কমলা রঙের রোদ পর্ব-১৬+১৭

0
6

#কমলা_রঙের_রোদ [১৬]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

খুশির বিয়ের কথা শুনে পরী বানু নড়েচড়ে বসলেন। মানছুরার সাথে কোন বিশ্বাস নেই। স্মরণ ছাড়া সে পৃথিবীর যেকারো সাথেই মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যাবে। মানছুরা এখনও প্রস্তাবটা নিয়ে ভেবে দেখছেন। মিসেস সুলতানা আশানুরূপ কোন উত্তর না পেয়ে আবার বললেন,

-আপনি হয়তো দ্বিধায় পড়ে গেছেন। এক্ষুনি আপনাদের কোন উত্তর দিতে হবে না। আগে আমার ছেলেকে দেখুন। ওকে পছন্দ হলে আমাদের সম্পর্কে জেনে নিন। তারপর নাহয় ভেবে দেখবেন।

মানছুরা উনাকে না চিনলেও মহিলার পরিমার্জিত আচার-ব্যবহার দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছেলেকে কেমন শিক্ষা দিয়েছেন তিনি।
পরী বানু মানছুরার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছেন। মনে মনে ভাবছেন,

-বউয়ের মতিগতি তো কোনকালেই বুঝি নাই। এইবারও কী করবো আল্লাহ মাবুদ ছাড়া কেউ জানবো না।

মানছুরা মুখ খোলার আগে পরী বানু জিজ্ঞেস করে উঠলেন,

-আপনার পোলা কাজকাম কী করে?

-এমবিএ করছে। এর সাথে সাথে আমার বিজনেসও অর্ধেক ও-ই দেখছে।

পরী বানু যদিও তেমন কিছু বুঝলেন না। তারপরও প্রস্তাবটা কোনভাবে কাটিয়ে দিতে হবে। তার আপন নাতি থাকতে খুশির বিয়ে অন্য কারো সাথে কেন দিবে?

-পোলা না দেইখা আমরা কোন কথাই দিবার পারমু না। আগে আপনার পোলা দেখমু। আমাগো পছন্দ হইলে পরে যাইয়া বিয়ার কথা আগাইবো।

-ছেলেকে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। তারপর ভাবলাম প্রথমবার আমার যাওয়া উচিত। যদিও আমি এখন আপনাদের আমার ছেলের ছবি দেখাতে পারবো। সামনাসামনি নাহয় অন্য কোনদিন দেখে নিবেন।

খুশবু দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে হাত কামড়ে ভাবছে, মহিলা তো আটঘাট বেঁধে এসেছে মনে হচ্ছে। গেটের বাইরে এত বড় একটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছে। দেখে বড়লোকও মনে হচ্ছে। যদিও এটা একটু স্বস্তি দিচ্ছে। মা সচরাচর বড়লোক মানুষদের দেখতে পারে না। বড়লোকরা গরিবদের মানুষ মনে করে না। কোন বড়লোক বাপের বেডার খুশিকে পছন্দ হয়ে গেল!

-আম্মা খুশি ফিরেছে কি-না একটু দেখবেন?

এতক্ষণ পরী বানু সব কথা বললেও মানছুরা এবার শাশুড়ীকে এটা বলে ঘর থেকে পাঠিয়ে দিল। এঘর থেকে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও পরী বানুকে ছেলের বউয়ের কথা শুনতে হলো। দাদী ঘর থেকে বেরোনোর সাথে সাথে খুশবু খপ করে হাত ধরে ফেলল। অধৈর্য গলায় জিজ্ঞেস করতে লাগল,

-ভেতরে এতক্ষণ কী কথা হলো দাদী? কে এই মহিলা? এখানে কী করতে এসেছে? মা কী রাজি হয়ে যাবে? তাহলে স্মরণ ভাইয়ের কী হবে?

