কমলা রঙের রোদ পর্ব-১৪+১৫

0
4

#কমলা_রঙের_রোদ [১৪]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

খুশবু বাড়ি ফেরার আগেই সান ওদের পাড়ায় এসে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করছে। এই পাড়ায় সচরাচর এত বড় গাড়ি আসে না। কার গাড়ি এটা? এত দামি গাড়িতে কে এসেছে? দোকানে বসা অনেকেই গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালিও করছে।

-কার গাড়ি এইডা এনে দাঁড় করাই রাখছে? এত দামী গাড়ি দিয়া কার বাড়িতে আসছে?

মাজু দোকানদার চায়ের কাপে চামচে টুংটাং শব্দে তুলে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল,

-তুমি গিয়া জিগাইয়া আসো মিয়া। আমি কেমনে কমু কার বাড়িতে আসছে।

কাপে থাকা বেঁচে যাওয়া চা টুকু মাটিতে ফেলে দিয়ে কাপ ফেরত দিয়ে গাড়িটার কাছে এসে দাঁড়াল মানুষটা। জানালার কাচে মুখ ঠেকিয়ে ভেতরের মানুষ দেখার চেষ্টা করছে। সান গরমে বাইরে না দাঁড়িয়ে গাড়িতেই বসে ছিল। মানুষটাকে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি পারতে দেখে বিরক্ত হলো।

হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরতে খুশবুর অনেকটা সময় লেগেছে। রিকশা ভাড়ার টাকাও সে খেয়ে ফেলেছে। যে কারণে হেঁটে আসতে হলো। তাদের বাড়ি থেকে একটু পেছনে মাজু কাকার দোকানের সামনে গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল। গাড়িটা চেনা চেনা লাগছে না একটু! হ্যাঁ। এটা তো মাহিয়ার ভাইয়ের গাড়ি। ওইদিনও লোকটা পাড়ায় এসেছিল। লোকটার সাথে তাকে কথা বলতে দেখে কে যেন মার কানে লাগিয়েছিল। ব্যস! সে আর যায় কোথায়? আজও কি লোকটা তার সাথে দেখা করতে এসেছে? খুশবু চট করে একটা কারেন্টের খুঁটির পেছনে লুকিয়ে পড়ল।

-না বাবা না! সেদিনের মারের কথা আজও ভুলতে পারিনি। তবে এই লোক কি পাগল? এত বড় গাড়ি কোন আক্কেলে এই চিপা রাস্তার মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

সাবধানের মার নেই। খুশবু সেটাই করল। লোকটা তার সাথে দেখা করতে না এলেও পরিচিত হিসেবে কথা বলতেই পারে। পাড়ার লোকের সামনে এই কথা বলাই তার কাল হয়ে দাঁড়াবে। তাই খুশবু সোজা রাস্তা ধরল না। মানুষের বাড়ির উপর দিয়ে শটকার্টে বাড়িতে চলে এলো। ঝামেলার দরকার নেই বাবা।

এইটুকু সময়ে সানের গাড়ি ঘিরে ছোট্ট মতো একটা ভিড় জমা হয়ে গেছে। কিছু মানুষ বিষয়টাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। সান হাতঘড়ির দিকে তাকাল। বাইরের ভিড় খেয়াল করে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট করল। খুশবুর সাথে দেখা করার অন্য কোন উপায় খুঁজে নিবে। কিন্তু আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে মানুষ ইট পাথর মেরে তার গাড়ির কাচ ভাঙা শুরু করবে।

পাড়ার কোন খবরই স্মরণের অজানা থাকে না। কীভাবে কীভাবে যেন সব খবর পেয়ে যায়। আজও এই খবরটা তার কানে পৌঁছে গেল। মাজুর দোকানের সামনে বিশাল একটা গাড়ি অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে ছিল। ভেতরে মনে হয় মানুষ ছিল। কিন্তু বাইরে বেরোয়নি। কথাটা শুনে স্মরণ বলল,

-তোরা গিয়ে দেখলি না কার গাড়ি?

