কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব-১০+১১

0
290

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১০
জাওয়াদ জামী

আজ শুক্রবার। আরমান বাড়িতেই আছে।

শহিদ আহমেদের ছোট ছেলে শুভ আজ বাড়িতে এসেছে। আরমানের বিয়ের পনেরদিন আগে সে ইউরোপে ট্যুরে গিয়েছিল। আরমানের বিয়ের আজ দশদিন পূর্ণ হয়েছে। দীর্ঘ পঁচিশ দিন পর শুভ বাড়ি ফিরেছে।
আকলিমা খানম ছেলেকে দেখে ভিষণ খুশি হয়েছে। ছেলেকে সে কাছ ছাড়া করছেনা।
এদিকে শুভ ড্রয়িংরুমে কান্তাকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে মায়ের দিকে তাকায়।

” মম, এই মেয়েটা কে? একে নতুন দেখছি বলে মনে হচ্ছে? নতুন মেইড রেখেছ? ”

” ও আরমানের বউ। ” এক কথায় জবাব দেয় আকলিমা খানম।

” ওহ। আমি ভেবেছিলাম নতুন মেইড রেখেছ বোধহয়। চেহারা দেখেতো মেইডের মতই মনে হচ্ছে। অবশ্য যার যেমন রুচি। সে তেমনই পছন্দ করবে। ” তাচ্ছিল্যের সাথে বলে শুভ।

ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল কান্তা। সেই সাথে রা’গে ওর মাথা গ’র’ম হয়ে গেছে।

” এসব কি বলছ, ভাইয়া! যাদের সম্পর্কে তুমি এসব বলছ, তারা তোমার ভাই-ভাবী। আর ভাবী নিজের সংসারে কাজ করছে। তাই বলে সে মেইড হয়ে গেল! তাছাড়া বড় ভাইয়ার রুচি কেমন, সেটা তুমিও জান আমরাও জানি। ” শ্রীজা শুভর কথার প্রতিবাদ করে বলে।

” এতদিন জানতাম তুই তোর বড় ভাইয়ের চা’ম’চা। এখন আবার নতুনভাবে তার বউয়েরও চা’ম’চা’মি’র চাকরি নিয়েছিস নাকি! দিনদিন তোর ভালোই উন্নতি হচ্ছে দেখছি! ” শুভ ব্যাঙ্গ করে বলে।

” শ্রীজাপু, যা করেছে তাকে চা’ম’চা’মি বলেনা, তাকে বলে শ্রদ্ধা করা। যা তোমার মোটা মাথায় ঢোকেনি, বুঝলে দেওরা? আমি দেখতে মেইডের মত তা মেনে নিলাম। আমি তোমার মত আলট্রা মর্ডান নই, পোশাকআশাকেও এতটা ঝাক্কাস নই। তাই আমি তোমার চোখে মেইডের মত। তোমার চেহারা তো দেখছি মাশাআল্লাহ। কিন্তু এতটা ফিটফাট, ঠাটবাটে থাকার পরেও তোমাকে আমার টো’কা’ই বলে মনে হচ্ছে। এক্কেবারে ইন্টারন্যাশনাল টো’কা’ই। অবশ্য চেহারা যা ঠিক আছে। কিন্তু ব্যবহার আর পোশাকআশাকে উ’ল্লু’ক বললেও ভুল হবেনা। একটা কথা মাথায় ভালোভাবে ঢুকিয়ে নাও, সম্পর্কে আমি তোমার বড় ভাবী। সে দেখতে যতই মেইডের মত হইনা কেন। আমাকে ভাবী বলেই ডাকবে। আর বড় ভাইকেও তার প্রাপ্য সম্মান দিবে। বুঝলে দেওরা? ”

কান্তার কথা শুনে আকলিমা খানম ও শুভ স্তব্ধ হয়ে গেছে।

” মম, এই মেয়েটা কি বলছে এসব! ও আমাকে টো’কা’ই বলছে!
ইউ ব্লা’ডি বি’চ তোমার সাহস তো কম নয়। তুমি আমাকে অপমান করছ? যতসব লো ক্লাসের মেয়ে। অল্প পানির মাছ বেশি পানিতে পরলে এভাবেই রূপ বদলায়। ”

