ওয়ান ফোর থ্রি পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
486

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৩৪.
” আই এম স্যরি। আমি তোমাকে আঘাত করে ফেলেছি। বেশি ব্যথা পেয়েছো? স্যরি। আমাকে মাফ করে দাও।”

এক মুহূর্তের জন্য রাশেদের চেহারা হিংস্র দেখাচ্ছিল। যেন জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড সে। স্নেহার বিস্ময়ভরা ছলছল চাহনী দেখে হঠাৎ নরম হয়ে এলো তার হৃদয়। আঘাতকৃত গালে খুব যত্নে কয়েকটা মৃদু চুমু দিল সে।স্নেহার বিস্ময় তখনও কা-টছে না। রাশেদ তাকে চড় মেরেছে? রাশেদ? এই অপমান সে ভুলবে কেমন করে?

রাশেদ কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলো মেঝে থেকে তুলতে তুলতে মনমরা কণ্ঠে বলল,” আমি খুব খারাপ। খুব বেশি খারাপ। আমার শাস্তি হওয়া উচিৎ। তুমি যা ইচ্ছা আমাকে শাস্তি দিতে পারো। কিন্তু প্লিজ আর এরকম কোরো না।”

এই পর্যায় কারেন্ট চলে এলো। ঘর আলোকিত হয়ে উঠল। রাশেদ অগোছালো রুমটা গুছাতে গুছাতে বলল,” এখন আর ডিনারে কোনো প্রবলেম হবে না। তুমি বসো। খাবার নিয়ে আসছি।”

স্নেহা কোনো জবাব দিল না। স্তম্ভিত সে। তার সঙ্গে যা ঘটছে তা বাস্তব নাকি কল্পনা? দুঃস্বপ্ন হয়ে যাক। সবটা দুঃস্বপ্ন হয়ে যাক! এতো জঘন্য বাস্তবতা নিয়ে সে বাঁচতে চায় না। রাশেদ রান্নাঘরে চলে গেল। স্নেহা তাকিয়ে রইল ছোট্ট ড্রেসিংটেবিলের ওই আয়নাতে। তার নরম-ফরসা গালে থাপ্পড়ের মোটা দাগ স্পষ্ট বসে গেছে। চামড়া জ্বালা-পোড়া করছে। তার চেয়েও বেশি জ্বালাপোড়া করছে স্নেহার বুক। আত্ম অহংকারে যেন চাবুক পেটাচ্ছে কেউ। এতোবড় অপমান সে কিভাবে মেনে নিবে? যেখানে আমীর কখনও তাকে চড় মা-রেনি সেখানে রাশেদ বিয়ের প্রথম রাতেই…. স্নেহা গর্জন করে উঠল। হাতের কাছে কিছু খুঁজল ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় ছুঁড়ে মা-রার জন্য। এই লাঞ্চিত মুখটাও সে দেখতে চায় না এই মুহূর্তে। কিন্তু আয়নায় ছুঁড়ে মারার মতো উপযুক্ত কিছু পাওয়া গেল না। রাশেদ সব সরিয়ে ফেলেছে। স্নেহার শরীরে কম্পন সৃষ্টি হলো। সে মেঝেতে বসে হাঁসফাঁস করতে লাগল। একটু পর রাশেদ খাবার নিয়ে ঢুকল। স্নেহার সামনে বসতে বসতে বলল,” ঘরে তেমন কিছু ছিল না। ডিম, চাল আর ডাল দিয়ে খিচুরির মতো বানিয়ে ফেলেছি। এতোটাও খারাপ হয়নি। ডিনারের জন্য যথেষ্ট। নাও।”

স্নেহা গাঁট হয়ে বসে রইল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেঝের দিকে। প্লেট ছুড়ে ফেলার সাহস পুনরায় আর করল না। রাশেদ যদি আবার চড় মা-রে তাহলে অপমানে ম-রে যাবে সে। রাশেদ বলল,” কি ব্যাপার? খাবে না?”

স্নেহা জবাব না দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে বসল। রাশেদ হতাশ গলায় বলল,” তুমি কি চাও আবার একটা চড় মারি?”

স্নেহা অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। রাশেদ হেসে ফেলল। রসিকতাপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” মজা করলাম। আমাকে কি এতো খারাপ মনে হয়? তুমি ভাবলে কিভাবে আমি তোমার গায়ে হাত তুলব? প্রথমবার ভুল হয়েছে বলে কি বার-বার হবে?”

স্নেহা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। সে রাশেদকে চিনতে পারছে না। সবকিছু কেমন বিষাক্ত লাগছে।

” নাও, খেয়ে নাও।”

রাশেদ স্নেহার প্লেট মেঝেতে রেখে নিজে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। স্নেহা প্লেটের দিকে তাকাল পর্যন্ত না৷ হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল। একটু পর রাশেদ উঁচু আওয়াজে বলল, ” খাও।”

স্নেহা মুখ তুলে আশেপাশে তাকাতেই দেখল রাশেদ ডাইনিং টেবিলে বসে তার দিকেই চেয়ে আছে। স্নেহা উপায়ন্তর না দেখে প্লেট হাতে নিয়ে খেতে শুরু করল। খাবার গলা দিয়ে নামছে না একদম৷ তবুও জোর করে খেল। রাশেদ এই দৃশ্য দেখল মুখে মৃদু হাসি আর অসীম সন্তুষ্টি নিয়ে। স্নেহা তার কাছে একসময় আকাশের চাঁদের মতো ছিল। সেই চাঁদ আজ তার ঘরে বসে আছে। এখন থেকে এই চাঁদ তার নিজস্ব, একান্ত। ভাবতেই পৈশাচিক আনন্দের শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরে। এতোদিন পর অবশেষে অপেক্ষার অবসান হয়েছে। আমীর তার কথা রেখেছে। এজন্য সে আমীরের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। এই কৃতজ্ঞতা শোধ হবে না কোনো কিছু দিয়েই।

তোহা দরজার বাইরে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জাবিদা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই বালিশ থেকে মাথা তুলে তাকাল। হাসিমুখে বলল,” ভেতরে আয়।”

মুখ গোমরা করে ভেতরে ঢুকল তোহা। সে এইখানে এসেছে তিনদিন হয়ে গেছে। একবারও রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি। অপরিচিত জায়গায় মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সবথেকে বড় কথা তোহা তার বাবাকে মিস করছে। এই বাড়িতে প্রতিদিন এতো মানুষ আসা-যাওয়া করে, এতো হৈ-হুল্লোড় লেগে থাকে, তবুও তোহা তার বাবার অভাব ভুলতে পারছে না। ফুপুকে দেখলে আরও বেশি মনে পড়ে যায় বাবার কথা। তার বাবার সাথে ফুপুর চেহারায় অনেক মিল আছে। বিশেষ করে জাবিদা যখন হাসে, তোহার কান্না পেয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করে,” আমার বাবা আর নেই ফুপু। পৃথিবীর কোথায় গেলে আমি বাবাকে পাবো? বলে দাও।”

জাবিদা চশমাটা চোখে পরে বলল,” এতোক্ষণ ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলি কেন? ভেতরে এলে কি সমস্যা?”

” ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে আছো। তাই ঘরে ঢুকব নাকি ঢুকব না সেটা ভাবছিলাম।”

” ঘুমাইনি। গতরাতে তোকে বিয়ের কথা বলেছিলাম দেখে কি রাগ করেছিস?”

তোহা মৃদু হাসল। ফুপুর হাতের উপর হাত রেখে আশ্বস্ত করে বলল,” মোটেও না। তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করছো তা আমি বুঝি। কিন্তু আমি এখন শুধু পড়াশুনা নিয়ে ভাবতে চাই ফুপু। বিয়ে-টিয়ের চিন্তা আমি মাথাতেও আনতে চাই না।”

” তোর বাবা বেঁচে থাকলেও এটাই বলতো।”

” একদম।”

” কিন্তু তখন এই কথা বলার পরেই হঠাৎ উঠে চলে গেলি তুই…..আলিফ বলছিল তুই নাকি রাগ করেছিস।”

” না ফুপু, এতো সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমি কেন রাগ করব? ঘুম পাচ্ছিল তাই উঠে গেছিলাম।”

” কোথায় ভর্তি হবি কিছু কি ঠিক করলি?”

