কমলা রঙের রোদ পর্ব-০৮

0
5

#কমলা_রঙের_রোদ [৮]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

সকালে খুশি কলপাড় থেকে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে দেখে খুশবু বেরিয়ে যাচ্ছে। ক্লাস শুরু হয় সাড়ে নয়টায়। আজ আটটার আগেই চলে যাচ্ছে দেখে বলল,

“কয়টা বাজে? এত আগে কেন যাচ্ছিস?”

খুশবু কোন উত্তর দিল না। উত্তর যে পাবে না এটা খুশিও জানতো। কয়টা দিন এরকম ভাবেই চলবে। তারপর খুশবুই সব ভুলে গিয়ে নিজে থেকে কথা বলতে আসবে। খুশবু দরজা পর্যন্ত চলে গেলে খুশি বলল,

“একটু পরে যা। আমিও তো যাবো।”

“তুই কি আমার পা দিয়ে হেঁটে যাবি? তোর যাওয়া তুই যা।”

প্রতিবারই মা’র রাগ খুশবু খুশির উপর দেখায়। খুশিও সয়ে নেয়। আবার মাঝে মাঝে সে-ও রেগে যায়। রাতে খুশবু না খেয়ে ঘুমিয়েছে। সকালেও না খেয়েই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। অন্যান্য দিন হলে স্মরণকে খুঁজে ওর থেকে টাকা নিয়ে যায়৷ আজ সেটাও করবে না স্বাভাবিক। খুশি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

“যেদিন তুই অভিমান করা ত্যাগ করতে পারবি সেদিন থেকে হয়তো তোর দুঃখ কিছুটা কমবে। অপাত্রে কোন কিছুই দান করা ঠিক না।”

বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুশবু ঠিক করল আজ সে ভার্সিটিতে যাবে না। আজকের দিনটা ঘুরেঘুরে কাটাবে। গায়ে হয়তো জ্বর আছে। গা-টা গরম গরম লাগছে। মারের জায়গা গুলো টনটন করছে। একটা ব্যথার বড়ি খেয়ে নিলে ভালো হতো। কিন্তু তার কাছে টাকা নেই।

“আমার যদি একটা আলাদীনের চেরাগ থাকত। চেরাগে ঘষা দিলেই ভেতর থেকে জ্বীন বেরিয়ে এসে বলতো, হুকুম করুন আমার মালিক। আপনার কী লাগবে? প্রথম হুকুমেই আমি এক বস্তা টাকা চেয়ে নিতাম।”

এসব কাল্পনিক জিনিস ভেবে কিছু সময়ের জন্য দুঃখ ভুলে থাকা যায়। কিন্তু বাস্তবে এমন কিছুই সম্ভব না মনে পড়লেই মন খারাপ হয়। খুশবু দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

“তুই কি দিনদিন লোভী হয়ে যাচ্ছিস? শুধু টাকাপয়সা আশা করলেই কি মানুষ লোভী হয়? সুখ চাওয়াও তো এক প্রকার লোভ। মন থেকে লোভ কম কর খুশবু।”

🌸

মিসেস সুলতানা খাবার টেবিলে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছেন। গত সপ্তাহে সান তার বাবার সাথে দেখা করেছে। কথাটা সুলতানা জানতেন না৷ সান তাকে জানায়নি। গতরাতেই এই বিষয়ে ছেলের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও ছেলে ফিরেনি দেখে রুমে চলে যায়। সানের চলাফেরায় অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন তিনি। মিসেস সুলতানা একজন কাজের লোককে বললেন সানকে যেন ডেকে দেয়। কাজের লোক জবাবে বললেন,

“ছোট সাহেব তো উইঠ্যা পড়ছে আম্মা।”

“ঠিক আছে। তাহলে তোমার ছোট সাহেবের জন্য টোস্ট অমলেট করে নিয়ে এসো।”

ছেলেকে তিনি ভীষণ কষ্টে মানুষ করেছেন। এমনও দিন কেটেছে তিনি না খেয়ে থেকেছেন। কিন্তু ছেলের মুখে ঠিকই খাবার তুলে দিয়েছেন। সেই ছেলেই তাকে এমনভাবে নিরাশ করছে! মিসেস সুলতানা নিজের ভাবনায় মগ্ন ছিলেন সান কখন নিচে নেমেছে দেখেননি।

“গুড মর্নিং বিউটিফুল লেডি।”

ছেলের কন্ঠ পেয়ে তার ধ্যান ভাঙলো। ছেলের উপর রাগ করে থাকতে চেয়েও পারেন না। উত্তরে তিনিও বললেন,

“গুড মর্নিং।”

