#কমলা_রঙের_রোদ [৩৭]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
দাদীর ঘরে সকলে জড়ো হয়েছে। স্মরণ ভয়ে আছে অজানায় সে আবার কোন অপরাধ করে ফেলল। যার জন্য সকলে তার ক্লাস নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে।
-অফিসে বসে আমি কী এমন অপরাধ করে এসেছি যে, বাড়ি আসা মাত্র তোরা আমাকে নিয়ে সালিশ বসিয়েছিস!
খুশবু মুখ টিপে হাসছে। খুশি এঘর থেকে পালানোর পথ খুঁজছে। মা হওয়া প্রতিটা মেয়ের জন্য পৃথিবীর সবথেকে বড়ো খুশির খবর। কিন্তু তার এখন লজ্জা লাগছে। সান এমনিতে হাসিখুশি থাকলেও খুশবু তার দিকে তাকানো মাত্র মুখ কালো করে ফেলছে। খুশবু অবশ্য এসব পাত্তা দিচ্ছে না।
-আমাকে নিয়ে কেন সালিশ বসিয়েছ বলবে তো কেউ?
পরী বানু মুখ গম্ভীর করে বললেন,
-তোর বিচার আছে।
-বিচার পরে কোরো। আগে তো অপরাধ বলো।
-ছোটখাটো কোন অপরাধ তো আর করছোস না। এই অপরাধের শাস্তি সারাজীবন বইয়া যাইতে হইব।
স্মরণের মুখের দিকে তাকিয়ে মানছুরার মায়া হচ্ছে। মুখটা কেমন ছোট হয়ে গেছে। আম্মা ছেলেটাকে এত না জ্বালালেও পারে।
-আম্মা এবার ছাড়েন তো। অফিস থেকে এসে এখনও কাপড়ও পাল্টায়নি। ওকে ঘরে যেতে দিন।
পরী বানু ছেলের বউকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,
-তুমি চুপ থাকো। অত দরদ দেখাইয়ো না।
স্মরণ খুশির দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানতে চাচ্ছে কাহিনি কী?
-দাদী আমি যাচ্ছি।
খুশি এটা বলে এক সেকেন্ডও দেরি না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। স্মরণ ভেবে পাচ্ছে না খুশি কি তার নামে দাদীর কাছে বিচার দিয়েছে। যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে এই খুশির বাচ্চার আজ খবর আছে।
খুশি নিজের ঘরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দাদীর বাড়াবাড়িতে যে সে কতটা লজ্জায় পড়েছে এটা বুড়িকে কে বোঝাবে।
-দাদী আর ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। এবার বলো কী অপরাধ করেছি।
পরী বানু গম্ভীর মুখে হাতে ইশারা করে বললেন,
-কাছে আয় কই।
স্মরণকে হাতে নাগালে পেয়ে কান টেনে ধরে আহ্লাদী গলায় বলল,
-ওরে গাধা! কোন অপরাধ করোস নাই রে। তুই বাপ হইবি।
কথাটা শুনে স্মরণ স্তব্ধ হয়ে রইল। নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই কি সে বাবা হবে!
একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে স্মরণ ঘরে ঢুকলো। তার মুখটা নক্ষত্রে ভরা রাতের মতো ঝলঝল করছে। স্মরণ এখনও বিশ্বাস করতে পারছে। চোখে খুশি গলায় অবিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-সত্যি খুশি!
খুশি লজ্জায় মুখ লোকাল। স্মরণ পলকের মধ্যে ওর সামনে চলে এলো।
সামান্য কাঁপা গলায় বলল,
-কিরে বল।
খুশি মৃদু স্বরে বলল,
-দাদী বলেনি?
-বলেছে। তারপরও আমি একবার তোর মুখ থেকে শুনতে চাই। তুই বল। এটা কি সত্যি?
খুশি মুখ নুইয়ে রেখে মাথা নেড়ে জবাব দিল,
-হুম।
স্মরণ খুশিতে চিল্লিয়ে উঠল। খুশি তাড়াহুড়ো করে ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
-পাগল হয়ে গেলে নাকি! চেঁচাচ্ছ কেন?
স্মরণ মুখের উপর থেকে খুশির হাত সরিয়ে আকষ্মিক খুশিকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরতে লাগল। খুশি ভয় পেয়ে স্মরণের শার্ট শক্ত করে ধরেছে।
-পড়ে যাব। নামাও প্লিজ।
-তোর মনে হয় আমি তোকে আর আমার সন্তানকে ফেলে দিব?
