কমলা রঙের রোদ পর্ব-২৩+২৪

0
4

#কমলা_রঙের_রোদ [২৩]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

মা তার সাথে কথা বলতে চাইবে এটা আশা করেনি খুশবু। সান তার দিকে ফোন এগিয়ে দিলে খুশবু ফোনটা হাতে নিয়েও বিশ্বাস করতে পারছে না মা তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। খুশি লুকিয়ে কাঁপা গলায় খুশবু বলল,

-হ্যালো মা!

-হুম। কেমন আছিস তুই?

খুশবুর বুকের ভেতর চিন করে উঠল। মা কি সত্যিই তার সাথে কথা বলছে?

-তোমাদের ছাড়া আমি কেমন থাকতে পারি? তোমরা ভালো আছো? আমার কথা মনে পড়ছে না?

মানছুরা ফোনের এপাশে অনেকটা সময় চুপ করে রইলো। খুশবু মনে করেছিল কল কেটে গেছে। খুশবু প্রায় কেঁদে ফেলবে এমন সময় মানছুরা বলল,

-জামাইয়ের সাথে আমার একটু কথা বলিয়ে দে।

খুশবু জলে টলমল চোখে সানের দিকে দেখল। তার সাথে কথা না বলে সানের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে শুনে রাগও হলো। সানকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে খুশবু গিয়ে রাগ করে বিছানায় বসে থাকল।
শাশুড়ির সাথে কথা বলতে বলতে সান খুশবুকে দেখছে। কথা বলার মাঝে মুচকি মুচকি হাসছে আবার! খুশবু অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো। শাশুড়ির সাথে কথা বলা শেষ করে খুশবুকে সান কিছুই বলল না। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে খুশবু ফোঁসে উঠল।

-কত্ত বড়ো শয়তান দেখেছ! আমার মা’র সাথে কী কথা বলেছে সেটা আমাকে বলার প্রয়োজনই মনে করল না।

খুশবু রাগ করে ঘরেই বসে থাকল। তার ভীষণ মন খারাপ করছে। বাড়িতে যেতে না পারলেও সবার সাথে কথা বলতে পারলে মনটা হয়তো একটু হালকা লাগত। কিন্তু সেটাও হলো না।
এক ঘন্টা পর সান ঘরে এসে তাড়া দিতে লেগে বলল,

-এখনও বসে আছো কেন? পাঁচ মিনিটের ভেতর রেডি হয়ে আমার সামনে এসো।

খুশবু আগে থেকেই রেগে ছিল, এখন সানের আদেশ শুনে আরও রেগে গেল। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,

-আপনার তো সাহস কম না। কী মনে করতেছে আপনি? বিয়ে করে আমাকে আপনার হাতের পুতুল বানিয়ে নিয়েছেন? যখন যা বলবেন তা-ই করতে হবে!

সান বড়ো বড়ো চোখ করে খুশবুর দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে দায়সারা ভাবে হাই তুলে বলল,

-ঠিক আছে। তুমি তোমার মর্জির মালিক। আমি তোমাকে জোর করবো না। তাহলে কি শাশুড়ী আম্মাকে কল করে জানিয়ে দেবো তুমি যেতে চাচ্ছ না?

খুশবু ঝট করে সানের দিকে তাকাল। এই লোক তার সাথে বিটকেল গিরি করছে! লাফিয়ে উঠে এসে খুশবু বলল,

-একদম না। আপনি আগে বলেছেন আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছেন? যদি বলতেন আমাদের বাড়িতে যাবো তাহলে কখনোই না করতাম না।

সান মনে মনে হাসছে। সান এখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখেও খুশবু রাগ দেখাতে লাগল।

-এখনও দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমি কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে যাবো।

🌸

এই নিয়ে পরী বানু কয়েকবার জিজ্ঞেস করে ফেলেছেন খুশবুরা কখন আসবে। খুশি প্রথম কয়েকবার উত্তর দিয়ে এখন আর উত্তর দিচ্ছে না। এক কথা হাজার বার জিজ্ঞেস করা দাদীর অভ্যাস। পরী বানু বিরক্ত গলায় বললেন,

-ওই ছেড়ি কথা কস না কেন? মুখে তালা দিছোস নাকি?

-এক কথা কয়বার বলবো দাদী? তোমাকে তো বলেছি ওরা বের হয়ে গেছে। এখন রাস্তায় কতটুকু সময় লাগে সেটা আমি কীভাবে বলবো?