সানের মন মেজাজ আজ বেশ ফুরফুরা। গতকাল খুশবুর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই মূলত মনের এই পরিবর্তন। আজ নিশ্চয় খুশবু ভার্সিটি আসবে। তাকেও বেরোতে হবে। সান খাচ্ছে না, বলা যায় নাকে মুখে খাবার ঠুসছে। মিসেস সুলতানা ছেলের এত তাড়াহুড়ো দেখেও কিছু বললেন না। খাওয়া প্রায় অর্ধেক শেষ। জুস খেয়ে উঠে পড়বে এমন সময় মিসেস সুলতানা খুব শান্ত কন্ঠে বললেন,

“গত সপ্তাহে তুমি নরসিংদী গিয়েছিলে?”

সান একটু থামল। মা’র কাছে তাহলে এই খবরটাও পৌঁছে গেছে। মনে মনে হাসল সান। কোন খবরই মা’র অজানা থাকে না। আচ্ছা, মা কি তার পেছনে স্পাই লাগিয়েছে? মুচকি হেসে সান বলল,

“গিয়েছিলাম। কিন্তু এই খবরটা তোমাকে কে দিয়েছে?”

“সেটা জানা কি জরুরি?”

“না।”

তাড়া থাকলেও সান উঠল না। আরও কিছুটা সময় বসে থাকল। মা যদি জিজ্ঞেস করে কেন গিয়েছিলে তাহলে সে সত্যটা বলে দিত। কিন্তু মা তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। মিসেস সুলতানা চান সান নিজে থেকে বলুক। তিনি ছেলেকে কোনকিছু বলতে বাধ্য করবেন না।

“মা আমি কি উঠবো?”

“কোথাও যাবে?”

“হুম।”

“তাহলে যাও।”

সান চলে যেতে নিয়েও আবার ফিরে এসে পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের গালে চুমু খেয়ে বলল,

“তোমার স্পাইকে আমি একদিন ঠিকই খুঁজে বের করবো। সেদিন ব্যাটার খবর আছে।”

🌸

খুশবুর বন্ধুদের সাথে ওকে না দেখে খুশি মনে করল খুশবু হয়তো ক্লাসে আছে। কিন্তু তাকে দেখে আজও মাহিয়া খুশবুর কথা জিজ্ঞেস করতে এলে খুশি কিছুটা চিন্তিত হলো। খুশবু ভার্সিটিতে আসেনি? সকাল সকাল বেরিয়ে কোথায় গেছে তাহলে?

“আপু আজও কি খুশবু আসবে না? ওর জ্বর কি এখনও সারেনি?”

চিন্তিত মুখেই খুশি জবাব দিল,

“আজ তো বলেছিল আসবে। এখন কেন এলো না এটা তো বাড়ি গিয়েই জানতে পারবো।”

দুইটা ক্লাস করে খুশি আর থাকতে পারল না। বাকি ক্লাস গুলো না করেই বাড়ির পথে ছুটলো। খুশবু হয়তো এতক্ষণে বাড়ি চলে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে খুশবু এক জায়গায় বসে পড়ল। রাত থেকে পেটে একটা দানাপানিও পড়েনি। খালি পেটে কাঠফাটা রোদের মধ্যে হেঁটে চোখে যে অন্ধকার দেখবে এটাই স্বাভাবিক। ঘোরাঘুরি তেমন একটা হলো না। একটু হেঁটেই পা ব্যথা করছে। পকেটে টাকা না থাকলে আজকাল কিছুই হয় না। খুশবু বসে আছে এর মাঝেই পাঁচ/ছয় বছর বয়সী একটা ছেলে এসে তার সামনে হাত পেতে বলল,

“আপা দশটা টেকা দিবেন? সকাল থেইকা কিছু খাই নাই।”

রোগা পাতলা অপরিচ্ছন্ন এই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে খুশবুর কেনই যেন মন খারাপ হয়ে গেল। আচ্ছা এর বয়স কত হবে? এটা কি ওর ভিক্ষা করার বয়স? তারপরও পেটের তাগিদে মানুষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। খুশবু জানে তার কাছে কোন টাকা নেই। তারপরও ব্যাগ খুঁজে টাকা বের করার বৃথা চেষ্টা করছে। ছেলেটা টাকা পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাগ খুঁজেও কোন টাকা না পেয়ে ভীষণ অপরাধী মুখে খুশবু বলল,

“আমার কাছে তো আজকে টাকা নেই বাবা। ভুলে হয়তো টাকার ব্যাগটা বাসায় রেখে এসেছি।”