” এইযে, ইংরেজ ব’ল’দ, মুখ সামলে কথা বল।

ঐরকম দুই,চার,দশটা ইংরেজি আমিও জানি। তুমি ক্লাস সম্পর্কে কি জানো? খালি বাপের বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক, ব্যালেন্স থাকলেই সে আপার ক্লাস হয়ে যায়! ক্লাস মেনইটেইন হয় যোগ্যতায়। যেটা তোমার নেই। তুমিতো বাপের সম্পদের ফু’টা’নি মেরে বেড়াও। ক্লাসের তুমি বুঝবে কি! আর ঐ ব্লা’ডি বি’চে’র হিসেবটা তোলা রইল। প্রথমদিনেই বেশি কিছু বলতে চাইনা। এতে ওভার ডোজ হতে পারে। ”

” এই মেয়ে, তুমি চুপ করবে? আমার ছেলেটা কতদিন পর বাসায় এসেছে। কিন্তু তুমি তাকে যাচ্ছেতাই বলছ? কিসের এত বড়াই তোমার? শুভ তো সত্যিই বলেছে। তুমি তো লো ক্লাসের মেয়েই। আজ দশদিন হচ্ছে বিয়ের, অথচ এতদিনেও বাপের বাড়ি থেকে কেউ এসেছে? নাকি আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করেছে? নাকি আরমানকে জামাই আদর করেছে? বিয়ের একদিন পর যেখানে জামাইকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যেতে হয়, সেখানে আজ দশদিন হচ্ছে। কিন্তু তোমার বাড়ির মানুষদের কোন খবর নেই। বিয়েতে কি দিয়েছে তোমাকে বাপের বাড়ি থেকে? আরমানকে কি দিয়েছে? একটা সুতাও তো আননি। যেই মেয়ের বাপের বাড়িতে কোন মূল্য নেই সে আবার বড়বড় কথা বলে! যে বাড়ি থেকে আমাদের কোন সম্মান করেনি, সেই বাড়ির মেয়ে হয়ে তুমি গলাবাজি করছ? ” আকলিমা খানম মনের যত রাগ সব উগরে দেয়।

কান্তা এবার যেন মিইয়ে যায়। ওর শ্বাশুড়ির কথায় কোন মিথ্যা নেই সেটা ও ভালো করেই জানে। এসব তিক্ত কথার কি জবাব দেবে ও?

” আমাকে নিয়ে আজকাল খুব বেশি চিন্তা করছেন বলে মনে হচ্ছে! তাহলে বলি, এত চিন্তা করার কিছুই নেই। আমি বিয়ে করে বউ এনেছি। শ্বশুর বাড়ি কিংবা তাদের থেকে কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই আমার। আমার বউ বিয়ের পর বাপের বাড়ি যাবে কিনা সেটা আমি বুঝব। আর আমি চাইনা আমার বউ বাপের বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ রাখুক। আর একজন বিবাহিতা মেয়ের ক্লাস বিবেচিত হয় তার স্বামীর স্ট্যাটাস দেখে। আর আমার স্ট্যাটাস নিশ্চয়ই লো লেবেলের নয়। ভবিষ্যতে ওকে কিছু বলতে চাইলে দশবার ভেবে তারপর বলবেন। আজ এখানে বাড়ির সবাই উপস্থিত আছেন। সবাই কান খুলে শুনে রাখুন, কান্তা ওর বাবার বাড়িতে আর যাবেনা। এ নিয়ে ভবিষ্যতে তাকে কেউ কিছু বললে আমি মেনে নিবনা।
আসলে কি জানেন, আমি আপনার হাসবেন্ডের মতই বউ ছাড়া থাকতে পারিনা।
আর শুভ তোকে বলছি, কান্তাকে সম্মান করতে না চাইলে করবিনা। কিন্তু তার কোন অসম্মান আমি মানবনা। ও এ বাড়িতে আমার অধিকারে চলবে। তোর মা অথবা দাদিমার এ বাড়িতে যেমন অধিকার আছে, ঠিক সমঅধিকার কান্তারও এ বাড়িতে আছে। তাই সময়ে অসময়ে এমন কোন ইংরেজি বুলি আউড়াসনা যেটা শুনলে আমার মাথার তার ছিঁ’ড়ে যাবে।
ইজ ইট ক্লিয়ার? ” আরমান একবার শুভর দিকে আরেকবার আকলিমা খানমের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে।

কান্তা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আরমানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটা ওকে কিভাবে অপমানের হাত থেকে বাঁচাল!

