#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_২৪
জাওয়াদ জামী
দেখতে দেখতে দিন পেরিয়ে মাস হয়। সেই মাসও পেরিয়ে যায়।
কেটে গেছে দুইমাস। আরমান এই দুইমাসের মধ্যে ঢাকায় আসেনি। এ নিয়ে কান্তার মন ভিষণ খারাপ। ওর অপেক্ষার প্রহর কেটেছে আরমানের কথা ভেবে। কিন্তু আরমান আসেনি। তাকে জিনিস করলেই বলেছে, ভিষণ কাজের চাপ।
আজ কান্তার রেজাল্ট দিবে। সকাল থেকেই ও ভিষণ টেনশনে আছে। ওকে সাথ দিতে শ্রীজা সকালে এই বাসায় হাজির হয়েছে।
কান্তা রেজাল্টের চিন্তায় গতরাত থেকেই খাওয়া বাদ দিয়েছে। রেজাল্ট খারাপ হলে আরমান ওকে ছেড়ে কথা বলবেনা।
শ্রীজা কান্তার রেজাল্ট পেয়েছে। জিপিএ ফাইভ পেয়েছে কান্তা।
ও আরমানকে রেজাল্ট জানাতে বারবার ফোন দিতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই আরমানের ফোন বন্ধ পায়।
চিন্তায় অস্থির হয়ে যায় কান্তা।
আরমানের মামা-মামী, খালা সবাই কান্তাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তারাও কান্তার এই অর্জনে ভিষণ খুশি।
কান্তা বাসার ভেতরে এলোমেলো পায়চারী করছে। ও আরমানের চিন্তায় অস্থির।
” ভাবী, কি হয়েছে তোমার! এভাবে হাঁটছ কেন? ” শ্রীজা রুমে এসে কান্তাকে এভাবে হাঁটতে দেখে জিজ্ঞেস করে।
” আপু, জানোইতো সকাল থেকে তোমার ভাইয়ার কোন খবর নেই। ফোনেও পাচ্ছিনা। আজকের দিনে সে এভাবে ঘাপটি মেরে বসে আছে, আমি এটা মানতে পারছিনা। সে ঠিক আছেতো আপু? ” কান্তা কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করে।
” তুমি এত চিন্তা করোনা। হয়তো ভাইয়া জরুরী কাজে আটকা পড়ে গেছে। তাই তার ফোন সুইচড অফ। রাতে নিশ্চয়ই সে ফোন করবে দেখ। আর তা নাহলে সে বাসায় আসবে দেখে নিও। তোমার এই অর্জনের দিনে ভাইয়া চুপচাপ থাকবে বলে তোমার মনে হয়? ”
” সে আসবেনা, তুমি দেখ। আজকাল সে খুব ব্যস্ত থাকে। দুইমাস হয়েছে সে বাসায় আসেনি। কাজের চাপে খাওয়ার সময় তার হয়না। কিন্তু এই দুই মাসে চারদিন ছুটিতে ছিল সে। অথচ ঢাকা আসেনি। অন্য কোথাও ছুটি কাটিয়েছে। ”
” তুমি এসব কিভাবে জানলে! ভাইয়া এমন কিছু করতে পারে বলে তোমার বিশ্বাস হয়? ”
” তাকে ফোনে না পেয়ে তার অফিসে কাছে ফোন দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই সব জানতে পেরেছিলাম। কি জানি হয়তো সে সত্যিই ব্যস্ত থাকে। ” কান্তা উদাসীনভাবে বলে।
” তুমি ভাইয়াকে বিশ্বাস কর ভাবী? তুমি আবার অন্য কিছু ভাবছনা তো? ”
” নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি তাকে। যে পুরুষ বিয়ের এত মাসেও আমার দিকে লো’লু’প দৃষ্টিতে তাকায়নি, তাকে অনায়াসে বিশ্বাস করা যায়। আমি এটা খুব ভালো করে জানি, সে একজন শুদ্ধ পুরুষ। তার অপেক্ষায় কয়েক জন্ম অনায়াসে পার করে দেয়া যায়। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, সে আমার কাছে কিছু একটা লুকাচ্ছে। ”