-কীভাবে দেখবো? বলেছি তো ভেতরে মানুষ থাকলেও বাইরে বের হয়নি।

-এমন গাড়ি কি আজই প্রথম এসেছে?

-আগেও মনে হয় একদিন এসেছিল।

স্মরণ ভাবছে দু’দিন যেহেতু এসেছে তাহলে ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলা যায় না। যে-ই এসেছে তার কোন উদ্দেশ্য ছিল।

-আচ্ছা আবার এরকম কিছু হলে তোরা আমাকে জানাস।

স্মরণ গাড়ি ও গাড়ির মালিকের কথা ভাবতে ভাবতেই বাড়ি চলে এলো। আজকাল খুশিটা যেন কেমন করছে। ভালো করে কথা বলে না। এমনকি চোখে চোখও পড়তে দেয় না। হয়েছে কি এটার?

রাতে সবাই একসাথে খেতে বসলে মানছুরা সবথেকে বড় মাছের মাথাটা স্মরণের পাতে তুলে দিল। স্মরণ আপত্তি জানিয়ে বলল,

-খালা আমি এই এক কেজি ওজনের মাথা একা খেয়ে উঠতে পারবো না।

-পারবি। কথা না বলে খা।

পরী বানু হতাশ চোখে ছেলের বউকে দেখেন। ছেলেটাকে এত ভালোবাসে কিন্তু মেয়ে দিতে রাজি না। এটা কেমন ভালোবাসা। খুশবু স্মরণের কানে ফিসফিস করে বলল,

-এখন থেকেই জামাই আদর পাচ্ছ। কী কপাল তোমার!

স্মরণ চোখ পাকিয়ে তাকিয়েও হেসে ফেলল। মানছুরা কঠিন গলায় বললেন,

-খাওয়ার সময় হাসাহাসি না করে তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠ।

মা তার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেছে দেখে খুশবু একদম চুপ হয়ে গেল। স্মরণ মাছের মাথাটা নিজে না খেয়ে খুশবুর পাতে দিয়ে দিল। খুশবু আঁতকে উঠে বলল,

-এটা কী করলে?

-চুপচাপ খা।

-আমি মাছ খেতে পারি না।

-পারবি। গরু হয়েছিস একটা। বাঙালি হয়েও মাছ খেতে পারিস না। তোর জন্য কী এখন থেকে ডালে ভাতে বাঙালি বলতে হবে?

ওদের খুনসুটি লেগেই থাকে এতে কারো কোন সমস্যা নেই। স্মরণ খুশির দিকে তাকায়। রাক্ষসের মতো কেমন খেয়েই যাচ্ছে। একবারও এদিকে তাকাচ্ছে না। স্মরণ টেবিলের নিচ দিয়ে খুশির পায়ের উপর তার পা রাখলে ‘খাওয়া শেষ’ বলে খুশি উঠে চলে গেল। স্মরণ বোকার মতো তাকিয়ে ভাবতে থাকল, এটা কী হলো!

🌸

খুশবুর আর একটা পরীক্ষাই বাকি আছে। এর পর শুধু শান্তি আর শান্তি। কয়েকদিন ঘুমিয়েই কাটাবে। শেষ পরীক্ষা প্রত্যাশার থেকেও একটু বেশিই ভালো হয়েছে। তাই আজ মনটাও ফুরফুরে। কিন্তু মাহিয়া কেন তার উপর রেগে আছে এটাই বুঝতে পারছে না। আজকেই শেষ দেখা। মাহিয়া ইন্ডিয়া থেকে ফিরলে আবার কবে দেখা হবে কে জানে। তাই গাধীটাকে ফুচকা খাওয়াতে চেয়েছিল। কিন্তু মাহিয়া তার প্রপোজাল রিজেক্ট করে দিয়ে বলল,

-খাবো না তোর ফুচকা। তোর মন চাইলে তুই খা।

খুশবু চোখ বাঁকা করে বলল,

-পরীক্ষা খারাপ হয়েছে? তা হয়েছে তো হয়েছে। কিন্তু এর রাগ আমার উপর দেখালে কি পাস করবি?

