কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-৯+১০

0
224

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৯.

বুকে হাত গুজে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে তাশদীদ। সামনেই রিংকি অংক করছে আর লিখতে লিখতেই অদ্ভুতভাবে হাসছে। কোনোরুপ প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও, বারবার কানের পেছনে কপালের চুল গুজছে মেয়েটা। বিরক্ত হয়ে এদিকওদিক তাকালো তাশদীদ। হাত বাড়িয়ে পাশের ড্রেসিংটেবিল থেকে হেয়ারব্যান্ড নিলো। টেবিলে রেখে, ঠেলে রিংকির দিকে এগিয়ে দিলো ওটা। বললো,

– পরেরবার পড়তে বসার আগে চুল ঠিকঠাকমতো সেট করে নিও কেমন?

রিংকি হাসি বর্ধিত করে হেয়ারব্যান্ড হাতে নিলো। মাথায় পরতে পরতে বললো,

– কেনো? আপনার বেবি হেয়ার পছন্দ না?

– আমার পড়ার সময় উঠকো ঝামেলা পছন্দ না। পড়ায় কনসেনট্রেট করো।

তাশদীদের স্পষ্ট জবাব। রিংকি নিশব্দে হেসে আরো দুইকলম লিখলো খাতায়। তারপর খাতাটা এগিয়ে দিলো তাশদীদকে। তাশদীদ সুক্ষ্মভাবে পরখ করলো খাতাটা। রিংকিকে পড়াশোনায় ও যতোটা গা ছাড়া ধারনা করেছিলো, ততোটা ও নয়। অংকগুলো একদম ঠিকঠাক করেছে। উপরন্তু ওর হাতের লেখাও যথেষ্ট সুন্দর। খাতাটা ফেরত দিলো তাশদীদ। কিছু বলতে যাবে, রিংকি কলম মুখে পুরে, ঘাড় বাকিয়ে বললো,

– কেমন বুঝলেন তাশদীদ ভাই? আমি আপনার যোগ্য তো?

– স্টুডেন্ট হতে যোগ্যতা লাগে না। মজার বিষয় হলো, মা তামজীদের লেখা দেখলেই রেগে যায়৷ ওর হাতের লেখা দেখলে নাকি কেউ মানবে না যে ও আমার ভাই। বাট ট্রাস্ট মি! তোমার হাতের লেখা মাশাআল্লাহ! যে কেউ দেখলেই বলবে, তুমি আমারই ছোট বোন! নো ডাউট ইন দ্যাট!

বলতে বলতে উঠে দাড়ালো তাশদীদ। রিংকি বা হাতের কনুই টেবিলে ঠেকিয়ে, তালুতে মাথা গুজলো। মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে রইলো সবরকমের যুক্তিখন্ডন করতে জানা মানবের দিকে। তাশদীদ টেবিল থেকে নিজের ওয়ালেট আর ফোনটা মুঠোয় নিলো। বললো,

– রেগুলার পড়া করে রেখো। আমি পড়া জমানো স্টুডেন্টদের পড়াই না।

বলা শেষে তাশদীদ মানিব্যাগ প্যান্টের পকেটে গুজে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। রিংকি একদৃষ্টিতে ওর বেরিয়ে যাওয়া দেখলো। তারপর উঠে গিয়ে তাশদীদের চেয়ারে বসে গেলো। টেবিলের ওপরে দু পা তুলে, চেয়ার দুলাতে দুলাতে চোখ বন্ধ করে নিলো ও। মৃদ্যু আওয়াজে আওড়ালো,
‘বিশ্বাস করুন তাশদীদ ভাই, আপনার এই স্টুডেন্ট কোনোরকম পড়া জমাবে না। একটুও পড়া চুরি করবে না। সে কেবল আপনার মনটা চুরি করবে। সবেতো আপনার জায়গায় বসেছি। হুট করেই দেখবেন, রিংকি আপনার মনেও বসে গেছে। ইউ নো হোয়াট তাশদীদ ভাই? আপনি শুধু আমার। আপনাকে কেবল আমার সাথেই মানাবে। ‘

মাগরিব পরে বাসায় ফিরলো তাশদীদ। রুমে ঢুকেই আগে ওয়ালেটটা বিছানায় ছুড়ে মারলো ও। তারপর নিজেও এসে বসলো। দুহাতে মুখ মোছার মতো করে ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো একটা। তামজীদ আধশোয়া হয়ে মোবাইলে গেমস খেলছিলো। একপলক ভাইকে দেখে নিয়ে, আবারো খেলায় মনোযোগ দিলো ও। বললো,

– তারপর? নাটকের কারখানা দর্শন করে কেমন বোধ করছিস?

– রিডিকিউলাস।

বিরবিরিয়ে বললো তাশদীদ। স্পষ্টভাবে শুনতে না পেয়ে তামজীদ ভাইয়ের মুখের দিকে উকি দিলো। তারপর ফোন রেখে উচ্চস্বরে হাঁক ছাড়লো,

– মা? ও মা? শুনছো? তোমার ছেলে ছাত্রী পড়াতে গিয়ে ছাত্রীকে বিয়ে করে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি এসো!

