কারণ আমি মেয়ে পর্ব-০৫

0
43

#কারণ_আমি_মেয়ে
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৫

উদাসের মনের মতোই সেজেগুজে গিয়েছিলাম ওর সাথে দেখা করতে। ঐ দিন ছুটি নিয়েছিলাম আর মা’কেও বলে গিয়েছিলাম ফিরতে রাত হবে। ওখানে গিয়ে আজ আর আমাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। আজ উদাস আগে থেকেই ওখানে বসে ছিলো। আমার উপস্থিতি ও টের পেয়ে আমার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলো। আমি ওর তাকানো কে উপেক্ষা করে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। আজ আমাদের মাঝে কোন প্যাকেট নেই, নেই বেশি দূরত্ব, বেশি হলে দশ আঙুলের ফারাক ছিলো। এতোটা কাছে থেকে মনে হয়েছিলো ওর হার্টবিট এর আওয়াজ আমার হার্টবিট থেকেও জোরে বিট করছে। কারো মুখে কোন কথা নেই শুধু দু’জনার চোখ কিছু ফুলের কাছে আবদ্ধ ছিলো। যখন আমি বুঝতে পারলাম ও হয়তো আজ আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না তাই আমিই মুখ খুললাম।

“আমার কিছু বলার ছিলো আপনাকে।”

“হুম শুনবো, আমারও কিছু বলার আছে।”

“তাহলে আপনি আগে বলুন।”

“বলবো, কিন্তু এখন না।”

“তাহলে…?”

“একটা রিকোয়েস্ট করবো রাখবেন।”

“জ্বি বলুন”

“আজকের বিকাল থেকে রাত আট’টা পর্যন্ত আমাকে দিবেন।”

তারপর উদাস উনার হাত ঘড়িতে তাকিয়ে টাইম দেখে বললো।

“এখন 4.1 তাহলে সময় চাইছি মাত্র 5 ঘন্টা, প্লিজ দিবেন?”

ওর হঠাৎ এমন করুন করে রিকোয়েস্ট করাটা কোথাও যেনো আমার বুকে বাঁধলো। আমি বললাম,

“ঠিক আছে।”

“তাহলে বাড়িতে জানিয়ে দিন।”

“আমি বাড়িতে বলে এসেছি, ফিরতে রাত হবে।”

“আপনি কি জানতেন, আমি এমন কিছু বলবো।”

“না।”

“তাহলে?”

“জানিনা কেন জানি মনে হলো আজ বাড়ি ফিরতে হয়তো রাত হবে।”

“আচ্ছা বাদদেই, যতোটুকু সময় হাতে আছে নষ্ট না করে চলুন।”

তারপর আমারা পার্ক থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিলাম। দু’জনেই পাশাপাশি বসে আছি খুব কাছাকাছি। কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। আমার না-হয় কথা না খুঁজে পাওয়ার কারণ আছে তার কি কারণ। তাই আমি আবারও মুখ খুললাম।

“চুপ করে আছেন, কিছু বলবেন না?”

“অনেক কিছুই তো বলার ছিলো, বলার আছে। কিন্তু প্রকৃতি সময় আর দিলো কই।”

“মানে!”

“না তেমন কিছু না, চলুন আজ আমার পছন্দের একটা জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাই।”

প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পর আমরা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে নামলাম। তাকিয়ে দেখি চাইনিজ হ্যাভেন নামের একটি রেস্টুরেন্ট। তারপর সে আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। আমি ভেতরে ঢুকে অনেক অবাক হলাম। পুরো রেস্টুরেন্টে জুড়ে ছুঁয়ে আছে সৌন্দর্যের প্রতীক। এখানে যে আমার মতো সাধারণ মেয়ের আসার কোন সাধ্য নেই তা বোঝাই যাচ্ছে, রেস্টুরেন্টের প্রতিটা কোণা দেখে। একটি টেবিলে গিয়ে বসলো উদাস আমাকে নিয়ে। তারপর একজন ওয়েটারকে ডাক দিয়ে দু’টো কফির অর্ডার দিলো।

পাঁচ মিনিট পর কফি চলে এলো। সে একে একে কফির মগে চুমুক দিলো। আর আমি আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম তার কফি খাওয়ার দৃশ্য। আমাকে ওমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উদাস বলল,

“আমাকে না দেখে কফিটা খান, না হলে কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

