#কমলা_রঙের_রোদ [৩৩]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
কাজী চলে এসেছে। খুশবু কাজী সাহেবকে অন্য ঘরে বসিয়ে এই ঘরে খুশিকে দেখতে এলো। খুশি তখন আয়নার সামনে বসে ছিল। ওকে সাজানো শেষ। খুশবু ঘরে এসে কিছু বলবে তার আগেই পার্লারের মেয়েটা বলল,
-দেখুন আপু কাজী আসার আগেই কিন্তু আমাদের বউ সাজানো শেষ। এবার ভালো করে দেখে বলুন বউকে কেমন লাগছে। এখনও কি কোন অভিযোগ আছে?
খুশবু খুশিকে দেখে থমকে গিয়েছিল। যে মেয়ে কোনদিন ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক পর্যন্ত লাগায় নি, তাকে আজ বধূ বেশে কী ভীষণ সুন্দর লাগছে! খুশবু চোখ সরাতে পারল না।
খুশির নার্ভাস লাগছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে তাকে দেখতে হয়তো উদ্ভট লাগছে। এরকম সাজে তাকে মানায় নাকি? খুশি অসহায় চোখে খুশবুর দিকে তাকিয়ে আছে। ইতস্তত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-বাজে লাগছে?
খুশবু বোনের দিকে এগিয়ে গেল। খুশির সামনে দাঁড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপরে কিছু খুঁজতে লাগল।
-কাজলটা কোথায়?
পার্লারের মেয়ে বলল,
-কাজল পরিয়েছি তো আপু।
খুশবু কাজল খুঁজে পেয়ে হাতে নিয়ে বলল,
-পরিয়েছেন। কিন্তু নজর টিকা লাগিয়েছেন কি? আমার বোনের আজ অনেক মানুষের নজর লাগবে।
খুশবু কাজলের সামান্য কালি আঙুলে লাগিয়ে ঝুঁকে খুশির কানের পেছনে লাগিয়ে দিয়ে বলল,
-এবার আর কারো নজর লাগবে না।
মেয়ে দু’জন হাসল। একজন বলল,
-আপনি কোন ভুল ধরবেন কি না এই ভয়েই ছিলাম। এখন স্বস্তি পেলাম।
খুশবু সামান্য লজ্জা পেলো। তখন উনারা দেরি করে আসায় রাগের মাথায় একটু বেশিই মনে হয় বলে ফেলেছিল।
-ক্ষমা করবেন আপু। বিয়ের এত ঝামেলায় তখন আপনাদের সাথে বাজে ব্যবহার করে ফেলেছি। আমার ওই ব্যবহারের জন্য দুঃখিত।
-ব্যাপার না আপু। আমরা কিছু মনে করিনি। বিয়েতে এরকম হয়ই।
-আপনারা কিন্তু এখন যেতে পারবেন না। বিয়ে শেষ করে তবেই যাবেন।
খুশবু খুশির ওড়নাটা ঠিক করে দিয়ে বলল,
-আজ স্মরণ ভাই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে না গেলেই হয়।
খুশি চিন্তিত মুখে বলল,
-কেন? আমাকে দেখতে এতই বাজে লাগছে?
খুশবু হেসে ফেলল। বলল,
-পাগল তোকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। এত সুন্দর লাগছে যে তোর প্রশংসার জন্য ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তোকে দেখে বেচারা স্মরণ ভাইয়ের হার্ট ব্লক হয়ে যাবে।
খুশি মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হাসল।
🌸
এক ঘর ভর্তি মানুষের সামনে লোকটা কেমন ভ্যাবলার মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে! খুশবু চোখে ইশারা করে জানতে চাইল,
-কী?
সানও ইশারা করেই বোঝাল,
-কিছু না।
খুশবু জোরে না বলে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
-কিছু না তাহলে হা করে তাকিয়ে কেন আছেন?