বিমূর্ত চোখে চাইলো তাশদীদ। তামজীদ সরল-শব্দহীন একটা হাসি দিয়ে বললো,

– চিল। মা বাসায় নেই। নামাজ পরে পাশের দর্জিবাড়ি গেছে। তুই আমাকে পাত্তা দিচ্ছিস না বলে ওভাবে বলেছি। এবার বল, কি কি হলো ও বাসায়। সৈয়দ ফ্যামিলি কি তোকে শুধু আপ্যায়নই করেছে? নাকি সত্যিসত্যিই বিয়ে পরিয়ে দিয়েছে?

তামজীদের মাথায় চাটি লাগালো তাশদীদ। গুরুত্ব দিলো না ওর প্রশ্নকে। উঠে গিয়ে টেবিলে থাকা বইপত্রের দিকে এগোলো ও। ওগুলো কিছুটা এলোমেলো দেখে, গুছাতে গুছাতে বললো,

– এগুলো এলোমেলো কেনো?

– বিকেলে তোর এক্স ভার্সিটির এক্স প্রফেসর বাসায় এসেছিলো। তোর রুমে দেখতে এসেছিলো, ভার্সিটি পাল্টে তুই কি পড়ালেখা করে দুনিয়া উল্টে দিচ্ছিস।

মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো তামজীদ। ওর কথা শুনে তাশদীদের হাত থেমে যায়। ভাইয়ের দিকে ফিরে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললো,

– এক্স ভার্সিটির এক্স প্রফেসর মানে?

– আরে তোর ডিপার্টমেন্টের টিচার। সুবোধ না কি যেনো নাম, সে। হঠাৎ বাসায় ঢুকে পরে বাবাকে বললো সে নাকি এদিকদিয়েই যাচ্ছিলো, তাই তোর সাথে দেখা করতে এসেছে। তোকে না পেয়ে বাবার সাথে বেশ অনেকটাসময় কথাটথা বললো ভদ্রলোক। তারপর এই রুম ঘুরে চলে গেলো।

তাশদীদ চুপ করে আছে। তামজীদ একটা বড় দম নিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পরলো বিছানায়। বললো,

– হাহ….! হ্যাঁ রে ভাইয়া? তুই কি জাদুটোনা জানিস নাকি বলতো? যেখানেই যাস, ফ্যানবেইস তৈরী করেই আসিস! কোনোদিনও শুনিনি কোনো ভার্সিটির টিচার তার স্টুডেন্টের বাসায় যায়। আর তোর কপাল দেখ! প্রফেসর বাড়ি বয়ে তোর পড়ার ঘর দেখতে আসে। ভাবা যায়? আমি তো…

তামজীদ বলে চলেছে। তাশদীদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসলো। তারপর টেবিলের সামনের তাকে থাকা কলমদানী থেকে একটা কলম হাতে নিলো ও। চেয়ারে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে, কলমের নিব ওঠানামা করাতে লাগলো। চেয়ে রইলো সর্বসামনের লেখাবিহীন খাতাটার দিকে। দুদন্ড পর কলমে থাকা ছোট্ট বোতামটা চাপলো তাশদীদ। তাক করলো খাতাটার দিকে। কলম থেকে বেরোনো সবুজরঙা রশ্মি খাতার ওপর পরতেই ফ্রন্টপেইজে স্পষ্টাক্ষরের লেখা ফুটে এবারে। সেখানে গোটাগোটা হরফে লেখা, ‘Reactions and Modifications.’

তৈয়ব আলফেজ বাসায় নেই। ড্রয়িংরুমের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে টিভি দেখছে তুল্য। হাতের বার্গারে কামড় দিতে যাবে, জুতার আওয়াজ শুনে টনক নড়ে ওর। পাশে তাকিয়ে দেখে তাথৈ গটগট করে সিড়ি দিয়ে নামছে। তুল্য বার্গারটা টি-টেবিলে রেখে, একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো বোনের দিকে। এলোমেলো চুল, শুকনো দেহ, চোখ বসে গেছে তাথৈয়ের। অজ্ঞান অবস্থায় ওকে হসপিটালাইজড করা হয়েছিলো। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর হসপিটালে একবেলাও ছিলো না ও। জ্বরের শরীর নিয়েই চলে এসেছে অম্বুনীড়ে। নিজেই নিজেকে সুস্থ করার চেষ্টা করেছে। দিনকয়েকের ব্যবধানে হয়তো জ্বর কমেছে কিছুটা। কিন্তু জেদ কমেনি। এই শরীর নিয়েই বাইরে বেরোতে উদ্যত হয়েছে ও। তুল্য বেশ বুঝলো, তাথৈ ক্যাম্পাসেই যাচ্ছে। দুদিনের নোটস জোগার করতে, পড়তে। উচু গলায় বললো,