” স্কলারশিপের জন্য এপ্লাই করব। আলিফ ভাইয়া বলেছে আমাকে হেল্প করবে।”

” হুম, সেই ভালো। আলিফের সাথে কথা বল। আর দ্যাখ ও যদি তোকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারে তাহলে আমাদের এখানেও থাকতে হবে না৷ আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে নিজেই থাকতে পারবি।”

তোহা এই কথা শুনে অবাক হলো। তার নিজের ফুপু তাকে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে অন্য জায়গায় থাকতে বলছে? কি অদ্ভুত! প্রথমে সে ভাবল হয়তো কানে ভুল শুনেছে। তাই আবার জিজ্ঞেস করল,” আলাদা ফ্ল্যাট? ”

জাবিদা দ্বিধাভরা কণ্ঠে বলল,” হ্যাঁ। সেটাই তোর জন্য ভালো হবে। মানে আমি সারাক্ষণ অসুস্থ থাকি। তোকে দেখে রাখার জন্য এইখানে কে আছে বল?”

তোহা বিষণ্ণ গলায় বলল,” আমি বড় হয়েছি ফুপু। আমাকে দেখা-শুনা করার জন্য মানুষ কেন লাগবে? আমি তো আর বাচ্চা নই। তবুও তুমি যদি চাও আমি অন্যকোথাও থাকার ব্যবস্থা করব। তোমাদের এখানে থাকব না।”

” আমার কথায় রাগ করেছিস মা?”

তোহা হেসে বলল,” রাগ কেন করব? তোমার কথা তুমি বলেছো। আমার কথা আমি বললাম। এখানে রাগের কথা আসবে কেন?”

সে উঠে চলে এলো। তার অসহায় লাগছে নিজেকে। এবার সে কোথায় যাবে? বাবা-মা ছাড়া পৃথিবী এতো কঠিন হয় কেন? করিডোরে এসে মনখারাপ করে চুপচাপ বসে রইল। এতোবড় একটা বাড়ি। কিন্তু এখানেও তার জায়গা নেই। সে অতিথি পাখি হয়ে এসেছে। যেখানেই যাবে, তাকে এই কথা বার-বার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে। স্থায়ী ঠিকানা বলে কি তার কিছু কখনোই হবে না? আকাশের ছন্নছাড়া পাখিগুলোরও দিনশেষে নীড়ে ফেরার জায়গা থাকে। তার তো সেটাও নেই।

” কফি?”

তোহা তাকিয়ে দেখল আলিফ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাস্যোজ্জ্বল। বাড়িতে এই একটা মানুষই আছে যার সঙ্গে কথা বললে একটু শান্তি লাগে! তোহা বলল,” থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। ”

কফিতে চুমুক দিতেই তার মন ভালো হয়ে গেল। কি সুন্দর ঘ্রাণ! আলিফ তোহার পাশে বসতে বসতে প্রশ্ন করল,” মনখারাপ?”

তোহা হাসার চেষ্টা করল,” নাতো!”

” টেনশনে আছো?”

” তা একটু আছি।”

” ইউনিভার্সিটি নিয়ে? এসব নিয়ে চিন্তা করতে না তোমাকে নিষেধ করেছি? আমি আছি কেন? একটা ব্যবস্থা করবই।”

” ভার্সিটি নিয়ে আমি আপাতত ভাবছি না। কিন্তু….”

” কি কিন্তু?”

তোহা মাথা নিচু করে আড়ষ্ট গলায় বলল,” আমার একটা চাকরির খুব দরকার ছিল ভাইয়া।”

আলিফ আশ্চর্য হয়ে তাকাল। খুব বিরক্ত হয়ে প্রায় ধমকের স্বরে বলল,” পাকনামি তাই না? তুমি চাকরি করবে কেন? স্টুডেন্ট লাইফে কেউ চাকরি করে? ক্যারিয়ারের বারোটা বাজাতে চাও?”

” কিন্তু আমার চাকরির দরকার।”

” কি দরকার তোমার চাকরির?”

তোহা অন্যদিকে চেয়ে বলল,” তুমি বুঝবে না।”

” আমি না বুঝলে কে বুঝবে? তোমার চাকরি করার প্রশ্নই আসে না। টাকার দরকার লাগলে আমাকে বলবে। আমি দিবো টাকা। তবুও চাকরির নাম মুখে আনবে না৷ একদম যেন না শুনি আর।”

তোহার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো,” ছি, ছি, তোমার থেকে কেন টাকা নিবো আমি?”

“আমি তোমার বড়ভাই এইজন্য টাকা নিবে! এখানে ছি এর কি হলো?”

কথা দূর থেকে ডাকল,” এই শোনো, এদিকে আসো।”

আলিফ বিরক্ত গলায় উচ্চারণ করল,” মানে আমাকে একটু আরাম করে বসতে দেখলেই হলো। সাথে সাথে ডাকাডাকি শুরু। বউ মানেই এক্সট্রা যন্ত্রণা। যারা বিয়ে করেনি তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বুঝলে তোহা? ”

তোহা হালকা হাসল। আলিফ বলল,” চাকরির ব্যাপারটা নিয়ে পরে কথা হবে। এখন আগে শুনে আসি তোমার ভাবী কি বলে।”

সে চলে যেতেই মন উদাসী হয়ে উঠল তোহার। আমীরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কেমন আছে আমীর? নিশ্চয়ই ভালো নেই। যার জীবনে স্নেহার মতো বিভীষিকা আছে তার কি ভালো থাকা সাজে? তোহা মনে মনে বলল,” হে আল্লাহ, তুমি মানুষটাকে খুব, খুব ভালো রাখো। আমার ভাগের সকল সুখ তুমি তার নামে করে দাও। নিজের জীবন নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু ওই মানুষটা ছোট থেকে কখনও সুখের মুখ দেখেনি। তার শৈশবটাও ছিল দুঃখে ভরা। প্রয়োজনে তার সব দুঃখ তুমি আমাকে দিয়ে দাও৷ আর তাকে ভালো রাখো। আমিন, আমিন, আমিন।”

ভোর ছয়টা বাজে। সারারাত ঘুমায়নি স্নেহা। শুধু অপেক্ষা করেছে কখন সকাল হবে! সে বিছানা ছেড়ে নামল এবার। রাশেদের ঘুম গাঢ় হয়েছে কি-না বোঝার চেষ্টা করল। রাশেদ কোনো উদ্দীপনা দেখাচ্ছে না। মনে হয় ঘুমে আচ্ছন্ন সে। স্নেহা আয়নায় তাকাল। নিজেকে পরিপাটি করে নিয়েই দরজার কাছে এগিয়ে গেল। খুব নিঃশব্দে, সতর্কতার সাথে নিশ্চিন্ত হয়ে দরজার লক খুলতে চাইল। কিন্তু একি! লক খোলা যাচ্ছে না কেন? দরজা তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। চাবিটা কোথাও নেই।

স্নেহার মাথা গরম হয়ে গেল। রাশেদ দরজায় তালা দিয়ে রেখেছে কেন? এখন থেকে কি তাহলে স্নেহাকে বন্দী থাকতে হবে? অসম্ভব! স্নেহা তার ব্যাগ খুলে দেখল মোবাইলটাও নেই৷ এবার আরও হতাশ হলো সে। এতোটা ধরাশায়ী কখনও হতে হয়নি। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। ক্রোধে শরীরের র-ক্ত টগবগ করে ফুটছে। হার মানতে শেখেনি স্নেহা। কয়দিন আটকে রাখবে রাশেদ তাকে? যতদিন তার আয়ু ঠিক ততদিন! তারপর? রান্নাঘরের র্যাকে রাখা ধারালো ছুরিটা নজরে পড়তেই উঠে দাঁড়ালো স্নেহা। ছুরিটা নিয়েই ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে লাগল রাশেদের কাছে। সে পরিণতির কথা চিন্তা করছে না। আপাতত সে শুধু মুক্ত হতে চায়।

বিছানার পুরোপুরি কাছে যেতেই স্নেহার পা কিছু একটার সাথে ঠেঁকল। মৃদু শব্দ হওয়ায় চোখ মেলে তাকাল রাশেদ। স্নেহা দ্রুত তার হাতের ছুরি আড়াল করে ফেলল। রাশেদ হাই তুলে হাসিমুখে তাকাল,” গুড মর্ণিং, এতো জলদি উঠে গেছো কেন? কয়টা বাজে?”