সানও একইভাবে বলল,
-আমার বউকে দেখছি।
এই লোক পাগল। খুশবু আর সানের দিকে ধ্যান দিল না। সান বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে খুশবুকে দেখে যাচ্ছে। খুশবুর কথা বলা, কানের পেছনে চুল গুঁজে দেওয়া। মাঝে মাঝে বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকানো। চোখের দৃষ্টি দিয়ে তাকে শাসানো৷ সবকিছুই সান উপভোগ করে।
🌸
কবুল বলতে খুশি সময় লাগালে খুশবু পাশ থেকে বোনের কানে কানে বলল,
-ভালোবেসে বিয়ে করছিস। তারপরও এত নাটক! কবুলটা বলে দিলেই তো শেষ।
খুশি অসহায় চোখে খুশবুর দিকে তাকাল। এই তিনটা শব্দ উচ্চারণ করতেও আজ হাত-পা কাঁপছে তার। খুশবু খুশির হাতটা শক্ত করে ধরল। চোখে অভয় দিয়ে বলল,
-আমরা সবাই তোর সাথে আছি খুশি। কোন চিন্তা নেই। বলে ফেল।
-কবুল।
কাজী তারপর আরও দুইবার কবুল বলালো। বিয়ে পড়ানো শেষে সবাই মোনাজাত ধরল। খুশিকে কাঁদতে দেখে খুশবু অবাক হয়ে বলল,
-ও মা, কাঁদছিস কেন?
পরক্ষণেই বলল,
-ওহ বুঝেছি। এটা তোর সুখের কান্না! আজই বেশি করে কেঁদে নে। নইলে এর পর আর কাঁদার সুযোগ পাবি না। আমার ভাই তোর চোখে পানি আসতেই দিবে না।
বিয়ে আলাদা পড়ানো হলেও এবার স্মরণকে এঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। এখনও অনেক নিয়ম পালন করা বাকি। বর কনেকে দুধ খাওয়ানো। আয়নায় মুখ দেখা। খুশবু আগেই সবকিছু রেডি করে রেখেছিল। ট্রে-তে করে দুধের গ্লাস নিয়ে এসে শর্মিলা ভাবীকে দিয়ে বলল,
-আপনি খাওয়ান ভাবী।
-কেন? তুই আয়। তোর তো এখন ডাবল সম্পর্ক। বোন আবার ভাবীও।
খুশবু গেল না। নিচেই দাঁড়িয়ে দেখল। সান কখন খুশবুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি।
-এত নিয়ম তো আমাদের বিয়ের সময় পালন করা হয়নি।
খুশবু আড়চোখে সানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-ওটাকে আপনি বিয়ে বলেন?
-তুমি ওটাকে বিয়ে মানো না? তাহলে কি আবার বিয়ে করতে হবে? আগে বলতে, ওদের সাথেই আমরাও আবার কবুল বলে ফেলতাম।
খুশবু চোখ পাকিয়ে তাকাল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-শখ কত!
স্মরণ বিয়ের সাজে খুশি এখন পর্যন্ত দেখেনি। আয়নায় এই প্রথম খুশিকে দেখে বেচারার দুনিয়াই থেমে গেল। আশেপাশের সবকিছু ভুলে গিয়ে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল।
-আয়নায় কাকে দেখা যায়?
কারো কথা স্মরণের কান পর্যন্ত পৌঁছালে তো! শর্মিলা ভাবী চোখ ছোট ছোট করে স্মরণকে দেখে বলল,
-ভূত দেখে ফেলেছিস নাকি? ভয়ে কি তব্দা খেয়ে গেছিস?
এই কথাই সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। খুশবু জানত স্মরণ ভাই আজ হুঁশ হারিয়ে ফেলবে।
-বউকে দেখে মুখের কথা হারিয়ে ফেলেছে বেচারা!
