবলীল ভাবে বিয়ে শেষ হতেই খাবারের আয়োজন করা হলো।
সকল নিয়ম কানুন পালন করে পাত্র পাত্রীকে তাদের মালিকের হাতে তুলে দেবার সময় এলো।
মিসেস নাজনীন কান্নায় বুক ভাসালেন।
মিসেস মিতালি নাজনীন কে সামলানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হলেন।
মিসেস নাজনীন একপর্যায়ে অনিমের হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
কান্নার দমকে তার কোনো কথাই স্পষ্ট নয়।
অনিম নাজনীন কে বুকে জড়িয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো

“মা এভাবে কাঁদবেন না।আপনার মেয়ে আমার কাছে পবিত্র আমানত স্বরূপ।আমি ওকে ভালোবাসায় আগলে রাখবো সবসময়।কখনো একরত্তি অভিযোগের সুযোগ দেবো না।

মিসেস নাজনীন আর নাবিল হাসানকে কোনো মতে সামলে রিজভী অনিম আর মাহাদ তাদের কথাবার্তা সারলো।
তিনজনকেই খুব চিন্তিত মনে হলো।
কিন্তু কেউ কোনো বিষয় প্রকাশ করলো না।

______
পেরিয়ে গিয়েছে দুটো দিন।হঠাৎই সুন্দর,স্নিগ্ধ ঢাকার সকাল উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী রা বিশাল এক আন্দোলনের ডাক দিয়েছে।
সেটাই খবরে বসে বসে দেখছেন মাহতাব চৌধুরী।

টিভি বন্ধ করে কিছুক্ষন মৌন থেকে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে মিতালিকে ডেকে বলে উঠলেন

“বুঝলে মিতালি চারদিকে হায়েনা আর শকুনে ভরে গিয়েছে।দেশটা বুঝি রসাতলেই গেলো।এই জাতির ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে?যেই দেশে মেধার দাম নেই সেই দেশ কিভাবে উন্নত হবে বলতে পারো?

মিসেস মিতালি রান্নাঘরে কাজ করছিলেন।মাহতাব চৌধুরীকে তিনি কখনোই আগে এমন চিন্তিত দেখেন নি।তবে কেনো এবার তিনি এতো মন মরা?

টিভিতে,ফেসবুকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বারবার একই নিউজ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দুদিন ধরে মাহাদকে খুবই হতাশা আর চিন্তাগ্রস্থ মনে হচ্ছে।
না ঠিক মতো খাচ্ছে না কারো সাথে ভালোভাবে কথা বলছে।
সব সময়ই তাকে আতঙ্কিত মনে হচ্ছে।
মাহাদকে এমন অস্থির ক্যামেলিয়া কখনো দেখেনি।
রাতেও মাহাদ ঠিকমতো বাড়ি ফিরছে না।তার মধ্যে দেশের এমন অবস্থা।
ক্যামেলিয়া অনেক জোড় জবরদস্তি করেও মাহাদের মুখ থেকে কিছু বের করতে পারেনি।
হঠাৎই আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর উপর পুলিশ গুলি চালিয়ে দিয়েছে।এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আরো জোরদার আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।

যেই পুলিশ জনগণের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকবে সেই পুলিশ নোংরা মস্তিষ্ক পঁচা সরকারের হয়ে দেশ গড়ার কারিগরের রক্ত ঝড়াচ্ছে?

সাধারণ জনগণের রক্ত সহ যেনো গরম হয়ে উঠলো।
নিমিষের ব্যাবধানেই দেশের অস্থিরতা বেড়ে গেলো কয়েক গুণ।
একদিন হুট করেই মাহাদ ধুপধাপ পা ফেলে দৌড়ে ক্যামেলিয়ার কাছে আসলো।গায়ে তার আকাশি রঙা ইউনিফর্ম ঘামে ভিজে জপজপে অবস্থা।
এসেই ক্যামেলিয়া কে জাপ্টে ধরে কম্পিত কন্ঠে বলে উঠলো

“”যদি আর না ফিরি তবে ভাববে দেশের আবর্জনা সাফ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে তোমার স্বামী।

ক্যামেলিয়া মাহাদের কথার আগামাথা না বুঝে এমন ভয়ঙ্কর কথা শুনে কেঁপে উঠলো।
না চাইতেও চোখ বেয়ে মোটা মোটা অশ্রুদানা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।

মাহাদ খড়খরে তপ্ত হাতে সেই জল মুছিয়ে বলে উঠলো

“কান্না তোমাকে মানাচ্ছে না ক্যামেলিয়া।ভুলে যেওনা তুমি একজন বিমান সেনার স্ত্রী।ভীরুতা কেনো তবে আজ কাবু করছে তোমাকে?