ছেলের ছবি মানছুরা দেখেছেন। ছেলের মায়ের কথাবার্তাও শুনেছেন। এবার নিজের দিক থেকে কিছু বলা উচিত।

-আপনার ছেলে আমার মেয়েকে পছন্দ করেছে বলেই আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন। কিন্তু বিয়ের জন্য শুধু ছেলের মেয়েকে পছন্দ করাই শেষ কথা না। মেয়ের পরিবার সম্পর্কেও নিশ্চয় জানতে চাইবেন।

মানছুরা স্বল্পভাষী হলেও মিসেস সুলতানার মানছুরার কথাগুলো পছন্দ হয়েছে। তিনি সামান্য হেসে বললেন,

-তা চাইবো। অবশ্য আমার জন্য আমার ছেলের পছন্দই মূখ্য বিষয়।

-তারপরেও কোনকিছু লুকিয়ে আমি মেয়ের বিয়ে দিব না। আমার স্বামীর দ্বিতীয় সংসার ছিল। ওই সংসারে একটা মেয়েও আছে। যদিও ওই মেয়ে এখন আমাদের সাথেই থাকে। বাবার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে অনেকেরই মেয়ের বিয়ে নিয়ে আপত্তি থাকে।

-আমার কোন আপত্তি নেই। সব জেনেই আমি আপনার বাড়িতে এসেছি। অতীতে যা হয়েছে তাতে আপনার বা আপনার মেয়ের কোন দোষ আমি দেখি না। তাহলে কেন এই বিষয়টা নিয়ে আমার কোন আপত্তি থাকবে?
আমি শুধু আপনার মেয়েকে চাই। আমাদের আর কোন চাওয়া নেই।

খুশি এখনও বাড়ি ফিরেনি। মিসেস সুলতানা অনেকটা সময়ই খুশির ফেরার অপেক্ষায় বসে ছিলেন। এর মধ্যে মানছুরা মেহমানের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছেন। তবে জরুরি একটা কল চলে এলে মিসেস সুলতানাকে উঠতে হলো। তিনি মানছুরা পরী বানুর থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসে চলে যাওয়ার একটু পরই খুশি বাড়ি ফিরে। মানছুরা এখন খুশিকে কিছু না জানালেও খুশবু পেটের মধ্যে কথা চেপে রাখতে পারল না। খুশি ঘরে যাওয়ার সাথে সাথে খুশবু পেছন দিয়ে এসে হাজির হলো। কথাটা বলার জন্য খুশবু উসখুস করছে। কিন্তু খুশি তার দিকে পাত্তাই দিচ্ছে না।

-খুশি।

-হুম।

খুশি আলনা থেকে কাপড় নিলো। পরনের কাপড় ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেগে আছে। খুশি ঘুরে দাঁড়ালে খুশবু সামনে পড়ল।

-সামনে সামনে ঘুরছিস কেন?

-একটা কথা।

-কী কথা বল।

-তুই মনোযোগ দিয়ে শুনছিস না তো।

-শুনছি। তুই বল।

-আজ বাড়িতে একটা মহিলা এসেছিল। বড় গাড়ি করে এসেছে।

-হুম তারপর।

-মহিলা ওর ছেলের জন্য তোর বিয়ের কথা বলতে এসেছিস। অনেকক্ষণ মা দাদীর সাথে কথা বলেছে।

খুশি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার মনের ভেতর কী চলছে খুশবু বুঝতে পারল না। এত বড় একটা খবর শুনিয়েছে। কিন্তু খুশির কোন প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না। খুশবু বিড়বিড় করে বলল,

-রোবট একটা!

🌸

এক বাড়িতে থাকলেও স্মরণের সাথে ইদানিং খুশির কথাবার্তা খুব কমই হয়। একজন আরেকজনকে দেখলেও এড়িয়ে যায়। রাত প্রায় শেষ হয়ে এলেও খুশির চোখে ঘুম নেই। কয়েকটা রাত ধরে একেবারেই ঘুমাতে পারে না। খুশি বিছানায় উঠে বসল। খুশবু ঘুমিয়ে আছে কিনা বোঝার জন্য খুব হালকা গলায় কয়েকবার ওকে ডাকল। খুশবুর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে খুশি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে গেল। যেন শব্দ না হয় খুব সাবধানে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো।
খুশবু চোখ বন্ধ রেখেই বলল,

-লায়লা মজনু ফেইল! কী পিরিত!

খুশির ভেতর এত সাহস কোত্থেকে এলো সে নিজেও জানে না। স্মরণের ঘরের সামনে এসে দরজায় কয়েকবার টোকা দিল। স্মরণের ঘুম পাতলা হওয়ায় এই সামান্য শব্দেও জেগে উঠল। দরজা খুলে খুশিকে সামনে দেখে বেচারা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। খুশি নিভু নিভু গলায় বলল,

-তোমার সাথে কিছু কথা আছে।

স্মরণের চোখের বাদবাকি ঘুমটুকুও ফুড়ুৎ করে উড়াল দিল। বেচারার স্বাভাবিক হতেই অনেকটা সময় লাগল।

-কী এমন কথা যা মাঝরাতেই বলতে হবে। দিনের বেলা বলা যেত না?

