ওয়ান ফোর থ্রি পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
462

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
২৩.
প্রায় আধঘণ্টা ধরে লেডিস ওয়াশরুমে ঢুকে বসে আছে স্নেহা। মেয়েরা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। হাসপাতালের বাথরুমের মতো একটা জঘন্য জায়গায় কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমন আসন গেঁড়ে বসে থাকে না। কিন্তু স্নেহার কাছে অন্যকোনো উপায়ও নেই। আমীরকে হাসপাতালে ঢুকতে দেখেই সে এখানে চলে এসেছে। ভয়ে তার হৃৎস্পন্দন ক্রমাগত বাড়ছে। তবে এখানে বসার পর থেকে সে কিছুটা স্বস্তিও বোধ করছে। আমীর সম্পূর্ণ হাসপাতাল চষে ফেলতে পারলেও লেডিস ওয়াশরুমে ঢুকবে না। তাই যতক্ষণ সে এখানে থাকবে, ততক্ষণ সে নিরাপদ।

রাশেদ ইমারজেন্সী ইউনিটের সামনে এসে দাঁড়াতেই একটু বিব্রত হলো। তোহার বেডের কাছে হাঁটু মুঁড়ে বসে আছে আমীর। রাশেদ আঁড়চোখে দেখল আমীর খুব যত্নে তোহার হাতটা ধরে রেখেছে, আবার কেমন বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ঘুমন্ত তোহার মুখটির দিকে। পৃথিবীর অন্যকিছুর প্রতি তার মনোযোগ নেই। রাশেদ এসে দাঁড়ানোর পরেও সে বুঝতে পারেনি। হয়তো টেরই পায়নি। রাশেদ হালকা কাশি দিল। তবুও যখন আমীরের হুঁশ ফিরল না তখন সে স্পষ্ট করে ডাকল,” স্যার, এক্সকিউজ মি।”

আমীর খানিকটা চমকে উঠল। বিরক্ত হয়ে কপাল কুঞ্চিত করল। ধমকের স্বরে বলল,” কি ব্যাপার?”

রাশেদ বিনয়ের সাথে জবাব দিল,” ফয়সাল বলছিল আপনি নাকি আমাকে খুঁজছেন।”

আমীর কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল তারপর হঠাৎ মনে পড়ল স্নেহার সাথে তার একটা বোঝা-পরার দরকার আছে। ব্যাপারটা মাথায় আসতেই চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠল তার। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” স্নেহা কোথায়? ওকে বলো আমার সাথে যেন দেখা করে।”

রাশেদের মুখ মলিন হয়ে গেল। কোনো উত্তর সে দিল না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল দরজার কাছে। আমীর আরও বেশি বিরক্তি নিয়ে বলল,” দাঁড়িয়ে আছো কেন? কথা শুনতে পাওনি?”

রাশেদ মাথা নিচু করল। চোখ লুকিয়ে বলল,” স্নেহা ম্যাডাম কোথায় আছে আমি জানি না স্যার। উনি মনে হয় বাড়িতে চলে গেছে।”

“বাড়িতে যায়নি। নিচে আমি গার্ডসের কাছে বলে রেখেছি। স্নেহা হাসপাতালের বাইরে গেলেই আমার কাছে ইনফরমেশন চলে আসবে। ও ভেতরেই কোথাও আছে তুমি খুঁজে দেখো।”

রাশেদ চলে গেল। মিনিট দশেক পর ফিরে এসে জানাল,” হাসপাতালের কোথাও ম্যাডামকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না স্যার।”

আমীর উঠে দাঁড়ালো এবার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” খুঁজে না পেলে আর কি করার? এদিকে এসো।”

এই কথা বলেই রাশেদের কাঁধে হাত রেখে তার বাহু টেনে ধরে ইমারজেন্সী ইউনিট থেকে বের হয়ে এলো আমীর। করিডোর ধরে রাশেদকে নিয়ে ওভাবেই হাঁটতে হাঁটতে একটা নীরব জায়গা বুঝে দাঁড়ালো। তারপর আচমকা রাশেদের গালে কষে চড় মা-রল। চড়ের ধাক্কা এতোই বেশি ছিল যে তাৎক্ষণিক মেঝেতে ছিটকে পড়ে গেল রাশেদ। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠতে পারল না সে। ঘাবড়ে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকাল। আমীর ওয়ার্ণিং দিল,” পাঁচমিনিট। জাস্ট পাঁচিমিনিটের মধ্যে ওকে আমার সামনে নিয়ে আসো নয়তো তোমার কপালে দুঃখ আছে।”

রাশেদ ঢোক গিলল। নিমেষেই চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। আমীর এদিক-ওদিক তাকাল। কেউ দেখতে পায়নি ঘটনাটা। ক্ষীপ্ত মেজাজ নিয়ে বসল একটা চেয়ারে। রাশেদ ধীরে-সুস্থে উঠে দাঁড়ালো। অসহায় সুরে বলল,” আমি ম্যাডামকে পেলে আপনাকে জানাবো স্যার।”

এই কথা বলেই দ্রুত পালিয়ে গেল। সে চলে যেতেই আমীর বিড়বিড় করে বলল,” বাস্টার্ড।”

ফয়সাল আমীরকে খুঁজতে খুঁজতে করিডোরের এক কোণায় বসে থাকা অবস্থায় দেখে ছুটে এলো। উৎসাহী কণ্ঠে বলল,” স্যার, স্নেহা ম্যাডামের খোঁজ পেয়েছি। লেডিস ওয়াশরুমের ভেতরে ঢুকে বসে আছেন। রাশেদকে দেখলাম ক্যান্টিন থেকে উনার জন্য কফি নিয়ে যাচ্ছে।”

আমীরের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ক্রোধপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” জানতাম।” তারপর কিছু একটা ভেবে মৃদু হাসল সে। পায়ের উপর পা তুলে বলল,” কতক্ষণ আর বসে থাকবে ওখানে? একসময় তো ওকে বের হতেই হবে। লেটস ওয়েট! তুমি গিয়ে নজর রাখো। বের হলেই আমাকে টেক্সট করবে।”

” ওকে স্যার।”

__________
এখানে একদম নেটওয়ার্ক নেই। কাউকে ফোন করা যাচ্ছে না। স্নেহা বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠেছে। এখন মনে হচ্ছে এখান থেকে বের হতে না পারলে সে ম-রেই যাবে। কোনোমতে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। এবার নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু পুরোপুরি না। রাশেদকে ফোন করার জন্য স্নেহা বাইরে বের হলো। তখনি ফয়সালকে পায়চারী করতে দেখে আবার চট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। একজন মহিলা তার এই অবস্থা লক্ষ্য করে বলল,” আপা আপনি কি করতে চান? একবার ঢুকছেন একবার বের হচ্ছেন এখন আবার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। মানুষকে কি চলা-ফেরা করতে দিবেন না?”

দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো স্নেহা। কটমট করে বলল,” আমি যেটাই করি তাতে আপনার কি? আপনি নিজের কাজ করুন।”

ভদ্রমহিলা বিড়বিড় করে কি যেন একটা বলে গেল। তার নাক ঈষৎ লাল দেখালো। মনে হয় স্নেহাকে উদ্দেশ্য করেই গালি-টালি দিয়েছে। স্নেহা কঠিন দৃষ্টিতে তাকাতেই ভদ্রমহিলা ভয় পেয়ে দ্রুত হেঁটে বাথরুম থেকে বের হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই এটা হলো স্নেহার চোখের স্পেশাল পাওয়ার। গ্রামে একবার তার এই চোখ রাঙানো দেখে একজন বৃদ্ধ লোক ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।

রাশেদ স্নেহার মিসডকল পেয়ে দ্রুত ওয়াশরুমের সামনে চলে আসে। স্নেহা বিচলিত কণ্ঠে বলল,” কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? আমি ক্ষুধায় ম-রে যাচ্ছি। চিকেন অন্থন আনতে বলেছিলাম না?”

” সব এনেছি ম্যাডাম। কিন্তু আপনি কি বাথরুমে ঢুকে খাবেন?”

” ছিঃ, অবশ্যই না।”

” তাহলে?”

স্নেহা একটু ভেবে বলল,” এখানে কি ছাদে উঠতে দেয়? না দিলেও স্টাফদের টাকা অফার করে আমাকে ছাদে নিয়ে চলো। আমি এই জায়গায় আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারব না। ডিসগাস্টিং লাগছে।”

” আমি দেখছি ম্যাডাম।”

রাশেদ যেতে নিলেই স্নেহা তার হাত ধরল। মৃদু কেঁপে উঠল রাশেদ। স্নেহার স্পর্শ তাকে মাতাল করে দেয়। কেমন একটা ঘোরাচ্ছন্ন মোহে আটকে গেল সে। স্নেহা ভ্রু কুচকিয়ে প্রশ্ন করে,” বাম গাল এমন ফুলে আছে কেন রাশেদ? আমীর তোমাকে চড় মেরেছে?”