-পরীক্ষা খারাপ হয়েছে তোকে কে বলেছে?

-খারাপ হয়নি? তাহলে কেন মেজাজের তেরোটা বেজে আছে।

-আজকাল তোর দাম বেড়েছে তাই।

-আমার দাম বেড়েছে! কীভাবে বাড়লো শুনি?

সেদিন খুশবুদের পাড়া থেকে ফেরার সময় সানের অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যায়। খুব বড় অ্যাক্সিডেন্ট না হলেও বেচারা হাত-পা যথেষ্ট ছিলেছুলে গেছে।

-সব জেনেও না জানার ভান করিস না তো।

-আমি সত্যিই কিছু জানি না। তুই বল। তাহলে হয়তো জানতে পারবো।

-সান ভাইয়ার ব্যাপারে তুই কিছুই জানিস না?

-কী জানবো?

মাহিয়া কতক্ষণ খুশবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

-সান ভাইয়ার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে এটা জানিস না তুই?

খুশবু অবাক হয়ে বলল,

-আশ্চর্য! আমি কীভাবে জানবো? আর উনার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ওটা জেনেই বা আমি কী করবো?

-কী পাষাণ রে তুই!

-এইজন্য তুই আমার সাথে কথা বলছিলি না? আমি কি তোর ভাইয়ের প্রেমিকা? নাকি উনাকে আশা দিয়ে রেখেছি? উনার সাথে আমার কোন কথাই নেই।

-আমার ভাইয়ের জন্য কি তোর মনে বিন্দু পরিমাণও জায়গা নেই?

-তা জানি না। ওসব কখনও ভেবে দেখিনি।

-ভাব তবে।

-আমার ভেবেও কোন লাভ নেই। দিন শেষে আমি সেটাই করবো যেটা আমার পরিবার বলবে। আর তুই তো খুব বলেছিলি তোর ভাইয়ের জন্য আমাদের বন্ধুত্বে কখনও আঁচড় আসবে না। তাহলে এই ভুল বোঝাবুঝি কেন তৈরি হলো?

খুশবু মন খারাপ করছে দেখে মাহিয়া ওকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে শুরু করল। আসলো সে ভাইয়ের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

-ছাড় আমাকে।

-না ছাড়ব না।

-তুই আমার কেমন বান্ধবী বোঝা হয়ে গেছে।

-দোস্ত প্লিজ ক্ষমা করে দে। আর জীবনেও এই বিষয় নিয়ে তোর সাথে রাগ করবো না।

-বান্ধবীর থেকে ভাই বড় হবে এটাই স্বাভাবিক।

-সরি না দোস্ত। প্লিজ রাগ করিস না।

-রাগ করার আমি কেউ না।

-তুই-ই আমার সব। আমার জান, বাবু, বয়ফ্রেন্ড।

-এখন এসব নাটক করার কোন মানে হয় না।

🌸

খুশবু বাড়িতে এসে লক্ষ্য করল বাড়ির পরিবেশ আজ বেশ থমথমে। ঝড়তুফান কিছু একটা হয়তো হয়ে গেছে। নইলে কিসের শোক পালন করছে সবাই? অবস্থা বোঝার আগে খুশবু কাউকে কোনরকম ঘাটাল না। মোটামুটি নিঃশব্দ পায়ে ঘরে চলে এলো। কাহিনি কি এটা একমাত্র খুশির থেকেই জানতে পারবে। তারপরও আজ খুশিকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগছে। তবুও ভয়ে ভয়ে বলল,

-বাড়িতে কি কিছু হয়েছে?