সবার এমন মন্তব্যে খুশি লজ্জায় মরে যাচ্ছে। সে সবার চোখের আড়ালে স্মরণের হাতে চিমটি কাটল। ব্যথা অনুভব করে স্মরণের হুঁশ ফিরেছে। শর্মিলা ভাবী বলছে,
-না ভাই, তোর বউকে তুই দেখতে থাক। আমরা সবাই বরং এখন চলে যাই।
স্মরণ লজ্জিত ভাবে হাসল। বেচারা ভাইকে একা পেয়ে সবাই কেমন মজা নিচ্ছে। এটা দেখে খুশবু চুপ থাকতে পারল না।
-অনেক হয়েছে। আমার দুলাভাইয়ের পেছনে লাগা বন্ধ করো এবার। নিজের বউকেই তো দেখছে। তোমাদের কাউকে তো দেখছে না।
খুশবুও কথা শেষ হতেই শার্লিন ভাবী গালে হাত দিয়ে বলে উঠল,
-বাবা খুশবু, তুই তো দেখছি দুলাভাইয়ের বডিগার্ড হয়ে গেছিস!
-হয়েছি তো? দুলাভাই প্লাস ভাইকে একা ছেড়ে দিব নাকি?
খুশবুর ঝগড়া করাও সান মুগ্ধ হয়ে দেখছে। বাহ! তার বউ তো ভালোই ঝগড়াটে। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তার পক্ষ নিয়ে কথা বলায় স্মরণ উচ্চস্বরে বলে উঠল,
-শালিকা জিন্দাবাদ।
ঘরজুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল। সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান শেষে বর কনেকে বিদায় দেওয়ার পালা আসে। কিন্তু এখানে তেমন কোন সিন নেই। খুশি নিজের ঘর থেকে স্মরণের ঘরে শিফট হচ্ছে। তারপরও মানছুরার চোখ ভিজে এলো। খুশবু এটাই ভেবে পায় না মা-রা এত ছিঁচ-কাঁদুনে কেন হয়? যেকোনো কাজে তাদের চোখের পানি ফেলতেই হবে? খুশবু ভয়ে ভয়ে মা’কে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলল,
-কেন কাঁদছো মা? খুশি কি তোমার চোখের আড়ালে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে? ওর তো শুধু ঘরটা পাল্টেছে।
মানছুরা চোখ মুছতে মুছতে ভেজা গলায় বলল,
-চোখের আড়ালে না গেলেও মেয়ের বিয়েতে মায়ের চোখে পানি আসেই।
-আমার বিয়েতেও কি…’ বলতে বলতে খুশবু থেমে গেল। মা তার সাথে কথা বলছে তার মানে এই না খুশবু যা ইচ্ছা বলতে ফেলতে পারবে। খুশবু এখনও ভয় পায়। মা যদি আবার আগের মতো হয়ে যায়। তার সাথে যদি কথা না বলে। খুশবুর অসম্পূর্ণ কথাটা মানছুরার বুঝতে বাকি থাকল না।
-আমি ওদিকে দেখে আসি।
এটা বলেই খুশবু চলে গেল। ওর চলে যাওয়ার পর পরী বানু বললেন,
-কইলা না কেন ওরে বিদায় দিয়া তুমি চোখ দিয়া নদী বওয়াই দিছিলা। পুরা রাইত লুকাই লুকাই কানছো। পাগলটাও জানতো।
মানছুরা শূন্য দৃষ্টিতে কতক্ষণ শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-কারো কিছু জানতে হবে না আম্মা।
-কেন জানুন লাগব না? সারাজীবন শাসনের আড়ালে কতখানি ভালোবাসা লুকাই রাখছো এই কথা কেন জানুন লাগব না?