রাশেদ নিজেকে ধাতস্থ করে বামহাতটা গালে বুলাতে লাগল। বলল,” আপনাকে খুঁজে না পেয়ে আমার উপর মেজাজ দেখিয়েছেন।”

” উফ… আমি বুঝতে পারছি না ওই মেয়ের জন্য আমীর কেন এতো ডেস্পারেট? আমি কি ইচ্ছে করে ওকে মে-রেছি? সে কি আমার সাথে বেয়াদবি করেনি! নাকি শুধু আমারই দোষ? ”

রাশেদ উত্তর দিল না। আলাভোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। স্নেহা বলল,” যাইহোক, ছাদে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারব না। ফয়সাল ঘুরছে আশেপাশে। আমীরও চলে আসতে পারে।”

লিফটে অনেক ভীড়। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ভেবে স্নেহা সিঁড়ি ভেঙে আটতলায় উঠল। অনেক ক্লান্ত লাগছে তার। রাশেদকে বলল তার জন্য আইসক্রিম এনে দিতে। ছাদে তো এসিও নেই। প্রচন্ড গরম লাগছে।

রাশেদ স্নেহাকে ছাদে রেখে পুনরায় নিচে যাওয়ার জন্য লিফটের কাছে এলো। সেখানেই দেখা হলো ফয়সাল আর ওমরের সাথে। বাইরে ওমর আর ভেতরে লিফট খুলে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল। রাশেদকে দেখেই সে চোখ টিপল। আর ওমর হাসল। রাশেদের শিরদাঁড়া বেয়ে প্রবাহিত হলো খুব শীতল একটা স্রোত। ধড়াস করে উঠল বুক। এরা দু’জন ছাদে এসেছে মানে আমীরও আছে। আর স্নেহাও তো মাত্রই ছাদে ঢুকল। সর্বনাশ! সে নিজ হাতে স্নেহাকে বাঘের গুহায় ছেড়ে এসেছে! চট করে রাশেদ ছাদের দরজার দিকে দৌড়াতে নিলেই তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে ফেলল ফয়সাল। সামনে থেকে ধরল ওমর। রাশেদ চেঁচাতে চাইল। কিন্তু তার আওয়াজ ছাদের দরজা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ধাম করে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো। রাশেদ হতাশ হয়ে বসে পড়ল। সে স্নেহাকে বাঁচাতে পারল না! ওমর আর ফয়সাল ধস্তাধস্তি করে তাকে লিফটের ভেতরে নিয়ে আটকে ফেলল।

ছাদের একদম প্রান্তে এসে দাঁড়ালো স্নেহা। আমীর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তাকে ছাদে দেখা মাত্রই আতঙ্কে স্নেহার হৃৎযন্ত্র বিকল হওয়ার দশা! সে কোনোমতে ঢোক গিলে বলার চেষ্টা করল,” আমীর, আমাদের আগে কথা বলে নেওয়া উচিৎ। তুমি শুধু একপক্ষ থেকে শুনে জাজ করতে পারো না। এখানে তোহাও সমানভাবে দোষী।”

আমীর অনেকটা কাছে চলে এলো। স্নেহার বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাসে অন্যরকম ছন্দ। কেমন একটা উত্তপ্ত স্রোত ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। এর আগে কখনও আমীর এতো কাছে আসেনি তার। স্নেহা জানে আমীর তার কোনো ক্ষতি করবে না। তবুও সে ভয় পাচ্ছে। আমীরকে হারিয়ে ফেলার ভয়! আমীর সামান্য ঝুঁকে এসে স্নেহার ঠোঁটের উপর হাত রাখতেই চোখ দু’টো টেনে বন্ধ করে ফেলল স্নেহা। এই দৃশ্যটা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম স্বপ্ন। কিন্তু কখনও এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে তা কল্পনাতেও ভাবেনি সে। আমীর স্নেহার শরীরটা দেয়ালের সাথে চেপে ধরতেই স্নেহা আর অন্যকিছু ভাবতে পারল না। নিজেকে সঁপে দিল৷ আর ঠিক তখনি আমীর ঠোঁট থেকে হাত নামিয়ে স্নেহার গলাটা চেপে ধরল।

ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফটিয়ে উঠল স্নেহা। বিস্ময়ে চোখ দু’টো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে এখনি। আমীর এইভাবে তাকে দূর্বল বানিয়ে প্রতিহত করবে তা ধারণাতীত ছিল। প্রাণপণে গোঙানির মতো আওয়াজ করতে লাগল স্নেহা,”ছা… ড়ো…”

আমীরের চোয়াল তীক্ষ্ণ, দৃষ্টি রক্তাভ। ধারালো কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আমার লাইফের ইম্পোর্ট্যান্ট পারসনদের যে কষ্ট দেয় তাকে আমি সহজে মাফ করি না। এই কথা তো তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না স্নেহা। তবুও কিভাবে সাহস পেলে?”

স্নেহার দুই চোখে অশ্রুপাত ঘটে। দম আটকে আসার পূর্বমুহূর্তেও হিংসাত্মক হয়ে উঠল। অস্পষ্ট গলায় বলল,” ও তোমার লাইফের ইম্পোর্ট্যান্ট পারসন হতে পারে না।”

তীব্রভাবে গলাটা ঝাঁকি মেরে ছেড়ে দিল আমীর। স্নেহা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে কাশতে লাগল। আমীর কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হঠাৎই খুব অশান্ত হয়ে স্নেহার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল,” হতে পারে। অফকোর্স হতে পারে। শী ইজ ইম্পোর্ট্যান্ট ফোর মি। ইভেন শী ইজ দ্যা মোস্ট ইম্পোর্ট্যান্ট পারসন ইন মাই লাইফ।”

আমীর তীব্র গলায় চিৎকার করে কথাগুলো বলে ফেলল। স্নেহা ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকালো একবার। পরমুহূর্তেই হেসে উঠল। তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,” এজন্যই বুঝি ওর বাবাকে নিজের হাতে খু-ন করেছিলে?”

আমীর চমকে উঠল, থমকে গেল। হৃদয়ের সবচেয়ে নড়বড়ে জায়গায় আঘাত পড়ায় একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল। গা জ্বালানো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল স্নেহা। হাসতে হাসতে মেঝেতে চিৎপটাং হয়ে পড়ল একদম। তারপর খুব আয়েশী ভঙ্গিতে শুয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলল,” তোহা যখন জানবে তুমি তার বাবাকে খু-ন করে আবার তারই প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো..তাকেই সবকিছু থেকে প্রটেক্ট করছো, ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে তার প্রতি অবাধ প্রেম দেখাচ্ছো তখন কি হবে? তোহা তোমাকে ঠিক কতটা ঘৃণা করবে? এসব কি আদৌ চিন্তা করেছো কখনও? নাকি ভাবছো তোহা তোমাকে ক্ষমা করে দিবে? ”

আমীরের স্মৃতিতে ভেসে উঠল তোহার সেই ক্রোধপরায়ণ মুখটি। অবিচল কণ্ঠে বলা নির্মম সেই বাক্য,”নিজহাতে খু-ন না করলেও অন্তত তাকে অভিশাপ দিতে চাই। যতটা কষ্ট আমি পেয়েছি তার চেয়েও দশগুণ কষ্ট যেন সে ফেরত পায়। ”

আমীরের ভেতরটা রুদ্ধ হয়ে এলো। মুষড়ে গেল সে। প্রচন্ড হাহাকার টের পেল বুকে। স্নেহা আঙুল দিয়ে আমীরের গালে আলতো স্পর্শ করে বলল,” শোনো ডার্লিং, একটা আদর্শ মেয়ে কখনোই তার বাবার খু-নীকে মাফ করবে না। আর তোহার মতো মেয়ে তো অবশ্যই না৷ শুধু শুধু ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে তুমি নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো। প্লিজ, দিও না এই ভাবে নিজেকে কষ্ট। আমি তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারি না। যদিও তুমি আমাকে সবসময় হার্ট করেছো, তাও! আমি তো তোমার মতো নির্দয় না। ভালোবাসি আমি তোমাকে।”

আমীর উঠে দাঁড়ালো। সাথে স্নেহাও দাঁড়ালো। পকেটে হাত গুঁজে একটু অন্যমনস্ক কণ্ঠে আমীর বলল,” ভালোবাসা হলো মনের ব্যাপার। কাউকে ভালোবাসার জন্য যে ন্যূনতম জায়গাটার দরকার হয়, সেটা তোমার সংকীর্ণ মনের নেই স্নেহা।”

স্নেহা শক্ত করে চেপে ধরল আমীরের কলার। খিটমিট করে বলল,” কি বলতে চাও?”

” যে নিজের ছোটবোনকে একফোঁটা দয়া দেখাতে পারেনি, সে আমাকে কিভাবে ভালোবাসবে?”