স্মরণের মুখে আমার সন্তান কথাটা শুনে খুশির এত ভালো লাগল! তার চোখে পানি চলে এসেছে। খুশির চোখে পানি দেখে স্মরণ ওকে নিচে দাঁড় করাল। অবাক গলায় বলল,
-কাঁদছিস কেন তুই?
পরক্ষণেই আবার ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল,
-কোলে তুলে ঘুরিয়েছি ব্যথা ট্যথা পেয়েছিস নাকি?
-না।
-তাহলে কেন কাঁদছিস পাগল?
-এমনিতেই।
স্মরণ কতক্ষণ খুশির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে কপালে চুমু খেলো।
-তুই সত্যিই একটা পাগল।
-বিয়ে করেছ। এখন পাগলের সাথেই সংসার করতে হবে।
-ইহকাল পরকাল দু’টোই পাগলের নামে করে দিলাম।
খুশি ঠোঁট কামড়ে হাসল। নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
-তুমি খুশি তো?
স্মরণ খুশির আরও কাছে এসে আলতো করে ওর পেটের উপর হাত রেখে নিজের সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করে বলল,
-তুই আমাকে জীবনের সবথেকে বড়ো খুশি দিয়েছিস। আমি কতটা খুশি তা পৃথিবীর সব শব্দ দিয়েও বর্ণনা করা যাবে না।
🌸
এক ঝুড়ি ভর্তি তেঁতুল নিয়ে খুশবু খুশির ঘরে ঢুকেই বলে,
-এইযে গর্ভবতী মহিলা, দেখ তোর জন্য কী এনেছি।
খুশি এদিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-এত তেঁতুল কোত্থেকে এনেছিস?
-পল্টু কোত্থেকে চুরি ডাকাতি করে এনেছে কে জানে।
-তুই ওই পাগলকে বলেছিস দেখেই তো এনেছে। তোর কথা শুনে দশতলা ছাদ থেকে লাফ দিতে পারবে। তেঁতুল চুরি করা এমন কী কাজ।
-এত কথা বলিস না তো। তোর জন্যই তো আনিয়েছি।
-আমার জন্য কেন? আমি কি বলেছি?
-এই তুই সত্যিই প্রেগন্যান্ট তো? আমার তো এখন সন্দেহ হচ্ছে। আমি দেখেছি এসময় মানুষ টক দেখলে মুখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে। তুই আমার সাথে তর্ক করছিস! তোর খেতে মন চাইলে খাবি না হলে আমিই
আচার বানিয়ে খাবো।
তেঁতুল গুলো রেখে খুশবু চলে যাচ্ছিল। খুশি পেছন থেকে ডেকে দাঁড় করাল।
-দাঁড়া। কথায় কথায় এত রাগ করিস কেন?
খুশবু খুশির দিকে ফিরে সবগুলো দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল,
-জি না। এখন চাইলেও তোর সাথে রাগ করতে পারব না। তোর পেটের ভেতর যে বসে আছে তিনি আমার অতি আপনজন। তোর সাথে রাগ করলে এখন তার সাথেও রাগ করা হবে। তোমার পু্ঁচকুর খালামুনি অনেক চালাক। এখন থেকেই কোনরকম অভিযোগ করার সুযোগ দিবে না।
খুশবু চলে গেলে খুশি হেসে বলল,
-আস্ত পাগল একটা।
🌸
সান খুশবুর সাথে ঠিকভাবে কথা বলছে না। তাকে এড়িয়ে চলছে। কাল রাতে ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। খুশবু ভেবেছে সকাল হতে হতে নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সকালে সে ঘুম থেকে উঠার আগে সান উঠে গেছে। তাকে ডাকেও নি। এ কোন জ্বালা! খুশবু ভেবে পায় না এই লোকের রোগের ঔষধ সে কী দিবে। বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বসে থাকে। নাস্তার পরে সান ঘরে এলেই খুশবু ওর শার্টের কপাল চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-এই বেটা সমস্যা কী আপনার? কাল থেকে আমার সাথে কথা কেন বলছেন না?
খুশবু কীভাবে বোঝাবে এই লোকের বকবক শুনতে না পেয়ে গতকাল থেকে সে কতটা অস্থির হয়ে পড়েছে। আজেবাজে পেঁচাল পারা এই লোকের স্বভাব। খুশবুও সানের এই স্বভাবের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে কথা বন্ধ করে দেওয়া এটা আবার কোন নাটক।
-কী হলো? জবাব দিচ্ছেন না কেন?