– নোটিশ দেখিসনি? আজ ক্লাস নেই।

তাথৈ থামলো না। জবাবও দিলো না। বেরিয়ে গেলো। তুল্য নিজের কপাল চেপে ধরে। পরপরই ছুট লাগায়। তাথৈ গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছিলো। এরইমাঝে তুল্য এসে ফ্রন্টসিটে বসে যায়। স্টেয়ারিং ছেড়ে ভাইয়ের দিকে ঘুরে বসে তাথৈ। ওর প্রশ্নসূচক চাওনি। তুল্য স্বাভাবিক গলায় বললো,

– বাস্কেটবল টুর্নামেন্ট আছে। ক্যাম্পাস যাবো।

– নিজের গাড়িতে যা!

– আমার ক্লাস নেই জেনে তোর ড্যাড ড্রাইভারকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে।

– আ’ম নট ইওর ড্রাইভার তুল্য!

– তোকে ড্রাইভার কে বানাচ্ছে? ফেভার ব্যাক কর! জ্বরের ঘোরে যখন অন্তুকে স্মরণ করছিলি তখন অন্তু এসে তোকে হসপিটালাইজড করায় নি। আমার গাড়িতেই হসপিটাল নিয়ে গিয়েছিলাম তোকে! মাইন্ড দ্যাট!

তাথৈ দাঁতে দাঁত চেপে গেলো। ওর চোখ গেলো তুল্যর পায়ের দিকে। হাটুর নিচ অবদি থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরা অবস্থাতেই বেরিয়ে এসেছে তুল্য। কিন্তু সেদিকে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো তাথৈ। ড্রাইভিং করতে করতে কয়েকমিনিট পর কাউকে কল করলো ও। কানে গোজা ব্লুটুথে বললো,

– হ্যাঁ রুমন? ক্যাম্পাসে আছিস তুই?

রুমনের নাম শুনেই চটে গেলো তুল্য। ও বেশ জানে, তাথৈ ইচ্ছে করে ওকে রাগাচ্ছে। হুট করেই ওর খেয়াল হয়, ও বাসায় পরা থ্রি কোয়াটার পরেই চলে এসেছে। তীব্র আক্ষেপে চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো তুল্য। তাথৈ না তাকিয়েও বুঝলো, ওর পাশেরজনের চেহারায় বিপুল বিব্রতবোধ। বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে গাড়ির স্পিড বাড়ালো ও।
ভার্সিটি পৌছে গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে নামলো তাথৈ। হাতের উপরপিঠে গলার দিকটা ডলা লাগালো। বুঝলো শরীরের উত্তাপ একেবারে অগ্রাহ্য না। জ্বরটা পুরোপুরি ঠিক হয়নি ওর। জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ব্যাকসিট থেকে ব্যাগ নিলো তাথৈ। একপলক সামনে তাকিয়ে দেখে তুল্য উঁকিঝুঁকি দিয়ে কাউকে খুজছে৷ তাথৈ কাধে ব্যাগ বাঝিয়ে হাটা লাগালো। আশপাশ দেখে তুল্য বেরিয়ে আসলো। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো একটা। তখনই আওয়াজ আসলো,

– ভর দুপুরে ভরা ক্যাম্পাসে লোমশ পায়ের লোভনীয় পেশি দেখিয়ে বেরাচ্ছো তুল্যবাবু? নট ফেয়ার!

তুল্য অনড় হয়ে দাড়িয়ে থাকে। ওর নাক মুখ দিয়ে সিগারেটের ধোয়া বেরোয়। আপাতদৃষ্টিতে দেখা না গেলেও, মাথা, কান দিয়েও হয়তো অদৃশ্য ধোঁয়া বেরোচ্ছিলো ওর। রাগের। রুমন পেছন থেকে হেলতেদুলতে পাশ কাটায় তুল্যকে। তুল্যকে আপাদমস্তক দেখতে দেখতে উল্টো হয়ে হাটছিলো ও। তুল্য অস্থিরচিত্ত্বে আশপাশে তাকালো। কিছু না পেয়ে নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করলো। তারপর পার্ক করা একটা সাইকেলের চেইনে ডলা মেরে কালি লাগালো রুমালটায়৷ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– নট ফেয়ার? আজকে ফেয়ারনেস ক্রিম লাগিয়ে দেবো তোর চেহারায়! দাড়া!

রুমন বুকে হাত দিয়ে আঁতকে ওঠে। ঘুরে উঠে দেখে তাথৈ অনেকটাই দুরে চলে গেছে। ‘তাথৈ’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে ও। ওর ডাক শুনে হতাশ শ্বাস ছাড়লো তাথৈ। পেছন ফিরে দেখে, রুমন হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, আর ওর পেছনে তুল্য রুমাল হাতে তেড়ে আসছে। তাথৈকে থামতে দেখে তুল্য কিছুটা দুরেই থেমে যায়। রুমালটা ছুড়ে ফেলে অন্যদিকে চলে যায় ও। রুমন হাপাতে থাকে। তাথৈ রাগ নিয়ে ওর পান্জাবীর কলার চেপে ধরলো। বললো,

– তোকে বলেছি না তুল্যর থেকে দুরে থাকতে? হু?