” ফীহার প্রতি আমার ঘৃণা তোমার জন্যই তৈরী হয়েছিল। সে যদি তোমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতো তাহলে আমিও তার প্রতি নির্দয় হতাম না। এটাও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আমীর।”

আমীর স্নেহার হাতটা ছাড়িয়ে নিল নিজের কলার থেকে। শীতল কণ্ঠে বলল,” তুমি ফীহাকে যতটা নির্দয়ভাবে খু-ন করেছো…. ততটা নির্দয়ভাবে একটা মাছিও কেউ মা-রে না। আর তুমি বলছো এটা ভালোবাসা?”

” খু-ন কি শুধু আমি একলা করেছি? তুমিও তো হাজার-হাজার মানুষকে খু-ন করেছো। তাহলে আমাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?”

আমীর ঘুরে তাকিয়ে কঠিন মুখে বলল,” পার্থক্য হলো আমি প্রিয়জনদের প্রটেক্ট করতে খারাপ মানুষদের খু-ন করি। আর তুমি শুধু নিজের সুখকে প্রটেক্ট করতে যে কাউকে খু-ন করো। সে হোক তোমার বোন, হোক বাবা- মা কিংবা হোক সন্তান…. ইউ ডন্ট কেয়ার!”

স্নেহা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল। বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। আমীর ধীরপায়ে হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে বলল,” তোহার থেকে একশো হাত দূরে থাকবে তুমি। এটা আমার লাস্ট ওয়ার্ণিং। নেক্সট টাইম এরকম কিছু হলে..”

স্নেহা চিৎকার করে বলল,” ফীহাকে খু-ন করেছি বলে তুমি যেমন আমার ভালোবাসাটা বুঝতে পারছো না ঠিক তেমনি তোহাও তোমার ভালোবাসা বুঝবে না আমীর। কারণ তুমি ওর বাবাকে খু-ন করেছো। ও যখন এটা জানবে…”

আমীরের দৃষ্টিতে আগুন জ্বলে উঠল। উৎক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল,” ও কখনও জানবে না এটা।”

” নিশ্চয়ই জানবে। আমি জানাবো ওকে।” স্নেহা ধৃষ্টতা দেখালো। আমীর ক্রুদ্ধ গলায় বলল,” তাহলে জেনে রাখো সেই দিনটাই তোমার লাইফের শেষ দিন হবে।”

আমীরের শান্ত হুমকিতে না হেসে পারল না স্নেহা। ঘাড় নেড়ে বলল,” আমাকে তুমি খু-ন করতে পারবে না৷ এটা তুমি নিজেও খুব ভালো করে জানো।”

আমীর কোনো জবাব দিল না। চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চুপচাপ হেঁটে নিচে চলে গেল। নিচে নামতেই জানা গেল তোহার ঘুম ভেঙেছে। দূর থেকে একবার তোহার কবিনের দিকে উঁকি দিল আমীর। রানুর সাথে মৃদু হেসে কথা বলছে তোহা। কি মায়া তার চোখেমুখে, কি মিষ্টি তার হাসিমুখ! কি মোহনীয় আর মধুর! বুকের বামপাশে দগ্ধতার প্রবল যন্ত্রণা টের পেল আমীর। একবুক অস্থিরতা নিয়ে বেরিয়ে গেল হাসপাতাল থেকে। গাড়িতে উঠে বসল। উদ্দেশ্যহীনভাবে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে কোথায় যে চলে গেল তা কেউ জানল না!

চলবে

®Sidratul মুন্তায

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
২৪.
তোহার চোখ দু’টো তখন থেকে এদিক-ওদিক ঘুরছে। ঘুম থেকে জাগার পরেই যে সে একটা নির্দিষ্ট মানুষের খোঁজে বিচলিত তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রানু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,” কাউকে খুঁজছো নাকি?”

তোহা অপ্রস্তুত স্বরে বলল,” উনি কি আসেননি?”

” আবির?”

তোহা মাথা নাড়ল। রানু হেসে বলল,” কেন আসবে না? খবর দেওয়া মাত্রই ছুটতে ছুটতে এসেছে। ”

তোহার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। রানু আরও বলল,” তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে আবির কিন্তু তোমার বেডের পাশেই বসেছিল ঘণ্টাখানেকের মতো।”

এবার বিস্মিত হলো তোহা। মুহূর্তেই তার চোখে-মুখে একটা ঝলমলে স্রোত প্রবাহিত হলো। অবিশ্বাসী কণ্ঠে শুধালো” সত্যি?”

” অবশ্যই সত্যি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে বাইরে ফয়সালরা দাঁড়িয়ে আছে ওদের জিজ্ঞেস করো।”

তোহার লজ্জা লাগছে। সে ঘুমের মধ্যে টের পেয়েছিল কেউ একজন তার পাশে বসে আছে। তার সাথে কথা বলছে। সে ভেবেছিল কল্পনা। কিন্তু সত্যি তখন আমীর ছিল। তোহা সামান্য উদগ্রীব হয়ে বলল,” এখন উনি কোথায়?”

” জানি না কোথায়। অনেকক্ষণ ধরে তো দেখছি না। তোমার জেগে ওঠার খবর শুনলেই তো চলে আসার কথা। দাঁড়াও খুঁজে দেখছি।”

রানু উঠে বাইরে গেল। ফয়সাল আর ওমর দাঁড়িয়ে আছে কেবিনের সামনে। তাদের কাছে আমীরের ব্যাপারে জানতে চাইলেই তারা বলল,” স্যার তো চলে গেছেন আন্টি।”

” চলে গেছে মানে?কোথায় গেল? কি এমন জরুরী কাজ পড়ল যে এখনি যেতে হলো?”

ফয়সাল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” জানি না। স্যার কাউকে কিছু না বলেই হঠাৎ চলে গেছেন। ”

রানু যথেষ্ট বিরক্ত হলো। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,” এইটা কোনো কথা? ফোন দাও। জিজ্ঞেস করো ও কোথায় আছে। নাহলে আমাকে ধরিয়ে দাও। আমিই কথা বলব। ”

ফয়সাল আমীরের নাম্বারে ডায়াল করল। কিন্তু আমীর ফোন কেটে দিচ্ছে বার-বার। ফয়সাল ঠোঁট উল্টে বলল,” স্যার তো ফোন ধরছেন না।”

ভেতর থেকে তাদের কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। তোহার সদ্য খুশি হওয়া মনটা দপ করে নিভে গেল। উপর থেকে স্নেহাকে নামতে দেখা যাচ্ছে৷ তাকে দেখেই রানু গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” এই মেয়ে এখানে কি করছে? ও এখনও যায়নি কেন?”
স্নেহা মৃদু হেসে সামনে এগিয়ে এলো। রানুর উদ্দেশ্যে বলল,” আমাকে কিছু বলছেন আন্টি?
রানু জবাব দিল না। দৌড়ে এলো রাশেদ। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। স্নেহাকে সহীহ-সালামতে দেখে যেন খুশির বৃষ্টি নামল মনে।

” ম্যাডাম আপনি ঠিকাছেন? আমি তো অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম। আপনার কিছু হলো কি-না!”

স্নেহা আঁড়চোখে তোহার কেবিনের দিকে তাকাল। আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল,” আমাকে নিয়ে ভয়ের কিছু নেই রাশেদ। এখন থেকে আমি আর কাউকে ভয় পাবো না। বরং সবাই শুধু আমাকে ভয় পাবে।”

রাশেদ ভ্রু কুচকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল। রহস্যময়ী স্নেহার ধাঁধার মতো কথা অনেক সময়ই তার মাথায় ঢোকে না। রানু বিড়বিড় করে বলল,” বেহায়া মেয়ে মানুষ। ”

স্নেহা তোহার দিকে চেয়ে কেমন গা শিরশিরানি হাসি হাসছে। তোহার অসহ্য লাগে এই মহিলাকে। সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। খুব রাগ হচ্ছে। মানুষ এতো কেয়ারলেস হয়? প্রথমে আমীর তাকে স্নেহার কাছে একা রেখে চলে গেল। তারপর এতোবড় একটা ঘটনা ঘটল তবুও সে আবারও একই কাজ করল। হুট করে বের হয়ে কোথায় যেন চলে গেল। স্নেহা তো এখানেই আছে। যদি আবারও তার কোনো ক্ষতি করে? সেই খেয়ালটুকুও কি আমীরের নেই? সে এমন কেন?
রানু ভেতরে এসে তোহার পাশে বসল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” তোমার কি ক্ষিদে পেয়েছে মা? কিছু নিয়ে আসবো?”

” না আন্টি। আমরা বাসায় কখন যাবো?”

” এইতো। একটু পরেই যাবো।”
তোহাকে রিলিজ দেওয়া হলো রাত আটটায়। ফয়সাল আর ওমর তাদের বাড়ি পৌঁছে দিল। আমীরের তখনও কোনো খোঁজ নেই। একবার ফোন পর্যন্ত করেনি। রানু রান্নাঘরে নৈশভোজের আয়োজন করতে ব্যস্ত। তোহা এই ফাঁকে রানুর ফোন থেকে আমীরের নাম্বারে ডায়াল করল। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর অবশেষে আমীর ফোনটা ধরল। ফোনের ওইপাশ থেকে তার জড়ানো এবং ক্লান্ত কণ্ঠ ভেসে এলো।

” হ্যালো, রানু আন্টি।”

” রানু আন্টি না। আমি তোহা বলছি।”

সিটে মাথা হেলিয়ে শুয়ে ছিল আমীর। তোহার সুস্পষ্ট কণ্ঠ শুনেই চমকে উঠল। সোজা হয়ে বসে বলল,” কে?”