সান মেয়েদের মতো অভিমানী মুখ বানিয়ে বলল,
-আমি কথা না বললেই বা তোমার কী?
খুশবুর রাগ বেড়ে যাচ্ছে। মেয়েদের মতো এই বেডা এত নখরা কেন করবে?
-আমার মাথায় রক্ত তুলে দিবেন না বলে দিলাম। আপনি কি চার পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে? অন্যের কাছে একটা খেলনা দেখে বাড়ি ফিরে সেটার জন্য আবদার করে বসলেন। আবদার পূরণ না হলে জেদ ধরে আদায় করে নিলেন।
-তুমি আমার জেদ আবদার কোনটাই তো পূরণ করছো না।
খুশবুর এত রাগ লাগছে। মন চাচ্ছে বদ লোকের মাথার চুল সব টেনে তুলে টাক করে দিতে।
-আপনার অহেতুক জেদ বা আবদারের কোন মানে আছে?
-অহেতুক! তোমার কাছে অহেতুক মনে হয়? আমি তোমার স্মরণ ভাইয়ের থেকে বড় এটা কি জানো? অথচ তোমার স্মরণ ভাই বয়সে আমার ছোট হয়ে, এমনকি আমার পরে বিয়ে করে আমার আগে বাপ হয়ে যাচ্ছে।
এত রাগের মাঝেও খুশবুর হাসি পেয়ে গেল। মানুষটাকে এভাবে ঠোঁট ফুলিয়ে কথা বলতে দেখলে এত আদর লাগে! চেষ্টা করলেও রাগ ধরে রাখা যায় না। খুশবু সানের কলার ছেড়ে দু-হাত দিয়ে গলায় জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-সাহেব যে বাবা হতে চান, নিজের আচরণ একবার দেখেছেন তো? আপনি নিজেই তো এখনও বাচ্চাদের মতো জেদ করেন। আরেকটা বাচ্চা যদি আসে, তখন দুই বাচ্চাকে আমি একসাথে কীভাবে সামলাবো বলেন তো?
সানও খুশবুর কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-ওসব নিয়ে মিসেসের কোন টেনশনই করতে হবে না। বাচ্চার মা এবং বাচ্চা দু’জনকেই আমি সামলে নেব।
-ঠিক আছে। দেখা যাবে। একসাথে আদর্শ স্বামী ও পিতা হতে পারেন কি-না। যদি না পারেন তখন কিন্তু খবর আছে।
চলবে
#কমলা_রঙের_রোদ [৩৮]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
-বকুল শুনেছ? তুমি দাদী হবে।
বকুল গুনগুন করে গান গাচ্ছিল। প্রায় সময়ই সে গুনগুন করে। কিন্তু হাসান তাকে কোন একটা গান গাইতে বললে আর গায় না। দাদী হবার খবরটা যেন বকুল আগে থেকেই জানত।
-তুমি জানার আগেই আমি জানি।
-ওহ।
বকুল এখনও গুনগুন করছে। হাসান মুগ্ধ চোখে স্ত্রীকে দেখছে। হাসানের দিকে না তাকিয়েই বকুল বলল,
-ওভাবে তাকিয়ে থেকো না তো। আমার ভীষণ লজ্জা করে।
-তুমি তো সবসময় থাকো না। একটু সময়ের জন্য আসো। তোমাকে দেখার শখ মিটে না।
-হয়েছে বুড়ো বয়সে আর ঢং করো না তো। কয়দিন পর দাদা হবে।
-তুমিও তো দাদী হবে। তবে তোমাকে দেখে বোঝা যায় না। তুমি এখনও আগের মতোই আছো।
-তোমার মা এসেছে। আমি এখন যাই।
কথাটা বলেই বকুল কোথায় চলে গেল। দরজায় পরী বানু এসেছেন। ছেলের সাথে অনেকদিন কথা হয় না। ছেলেও মা’র খোঁজ নেয় না। যে নিজেই বাস্তবে থাকে না। সে কী মা’র খোঁজ নিবে? হাসান চারদিকে তাকিয়ে বকুলকে খুঁজে পেলো না। মাকে দেখে বলল,
-মা আসো।
পরী বানুর হাঁটুতে ব্যথা। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। ঘরে এসে তিনি বললেন,
-তুইও তো একটু ঘর থেকে বাইর হইতে পারস নাকি। মানুষ তো শইলে হাওয়া বাতাসও লাগায়। সারাদিন ঘরে বইয়া কী করোস?