স্নেহা দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে রইল। তার স্থির দৃষ্টি নিচের দিকে নত। চোখমুখ অত্যন্ত শক্ত। রাশেদ উঠে বসতে বসতে বলল,” মাত্র ছয়টা বাজে তোমার ঘুম ভেঙে গেল? নাকি সারারাত ঘুমাওনি?”

স্নেহা উত্তর দিল না। চড় খাওয়ার পর থেকে সে আর একটা কথাও বলেনি রাশেদের সঙ্গে। রাশেদ দেখল স্নেহা কিছু একটা আড়াল করতে চাইছে। সন্দেহবশতই সে কাছে এগিয়ে গেল। এতোদিন ধরে ছায়ার মতো স্নেহার সঙ্গে আছে, স্নেহার ব্যাপারে সবকিছুই তার ধারণার অন্তর্গত। স্নেহা কি করতে পারে আর কতটুকুই বা করতে পারে তা সবই রাশেদের জানা। সে আলতো করে স্নেহার মাথায় স্পর্শ করে বলল,”চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ করল নাকি আবার? দেখি তো!”

স্নেহা তৎক্ষণাৎ রাশেদের হাত সরানোর চেষ্টা করল। তখনি দৃষ্টিগোচর হলো তার হাতের ছুরিটা। রাশেদ ভ্রু কুচকালো। শক্ত করে স্নেহার হাত চেপে ধরে ছুরিটা ছিনিয়ে নিল। রাগে দাঁতে দাঁত পিষল স্নেহা। বুদ্ধির জোরে সে রাশেদের থেকে এগিয়ে থাকলেও শরীরের জোরে রাশেদই জিতে যাবে। রাশেদ ছুরিটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল,” আমাকে মে-রে ফেলতে চেয়েছিলে নাকি? এইভাবে মা-রবে আমাকে? ঘুমের মধ্যে? একটা ঘুমন্ত ব্যক্তিকে খু-ন করে ফেলবে? তুমি এতো নির্দয় কেন জান?”

রাশেদের সম্বোধন শুনে স্নেহার গা-পিত্তি জ্বলে গেল। সে কিভাবে এতো সাহস পাচ্ছে? তার কি মৃ-ত্যু ভয় নেই? স্নেহা কি কি করতে পারে সেই সম্পর্কে তার ধারণা আছে। তবুও সে কেন আগুন নিয়ে খেলছে? কোন সাহসে? তার এই সাহসের উৎস কি আমীর?

রাশেদ অল্প ঝুঁকে এসে বলল,” এটা ঠিক না। চেষ্টা করলেও আমাকে তুমি মা-রতে পারবে না। কেন জানো?”

স্নেহা বরাবরের মতোই নিরুত্তর রইল। রাশেদ নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিল,” কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসে। আর তোমার ইগো সেটা মানতে চাইছে না।”

স্নেহা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকাল। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে রাশেদকে ধাক্কা মেরে বোঝালো এই কথা সে মানতে রাজি নয়৷ রাশেদ হেসে উঠল। উচ্চশব্দে হাসতে হাসতে বলল,” এটাই সত্যি। ইউ লভ মি। নাহলে আমার মৃ-ত্যু নিশ্চিত জেনে আমাকে বিয়ে করলে কেন? আমার উপর তোমার দয়া হলো কেন? তোমার তো কারো জন্য কখনও দয়া হয়নি।”

স্নেহা ক্রুর দৃষ্টি তাকাল। সে স্পষ্ট কণ্ঠে বিরোধিতা করল,” দিবাস্বপ্ন দেখছো। তোমার মতো কাওয়ার্ডকে আমি ভালোবাসব না, ইম্পসিবল। এতোদিন তো তোমার উপর দয়াটুকু ছিল। কিন্তু এখন আমি তোমাকে মন থেকে ঘৃণা করি। মৃত্যুর চেয়েও বেশি তোমাকে ঘৃণা করি রাশেদ। আমি ম-রব তবুও তোমার সঙ্গে থাকব না।”

রাশেদের দৃষ্টি রক্তিম হয়ে গেল। আচমকা স্নেহাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে তার গলায় ছুরি চেপে বলল,” তাহলে ম-রে যাও তুমি। এই পৃথিবীতে আমার না হলে আর কারো হওয়ার দরকার নেই তোমার।”

তারা ঠিক ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। স্নেহা আয়না দিয়ে রাশেদের আক্রোশী চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেল। বুক কেঁপে উঠল তার। গলার কাছে নিঃশ্বাস আটকে এলো। তাকে এতো অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন? এই রাশেদ আর আগের রাশেদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। মানুষ একদিনে কিভাবে এতো বদলে যায়? রাশেদ কি সত্যি তাকে মে-রে ফেলবে?

চলবে

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৩৫.

“ভাবী, আমি তোমাকে সাহায্য করি? কি রাঁধছো আজ?”

তোহার প্রশ্নে মিষ্টি করে হাসল কথা। আন্তরিকভাবে বলল,” তোমার ভাইয়ার পছন্দের খাবার। সয়া দিয়ে নুডলস।”

” আমি সবজি কে-টে দিবো?”

” প্রয়োজন নেই। তুমি মেহমান হয়ে এসেছো। দুইদিন পর চলে যাবে। তোমাকে দিয়ে কেন কাজ করাব?”

তোহার মুখ মলিন হয়ে এলো। বার-বার তাকে চলে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? সে যে এই বাড়ির স্থায়ী সদস্য নয় সেটা সবার আচরণেই প্রকাশ পাচ্ছে। ফুপা তো তোহার সাথে এখন পর্যন্ত কথাই বলেননি ঠিক করে। শুধু আলিফ ভাই-ই একটু ভালো ব্যবহার করে। এছাড়া কেউই তোহাকে পছন্দ করছে না। কথা ভাবী তো তোহার উপস্থিতিও সহ্য করতে পারে না! যেদিন এয়ারপোর্ট থেকে সে বাড়ি এলো সেদিন অযথাই সামান্য ইস্যু নিয়ে আলিফ আর কথার মাঝে বিরাট ঝগড়া হলো। তোহা জানে ঝগড়ার মুল উৎস সে নিজে। কিন্তু তাকে নিয়ে সবার এতো সমস্যা কেন? এমন তো নয় যে তারা মধ্যবিত্ত পরিবার। মানুষ একজন বাড়লেই খাওয়ার খরচে সমস্যা হয়ে যাবে। বরং তারা যথেষ্ট বিত্তশালী। কত বড় বাড়ির মালিক। কত ভালো কোম্পানিতে জব করছে আলিফ। তাহলে সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে তোহাকে রাখতে? নাকি ওরা তোহাকে খারাপ চরিত্রের মেয়ে ভাবে? কে জানে?

” তুমি নাকি এখানে কোন বন্ধুর বাসায় উঠবে?”