আজ খুশি সাহসী হয়ে গেলেও স্মরণ ভীতু হয়ে গেছে। স্মরণের এই কথা শুনে খুশি রাগ করে চলে যেতে চাইল স্মরণ ওর হাত ধরে ফেলল।

-এত রাগ কেন তোদের? মা মেয়ের সমান রাগ।

স্মরণ খুশিকে নিয়ে কলপাড়ের ভেতরের দিকে চলে এসেছে। একটু একটু আলো ফুটতে শুরু করেছে। স্মরণ বলল,

-কী বলবি বল।

-তুমি জানো বাড়িতে কী হচ্ছে?

-কী হচ্ছে?

-আমার বিয়ের কথা চলছে।

স্মরণ হতবাক হয়ে রইল। কদু ঘটক আবার ঘটকালি শুরু করেছে? শালাকে এবার জ্যান্ত ছাড়বে না।

-কদু শালাকে গাছে ঝুলিয়ে পেটাবো। শালা এখনও…

-কদু না। কে বা কারা এসেছিল আমি জানি না। কিন্তু এব্যাপারে কথা যে হচ্ছে এটা জানি।

এতক্ষণ খুশির গলা স্বাভাবিক থাকলেও এবার গলাটা যেন একটু কেঁপে উঠল।

-তুমি কি কিছুই করবে না?

স্মরণ খুশির কন্ঠের পরিবর্তন টের পেলো। সে-ও নরম স্বরে বলল,

-তোর কী মনে হয় আমি কিছু করছি না? আজকাল আমি কোথায় থাকছি সারাদিন?
আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দে। অনেক জায়গায় চাকরির কথা হয়েছে। আমি বেকার এজন্যই তো খালা তোকে আমার হাতে তুলে দিবে না। আমার চাকরি হলে তখন নিশ্চয় খালার আপত্তি থাকবে না। কাল একটা ইন্টারভিউ আছে। ভাগ্য সহায় হলে চাকরিটা পেয়ে যাব।

চারদিক ফরসা হয়ে উঠেছে। এখানে তাদের একসাথে দেখে ফেলার ভয় আছে। তাই খুশি স্মরণকে একটু দেরি করে যেতে বলে নিজে আগে চলে এলো। অজু করার জন্য কলপাড়ে এসেছিল মানছুরা। ওরা কেউ জানতেই পারল না মানছুরা ওদের সব কথা শুনে নিয়েছে।
খুশি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।

-প্রেমিক প্রেমিকা আর চোরের মাঝে তেমন কোন পার্থক্য নেই।

হঠাৎ খুশবুর কথা শুনে খুশি ভয় পেয়ে বুকে হাত চেপে ধরল। খুশবু জেগে আছে! এই মেয়ে কি তাকে একটু শান্তিও দিবে না।

🌸

মা খুশবুদের বাড়ি থেকে এসে কিছুই তো জানাল না। কী কথা হয়েছে ওখানে। খুশবুর পরিবার কি রাজি হয়েছে? কাল রাতে এসব ভেবে ভেবেই ঘুম হয়নি। সান মা’র রুমে যাওয়ার জন্য বিছানা থেকে পা নামিয়েছে তখনই তার ফোন বাজতে লাগল। মাহিয়া এত সকালে কেন কল করেছে? সান কল রিসিভ করার সাথে সাথে মাহিয়ার চিৎকারে তার কান তব্দা হয়ে গেল।

-তুমি এটা করতে পারলে ভাইয়া! এত বড় অন্যায়টা আমার সাথে কীভাবে করলে?

সান কপাল কুঁচকে ভাবছে কী এমন অন্যায় করেছে সে যার জন্য মাহিয়া তার কানের উপর এই অত্যাচার চালাচ্ছে।

-কী করেছি আমি একটু বলবি?

-তুমি জানো না কী করেছ? তুমি এত ফাস্ট! আমাকে দেশে এসে নিতে দিতে। তুমি তো তার আগেই সব করে ফেলেছ।

-কী করেছি সেটা তো বলবি বোন?

-এখনও তুমি ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করছো!