শহিদ আহমেদ ওপর থেকে সব কিছু দেখছিলেন। শুভর কথাবার্তা তার কাছে ভালো লাগেনি।
আবার আরমানের ওপরও একটু বিরক্ত হন। ছোট ভাইয়ের সাথে এত কঠোর হওয়ার দরকার কি ছিল!

আরমানের কথা শুনে রাজিয়া খানম চুপসে গেছে। সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে, এই মেয়েটাকে কিছু বলে পার পাওয়া যাবেনা।

কান্তা রুমে বসে আছে। ওর এই মুহুর্তে পড়তে মোটেও ইচ্ছে করছেনা। এদিকে আরমানও বাসায় নেই। সে কখন আসবে কে জানে। একা একা ওর সময় কাটছেনা।
শ্রীজাপুও কোন বান্ধবীর বাসায় গেছে। তারও নাকি ফিরতে রাত হবে।
বসে বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল আর নানান কথা ভাবছে।

” বাসায় কোন খাবার নেই? ”

আরমানের গলা শুনে ভয় পায় কান্তা৷ ওর ভাবনার মাঝেই কখন যে সে রুমে এসেছে তা বুঝতে পারেনি বেচারি৷
ভয়ে কান্তার বুক ধুকপুক করছে। একটু থিতু হয়ে মুখ খোলে।

” আপনার ক্ষুধা লেগেছে? রাতের জন্য খাবার রান্না করেছি অনেকক্ষণ আগেই। আপনার জন্য নিয়ে আসব? ”

” আমি তোমার কথা বলছিলাম। ”

এবার ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকে কান্তা। আরমানের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছেনা।

” আমি আবার কি করলাম! “বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল কান্তা।

” যেভাবে দাঁত দিয়ে নখ কা’ট’ছি’লে, আমি ভাবলাম ক্ষুধা লেগেছে তাই এমন করছ। ”

এবার বিষয়টা বোধগম্য হয়।

” একটা কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে এমনটা করেছি বুঝতেই পারিনি। ” ম্লানমুখে বলে কান্তা।

” কিসের এত চিন্তা তোমার? ”

” এই যে আপনি আমাকে বারবার অপমানিত হওয়ার থেকে বাঁচাচ্ছেন। সত্যিইতো আমার বাড়ি থেকে কেউ আপনার যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি। কেউ একটাবার খোঁজ নেয়নি। তবুও আপনি আমাকে এ নিয়ে কিছু বলেননি। আবার এ বাড়িতে কেউ কিছু বললে আপনি তার প্রতিবাদ করছেন! ”

” এই মেয়ে, তোমার পড়াশোনা নেই? ইচ্ছে নেই জীবনে বড় কিছু হওয়ার? নাকি সত্যি সত্যিই মেইড হয়ে থাকতে চাও? তোমাকে যতটা অবলা ভেবেছিলাম ততটাও অবলা তুমি নও! শুভ বাসায় আসতে না আসতেই ওর চেহারা যে মাশাআল্লাহ তা বুঝে গেছ! দুই দুইবার তাকে চেহারার কথা বললে! এসব কুচিন্তা মনে ঢুকলে পড়াশোনায় মন বসবে কেমন করে। ”

” বলছি যে, একটা উট দিয়ে আমার আরেকবার আকিকা দেন। আর কান্তা নামটা পরিবর্তন করে ‘ এই মেয়ে ‘ রাখুন। আমি এই বাসায় আসার পর থেকে সবাই কারনে অকারণে এই মেয়ে, এই মেয়ে বলে ডেকে উঠে। যেন এটাই আমার জাতীয় নাম। কয়দিন পর দেখা যাবে বাবার দেয়া নামটাও ভুলে গেছি। কিন্তু এমনি এমনি নাম ভুলতে রাজি নই আমি। ”

” কিন্তু তাই বলে উট! গরু বা খাসি নয় কেন? ” আরমান বেশ মজা পাচ্ছে।

” বা রে। রাখবেন আনকমন নাম। আর তার বদলে উট দিবেননা! সারা দুনিয়া ঘুরলেও এই আনকমন নাম খুঁজে পাবেননা। তাই উটের কথা বলেছি। এখন দেশেও নাকি উট পাওয়া যায়। আমিতো আর ডায়নোসরের কথা বলিনি যে পাবেননা। ”