-কিছু করি না।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে পরী বানু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলে যে কেন সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকে এটা তিনি জানেন। মনে মনে পরী বানু বললেন,
-যে বউ কত বছর আগে মইরা গেছে অহনও তুই তার লগে কথা কস। মরা একটা মানুষের লাইগা জীবন সংসার ত্যাগ দিলি।
হাসান যখন অন্য কোন মানুষের সাথে থাকে বকুল তখন আসে না। হাসান একা হলেই আসে। তাই সে মানুষের সঙ্গ পছন্দ করে না।
-খুশিরেও তো দেখতে গেলি না।
হাসান অপরাধী মুখে বলল,
-যাওয়া উচিত ছিল।
ছেলেদের কথা মনে পড়লে পরী বানুর চোখ ভিজে আসে। এক ছেলে বিয়ে করে বউ রেখে গিয়ে আরেক বিয়ে করেছে। স্বামীর করা বেইমানি সহ্য করতে না পেরে বউটা পাথর হয়ে গেছে। আরেক ছেলে বউ হারিয়ে শোকে পাগলই হয়ে গেছে। এক ছেলে পৃথিবীতে নেই। আরেক ছেলে পৃথিবীতে থেকেও না থাকার মতোই।
🌸
খুশির প্রেগন্যান্সিতে সবথেকে বেশি ছোটাছুটি খুশবুর হচ্ছে। কারণ সে শাশুড়ি মাকে একা রেখে বাবার বাড়িতেও বেশিদিন থাকতে পারে না। আবার কয়েকদিন পরপর বাবার বাড়িতে না এলেও অস্থির লাগে। খুশবু যখনই আসে বাড়ি থেকে অনেককিছু রান্না করে নিয়ে আসে। মূলত শাশুড়ি মা’ই তাকে খালি হাতে আসতে দেয় না। আবার এতকিছু নিয়ে আসে দেখে মা দাদী সবাই বকাবকি করে। খুশবু কোন দিকে যাবে এটাই ভেবে পায় না। তবে বড় আব্বু যখন তার হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসা করে তখন আর মা দাদীর বকা গায়ে লাগে না।
-আরেকটা মাছ দেই বড় আব্বু?
-ইলিশ মাছে অনেক কাটা রে। খেতে পারি না।
-আমি কাটা বেছে দেই?
হাসান খুশবুর মুখের দিকে তাকিয়ে শিশুদের মতো হেসে বলল,
-দে।
খুশবু মাছের কাটা বেছে দিচ্ছে। বড় আব্বু তৃপ্তি করে খাচ্ছে। নিজের বাবাকে খুব বেশি সময় কাছে পায়নি খুশবু। বড় আব্বুকে দেখে তার ঠিক বাবার মতো মনে হয়।
-তুই খাবি না?
-পরে খাবো। তুমি খাও।
খুশির এখন সাত মাস চলছে। পেট অনেকটা বড় হয়েছে। খুশির পেটের উপর কান রেখে খুশবু কিছু শোনার চেষ্টা করছে।
-এই দুষ্টু এখন কথা বলছিস না কেন? মাকে নাকি অনেক জ্বালাস৷ মা কিন্তু আমার কাছে বিচার দেয়।
খুশবুর পাগলামি দেখে খুশি হাসে। শুধু আজ না। এই ছয় সাতটা মাস ধরেই দেখে যাচ্ছে। বাবুকে নিয়ে ওর শখের কোন শেষ নেই। মেয়ে বাবু হলে এই নাম রাখবে। ছেলে বাবু হলে ওই নাম রাখবে। এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে সারাটা সময়। মাঝে মাঝে তার পেটে হাত রেখে বাবুর নড়াচড়া অনুভব করার সময় খুশবুর মুখে অন্যরকম উজ্জ্বলতা দেখা দেয়। খুশি তখন মুগ্ধ হয়ে খুশবুকে দেখে।
-খুশবু।
-হুম বল।
-তোরা কেন বেবি প্ল্যান করছিস না?
এই কথা শুনে খুশবুর মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেল। ওর চেহারার পরিবর্তন খুশিরও চোখ এড়ায়নি। খুশবুর হাত ধরে খুশি নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
-কী হয়েছে রে?