– তোর না জ্বর ছিলো তাথৈ? জোর কমেনি কেনো? ছেড়ে দে প্লিজ! ছেড়ে দে! আর কোনোদিনও তোর ভাইকে কিছু বলবো না। আজকের মতো ছেড়ে দে প্লিজ!

রুমন চেচাচ্ছে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। এতে ওর শলাকার মতো শরীরটা আরো ঝাকি দিয়ে উঠছে। হঠাৎই পাশ থেকে কেউ রুমনের কলার মুঠো করা তাথৈয়ের হাত ধরে ফেলে। তাথৈ থেমে যায়৷ বিস্ময় নিয়ে সে হাতের দিকে তাকালো ও। হাতের মালিক রুমনের কলার থেকে তাথৈয়ের একটা একটা আঙুল ছাড়িয়ে নেয়। তারপর কবজি ধরে ফেলে। রুমনের ফোকলা হাসিটা দেখে মানুষটার দিকে দৃষ্টিতাক করলো তাথৈ। কিন্তু সে হাসোজ্জল চেহারাটা দেখতেই গায়ে আগুন ধরে গেলো ওর। ওর হাত ধরা মানুষটা অন্য কেউ ছিলো না। সে স্বয়ং তাশদীদ। পরনে অফ হোয়াইট শার্ট। বড়হাতা গুটানো। বিভাগের বাস্কেটবল টুর্নামেন্ট দেখবে বলে মাঠের দিকে এগোচ্ছিলো তাশদীদ। যাওয়ার পথে রুমন-তাথৈকে দেখে থেমে যায়। তাথৈকে আপাদমস্তক দেখে নিলো ও। কালো জিন্স, সাদা কুর্তা পরিহিত রমনীর শরীরে জ্বরের উষ্ণতা, চেহারায় বিধ্বস্ততা। তবুও রাগের কোনো কমতি নেই। তাশদীদ ঘাড় কিছুটা বাকিয়ে কপাল কুচকালো। আগ্রহীস্বরে শুধালো,

– এতো রাগ কেনো?

– নান অফ ইওর বিজনেস!

তাথৈয়ের শক্তকন্ঠের জবাব শুনে ওর হাত ছেড়ে দিলো তাশদীদ। হাত ছাড়া পেতেই তাথৈ ঠাস করে চড় লাগালো রুমনের মাথায়। তাশদীদ স্তব্ধ। একমুহুর্তের জন্য ওর মনে হয়েছে, মারটা যেনো ওর গায়েই লেগেছে। একনজর তাশদীদকে দেখে নিয়ে তাথৈ দ্রুতপদে চলে গেলো ওখান থেকে। তাশদীদ রুমনের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। তাথৈয়ের চলে যাওয়ার দিক চেয়ে অজান্তেই বলে উঠলো,

– আমার তো বিজনেস না। কিন্তু যার বিজনেস হবে, তার কি হবে?

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১০.

বাস্কেটবল কোর্টে দুদলের খেলা চলছে। প্রাণরসায়নের প্রথম বর্ষ বনাম দ্বিতীয় বর্ষ। তাশদীদ শান্ত আর টিটুর সাথে কোর্টের বাইরের বসার সিড়িতে বসে। দর্শকসংখ্যা খুব কম না। ক্লাসব্রেকে অন্যান্য বিভাগ থেকে ছেলেমেয়েরাও এসেছে খেলা দেখতে। তবে বসার জন্য চারধাপের সিড়িটাতে জায়গা হয়নি সবার। দাড়িয়েই প্রচন্ড উত্তেজনা নিয়ে খেলা দেখছে সবাই। সবার মতো উত্তেজিত না হলেও তাশদীদ বেশ আগ্রহে খেলা দেখছে। এখনো অবদি প্রথমবর্ষ সাতবার, দ্বিতীয়বর্ষ পনেরোবার বল বাস্কেট করেছে। আর সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় যেটা, দ্বিতীয়বর্ষের এক ছেলে একাই এগারোটা বাস্কেট করেছে। সবার মাঝে তার খেলার ধরন নজরে পরার মতোই। আর সেটা তুল্য! খেলা শুরুর পর থেকেই এ নামটা তাশদীদের কানে আসছিলো। আর চোখে পরছিলো তুল্যর আক্রমনাত্মক খেলা। যদিও তুল্য কাউকে কোনোরুপ আঘাত করে খেলছে না, তবুও ওর খেলার ধরনটা একটু বেশিই গুরুতর লেগেছে তাশদীদের। টিটুর হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে পানি খেলো তাশদীদ। তারপর বোতল ফেরত দিয়ে বললো,

– ছেলেটা এমনিতেই অনেক ভালো খেলছে। কিন্তু এমন এগ্রেসিভনেস কেনো?