” তুমি যাবে এখান থেকে? যাও পড়তে বস। খালি ফাঁকি দেয়ার চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করে? ” আরমানের রা’গী গলার স্বরে কান্তার পিলে চমকে যায়। তাই ও আর কথা না বাড়িয়ে দৌড়ে বারান্দায় আসে।

কান্তার আজ সত্যিই পড়ায় মন বসছেনা। কিন্তু আরমান তা বুঝলে তো।
সে জোর করে কান্তাকে পড়াচ্ছে। ফাঁকি দেয়ার কোন রাস্তাই নেই কান্তার সামনে।

রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে আরমান। কিছুতেই ঘুম আসছেনা। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে।
কান্তাও বুঝতে পারে আরমানের কিছু একটা হয়েছে। ও উঠে বসে। উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায়।

” কি হয়েছে? এমন ছটফট করছেন কেন? ”

” কিছুনা। তুমি ঘুমাও। ”

” কিছুতো একটা অবশ্যই হয়েছে। প্লিজ বলুননা। আপনার কষ্ট হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি। ” অনুনয় করে কান্তা।

” মাথাটা ভিষন ব্যথা করছে। ”

আরমানকে আর কিছুই বলতে হয়না। কান্তা বিছানা থেকে নেমে ওর তেলের কৌটা এনে আরমানের মাথায় তেল দিয়ে ম্যাসাজ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর উঠে রান্নাঘরে যায়। নিয়ে আসে মসলা চা। আরমানকে জোর করে বসিয়ে দিয়ে চায়ের কাপ তার হাতে ধরিয়ে দেয়।

প্রায় অর্ধেক রাত পর্যন্ত কান্তা আরমানের মাথা ম্যাসাজ করে। এরইমধ্যে আরমান ঘুমিয়ে গেছে।
তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কান্তা।
আজ দশদিন যাবৎ তার সাথে এক খাটে ঘুমায়। অথচ মানুষটা ওকে একটাবারের জন্যও ছুঁয়ে দেখেনি। কিন্তু ওর যথেষ্ট খেয়াল রাখছে ,আগলে রাখছে।

” আচ্ছা, ঐ উ’ল্লু’কে’র চেহারা দেখে মাশাআল্লাহ বলায় ইনি এত ক্ষেপলেন কেন? তবে কি মহাশয় জেলাস ফিল করছেন! কিন্তু প্রথমদিনই তো বলেছিলেন ভালো রেজাল্ট না করলে, পাব্লিক ভার্সিটিতে চান্স না পেলে আমাকে ভালোবাসবেনা? উহু, কান্তারে তুই ভুল ভাবছিস। মহাশয় তোকে ভালোবাসে কিন্তু ধরা দিচ্ছেনা। ভালো না বাসলে কেউ কি এভাবে আগলে রাখে? ” কান্তা নিজের সাথে কথা বলছে।

হঠাৎ আরমান পাশ ফিরে শুতেই কান্তার খেয়াল হয়, ও এতক্ষণ আরমানের হাত জড়িয়ে রেখেছিল। আরমান নড়ে উঠতেই ও হাত ছেড়ে দেয়।

চলবে…

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১১
জাওয়াদ জামী

” শ্রীজাপু, আসব? ” শ্রীজার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে কান্তা।

” ভাবী, আমার রুমে আসতে তোমার পারমিশন লাগবে! তোমার যখন খুশি তুমি আসবে। তারাতারি ভেতরে এস। ” শ্রীজা দৌড়ে দরজার কাছে যেয়ে কান্তার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসে।

” একা একা ভাল্লাগছিলনা। তাই তোমার কাছে আসলাম। তুমি কি পড়ছিলে আপু? আমি বুঝি তোমাকে বিরক্ত করলাম! ” কান্তার মন খারাপ হয়ে গেছে।

” তুমি এখন এসেছ বেশ করেছ। সব সময় পড়তে কি ভালো লাগে? আমিও বই নিয়ে বসে বসে বোর হচ্ছিলাম। এখন দু’জন মিলে জম্পেশ আড্ডা দিব। আচ্ছা, আমার নিরামিষ ভাইয়া এখনও আসেনি? আমি একটুআধটু ফাঁকি দিলেও অসুবিধা নেই। কিন্তু তোমার ফাঁকিবাজির কোন সুযোগ নেই। তোমার আনরোমান্টিক, নিরামিষ জামাই ফাঁকিবাজির বিরুদ্ধে। ”