একটু সময়ের জন্য খুশবু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাথে সাথে হেসে বলল,
-কী হবে আবার?
-বেবি নেওয়ার কথা শুনে তোর মুখ এমন মলিন হয়ে গেছে কেন?
-দূর! মুখ মলিন হবে কেন? তুই যে কত আজেবাজে ভাবিস!
খুশবু মুখে যতই বলুন কিছু হয়নি। খুশির তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। তাহলে কি সান চায় না!
-সান কি এখনই বেবি চায় না?
-কী যে বলিস! ওই লোক বাচ্চা বলতে পাগল। পারলে একসাথে তিন চারটার বাপ হয়ে যাবে।
খুশবুর চোখ সাক্ষী দিচ্ছে ও মিথ্যা বলছে না। সানেরও কোন সমস্যা নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
-তোরা কি বেবি প্ল্যানিং করছিস?
-প্ল্যানিং ট্যানিং কিছু না। সময় হলে আল্লাহই দিবে। আর এক বছরই তো হয়েছে মাত্র। এখনই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সাংসারিক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে জীবনটা এনজয় করা হবে না।
খুশি হতভম্ব হয়ে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কথাগুলো খুশবু বলেছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। মনেই হচ্ছে না এগুলো খুশবুর চিন্তাভাবনা। তার বাবুকে নিয়ে খুশবুর এত শখ আহ্লাদ নিজের চোখেই তো দেখছে। অথচ নিজের বেবি নেওয়ার কথা উঠলে এতটা হেলাফেলা! নিশ্চয় খুশবু কিছু লোকাচ্ছে। খুশবু কখন মিথ্যা বলে, কখন সত্য বলে এটা খুশি খুব ভালোই বুঝতে পারে।
খুশবু আজ থাকতে পারবে না। সান সিলেট গিয়েছে। মা বাড়িতে একা। এক দুপুরের জন্য এসেছিল। বাড়ি ফেরার সময় পুরোটা পথ খুশবুর মন খারাপ হয়ে থাকল। বাড়িতে ঢুকে শাশুড়ি মা’র সামনে পড়লে মিসেস সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন,
-চলে এসেছ?
-হুম।
-আমি ভেবেছিলাম তুমি আজ থাকবে। বাড়িতে সবাই কেমন আছে?
-ভালো।
খুশবুর মুখ দেখে মিসেস সুলতানাও বুঝতে পেরেছেন কোন কারণে হয়তো খুশবুর মন খারাপ।
-তোমার কি মন খারাপ?
খুশবু শাশুড়ি মা’র দিকে তাকিয়ে জোর করে হেসে বলল,
-না মা। আমার কেন মন খারাপ হবে?
খুশবু না বললেও মিসেস সুলতানা বুঝতে পারেন। অনেকদিন ধরেই খুশবুকে অন্যরকম লাগছে। কাজকর্ম করলেও সারাক্ষণ যেন কেমন উদাস থাকে। কথা বলে কিন্তু আগের মতো সেই চঞ্চলতা নেই। কী হয়েছে মেয়েটার? স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কি কোন ঝামেলা চলছে? আরও কয়েকটা দিন দেখবেন তিনি। তারপর ছেলেকে ধরবেন। এরকম হাসিখুশি মেয়েটার হঠাৎ পরিবর্তনের পেছনে নিশ্চয় তার ছেলেরই হাত আছে।
দুপুরে বাবার বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছিল। রাতে শাশুড়িকে খাইয়ে নিজে না খেয়েই ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। সান এখনও ফিরেনি। খুশবু কল করেছিল ফোন বন্ধ আসছে। খুশবুর আজ অনেক বেশি মন খারাপ লাগছে। কান্নাও করেছে। তার ভেতর কী চলে সে কাউকেই বোঝাতে পারে না। খুশিও নিশ্চয় আন্দাজ করতে পেরেছে। চোখের পানি ফেলে বালিশ ভেজাতে ভেজাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানা নেই। কপালে উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে ঘুমটা একটু পাতলা হয়ে এলো। সান একটু আগেই ফিরেছে। ফোনে চার্জ না থাকায় খুশবুর সাথে কথা হয়নি। খালা দরজা খুলে দিলে খুশবুর কথা জিজ্ঞেস করলে বলল, ঘরে। যদিও রাত এগারোটা বাজে। তারপরও খুশবু তার জন্য অপেক্ষা করে আছে এটাই আশা করেছিল। ঘরে এসে দেখল পুরো ঘর অন্ধকার। তার বউ ঘুমিয়ে আছে। সানের খুশবুকে তুলতে ইচ্ছে করল না। জামাকাপড় না ছেড়েই খুশবুর পাশে শুয়ে পড়ল। বউয়ের ঘুম না ভাঙিয়ে সাবধানে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল। এভাবেই সময় কাটতে লাগল। খুশবুর গরম নিঃশ্বাস সানের গলায় পড়ছে। আজকে সারাদিন বউকে অনেক বেশি মিস করেছে। খুশবু নড়ে উঠলে সান ওর কপালে চুমু খেলো। এতেই খুশবু ঘুম ভেঙে গেল। চিরচেনা সেই ঘ্রাণ পেয়েই বুঝতে পারল সান চলে এসেছে। চোখ খুলে অন্ধকারে সানকে দেখতে পেলো না। কিন্তু সান তার নড়াচড়া দেখে বলল,
-শান্ত হয়ে আরেকটু শুয়ে থাকো না। এভাবেই ভালো লাগছে।
ঘুমে নেতিয়ে পড়া গলায় খুশবু বলল,
-আপনি কখন এসেছেন?