তার কথা খুশির কানেই ঢুকলো না। খুশবু আরও কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও যখন কোন জবাব পেলো না তখন সে দাদীর কাছে ছুটলো। পরী বানু মানছুরাকে বোঝাচ্ছিলেন। খুশবু স্পিডে দৌড়ে এলেও দরজার সামনে এসে ব্রেক কষলো। ভেতরে কী আলোচনা হচ্ছে এখান থেকেই শোনার চেষ্টা করল।

-কেন জিদ করতাছো? তোমার মাইয়া তোমার চোখের সামনে থাকব এইডা ভালা না।

-আমার এই ভালোর প্রয়োজন নেই আম্মা।

-তোমার জেদের লগে আজ পর্যন্ত কেউ পারে নাই। আমিও আর পারমু না। যা খুশি করো তুমি।

পরী বানু ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দরজার আড়ালে খুশবুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু বলতে গেলে খুশবু দাদীর মুখ চেপে ধরল।

-বুড়ী এখন কিছু বোলো না।

দাদীকে টেনে খুশবু বারান্দার শেষ মাথায় চলে এলো। পরী বানু বিরক্ত হয়ে বললেন,

-টানাহেঁচড়া করতাছোস কেন?

-বাড়িতে কী হয়েছে গো দাদী।

-যা হওনের তা-ই হইছে।

-বুড়ী কথা না পেঁচিয়ে খোলাসা করে বলো। আমার পেটের ভেতর এসিডিটি হচ্ছে।

-স্মরণ কদু ঘটককে পোলাপান দিয়া শাসাইছে। এই ডরে কদু ঘটক ঘটকালি ছাইড়া দিছে।

-আলহামদুলিল্লাহ। এই শালার জ্বালায় কোন মেয়ে শান্তিতে বাপের বাড়ি থাকতে পারত না।
সমস্যা তাহলে কোন জায়গায় দাদী?

-কদু খুশির ঘটকালি করতাছিল। হের লাইগা স্মরণ ওরে জান নেওনের ভয় দেখাইছে এই কথা পাড়া জুইড়া ছড়াইতাছে।

-ছড়ালে ছড়াল। এই শালার কথা কে বিশ্বাস করবে?

-এই পাড়ার মানুষরে তুই চিনস না? আজগুবি কথাই তো বিশ্বাস করবো। নানান লোকে তোর মা’র কান পড়া দিতাছে।

খুশবু একটু চিন্তিত ভাবে বলল,

-এটা ঠিক। আমাদের পাড়াটা খারাপ। নিজের কাজের থেকে বেশি মানুষের ঝুটঝামেলা নিয়ে নাচে। কিন্তু দাদী স্মরণ ভাই তো সত্যিই খুশিকে পছন্দ করে। তাহলে ওদের বিয়ে দিয়ে দাও না কেন?

-আমার কথাতে কি কিছু হইবো? তোর মারে এই কথা কেডা বুঝাইবো। তোর মা স্মরণের লগে খুশির বিয়া দিবো না।

-কেন?

-আমি জানি না। তোর মারে গিয়া জিগা।

খুশবু ঢোঁক গিলে মনে মনে বলল, থাক আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না। যাদের ঝামেলা তারা বুঝবে। কিন্তু আমি স্মরণ ভাইয়ের দলে।

চলবে

#কমলা_রঙের_রোদ [১৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

খুশির আচরণ কয়েকদিন ধরেই অদ্ভুত ঠেকছিল। শতবার জিজ্ঞেস করেও এর কারণ জানতে পারেনি স্মরণ। তার কোন ভুল হলে সেটা বলুক। মুখে কুলুপ এঁটে রাখা তো কোন সমস্যার সমাধান না। স্মরণ জানত না বাড়িতে খুশির বিয়ের কথা চলছে। যখন জানতে পারল তখন মাথা ঠিক রাখতে পারল না। কদু শালাকে জন্মের শিক্ষা না দিয়ে ছাড়বে না কসম কাটল। স্মরণের চ্যালাপেলার অভাব নেই। কোন বিশেষ কারণে পাড়ার ছেলেরা তাকে সম্মান করে। এই বিশেষ কারণ কী তার জানা নেই। দুই তিনটা ছেলেকে কদু ঘটককে একটু খাতির করার কথা বলেছিল। কথাটা সকালে বলেছিল। দুপুরের মধ্যে ছেলেরা এসে জানাল,

-স্মরণ ভাই, কাজ হয়ে গেছে।

এত তাড়াতাড়ি ওরা কাজ সেরে ফেলবে জানা ছিল না। টং দোকানে বসে ছেলে গুলোর জন্যও চায়ের অর্ডার দিয়ে স্মরণ বলল,