” তুমি একদম ঠিক বলেছ, আপু। পড়াশোনার ব্যাপারে এক বিন্দু ছাড় দিতে রাজি নয় সে। দা’ন’ব একটা। ”

কান্তার কথা শুনে শ্রীজা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।

” তা ভাবীজি, তোমার দা’ন’ব তোমাকে ভালোবাসে তো? না-কি অবসরে শুধু পড়াতেই থাকে? দেখ, বেশি বইয়ের পড়া পড়তে যেয়ে, অন্য পড়া যেন ভুলে যেওনা। তুমি যতই বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকবে, সে ততই তোমাকে বইয়ের ভেতর ডু’বি’য়ে দিবে। ”

শ্রীজার কথা শুনে কান্তা মুখ টিপে হাসে। শ্রীজাপু কথাটা মন্দ বলেনি৷ সত্যিই সে একটা নিরামিষ, আনরোমান্টিক ভূ’ত।

” কোথায় হারালে আমার মিষ্টি, ভাবী? ভাইয়াকে বুঝি মিস করছ? শোন আজ আর কোন পড়াশোনা নয় বুঝলে? সে বাসায় আসলে শুধু রোমান্স করবে। ” কান্তার ভাবনার মাঝেই টিপ্পনী কাটে শ্রীজা।

” আপু, কি সব বলছ তুমি! আমি কিন্তু লজ্জা পাচ্ছি। ” কান্তা কৃত্রিম লজ্জার সাথে বলে।

” ইশ রে, আমার ভাইয়ার লজ্জাবতী। সত্যি করে বল, আমার দা’ন’ব ভাইয়া তোমাকে শুধু ধমকায় নাকি ভালোও বাসে? উত্তর না দেয়া পর্যন্ত তোমার ছাড় নেই। ” শ্রীজা জোড়াজুড়ি করছে।

” আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা সম্পূর্ণ অন্যরকম। ভালোবাসা কি শুধুই শরীরের মাঝে সীমাবদ্ধ? আমার কাছে তা মনে হয়না। আমার প্রতি তার খেয়াল, যত্ন, আগলে রাখা এসবের মাঝেই আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই। এমনকি তার ধমকের মাঝেও সুক্ষ্ম ভালোবাসা আছে, যা আমি বুঝতে পারি। আর এ সবকিছু মিলিয়ে সে আমাকে ভালোবাসে তা আমি উপলব্ধি করতে পারি। ” অকপটে স্বীকার করে কান্তা।

” বাব্বাহ্ কি ভালোবাসা! আমার এমন গোমড়ামুখো ভাইও ভালোবাসতে জানে! তবে তোমার কথা শুনে খুব ভালো লাগছে। দু’জন সারাজীবন এভাবেই থেক। জানো ভাবী, আমার ভাইয়া খুব ভালো। সে উপর উপর সবাইকে যা দেখায়, আসলে সে তেমন নয়। সে আমাদের সবার থেকে আলাদা। ”

” তবে যে উনি বাসায় কারও সাথে ভালোভাবে কথা বলেননা? যখন কথা বলেন, তখন শুধু রা’গ’ই করেন? কেন আপু? কেন তিনি এমন করেন? ” সুযোগ পেয়ে কান্তা প্রশ্নটা করেই বসল।

” আর কিছুদিন যাক, তুমি এমনিতেই সব বুঝতে পারবে। নিজের পরিবারের দূ’র্না’ম নিজ মুখে কেমন করি বল? একটু ধৈর্য্য রাখ একদিন ভাইয়াই তোমাকে সব বলবে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যেওনা। ”

” ঠিক আছে, আপু। আমি এসব নিয়ে কোন প্রশ্ন কখনোই করবনা। ”

” নতুন বউ গো, বাপজান আইছে। তোমারে ডাকতাছে। ” দরজার বাইরে থেকে খালা কান্তাকে ডেকে বলে।

” যাও, যাও তোমার উনি এসেছে। ভালোভাবে সেবাযত্ন কর। আর কতদিন নিরামিষ থাকবে সে। এবার একটু রোমান্টিক বানাও। ”
শ্রীজার কথা শুনে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে কান্তা।

রুমে ঢুকেই আরমানকে বিছানায় বসে থাকতে দেখল কান্তা। তার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।