-এসেছি কিছুক্ষণ।
-কয়টা বাজে এখন?
খুশবু কপালে নাক ঘষে দিয়ে সান বলল,
-জানি না। তোমার সময়ের চিন্তা করতে হবে না।
-খেয়েছেন?
-বাইরের কাপড়ও ছাড়িনি।
-আপনি আমাকে ডাকেননি কেন? কাপড় না পাল্টে আপনিও আমার সাথে শুয়ে আছেন!
খুশবু উঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু সান তাকে ছাড়ছে না।
-তুমি জানো সারাটা দিন তোমাকে কত মিস করেছি? মনে হচ্ছিল আমার কলিজা কেটে বাড়িতে রেখে গেছি। যত ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংই হোক না কেন এরপর থেকে আমি আর শহরের বাইরে যাব না। আর গেলেও তুমি আমার সাথে হবে এটা মেক সিওর করব।
অন্ধকারে খুশবু মুচকি হাসল। দুপুর থেকে মন খারাপ ভাবটা হঠাৎই উধাও হয়ে গেছে। এই মানুষটা কাছে থাকলে তার কোন মন খারাপই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
-আচ্ছা ঠিক আছে। এবার উঠতে দিন।
-না। এভাবেই থাকো না।
-আপনি খাবেন না? বাইরের কাপড় তো ছাড়বেন?
-কোনকিছু করতেই ইচ্ছে করছে না। তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
খুশবুও আর জোড়াজুড়ি করল না। কারণ জানে সে কখনও এই লোকের সাথে জিততে পারবে না। নিজের কথা কীভাবে মানাতে হয় এটা ইনার থেকে ভালো আর কেউ পারবে না।
-তোমার আজকের দিন কেমন কেটেছে?
-বাড়ি গিয়েছিলাম।
-তাহলে ভালোই কেটেছে।
তার দিন ভালো কেটেছে এটা সত্যি হলেও সাথে করে অনেকখানি মন খারাপ নিয়ে ফিরেছিল। যদিও তার মন খারাপের পেছনে কারো হাত নেই। খুশির তো একদমই না।
-আমার দিন আজ অনেক বেশি কাজের চাপে কেটেছে। বিরক্তির সাথে ক্লান্তিও ভর করেছিল। কিন্তু এখন শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে আমি আবার নিঃশ্বাস নিতে পারছি।
সানের বুকে মাথা রেখে হৃদপিণ্ডের ওঠানামার শব্দ শুনতে শুনতে নিঃশব্দে হাসল। এই লোক আস্ত একটা পাগল। তাদের পাড়ার কাকীমাদের ভাষ্যমতে বললে, বউ পাগল। বউ ছাড়া চোখে পথ দেখে না। বউয়ে মনে হয় তাবিজ করছে।
সানের বুকই নিজের জন্য পৃথিবীর সবথেকে নিরাপদ স্থান মনে হয় খুশবুর কাছে। সানের হাত ধরে চোখ বন্ধ করে সে অনেক অনেক পথ পাড়ি দিতে পারবে। খুশবুর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। দু’চোখে আবার ঘুমেরা ভর করেছে।
-খুশবু।
-হুম।
-ভালোবাসি।
-আমিও।
চলবে