আমি উনার ওমন কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে কফিটা মুখে দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেললাম। আমার এমন দৃশ্য দেখে, তিনি বললেন,

“ঐ কফির সাথে আমার হিংসে হচ্ছে। ওর অধিকার আছে আপনাকে ছুঁয়ে দিয়ে কষ্ট দেওয়ার, কিন্তু আমার ভালোবাসারও অধিকার নেই।”

আমি উনার এই কথা শুনে ডানে বামে তাকিয়ে কথাটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কফি শেষ করে রেস্টুরেন্টে থেকে বেরিয়ে এলাম।

“এবার আপনার একটা পছন্দের জায়গার নাম বলুন।”

“আমার?”

“হুম, আপনার।”

“যাবেন?”

“কেন নয়।”

“আচ্ছা, তাহলে আমার কলেজে চলুন।”

“আপনার কলেজ মানে বিএএল কলেজে?”

“হুম।”

“নিশ্চয়ই বকুল তলায় যাবেন।”

“উনার মুখে বকুল তলার কথা শুনে একটু হেসে দিলাম। আমার ওই হাসির বিনিময়ে তিনিও হাসলেন।”

তারপর ওখান থেকে রিক্সা করে চলে গেলাম কলেজে। এখন কলেজ বন্ধ যেহেতু সরকারি কলেজ তাই সব সময়ই ঢোকা যায়। আর ভেতরে রয়েছে হোস্টেল তার জন্য আরো বেশি ঢোকা যায়। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম বকুল তলায়। সেখানে বসতেই তিনি বলতে শুরু করলেন।

“জানেন প্রেম ভালোবাসা আমার কাছে মনে হতো একটা রোগ। যেটা কখনো শরীর কে ছুঁতে দেওয়া যাবে না। এটাই ভেবে এসেছি এতো বছর। কিন্তু আপনাকে যেদিন প্রথম শপে দেখি সেদিন আমারও কেন জানি মনে হলো আমিও একটু আক্রান্ত হই এই প্রেম নামের রোগে। কিন্তু কে জানতো এই রোগে একবার আক্রান্ত হলে মনের সাথে সাথে শরীরেও মৃত্যু হবে। আমার স্বপ্ন ছিলো আমি বিয়ে না করা অবধি আমার প্রিয়তমাকে আপনি বলেই সম্মোধন করবো। বাসর রাতে গিয়ে তাকে প্রথম বউ বলে ডেকে তারপর তুমি করে ডাকবো। তাই আমি আপনাকে তুমি বলে ডাকিনি। কিন্তু কেন জানি সেই ইচ্ছে টাকে মাটি দিয়ে আপনাকে আপনি থেকে তুমি বলতে ইচ্ছে করছে। আমাকে আমার বাবা-মা সব সময় বেস্টটাই দিয়েছে। বেস্ট স্কুল থেকে বেস্ট কলেজ, আর এই বেস্ট বিষয় গুলোর জন্যই আমি বেস্ট চাকরিটাও পেয়েছি। তারা তাদের জীবনের সব বেস্ট গুলো আমায় দিয়েছে, তাই তারা বেস্ট জীবন সঙ্গীও দিতে চায়। কিন্তু আমি তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। তারা চকচক হীরে দেখতে দেখতে ভুলে গেছে ব্লাক ডায়মন্ড কিন্তু চকচক করে না, কিন্তু সেটা সব চেয়ে দামি এবং বেস্ট ডায়মন্ড। কিন্তু বাবা-মায়ের চোখে সাদা ডায়মন্ডেই চোখ আঁটকে আছে তাই…”

“আমিও আপনাকে বিয়ে করতে চাই না উদাস।”

আমি যে এমন একটা কথা বলবো সেটা হয়তো উদাস বুঝতে পারেনি। তাই সে ফ্যাল ফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। “এই বিষয়টা নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো উদাস। আমিও জানি আপনিও জানেন এই সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যাওয়া মানে দু’জনার বাবা-মা কে ছোট করা।”

তারপর আমরা দু’জনেই চুপ হয়ে রইলাম! বুঝতে চেষ্টা করছি দু’জনার পরিস্থিতি। এক কষ্টে, এক জায়গায়, এক পরিস্থিতিতে আঁটকে আছি দু’জন। হৃদয়ের আগুনের জ্বালা কতটা গভীর সেটা বোঝার চেষ্টা করছি দু’জনেই। একটা সময়প র আমি দাঁড়িয়ে বললাম।