-তোরা তো ভীষণ কাজের দেখছি।

একজন সামান্য লজ্জিত হেসে বলল,

-ব্যাটাকে এমন টাইট দিয়েছি আরেকটু হলে কাপড়ই নষ্ট করে ফেলত।

-কদু ব্যাটা এই জীবনে আর ঘটকালি করার দুঃসাহস করবে না।

স্মরণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল,

-জোশে উঠে বেশি টাইট দিয়ে ফেলিস নি তো? বুড়া শালা মরে টরে গেলে কেস হয়ে যাবে।

-আরে না। তুমি ওসব নিয়ে কোন চিন্তাই কোরো না।

স্মরণ জানত তার এই কাজের জন্য পাড়ায় একটা হৈ-হল্লা তৈরি হবে। কদু ভয়ে থানা-পুলিশ না করলেও চুপ থাকবে না। অন্তত তার বাবা খালার কানে নালিশ তো লাগাবেই লাগাবে। স্মরণ ওসব পরোয়া করে না। খালাও জেনে রাখুক, খুশির বিয়ে সে অন্য কোথাও হতে দিবে না।

🌸

ছেলেকে নিয়ে মিসেস সুলতানার হতাশার সাথে চিন্তারও শেষ নেই। ওরকম একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটানোর পরও এই ছেলের শুধরায়নি। তার কোন কথা তো শুনবেই না ডাক্তারের কথা পর্যন্ত শুনছে না। ডাক্তার পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আপনি কয়দিন হাঁটাচলা করবেন না। কিন্তু এই ছেলে কি ওসব মানতে রাজি! মিসেস সুলতানা ঠিক করলেন ছেলের সাথে যতটা কঠিন হওয়া দরকার হবেন তিনি।

-তুই কি চাস? তোর চিন্তায় চিন্তায় আমিও অসুস্থ হয়ে পড়ি? কারো কথা কেন শুনিস না তুই?

মা’কে রাগতে দেখে সান মিটিমিটি হাসছে। অনেকদিন পর মা’র মুখ থেকে তুই ডাক শুনছে।

-এই ভাঙাচোরা শরীর নিয়ে কোথায় যাবি তুই? কার সাথে দেখা করার জন্য এত উতলা হচ্ছিস?

-তুমি কীভাবে জানো আমি কারো সাথে দেখা করার জন্য উতলা হচ্ছি?

মিসেস সুলতানা এত কথার পরে এই জবাব মোটেও আশা করেননি। সান হাসছে। মা তাহলে সব জানে। অবশ্য মা যদি না জানত তাহলে সে অবাক হতো। মা বললে মা’র স্পাই আন্ডার ওয়াল্ডের খবর পর্যন্ত এনে দিতে পারবে।

-তোমার স্পাইয়ের স্যালারি কত দাও মা?

-কেন? এটা জেনে তোর কাজ কি?

-উনার স্যালারি বাড়াতে হবে।

-সেসব চিন্তা তোকে করতে হবে না। একটা মেয়ের জন্য তুই নিজের জীবনেরও পরোয়া করবি না? এতটা পাগল কেউ কারো জন্য হয়?

-ভালোবাসায় পাগলামি না থাকলে সেটাকে আসলে ভালোবাসা বলা যায় না।

-ভালোবাসায় হাত-পা ভেঙে পড়ে থাকলে খুব লাভ হবে কি?

-আমার তো কোন কিছুতেই লাভ হচ্ছে না। যাকে ভালোবাসি এই কথা তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না।

-কে ওই মেয়ে? নাম কী? বাসার ঠিকানা দে।

সান এক্সাইটেড হয়ে উঠে বসতে গেলে ব্যথায় ককিয়ে উঠল। মিসেস সুলতানা কঠিন চোখে ছেলের কর্মকাণ্ড দেখছেন।

-তুমি আমার হয়ে কথা বলতে যাবে?

