#কন্ট্রোললেস
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১৯]
বাড়িতে বউ এসেছে নতুন বউ সবারি নিশ্চয়ই হই হুল্লোড়ে মেতে থাকার কথা।বউকে বরণ করার কথা।নতুন বউকে নিয়ে আহ্লাদে আটখানা হওয়ার কথা,কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি।সাত সকালে সৈয়দ বাড়িতে রুমুর আগমন ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো।কেউ খুশি নয় সবার মুখটা ভার হয়ে আছে।রুমুর বুকটা ভার হয়ে যায় কলিজা মুচড়ে উঠে।মেয়েটা কাঁদতে পারে না উর্মি তার হাতটা চেপে দাঁড়িয়ে আছে শক্ত করে।বসার ঘরে নিগূঢ় নিস্তব্ধ পরিবেশ, থেকে থেকে নার্গিসের কান্নার শব্দে ভারি হচ্ছে পরিবেশ।
উজ্জ্বল বুঝে পায় না বাবা মায়ের এতটা রিয়েক্ট করার কি আছে?সে একটা বিয়ে করেছে মা ডা র তো করে আসেনি।উর্মি তামিম দুজনেই নিরব তারা জানতো রুমুর আগমন সবার মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে।উজ্জ্বলের মাথা গরম হয় মায়ের দুহাত ঝেরে বলে,
” আম্মা তাকাও আমার দিকে।তাকাও।”
” তুই ছাড় আমাকে।তোর মতো…”
” আমার মতো কি?”
” তুই তোর কবর খুড়লিরে বাপ।আমার একটা মাত্র ছেলে। আমার কলিজার ধন বিপদের মুখে।”
” কবর খুড়েছি মানে কি?আমি কি করেছি?”
” তুই রাশেদরে চিনস না।অবুঝের মতো কথা বলিস না।”
” আমি অবুঝ?তোমরা অবুঝের মতো কাজ করছো।”
” আমি এতকিছু জানি না।আমি শুধু আমার ছেলেকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখতে চাই আর কোন ঝগড়া বিবাদ চাই না।”
উর্মি এগিয়ে এসে নার্গিসকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” আম্মা শুধু শুধু এসব চিন্তা কেন করছো?”
” কেমন চিন্তা করছি?তুইও ভুলে গেলি তোর চাচি তোর সাথে কি কি করেছে।ওই মহিলার মনে কতটা বিষ থাকলে তোর একেরপর এক বিয়ে ভেঙে দিয়েছে,এলাকায় তোর নামে বদনাম রটিয়েছে।”
” আম্মা আমি ভুলিনি।কিন্তু এসব ভেবে আমাদের কাজ নেই।আমাদের ঘরের বউ যদি ঠিক থাকে তবেই হবে।”
নার্গিস উঠে দাঁড়াল অতিদ্রুত এগিয়ে এসে ধরলেন রুমুর হাত।
” মা তুই কথা দে আমার ছেলেকে বিপদে ফেলবি না।”
রুমু ঘাবড়ে যায়।তার নিজেকে মনে হচ্ছে কাঠগড়ায় থাকা আসামি।রুমু একবার তাকায় উজ্জ্বলের পানে আরেকবার তাকায় উর্মির পানে মেয়েটা ঘাবড়ে গিয়ে মাথা নাড়ে।নার্গিস চোখের জল মুছে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ান।
” রুমু তোর বয়স কম নিশ্চয়ই আবেগে পড়ে উজ্জ্বলের কাছে এসেছিস।”
রুমু মাথা নাড়ে,
” আবেগে আসবো কেন?উজ্জ্বল ভাই তো আমাকে এটা ওটার লোভ দেখায়নি যে আমি আবেগে আসবো।”
” এবার তুই নিজেই বল সজ্ঞানে বাড়ি ছেড়েছিস?”
” হ্যাঁ সজ্ঞানে বাড়ি ছেড়েছি।”
” আমার ছেলে কি তোকে জোরাজোরি করে বিয়ে করেছে?”