-কিছু জিনিস অজানা থাকাই ভালো।
-কিন্তু…
– দয়া করে এবিষয়ে আর কোন কথা তুলবেন না আম্মা।
ছেলের বউয়ের সামনে পরী বানু কবে কোন কথা বলতে পেরেছেন? এভাবেই তো সবসময় থামিয়ে দেয়। খুশবুর প্রতি মানছুরার রাগ, শাসনই প্রকাশ পায়। রাগের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা প্রকাশ পেতে দেয় না।
🌸
খুশবু আর সান মিলে বাসরঘর সাজিয়েছে। ঘর সাজাতে সাজাতেও সানের দুঃখের গল্প শুনতে হয়েছে।
-বিয়ে করলাম এক মাসের মতো হয়ে গেল এখনও বাসর করাই হলো না। আমি আবার অন্যের বাসর সাজাচ্ছি। কী কপাল আমার! ইচ্ছে করছে ফুলের মালা গলায় পেঁচিয়ে ফাঁ*স নিয়ে ম*রে যাই। কারণ আমার কপালে তো আর বউয়ের ভালোবাসা পাওয়া লেখা নেই। কী লাভ আমার বেঁচে থেকে? কী করবো এ জীবনে রেখে?
খুশবু আগুন চোখে সানকে দেখল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-আপনার মরে যাওয়াই উচিত।
সাথে সাথে সান বুক চেপে ধরে কাতরাতে কাতরাতে বলল,
-আহ, আহ মরে গেলাম। বুকে ব্যথা। হার্ট অ্যাটাক।
এক মুহূর্তের জন্য খুশবু সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরে বুঝতে পারল এই লোক তার সাথে ফাজলামি করছে। খুশবু রেগে সামনে থাকা ফুলের ডালাটা তুলে সানের উপর ছুঁড়ে মারল।
-ইতর লোক।
🌸
রাতে খুশিকে স্মরণের ঘরে দিয়ে যেতে এসে খুশবু বলল,
-আজ থেকে এটা তোর নতুন আস্তানা। ওই ঘর এখন পুরোটাই আমার।
-শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে তুই তো ওই ঘরে থাকতে চলে আসবি!
খুশবু মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-নতুন বউদের এত কথা বলতে হয়! আদব কায়দাও জানিস না।
-আমি আগে তোর বোন পরে নতুন বউ।
খুশবু মুখ ভেঙাল। সারাদিন বোবা থাকার পর এখন মুখে কথা ফুটেছে।
-ঘর সাজানো কেমন হয়েছে? আমি সাজিয়েছি।
খুশি চোখ ঘুরিয়ে ঘরটা দেখল। খুশবু আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে খুশি হয়তো প্রশংসা করবে।
-শুধু শুধু ফুলগুলো অপচয় হলো।
খুশবু চেতে উঠে বলল,
-স্মরণ ভাই যে কী দেখে তোকে পছন্দ করেছে! তোকে বিয়ে করে বেচারার জীবনটাই নিরামিষ হয়ে যাবে।
খুশি খুশবুর কোন কথা গায়ে মাখাল না। সারাদিন এই ভারী শাড়ি পরে কেটেছে। খুশি এবার চেঞ্জ করতে চাচ্ছে। কিন্তু তার কাপড়চোপড় এখনও ওই ঘরে।
-আমার সালোয়ারকামিজ এনে দে তো।
খুশবু চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করল,
-কেন?
-কেন কী? চেঞ্জ করব না?
-স্মরণ ভাই তো ভালো করে এখনও তোকে দেখলোই না। এতগুলো টাকা দিয়ে বউ সাজিয়েছি। স্মরণ ভাই দেখার আগেই কেন চেঞ্জ করবি!
-তোর স্মরণ ভাই কি জীবনে আমাকে দেখেনি?