” তোহা। চিনতে পেরেছেন? নাকি নামও ভুলে গেছেন?”

আমীর গম্ভীর হয়ে বলল,” ভুলিনি। বলো।”

” আপনি কোথায় আছেন? এতোক্ষণ ফোন কেন ধরছিলেন না? রানু আন্টি আপনাকে নিয়ে কত টেনশন করছে সেটা কি জানেন?”

আমীর কাঠখোট্টা শুকনো গলায় বলল,” রানু আন্টি আমাকে নিয়ে কেন টেনশন করবে?”

” বাঃ রে… টেনশন করবে না? এতোক্ষণ ধরে কোনো খোঁজ নেই আপনার।”

“আমার জন্য এসব নরমাল ব্যাপার। রানু আন্টির অভ্যাস হয়ে গেছে। এতো ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে আর টেনশন করে না সে।”

তোহা চুপ করে গেল। মিথ্যাই তো বলেছে সে। রানুর আমীরকে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। বরং সে রেগে আছে আমীরের উপর। কেন না বলে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল। অন্যদিকে তোহারই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমীরের জন্য। তাই টিকতে না পেরে ফোন দিয়েছে। ভেতরটা কেমন হাঁসফাঁস লাগছিল। আমীরের কণ্ঠ শুনে এখন ভালো লাগছে।

আমীর প্রশ্ন করল,” তোমরা হাসপাতাল থেকে ফিরেছো কখন?”

” এইতো কিছুক্ষণ আগে। আপনি তো একটা ফোনও দিলেন না।”

” ফোন দেওয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি।”

” ও তাই? আপনি কি আমার সাথে দেখা করতেও আসবেন না?”

” সেটারও কোনো প্রয়োজন দেখছি না।”

” আরে, আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন? কি হয়েছে আপনার?”

” আমার কি হয়েছে তা আমি নিজেও জানি না। রাখছি।”

আমীর ফট করে ফোন রেখে দিল। সে আছে একটা নির্জন জায়গায়। গাড়ি থামিয়ে এমন একটা জায়গায় কেন বসে আছে সেই উত্তর তার নিজের কাছেও নেই। শুধু একা থাকতে ভালো লাগছে। আমীর পুনরায় ড্রাইভিং শুরু করল উদ্দেশ্যহীনভাবে। কিছুদূর এগোতেই দেখল সামনে একটা বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকবার হর্ণ বাজানোর পরেও গাড়িটি নড়ল না। আমীর নেমে দেখতে গেল। তখনি পেছন থেকে দু’জন হাট্টা-গোট্টা মানুষ আক্রমণ করল তার উপর। আমীরও পাল্টা আক্রমণ করতে ভুলল না। কিন্তু বেশিক্ষণ তাদের সাথে লড়াই করা গেল না। গাড়ি থেকে নেমে এলো আরও পাঁচজন। তাদের হাতে পিস্তল ছিল, ছুরিও ছিল।

__________
আমীর ফোন রেখে দেওয়ার পর তোহা বোকার মতো ফোনটা হাতে নিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। রানু ডাইনিংটেবিলে খাবার পরিবেশন করার সময় তোহাকে ডাকল।তোহা এসে দেখল অনেক আয়োজন। কিন্তু তার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। রানু বলল, “কাল থেকে এই একটা জামাই পরে আছো। এবার একটু চেঞ্জ-টেঞ্জ করো।”

” আমি তো পরার মতো কোনো জামা সাথে আনিনি।”

” ওহ…আমার কাপড়ও তোমার লাগবে না। আচ্ছা এদিকে এসো।”

তোহাকে নিয়ে দুইতলার একটা ঘরে ঢুকল রানু। ঘরটা তালা দেওয়া ছিল। চাবি দিয়ে খুলে নিতে হলো। কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ ছড়িয়ে আছে ঘরের চারদিকে। মনে হয় অনেকদিন ধরে কেউ আসে না এখানে। তোহা দেয়ালে টাঙানো একটা ছবি দেখে থেমে গেল। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল,” এটা কে?”

রানু মুচকি হেসে বলল,” আবিরের মা। খুব সুন্দরী তাই না?”

তোহা অবাক হয়ে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইল। আসলেই খুব সুন্দরী তিনি। এটাই কি তাহলে অনন্যা চৌধুরী? তোহা প্রশ্ন করতে নিয়েও করল না। রানু যদি জিজ্ঞেস করে আমীরের মায়ের নাম সে কিভাবে জানল তাহলে উত্তর দিতে পারবে না। হঠাৎ ডায়েরীটার কথা মনে পড়ল তোহার। ডায়েরীর কিছু অংশ এখনও পড়া বাকি৷

রানু একটা বড় কাঠের আলমারী খুলল। রঙ-বেরঙের শাড়িতে পরিপূর্ণ আলমারীটি। তোহা মুগ্ধ হয়ে বলল,” ওয়াও, এতো শাড়ি?”

” এগুলো সব অনন্যার। আবির যত্ন করে তুলে রেখেছে। এই ঘরে সে কাউকে ঢুকতে দেয় না। তবুও আজ আমি ঢুকেছি। কেন বলোতো?”

” কেন?”

রানু তোহার কাঁধে হাত রেখে বলল,” কারণ আমি তোমাকে অনেক কিছু বলতে চাই আজকে। বাড়িতে শুধু তুমি আর আমি আছি। কথাগুলো বলার জন্য এর থেকে ভালো সুযোগ আর হবে না।”

রানু যেই কথাগুলো বলতে চায় তার প্রায় সবকিছুই তোহার জানা। তবুও সে আগ্রহ নিয়ে দ্বিতীয়বার সবকিছু শুনল। ছোট্ট আমীর আর অনন্যার ছবিও দেখল৷ কিছু ছবি দেখে তোহার চোখ ছলছল করে উঠল। রানু খুব অনুরোধ করে বলল,” তুমি আবিরকে বিয়ে করো তোহা।”

আচমকা এমন প্রস্তাব শুনে তোহা থতমত খেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” এগুলো কি বলছেন? উনি তো আগেই বিবাহিত।”

রানু রাগী কণ্ঠে বলল,” কিসের বিবাহিত? তোমাকে সকালেই না বললাম? ওদের ওই বিয়ে কোনো বিয়েই না। তাছাড়া আবিরও স্নেহাকে পছন্দ করে না। ডাইনিটা ব্লেকমেইল করে আবিরের সঙ্গে আছে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলোতো, আবিরকে তুমি পছন্দ করো না? মিথ্যা বলবে না কিন্তু।”

তোহা হতাশ গলায় বলল,” এটা সম্ভব না আন্টি।”

” সম্ভব নাকি অসম্ভব সেটা পরে দেখা যাবে। তুমি আগে বলো আবিরকে পছন্দ করো কি-না।”

রানু চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল উত্তরের আশায়। তোহা দূর্বল গলায় বলল,” না।”

” মিথ্যা কথা বলছো কেন? বুঝেছি স্নেহাকে ভয় পাচ্ছো।”

” আমি কাউকে ভয় পাই না রানু আন্টি। স্নেহা আমার সাথে কি করবে? বড়জোর ও আমাকে মে-রে ফেলতে চাইবে। আর ম-রতে পারলে আমিও খুশি। আমার বেঁচে থাকার সব কারণ শেষ হয়ে গেছে। এই দুনিয়ায় আমার কেউ নেই।”

তোহার কণ্ঠ চেপে এলো। চোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ হলো। রানু শাসনের সুরে বলল,” এই ধরণের কথা আর কখনও বলবে না। তাহলে কিন্তু মার খাবে আমার হাতে।”

তোহা মৃদু হাসল। রানু নরম গলায় বলল, ” আবির বিপদে আছে। অনেক বড় ভুল করেছে ওই মেয়েকে বিয়ে করে। আর তুমিও কষ্টে আছো। আমি চাই তুমি ওকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনো। তোমরা দু’জন-দু’জনের জন্য একদম পারফেক্ট। ওর যেমন তোমাকে প্রয়োজন তেমনি তোমারও ওকে প্রয়োজন। বোঝার চেষ্টা করো লক্ষী মেয়ে। নিষেধ কোরো না। আমি জানি তুমি এটা পারবে। আমার এই একটা অনুরোধ রাখো।”

তোহা কি বলবে ভেবে পেল না। রানু আলমারির কাছে গিয়ে বলল,” এখান থেকে পছন্দমতো একটা শাড়ি নিয়ে তুমি পরো।”

” কি বলছেন? আমি এই শাড়ি পরব?”