” তাহলে তো মিটেই গেল। ভাইয়ার প্রতি এই বিশ্বাস সারা জীবন রেখ। দেখবে তুমি কখনও ঠকবেনা। এবার চোখ মুছে খেতে চল। তোমার জন্য আমরা দুজন মানুষ না খেয়ে আছি। ভিষণ ক্ষুধা লেগেছে, আর থাকতে পারছিনা। ”
” আপু, তোমরা খেয়ে নাও। আমার এই রিকুয়েষ্ট অন্তত রাখ। তার খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত আমার গলা দিয়ে খাবার নামবেনা। ” কান্তা অনেক অনুরোধ করে শ্রীজা ও খালাকে খাওয়ার জন্য রাজি করায়।
শেষ বিকেলের আলো ফুরিয়েছে আগেই। সন্ধ্যা আঁধারকে আলিঙ্গন করেছে পরম সুখে। আজ একটু তারাতারিই ধরনী অন্ধকারে ছেয়েছে। অমাবস্যার রাজত্ব চলছে ধরনীতে।
কান্তা বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ ঝরাচ্ছে। আরমান কেন এমনটা করল! সারাটাদিন তার কোন ফোন আসেনি। সে কোথায় আছে? কেমন আছে? ওর অপমান, অসম্মানের জীবনে মানুষটা যে ওকে এক নতুন জীবন দিয়েছিল, যে জীবনে শুধু ভালোবাসায় ভরা। সব সময়ই ছায়ার মত পাশে থেকেছে, সাহস জুগিয়েছে, অনুপ্রেরনা দিয়েছে। তার জন্যই আজ কান্তা এ পর্যন্ত এসেছে। আজ ওর এতবড় অর্জনের দিনে মানুষটা ওর পাশে নেই, তা ভাবতেই পারছেনা কান্তা।
কলিং বেলের আওয়াজে ও ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। হয়তো পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি এসেছে। বয়স্ক ভদ্রমহিলার ছেলে-মেয়েরা সবাই দেশের বাইরে থাকে। একা একা ফ্ল্যাটে তার মন বসেনা। তাই প্রতিদিনই বিল্ডিংয়ের একেকটা ফ্ল্যাটে যেয়ে তিনি গল্প করেন। কান্তার কাছেও সপ্তাহে একদিন করে গল্প করতে আসেন। আজও হয়তো তিনিই এসেছেন, কান্তার রেজাল্ট শুনতে। কিন্তু আজ কান্তার ঘর থেকে বের হতে মোটেও ইচ্ছে করছেনা। কারও সাথে কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। আজ ওর ভাবনা জুড়ে শুধু একজন মানুষই বিরাজ করছে।
হঠাৎই কান্তা অনুভব করল কেউ ওকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরেছে। আগন্তুকের হাতের ছোঁয়া আর শরীরের ঘ্রানেই কান্তা বুঝতে পারে মানুষটা কে। তবুও ও কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তার সাথে কান্তার কোন কথা বলার ইচ্ছে এই মুহুর্তে হচ্ছেনা। চুপটি থেকে এই ছোঁয়া শরীর থেকে অন্তর পর্যন্ত মাখতে ইচ্ছে করছে। তাই সে যেভাবে শুয়ে ছিল সেভাবেই থাকে। আর চোখ দিয়ে ঝরতে থাকে অশ্রুধারা।
” এই মেয়ে, দিনদিন তুমি দেখছি খুব লোভী হয়ে যাচ্ছ! দিন নেই রাত নেই সব সময়ই জামাইকে কাছে পেতে চাচ্ছ! এসব ভালোনা, বুঝলে, মেয়ে? মেয়েদের একটু লজ্জাশরম না থাকলে চলে? মিথ্যে করে হলেও তো একটু লজ্জা পেতে পার। আমিও দেখি লজ্জা পেলে এই ঝগরুটে বুড়িকে কেমন লাগে। ” আরমান কান্তার খোলা ঘাড়ের ওপর নাক ঘষছে।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে তবুও কান্তা সাড়া দেয়না। আরমানও ওকে জড়িয়ে ধরে আছে আর মাঝেমধ্যে কান্তার ঘাড়, পিঠ, গলায় নাক ঘষছে।