খুশবুর নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। স্মরণ ভাই এটা কাকে বিয়ে করল? এখানে বেশিক্ষণ থাকলে সে হয়তো নিজের চুল টানা শুরু করবে।
-তুই দুইটা মিনিট দাঁড়া বোন। আমি তোর বরকে পাঠাচ্ছি। তারপর চেঞ্জ করিস বা যা খুশি মন চায় করিস। সেটা তোর জামাই বুঝবে।
চলবে
#কমলা_রঙের_রোদ [৩৪]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
খুশবু স্মরণকে খুঁজে পাচ্ছে না। কোথায় গেল এই ছেলে? বিয়ের রাতেও নতুন বউ রেখে আড্ডা দিতে বেরিয়ে গেল নাকি? এ কী মুসিবত! বাড়ির বাইরে দেখবে? ভাবা মতোই খুশবু গেটের বাইরে বেরিয়ে স্মরণকে সানের সাথে পেলো।
-তোমরা এখানে..
বলতে বলতে থেমে গেল খুশবু। সানের হাতে জলন্ত সিগারেট দেখে কতক্ষণ তব্দা খেয়ে তাকিয়ে রইল। সানের এই গুণ এতদিন তার অজানা ছিল। খুশবু নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
সানও খুশবুকে দেখে হকচকিয়ে গেছে। জীবনে সে সিগারেট ছুঁয়েও দেখেনি। আজ খাওয়ার ইচ্ছে না হলেও এমনিতেই জ্বালিয়েছিল। আজই খুশবুর চোখে পড়ে গেল! স্মরণ সানের চেহারার পরিবর্তন দেখে নিঃশব্দে হাসছে। খুশবু এগিয়ে এসে সানকে কিছুই বলল না। সব রাগ স্মরণের উপর দেখিয়ে বলল,
-এখানে কী করছো তুমি? আজকাল কাদের সাথে মিশছো? যদি দেখি তুমিও এসব বিদ্যা অর্জন করেছ তাহলে খুশিকে বলে তোমার খবর করিয়ে ছাড়ব। এসো এখন।
স্মরণকে কথাগুলো বলে খুশবু গটগট করে হেঁটে বাড়ির ভেতর চলে গেল। সান এখনও আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। স্মরণ এবার শব্দ করে হাসতে লাগল। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠে সান তাড়াতাড়ি করে হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিল। স্মরণ হাসতে হাসতে বলল,
-যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
সান বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে রোবট গলায় বলল,
-খুশবু আমাকে ভুল বুঝে চলে গেল!
এই কথা শুনে স্মরণের হাসি আরও বেড়ে গেল। বেচারা দেখতে চেয়েছিল এই জিনিস মানুষ কীভাবে খায়? সিগারেট খেয়ে লাভটা কী হয়। কে জানত সে নিজেই এভাবে ফেঁসে যাবে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের কপালে আরও বড় শনি টেনে না এনে দু’জনই বাড়ির ভেতর চলে এলো। স্মরণ বাসরঘরে নতুন বউয়ের কাছে গেল। সান গেল বউয়ের ভুল ভাঙাতে।
স্মরণ নিজের ঘরে পা রেখে অবাক হয়ে গেল। এই কাজ খুশবু কখন করেছে? নিজের ঘরটাই আজ তার কাছে অচেনা লাগছে। মিষ্টি সব ফুলের ঘ্রাণে ঘর ম-ম করছে। বিছানার দিকে চোখ যেতে স্মরণ তার ঘরের জীবন্ত ফুলকে দেখতে পেলো। খুশি কি এতক্ষণ তার আসার অপেক্ষা করছিল! ভাবতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল। স্মরণ ঘরে এসেছে বুঝতে পেরে খুশি ঘোমটা তুলে ফেলল। খুশবু জোর করে এক হাত লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
-উফ বাবা, কী গরম!
স্মরণ কপাল কুঁচকিয়ে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
-এই তুই ঘোমটা তুলে ফেলেছিস কেন?
-তাহলে কী করব?
স্মরণ দুই লাফে এসে খুশির সামনে বসে বলল,
-আমার জন্য অপেক্ষা করবি। আমি এসে তোর ঘোমটা তুলব।
খুশি মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
-শখ কত!