– ওটা তুল্য আলফেজ। আলফেজ গ্রুপের ওনার তৈয়ব আলফেজের ছেলে, তাথৈ আলফেজের ভাই। এগ্রেসিভনেসের পরিবর্তে ওর কাছ থেকে আর কি এক্সপেক্ট করিস তুই?

জবাব দিয়ে মাথা নাড়ালো শান্ত। তাশদীদ কিছুটা ভ্রুকুটি করে তাকালো ওর দিকে। পরপরই তাথৈয়ের কথা ভেবে মনেমনে তুল্যর এমন রুপের কারন স্বীকার করলো। নিশব্দে হেসে মাথা নাড়লো ডানেবামে। টিটু মুখে বাদাম ছুড়ে মেরে বললো,

– সেকেন্ড ইয়ারের টিম থেকে তুল্য এখনো অবদি হাইয়েস্ট বাস্কেট করেছে। গতবছর কাপটা ওরাই নিয়েছে৷ পাঁচ পাঁচটা সিনিয়র ব্যাচকে হারিয়ে ফার্স্ট ইয়ার কাপ নিয়েছে। ভাবতে পারছিস?

– বাস্কেটবলের মতো এ ছেলের সিজিও ফার্স্টক্লাস। দুই জমজ ভাইবোন মিলে বায়োকেমে ভালো সিজির ঘাটি গেরেছে একদম।

শান্তর কথায় এবারো তাশদীদ জবাব দিলোনা। হাত ঘড়িটা সোজা করায় মনোযোগী হলো। অকারনেই ছোট্ট একটা হাসি ফুটলো ওর ঠোঁটে। টিটুর চোখে পরলো সেটা। ও ডান ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

– ভালো সিজি ওই টুইন ভাইবোনদের। তুই কেনো খুশি হচ্ছিস তাশদীদ?

– হুম? কই? আমি কেনো খুশি হতে যাবো?

– এইযে মিটমিটিয়ে হাসছিস! আমি দেখেছি, তাথৈয়ের নাম শুনলেই তোর এমন হাসি পায়। তুই সেদিনও ওর সাথে এমন মুচকি হেসে হেসে কথা বলেছিস! কেসটা কি গুরু? তাথৈ আলফেজের সাথে এতো ভাব কেনো তোমার? হু?

দুষ্টুমিমিশ্রিত গলায় বললো টিটু। তাশদীদ একপলক ওর দিকে তাকিয়ে উঠে দাড়ালো। একপা সামনের সিড়িতে রেখে, ঝুকে দাঁড়িয়ে, ফিসফিসিয়ে বললো,

– কারন ও তোর সাইকেল ভেঙেছিলো। আর তোর লোকসানে আমার হাসি আসে।

– শা’লা…

টিটু হাত বাড়াচ্ছিলো। শান্ত ওকে থামিয়ে গুরুত্ব দিয়ে বললো,

– থাম তোরা। আর তাশদীদ? তুই শোন! কাল টুর্নামেন্ট আছে। কোয়ার্টার। ঠিকঠাক প্রিপারেশন নিয়ে আসিস।

– কেনো? আমাকে কেনো টানছিস?

– তোকেও খেলতে হবে। গত তিনবছরে একটাও কাপ ওঠেনি আমাদের ব্যাচের ঘাড়ে। এখন তুই যখন আমাদের সাথে, এবারের বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশিপ চাই আমাদের! ব্যস! রিস্ক নিতে চাইছি না। টিমসিলেকশন আমি দেখে নেবো।

শান্তর রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে। ও পারবে দল ম্যানেজ করা। তাশদীদ আরেকপলক তুল্যর দিকে তাকালো। ঘেমে একাকার, অস্থিরভাবে হাপাতে থাকা ছেলেটার চেহারা তাথৈয়ের সাথে খুবএকটা মেলে না। তবে তেজের দিক দিয়ে সে আসলেও তাথৈয়ের জমজ। খেলার ধরনে বোঝাই যায়, জেতার জেদ করেই মাঠে নামে ও। তাশদীদ মুচকি হেসে হাতের বইটা আঙুলে ঘুরালো। কি ভেবে বললো,

– ওকে। খেলবো আমি।

শান্ত মাথা নাড়লো। ওরা দুজন খেলা দেখছিলো। কিন্তু তাশদীদ চলে আসলো। যোহরের আযান পরেছে। শার্টের হাতা তুলতে তুলতে ওযুখানার দিকে এগোলো ও। কিছুটা দুরে বুকে বই গুজে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিলো রুমন। সকালবেলা এই ছেলেটা ওকে যতোটুকো সহমর্মিতা দেখিয়েছে, ওইটুকো যথেষ্ট তাশদীদের পিছু নেওয়ার জন্য। শার্লি কোত্থেকে এসে ওর সামনে দাড়ালো। উবু হয়ে নিজের জুতার ফিতা বাধতে বাধতে বললো,

– তাথৈ কই রে?