” পরলে কি হয়েছে? ব্লাউজও তোমার লাগার কথা। একটু ঢিলে হলেও লাগবে। নিজের শাশুড়ীর শাড়ি ভেবে পরে ফেলো।”

তোহা হেসে ফেলে বলল,” উনি আমার শাশুড়ী না।”

” একদিন হতেও পারে। বলা যায় না।”

তোহা আলমারি থেকে একটা লাল শাড়ি তুলে নিল।

___________
বাইরে খুব ঝড়ের দাপট। আমীর আহত অবস্থায় ড্রাইভ করতে করতে বাংলোর সামনে এসে থামল। সে এখানে কেন এসেছে তা নিজেও জানে না। দারোয়ান আমীরের গাড়ি দেখেই গেইট খুলে দিল। তোহার ঘুম আসেনি। লিভিংরুমে বসে ডায়েরীটা পড়ছিল। বাতাসে জানালা দু’টো বার-বার বারি খাচ্ছে। পর্দা উড়ছে। ধূলো প্রবেশ করছে ঘরে। তোহা জানালা লাগাতে এসে দেখল বাইরে একটা কালো ছায়া হেঁটে এদিকেই আসছে। প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরিচিত অবয়বটি চিনতে অসুবিধা হলো না তার। কিন্তু আমীর এমন খুঁড়িয়ে হাঁটছে কেন? তার কি কিছু হয়েছে? তোহা দৌড়ে বাইরে ছুটে গেল। আমীরকে কাছ থেকে দেখে বুঝতে পারল সে মারাত্মক আহত হয়েছে। তার কপালে, পিঠে, ঠোঁটের কোণায় রক্তা-ক্ত জখমের দাগ। তোহা বিচলিত গলায় বলল,” কি সর্বনাশ! আপনার এই অবস্থা কিভাবে হলো?”

” রানু আন্টি কোথায়?”

” উনি তো শুয়ে পড়েছেন। আচ্ছা আমি ডেকে দিচ্ছি। আপনি আগে ভেতরে আসুন।”

” ডাকার দরকার নেই।”

” কি বলছেন? আপনার অবস্থা তো খুব খারাপ। এসব কিভাবে হলো?”

” তুমি জেনে কি করবে? ছাড়ো আমাকে। আমি একাই যেতে পারব।”

” আপনি তো হাঁটতেও পারছেন না।”

” দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।”

তোহা আমীরকে ছেড়ে দিল। আমীর একপায়ে ভর দিয়ে কোনোমতে হেঁটে দুইতলায় নিজের ঘরে গেল। কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল তোহা। তারপর রান্নাঘরে ঢুকল। ফ্রীজে খাবার আছে। সেগুলো গরম করে নিল আমীরের জন্য। মানুষটা নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত।

আমীর খালি গায়ে বসে আছে বিছানায়। পিঠের যে অংশে জখমের দাগ সেখান থেকে র-ক্ত পড়ছে। তোহা কাছে গিয়ে বলল,” অনেকটা কে-টে গেছে দেখছি। আপনি এখানে কিছু বাঁধছেন না কেন? এতোবড় বাড়িতে কি ফার্স্ট এইড বক্সও নেই?”

আমীর ঘুরে তাকিয়ে রুক্ষতা যুক্ত গলায় বলল,” তুমি এখানে কি করছো?”

তোহা মাথা নত করে জবাব দিল,” আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। ক্ষিদে পায়নি আপনার?”

আমীর খাবারের প্লেটের দিকে একপলক তাকালো। তারপর আচমকা প্লেটটি উল্টে ফেলে দিয়ে বলল,” আমার ক্ষিদে পেয়েছে এই কথা আমি কখন বললাম? এতো বেশি বোঝো কেন?”

তোহা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। কাঁচের প্লেট মেঝেতে পড়ে ভেঙে খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেছে। তোহা আশ্চর্য কণ্ঠে শুধালো,” আপনি এতো অভদ্র কেন?”

আমীর কটমট করে বলল,” অভদ্রের কাছে এসেছো কেন তাহলে? বের হয়ে যাও। গেট লস্ট।”

” আমারও এখানে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই। ভুল হয়েছে যে আপনার খেয়াল রাখতে এসেছিলাম।”

তোহা হনহনিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রাগে শরীর পুড়ে যাচ্ছে তার। সে রীতিমতো কাঁপছে। এটা কেমন মানুষ? মেজাজের কোনো লাগাম নেই! তোহা কাউচে বসে অযথাই কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করল। প্রচুর অভিমান হলো আমীরের উপর। সে ঠিক করল ম-রে গেলেও আর আমীরের সামনে যাবে না। কিন্তু নিজের এই সিদ্ধান্তে বেশিক্ষণ অটল থাকতে পারল না সে। মাঝরাতে হ্যাঙলার মতো আবারও গিয়ে হাজির হলো। আমীর তখন বিছানায় উল্টো হয়ে ঘুমাচ্ছে। পিঠের ক্ষত-বিক্ষত অংশটা দেখা যাচ্ছে। তোহা দেখল মেঝেতে প্লেটের টুকরো আর খাবার পরিষ্কার করা হয়েছে। আমীর নিজেই হয়তো করেছে। তোহা এই সময় এখানে কেন এসেছে সে জানে না। বিছানার একপাশে বসল চুপচাপ।

আমীরের কপালে হাত ছোঁয়াতেই বিস্ময়ে শিউরে উঠল সে। কি গরম! মনে হচ্ছে গায়ে তীব্র জ্বর। এজন্যই বুঝি এতো মুষড়ে পড়েছে মানুষটা? তোহার খুব দুঃখ হলো। রানু আন্টিকে ডেকে এনে দেখাবে নাকি? নিশ্চয়ই দেখানো উচিৎ। তোহা উঠে যাওয়ার কথা ভাবছিল আর তখনি আমীর চেপে ধরল তার হাত। কাতর কণ্ঠে কেমন দূর্বলের মতো বলে উঠল,” মা, আমার মা কোথায়?”

তোহার কান্না পেয়ে গেল। সে এই মুহূর্তে যে লাল টুকটুকে শাড়িটা পরে আছে সেটা অনন্যার শাড়ি। তখন আমীর প্লেট উল্টে ফেলে দেওয়ায় ঝোল লেগে তোহার জামা নোংরা হয়ে গেছিল। সেজন্যই বাধ্য হয়ে শাড়িটা পরতে হয়েছে। এই শাড়ির গন্ধ পেয়েই কি আমীরের তার মায়ের কথা মনে পড়েছে? তোহা আর উঠল না। চুপচাপ বসে রইল আমীরের শিয়রে। কিছুক্ষণের জন্য যদি সে মাকে মনে করে ভালো থাকতে পারে তাহলে ক্ষতি কি? তার পিঠের যে জায়গাটায় জখমের দাগ সেখান থেকে এখনও র-ক্ত পড়ছে অবিরাম। মানুষটা নিজের প্রতি এতো উদাসীন কেন? তোহা তার শাড়ির আঁচল চেপে ধরল জখমের জায়গায়। তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভূত হওয়ায় সামান্য চেঁচিয়ে উঠল আমীর। তোহা অনুনয় করে বলল,” আই এম স্যরি।”

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আমীরের। তোহাকে দেখেই একটানে বিছানায় চিৎ করে শুয়িয়ে গলা চেপে ধরল। ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেল তোহা। আতঙ্কে অস্থির হয়ে বলল,” কি করছেন? আমাকে ছাড়ুন। আমি তোহা। আপনার শত্রু না।”

আমীর ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকেই ছেড়ে দিল। তোহা সোজা হয়ে উঠে বসল। আমীর অপলক তাকিয়ে রইল লাল শাড়ি পরিহিত তোহার স্নিগ্ধ মুখের দিকে। তাকে ঠিক মায়াদেবীর মতো লাগছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মোহনীয় মিষ্টি একটা মেয়ে মাঝরাতে এমন লাল শাড়ি পরে তার মাথার কাছে বসে থাকবে এটা একমাত্র কল্পনাতেই সম্ভব। তোহা উঠে যেতে নিলেই আমীর হাত দিয়ে বেরিকেডের মতো আটকে ফেলল তাকে।

আমীরের এমন আচরণে বিস্মিত হলো তোহা। আমীর তার চিবুক উপরে তুলে বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে রইল। ওই গভীর রহস্যময় দৃষ্টির এতো কাছাকাছি উপস্থিতি তোলপাড় করে দিল তোহার ভেতরটা। সে কাঁপতে লাগল তিরতির করে। নিঃশ্বাস এলোমেলো হয়ে এলো। শ্বাসরুদ্ধকর অস্থিরতায় কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আমীর ক্রমান্বয়ে কাছে এলো। কাটল কিছু নৈসর্গিক মুহূর্ত। তারপর, আমীর তোহার মসৃণ ঠোঁটের স্পর্শে নিজেকে বিলীন করে দিল। জোরালো বাতাসের ধাক্কায় জানালা খুলে যায়। সেই শব্দে আমীর সম্বিৎ ফিরে পেলো। দ্রুত তোহাকে ছেড়েই দূরে সরে বসল। তোহা ছাড়া পাওয়া মাত্রই এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

আমীর স্থবির হয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। যে ব্যাপারটাকে সে কল্পনা ভেবেছিল আদতে তা মোটেও কল্পনা নয়। এই বোধ জাগ্রত হতেই নিজের প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হলো আমীর। ড্রেসিংটেবিলের আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজেকে দেখে রাগ আরও বেড়ে গেল তার। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” কি চাও তুমি? কেন করলে এটা? হোয়াই?”