এই মিথ্যা কথাটা বলতে গিয়ে খুশবুর মনে হলো, এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সবথেকে বড় মিথ্যা কথাটা বলেছে। ছেলেটা খুশবুর কথা বিশ্বাস করেছে। এটা ভেবেই খুশবুর আরও বেশি কান্না পাচ্ছে। মানুষ কত সহজে অন্যের মিথ্যা কথাও বিশ্বাস করে নেয়।

“ঠিক আছে আপা।”

তার সাথে সময় নষ্ট না করে ছেলেটা অন্য কারো কাছে ভিক্ষা চাইতে চলে গেল। ছোট্ট এই ছেলেটা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই খুশবুর চোখ বেয়ে টুপ করে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট জোড়া কামড়ে কান্না আটকালো।
সকাল থেকে বেশ রোদ ছিল। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। তারপরও এই রোদের মাঝেই হঠাৎ আকাশ এমন অন্ধকার হয়ে এলো যে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এই অসময়ের বৃষ্টিতে কেউ কেউ খুশি হলেও অনেকেই বিরক্ত। পথচারীরা ছোটাছুটি করে আশেপাশের দোকানের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিচ্ছে। খুশবু একটুও নড়ল না। যেখানে বসে ছিল ওখানেই বসে থাকল। ছুটতে ছুটতে অনেক মানুষই কৌতূহলী চোখে তাকে দেখছে। মনে মনে হয়তো ভাবছে, এই মেয়ে পাগল নাকি? বৃষ্টির মধ্যে এভাবে বসে আছে কেন? তবে কেউই দাঁড়িয়ে তার জন্য সময় নষ্ট করছে না।

🌸

খুশি বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দৌড়ে বারান্দায় উঠে একটুর জন্য ভিজে যাওয়া থেকে বাঁচল। মা দাদী কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে সোজা নিজের ঘরে গেল। ঘরে গিয়েও খুশবুকে না দেখতে পেয়ে দাদীর খোঁজ করতে লাগল। খুশিকে আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে দেখে পরী বানু বললেন,

“আইজ এত জলদি আইয়া পড়ছস? ভালা হইছে মেঘে ধরে নাই।”

“খুশবু ফিরেছে দাদী?”

“কেন খুশবু তোর লগে আসে নাই?”

খুশি বুঝতে পারল খুশবু এখনও ফিরেনি। কিন্তু এই কথাটা দাদীকে বলা যাবে না। তাই সে বলল,

“আমার ক্লাস ছিল না তাই চলে এসেছি। খুশবু আরেকটু পরে আসবে।”

দাদীকে মিথ্যা বলে বোঝ দিলেও খুশি নিজেকে কী বলে বোঝ দিবে? সকাল আটটার সময় বেরিয়ে বারোটা বাজার পরও খুশবু বাড়ি ফিরছে না কেন? খুশবুর জন্য তার বিশেষ তেমন মায়া নেই। এই মেয়ের সব কাজেই সে বিরক্ত হয়। কিন্তু আজকের কথাটা ভিন্ন। মা গতকাল খুশবুকে মেরেছে। মেয়েটা জেদ থেকে যদি কিছু একটা করে বসে! সচারাচর এই সময় স্মরণ বাড়িতে থাকে না। কিন্তু আজ খুশি ওকে ঘরেই পেলো। খুশিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে স্মরণ বলল,

“কালো ষাঁড়ে তাড়া করেছে নাকি?”

“খুশবু আজ ভার্সিটিতেও যায়নি। বাড়ি এসে দেখি এখনও বাড়িও ফিরেনি। ওর বন্ধুরাও কেউ জানে না খুশবু কোথায় গেছে।”

খুশির এক দমে বলে ফেলা কথাগুলো বুঝতে স্মরণ একটু সময় নিলো। কিন্তু তারপরই উঠে পড়ল। বৃষ্টির মধ্যে বেরোতে নিলে খুশি বলল,

“ছাতা নিয়ে যাও।”

“লাগবে না৷ তুই বাড়িতে কাউকে বলিস না। বেক্কলটাকে পেলে আক্কেল ঠিক করে ফেলবো।”

বৃষ্টি মাথায় নিয়েই স্মরণ বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এত বড় শহরে কোথায় খুঁজবে এই মেয়েকে? পাগলটাকে তাদের উপর গছিয়ে দিয়ে কাকা তো টিকিট কেটেছে। কিন্তু এই পাগলের খেয়াল কে রাখবে এটা ভাবেনি।

“অনেক ভালোবেসে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুই আমাকে শান্তি দিবি না ঠিক করে নিয়েছিস। আজ খালি হাতে পাই। থাপড়ে দাঁত সব ক’টা ফেলে দেব। ফাজিল মেয়ে। তোর জন্য আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে।”

চলবে