” এখনও কথা বলবেনা? তবে কি আমি চলে যাব? ” আরমান কথাটা বলার সাথে সাথে কান্তা এক ঝটকায় উঠে বসে। এতে আরমান একটু ভ্যাবাচ্যাকা খায়।
” কি হল! হঠাৎ এভাবে বাঘিনীর রূপে এন্ট্রি নিলে কেন! আরেকটু হলেই আমার হার্ট অ্যা’টা’ক হত। তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে আমার হার্ট কি পরিমান দুর্বল হয়েছে তা-কি তুমি জান? সামান্য একটু শব্দেই আমার দুর্বল হার্ট চোখ,নাক, কান, গলা দিয়ে বের হয়ে আসতে চায়। ভবিষ্যতে আর এমন করনা। ”
” এখন সব দোষ আমার! বিয়ে করলেন কেন আমাকে? আমি কি বিয়ের জন্য আপনার হাতে-পায়ে ধরেছিলাম? আপনার চোখ, মুখ, পেটের নাড়িভুঁড়ি, কিডনি, কলিজা সবকিছুতেই জিলাপির প্যাঁচ দিয়ে ভরা। নইলে এমন প্যাঁচের কথা কেউ বলতে পারে! ” তেজোদৃপ্ত গলায় বলে কান্তা।
” দেখেছ, তুমি তোমার ফর্মে চলে আসছ? সাধে কি আর বলি আমার হার্টের এই অবস্থার জন্য তুমিই দায়ী। এর প্রমান হাতেনাতে দিলাম। এরপর থেকে নিজে সাধু সেজে আমাকে দোষ দেয়ার চেষ্টা করবেনা। এই ঝগরুটে মেয়ের চাপে বেচারা আমি চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছি। ”
” কেন আসলেন আপনি? আমাকে কথা শোনানোর জন্য? তবে সেটাতো ফোনেই শোনাতে পারতেন। কষ্ট করে এতদূর আসার দরকার ছিলনা। টাকাও বাঁচত, কষ্টও কম হত। ”
” তখন কি এই ঝগরুটে বুড়িকে দেখতে পেতাম? নাকি তার কান্না দেখতে পেতাম! তুমি দিনদিন ছিঁচকাঁদুনে হয়ে যাচ্ছ, বুঝলে? আমার আবার এমন ছিঁচকাঁদুনে মেয়েকে পছন্দ নয়। মাঝেমাঝে মনে হয় একটা স্ট্রং স্বভাবের মেয়েকে বিয়ে করি। ”
” তো করুননা স্ট্রং স্বভাবের মেয়েকে বিয়ে করুন। কে বারণ করেছে। আমি আর থাকবনা এখানে। ”
” কোথায় যাবে? ভাইয়ের বাড়িতে? সেখানে ভাবী বোধহয় তোমাকে আপ্যায়ন করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে! তা কবে যাচ্ছ? ”
” কে বলেছে, আমি ভাইয়ের কাছে যাব? আমিতো যাব চিটাগং। সেখানে একা একা থেকে আপনার সাহস বড় বেড়েছে। এবার আপনার একটু লাগাম টেনে ধরা দরকার। ”
” বললেই হয়, আমাকে ছাড়া থাকতে পারছনা। সেজন্যই বললাম, তুমি দিনদিন বড্ড লোভী হয়ে যাচ্ছ। এ লোভ যে সে লোভ নয়, জামাইকে কাছে পাওয়ার লোভ। কি ঠিক বললাম তো? ” আরমান কান্তার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসে।
” আমি ভুল কিছু করেছি? অধিকার আছে তাই লোভ করছি। এটা এমন এক অধিকার, যার শক্তির কাছে পৃথিবীর সকল শক্তি হার মানে। কিন্তু আপনার এমন বেশ কেন? ইউনিফর্ম পরেই চলে এসেছেন! আর থেকে ফোন বন্ধ রেখেছেন কেন? আপনাকে কতবার ফোন দিয়েছি জানেন? আমার বুঝি চিন্তা হয়না? বদ লোক একটা। ”
” একটা কাজে গিয়েছিলাম, তাই ফোনের সুইচড অফ রেখেছিলাম। এরপর সেই কাজ সেরেই তবে বেরিয়েছি। কিন্তু তুমি আমার যত্নআত্তি না করে এভাবে বসিয়ে রেখেছ। এদিকে সকাল থেকে না খেয়ে আছি। সেদিকে তোমার খেয়াল আছে? ”