– সেমিনারে।

একশব্দে জবাব দিয়ে দেয়ালে হেলান দিলো রুমন। শার্লি সোজা হয়ে দাড়িয়ে সময় নিলোনা। রুমনের পান্জাবীর পেছনের কলারটা ধরে হাটা লাগালো ও। বললো,

– ছেলে পরে দেখিস। আগে তাথৈয়ের কাছে চল। ওকে সেমিনার থেকে বেরোতে দেওয়া যাবে না৷ সোহা ক্যাম্পাসে এসেছে।

কয়েকপা অনিচ্ছাকৃত হাটলেও অন্তুর বউয়ের নাম শুনে রুমন ঠিকঠাক হলো। ওদের সাথে সোহার জানাশোনা ছিলো না। তবে সোহা তাথৈয়ের পরিচিত। একসময় প্রতিবেশি ছিলো ওরা। পরে চাকরির জন্য শিফট হতে হয়েছিলো সোহাদের। ওকে ক্যাম্পাসে দেখলে তাথৈয়ের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে ধারনায় আসলো না রুমন-শার্লির। দ্রুতপদে সেমিনার গেলো দুজনে। হন্তদন্ত হয়ে খুজলো তাথৈকে। কিন্তু ও নেই সেমিনারে। শার্লি চিন্তায় নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। ঠিক সেসময়েই বাইরে থেকে জোরালো আওয়াজ আসে,

– হাউ ডেয়ার ইউ টু ডু দ্যাট তাথৈ?

বিস্ফোরিত চোখে একপলক দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে বাইরে ছুটলো রুমন-শার্লি। বারান্দার দক্ষিণের মোড়টায় এসে পা থামে ওদের। ঠিক সামনের রাস্তায় তীব্র রোদের মাঝেই সোহা-তাথৈ মুখোমুখি দাড়ানো। তাথৈয়ের চোখ লালচে হয়ে আছে। কারুকাজকরা লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিত সোহা হাতের আঁচল ঝারা মারলো। রাস্তার পাশের ঘাসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে, আবারো তাথৈয়ের দিকে এগিয়ে এসে বললো,

– এটা তুই কি করলি? রিংটা ফেলে দিলি?

– আওয়াজ নিচে!

তাথৈ দাঁতে দাঁত চেপে বললো। সোহা ছোটবেলা থেকেই অর্থবিত্ত আর রেজাল্টের জন্য হিংসা করতো ওকে। এতোগুলো বছর পরও সে স্বভাব ভোলেনি। এই মেয়ে ক্যাম্পাসে এসেছে শুধুমাত্র অন্তু আর ওর বৈবাহিক জীবন নিয়ে ওকে শোনাবে বলে। সেমিনার থেকে ডেকে এনে তাথৈকে অন্তুর কেয়ারিং, ভালোবাসা নিয়ে শোনাচ্ছে সোহা। এক পর্যায়ে বাসরঘরে অন্তুর দেওয়া আংটিটাও খুলে তাথৈয়ের সামনে ধরে ও। দামদর শুনিয়ে, অন্তু ওকে আংটিটা কিভাবে পরিয়েছে, সোহা সেটাও বলতে উদ্যত হয়েছিলো। কিন্তু ওকে বলার সুযোগ দেয়নি তাথৈ। অকস্মাৎ আংটিটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলার ভঙিমা দেখিয়েছে। ব্যস! এতেই প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে সোহা। ওর উচু আওয়াজ শুনে তাথৈ একপা এগোলো। বললো,

– সেই ক্লাস সিক্সে থাকতে আঙ্কেলের শিফটিং হলো। অনেকদিন মেলামেশা করিসনি আমার সাথে। এখন আমার সাহস নিয়ে তোর মনে প্রশ্ন জাগবে, এটাই স্বাভাবিক। যাইহোক। এসব অন্তুকে জিজ্ঞেস করে নিস। ও আমার সম্পর্কে ভালোভাবেই জানে। এই যে তুই আমাকে তোদের সাংসারিক জীবনবৃত্তান্ত শোনাতে ক্যাম্পাসে আসলি, জানলে অন্তুই তোকে আসতেই দিতো না। কারন ও এটাও জানে, তাথৈ আলফেজ কতোটা বিশ্রিভাবে অপমান করতে জানে।

সোহা ঢোক গিলে আঁচল হাতে প্যাচালো। ভয় পেলেও প্রকাশ করলো না। সাংসারিক জীবনে বেশ আছে ও। তাথৈকে ছেড়ে অন্তু ওকে বিয়ে করেছো, এ নিয়ে ওর গর্ব। কিন্তু যতোটা ভাব দেখাতে ও এসেছিলো, তাথৈয়ের ধমকিতে পুরোটাই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলো। তাথৈ ওর মুঠোতে আংটিটা পুরে দিলো। শান্ত শীতল স্বরে বললো,