-ছেলের ভালোবাসার কথা বলতে যাওয়ার মতো মহাবোকা আমি নই।

সান মন খারাপ করে ফেলল। বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগে মিসেস সুলতানা বললেন,

-গেলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব।

কথাটা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারল না সান। মা কি সত্যি বলছে? পরমুহূর্তে শরীরের ব্যথা সব ভুলে গিয়ে লাফিয়ে উঠে চিৎকার শুরু করল। মিসেস সুলতানা কানে হাত চাপলেন। সান মা’কে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল,

-সত্যি বলছো তুমি মা? কী বলেছ প্লিজ আবার বলো। মনে হয় আমি কানে ভুল শুনেছি। আমার মনে হচ্ছে আমি কোন স্বপ্ন দেখছি। ঘুম থেকে গেলে তুমি আর রাজি হবে না।

🌸

স্মরণ বাড়ি ফিরলে মানছুরার আগে পরী বানু নাতির উপর গালাগাল বর্ষণ করতে লাগলেন। স্মরণ অবশ্য দাদীর লোক কথাই গায়ে মাখছে না। সে কলপাড়ে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এলো। স্মরণ ঘরে এলে দাদীও ওর পেছন পেছন এলো।

-নাদানের ঘরের নাদান কথা কস না কেন? এহন কেন বোবা হইয়া গেছস।

স্মরণ গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে শান্ত স্বরে বলল,

-কী বলবো?

-ওরে গোলাম অহন জিগাস কি কইবি? কদুরে কেন মারছস? গুণ্ডা হইছস? পাইলা টাইলা তোরে গুণ্ডা বানাইছি!

-রিলাক্স দাদী। আমি মারলে কদু এখনও বেঁচে থাকত? তবে হারামজাদাকে একটু টাইট দেওয়ার দরকার ছিল।

-কয়জনরে টাইট দিবি তুই? তোর খালাই তো তোরে মাইয়া দিবো না।

স্মরণ এবার অসহায় চোখে দাদীর দিকে তাকাল। ব্যথিত গলায় বলল,

-কেন দাদী? আমি কি খালার মেয়েকে ভালো রাখব না?

-কেমনে রাখবি রে হারামজাদা। কামকাজ কিছু করস? বিয়া কইরা বউরে খাওয়াইবি কী?

-আমি কাজকর্ম করলে, চাকরি পেলে খালা খুশিকে আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবে?

-তোরে কেডা চাকরি দিবো রে নাদান। তোর ভণ্ডামিই তো শেষ হয় না।

এসময় খুশবু হুড়মুড়িয়ে এসে ঘরে ঢুকলো। মা এতক্ষণ বারান্দায় ছিল বলে আসতে পারেনি। এখন মা ঘরে চলে গেলেই সে চলে এলো। দাদীকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,

-দাদী তুমি স্মরণ ভাইকে এত বোকো না তো। বেচারা কী এমন দোষ করেছে? ভালোবাসার জন্য কত মানুষ কতকিছু করে। স্মরণ ভাই নাহয় একটু মারধোরই করেছে।

পরী বানু আগুন চোখে খুশবুর দিকে তাকিয়ে এক ধমক দিয়ে বললেন,

-তুই চুপ কর খবিশ। নিজেও তো একটা খবিশ হইতাছোস।

খুশবু মুখ বাঁকাল। দাদী এঘর থেকে চলে গেলে খুশবু বিছানায় বসে পড়ে বলল,

-স্মরণ ভাই, তুমি সত্যিই এবার একটা চাকরিবাকরি করো। অনেক তো হলো। এবার জীবন নিয়ে একটু সিরিয়াস হও।

🌸

তিন-চারটা দিন কেটে গেলেও এই বিষয়ে মা আর কিছু বলছে না দেখে সান মনে মনে অস্থির হচ্ছে। মা কি তার মন রাখতে ওসব কথা বলেছিল? কাল থেকে সান একটু হাঁটতে পারছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে সে মা’র ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। একটু নার্ভাস লাগছে। তবে মা’কে সে ভয় পায় না।

-মা আসবো?

-সান! আবারও তুই বেড থেকে নেমেছিস? তোকে নিয়ে কী করবো আমি!