” এই নিন, শরবত। ” আসার সময় আরমানের জন্য বানিয়ে রাখা শরবত নিয়ে এসেছে কান্তা।

” আগে তুমি খানিকটা খেয়ে দেখাও। তোমাকে সব সময় পড়ার কথা বলি জন্য, হতেও পারে এর মধ্যে কিছু মিশিয়ে দিয়েছ। ”

” কি! বাসার সবাইকে দিয়েছি এটা। আপনার জন্যও রেখেছি। আমি এতে কি মেশাতে যাব? ”

” সবাইকে দিয়েছ ভালোকথা। তুমি কি খেয়েছিলে? ”

” নাহ্। ”

” কিছু মিশিয়েছ জন্যই তো খাওনি। এখান থেকে কিছুটা খেয়ে দেখাও, তবেই আমি বিশ্বাস করব।”

” আমি এই গ্লাসে মুখ দিলে তো পুরোটাই এঁটো হয়ে যাবে। দাঁড়ান একটা গ্লাস নিয়ে আসি। ” মুখ কালো করে বলে কান্তা।

” হোক এঁটো। তুমি আমার সামনেই মুখে দিবে, এবং এখনই। ”

আরমানের কথা শুনে কান্তার কান্না পাচ্ছে।
সে আরমানের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে বিছানায় বসে, ছোট্ট ছোট্ট তিন চুমক দেয় শরবতে।
আরমান আঁড়চোখে একবার কান্তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

” এই যে দেখুন, আমি এখনও বিছানায় ঠিকঠাক বসে আছি। চোখমুখও উল্টায়নি আবার হাত-পাও বাঁকা হয়নি। ”

কান্তার গলায় ঝাঁঝের উপস্থিতি পেয়ে আরমান আবারও হাসে।
এরপর কান্তার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে চুমুক দেয় ভেতরের অমৃতে। কান্তা নিজের রা’গ নিয়েই ব্যস্ত।সে একবারও লক্ষ্য করলনা, গ্লাসে ওর ঠোঁট লাগানো জায়গায় ঠোঁট রেখে চুমুক দিয়েছে আরমান।

রাতে খাওয়ার পর কান্তা রুমে এসে বই নিয়ে বসেছে। এমন সময় ওর ফোন বেজে ওঠে। বই বন্ধ করে হাসিমুখে রিসিভ করে। ও ভুলেই গেছে পাশে আরমান বসে আছে।

বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখতেই আরমানের সাথে চোখাচোখি হতেই কান্তা একটু হাসে।

” এত হেসে হেসে কার সাথে কথা বললে? বিয়ের পনের দিনেও তোমাকে এত হাসতে দেখলামনা। ”

” আপনি কি খোঁ’চা দেয়া ছাড়া কথা বলতে পারেননা! ভালোভাবে জিজ্ঞেস করতে কষ্ট হয় বুঝি? ”

” আমার প্রশ্নের উত্তর এটা? কানে ঠিকঠাক শুনতে পাওনা? ”

” আমার বান্ধবীর ফোন ছিল। আমাকে ফোন দেয়ার মানুষই আছে দু’জন। ”

” একজন তোমার বান্ধবী। আরেকজন কে? ”

” পাশের বাড়ির দাদি। ”

” এবার পড়তে বস। অনেক কথা হয়েছে। আগামীকাল থেকে তোমার কোচিং। তুমি বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে তৈরী হয় থাকবে। আমি এসে নিয়ে যাব। কালকে আমার সাথে গেলে, এরপর থেকে পথ চিনে একা যেতে পারবে? ”

” আপনার কোচিং-এ যাব বুঝি? আপনি ভালোভাবে পথ চিনিয়ে দিবেন, তাহলে আমি যেতে পারব। ”

” তোমার সাহস তো মন্দ নয়। একদিনেই এই ঢাকার পথ চিনতে পারবে? ”

” যাকে ছোটবেলায় বাবা একা পথ চিনতে রেখে গেছে, যার মা জীবনের চলার পথের শুরুতেই একা করে গেছে। তাকে যে বাকিটা পথ নিজেকেই চিনে চিনে খুঁজে বের করতে হয়েছে, তার এই সাহস থাকাটা কি মন্দের ভালো নয়! ”