এই গাধাটা পাগল টাগল হয়ে গেছে নাকি? তখন থেকে কী সব বলে যাচ্ছে। সান কল কেটে দেওয়ার মন বানিয়ে নিয়েছে তখনই মাহিয়া বলল,

-অবশেষে সত্যিই তুমি খুশবুকে আমার ভাবী বানাতে যাচ্ছ!

-মানে?

এবার সানের চিৎকারে মাহিয়ার কান তব্দা হলো।

-উফ চেঁচাচ্ছ কেন?

মা কি তাহলে সবকিছু ঠিক করে এসেছে? কিন্তু তাকে কেন কিছু জানায়নি। সান ফোন ফেলে মা’র ঘরের দিকে ছুটলো। তার বিশ্বাস হচ্ছে না।

🌸

রাতে খুশির ঘুম হয় না। সকালের দিকে চোখটা একটু লেগে আসে। অন্যান্য দিনের থেকে আজ খুশির ঘুম ভাঙতে একটু বেশি বেলা হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে খুশি যে কথাটা জানতে পারল তাতে ওর পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। কাল নাকি তার বিয়ে। কার সাথে হবে বিয়ে? বিয়ে কার সাথে হবে তার থেকে বড়ো কথা এব্যাপারে তাকে কেউ কিছু কেন জানায়নি?
খুশি মরে গেলেও এই বিয়ে করবে না। তার সিদ্ধান্ত মাকে জানিয়ে দিতে চলল সে। খুশিকে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে মা’র ঘরের দিকে যেতে দেখে খুশবুও পেছনে এলো।

-খুশি কোথায় যাচ্ছিস তুই?

-আজ আমার পথে আসিস না খুশবু। ভালো হবে এই ব্যাপার থেকে তুই দূরে থাক।

এই কথা শুনে খুশবু আর খুশির পেছনে গেল না। মানছুরা মেয়েকে দেখেই বুঝতে পেরেছেন। খুশি দৃঢ় ও কঠিন গলায় মাকে জানাল,

-এই বিয়ে করবো না আমি। এসব করার আগে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করলে না! আমার জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?

মানছুরা শান্ত চোখে মেয়েকে দেখছেন। খুশি রাগে থরথর করে কাঁপছে। মানছুরা এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। পরী বানু তাই ছুটে এসেও মা মেয়ের মাঝে কথা বলতে পারলেন না।

-তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমাকে কে দিয়েছে জানতে চাস তো? ঠিক আছে। তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো আমি। কিন্তু তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে, তোর এই জীবন তোকে কে দিয়েছে?

খুশি মা’র কথা শুনে থমকে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে মা’র দিকে তাকিয়ে রইল।

-দশ মাস তোকে পেটে রেখেছি। জন্মের ছয় বছর পরই তোর ওই বাপ তোর মুখ দেখেছি। দেশে এসেও যে মেয়ের ভালোবাসায় পাগল ছিল এমনটাও হয়নি। তোর ভাগের ভালোবাসা সবসময় অন্য একজনকে দিয়েছে। জন্মের পর থেকে সর্বক্ষণ আমি তোর কাছে ছিলাম। তোর সব চাওয়া আমি পূরণ করেছি। যত খারাপ দিনই যাক তোকে কখনও কষ্ট বুঝতে দেইনি। নিজে না খেয়ে থেকেছি কিন্তু তোর মুখে খাবার ঠিকই তুলে দিয়েছে। দুনিয়া থেকে তোকে আগলে রেখেছি। এখন তুই জিজ্ঞেস করছিস তোর জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমাকে কে দিয়েছে?

খুশি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কোন উত্তর দিতে পারল না।

-তোর জীবনের সিদ্ধান্ত তুই নিজে নিতেই পারিস। তোর জীবনের ভালোটা তুই সবথেকে বেশি বুঝবি। বিয়েতে রাজি না হলে আমি তোকে জোর করবো না।

খুশি কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল। মা তার জন্য নিজের জীবনের সুখদুঃখ ত্যাগ করেছে। মা’র কথার অবাধ্য সে হতে পারবে না। কিন্তু স্মরণকে ঠকানোর কথা ভাবলেও নিজের জীবনই শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। সৃষ্টিকর্তা এ কোন পরীক্ষায় ফেলল তাকে?