পরী বানু বিড়বিড় করে কিছু বললেন। বিরক্তিই প্রকাশ করলেন হয়তো। খুশি তিনি ভয় পান। তাই জোরে বলার সাহস হয়নি। একটু পরেই স্মরণ এসে জানাল,

-দাদী তোমার নাতনি আর নাতজামাই চলে এসেছে।

স্মরণের বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই গেটে গাড়ির শব্দ হলো। পরী বানু খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে বললেন,

-চইলা আইছে।

খুশবু অধৈর্য হয়ে গেট ধাক্কাচ্ছে। স্মরণ খুশিকে ক্ষেপিয়ে বলল,

-যা গেট খুলে দে। তোর একটুর জন্য হতে না পারা বর এসেছে।

খুশি রাগী চোখে স্মরণের দিকে তাকাল। পরী বানু এদের দু’জনের ভালোবাসাময় ঝগড়া দেখে বলল,

-আগে গেট খুইলা মাইয়াটারে ভেতরে আইতে দে। তোরা প্রেম পিরিতি পরেও করবার পারবি।

দাদীর উপর রাগ হলেও খুশির কিছু করার থাকলো না। দাদীর মুখে লাগাম টানা তার সাধ্যের বাইরে। খুশি গেট খুলে দিতেই খুশবু একপ্রকার তার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। বোনকে জড়িয়ে ধরে খুশবুর মনে হতে লাগল কত বছর পর দেখা হয়েছে তাদের। অথচ একটা রাতের দূরত্বে ছিল মাত্র।

-তোকে অনেক বেশি মিস করেছি। আমার কথা নিশ্চয় তোর একটুও মনে পড়েনি। জানি তো তুই একটা পাষাণ।

খুশি মনে মনে তাচ্ছিল্য করে বলল, আমাকে তুই বরাবরই ভুল জেনে এসেছিস।

ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে সান ভাবছে, পরিবারের প্রতি তার বউয়ের যে পরিমাণ ভালোবাসা! খুশবুকে পরিবার থেকে দূর না করে তারই ঘরজামাই চলে আসা উচিত ছিল। স্মরণ এগিয়ে এলে খুশবু উৎফুল্ল হয়ে স্মরণের দিকে আগাচ্ছে দেখে সান বিদ্যুৎ গতিতে এসে খুশবুর আগে স্মরণকে জড়িয়ে ধরল। খুশবু কিছুটা হতবাক হলেও স্মরণ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মনে মনে হাসল।
বাইরে শব্দ পেয়েই মানছুরা বেরিয়ে এসেছে। খুশবুর খুব করে ইচ্ছে করলেও সে ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে পারল না।

জামাই আদর পেতে সানের অবশ্য খারাপ লাগছে না। সবটাই নতুন অনুভূতি। বাড়ি আসার পর থেকে অবশ্য খুশবুর মুখ একবারই দেখেছিল। এই মেয়ে তাকে রেখেই কোথায় কোথায় ঘুরছে কে জানে? খুশবুর অনুপস্থিতিতে দাদী তার সঙ্গ দিচ্ছে।

-এই মাইয়ার কবে যে একটু আক্কেল জ্ঞান হইবো! জামাইরে একা রাইখা কই গিয়া বইয়া আছে কেডা জানে।

-আমার সাথে আপনি আছেন তো দাদী। আপনার নাতনিকে লাগবে না।

পরী বানু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

-এই মাথা খারাপ মাইয়ার লগে জীবন কাটাইতে তোমার কষ্ট হইবো ভাই।

সান হো হো করে হেসে উঠে বলল,

-সমস্যা নেই। আমিও একটা মাথা খারাপ বউই চাইতাম দাদী।

খুশবু পল্টুদের বাড়িতে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরেই সে মা’র মুখোমুখি হলো। মা’র বকা খাওয়া থেকে এবার তাকে কে বাঁচাবে? তাই আগেভাগেই সাফাই দিতে বলল,

-পল্টু জোর করে ওদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল।

-জামাই ঘরে একা আছে। গিয়ে দেখ ওর কিছু লাগবে কি-না।

মানছুরা এটুকু বলে চলে গেলে খুশবু অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল। মা’র কি আজ কিছু হয়েছে? তাকে বকলো না কেন?
খুশবুকে ঘরে ঢুকতে দেখে সান বলল,

-তোর বউটা ভীষণ পাষাণরে সান। বরের প্রতি একটুও মায়া নেই।

খুশবু মুখ মুচড় দিয়ে বলল,

-আমাকে কিছু বললেন?