-তুই আবার ঘোমটা দে। আমি ঘোমটা তুলে আমার নতুন বউকে দেখব। আমার এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার তোর কোন অধিকার নেই।
কী পাগলের পাল্লায় পড়ল এটা। খুশি রাগী চোখে স্মরণের দিকে তাকিয়ে আছে। স্মরণও জেদ ধরে বসে আছে।
-পাগল হয়েছ?
-বিয়ে মানুষ পাগল হলেই করে। সুস্থ মস্তিষ্কের কোন লোক স্বইচ্ছায় বউ নামক আপদ ঘাড়ে নিতে চাইবে না।
🌸
খুশবু সানকে বাইরে রেখেই ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়েছিল। সান খুশবুর পেছনে পেছনে এসে দেখল দরজা আটকানো। হায় আল্লাহ, বউ কি আজ সারারাত তাকে বাইরে রাখবে? সান জোরে ডাকতেও পারছে না। পাশের ঘরেই মা দাদী আছে। তাই সান গলার স্বর নিচু রেখে ডাকছে।
-খুশবু। দরজাটা খোলো। তুমি আমাকে ভুল বুঝছো।
খুশবু সানের ডাক শুনতে পেলেও জেদ ধরে বসে থাকল। বাইরে দাঁড়িয়ে সারারাত সিগারেট খাক। ঘরে আসার দরকার কী?
-আমি কি সারারাত বাইরে থাকব?
খুশবু বিড়বিড় করে বলল,
-থাকুন। তাতে আমার কী?
-আমাকে একটা সুযোগ তো দিবে? তখন তুমি যা দেখেছ তা সত্য নয়। মানছি মানুষ চোখের দেখাই বিশ্বাস করে। কিন্তু মাঝে মাঝে চোখও মানুষকে ধোঁকা দেয়।
খুশবু শব্দ করে দরজা খুলে দিল। সান ভাবেনি এত সহজে ক্ষমা পেয়ে যাবে। খুশবু কঠিন মুখে সানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-সিগারেট খেয়েছেন তো খেয়েছেন। এখন আবার লেকচার কেন দিচ্ছেন? আপনার ভাষণ শুনতে কেউ আগ্রহী না।
সান আহত গলায় বলল,
-তোমার মনে হচ্ছে আমি ভাষণ দিচ্ছি!
-না, বক্তৃতা দিচ্ছেন।
খুশবু মুখ মোচড় দিয়ে দরজার সামনে থেকে সরে গেল। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে বলল,
-বাতি নিভিয়ে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকুন কোন আপত্তি নেই।
সান লাইট অফ করে বিছানায় এসে বসল। জানালা দিয়ে যেটুকু চাঁদের আলো আসছে তা দিয়ে খুশবুর পিঠ দেখা যাচ্ছে। সান নরম গলায় বলল,
-তুমি কি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ?
-মানুষের আরও কত রুপ যে এখনও দেখার বাকি আছে আল্লাহই জানেন।
বউ ভীষণ রেখে আছে। এখন কথা না বাড়ানোই মঙ্গল। কতক্ষণ বসে থেকে সান নিজে নিজে বলল,
-সিগারেট খেলেই বা ক্ষতি কী? এই ঠোঁটে কেউ তো আর চুমু খায় না।
সান ভেবেছে খুশবু হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সে-ও শুয়ে পড়ল। অপরদিকে খুশবু জেগে থাকলেও কথাটা শুনে কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শক্ত করে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল।
🌸
পরী বানু খুশির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল,
-রাইতে আদর সোহাগ মনে কয় ভালোই পাইছোস!
খুশি দাদীর দিকে না তাকিয়েই বলল,
-কিসের আদর সোহাগ বুড়ি?
-আদর সোহাগ বুঝো না?
-না, বুঝি না। তুমি একটু বুঝিয়ে দিবে?
পরী বানু হালকা করে খুশির গালে ঠোকর দিয়ে বলল,
-বুঝো না আবার সকালবেলা উইঠাই গোসল করো!