চলবে

#কমলা_রঙের_রোদ [১৭]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

স্মরণ চাকরির ইন্টারভিউ দিতে সকাল আটটার আগেই এসে বসে আছে। গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করেও কখনও চাকরি করার কথা ভাবেনি। আসলে তখন জীবনের কোন লক্ষ্য ঠিক করতে পারেনি। ছোট্ট একটা জীবন। যেমন-তেমন করে বেঁচে থাকলেই হয়। কিন্তু এখন সে যেমন-তেমন করে নয়, ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে সুন্দর ভাবে জীবনটা কাটাতে চায়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ইন্টারভিউ দেওয়ার মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। স্মরণ জীবনে কোনদিনও নার্ভাস হয়নি। যা আছে কপালে বলে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ তার নার্ভাস লাগছে। যে করেই হোক চাকরিটা তাকে পেতেই হবে। তার আর খুশির মাঝের দূরত্ব কেবলমাত্র একটা চাকরি। খালার সামনে দাঁড়াতে হলে চাকরিটা জরুরি। একটা ছেলে তার মতোই হবে বয়স। বা কিছু কমও হতে পারে। সে স্মরণের সামনে এসে বলল,

-ভাই, এখানে একটু বসতে পারি?

স্মরণ তার ফাইলপত্র হাতে তুলে নিয়ে বলল,

-বসুন।

ছেলেটা বসেই স্মরণের সাথে আলাপ জুড়ে দিতে চাইল।

-জীবনে প্রথম বার চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। ভীষণ নার্ভাস লাগছে।

স্মরণ ছেলেটাকে দেখল। এই ছেলের অস্থিরতা আচার-আচরণেই ফুটে উঠছে। তবে এক্ষেত্রে সে একটু ভিন্ন। ভয়, দুশ্চিন্তা কোনকিছুই চেহারায় প্রকাশ পায় না।

-আপনি কি এর আগে কোথাও চেষ্টা করেছিলেন?

-না।

-এখানেই প্রথম?

-হ্যাঁ।

-আপনার ভয় লাগছে না?

-না।

ছেলেটা কেমন অবাক চোখে স্মরণকে দেখছে। তারপর লজ্জিত ভাবে একটু হেসে বলল,

-আপনি মনে হয় মনে মনে আমার উপর হাসছেন। আমি ছোটবেলা থেকেই এমন। কোন কাজ করার আগে ভয়েই অর্ধেক হার মেনে নিই।

-ভয় পেয়ে যদি পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো যেত তাহলে আমিও হয়তো ভয় পেতাম।

🌸

খুশি মা’র ঘর থেকে এসে নিজের ঘরে দরজা দিয়ে ফেলল। এই মেয়ে খালি ঘরে কিছু করে ফেলবে নাকি এই ভয় পেয়ে খুশবু দরজা ধাক্কাতে লাগল।

-খুশি দরজা খোল। এই খুশি, কানে কালা হয়ে গেছিস নাকি? দরজা খোল।

খুশি কোন সাড়াশব্দ না করে খুশবু দৌড়ে জানালা দিয়ে এসে উঁকি দিল। ভাগ্য ভালো জানালা খোলাই ছিল। খুশি কিছু করছে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। খুশবু ছোট্ট একটা দম ফেলল।

-ঘর কি তোর একার? দরজা কেন খুলছিস না? ঘরে আমার দরকার আছে। দরজা খোল।

খুশি উঠে চোখ মুছে দরজা খুলে দিল। খুশবু দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে পড়ল। খুশি কান্না থামানোর চেষ্টা করলেও এখনও ফোঁপাচ্ছে। খুশবু খুশির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, ভালোবাসলে এত কষ্ট পেতে হয়? তার থেকে কাউকে না ভালোবাসাই ভালো।

-মা কী বলেছে?

-কিছু না।

খুশবু বিরক্ত চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মেয়ে ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। তার সাথে দুই একটা কথা শেয়ার করলে কী এমন ক্ষতি হয়!

-দুঃখের দিনে বোনই বোনের কাজে আসে। মা কী বলেছে বল। আমি হয়তো কোন সাহায্য করতে পারব।

-তোর সাহায্য আমার লাগবে না।

খুশবু মন থেকে বোনের জন্য ভাবছিল দেখেই তো ওর কাছে এসেছিল। কিন্তু খুশি সবসময় এমন করে। খুশবুও রাগ দেখিয়ে বলল,

-সাহায্য না লাগলে মর গিয়ে। আমিই গাধার বাচ্চা। নাহলে তোর জন্য কেন ভাবি? তুই যে একটা শয়তান এটা মাঝে মাঝে ভুলে যাই।