– শুধুমাত্র অন্তুর কথা ভেবে আজকে ছাড় দিলাম। সসম্মানে বাচতে চাইলে, আমার থেকে দুরে থাক সোহা। কারন আমার নামটা পানির বিশেষণ হলেও, আমি মানুষটা আগুনের বিশেষণ। একদম সুবিধের না।

শেষের কথাটা মাথা দুলিয়ে বললো তাথৈ। বলাশেষে সোহাকে পাশ কাটালো ও। সোহা শক্ত হয়ে দাড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলো শুধু। এই মেয়ের তেজ খন্ডন করা সহজ কথা না। কয়েকপা এগিয়ে রুমন শার্লিকে দেখে গতি কমে তাথৈয়ের। রুমন দাঁত কেলিয়ে বললো,

– ভিম ছাড়াই মুখে ঝামা ঘসে দিতে জানা সখী, আই জাস্ট লাভ ইউ!

তাথৈ ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বললো,

– তোরা এখানে কেনো?

– তুই তো অসুস্থ, তাই…

শার্লি হেসে ওর হাত ধরতে যাচ্ছিলো। রুমন ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,

– খবরদার আমার বান্ধবীকে ছুবি না। তোর ড্রেসআপের মতো তোর ছোঁয়াও মনেহয় ঠিকঠাক না। আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে!

– আমার ড্রেসআপ নিয়ে কথা বলছিস, তোর ড্রেসআপ মনেহয় অনেক ঠিকঠাক? শা’লা…

শার্লি কাধের ব্যাগ খুলে ওইটা দিয়েই রুমনকে মারতে শুরু করলো। রুমন মার ঠেকাতে ব্যস্ত, আর শার্লি মার দিতে। তাথৈ হাটা লাগালো। ওর গলা শুকিয়ে আসছে। জ্বর পুরোপুরিভাবে নামেনি। এতোক্ষণ রোদে দাড়ানোর জন্য দেহের উত্তাপটাও বাড়ছে। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে কয়েকঢোক পানি খেলো তাথৈ। টের পেলো তারপরও ওর শরীর টলছে। দাড়াতেই পারছে না। উপায়ন্তর না দেখে, পুরো বোতলের পানি মাথায় ঢেলে নিলো তাথৈ। আধভেজা হয়ে যায় ওর চুল, চেহারা, জামার গলার দিকটার কিছু অংশ। চুল আঙুলে নেড়ে, ও পা বাড়ালো গাড়ির দিকে।
কিছু না শুনলেও, দোতালার ক্লাসে বসে পুরোটাই দেখলো তাশদীদ৷ রাগান্বিত রমণী তার ঘাড়ের আধভেজা চুল আঙুলে উল্টাচ্ছে। না চাইতেও ক্লাস বাদ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলো ও। তাথৈ-সোহার একসাথে দাড়িয়ে থাকাও দেখেছে ও। ও যে সোহাকে কোনো বিষয়ে ঠান্ডা গলায় হুমকি দিয়েছে, তা সোহার চেহারায় স্পষ্ট। এরপর নিজের মাথায় পানিও ঢেলে নিয়েছে তাথৈ। সেটাও দেখেছে তাশদীদ। ও হলফ করলো, নিসন্দেহে তা রাগ কমানোর জন্যই হবে! হাফঁ ছাড়ার মতো করে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ালো তাশদীদ। মাথা নাড়িয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,

– টু স্পাইসি!

– মিষ্টি খাবেন তাশদীদ ভাই? টাঙ্গাইল স্পেশাল৷ আব্বু আপুর জন্য এনেছে।

খাতা থেকে চোখ তুললো তাশদীদ। কিন্তু টেবিলের ও প্রান্তে বসা রিংকির হাসিটা দেখেই বিরক্তি ছেয়ে গেলো ওর চেহারায়। তাশদীদ একটা বড় নিশ্বাস নিলো। আজকে ক্লাস নেই ওর। তবে বাস্কেটবলের সেমি ফাইনালের টুর্নামেন্ট আছে। এজন্যই ভার্সিটির বাসে যায়নি ও। যেহেতু সকালে সময় আছে, তাই সকালেই রিংকিকে পড়াতে চলে এসেছে তাশদীদ। বিকেলবেলা অন্যকাজে বেরোতে হবে ওকে। খাতাটা ঠেলে রিংকিকে এগিয়ে দিয়ে, বুকে হাত গুজলো ও। বললো,

– আমি এ বাসায় মিষ্টি খেতে আসিনা রিংকি। ইউ নো দ্যাট। আর এখানে প্রশ্নে প্রাসের গতিপথ চেয়েছে। তুমি থিটার পরিবর্তে ভ্যেলোসিটি কেনো বের করেছো?