রান্নাঘরের বড় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে করিডোরের দিকে তাকিয়ে তোহা। কথার ডাকে হুশ ফিরল তার। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” বন্ধু মানে? কে বন্ধু?”

কথা নিজের কাজ করতে করতে বলল,” মা বলছিল। তোমার কোন বন্ধু নাকি এই শহরেই থাকে। তুমি তার বাড়িতে চলে যাবে।”

তোহা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সে এখান থেকে যাওয়ার কথা একবারও বলেনি। আর এইখানে তার বন্ধু আসবে কোথ-থেকে?

আলিফ কখন রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে তা কেউই খেয়াল করেনি। সে তাদের কথাগুলো শুনতে পেয়েই রাগান্বিত গলায় বলল,” তোহা, এইখানে কি করছো তুমি?”

” কিছু না আলিফ ভাই। ভাবীর সাথে গল্প করছিলাম।”

মনমরা হয়ে এই কথা বলে তোহা। আলিফ বলল,” গার্ডেন সাইডে বাবা বসে আছেন। একটু কফি দিয়ে আসতে পারবে?”

” শিউর, কেন পারব না?”

” যাও তাহলে।”

তোহা বের হয়ে যেতেই আলিফ কথার কাছে এসে বলল,” তোমাকে না বলেছি তোহার ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়িটা না করতে? তুমি কি চাইছো কথা?”

” আমি আবার কি চাইবো? মা আমাকে যেটা বলেছে সেটাই তো আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছি।”

” মা আমাকেও একই কথা বলেছে। কই আমি তো ওকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। ওর যদি বন্ধুর বাসায় থাকতে ইচ্ছে হয় তাহলে ও নিজেই আমাদের জানাবে। আমরা কেন আগ বাড়িয়ে ওকে জিজ্ঞেস করতে যাব? তোমার এই প্রশ্নে ও কত আপসেট হয়ে গেছে খেয়াল করেছো? ও তো এখন ভাবছে আমরাই ওকে এই বাড়িতে রাখতে চাই না।”

” কথাটা তো মিথ্যা নয়। ও এই বাড়িতে থাকলে আমাদের কারো জন্যই ভালো হবে না। আর তুমি ওর ফিলিংস নিয়ে এতো ভাবছো কেন?”

আলিফ খুব কষ্টে নিজের রাগ সংবরণ করে বলল,” ও আমার মৃ-ত মামার মেয়ে হয়। আমি ওর বড়ভাই। ওকে নিয়ে আমি চিন্তা করব না?”

কথা তাচ্ছিল্য হাসল। যেন খুব মজার কথা শুনেছে সে। আলিফ দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” তোমাকে যদি এই ব্যাপারে আমি আর একটা বাড়াবাড়ি করতে দেখি তাহলে…”

কথা খেঁকিয়ে উঠল,” কি করবে তাহলে? ডিভোর্স দিবে আমাকে? এটাই তো চাইছো তুমি।”

আলিফ রাগে টিস্যুবক্স ছুঁড়ে ফেলল। জোরে শব্দ হওয়ায় তোহা ভয় পেয়ে গেল। আবার শুরু হয়েছে ঝগড়া। ঝামেলার মধ্যমণি সে নিজে এইটুকু বুঝতে তার বাকি নেই। কিন্তু সে এটাই বুঝতে পারছে না যে তাকে নিয়ে সবার সমস্যা কোথায়! যাওয়ার জায়গা থাকলে এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতো সে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সবকিছু বুঝেও তাকে এখানেই থাকতে হবে মুখ বুজে।

মাহমুদ সাহেব আইপ্যাডে নিউজ দেখছিলেন। তোহা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে সালাম দিল৷ তারপর বিনয়ের সাথে বলল,” ফুপা, আপনার কফি।”

একবার আঁড়চোখে তোহাকে দেখে নিয়েই তিনি বললেন,” রাখো।”

তোহা কফি একপাশে রেখে চলে যেতেই নিচ্ছিল, মাহমুদ সাহেব ডাকলেন,” শোনো।”

তোহা থামল,” কিছু বলবেন ফুপা?”

গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি মাথা নাড়লেন,” বসো।”

তোহা হাসিমুখ নিয়ে বসল। মাহমুদ বললেন,” এখানে কতদিন থাকছো?”

তোহা অপ্রস্তুত হলো৷ তাকে বার-বার একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিষয়টা বেশ অস্বস্তিদায়ক। মাহমুদ বললেন,” মানে একটা প্ল্যান তো আছে তোমার এখানে আসার। শুনলাম তোমার বাবার কোন বন্ধু নাকি তোমাকে পাঠিয়েছে?”

তোহা মাথা নিচু করে বলল,” জ্বী। বাবার মৃ-ত্যুর পর থেকে খুব মনে পড়ছিল ফুপুর কথা। জানেনই তো, ফুপু ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি খুব শীঘ্রই চলে যাবো। এখানে এমনিতেও আমার মন টিকছে না।”

মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন,” এইখানে তুমি যতদিন খুশি থাকতে পারো। বাড়িটা তোমার ফুপুর। আমি নিষেধ করার কে? ”

” ফুপুও হয়তো চান না যে আমি এইখানে থাকি।”

” হুম। না চাওয়াই স্বাভাবিক। তোমার বাবা যেটা করেছে…” মুখ ফসকে কথাটা বলার পর মাহমুদ বুঝলেন ভুল হয়েছে। তোহাকে এইসব জানানো উচিৎ নয়। তিনি প্রসঙ্গ বদলাতে বললেন,” যাইহোক, বাদ দাও। তুমি এখন অনাথ। তোমার সব দায়িত্ব আত্মীয় হিসেবে আমাদের উপরেই বর্তায়।”

তোহা কথার জালে ফাঁসল না। ঠিকই ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল,” আমার বাবা কি করেছেন?”

” কিছু না৷ তোমার সেসব কথা না জানাই ভালো।”

” কিন্তু আমি জানতে চাই।” তোহার চোখেমুখে উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ল। বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল সে। মাহমুদ বললেন,” তিনি খুব অহংকারী মানুষ ছিলেন। আর অহংকার পতনের মূল। তোমার বাবার অহংকারের জন্যই তার পতন হয়েছে। কথাগুলো শুনতে হয়তো তোমার খারাপ লাগবে। কিন্তু দেখো, আজ তিনি তোমার বিয়েটা পর্যন্ত দিয়ে যেতে পারলেন না। আমরা না থাকলে তোমার কি হতো চিন্তা করে দেখেছো?”

মুহুর্তেই চোখমুখ জ্বলে উঠল তোহার। তীব্র ক্রোধসিক্ত, রূঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” কি বলতে চান? আমার বাবা অহংকারী ছিল মানে? একজন মৃ-ত মানুষকে নিয়ে আপনি এসব কিভাবে বলতে পারেন?”

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তোহা আরও অনেক কিছু বলে ফেলছিল কিন্তু হঠাৎ ড্রয়িংরুম থেকে শব্দ ভেসে আসে। জাবিদা অসুস্থ অবস্থায় উঠে এসেছে। তার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। তোহা আর মাহমুদ সাহেব উঠে দ্রুত সেদিকে যায়। তোহা দেখল কথা কাঁদতে কাঁদতে ট্রলিব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে আর এক মুহূর্তও এই বাড়িতে থাকতে চায় না। আলিফ ভাবলেশহীন। সে কথাকে আটকানোর চেষ্টাও করছে না। চুপচাপ সোফায় বসে আছে। জাবিদা এসব দেখে ভয়ে কান্নাকাটি করছে। তোহা এইসব দেখে খুব অবাক হয়ে গেল।

মাহমুদ সাহেব রাগী গলায় বললেন,” আমার ছেলে তোমার সাথে কি করেছে বউমা? আমাকে বলো একবার। তারপর ওর ব্যবস্থা আমি করছি। তুমি কেন বাড়ি ছেড়ে যাবে? দরকার লাগলে ও চলে যাবে।”

কথা শক্ত কণ্ঠে বলল,” আমাকে মাফ করবেন বাবা। কিন্তু আপনার ছেলে যা করেছে এরপরেও আমার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব না।”

মাহমুদ আলিফের দিকে তাকালেন অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে। মাথা নিচু করে বসে আছে আলিফ। জাবিদা অনুনয় করে বলল,” কথা, এরকম কোরো না মা। তুমি এমনিতেও অসুস্থ। এই অবস্থায় ঝগড়াঝাঁটি করা ঠিক না। আমি তোমাকে প্রমিস করছি সব ঠিক করে দিবো।”

” আপনি কিছুই ঠিক করতে পারবেন না মা।”

কথা এই কথা বলেই আঁড়চোখে আলিফের দিকে তাকাল। তোহা সাথে সাথেই আলিফের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল,” ভাইয়া কি হয়েছে? ভাবী এভাবে কেন চলে যাচ্ছে? তুমি কি আমার ব্যাপার নিয়ে ভাবীর সাথে ঝগড়া করেছো?”