🌸

বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হচ্ছে দেখে সানের বাড়িতেও তেমন কোন জাঁকজমক আয়োজন হচ্ছে না। বরযাত্রী কয়েকজন মানুষ যাবে। তাদের এখানে পরে বড় করে রিসিপশন পার্টি রাখা হবে। মিসেস সুলতানা তারপরও ম্যানেজারকে হলুদের ছোটখাটো একটা আয়োজন করতে বলেছে। সানের পা এখনও পুরোপুরি সেরে উঠেনি। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছে, সত্যিই কি খুশবু সারাজীবনের জন্য তার হয়ে যাচ্ছে? মা খুশবুকে দেখে আসার দুই দিনের মধ্যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ে ঠিক হবার পরেও সান খুশবুর সাথে দেখা করতে পারেনি। তার কি একবার খুশবুর সাথে দেখা করা উচিত?

-আমি এমন গাধার বাচ্চা কেন? মা বিয়ে ঠিক করার আগে খুশবুর সাথে আমার পার্সোনালি কথা বলে নেওয়া উচিত ছিল।

গাড়ির চাবি আর ফোন হাতে নিয়ে সান রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এসময় ছেলেকে বেরোতে দেখে মিসেস সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন,

-কোথায় যাচ্ছিস?

-কাজ আছে একটু।

-আজকেও তোর কিসের কাজ? ভুলে গেছিস তোর হলুদ আজ।

-অনেক জরুরি কাজ মা।

এই ছেলে কখনোই তার কোন কথা শুনে না। তাই মিসেস সুলতানা একটু রাগ হয়ে বললেন,

-যেখানে খুশি যা। কিন্তু বিকেলের আগে চলে আসিস।

সান চলে যেতে যেতেও দাঁড়িয়ে বলল,

-মা আমার শ্বশুরবাড়িতে একটা কল করতে পারবে? হবু বউকে দেখতে ইচ্ছে করছে। সে যদি একটু গেটের সামনে আসতো। আমি বাড়ির ভেতর ঢুকবো না।

মিসেস সুলতানা চোখ বড়ো বড়ো করে ছেলেকে দেখছেন। এই ছেলে কি লাজলজ্জা সব বিসর্জন দিয়েছে!

-কালই তো। একটা দিন অপেক্ষা করতে পারবি না?

সান ব্যথিত মুখ করে বলল,

-কষ্ট হবে।

🌸

স্মরণের ইন্টারভিউ খুব যে ভালো হয়েছে তা না। আবার খুব খারাপও হয়নি। ওরা বলেছে পরে যোগাযোগ করবে। এটা একটা বাহানাও হতে পারে। হয়তো মুখের উপর বলতে পারেনি আপনাকে আমরা চাকরিতে নিচ্ছি না। নতুন অফিস। এখনও লিফট চালু হয়নি। তাই চারতলা থেকে সিঁড়ি বেয়েই নিচে নামতে হয়েছে। এসি রুমে বসে গরম টের পাওয়া না গেলেও এখন গা জ্বলছে। হাতে থাকা ফাইলটা নালায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। এসব সার্টিফিকেট দিয়ে যে কিছু হবে না সে-ও জানে। কয়েকদিন ধরে বাইক নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বাড়ি ফেরার জন্য স্মরণকে রিকশা খুঁজতে হলো। একটা খালি রিকশা দেখতে পেয়ে ডাকল,

-এই মামা, যাবা?

-না মামা, যামু না।

-খালিই তো যাচ্ছ। যাবে না কেন?

-বাড়িত যামু মামা। বউ অপেক্ষা করতাছে।

ক্লান্ত মুখেও হাসি ফুটে উঠল স্মরণের। মামারও বউ আছে। শুধু তার বিয়েটাই হচ্ছে না। খালা যে কেন তার লাইফের ভিলেন হচ্ছে!

স্মরণ বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর পেরোলে। গেটে পা দিয়েই বুঝতে পারল আজ বাড়ির আবহাওয়া একটু ভিন্ন। পাড়ার কাকীরা এসময় তাদের বাড়িতে জড়ো হয়েছে কেন? স্মরণ কিছু বুঝে উঠার আগেই খুশবু ঝড়ের বেগে এসে স্মরণের হাত ধরে টেনে কোথাও নিয়ে যেতে লাগল।

-আরে টানছিস কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস খুশবু?