রিংকি মুচকি হেসে, খাতা দুহাতে টেনে সামনে নিলো। ওর অদ্ভুত হাসিটা আরোবেশি অসহ্যকর লাগছে তাশদীদের। ম্যাথ ভুল করেছে, এটা শুনেও হাসি কেনো কমছে না এ মেয়ের? রিংকি দিবার ক্যালকুলেটর টিপে, খাতায় লিখতে লিখতে বললো,

– প্রাসের গতিপথ প্যারাবোলা। ও যদি কোনোভাবে রিভার্সেবল হতো, তাহলে ওর গতিপথ কেমন হতো তাশদীদ ভাই?

– কোথাও দেখেছো বল ছুড়ে মারলে, ওইটা মাটিতে পরে, মাটি খুড়ে আবারো তোমার পায়ের নিচে ব্যাক করে?

– হয়না। এজন্যই বললাম। যদি হতো, তখন? গতিপথটা কেমন হতো? কিছুটা লাভ শেইপ না?তাহলে ইকুয়েশনটার নাম কি হতো তখন তাশদীদ ভাই? লাভ ইকুয়েশন?

চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামাল দিলো তাশদীদ। পরপরই চোখ খুলে বললো,

– না। ওটাকে…

ওকে শেষ করতে না দিয়ে খাতা ঠেলে দিলো রিংকি। তাশদীদ খাতায় তাকালো। ম্যাথ শেষ রিংকির। তাশদীদ খাতায় ভুল খুজতে লাগলো। রিংকি গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। হালকা মেরুন শার্ট পরিহিত, সুঠামদেহী পুরুষের চুল আজকে বেশিই নড়চড় করছে। যেনো হেলেদুলে বলছে, মহাশয় প্রতিদিনের মতো সকালে গোসল সেড়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে৷ সপ্তাহে চারদিন ভার্সিটির ক্লাসশেষে পড়াতে আসা এই মানুষটার ক্লান্ত চেহারাই ওর চোখ আটকে রাখে। সেখানে আজকের এই সতেজ মুখটা…রিংকি কল্পনায় তাশদীদের অতিসন্নিকটে পৌছে যায়৷ ফু দেয় ওর চোখেমুখে। লজ্জায় কুকড়ে যায় রিংকি। অকস্মাৎ ওকে ওমন দেখে তাশদীদ নিজেই হচকিয়ে যায়। ঠিক সেসময়েই দরজায় নক পরে। তাশদীদ চোখ ফিরিয়ে দেখে রিংকির মা হাতে একটা ট্রে নিয়ে দাড়ানো। পাশে রোজিও আছে। তারা দুজনেই ঘরে ঢুকলো। রিংকির মা টেবিলে মিষ্টি, আপেল আর কেক সাজাতে লাগলো। তাশদীদ এরমাঝে কয়েকটা পড়া দাগিয়ে দিলো রিংকিকে। পরিবেশন শেষে মিসেস সৈয়দ সবে কিছু বলতে যাবেন, উঠে দাড়ালো ও। হাতঘড়িটা টাইট দিতে দিতে হাসিমুখে বললো,

– আন্টি আসি আমি।

– ওমা! আসি কি তাশদীদ? কিছু মুখে দাও? তোমার আঙ্কেল কাল টাঙ্গাইল গিয়ে…

তাশদীদ ভদ্রমহিলাকে বলার সুযোগ দিলো না। ও জানে, ও কিছু না খেলেই তিল তাল হয়ে যাবে। হট্টগোল পরে যাবে দুই বাড়িতে। কাটাচামচে মিষ্টির একপাশ থেকে একটুখানি কাটলো ও। অল্পটুকু মুখে তুলে চামচটা রেখে দিলো পিরিচেই। টিস্যুতে মুখ মুছতে মুছতে বললো,

– আমাকে ক্যাম্পাসে যেতে হবে আন্টি। ভার্সিটির বাসে যাইনি, এখন লোকালে যাবো। বুঝতেই পারছো, সময় লাগবে। আসি হুম?

বলাশেষে তাশদীদ দ্রুততার সাথে বেরিয়ে যায়। ‘সোনার ছেলে’ বলে দরজায় তাকিয়ে থাকে মিসেস সৈয়দ। রোজি মায়ের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললো, ‘তোমার সোনার ছেলে তোমাদের এমন আদিক্ষেতার ওপর বিরক্ত হচ্ছে মা। আই উইশ কেউ এটা তোমাদের বুঝাতো।’
ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বোনের দিকে তাকালো রোজি। রিংকি তাশদীদের রেখে যাওয়া কাটাচামচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে আর ঘাড় বাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসছে। একটুপর চামচটা মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে নেয় ও৷ বোনের কর্মকান্ডে রাগ হয় রোজির। বরাবরের মতো মুখে কিছু না বলে, মনেমনেই বলে,

– তুই তাশদীদের সাথে মানানসই নস রিংকি। আই উইশ, কেউ এটা তোকে শিক্ষা দিতো!

#চলবে…