“এবার আমাদের উঠা উচিৎ উদাস”

উদাস আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখটা সরিয়ে নিলাম। নিজেকে যথেষ্ট কঠিন রাখারা চেষ্টা করলাম। উদাসের চোখ প্রচুর লাল হয়ে আছে, হয়তো আকাশের মতো! বৃষ্টি নামার আগে যেমন আকাশ মেঘে ছেয়ে যায়। এই মুহুর্তে উদাসের চোখের অবস্থা ঠিক তেমন। আমি ওর দৃষ্টি কে এড়িয়ে হাঁটতে নিলেই পিছন থেকে উদাস ডেকে উঠলো।

“রাবেয়া, একবার জড়িয়ে ধরবে?”

ব্যাস, উদাসের বলতে বাকি ছিলো কিন্তু ওর বুকে আমার ঝাঁপিয়ে পরতে বাকি ছিলো না।

কিছু দিনের অতিথি হয়ে কেন এলো উদাস আমার জীবনে? কেন এই এলোমেলো জীবনটাকে আরো এলোমেলো করে দিলে। খুব কি দরকার ছিলো এমনটা করার। তোমার বোঝা উচিৎ ছিলো তুমি চাঁদ তোমাকে ঐ আসমানেই মানায় জমিনে নয়। কেন ভুল করে আমার হৃদয় নামের জমিনে নেমে এসে, স্বপ্ন দেখালে, কেন উদাস কেন?

উত্তরে উদাস দুফোঁটা চোখের জল দিয়েছিলো। যেটা আমার পিঠ বেয়ে নেমে গিয়েছিলো। কিন্তু ওর ওই চোখের শীতল দু ফোঁটা চোখের জল এসিডের মতো ছিলো, যতটা গড়িয়ে গিয়েছিলো ততোটাই পুড়িয়ে দিয়েছিলো।

আমি ওকে ছেড়ে এক ছুটে বেরিয়ে চলে এসেছিলাম রাস্তায়। ফিরে তাকাইনি পিছন ঘুরে,দেখার বা বোঝার চেষ্টা করিনি উদাসের অবস্থান। সেদিনই ছিলো ওর আমার শেষ দেখা। আর কখনো কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করিনি। ওর নাম্বারটা আমার ফোনে সেভ করাই ছিলো। না আমি ওকে কল দিতাম না ও আমাকে কল দিতো। আমরা কেউ কারো নাম্বার ব্ল্যাক লিস্টে রাখিনি। চাইলেই আমরা যোগাযোগ করতে পারতাম, কিন্তু যেখানে আমাদের প্রকৃতি আলাদা করেছে সেখানে জোর করে যোগাযোগ রাখাটা বেমানান ছিলো।

উদাস হারিয়ে যাওয়ার কষ্টটাও সয়ে নিলাম। কারণ আমি মেয়ে। আমাদের সব কিছু পারতে হয় সবার কথা ভেবে। আবার কাজে, লেখাপড়ায় মনোযোগ দিলাম, সব কিছু আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো। এর মধ্যে অনেক জায়গা থেকেই আমার জন্য সম্বন্ধ আসতে শুরু করলো। গরীব বাবার সুন্দরী মেয়েদের একটু চাহিদা বেশিই। কারণ তাদের না আছে পরিবারের জোর, না আছে টাকার জোর। এভাবে দিন গড়াতে গড়াতে আরো একটি বছর চলে গেলো। আমার অর্নাস কমপ্লিট হয়ে গেলো। ভালো রেজাল্ট করলাম, তাই সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে শুরু করলাম। কিন্তু চাকরি পাওয়া কি আর মুখের কথা? কখনো বড় মাপের মানুষ প্রয়োজন কখনো মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু কিছুই তো আমার নেই। তাই যেখানেই চাকরির ইন্টারভিউ দিতামনা কেন চাকরি পাওয়ার চান্স ছিলো 25%। একদিন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিলাম, সেখানে চাকরি পাওয়ার চান্স ছিলো 88% আগের তুলনায় অনেক বেশি। তাই এক বুক আশা নিয়েই বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু বাড়ি ফিরে এমন কিছু দেখবো তা কল্পনাও করতে পারিনি।

চলবে…