-না, আমি তো নিজের সাথে কথা বলছিলাম।

-নিজের সাথে পাগলেরা কথা বলে জানেন তো?

-আমি তো পাগলই। তোমার প্রেমে।

খুশবু নাক উঁচিয়ে বলল,

-ছি! বাংলা মুভি এত বেশি দেখেন কেন?

খুশবুর কথা বলার ধরন দেখে সান হাসি থামিয়ে রাখতে পারল না। ওকে হাসতে দেখে খুশবু একটু থমকালো। লোকটার হাসি আগে কখনও লক্ষ্য করেনি। হাসলে উনাকে মোটামুটি হ্যান্ডসামই লাগে।

🌸

মাহিয়া ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসেছে এটা খুশবু জানতো না। শয়তানটা এসে এমনভাবে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে খুশবু একটুর জন্য চিত হয়ে পড়তে পড়তে বেঁচেছে। মাহিয়া খুশবুকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে নানান কথা বলে যাচ্ছে।

-ফাইনালি তুই আমার ভাবী হয়েই গেলি! কিন্তু হারামি, আমাকে ছাড়া কীভাবে বিয়ে করলি তুই? এত কিসের তাড়া লেগেছিল? একটু অপেক্ষা করতে পারলি না? ইন্ডিয়াই তো গিয়েছিলাম, পৃথিবীর সীমানার বাইরে তো আর চলে যাইনি যে ফিরতে অনেকবেশি সময় লাগবে।

খুশবু মাহিয়াকে ছাড়িয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-থাম তো। তুই সব নষ্টের গোড়া। তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব না থাকলে তোর ভাইয়ের সাথেও দেখা হতো না। আর ওই লোকের সাথে দেখা না হলে বিয়ে হওয়ার তো প্রশ্নই উঠত না।

মাহিয়া হা করে রইল। বলে কী এই মেয়ে?

-পাগল টাগল হয়ে গেছিস নাকি?

-পাগল তো তুই হয়েছিস। এমনভাবে খুশি হচ্ছিস যেন কিছুই জানিস না। খুব শখের চোটে কি আমি তোর ভাইকে বিয়ে করেছি?

মাহিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

-কেন তুই রাজি ছিলি না?

অনেকগুলো দিন পরে বান্ধবীকে পেয়ে খুশবু জমানো সব দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। কীভাবে কোন অবস্থাতে বিয়েটা হয়েছে সবই বললো।

-তোর বোন মানে খুশির সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিস! বলিস কী? আল্লাহ বাঁচিয়েছে আমার ভাইকে যে তোর বোনের সাথে বিয়ে হয়নি।

এত কথা বলে কী লাভ হলো খুশবু বুঝতে পারছে না। তার জন্য আফসোস না করে তো উল্টো সেই ভাইয়ের জন্যই ভাবছে। খুশবু হতাশ হয়ে ফোঁস করে দম ফেলল। আজকাল নিজের বান্ধবীও আপন হয় না।

🌸

মানছুরা পরী বানুকে কিছু বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু কীভাবে বলবেন তা নিয়ে একটু দ্বিধায় আছেন।

-আম্মা। আমি ভাবছিলাম কী ভাইজানের সাথে কথা বলবো।

পরী বানু পান চিবোতে চিবোতে বললেন,

-কী কথা কইবা?

মানছুরা একটু ইতস্তত করে বলল,

-খুশির বিয়ের ব্যাপারে।

পরী বানু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

-কথা কইবা কও। খুশির বিয়া অহন যত তাড়াতাড়ি দিবার পারো ততই ভালা। বড়টার আগে ছোটটার বিয়া হইলে মানুষ কত কথাই উঠাইব। কোন ঘর আইছে?

-স্মরণ খুশির বিয়ে আম্মা।

পরী বানু চমকে উঠে ছেলের বউয়ের দিকে তাকালেন।

-মাথা ঠিক আছে তোমার বউ? হুঁশে থাইকা কইছো তো!