আমীর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার প্রতিবিম্বে আঘাত করল। কাঁচের আয়না ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল আর রক্তা°ক্ত হলো আমীরের হাত। তোহা ঘরে এসে দরজা আটকে দিল। তারপর দরজায় পিঠ ঠেঁকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। এইমাত্র যেটা ঘটে গেল সেটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব এখনও বুঝতে পারছে না সে। তোহা মেঝেতে বসে দুইহাত দিয়ে ঠোঁট মুছল। চোখের জল মুছল।

চলবে

®Sidratul মুন্তায

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
২৫.
আমীর এতোটা বেচাল কি করে হলো? তার দ্বারা এমন ভুল কিভাবে হলো? নিজের প্রতি নিজের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই এতোদিন সে জানতো। তবে আজ সে এমন বেপরোয়া কাজ কিভাবে করল? চিন্তায় আর অস্থিরতায় সারারাত একফোঁটা ঘুম এলো না।তোহা নিশ্চয়ই আমীরকে খুব খারাপ ভাবছে। ও কি এখন থেকে ঘৃণা করবে আমীরকে? এভাবে দৌড়ে কোথায় গেল? আমীরের কি এখনি গিয়ে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ একবার? দ্বিধা-দ্বন্দে কেটে গেল রাত।

ভোরে রানু এসে আমীরের ঘরের অবস্থা দেখে হতভম্ব। ড্রেসিংটেবিলের আয়না ভেঙে পড়ে আছে। আমীরের হাতে ব্যান্ডেজ। কপালে, গালে আর ঠোঁটে জখম। চোখ দু’টি ফুলে লাল টকটকে দেখাচ্ছে। তার এমন করুণ অবস্থা দেখে রানু বিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” এসব কি বাবা? তোর এই অবস্থা কেন?”

আমীর বিবশের মতো বলল,” আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি রানু আন্টি।”

” কি ভুল করেছিস?” আমীর নিরস কণ্ঠে বলল,” না, কিছু না।”

” কিছু না মানে? ড্রেসিংটেবিলটা ভাঙল কিভাবে? নিজের সাথে কি করেছিস এসব তুই?” রানু অস্থির হয়ে উঠল।

আমীর কোনো উত্তর দিল না। নির্ণিমেষ দেয়ালের দিকে চেয়ে কি যেন ভাবতে লাগল৷ রানু ফার্স্ট এইড বক্স বের করল। আমীরের কপালের ক্ষত, গালের কাটা দাগ, ঠোঁটের কোণায় তুলো দিয়ে স্যাভলন ঘঁষতে ঘঁষতে বলল, “কাদের সাথে লেগেছিলি? তোকে এতো বলি সাবধানে থাকবি তাও কি তোর হুশ হয় না? কোনদিন যেন দেখবো রাস্তায় ম-রে পড়ে আছিস। নিজের জীবনের প্রতিও কি একটু মায়া নেই তোর?”

” আমি জানি না ওরা কারা ছিল। হঠাৎ এসে আক্রমণ করল আমার উপর। প্রথমে ভেবেছিলাম ছিনতাইকারী। কিন্তু ওরা টাকা-পয়সা কিছু নেয়নি। শুধু মার-ধোর করে চলে গেছে।”

” কি সাংঘাতিক ব্যাপার! অনেক মানুষ ছিল নিশ্চয়ই? ”

” তা তো ছিলই।”

” সেজন্যই বলি, সামান্য কয়েকটা ছোঁকরার পক্ষে তো আর আমার শক্তিশালী ছেলেকে হারানো সম্ভব না।”

রানু খুব গৌরব করে কথাটা বলল৷ ব্যথার জায়গায় স্যাভলন পড়তেই তীক্ষ্ণ জ্বলুনি অনুভব করল আমীর। মৃদু চেঁচিয়ে উঠল। রানু ফু দিয়ে বলল,” তোহার থেকে যখন শুনলাম রাতে তুই আহত অবস্থায় বাড়ি ফিরেছিস তখন তো খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম৷ তুই নাকি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিস?”

” ও কি তোমাকে কিছু বলেছে?” আমীর সতর্ক কণ্ঠে প্রশ্নটা করল। রানু বলল,

” তেমন কিছু বলেনি। শুধু বলেছে তুই অভদ্রতা করেছিস।”

আমীর তাচ্ছিল্য হাসল,” অভদ্র মানুষ তো অভদ্রতাই করবে।”

” কি এমন অভদ্রতা করেছিস যে মেয়েটা এতো রেগে আছে?”

” রেগে আছে কি করে বুঝলে?”

” তোকে গালা-গাল দিচ্ছিল। আমি বললাম তোর জন্য কফি বানাতে তাও বানালো না। ও নাকি আর কখনও তোর সামনেই আসবে না।মেয়েটার সাথে এমন কেন করিস বলতো? ও কিন্তু অনেক সেন্সিটিভ।”

আমীর মুচকি হেসে বলল,” সামনে না আসাই তো ভালো। ”

” তোদের ব্যাপার-স্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। যাইহোক, আমি কিন্তু তোহাকে অনন্যার একটা শাড়ি দিয়েছি। ওর পরার মতো কোনো জামা ছিল না।”

আমীরের স্মৃতিতে পুনরায় ভেসে উঠল তোহার বেড়ালের মতো আদুরে মুখটি। লাল শাড়িতে কি চমৎকার মিষ্টি দেখাচ্ছিল তাকে! একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল,” হুম দেখেছি। মায়ের শাড়িতে ওকে সুন্দর লাগছিল।”

রানু আগ্রহী কণ্ঠে বলল,” তাই না? আমারও অনেক ভালো লেগেছে। সকাল সকাল ওকে দেখেই আমি খুশি হয়ে গেছি। মনে হচ্ছে রোজ যদি এরকম একটা জ্যান্ত পুতুল শাড়ি পরে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতো তাহলে মন্দ হতো না। আবির শোন একটা কথা বলি তোকে। তুই কিন্তু আবার রাগ করিস না।”

আমীর হয়তো কথাটা বুঝতে পারল। আগেই গম্ভীর হয়ে শুধাল,” কি কথা?”

তোহা কফি নিয়ে আমীরের ঘরে প্রবেশ করল। তাকে দেখে রানু আর কথাটা বলে উঠতে পারল না। তোহা একপলক আমীরের দিকে চেয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। শুকনো গলায় বলল,” আমার রুটি গোল হচ্ছে না রানু আন্টি। আপনি একটু এসে দেখলে ভালো হয়।”

” ওমা, তুমি আবার রুটি বেলতে গেলে কেন? আমি তো আসছিলামই। আবির, কফি খেয়ে নিচে আয় বাবা।”

রানু উঠতে নিয়ে আবার বসল। তোহার শাড়িটার দিকে চেয়ে বলল,” আজকে ওকে নিয়ে একটু শপিংয়ে যা আবির। মেয়েটার একটাও জামা নেই। শাড়ি পরে কতক্ষণ থাকা যায়?”

আমীর কিছু বলার আগেই তোহা রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠল,” আমি কোথাও যাবো না।”

” কেন? না গেলে তোমার চলবে কিভাবে?” রানু প্রশ্ন করল। তোহা মুখ ভার করে বলল,

” আমি গেলে আপনার সাথে যাবো আন্টি। অন্যকারো সাথে যাবো না।”

আমীর এই কথা শুনে অন্যদিকে চেয়ে হাসল। সে জানে তোহা এসব কেন বলছে! রানু চোখ বড় করে একবার আমীরের দিকে তাকালো তো একবার তোহার দিকে। পরমুহূর্তেই বলল,” ও বুঝেছি৷ কালরাতের ওই ঘটনার জন্য এখনও রেগে আছো তাইতো? আবির, ওকে স্যরি বল বাবা।”

আমীর তোহার দিকে তাকিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলল,” আই এম স্যরি!”

তোহা সরু চোখে চাইল। রাগে মুখ শক্ত হয়ে উঠল তার। রানু বলল,” এবার হয়েছে? ”

তোহা হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে তাকাল। কঠিন গলায় বলল,” একদম না। স্যরিতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না আন্টি। আর এইটা তো অনেক বড় সমস্যা।”

রানু বিস্মিত হলো। একটু উদগ্রীব হয়ে বলল,” কি এমন সমস্যা আমাকে কি বলা যায়? তাহলে আমি সোলভ করে দিচ্ছি। বলো ও তোমার সাথে কি করেছে যে তুমি এমন রেগে ঢোল হয়ে আছো?”