” আমি আজ রান্না করিনি। আজ শ্রীজাপু আর খালা মিলে রান্না করেছে। আপনি বরং গোসল সেরে আসুন, আমি খাবার দিচ্ছি। ”
” তোমার হাতের রান্না না খেলে আমার তৃপ্তি হয়না, তা তুমি ভালো করেই জান। কিন্তু তুমি বলছ, আজ তুমি রান্না করনি। তোমার ঐ গবেট মাথায় একটাবারও আসেনি, যে আজ আমি যেখানেই থাকিনা কেন ঢাকায় আসবই। ”
” আপনি গোসল করতে করতে আমি কিছু একটা বানিয়ে দিচ্ছি। শুধু আধাঘন্টা সময় নিয়ে গোসলটা করবেন, তাহলেই হবে। ”
” তুমিও তো না খেয়ে আছ। এখন তোমাকে কিছু করতে হবেনা। আজ খালার হাতের রান্নাই খেয়ে নিচ্ছি। কাল তুমি রান্না করবে। ”
” আমি না খেয়ে আছি, আপনি কি করে জানলেন! ”
” আমার মাথায় তো তোমার মাথার মত গোবর নেই যে বুঝতে পারবনা। ইডিয়ট মেয়ে। ”
” এভাবে বলছেন কেন। আমাকে ধমক দিয়ে কি সুখ পান? ” হঠাৎই আবেগে কান্তার চোখ ভিজে যায়।
আরমান ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা। বুকে জরিয়ে নেয় তার রমনীকে। কান্তা আরমানের বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছে। আজ ওর সকল সুখ-দুঃখ একসাথে বুকে এসে ভীড় করেছে।
” এ কি! তোমার সর্দি লেগে আমার ইউনিফর্ম নষ্ট হয়ে গেল! শেষে কিন্তু তোমাকেই ধুতে হবে। ধুতে কষ্ট হবেনা তোমার? ” আরমান মসৃণ গলায় বলে।
” নষ্ট হোক। ধুতে আমার কোন কষ্ট হবেনা। প্রয়োজনে আরও নষ্ট করব। আপনি জানেন, গত দুইমাস থেকে আপনার কোন পোশাক আমি ধুতে পারিনি এতে আমার কত খারাপ লেগেছে? কেন আসেননি? একটুও কষ্ট হয়নি আপনার? ” কান্তার এমন আচরণে আরমান না হেসে পারেনা।
” আর পনের দিন অপেক্ষা কর। সামনে মাসেই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব। তখন আর তোমাকে কষ্ট পেতে হবেনা। আমিও ভালো থাকব। আমরা দু’জন মিলে একসাথে থাকব। এবার কান্না থামাও। তোমার চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারিনা। ”
” ঠিক আছে, আর কাঁদবনা। আপনি এবার গোসল সেরে আসুন। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। ”
” উঁহু, আজ রুমে খাবার নিয়ে এস। ”
” আচ্ছা। ”
আরমান গোসল সেরে এসে দেখল কান্তা খাবার নিয়ে এসেছে। ও মৃদু হেসে ডিভানে বসে। কান্তা দুজনের জন্য দুই প্লেটে খাবার নিতে গেলেই আরমান ওকে থামিয়ে এক প্লেটে খাবার নেয়। এরপর নিজে খেতে খেতে কান্তাকেও খাইয়ে দেয়।
রাতে সবাই মিলে অনেকক্ষন আড্ডা দেয়। আরমান ক্লান্ত থাকায় কান্তাকে রেখেই রুমে এসেছে।
এরপর শ্রীজা জোড় করে কান্তাকেও রুমে পাঠিয়ে দেয়।
কান্তা রুমে এসে দেখল আরমান বিছানায় বসে নতুন একটা ফোন নাড়াচাড়া করছে। বিছানায় ওর বাটন ফোনটা গড়াগড়ি খাচ্ছে। কান্তা লক্ষ্য করল ওর ফোন খুলে ফেলা হয়েছে।
” আমার ফোনের এমন অবস্থা করলেন কেন! এটা দিয়েই আমি কথা বলি। ”
” এখন থেকে এটা দিয়ে কথা বলবে। ” নতুন আইফোন কান্তার দিকে বাড়িয়ে দেয় আরমান।