মানছুরাও এটাই ভাবছিল। এখন স্মরণ খুশির বিয়ের কথা বললে সবাই এটাই ভাববে খুশির বিয়ে ভেঙে গেছে এখন আর ভালো কোথাও বিয়ে হবে না তাই মানছুরা রাজি হচ্ছেন। বোনের ছেলের জন্য মানছুরার কোন ভাবনা নেই। স্বার্থপরের মতো নিজের মেয়ের কথাই ভাবছে। কিন্তু এটা তো সত্য না।

চলবে

#কমলা_রঙের_রোদ [২৪]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

খুশি ভার্সিটি থেকে ফিরে দেখল মা দাদী বাড়িতে নেই। বড় আব্বু বারান্দায় বসে আছেন। খুশিকে দেখে তিনি হাতে ইশারা করে ডাকলেন। খুশি বড় আব্বুর দিকে এগিয়ে গেল। মানুষটা সর্বক্ষণ নিজের দুনিয়ায় বসবাস করেন। বাড়িতে থাকলেও খুব একটা কথা হয় না।

-ভার্সিটি থেকে এসেছিস?

-হুম। মামা দাদী কোথায় গিয়েছে বড় আব্বু?

-জানি না তো রে মা। আমাকে বলে যায়নি।

-ওহ।

-তুই হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নে।

-আচ্ছা।

খুশি ঘরের দিকে পা বাড়ালে বড় আব্বু আবার ডেকে বললেন,

-আমার ছেলেটা কোথায় থাকে বলতে পারিস? অনেকদিন দেখি না। আমার কাছে যায়ও না তেমন।

আজ হঠাৎ বড় আব্বুর দিকে তাকিয়ে খুশির ভীষণ মায়া হতে লাগল। সে অনেক ছোট ছিল তখন খালা মারা গেছে। এতকিছু মনে নেই। তবে বোঝ হওয়ার পর থেকে দেখছে বড় আব্বু স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসতো। এখনও খালাকে ভুলতে পারেনি। সত্যিকারের ভালোবাসা হয়তো এরকমই হয়।

🌸

সেদিন স্মরণ হঠাৎ মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরল। মিষ্টি কেন এনেছে কারণ জিজ্ঞেস করলে বলল,

-আগে মিষ্টিমুখ করো পরে বলছি।

এই বলে একটা মিষ্টি হাতে নিয়ে পরী বানুর মুখে তুলে দিলে পরী বানু অর্ধেকটা খেয়ে বলল,

-খাইছি অহন ক।

এসময় খুশিও চলে এলে স্মরণ খুশির সামনে গিয়ে বলল,

-তোর বিয়ের মিষ্টি তো খাওয়াসনি। নে আমার তরফ থেকে মিষ্টি খা।

খুশি কঠিন চোখে স্মরণকে দেখছে। যদিও বিয়েটা ভেঙে গেছে। কিন্তু খুশি রাজি কেন হয়েছিল এটা নিয়ে স্মরণ এখনও রেগে আছে। খুশি কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও স্মরণ ঠিকভাবে বলেনি। ধৈর্যের সীমা আজ খুশিও ভেঙে গেল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

-কিসের মিষ্টি? তুমিও বিয়ে করছো নাকি?

-না। বিয়ে তো তোদের মতো সাধারণ মানুষ করে। আমার মতো মহামানবেরা সারাজীবন বিয়ে ছাড়াই থাকে।

পরী বানু ধমক দিয়ে এদের থামিয়ে দিয়ে বললেন,

-আমার সামনেই আবার শুরু করছোস তোরা? দুইটা কি কোনদিন বড় হইবি না?

-আমি তো কিছুই করিনি দাদী। যা করার তোমার নাতনিই করতে চেয়েছিল।

খুশি তেতে উঠে দাদীকে বলল,

-তোমার নাতিকে জিজ্ঞেস করো তো দাদী আমি কী করতে চেয়েছিলাম?

স্মরণ তাচ্ছিল্য করে বলল,

-কী করতে চেয়েছিল সে যেন জানে না।

-না জানি না। তুমি বলো।

-বিয়ে কি তাহলে আমি করতে চেয়েছিলাম?

-তোমার করতে মন চাইলে তুমিও করো। আমাকে কেন কথায় কথায় খোঁটা দিচ্ছ?

-আমি কিছু মানুষের মতো একজনকে ভালোবেসে তাকে নানান স্বপ্ন দেখিয়ে, শুধুমাত্র ভালোমানুষি দেখানোর জন্য অন্য একজনকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যেতে পারব না।

পরী বানু কানে হাত চাপলেন। দুইটাই সমান ঝগড়ুটে। একটা কথা ছাড় দিবে না কেউ। পরী বানু ধমক দিয়ে বললেন,

-তোরা চুপ করবি নাকি আমি মানছুরারে ডাকমু?