” তবে যাওয়ার সময় ভালোভাবে পথঘাট দেখে রাখবে। আমি যে কোন পরিস্থিতিতেই তোমার পাশে থাকব। হয়তো পথে তোমাকে সঙ্গ দিতে পারবনা। বাসা থেকে কোচিং কিংবা ভার্সিটি এই পথটুকু তোমাকে একাই পেরোতে হবে। তবে পথের নির্দেশনা ঠিক দিতে পারব। কোন পথ বন্ধুর কিংবা কোন পথ মসৃণ তা ঠিক জানিয়ে দিব। ”
কান্তার কথার প্রেক্ষিতে আরমান এতটুকুই বলতে পারে।

পরদিন বিকেলে কান্তা তৈরি হয়ে আরমানের অপেক্ষা করছে।
যথাসময়ে আরমান আসলে ওরা বেরিয়ে যায়।
আরমানের বাইকে বসে কান্তা রাস্তার দুইপাশে ভালোভাবে লক্ষ্য করছে। যদিও বাইকে বসে ওর বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। কারন এর আগে কখনোই ও বাইকে উঠেনি। দুই ভাইয়ের বাইক থাকলেও কেউ ওকে একদিনও শখ করে চড়ায়নি।
আরমান কান্তার অস্বস্তি টের পায়।

” আমাকে ঠিকঠাক ধরে বস। ভয় পেওনা। বাইকের গতি বেশি নেই। রাস্তার চারপাশ ভালোভাবে দেখে রাখ। ”
আরমান চারপাশটা কান্তাকে চিনিয়ে দিচ্ছে। কান্তাও বাধ্য মেয়ের মত সব মাথায় গেঁথে রাখছে।

কান্তার ধারণাই ঠিক। আরমান ওকে নিজের কোচিং-এ ভর্তি করিয়েছে।
সে কোচিং-এ ঢুকেই প্রথমে কান্তাকে সব শিক্ষকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এখানকার শিক্ষকরা বেশিরভাগই আরমানের বন্ধু। সবাই কান্তাকে যথেষ্ট সম্মান করেছে।
এরপর আরমান ওকে ক্লাসে নিয়ে যায়। যদিও স্টুডেন্টদের কাছে কান্তার পরিচয় দেয়না।
কান্তা মনযোগ দিয়ে সব ক্লাস করে। তবে আরমানের ক্লাসে বেশি মনযোগী থাকে সে। প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট মনযোগ দিয়ে আরমানের ক্লাস করছে দেখে ওর খুব ভালো লাগে। তবে একটা বিষয় ও খেয়াল করেছে, কয়েকটা মেয়ে আরমানকে দেখেই ওর মনযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আরমান সুক্ষ্মভাবে তাদের এড়িয়ে যায়।

দুইঘন্টা ক্লাস শেষে আরমান ওকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আজ কান্তার প্রথম দিন তাই ও একটু আগেই কোচিং থেকে বেরিয়ে এসেছে।

আরমান একটা রেস্টুরেন্টের সামনে বাইক পার্কিং করে, কান্তাকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে।

একটা টেবিলে কান্তাকে নিয়ে বসে। ওয়েটার এসে মেন্যু কার্ড দিলে, আরমান কান্তার দিকে এগিয়ে দেয়।

” কি খাবে অর্ডার কর। ”

” আপনি আমাকে এখানে আনলেন কেন বলুনতো! আমি আগে কখনোই কোন রেস্টুরেন্টে যাইনি। তাই কোন অভিজ্ঞতাও নেই। ” কান্তা বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছে।

” বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি। কিন্তু তুমি এভাবে বলছ কেন? অভিজ্ঞতা নেই, হয়ে যাবে। আগে কখনোই রেস্টুরেন্টে যাওনি বলে, আজ আসতে মানা আছে? একদিনে কেউ শিখেনা। আজ আমার থেকে নাহয় কিছু শিখলে। এতে দোষ আছে? ”

কান্তা তার সামনে বসে থাকা মানুষটাকে যতই দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে। কি নির্দিধায় কথাগুলো বলল! তার গলায় কোন উপহাস ছিলনা।

” কি এত ভাবছ? না-কি আমার সাথে খেতে ইচ্ছে করছেনা? ”

” আপনার নাম আরমান না হয়ে খোঁ’চা’মা’ন হওয়া উচিত ছিল। মুখ খুললেই খোঁ’চা’মা’রা কথা বের হয়। ”

” তুমিই রাখ। তারা ভুল করে নাম রেখেছে বলে তুমিও ভুল করবে! আর আকিকার ব্যবস্থাও কর। তার আগে খাবার অর্ডার দাও। ”