” একদমি না আমি নিজেই বিয়ের প্রস্তাব রেখেছি।”
” তোর মা ভাই যদি কেস-মামলা করে আমার ছেলের জীবন নষ্ট করে এসবের জন্য তুই দায়ী থাকবি আমি আগেই বলে দিলাম।এখন যা যা বলেছিস ভবিষ্যতেও এসব কথা ভুলবি না।”
রুমু চুপ হয়ে যায় মনে মনে মেয়েটা ভাবে,নতুন বউ বেশে লাল শাড়ি না পরে একটা কালো শাড়ি পরা উচিত ছিল।তার আজ শোক দিবস যে ভাবে সবাই জেরা করছে সে তো আসামি।তামিম উজ্জ্বলকে চুপ থাকতে বলে।সৈয়দ শামসুল এতক্ষণে মুখ খুললেন তিনি তার গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলেন,
” এই বিয়ে আমরা মানা না মানায় নিশ্চয়ই তোদের কিছু যায় আসে না।তোরা নিজেদের যুক্তিতে বিয়ে করেছিস।বিয়ে করে ক্ষান্ত হলিনা লুকিয়ে এতটা দিন ছিলি।তোরা যা ভালো মনে করেছিস তাই করেছিস আমার আর কিছু বলার নেই।তবে উজ্জ্বল তুই আমার ছেলে তোর ভরণপোষণের জন্য তুই আমার উপর নির্ভর।যেখানে তুই নিজেকে নিজে সামলাতে পারিস না সেখানে তুই আরেকটা মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে নিলি।আমাদের একটাবার জানালিও না।যেহেতু তুই তোর যুক্তির কাছে সঠিক এবার আমিও আমার যুক্তির কাছে সঠিক।তোর কিংবা তোর বউয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমি নিতে পারবো না।আজ থেকে তুই তোর রাস্তা ধর।”
এসবের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না উজ্জ্বল।ছেলেটার মাথায় আচমকা যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।এক মুহূর্তে মনে হলো পায়ের নিচের মাটিটাও নড়ে গেছে।বাবার এমন সিদ্ধান্তে উর্মি প্রতিবাদ করল,
” আব্বা এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।উজ্জ্বল আপনার একমাত্র ছেলে।টাকা পয়সা আপনার অভাব আছে?এত এত উপার্জন করেও ছেলে আর ছেলের বউয়ের প্রতি অবিচার কেন করছেন?”
” আমি ওদের বিয়ে করতে বলেছি?নাকি আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছি।আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল।উজ্জ্বলের বউয়ের ভরণপোষণ তার নিজেকেই নিতে হবে,তবে একটা সাহায্য করছি, তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছি না।এ বাড়িতেই তারা থাকবে তবে হাড়ি আলাদা হবে।”
” আব্বা এসব ঠিক না ওরা কি না খেয়ে থাকবে?উজ্জ্বলের ইনকাম আছে যে সে আলাদা সব কিছুর ব্যবস্থা করবে।আমার তো মনে হচ্ছে আপনি সংসার ভাগ করছেন।”
” উর্মি আমার উপর কথা বলবি না।তোর যদি এত মায়া মহাব্বত থাকে ওদের নিয়ে এখান থেকে দূর’হ।”
” এতদিন যখন ওরা আমার কাছে ছিল এখনো থাকবে।তোমাদের কতবার ফোনে বোঝালাম বিয়েটা মেনে নাও আর এখন…এই উজ্জ্বল চল তোরা আমার সাথে যাবি।”
উজ্জ্বল ঠাই দাঁড়িয়ে রইল।রুদ্ধশাস ছেড়ে বলে,
” আপা আমি কোথাও যাব না।আব্বা বলেছিল পড়াশোনা ছেড়ে ব্যবসায় বসতে ঠিক আছে আজ থেকে আমি ব্যবসায় বসব তখন নিশ্চয়ই আমাকে আকাইম্মা মনে হবে না।”