আলিফ উদাসীন কণ্ঠে বলল,” সেরকম কিছু না।”

” আমি সব বুঝতে পারছি। আমি আসার পর থেকেই তোমাদের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়েছে। প্লিজ মিথ্যা বোলো না।”

” তুমি অযথা নিজের ঘাড়ে দোষ কেন চাপাচ্ছো তোহা?”

তোহা কথার কাছে ছুটে গিয়ে বলল,” ভাবী, প্লিজ যেও না তুমি।”

” আমার সামনে থেকে সরো তোহা। আমাদের মধ্যে কি হয়েছে সেটা তুমি জানো না। তাই এই ব্যাপারে তোমার ইন্টারফেয়ার করাও উচিৎ না।”

” কিন্তু আমি জানি যা হয়েছে আমার জন্যই হয়েছে। প্রয়োজনে আমি এখান থেকে চলে যাবো তাও তোমাকে যেতে দিবো না।”

এই পর্যায় মাহমুদ সাহেব ধমক মেরে বললেন,” আমাদের পারিবারিক বিষয়ে কথা বলার তুমি কে? তোমার কথা শুনতে চেয়েছে এখানে কেউ? গেস্ট হয়ে এসেছো গেস্টের মতো থাকো। সীমা লঙ্ঘন করতে এসো না।”

হঠাৎ এমন বকা শুনে তোহা থতমত খেয়ে গেল। তার মুখ অপমানে লাল হয়ে এলো। কথা নিচু কণ্ঠে বলল,” বাবা থামুন প্লিজ।”

মাহমুদ দরাজ গলায় বললেন,” কেন থামব? তুমি কি ভেবেছো আমি কিছু জানি না? সব ঝামেলা তো এই মেয়ের জন্যই হচ্ছে।”

জাবিদা নিশ্চুপ এই পর্যায়ে। তোহা তার ফুপুর দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু সে একটা কথাও বলছে না। আলিফ এতোক্ষণে উঠে এসে ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” বাবা, তুমি ওকে ধমকাচ্ছো কেন? প্রবলেমটা আমাদের পারসোনাল। এখানে ওর তো কোনো দোষ নেই।”

তোহা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে অপ্রস্তুত গলায় বলল,” ফুপা ঠিকই বলেছেন। আমার জন্যই সব ঝামেলা হচ্ছে। আর ফ্যামিলি ম্যাটারে আমার কথা বলাও উচিৎ হয়নি।”

এটুকু বলে সে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আলিফ রাগে গজগজ করে কথা আর তার বাবার উদ্দেশ্যে বলল,” এবার শান্তি হয়েছে তোমাদের? ভেরি গুড। মেয়েটাকে ঘর থেকে বের করেই ছাড়লে।”

তাচ্ছিল্য স্বরে কথাগুলো বলে সেও তোহার পিছনে যেতে লাগল। তোহা খুব দ্রুত হেঁটে মূল ফটক পেরিয়ে বের হয়ে যায়। আলিফ গাড়ি বের করে তোহার পিছু নেয়। তাকে থামানোর চেষ্টা করে।

” গাড়িতে ওঠো তোহা।”

তোহা চোখের জল মুছে বলল,” আপনি প্লিজ চলে যান আলিফ ভাই৷ এখানে আপনি কেন এসেছেন? বাড়িতে আরও ঝামেলা হবে।”

” তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না৷ তুমি গাড়িতে ওঠো। আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। তুমি কি সত্যিটা জানতে চাও না?”

এই কথা শুনে তোহা থেমে দাঁড়ালো। সে সব সত্যি জানতে চায়। এইটুকু সে বুঝতে পারছে যে এই সব সমস্যার পেছনে তার বাবা আছে। তাই সত্যি তাকে জানতেই হবে। তোহা আলিফের সাথে গাড়িতে উঠল। দূর থেকে একজন এই ঘটনা অবলোকন করে আড়ালে তোহা আর আলিফের পিছু নেয়। পাশাপাশি সে আমীরকেও ফোন করে।

” হ্যালো।”

” স্যার, ইটালি থেকে শাহিদ বলছি। ”

“হুম শাহিদ। তোমার কলের অপেক্ষায় ছিলাম। বলো, কি খবর?”

” তোহা ম্যাডামকে আজ তিনদিন ধরে আমি ফলো করছি স্যার৷ আমার মনে হয় এই বাড়িতে তাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা হচ্ছে। এই মাত্র তাকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম৷ আর তার কাজিন মিস্টার আলিফও সঙ্গে আছে।”

আমীর চিন্তিত স্বরে বলল,” কি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে?”

” সেটা এখনও জানতে পারিনি স্যার। তবে মনে হয় সিরিয়াস কোনো ইস্যু। ম্যাডাম কাঁদছিলেন।”

” আচ্ছা, তুমি ওদের ফলো করো। প্রত্যেকটা স্টেপ আমাকে জানাবে।”

” জ্বী স্যার।”

” মায়ার যেন কোনো অবস্থাতেই কোনো ক্ষতি না হয় শাহিদ।”

” আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি টুয়েন্ট ফোর আওয়ার্স ম্যামের সাথেই আছি।”

” খুব ভালো। আমাকে আপডেট জানাবে।”

” আচ্ছা স্যার। এখন রাখছি।”

ফোন রাখার পর আমীর একটুও নিশ্চিন্ত হতে পারল না৷ তোহা কাঁদছিল কেন? কি হয়েছে ওখানে?

_____________
আগে কখনও স্নেহার ভয় লাগেনি। কিন্তু ছুরির ওই ঘটনার পর থেকে স্নেহার মনে মৃ-ত্যু ভয় ঢুকেছে। আমীর স্নেহাকে খু-ন করবে না এই ব্যাপারে স্নেহা নিশ্চিত ছিল। কারণ আমীরের এই ব্যাপারে দূর্বলতা আছে। সে তার মায়ের আদরের ভাগ্নীকে খু-ন করতে পারতো না। কিন্তু রাশেদের তো কোনো দূর্বলতা নেই। সে ইচ্ছা করলেই স্নেহাকে মে-রে ফেলতে পারে। আগে রাশেদ যতটা সহজ-সরল ছিল এখন সেরকম নেই। সে খুব অচেনা হয়ে গেছে। তাকে দেখলেই স্নেহার ভয় লাগে। তাই ইদানিং সে পুরোদস্তুর ভদ্র সেজে আছে। ঠিক রাশেদের স্ত্রীর মতোই আচরণ করছে। ঘাড়ত্যাড়ামি ছেড়ে দিয়েছে৷ আগে রাশেদের বিশ্বাস অর্জন করা জরুরী। যতই রাশেদ ভয়ংকর হয়ে উঠুক, তাকে কাবু করা স্নেহার জন্য কোনো ব্যাপার না। একবার শুধু তাকে বাঘে আনতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। স্নেহা খুব যত্নের সাথে চা বানিয়ে বেডরুমে গেল। রাশেদ বিছানায় শুয়ে গুণগুণ করে গান গাইছে। তাকে দেখে স্নেহার গা-পিত্তি জ্বলে গেল। কিন্তু মুখে মধু মিশিয়ে বলল,” তোমার জন্য চা বানিয়েছি।”

রাশেদ চোখ মেলে স্নেহাকে দেখল। চমকিত গলায় বলল,” কি?”