তোহার জবান বন্ধ হয়ে গেল। গালের রঙ লালচে দেখালো। আমীর ঠোঁট টিপে বলল,” আমিও বুঝতে পারছি না৷ আমি কি এমন করেছি?”

তোহা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকাল। মানুষটা কেমন খাটাশ! আঙুল উঠিয়ে বলল,” মানে? আপনি ভুলে গেছেন?”

আমীর ঠোঁট উল্টাল। যেন সে সত্যি ভুলে গেছে।

রাগে ফুঁসে উঠল তোহা। রানুর দিকে তাকিয়ে বলল,” আন্টি উনার কিন্তু সব মনে আছে। উনি আপনার সামনে ঢং করছে।”

” কি অবস্থা! ঢং কেন করবে? আচ্ছা তুমি বলেই দাও তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।”

আমীর নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল,” তাইতো, তুমি বলছো না কেন? বলো, কি করেছি আমি?”

তোহার মুখমন্ডল লাল হয়ে এলো। ল্যাম্পশেডের পাশে একটা ছোট্ট টেবিলের উপর কফির কাপটা শব্দ করে রাখল সে। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে বলল,” আপনি সত্যিই একটা অভদ্র।”

রানু পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত মীমাংসায় এলো,” বুঝেছি। ও নিশ্চয়ই খুব অভদ্র কাজ করেছে। যেটা তুমি বলতেও পারছো না আবার ভুলতেও পারছো না। তাহলে তুমি বরং ওর অভদ্র কাজটা ওকে ফিরিয়ে দাও। ও যেটা করেছে তুমি তার চেয়েও অভদ্র কিছু করো। শোধবোধ হয়ে গেল।”

আমীর হেসে ফেলল এই কথায়। তোহা লজ্জায় হতভম্ব বনে গেল। রানু উঠতে উঠতে বলল,” আমার এখানে বসে থাকলে চলবে না। আমি যাচ্ছি আমার কাজে। তোমরা দ্রুত ঝামেলা মিটিয়ে খেতে এসো।”

রানু চলে যেতেই আমীরের হাসিমুখের দিকে চেয়ে তোহা কটমট করে বলল,” আমি আপনার নামে পুলিশের কাছে কমপ্লেইন করব। তারপর সব মনে পড়বে আপনার। অসভ্য লোক!”

আমীর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” কি নিয়ে কমপ্লেইন করবে? আমি কি কোনো ক্রাইম করেছি?”

” অবশ্যই ক্রাইম করেছেন।” তোহা একটা উত্তপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যেতে নিলেই আমীর পিছু ডাকল,” শোনো।”

তোহা দাঁড়াল কিন্তু ফিরে তাকাল না। আমীর ইতস্তত করে বলল,” স্যরি…. রানু আন্টির সামনে এতোক্ষণ মিথ্যা বলছিলাম। আমার সব মনে আছে। আর আমি আমার কাজের জন্য লজ্জিত। এরকম আর কখনও হবে না।”

তোহা রাগী দৃষ্টিতে তাকাল এবার,” আমি জানতাম। আপনি আস্তো নাটকবাজ। আর স্যরি বললেই আমি সব ভুলে যাবো কেন? আমাকে আপনার কি মনে হয়? আমি কি কোনো পণ্য যে যখন ইচ্ছা স্পর্শ করবেন আর স্যরি বলেই পার পেয়ে যাবেন? এতোই সহজ?”

আমীর বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল তোহার রাগান্বিত মুখের দিকে। বড় বড় কঠিন চোখেও মায়াবী লাগছে তাকে। তোহার মোহে আমীর আবারও বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” দেখো আমি ইনটেনশনালি কিছুই করিনি।”

” ইনটেনশনালি করেননি মানে? আপনাকে কেউ জোর করেছিল নাকি?”

” না। কিন্তু..”

” থাক, আর এক্সকিউজ দিতে হবে না। আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।”

তোহা বের হয়ে গেল। তার ছেলেমানুষী অভিমানী আচরণ দেখে আমীর না হেসে পারল না। মনে মনে বলল,” কিউট।” অন্যমনস্ক হয়ে কফিতে চুমুক দিতে নিয়ে আমীরের ঠোঁট পুড়ে গেল। সে হাত দিয়ে স্পর্শ করল নিজের ঠোঁট। এই ঠোঁটে এখনও তোহা লেগে আছে।

_________________
সকাল সকাল মুড খারাপ হওয়ার জন্য স্নেহার একটা ফোনকলই যথেষ্ট। না চাইতেও আমীরকে ফোনকলটা রিসিভ করতে হবে। নাহলে দেখা যাবে স্নেহা বার-বার ফোন করবে এবং একসময় এখানেও চলে আসতে পারে। আমীর কোনোভাবেই আর রিস্ক নিতে চায় না। যেখানে তোহা আছে সেখানে স্নেহার উপস্থিতি মাত্রই বিপজ্জনক!

” হ্যালো।”

স্নেহা আদুরে কণ্ঠে বলল,” জান, কোথায় তুমি? রাতে বাড়িতে আসোনি কেন?”

” আমি কখন কি করব তার সব কৈফিয়ৎ তোমাকে দিতে বাধ্য না। তুমি নিজের কাজের হিসাব রাখো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।” আমীর খুব বিনয়ের সাথে কথাটি বলল। স্নেহা বলল,

” বুঝেছি। এখনও তোহার ব্যাপারটা নিয়ে রেগে আছো তাই না? তুমি কি এখন ওর কাছেই আছো? রানু আন্টির বাড়িতে?”

আমীর হেসে ফেলে বলল,” আমি যেখানেই থাকি, তোমার তাতে কি?”

এমন সময় রানু এসে বলল,” বাবা আবির, তোহাকে নিয়ে শপিংয়ে গেলে এখনি বেরিয়ে পড়। ওয়েদারটা ভালো আছে। কিছুক্ষণ পর রোদ উঠে গেলে কিন্তু আর ভালো লাগবে না।”

আমীরের কানে মাইক্রোফোন ছিল সেটা রানু খেয়াল করেনি। তাই অবলীলায় শপিং-এর কথাটা বলে ফেলল। ওই পাশ থেকে এই কথা শুনে ব্রক্ষতালু জ্বলে উঠল স্নেহার।

” তুমি ওই মেয়েকে নিয়ে শপিংয়ে যাচ্ছো নাকি?” আমীর শান্ত ভঙ্গিতে বলল,” আমি যেখানেই যাই, যাকে নিয়েই যাই, নান অফ ইউর বিজনেস।”

কথাটা বলেই ফোন রেখে দিল সে। রানু জীভ কেটে বলল,” স্নেহা ছিল নাকি? আমি খেয়াল করিনি। সব কি শুনে ফেলল?”

” বাদ দাও ওর কথা।”

রানু একবার আশেপাশে তাকাল। তোহা এখানে নেই৷ রান্নাঘরে আছে। এই সুযোগে সে বলল,” তোকে একটা কথা বলব বাবা?”

” বলো।”

রানু আমীরের হাতের বাহু স্পর্শ করে গলায় সবটা অনুরোধ ঢেলে দিয়ে বলল,”তুই তোহাকে বিয়ে করে ফেল।”

তোহা রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছিল। বিয়ের প্রসঙ্গ শুনে আবার ভেতরে ঢুকে গেল। দেয়ালে পিঠ ঠেঁকিয়ে দাঁড়াল। আমীর বিস্মিত কণ্ঠে বলল,” মানে? তোমার কি মাথা ঠিকাছে?”

রানু কঠিন গলায় বলল,” মাথা আমার একদম ঠিকাছে দেখেই এই কথা বলছি। তুই ওর দিকে কিভাবে তাকাস সেটা তো আমি খেয়াল করেছি। ও যখন হাসপাতালের বেডে শুয়েছিল তখন তোর অবস্থাও আমি দেখেছি। উদভ্রান্তের মতো আচরণ করছিলি। ওর কাছে বসার জন্য নার্সের সাথে পর্যন্ত ঝগড়া শুরু করে দিলি। এমন পাগল হতে তোকে আমি কখনও দেখিনি। তবুও তুই বলবি ওকে তুই ভালোবাসিস না?”

আমীর থতমত খেল। অপ্রস্তুত হয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,” কি আজব কথা বলছো! মৃ-ত্যুর আগে ওর বাবা আমাকে ওর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। তাই ওর প্রতি আমার একটা রেসপন্সিবিলিটি আছে।”

” কোনটা রেসপন্সিবিলিটি আর কোনটা ভালোবাসা সেটা বোঝার বয়স আমার হয়েছে। তাছাড়া তুই আমার পেটের ছেলে না হলেও ছোট থেকে তোকে আমি মানুষ করেছি। তোর মনের কথা আমি বুঝব না এটা তো আর হতে পারে না। এতোটাও বোকা ভাবিস না আমাকে।”

আমীর বিরক্ত হওয়ার ভাণ ধরে বলল,” তুমি আমার মাথা ব্যথা করে দিচ্ছো। সকাল সকাল কি এক আজাইরা প্যাঁচাল শুরু করলে! তোমার কি আর কোনো কাজ নেই?”