সৈয়দ শামসুল তাচ্ছিল্য হাসলেন।হাসতে হাসতে পুনরায় বসলেন সোফায়।
” আমার ব্যবসায় বসে এত পাওয়ার তোমাকে দেখাতে হবে না।বুকে দম থাকলে নিজে করে দেখাও এবার কি করবে তুমি সেটা নিজেই ভাব।”
একেরপর এক ধাক্কা হজম হলো না উজ্জ্বলের।প্রচন্ড চিন্তায় যখন তার ভেঙে পড়ার কথা অথচ উজ্জ্বল কঠিন পরিস্থিতিতেও হেসে ফেলল।গলা ঝেরে কেশে বলে,
” আব্বা রুমু এখন অতিথি।আপনার ভাইয়ের মেয়ে তাকে কি অযত্নে রাখলে চলে?আপনার ভাইয়ের কাছে আমি কিন্তু বিচার দিব।”
উজ্জ্বলের এমন আচরণে সবাই ভড়কে যায়।উজ্জ্বল যেন এতে আরো বেশি আনন্দ পায়।
” আব্বা অতিথিকে কিভাবে আপ্যায়ন করবেন সেটা আপনার দায়িত্ব।অন্তত তিনদিন অতিথিকে আদর যত্ন করুন এরপর অতিথির ব্যবস্থা আমি করে নেব।তাছাড়া দুলাভাই এসেছে ভালো মন্দ রান্নার ব্যবস্থা করুন।আপনাদের সব বক্তিতা শেষ?এবার আমি যাই।”
উজ্জ্বল নিজের রুমে চলে গেল আর পেছনে ফেলে গেল পাঁচ জোড়া হতবাক চোখ।
.
বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে উজ্জ্বল মাথাটা কেমন ঝিম ধরে গেছে।পারিপার্শ্বিক চিন্তা এখন তার মাথায় নেই।আব্বা নিশ্চয়ই রাগের দরুনে এসব বলেছে একদিন না একদিন ঠিকি মন গলে যাবে।তবে রাশেদ এখন যে যুদ্ধটা করবে তার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে হলে অবশ্যই পারিবারিক সাহায্য দরকার অথচ উজ্জ্বলের ভাগ্যটাই হয়তো খারাপ সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল।
রুমের পর্দা সরিয়ে রুমুর আগমন ঘটে।রুমুকে দেখেই ছেলেটা বিস্তার হাসে।
” স্বাগতম ডার্লিং।”
কৌতূহলের চোখ নিয়ে উজ্জ্বলের রুমটা পরখ করল রুমু।
” কতদিন পর এলাম।এই রুমটা আগে আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল।”
” তুই যা দুষ্টু ছিলি।আমার সারা রুম এলোমেলো করে পালিয়ে যেতি।”
” উজ্জ্বল এসব কথা আপনার মনে পড়ে?মিস করেন সেই দিনগুলো?”
“ভীষণ।মনে আছে একবার ডয়ারে থাকা আমার সব শার্টে তুই কিস করে লিপস্টিকের ছাপ দিয়ে গেছিলি।তোর ঠোঁটের ছাপ দেখে কি যে তুলকালাম কান্ড করেছি।”
” ওটা তো আমি একটা সিনেমায় দেখে শিখেছিলাম।”
” তুই অনেক দুষ্টু ছিলি রুমু।”
” আপনাকে জ্বালিয়ে আমি খুব আনন্দ পেতাম।”
” বলেছিলাম না এই রুম, এই খাট, এই বালিশ,সবকিছু তোর হবে দেখলি তো প্রমাণ করে দিলাম।”
” আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগছে উজ্জ্বল ভাই।”
” কী প্রশ্ন?”
” চাচাজান যা বলেছে তা আপনি করতে পারবেন?আমি কোন রাস্তা দেখছি না অথচ শেষ মুহূর্তে আপনি হাসতে হাসতে কথা ঘুরিয়ে দিলেন।”
উজ্জ্বল রুমুকে টেনে কোলে বসাল।মেয়েটার উদম পেটে হাত রেখে চেপে ধরল শক্তভাবে।
” এখন এসব ভাবার সময় নেই।আজ তোকে বাড়ি তুলেছি আজ আমার দ্বিতীয় বাসর।”
” ভালো কিছু ভাবতে পারেন না আপনি?”
” এটা মন্দ কিছু? আমি অন্যের বউকে নিয়ে ভেবেছি?আমি আমার বিবাহিত বউকে নিয়ে ভাবছি।”
” এই বাসায় কয়টা বেড রুম?”
” চারটা বেড রুম।কেন?”