” বললাম চা। আমি বানিয়েছি।”

রাশেদ বিষমচিত্তে বলল,” এটা কি সত্যি? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”

” কেন? আমি কি চা বানাতে পারি না?” স্নেহার অমায়িক দৃষ্টি৷ রাশেদ বিস্মিত গলায় বলল,” কিন্তু তুমি তো এই বিয়েটা মানতেই পারছো না।”

স্নেহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাশেদের পাশে বসতে বসতে বলল,” অনেক ভেবে দেখলাম রাশেদ। আমীরের কাছে আমি কখনোই দাম পাইনি। ও আমাকে শুধু নিজের কাজে ইউজ করেছে। সেখানে তুমি আমাকে কত ভালোবাসো! আমি তোমাকে বুঝতে ভুল করেছি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

রাশেদ মজা করে বলল,” স্বপ্ন দেখছি না তো?”

স্নেহা হাসল। রাশেদ দ্রুত চা নিয়ে কাপে চুমুক দেওয়া শুরু করল। তার মনে হচ্ছে এতো স্বাদের চা সে জীবনে খায়নি। স্নেহা মনে মনে বলল,” খাও রাশেদ। এভাবে আস্তে আস্তে তোমাকে ধ্বংস করব আমি।”

রাশেদ হাসি মুখে চা খেতে খেতে ভাবল,” তোমাকে আমি হারে হারে চিনি স্নেহা। এতো দ্রুত তুমি শোধরাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তোমার প্ল্যানটা কি? হঠাৎ কেন ভালো ব্যবহার করছো? তবে তুমি যতই চাল চালো, আমার থেকে মুক্তি পাওয়া এতো সহজ না। আমি তোমাকে কোনো অবস্থাতেই আর হারাতে চাই না।”

চলবে

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৩৬.
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। শহরটা আসলে খুব সুন্দর। চারপাশ ঘেরা বড় বড় পর্বত। তার ঠিক মাঝখানে মিষ্টি একটা শহর। নানান ঝামেলায় একবারও বাড়ি থেকে বের হওয়া হয়নি। আজকে বেরিয়ে তোহার বেশ ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা সে ভুলে থাকতে পারছে। কিন্তু বাড়ি ফিরলেই মন আবার বিষণ্ণ হবে। আলিফ বলল,” আইসক্রিম খাবে তোহা?”

তোহার যথেষ্ট গরম লাগছে। আইসক্রিম খাওয়ার মতোই আবহাওয়া এটা। তবু সে বলল,” ইচ্ছে করছে না।”

আলিফ সেই কথা শুনল না। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বলল,” তোমাকে আজ মিরানোর সেরা আইসক্রিম খাওয়াবো।”

তোহা কিছু বলার আগেই আলিফ গাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তোহা বসে রইল একা, বিষণ্ণ মনে। একটু পর দু’টো জিলাটো নিয়ে আলিফ ফিরে এলো। তোহা মৃদু হেসে বলল,” থ্যাঙ্কস।”

আলিফ গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। গম্ভীর মুখে বলল,” বাবার কথায় কষ্ট পেও না প্লিজ। আসলে আমি নিজেই খুব ইমব্যারেসড। জানি না তোমাকে কি বলব।”

” আমি কিছু মনে করিনি ভাইয়া। ওই সময় ফুপার মাথাটা গরম ছিল। তাই হয়তো ওরকম ব্যবহার করেছেন। মাঝে মাঝে হয়ে যায়!”

আলিফ মুচকি হাসল। তোহা এসব বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চাইছে নাকি আলিফকে? তা জানে না আলিফ। কিন্তু তোহার দিকে সে মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। নিজের কাছে নিজেকেই অপরাধী লাগছে। তার জন্যই তো এতোসব হচ্ছে আজ। সবকিছুর জন্য মূল দোষী সে নিজেই। কিন্তু সেটা না ভেবে সবাই তোহাকেই দোষারোপ করছে। অথচ তোহা তো ওই ঘটনার কিছুই জানে না! জানলে কি আর এতো স্বাভাবিক থাকতো সবকিছু?

” আলিফ ভাই।” তোহার ডাকে ঘোর কাটল আলিফের। আইসক্রিম মুখে নিয়ে জবাব দিল,” হুম?”

” তুমি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলে। কি সত্যি জানার কথা বলছিলে? আমি জানতে চাই।”

আলিফ কিছুটা হকচকিয়ে গেল। ওই মুহূর্তে তোহাকে থামানোর জন্য আর কোনো বুদ্ধি মাথায় আসছিল না। সেই জন্য এই কথা বলেছে। ব্যাপারটা পাশ কাটাতে বলল,” হয়তো তেমন সিরিয়াস কিছু না। ভুলে গেছি।”

” মিথ্যা বলছো না তো?”

” মিথ্যা কেন বলব?”

” তাহলে কেন ফুপা আমার বাবাকে অহংকারী বললেন?”

তোহার কণ্ঠে স্পষ্ট তেজ। রাগে নাকের ডগা তিরতির করে কাঁপছে। আলিফ অবাক হয়ে জানতে চাইল,” বাবা ছোটমামার সম্পর্কে এই কথা বলেছে?”

” হ্যাঁ বলেছে। এখন আমি জানতে চাই কেন বলেছে? তুমি নিশ্চয়ই এর কারণটা জানো।”

আলিফ তোহার চোখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অন্যদিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিথ্যা বলল,” আমি কিছু জানি না তোহা।”

” অবশ্যই তুমি জানো। প্লিজ আমাকে বলো। আমি কেন জানতে পারব না? আমার সঙ্গে কেন ফুপা আর ফুপু এমন ব্যবহার করছে সেটা আমার জানা দরকার। আমি বুঝতে চাই সবকিছু।”

” মাও তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে নাকি?”

তোহা চুপ করল। গতকালই তো জাবিদা তাকে আলাদা থাকার কথা বলেছিল। সে যদি একটা চাকরি পেয়ে যায় তাহলে ওদের বাড়ি থেকে চলে যাবে। কিন্তু আলিফ চাকরির কথা শুনে রেগে গিয়েছে। অর্থাৎ সে চায় না তোহা এখান থেকে যাক। অথচ সে ছাড়া বাকি সবাই চাইছে তোহা চলে যাক। কথা ভাবী মুখে না বললেও তার আচরণেই বোঝা যায় সে তোহাকে দুই দন্ড সহ্য করতে পারছে না৷ তোহা নিভন্ত কণ্ঠে বলল,

” ফুপু খারাপ ব্যবহার করেনি। কিন্তু আজ যখন ফুপা আমাকে ধমক দিচ্ছিলেন তখনও তো তিনি কিছু বলেননি।”

আলিফ মোলায়েম গলায় বলল,” মনখারাপ কোরো না৷ বাবা রেগে থাকলে মা আসলে কথা বলতে ভয় পায়। তুমি যখন বের হয়ে গেলে তখন মা-ই আমাকে বলল তোমার পিছু নিতে। তুমি একা একা কোথায় চলে যাও এই নিয়ে মা চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিল।”

আলিফ আবারও মিথ্যা বলল৷ সে নিজের গরজে তোহার পেছনে এসেছে। জাবিদা একবারও কিছু বলেনি। তোহা যন্ত্রণাময় কণ্ঠে জানাল,” আমার এখানে থাকা ঠিক হচ্ছে না আলিফ ভাই। আমি দেশে ফিরে যেতে চাই।”

” দেশে ফিরতে চাও মানে? ওখানে আছে কে তোমার?”