” আমি আজাইরা প্যাঁচাল পারছি? প্রসঙ্গ চেঞ্জ করবি না। বল তুই ওকে ভালোবাসিস না?”

আমীর অন্যদিকে চেয়ে ত্যাড়া গলায় উত্তর দিল,” একদম না।”

” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল।”

” কি আশ্চর্য! আমি মিথ্যা বলবো কেন?”

” তুই মিথ্যুক। এজন্যই মিথ্যা বলবি।”

আমীর রানুর চোখের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,”এটা খুবই অসম্ভব ব্যাপার।”

” কেন অসম্ভব শুনি?”

” ও তো আমাকে সহ্যই করতে পারে না। তাছাড়া ও জানে আমি বিবাহিত।”

” স্নেহার সাথে তো তোর কোনো সম্পর্ক নেই। তোদের বিয়েটাও কোনো বিয়ে না। এইসব ও জানে।”

” তুমি এসব ওকে কেন বলতে গেছো?”

” ও যদি রাজি হয় তাহলে কি তুই রাজি হবি?”

আমীর অবাক হয়ে তাকাল,” ও কেন রাজি হবে? কি আশ্চর্য! ”

রানু আত্মবিশ্বাসের হাসি হাসল,” আশ্চর্য হওয়ার তো কিছু নেই। রাজি হতেই পারে! আমার ছেলে দেখতে তো কম সুদর্শন না।”

আমীর আতঙ্কিত হয়ে বলল,” তুমি ওকেও এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছো নাকি?”

” এখনও করিনি। কিন্তু তুই বললে এতোটুকু উপকার করতেই পারি।” রানু ইচ্ছা করেই মিথ্যা বলল। আমীর দুই হাত জড়ো করে মাথায় ঠেঁকিয়ে বলল,” লাগবে না আমার এতো উপকার। দয়া করে তুমি এই বিষয়ে কথা বলা বন্ধ করো।”

” ঠিকাছে বন্ধ করব। কিন্তু তার আগে বল, ওকে ভালোবাসিস তুই? সত্যি কথা বলে দে তাহলে আমিও আর জ্বালাবো না।”

আমীর হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল। রানুও নাছোড়বান্দা। উত্তর না শুনে সে যাবে না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। আমীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” ঠিকাছে বলব। কিন্তু পরে আর এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।”

” বললাম তো, তুই যদি সত্যি বলিস তাহলে আর জ্বালাবো না।”

আমীর না পারতেই বলল,” ভালোবাসা কি-না জানি না। কিন্তু ও আমার জীবনের সব সুখ-শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে। আমি এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারছি না। ওকে দেখলেই অদ্ভুত একটা জ্বালা হয় বুকে, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। মনে হয় মরে যাবো।”

রানু হাসতে হাসতে আমীরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,” এটাই তো ভালোবাসা, পাগল!”

আমীর কোনো কথা বলল না। মাথা নিচু করে রইল। সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। নিজের সর্বনাশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। অন্যদিকে আমীরের স্বীকারোক্তি শুনে তোহার শরীর ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসের শীতলতায় কেঁপে উঠল। রক্তের স্রোতে বয়ে গেল ধারালো একটা গা শিরশিরে লজ্জাময় অনুভূতি। অদ্ভুত ভালো-লাগায় মন আবেশিত হলো। রানুকে রান্নাঘরে আসতে দেখে তোহা আঁটসাঁট হয়ে দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে রইল। রানু তাকে লক্ষ্য করে বলল,” সব নিজের কানে শুনেছো তো?”

তোহা লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। মাথা নিচু করে ফেলল। রানু কাছে এসে তোহার চিবুক স্পর্শ করে বলল,” আমি চাই তোমরা অনেক সুখে থাকো। এখন থেকে আমি সবসময় করুণাময়ের কাছে একটাই প্রার্থনা করব। তিনি যেন খুব দ্রুত তোমাদের মিলিয়ে দেন।”

তোহা কিছু ভাবতে না পেরে রানুকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখ দিয়ে নামল অশ্রু। রানু হেসে ফেলল।

_________________
একটা পিচ রঙের পাতলা শাড়ি পরিয়ে রানু তোহাকে নিজের হাতে সাজালো। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে দিল। লিপ্সটিক ঠোঁটে লাগিয়ে দিল। তোহা কখনও গাঢ় লিপ্সটিক দেয় না। তার লজ্জা লাগে। সাজ-গোজে সে খুব একটা অভ্যস্ত নয়। সবসময় সিম্পল থাকে। কিন্তু এবার রানুর ধমক খেয়ে লিপ্সটিক দিতেই হলো। আমীর গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিল। তোহা এসে জানালায় টোকা দিতেই আমীর ওকে দেখে থমকে গেল কিছুমুহূর্তের জন্য৷ বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল সর্বোচ্চ হারে। মুগ্ধতায় ঠোঁট দু’টো বিভক্ত হলো। তোহা আরেকটু জোরে টোকা মারতেই আমীরের সম্বিৎ ফিরল। একটু হকচকিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল,” বসো।”

তোহা রাগী গলায় বলল,” আমি আপনার পাশে বসবো? অসম্ভব!”

” তাহলে কোথায় বসবে?”

“পেছনে বসবো।” তোহা চোখমুখ শক্ত করে বলল।

আমীর মৃদু হেসে পেছনের দরজা খুলে দিতে দিতে বলল,” এজ ইউর উইশ।”

তোহা পেছনেই বসল। আমীর সামনের লুকিং গ্লাসটা এমনভাবে রাখল যেন তোহাকে পেছন থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর তোহা লক্ষ্য করল আমীর লুকিং গ্লাসে তাকে দেখছে। তখন সাথে সাথেই শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। আমীর হেসে ফিসফিস করে বলল,” যতই চেষ্টা করো, আমার চোখের আড়ালে তুমি কখনোই যেতে পারবে না।”

গাড়ি থামল একটা বড় শপিং কমপ্লেক্সের সামনে। আমীর গাড়ি থেকে বের হয়ে পেছনের দরজা খুলে দিল। তারপর তোহা বের হলো। ঠিক এমন সময় আমীরের ফোন এলো। সে মোবাইল হাতে নিয়ে বলল,” এখানেই অপেক্ষা করো৷ আমি একটু আসছি।”

তোহা কোনো উত্তর দিল না। আমীর দূরত্বে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করল। ওই পাশ থেকে শোনা গেল সরবের আতঙ্কিত গলা,” স্যার, স্নেহা ম্যাডাম কিছুক্ষণ আগেই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন। সম্ভবত উনি আপনার কাছেই আসছেন।”

আমীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,” এই কথা তুমি আমাকে এখন জানাচ্ছো কেন? ও ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আমাকে ইনফর্ম করতে বলেছিলাম।”

” স্যরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে। স্যার আপনি এখন কোথায় আছেন?”

” সেটা তোমার জানার দরকার নেই। তুমি স্নেহার পেছনে গার্ড পাঠিয়েছো?”

” জ্বী স্যার।”

” ওকে। কীপ মি পোস্টেড।”

” ওকে স্যার।”

আমীর ফোনটা রেখে পেছনে ঘুরতেই দেখল তোহা নেই। কি আশ্চর্য! মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কোথায় উধাও হয়ে গেল মেয়েটা? আমীর উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিকে খুঁজতে লাগল। পথচারীদের থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,” পিচ রঙের শাড়ি পরা ছোট চুলের কোনো মেয়েকে দেখেছেন?”

কেউ উত্তর দিতে পারল না। রাগে আমীর একজন শরবত বিক্রেতার কলার চেপে ধরে বলল,” রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি করেন সারাক্ষণ যে একটা মেয়েকে পর্যন্ত দেখে রাখতে পারেন না?”

লোকটি থতমত খাওয়া দৃষ্টিতে তাকাল। আমীর পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” স্যরি ভাই, এক্সট্রিমলি স্যরি।”

সে ধীরপায়ে হেঁটে একটা সিঁড়ির কাছে বসল৷ প্রচন্ড হতাশ লাগছে নিজেকে। তোহা কোথায়? কোথায় তোহা! এতোবড় একটা জায়গায় সে হারিয়ে গেলে আমীর তাকে কিভাবে খুঁজে পাবে? ভয় আর অনিশ্চয়তায় যখন হৃদযন্ত্রটা বিকল হওয়ার যোগাড় তখনি খেয়াল করল দূরে একটা আইসক্রিম ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে তোহা। আমীর বাতাসের গতিতে ছুটে গেল সেখানে। তোহার বাহু ধরে কাছে এনে ক্রোধে উন্মত্ত কণ্ঠে বলল,” কি সমস্যা? তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও?”

আচম্বিতে আমীরের এহেন আচরণে তোহা নির্বাক হয়ে গেল। আশেপাশের সবাই আগ্রহ নিয়ে তাদের দেখছে। তোহা থমথমে কণ্ঠে বলল,” আমার হাত ছাড়ুন। আমি ব্যথা পাচ্ছি।”

চলবে

®Sidratul Muntaz