ক্যামেলিয়া মুখের ভাষা হারালো যেনো।সমস্ত কথা গলার কাছে পেঁচিয়ে কন্ঠ অবরোধ করলো।

ক্যামেলিয়া কে ছেড়ে মাহাদ বলে উঠলো

“আসছি।বেঁচে থাকলে ফের দেখা হবে।

ক্যামেলিয়া কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো মাহাদ।

★★★★★
মনে রেখো টুসি সব পুলিশ ই খারাপ জানোয়ার নয়।আমি অনিম চৌধুরী এখনো আমার বিবেক বোধ বিসর্জন দেইনি।
কথা দাও আমাকে বিশ্বাস করবে?
যত যাই হয়ে যাকনা কেনো আমাকে ঘৃণা করোনা টুসি।

অনিমকে টুসি এই আড়াই বছরে বেশ ভালো চিনেছে।
বিনা কারণে একটি পিঁপড়ে পর্যন্ত মারতে রাজি নয় অনিম।
সেখানে এমন তরতাজা প্রাণ অনিমের বন্দুকের গুলিতে ঝরবে এটা টুসি স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না।

অনিম টুসীর চোখের জল মুছিয়ে বলে উঠলো

“খুব শীঘ্রই আলো আসবে টুসি।ফেরাউন পানিতে তলাবে।তুমি শুধু আমাকে বিশ্বাস করবে।
“আসছি”

টুসীর দিকে ফিরে না তাকিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে গেলো অনিম।
পিছনে ফেলে গেলো সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর কান্নাযুক্ত মুখশ্রী।

——
মেজর মুহিত পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ রুপ ধারণ করছে।সাথে উপর মহল থেকে বিভিন্ন অন্যায় ওর্ডার আসছে।
একজন মানুষ হয়ে বিবেক বর্জন করে এমন ওর্ডার আমাদের পক্ষে মানা সম্ভব নয়।

মেজর আদ্রিয়ান আমরা কারো গোলাম নই।আমরা হচ্ছি জনগণের আস্থার স্থান।কোনো ব্রেইনলেস জালিম শাসকের জন্য আমরা একটা নিষ্পাপ তাজা প্রাণ সংহার করতে পারবো না।

স্যার এই কঠিন পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেবো?উগ্র পুলিশ আর হেলমেট নামক সন্ত্রাস বাহিনী অকাতরে ছাত্রদের উপর স্মোক গ্রেনেড, টিয়ারসেল,আর গুলি ছুড়ছে।

ক্যাপ্টেন সৌম্য গাড়ি বের করো,আর্মি জেনারেল এর সাথে কথা বলতে চাই আমি এই মুহূর্তে।

——
আর্মি হেড কোয়ার্টার এ গোপন বৈঠক এর আয়োজন করা হয়েছে।
এখানে শুধু আর্মি অফিসার ই নন বরং বিমান বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তা দের ও ডাকা হয়েছে।
আর্মি জেনারেল এর উদ্দেশ্য মুহিত বলে উঠলো

“স্যার আর্মি হচ্ছে জনগণের আস্থা।আমরা নিজেদের জান মাল জনগণের কাছে সমর্পণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।দেশের শাসকের এই অন্যায় আবদার আমরা মানতে প্রস্তুত নই।ক্ষমতার লোভ সবচেয়ে বড় লোভ স্যার।এই লোভের জন্য আমরা মানুষের প্রাণ নিতে পারি না।উপরে যিনি আছেন উনি সব কিছুই দেখেন জানেন,
এই পারে আয়েশ করে জীবন পার করলেও ওপারে ঠিকই জবাব দিতে হবে।
আমরা মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারবো না স্যার।

আর্মি জেনারেল কিছুক্ষন মৌন থেকে সমানে দুই হাতের আঙ্গুল এর সহিত কপাল স্লাইড করলেন।
এরপর বলে উঠলেন

“তুমি যার ইঙ্গিত করছো সেটা আমি বুঝতে পেরেছি মেজর।কিন্তু আর্মিতে এমন কিছু লোক আছে যারা নিজের রেঙ্ক বাড়াতে অন্যায়কারীর পা চাটতে প্রস্তুত।আর এই ঘটনা কেউ লিক করলে ডিরেক্ট ক্রস ফায়ার হবো আমরা।

নিজের জীবন যদি এতই প্রিয় তবে ওই নিষ্পাপ মেধাবী ছাত্রদের কি হবে একবার ভেবে দেখেছেন স্যার?সেনাবাহিনীর দেশ চালানোর মতো পাওয়ার আর জ্ঞান দুটোই আছে।আপনি শুধু ক্ষমতায় বসুন স্যার।আমি একাই এক হাজার আর্মির সমান হয়ে আপনাকে সেফ রাখবো।
কথাটি গমগমে তেজী কন্ঠে বলে পিছনে হাত মুড়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মুহিত।