তোহার স্মৃতিতে ভেসে উঠল চশমায় আবৃত দু’টো গভীর চোখ। সেই নিখুঁত মুখ আর শীতল হাসি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। সে ছাড়া ওই দেশে তোহার কেউ নেই। কিন্তু সেও তো তোহার কেউ না! আমীরের বলা শেষ কথাগুলো এখনও মনে পড়ে,” শুধু দায়িত্ব পালন করেছি।” যার কাছে তোহা শুধুই দায়িত্বের বোঝা ছিল তার কথা ভেবে কষ্ট পাওয়ার মানেই হয় না। তোহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল।

” ডন্ট ওরি। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি শুধু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে মন দিয়ে পড়াশুনাটা শুরু করো। আমি তোমার পাশে সবসময় থাকব। নিজের ছোটবোন হলে যতটা করতাম তোমার জন্যও ততটাই করব। আমাকে কখনও পর ভেবো না।”

আলিফ হাত রাখল তোহার মাথায়। তোহা কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বলল,” থ্যাংকস ভাই। তুমি ছাড়া এই ভিনদেশে আমার কে আছে?”

সে এই কথা বলে বসে থাকা অবস্থাতেই আলিফের কাঁধে মাথা রাখল। সাথে সাথে আলিফের হাতের আইসক্রিম পড়ে গেল। তোহা অবাক হয়ে তাকাতেই হেসে ফেলল আলিফ। হাসল তোহাও। দূর থেকে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা ক্যামেরা বন্দী করল শাহিদ। আমীরকে ভিডিওটা পাঠানো মাত্রই সে ফোন করল,” হ্যালো শাহিদ।”

” জ্বী স্যার?”

“কে এই ছেলে? ওর সম্পর্কে সব ডিটেলস আমার চাই।”

শাহিদ যতটা জানে আপাতত ততটাই বলল,” ম্যামের কাজিন হয়। পুরো নাম আলিফ আহসান। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে। আপাতত এইটুকুই জানি। বাকিটা জেনে আপনাকে বলব।”

” হুম। ”

ফোন রেখে আমীর রিওয়াইন্ড করে ভিডিওটা বার-বার দেখছিল। এমন সময় নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকল রানু।সবার আগে তার নজর গেল এলইডি’র স্ক্রিনে যেখানে আমীর তোহার ভিডিওটা দেখছিল! সে ভ্রু কুচকে বলল,”কে এই মেয়ে?”

আমীর টিভি বন্ধ করে বলল,” কেউ না।”

রানু স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বলল,” কখন উঠেছিস বাবা?”

” এইতো কিছুক্ষণ আগে। তুমি কষ্ট করে নাস্তা বানাতে গেলে কেন আন্টি? শেফ কি করছে?”

” বাবর্চির হাতের রান্না তোর খেতে হবে না৷ এখন থেকে আমিই রান্না করব। একগাদা তেল-মশলা দিয়ে রাঁধে বেটা। এসব খেতে থাকলে তো শরীর খারাপ করবে।”

” ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছো। এমনিতেও আমি তোমার রান্না খুব মিস করি।”

রানু ভিডিওর বিষয়টা ভুলে গেল না। খাবার পরিবেশন করতে করতে বলল,” আমি যদি ভুল না হই, মেয়েটা তোহা ছিল। তাই না?”

আমীর নিশ্চুপ। রানু আত্মবিশ্বাস পূর্ণ কণ্ঠে বলল,” জন্ম না দিলেও তোকে আমি বুঝি। তুই এখানে বসেই তোহার সম্পর্কে সব খোঁজ-খবর রাখছিস। কিন্তু কেন এসব করছিস? কি লাভ?”

” জানি না। কিন্তু আমি কোনো ভুল করছি না।”

” অবশ্যই ভুল করছিস। তোর ওকে ওর মতোই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। ওর আলাদা ব্যক্তিগত জীবন আছে। তুই যদি এখানে বসে ওর উপর এভাবে নজরদারিই করিস তাহলে ওকে দূরে পাঠিয়ে লাভ কি হলো? তুই যাতে ওকে ভুলে থাকতে পারিস সেজন্যই তো ওকে বিদেশে পাঠাতে বলেছিলাম আমি।”

আমীর অসহায়বোধ করল। স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,” পারছি না ভুলে থাকতে। আমি কি করব?”

” তোকে পারতে হবে। এমনিতেও মেয়েটার অর্ধেক জীবন শেষ হয়ে গেছে। তুই কি চাস ওর পুরো জীবন শেষ হয়ে যাক?”

” এসব কি বলছো আন্টি? আমি ওকে সবচেয়ে সুখে দেখতে চাই। ওর সব কষ্ট শুষে নিতে চাই। ”

” তুই-ই তো ওর কষ্টের উৎস। তুই কিভাবে ওর কষ্ট মুছবি?”

কথাটা বুলেটের মতো হৃদয়ে আঘাত করল। আসলেই তো, তোহার সব কষ্টের উৎস সে নিজেই। অথচ তার চেয়ে বেশি তোহার ভালো কেউ চাইতে পারবে না।

” আমি ইচ্ছে করে তো কিছু করিনি। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।” আমীরের কণ্ঠে অপরাধবোধ। রানু জানতে চাইল,

” এই কথা কি তুই তোহাকে বোঝাতে পারবি কখনও?”

আমীর তীব্র আক্ষেপ নিয়ে উচ্চারণ করল,” পারব না। সেজন্যই তো ওকে যেতে দিয়েছি। নয়তো আমার কাছে বেঁধে রাখতাম। কখনও হারাতে দিতাম না। দূর্ভাগ্য আমার।”

রানু তাকিয়ে রইল আমীরের মুখের দিকে। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল,” তোর সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবা। তুই ওকে কবে এতো ভালোবাসলি?”

রানু কাঁদতে লাগল। আমীর অবশ্য কাঁদল না৷ শক্ত হয়ে বসে আছে চুপচাপ। কি হবে এই অসম্ভব ভালোবাসার পরিণতি? সত্য কখনও চাপা থাকে না। তোহা যখন সব জানতে পেরে আমীরকে প্রচন্ড ঘৃণা করবে তখন আমীর কিভাবে সামলাবে নিজেকে? সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা চিন্তা করেই রানুর গা শিউরে ওঠে। সে মনে মনে প্রার্থনা করল,” সব ঠিক করে দাও আল্লাহ। তুমিই তো উত্তম পরিকল্পনাকারী।”

_____________
নিঝুম দুপুর। ফ্যানের নিচে বসেও ঘামছে স্নেহা। বিছানায় রাশেদ বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে। স্নেহা ধীরপায়ে হেঁটে বিছানার কাছে গেল। বালিশের নিচেই রাশেদের ফোনটা আছে। সে হাত বাড়িয়ে মোবাইল নেওয়ার চেষ্টা করল। শুধুমাত্র একটা ফোন করতে হবে তাকে। রাশেদ হালকা নড়ে উঠতেই স্নেহা হাত সরিয়ে নিল। তারপর পুনরায় চেষ্টা করল। এবার বালিশের নিচে হাত রাখতেই রাশেদ শক্ত করে চেপে ধরল তার হাতটা। স্নেহা সামান্য কেঁপে উঠল। রাশেদ জড়ানো কণ্ঠে বলল,” কি করছো?”

স্নেহা হাসার চেষ্টা করে মৃদু গলায় বলল,” আমার ফোনটা খুঁজে পাচ্ছি না৷ তোমার মোবাইলটা একটু দেবে?”

রাশেদ মুচকি হাসল। আড়মোড়া ভেঙে বলল,” আমার সবকিছুই তো তোমার। অনুমতি নিতে হয়?”