এবার খুশি লজ্জা পেয়ে গেল। দাদীর কি মুখে কোনকিছু আটকায় না? খুশিকে লজ্জায় লাল হতে দেখে পরী বানু বললেন,
-ওইসব কাম করবার সময় লজ্জা পাও না। আমি কইলেই খালি লজ্জায় মইরা যাও। এত লজ্জা কি আমার নাতির সামনেও পাইছিলি?
-দাদী তুমি একটা অশ্লীল।
খুশি ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় খুশবু ঘরে ঢুকেছে। খুশিকে ওরকম ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দাদীকে জিজ্ঞেস করল,
-তোমার নাতনির আবার কী হয়েছে?
-যা হওনের হইছে। তুই এদিকে আ।
খুশবু দাদীর কাছে গিয়ে বলল,
-কী? তাড়াতাড়ি বলো।
পরী বানু তীক্ষ্ণ চোখে খুশবুকে পরখ করে নিচ্ছেন। কয়দিন ধরেই তার সন্দেহ হচ্ছে।
-তুই গোসল করোস নাই?
-এখন কি গোসল করার সময় বুড়ী? নাস্তাই তো খাওয়া হয়নি।
-এই গোসল ওই গোসল না রে বেকুব। জামাইয়ের লগে থাকলে সকালে উইঠা গোসল করুন লাগে না?
দাদী কী জানতে চাচ্ছে এবার মাথায় ঢুকেছে খুশবুর। এই বুড়ী তো সাঙ্ঘাতিক চিজ। দাদী তাকে চেপে ধরার আগে খুশবু বলে উঠল,
-মা একা একা কী রাঁধছে দেখে আসি।
কথাটা বলে খুশবু এক সেকেন্ডও দেরি করল না। চোখের পলকে দাদীর সামনে থেকে পালিয়ে গেল। পরী বানু যা ভাবছিলেন সেটাই। এরা দুইটা তাদের সবাইকে গাধা বানাচ্ছে। উপরে উপরে মিল মোহাব্বত দেখালেও বন্ধ ঘরে এদের মধ্যে কিছুই হয় না। পরী বানু এবার চিন্তিত হচ্ছেন। খুশবুর সংসার কি ভালো যাচ্ছে না? কিন্তু জামাইকে দেখে তো মনে হয় বউয়ের জন্য জীবন দিয়ে দিবে।
🌸
খুশিকে দেখতে পাড়ার কয়েকজন মহিলা এসেছে। খুশবু এটাই ভেবে পায় না, খুশি এই পাড়ার মেয়ে। এখানেই বড় হয়েছে। এখন ওর বিয়ে হয়েছে বলে নতুন করে দেখতে আসার কী হলো? খুশবুর হয়েছে জ্বালা। মহিলা গুলোর জন্য তাকেই চা বানাতে হচ্ছে। খুশির বিয়েতে সে যত কাজ করেছে এত কাজ মনে হয় পুরো জীবনে করেনি।
-খালি হাতে বউ দেখতে চলে এসেছে। এখন নাকি আবার চা খাওয়াতে হবে! চা কি মুখে বললেই হয়ে যায়? আগুনের পাড়ে বসে থেকে পানি গরম করতে হয়।
খুশবু একা একাই বিড়বিড় করছে। সান এসে কখন পেছনে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। চিনি নেওয়ার জন্য পেছনে ফিরলে সানের বুকের সাথে ধাক্কা খেল। কপালে হাত ধরে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
-কী সমস্যা?
-তুমি ক্ষমা করছো না এর থেকে বড় সমস্যা আর কী হতে পারে?
-আমার ক্ষমা দিয়ে আপনার কাজ কী?
সানকে পাশ কাটিয়ে চিনি নিতে গেল। সানও পেছন পেছন গেল।
-ক্ষমা কী পাবো না?
-আপনি বারবার ক্ষমা কেন চাচ্ছেন বলুন তো? আপনি কি কোন অপরাধ করেছেন?