মাকে ডাকার কথা শুনে খুশি সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল। কিন্তু স্মরণ তখনও পুরোপুরি চুপ হয়নি। বিড়বিড় করে বলল,

-তোর মতো মেয়েকে ভালোবাসা আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল।

খুশিও দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

-ভুল যখন বুঝতে পেরেছো, তাহলে শুধরে নিলেই পারো।

-বউ। ও বউ, এই ঘরে আইসা দেইখা যাও তো।

দাদী সত্যি সত্যিই মাকে ডাকছে দেখে খুশি ভয় পেয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। স্মরণ ওদিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-ভীতুর বাচ্চা এখনও কত ভয় পায়!

🌸

খুশবু বুঝতে পারছে বিয়েতে তার শাশুড়ি হয়তো রাজি ছিলেন না। কারণ সে এবাড়িতে আসার পর থেকে শাশুড়ি মা তার সাথে একটা কথাও বলেননি। উনি রেগে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। উনি তো প্রথমে খুশিকে পছন্দ করেছিলেন। উনার ছেলে যে মাঝখানে গণ্ডগোল লাগিয়ে দিবে এটা হয়তো কল্পনা করেননি। খুশবুও অবশ্য শাশুড়ী মার সাথে খাতির লাগানোর কোনরকম চেষ্টাই করেনি। এই বাড়িতে সে বেশিদিন থাকতে চায় না। তাই এটাই ভালো হবে শাশুড়ি মা’র সাথে শত্রুতা চালিয়ে যাওয়া। উনিই একদিন খুশবুকে বাড়ি থেকে বের করে দিবেন।

সান তার বিবাহিত বন্ধু গুলোর থেকে পরামর্শ নিয়ে এসেছে। কীভাবে বিবাহিত জীবন সুখের করা যাবে। বন্ধুরা যে পরামর্শ গুলো দিয়েছে তা শুনে বেচারার মনে হলো,

– তোরা যা বলছিস এসব যদি সত্যি হয় তাহলে এই জীবনের মানে কী দোস্ত?

বন্ধুরা একেকটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেছে,

-যা বলেছি একমাত্র সেসব ফলো করলেই বউয়ের ঝাড়ুর বাড়ি খেতে হবে না।

সান চোখ গোল গোল করে আমানের দিকে তাকিয়ে বলল,

-তোর বউ যা বলে তুই সেটাই করিস?

আমান জবাব দেওয়ার আগে ওর ফোন বেজে উঠল। কল রিসিভ করেই অস্বাভাবিক মিষ্টি কন্ঠে কারো সাথে কথা বলছে। কথা বলা শেষ হতেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-দোস্ত আমাকে যেতে হবে।

সান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

-কোথায় যাবি? এক্ষুনি তো এলি!

আমান সহানুভূতির হাসি হেসে বলল,

-দুই দিন পরে তোমারও আমার মতো অবস্থাই হবে দোস্ত। বউয়ের কল পেয়েও বাড়ি না গেলে কপালে ভাত জুটবে না।

-বলিস কী!

পুরো রাস্তা সান ভেবেছে খুশবুও কি ভবিষ্যতে আমানের ওয়াইফের মতো হবে? ভাবনাটা মাথায় এলেও মাছি তাড়ানোর মতো ভাগিয়ে দিয়েছে।

-দূর! খুশবু সবার মতো না। ও ভীষণ আনকমন।

বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে সান ভাবছে, যদিও খুশবু ওরকম হয় তাহলেও অসুবিধে নেই। বউয়ের আঁচল ধরে ঘরে বসে থাকলেও রাজি সে।

-বউয়ের হুকুমই তো মানতে হবে। এতে অন্যায় কিছু নেই।

রুমে এসে সান খুশবুকে না পেয়ে বাইরে থেকে একবার খুঁজে এলো। বউকে খুঁজতে গিয়ে বেচারা নতুন একটা বোঝা মাথায় নিয়ে এলো। তাকে দেখে মা ডেকে কাল এক মিটিংয়ে যেতে বলেছে। মিটিং ফিটিং সানের ভালো লাগে না। বোর হয় ভীষণ। পুরো বাড়ি খুঁজেও খুশবুকে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল।

-আমার বউ কোথায় গেল? পালিয়ে যায়নি তো আবার!