এতোক্ষন মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ চুপ করে সব কিছু শুনছিলেন।নিজের মেয়ের জামাইকে তিনি খুব ভালো করেই জানেন।মুহিত নিজের জীবন দিয়ে দেবে দরকার পড়লে তবুও অন্যায়কারী কে প্রশ্রয় দেবে না।
আর এদিকে দেশের অবস্থাও চরম বিপর্যয়ে।
কোথা থেকে কি শুরু করবেন কিছুই যেনো তার বোধগম্য হচ্ছে না।

মেজর আদ্রিয়ান গলা খাকরি দিয়ে বুকে দুই হাত গুঁজে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন

“আপনার ছেলেও কিন্তু সেই আন্দোলনে জড়িত আছে স্যার।ভাবুন কোনো এক মেধাহীন প্রশ্নফাঁসে বিসিএস হওয়া পুলিশ অফিসার আপনার ছেলের বুকে বুলেট বিধিয়ে দিলো।তখনো কি আপনি এভাবেই বসে থাকবেন?

আর্মি জেনারেল চোখ তুলে আদ্রিয়ান এর দিকে নিরুপায় হয়ে চেয়ে রইলেন।

মাহাদ তার তেজী কন্ঠে বলে উঠলো

“যাকে রাষ্ট্র চায়না তাকে দেখে কিসের ভয়?আপনি তাকে গ্রেফতার এর ব্যাবস্থা করুন স্যার।আমরা নিজের রক্ত দিয়ে হলেও দেশ থেকে স্বৈরাচারী বিদেয় করবো।

মাহাদের কথায় সকলে হাত তালি দিয়ে মাহাদকে সমর্থন করলো।

কিছুক্ষন ভেবে চিন্তে আর্মি জেনারেল বলে উঠলেন

“মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ওই নমরুদকে গ্রেফতার এর ব্যাবস্থা করা হোক তবে।

*******
ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট।
চারপাশে থমথমে অবস্থা।
হাইকোর্ট থেকে এরেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এর হাজার হাজার আর্মি ছুটে চললো তাদের গন্তব্যে।
মিনিট বিশেক পার হতেই কাঙ্খিত গন্তব্যে এসে সকলেই বন্দুক তাক করে একে একে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো।
আর্মি জেনারেল কে দেখে প্রথম গেটের গেট কিপার গেট খুলে দিয়ে স্যালুট জানালো।

একে একে তেরোটা গেট পার হয়ে আসামির দেখা পেয়ে সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠলো

আর্মি জেনারেল এরেস্ট ওয়ারেন্ট দেখিয়ে বলে উঠলেন

“ইউ আর আন্ডার এরেস্ট ,”

*******
আন্দোলন থেমে গিয়েছে,ছাত্রদের সকল দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে।স্কুল,কলেজ ভার্সিটি তে কোনো হেলমেট বাহিনীর অস্তিত্ব নেই।যারা আন্দোলনে শহীদ হয়েছে তাদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্র।
হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের দায়ে গ্রেফতার কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে সেই জালিম শাসক কে।
লেজ গুটিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা খেয়েছে তার আমলা।

দেশে কোনো অরাজকতা নেই,নেই কোনো বিশৃঙ্খলা।
মেয়েরা রাস্তায় নিরাপদ এমনকি অন্ধকার রাতেও।
পুলিশ কাউকে হেনস্থা করার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারেনা।
বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রিয় শায়েখের ভাতের হোটেল।
সাধারণ ঘরের মেধাবী ছেলেটাও আজ বড় সরকারি অফিসার।
দেশে কোনো ঘুষ নেই ,রাজনৈতিক দলের পীড়াপীড়ি নেই।
সুন্দর ভাবে নাশকতা হীন চলছে আমার সোনার বাংলা দেশ।
বাংলার মানুষ আজ মুক্ত,তারা প্রানভরে শ্বাস নেয়।
গরিব ভিখারি লোকটাও আজ ইলিশ মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খায়।
কমে গিয়েছে সকল জিনিসের আকাশ ছোয়া দাম।
দেশের মানুষ তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলে

“আহ তোমাকেই তো চেয়ে ছিলাম প্রিয় বাংলাদেশ”

_____
নাহ সেই আন্দোলন যুদ্ধে আর কেউ মরেনি।খালি হয়নি কোনো মায়ের বুক।সবাই হাসি মুখে ফিরে গিয়েছে নিজ নিজ ক্যাম্পাসে।
অনিম টুসীর সুখের সংসার হয়েছে।
রিজভী সুজানা ভালো আছে।
মুহিত ,স্বর্গ তাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্যাস্ত সময় পার করছে।

ক্যামেলিয়া সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা।তার মুড সুইং এ মাহাদের জীবন ওষ্ঠাগত।
তবুও সবাই ভালো আছে।
কারন সবাই পরাধীনতার শিকল ছেড়ে মুক্ত হতে পেরেছে।

________সমাপ্ত_______