-কথা বোলো না। আসো আমার সাথে।

-কোথায় যাব? বাহির থেকে ফিরেছি। ঘরে তো যেতে দে। আর বাড়িতে এত মানুষ কেন?

খুশবু স্মরণের হাত ছেড়ে দিয়ে করুণ মুখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

-স্মরণ ভাই, মা খুশির বিয়ে দিচ্ছে। তুমি যেভাবেই হোক বিয়েটা আটকাও।

স্মরণ এসবের কিছুই জানত না। বলা যায় এটা শুনে সে আকাশ থেকে পড়েছে। খুশির বিয়ে মানে কী! স্মরণ যতটা ধাক্কা পেয়েছে তার থেকে তিনগুণ রেগে খালার কাছে যেতে চাচ্ছিল। খুশবু ফের স্মরণের হাত খামচে ধরে বলতে লাগল,

-তুমি খুশিকে নিয়ে পালিয়ে যাও স্মরণ ভাই।

-হাত ছাড় খুশবু।

-কেন? পালাবে না? আমি সবদিক দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবো।

-তোর সাহায্য আপাতত তুলে রাখ। আমি তোর মা’র সাথে বোঝাপড়া করতে যাচ্ছি।

ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হলেও হাজারটা কাজকর্ম রয়েছে। সব কাজই মানুষকে দিয়ে করাতে হচ্ছে বলে সময়ও বেশি লাগছে। রাগ ক্ষোভ দুঃখের মিশ্র এক অনুভূতি নিয়ে স্মরণ খালার কাছে এসে হাজির হলো। মানছুরা স্মরণকে দেখেও বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দিলেন না।
কম্পিত কন্ঠে স্মরণ বলল,

-তুমি আমার সাথে কেন এমন করছো খালা? আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি? ছোট থেকে মায়ের ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছো। দুঃখ কষ্টকে কখনও আমার কাছে ঘেঁষতেও দাওনি। তাহলে তুমিই কেন আমাকে পৃথিবীর সবথেকে বড় দুঃখটা দিতে চাচ্ছ? আমার জন্য তোমার মন কাঁদে না? মায়া হয় না একটুও?

স্মরণের চোখ জলে টলমল করছে। মানছুরা সরাসরি স্মরণের দিকে না তাকিয়ে বলল,

-আমি যা করছি ধরে নে এতেই তোদের ভালো হবে।

-এটা কেমন ভালো খালা? খুশিকে ছাড়া আদোও কি আমি ভালো থাকতে পারবো?

-পারবি।

-পারবো না খালা। তোমার মেয়েকে ছাড়া আমি বাঁচতেই পারবো না। ভালো থাকা তো অনেক পরের ব্যাপার।

তার চোখে পানি দেখেও কি খালার মন একটুও গলছে না? স্মরণ মানছুরার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে বলল,

-তোমার মেয়েকে আমি ভিক্ষা চাই খালা। খুশিকে তুমি আমার থেকে দূর কোরো না। আমি মরে যাব।

স্মরণ রেগে মা’র কাছে গেছে খুশবু খুশিকে এই কথাটা জানালে খুশি ছুটে এসেছিল। কিন্তু দরজায় পা রেখে স্মরণকে তার মায়ের হাত ধরে তাকে ভিক্ষা চাইতে দেখে থেমে গেল। খুশবুও স্মরণের কান্না দেখে কাঁদছে। সব দোষ সে খুশিকে দিচ্ছে। খুশি কেন বিয়েতে রাজি হয়েছে? খুশির পেছন থেকে খুশবু বলল,

-এখনও তুই স্মরণ ভাইকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবি? স্মরণ ভাইয়ের জন্য তোর কষ্ট হয় না?

🌸

মিসেস সুলতানা বিকাল থেকে সানকে কল করে যাচ্ছে। প্রথম কয়েকবার রিং হলেও সান কল তুলেনি। এখন তো ফোনই সুইচ অফ বলছে। আজকে ওর হলুদ এটাও কি ভুলে গেছে? সান বলে গিয়েছিল খুশির সাথে দেখা করবে। মিসেস সুলতানা সেখানেও কল করে জানলেন। সান ওবাড়িতে যায়নি। কোথায় গেল ছেলেটা? সন্ধ্যার পর থেকে মিসেস সুলতানার অস্থিরতা বাড়তে লাগল। তিনি ছেলের খোঁজ করার জন্য নানা জনকে লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু সান কোথায় গেছে কেউই সঠিক খবর এনে দিতে পারল না।

চলবে