স্নেহা হাসিমুখে মোবাইল নিল। কিন্তু মোবাইলে কোনো সিম নেই দেখে মুহূর্তেই খুব হতাশ হলো সে। ভ্রু কুচকে বলল,” তোমার ফোনের সিম কোথায়?”

রাশেদ হাই তুলে বলল,” ফেলে দিয়েছি।”

” মানে?”

” আমি চাই না আমাদের কেউ ফোন করে বিরক্ত করুক। আগামী বেশ কিছুদিন আমরা থাকব নেটওয়ার্কের বাইরে। শুধু তুমি আর আমি।”

স্নেহার চোখমুখ শুকিয়ে গেল। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল,” এসব কি বলছো? আমার এই মুহূর্তে কাউকে ফোন করা অত্যন্ত জরুরী। আমার ফোনটাও তুমি লুকিয়ে রেখেছো। এসবের মানে কি?”

রাশেদ হাসল৷ স্নেহা বিব্রত কণ্ঠে বলল,” এমন পাগলামি করলে তো তোমার সাথে থাকাই যাবে না।”

” এমনিতেও তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।”

স্নেহা ঢোক গিলল। এই কথা সত্যি যে সে নিজের ইচ্ছায় কোথাও যেতে পারবে না। গত তিনদিন ধরে একবারও এই ফ্ল্যাটের বাইরে যেতে পারেনি স্নেহা। রাশেদ দু-একবার বের হয়েছিল। কিন্তু যতবার বের হয়েছে ততবার বাইরে থেকে দরজা লক করে গিয়েছে।এভাবে স্নেহার প্রত্যেকটা মুহূর্ত অস্থিরতায় কাটছে, অসহ্য লাগছে। স্নেহা যেভাবেই হোক এই বন্দী দশা থেকে মুক্তি চায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আমার ফোন আমাকে ফিরিয়ে দাও রাশেদ। নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।”

রাশেদ হেসে বলল,” তোমার অনুরোধ আমি ফেলতে পারি জান? নিশ্চয়ই দিবো।”

আলমারি খুলে স্নেহার ফোনটা বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিল রাশেদ। স্নেহা ভাবতেই পারেনি এতো সহজে সে মেনে যাবে। খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে মোবাইল হাতে নিল। কিন্তু পুনরায় হতাশ হলো সে। তার ফোনেও সিম নেই। কিচ্ছু নেই। সম্পূর্ণ ফ্লাশড করা হয়েছে মোবাইল। রাগে আর জেদে স্নেহা চিৎকার করে উঠল। আছাড় দিয়ে মোবাইল ভেঙে ফেলল। উন্মত্ত কণ্ঠে বলল,” কি চাও তুমি? কি চাও হ্যাঁ? ”

রাশেদ তেড়ে এসে স্নেহাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। হকচকিয়ে গেল স্নেহা। বার কয়েক বড় করে শ্বাস নিয়ে রাশেদ কাতর গলায় বলল,” শুধু তোমাকে চাই আমি। আর কিছুই না বিশ্বাস করো।”

” তোমার কি মনে হয়? এভাবে জোর খাটালেই আমাকে পেয়ে যাবে?”

রাশেদ স্নেহার ঠোঁটের দিকে চেয়ে বলল,” চেষ্টা করতে দোষ কই?” সে কাছে আসতে নিলেই স্নেহা চিৎকার করল,” অসম্ভব। জীবনেও পাবে না আমাকে তুমি।”

স্নেহার দুইহাতের তুমুল ধাক্কায় ছিটকে পড়ল রাশেদ। রাগ সংবরণ করে শান্ত গলায় বলল,” সেটা সময়ই বলে দিবে স্নেহা।”

এই কথা বলেই সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে দরজায় তালা দিতে ভুলল না। স্নেহা হিংস্র বাঘিনীর মতো গর্জন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সাহায্যের জন্য কেউ এলো না।

____________
তখন মাঝরাত। শোর-গোলের শব্দে ঘুম ছুটে গেল তোহার। সে উঠে বাতি জ্বালল। তর্ক-বিতর্কের আওয়াজ আসছে লিভিংরুম থেকে। তোহার ঘরটা লিভিংরুমের খুব কাছাকাছি হওয়ায় সে স্পষ্ট শুনতে পেল, কথা কাঁদছে। আলিফ সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কথার কান্নার আওয়াজ বেড়েই চলেছে। তোহা দরজার কাছে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিদিন এমন অশান্তি তার আর ভালো লাগে না। আজ নতুন করে আবার কি হলো কে জানে? একটু পর তোহা দেখল কথা এসে খুব জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে।

” তোহা, দরজা খোলো। বের হও তুমি।”

আলিফ নিচু গলায় বলল,” কথা, প্লিজ ফোর গড সেইক। এই রাতের বেলা অন্তত সিন ক্রিয়েট কোরো না। এটলিস্ট সকাল হতে দাও।”

কথা উচ্চস্বরে বলল,” শাট আপ। আমি আর একটা কথাও শুনব না তোমার। তোহা, এই তোহা! দরজা খোলো।”

বাধ্য হয়ে দরজা খুলল তোহা। অবাক হয়ে জানতে চাইল” কি ব্যাপার ভাবী? এই মাঝরাতে তোমরা কি শুরু করেছো?”

কথা কেমন আক্রোশী দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তোহা অপ্রস্তুত বোধ করল। আলিফের মাথা নত। কথা থমথমে কণ্ঠে বলল,” আমার দেখা সবচেয়ে ফালতু মেয়ে তুমি।”

তোহা বিস্মিত হলো। আলিফ প্রতিবাদ করে বলল,” কথা, স্টপ ইট। তোহা, তুমি দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ো প্লিজ। ওকে আমি দেখছি। তোমার ভাবীর শরীর ভালো নেই সেজন্যই এমন করছে।”

কথা আলিফকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে বলল,” অসম্ভব। কোথাও যাবো না আমি। এই মেয়ে, তুমি কি আসলেই কিছু বোঝো না নাকি নাটক করো?”

তোহা আহত কণ্ঠে বলল,” আমি কি করেছি? কেন আমার সাথে এভাবে কথা বলছো তুমি?”

কথা তার হাতের কাগজে মোড়ানো ছবিগুলো ছুড়ে মা-রল তোহার মুখের উপর। উপহাস করে বলল,

” দেখো তাহলে। যখন তুমি ক্লাস টেনে পড়তে তখন আমার বিলোভড হাসব্যান্ড তোমার প্রেমে পাগল ছিল। তোমার ছবির উপর কবিতা লিখতো। কত প্রেম, আহা! এতোই যদি প্রেম ছিল তাহলে ওকে বিয়ে কেন করলি না তুই? আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলি?”

তোহা স্তম্ভিত। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথায় বাজ পড়ল তার। অবাক হয়ে নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইল। সব তোহার ছোটবেলার ছবি। সেই ছবির উপর রঙিন কলম দিয়ে লেখা হয়েছে প্রেম বাক্য। মুহূর্তেই তার বিস্মিত চোখজোড়া অজস্র দ্বিধা নিয়ে তাকাল আলিফের দিকে। লজ্জায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে আলিফ। তার ফরসা মুখ লালচে দেখাচ্ছে। কথা তার মতো চেঁচিয়ে গেল, পাগলামি করল। তোহা কিছুক্ষণ স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর প্রচন্ড লজ্জায় আর অস্বস্তিতে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কান্না পাচ্ছে তার। ভেবেছিল এই বাড়িতে অন্তত একটা মানুষ আছে যাকে সে ভরসা করবে। আলিফকে নিজের আপন বড়ভাই ভেবেছিল। মাথার উপরের ছাদ ভেবেছিল। কিন্তু এটা কি হয়ে গেল? এতো জঘন্য পরিস্থিতি কারো জীবনে না আসুক! তোহা মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগল। সে আসলেই পোড়া কপালী! নাহলে বার-বার তার সাথেই কেন এমন হবে?

চলবে

®Sidratul Muntaz