” একটা কথা বলব। ” সাহস নিয়ে বলে কান্তা।

” দশটা বল। ইচ্ছে করলে হাজারটাও বলতে পার। তোমার সব কথা শোনার জন্য রেজিস্ট্রিকৃত এই অধম আছে। ” আরমানে চোখ ফোনের স্ক্রীনে।

কান্তা বুঝল এর সাথে কথা বাড়ালেই নিজেরই ক্ষতি।

” বলছিলাম কি, আমরা এখানে একা একা খাব? ”

” আর কাকে লাগবে তোমার! বাইরে থেকে কাউকে ধরে এনে এখানে বসাব? ”

” আমি সেটা বলিনি। ”

” তবে কি বলেছ। ”

” আমরা বাড়ির সবাইকে রেখে একা একা খাব? শ্রীজাপু, খালা, আম্মা, দাদিমা ওদের রেখে খেতে ভালো লাগবেনা। ”

” তো, এখন কি তাদের ফোন করে ডেকে নিয়ে আসব? আজব মেয়ে তুমি! রেস্টুরেন্টে এসেছ হাজবেন্ডের সাথে, কিন্তু চিন্তা করছ বাড়ির মানুষের! ” আরমানের চোখেমুখে বিস্ময়।

” আমরা এখানে হালকা কিছু খেয়ে, বাড়ির জন্য কিছু নিয়ে যাই? ওদের রেখে খেতে কেমন যেন লাগছে। ”

” কি খাবে বল? ”

কান্তা মেন্যু দেখে কোল্ড কফি আর স্ন্যাকসের অর্ডার দেয়। আসলে ও আরমানের বেশি খরচ হোক তা চাচ্ছেনা।

” তুমি শিওর, এগুলোই খাবে? ”

কান্তা মাথা নাড়ায়।

আরমান ওদের জন্য স্ন্যাকস আর কোল্ড কফির অর্ডার দেয়।
আর বাসার সবার জন্য বিরিয়ানি অর্ডার করে।

ওরা যখন বাসায় ফিরে তখন সন্ধ্যা পেরিয়েছে।
ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই ওরা আকলিমা খানমের মুখোমুখি হয়।
আকলিমা খানম কান্তার কাঁধে ব্যাগ দেখে চোখমুখ বি’কৃ’তি করে।

” কোথায় গিয়েছিলে তোমরা? ” আকলিমা খানম ওদের দিকে তাকিয়ে দুজনকেই প্রশ্ন করে।

” কান্তাকে কোচিং-এ ভর্তি করিয়েছি। ও আজ থেকে ক্লাস শুরু করেছে৷ ” আরমান জবাব দেয়।

” তুমি যে ওকে কোচিং-এ ভর্তি করিয়েছ, কার কাছ থেকে হুকুম নিয়েছ? তোমার বাবা জানে? তুমি বউকে পড়াশোনা করাবে তা আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলেনা? ”

” আমার বউকে আমি পড়াব, এটা কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন? সে পড়বে কি-না সেটা আমি বুঝব। এটা নিয়ে অন্য কাউকে আমার কৈফিয়ত দিতে হবে কেন, তা কি দয়া করে বলবেন? ”

” তোমাকে একশোবার কৈফিয়ত দিতে হবে। মনে রেখ তুমি এখনও তোমার বাবার বাড়িতে আছ। তাই যে কোন কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে হলে তোমার বাবাকে জানাতে হবে। সেই সাথে আমাদেরও। আর আমরা চাইনা তোমার বউ পড়াশোনা করুক। এমনিতেই তার কথার তেজে বাসায় থাকা দায়। তারউপর তাকে পড়াশোনা করিয়ে আমাদের কি রাস্তায় নামানোর চিন্তা করছ? ”

” আমি যদি এই বাসায় না থাকি, তবে কাউকেই কৈফিয়ত দেয়ার প্রশ্ন আসছেনা, তাইনা?
আর আমাদের বিষয় নিয়ে কাউকে কৈফিয়ত দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। তবে শুনে রাখুন আমি কান্তাকে পড়াশোনা শেখার সুযোগ করে দিব। ”
এরপর আরমান খালাকে ডেকে তার কাছে সবার বিরিয়ানির প্যাকেট দিয়ে, কান্তাকে নিয়ে রুমে আসে। তার হাতে দু’জনের বিরিয়ানির প্যাকেট।
সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ সে নিজের রুমেই খাবে।

চলবে….