রুমের ভেতর ঢুকে সান দেখল মা কিছু ফাইল দেখছিল। সান গাল ফুলিয়ে ফেলল। মা তার বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

-তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে মা।

-কী কথা দিয়েছিলাম?

সান আশ্চর্য চোখে মা’কে দেখে কিছুটা অভিমান করে বলল,

-ভুলেও বসে আছো!

মিসেস সুলতানা ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে হাসছেন। মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা তার মনে আছে। কিছু কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিল এই যা।

-বয়স হয়েছে। কত কথাই তো ভুলে যাই৷ তুই মনে করিয়ে দে।

-তুমি বলেছিলে যাবে।

-কোথায়?

মা কি জেনে-বুঝে তার সাথে মজা করছে? মিসেস সুলতানা পরীক্ষা করছিলেন তার ছেলে কতটা পাগল।

-মা প্লিজ। তোমার স্মৃতিশক্তি এতটাও খারাপ না।

মিসেস সুলতানা হেসে ফেললেন। ছেলের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললেন,

-যাবো রে পাগল। আমার সব মনে আছে। কিছুই ভুলিনি। জরুরি কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলাম।

-কবে যাবে?

সান এতটাই এক্সাইটেড সে মা’কে এটা জিজ্ঞেস করতেও দ্বিধাবোধ করল না। মিসেস সুলতানা ছেলেকে এতটা অধৈর্য হতে দেখে হাসতে লাগলেন।

-ভাগ্যবতী সেই মেয়ে যার জন্য আমার ছেলে এতটা পাগল।

🌸

পরীক্ষা শেষ এখন আর খুশবুর কোন কাজকর্ম নেই। বেকার দিন কাটতে চায় না।
কোথাও বেড়াতে যেতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু তার কোন আত্মীয় নেই। পল্টু আজকে কোত্থেকে যেন অনেকগুলো কাঁচা আম এনে দিয়েছে। খুশবু উঠানে কাঁঠাল গাছের নিচে বসে আম গুলো কাটছে। অনেক বেশি ঝাল দিয়ে ভর্তা করে খাবে। গেট খোলাই ছিল। হঠাৎ করে গেট দিয়ে একজন মহিলা এসে উঠল। মহিলার পেছনে একজন পুরুষও আছে দেখে খুশবু তাড়াতাড়ি করে মাথায় ওড়না দিতে লাগল। মিসেস সুলতানার চোখ প্রথমেই খুশবুর উপর পড়েছে। তিনি খুশবুর দিকে এগিয়ে এলেন। খুশবু দৌড়ে ঘরে চলে যাবে কি-না ভাবছে। যদিও এমনটা করা অসভ্যতা হবে। খুশবু মা’র ঘরের দিকে দেখছে। মা দাদী কেউ বেরোচ্ছে না কেন?
মিসেস সুলতানা খুশবুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-তোমার মা বাসায় আছেন?

-হু, হ্যাঁ। আপনারা একটু দাঁড়ান। আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি।

এটা বলেই খুশবু আম-টাম সব ফেলে ঘরে চলে গেল। বাইরে যেন কে এসেছে এই কথা মাকে বলতেই মানছুরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

মিসেস সুলতানা না জানিয়ে আসার জন্য প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। তিনি সাথে করে অনেকগুলো মিষ্টিও এনেছেন। মানছুরা যদিও মনে মনে একটু বিরক্ত হলো। এতগুলো মিষ্টি নিয়ে আসার কোন মানে ছিল না। মিসেস সুলতানা তার এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্যের কথা জানালেন।

-আমি আপনার মেয়েকে আমার ঘরের বউ করে নিতে চাই। আপনার মেয়েকে আমার ছেলে পছন্দ করেছে।

খুশবু দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভেতরের আলোচনা শুনে মুখে হাত চেপে ধরল। মনে মনে বলল,

-স্মরণ ভাইয়ের আবার কোন শত্রু বেরিয়ে এলো? কোন শালা খুশিকে পছন্দ করেছে? স্মরণ ভাইয়ের এখন কী হবে?

চলবে