” এখন থেকে আপনি আমি আলাদা থাকবো।আপুর বাসায় সুযোগ ছিল না বলে কিছু বলিনি।”
” অসম্ভব।পাষাণ মহিলা এই কথা বলার আগে তোর কলিজা কাঁপেনি?”
” না কাঁপেনি।”
” নাটক করিস না।রাত হলে দেখা যাবে।”
.
উজ্জ্বল বউ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে এবং সেই বউ রুমু এই কথাটা চারিদিকে বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পড়ল।রাশেদের সুপ্ত মস্তিষ্ক পুনরায় দাউদাউ করে জ্বলছে বাড়ির উঠনে ঘন্টার পর ঘন্টা রুমু আর উজ্জ্বলকে উদ্দেশ্য করে গালাগাল করেছে,শেষ পর্যায়ে রুমুর মাও ধমকাধমকি শুরু করে কিন্তু কেউ সাহস করে উজ্জ্বলের বাড়ির ত্রিসীমানায় আসার সাহস করেনি।উজ্জেল প্রস্তুত ছিল আজ তো ব্যাটে বলের ছক্কা চলবেই অথচ ঝামেলা খুব বেশি হলো না।রুমু ভয়ে কুঁকড়ে ছিল মেয়েটার ভীতু মুখখানী দেখে নার্গিস অবজ্ঞায় হাসলেন।একবার তো রুমুকে বলেও ফেললেন, “এসব যে হবে জানতি না?ভেবে চিনতে যখন পালিয়েছিস তবে এখন ভয় কেন পাচ্ছিস?শুন,তোর দায়িত্ব যেমন আমার ছেলের উপর তেমনি আমার ছেলের দায়িত্ব তোর উপর।তাকে এসব ঝামেলা থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব কিন্তু তোর।”
সে কথায় রুমু শুধুই মাথা নাড়ে এছাড়া আর কিছুই বলার নেই তার।
.
রাত হলো।রাতের খাবার খেয়ে যে যার রুমে ফিরল।শর্তমতে রুমু আজ আলাদা রুমে থাকবে এতে অবশ্য উজ্জ্বল কিছুই বলল না।রুমুকে আলাদা রুমে রেখে এসে সে নিজের রুমে ফিরল।গা থেকে এক টানে টিশার্ট খুলে রাখল চেয়ারে।আয়নায় দাঁড়িয়ে শরীরটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বিছানায় শুয়ে পড়ে।একাকী রুমটায় গলা ছেড়ে গান ধরে সে গানের মাঝ পর্যায়ে দেখতে পেল রুমু দরজার কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।উজ্জ্বল অবাক হওয়ার ভান ধরে বলে,
” চুমু বউ তুই এখানে?”
” আপনি ঠিক আছেন কি না দেখতে এলাম।আপনার তো আবার বউ ছাড়া চলে না।”
“ওও দেখা হয়েছে?এবার যা।”
রুমু গাল ফুলাল এগিয়ে এলো উজ্জ্বলের সামনে,
” আপনি একা ঘুমাতে ভয় পাবেন না?”
” না পাব না।এত বছর একাই ঘুমালাম।”
” না আপনি ভয় পাবেন।”
” পাব না।”
” আপনি জানেন না?ছেলেরা রাতে ঘুমাতে ভয় পায় বলেই আমরা মেয়েরা বিয়ে করি।নয়তো জামাই আহামরি কিছুই নয়।”
উজ্জ্বল খকখক করে কেশে উঠল।কাশতে কাশতে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল রুমুকে।নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলে,
” আমার ভীষণ ভয় লাগছে বউ।দেখো না ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি।আসো কাছে আসো আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।”
” উজ্জ্বল দম বন্ধ লাগছে ছাড়ুন।”
” আমার ভয় লাগছে ছাড়া যাবে না।”
উজ্জ্বল দরজা বন্ধ করে রুমুকে কোলে নিয়ে বিছানায় যায়।ইনোসেন্ট ফেস করে বলে,
” রাতে কোল বালিশের উপর অত্যাচার কমাতে আমরা ছেলেরা বিয়ে করি।নয়তো বউ এত আহামরি কিছুই নয়।”
চলবে…