দ্বিতীয় বার রুমে ফিরে এসে সান বারান্দা থেকে কারো কথা শুনতে পেলো। কন্ঠটা যে খুশবুর এতে কোন সন্দেহ নেই। কোন ধরনের শব্দ না করে বারান্দার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। খুশবু তার পাখিদের সাথে কথা বলছে।

-এই বন্দী জীবন তোদের ভালো লাগে? চোখের সামনে ওই বিশাল নীল আকাশটায় উঠতে ইচ্ছে করে না?

খুশবুর সারাদিন কিছুই করার থাকে না। এবাড়িতে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘর গোছানো সবই কাজের লোক করে। শাশুড়ি বাড়ি না থাকলে নিচে গিয়ে টিভি দেখে। কিন্তু এত বেশি টিভি দেখাও ভালো লাগে না। গতকালই খুশবু বারান্দায় এই পাখি গুলোকে আবিষ্কার করেছে। আশেপাশে কোথাও থেকে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ আসতে শুনে বারান্দায় বেরিয়ে দেখল এই কাণ্ড। লোকটার তাহলে এই শখও আছে! পাখির মালিক বাসায় না থাকলেই খুশবু ওদের সাথে গল্প করতে চলে আসে।

-মানছি তোরা এখানে খাবার পাচ্ছিস। তোদের মালিক হয়তো তোদের যত্ন করে রেখেছে। কিন্তু তারপরেও তোদেরকে কি ওই আকাশ টানে না? তোদের সজাতি ভাই বোনরা যেখানে স্বাধীন ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে তোদের কি বন্দী হয়ে থাকতে ভালো লাগে?

-তুমি কি চাও ওরাও স্বাধীনতার স্বাদ পাক?

সান কখন খুশবুর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খুশবু বুঝতে পারেনি। হঠাৎ ও কথা বলে উঠলে খুশবু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বুকে থু থু দিয়ে বলল,

-স্বাধীনতা কার না পছন্দ? পাখি হোক বা মানুষ।

-ঠিক আছে।

এটা বলে সান খুশবুর কাঁধের উপর দিয়েই হাত বাড়িয়ে পাখির খাঁচার মুখটা খুলে দিল। পাখি দুইটা খাঁচা ছেড়ে উঠে যেতে কয়েক সেকেন্ডও সময় নিলো না। ফুড়ুৎ করে দু’জনই উড়ে গেল। খুশবুর চোখ কপালে উঠে পড়েছে। সে আতঙ্কিত গলায় বলল,

-কী করছেন? উড়ে গেল তো!

সান খুশবুর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

-তুমি তো এটাই চেয়েছিলে।

খুশবু হতবাক হয়ে সানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার একটা কথায় লোকটা নিজের শখের পাখি গুলোকে মুক্ত করে দিল!

-আমি চেয়েছি তাতে কী? আপনার প্রিয় জিনিস। এভাবে যেতে দিলেন?

-তোমার খুশির থেকে প্রিয় আমার কাছে আর কিছু নেই। পাখি গুলো হয়তো আমার শখের ছিল। কিন্তু তুমি তাদের বন্দী অবস্থায় দেখে রোজ আফসোস করতে।

খুশবু ভাবছে, সানের জায়গায় সে হলে জীবনেও এমনটা করতে পারত না। পছন্দের জিনিস গুলোর প্রতি তার জীবন মায়া। ক্লাস নাইনে থাকতে শখ করে একটা বিড়ালের বাচ্চা পালতে এনেছিল। একদুপুর বাচ্চাটা তার সাথে ছিল। তারপর মা আর রাখতে দেয়নি। খুশবুর এখনও মনে আছে। ওই বিড়ালের বাচ্চার জন্য কত কেঁদেছিল সে। দুই দিন না খেয়ে থেকেছে। দাদী স্মরণ ভাই কেউ তার মন খারাপ কম করতে পারেনি। সেখানে তো উনি পাখি গুলোকে অনেকদিন ধরে পালছেন। খুশবু কৌতূহল বশত অজান্তেই জিজ্ঞেস করে ফেলল,

-আমি যা বলবো আপনি সব শুনবেন? আমার অন্যায় আবদারও মেনে নিবেন?

জবাবে সান খুশবুর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। খুশবু চেষ্টা করেও চোখ সরিয়ে নিতে পারল না। লোকটার হাসি দিনদিন এত সুন্দর হচ্ছে কেন? নাকি আগে থেকেই সুন্দর ছিল। সে এখন লক্ষ্য করছে।

চলবে