-করেছি। আমার বউয়ের অপছন্দের জিনিস হাত লাগিয়েছি।
লোকটা এমন বাচ্চা কেন? এত সহজভাবে ভুল স্বীকার করে নিলে তার পক্ষে রাগ ধরে রাখা কি সম্ভব হবে? খুশবু চায়ে চিনি মেশাচ্ছে। সান পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
-সরি না! এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।
-আচ্ছা দিলাম।
সান অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
-সত্যি?
-হুম।
খুশবু এত সহজে ক্ষমা করে দিবে সান বিশ্বাস করতে পারল না। তাই বারবার জিজ্ঞেস করছে।
-মন থেকে ক্ষমা করেছ?
এবার খুশবু সানের দিকে ফিরে কঠিন গলায় বলল,
-এক কথা কয়বার বলবো?
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আবার রেগে যেও না। তোমার রাগকে আমি ভীষণ ভয় পাই।
খুশবু মুখ টিপে হাসল। পুরুষ মানুষও যে বউকে এত ভয় পায় এই লোককে না দেখলে বিশ্বাস হতো না।
-চা খাবেন?
সান মুখ বাঁকিয়ে একটু ভেবে বলল,
-না। তবে অন্য কিছু খেতে চাইলে কি পাবো?
-একটু হেসে কথা কী বললাম, এখন আবার আপনার আবদার শুরু হয়ে গেছে।
-নিজের বউয়ের কাছে আবদার করা কি অপরাধ?
-না। বলুন কী খেতে চান?
-বলবো? কিন্তু তুমি যদি রেগে যাও। তাই বলতে সাহস পাচ্ছি না।
-ঠিক আছে। তাহলে বলতে হবে না।
-না দাঁড়াও। বললে কি তুমি রাগ করবে?
খুশবুর চা বানানো শেষ। এখন চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। এই লোক হুদাই তাকে দেরি করাচ্ছে। মেহমানদের কি ঠান্ডা চা খেতে দিবে?
-আপনার কোন কাজটা রাগ না করার মতো বলুন তো?
সান ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলল,
-আমি তোমাকে ইমপ্রেস করতে গিয়ে রাগিয়ে দেই। এটা কি আমার দোষ বলো?
-না আপনার দোষ না। এবার বলুন কী বলতে চান? দেরি করাবেন না দয়া করে। চা ঠান্ডা হয়ে শরবত হয়ে যাবে।
-তোমাকে একটা চুমু খেতে পারি?
কথাটা বলার সাথে সাথে সান চোখ বন্ধ করে চড় খাওয়ার জন্য গাল বাড়িয়ে দিল। খুশবু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ পরেও চড় পড়েনি দেখে সান চোখ খুললো। মিনমিনে গলায় বলল,
-ঠোঁটে না। অন্তত কপালে দেওয়ার অনুমতি তো দিতেই পারো।
খুশবু এটাই ভেবে পাচ্ছে না এই কাজের জন্য কে অনুমতি চায়? খুশবু রাজি হবে না বুঝতে পেরে সান মুখ ছোট করে ফেলল।
-আচ্ছা থাক। তুমি এখনও তৈরি হওনি। মনকে নাহয় আরও কিছু দিন বেঁধে রাখলাম।
সান কথা শেষ করার আগেই খুশবু চট করে ওর গালে চুমু খেয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সান বোকার মতো তাকিয়ে আছে। কী ঘটে গেল এটা! সবটাই কি তার কল্পনা ছিল! নাকি খুশবু সত্যিই…। সান গালে হাত দিয়ে দরজার সামনে এসে গলা উঁচিয়ে ডাকল।
-এই খুশবু!
খুশবু পেছন ফিরে চোখ রাঙাল। মুখে কিছু না বলেও শাসন করে দিল, সবার সামনে এরকমভাবে ডাকলে খবর আছে।
চলবে