” এত দামী ফোন দিয়ে আমি কি করব! আমার বাটন সেটই ভালো ছিল। কতদিন থেকে এই ফোন ব্যবহার করছি। ”
” এটা তোমার ভালো রেজাল্টের জন্য গিফ্ট। একটা ল্যাপটপও আছে। আমি চাইলে আগেই তোমাকে ফোন কিনে দিতে পারতাম। কিন্তু ইচ্ছে করেই দিইনি। আমি সিমকার্ড, চিপ সেট করে দিয়েছি। এখন থেকে এই বাটন ফোনের কথা ভুলে যাও। প্রয়োজনে এটাকে মিউজিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করব। ”
” আপনি জানেন, আমি কত কষ্ট করে এই ফোনটা কিনেছিলাম? কয়েকমাস প্রাইভেট পড়িয়ে, নিজের খরচ চালানোর পর কিছু কিছু করে সঞ্চয় করেই তবে এই ফোন কিনেছিলাম। ”
” আমি সব জানি। কিন্তু এখন এত কথা না বলে, দেখ ফোনটা কেমন হয়েছে? ল্যাপটপও ভালো করে দেখ, পছন্দ হয় কিনা। ”
” আপনার পছন্দ হলেই হবে। আমার এত বাছবিচার নেই। আপনার একটা ছবি তুলে ফোনে সেট করে দিন। ”
” কেন! আমার ছবি কেন! তোমার মতলব মনে হয় ভালো নয়। ফ্রিতে চুমু খাওয়ার ধান্দা করছ নাকি? এটা হবেনা। তুমি মিনিটে মিনিটে আমার ছবিতে চুমু খাবে, কিন্তু আমি বুঝবনা, এটা মানতে পারবনা। ”
” লাগবেনা আপনার ছবি। ” কান্তা পাশ ফিরে শুতে গেলেই, আরমান ওকে বাঁধা দেয়।
” রা’গ কর কেন! শুধু চুমুই তো দিবে, অন্য কিছুতো দিবেনা। নাকি দেয়ার ইচ্ছে আছে? ”
কান্তা লজ্জায় মুখ তুলতে পারেনা। মাথা নিচু করে থাকে।
” রমনী, আজ কিছুই নিবনা। তোমাকে হরণ করব অ্যাডমিশনের পর। তখন এত লজ্জা পেয়েও তোমার রেহাই মিলবেনা। সময়টা তখন শুধুই আমার থাকবে। সেদিনের একেকটা ক্ষণ হবে আমার এতদিনের প্রতিক্ষার সাক্ষী। যে ক্ষণ তোমার স্মৃতি আর তনু-মনে সারাজীবন বিরাজ করবে। যে ক্ষণে তোমার অস্তিত্বে লেখা হবে আরমানের নাম। যেটা সারাজীবন তোমাকে বয়ে বেড়াতে হবে। ” আরমানের ফিসফিসানি কথায় কান্তার শরীর অবশ হয়ে গেছে। ওর বুকের ভিতর শুকিয়ে আসছে। এই মুহূর্তে ওর পানির ভিষণ প্রয়োজন। কোন মানুষের কথাও এত নেশাক্ত হতে পারে!
” রমনী, এখনই এভাবে ঘামছ! তবে সেদিন কি করবে? সেদিন আমি কিন্তু কোন ছাড় দিবনা। এতটা দয়ালুও আমি নই। ” আরমান আর কিছু বলার আগেই কান্তা ধপ করে বালিশে মাথা রেখে শক্ত হয়ে শুয়ে থাকে। ও আজ নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়েছে।
চলবে…
#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_২৫
জাওয়াদ জামী
আকলিমা খানমের মন বেশ কয়েকদিন থেকে ভালো নেই। আজকাল শুভ সারারাত বাইরে কাটায়। ফজরের আজানের পর ও বাসায় আসে। এ নিয়ে আকলিমা খানমের তার ছেলের সাথে প্রায়শই কথা-কাটাকাটি হয়। কিন্তু শুভ শোধরাবার ছেলে নয়। আজ সে বাসায় ফিরেইনি। সকাল দশটা বাজে, অথচ এখনও সে শুভর খোঁজ পায়নি। বিষয়টি সে এখন পর্যন্ত শহিদ আহমেদকে জানায়নি। এদিকে শ্রীজাও বাসায় নেই। ও থাকলে শুভর খোঁজ যেভাবেই হোক বের করত। তার এখন শ্রীজার ওপর ভিষণ রা’গ হচ্ছে। নিজের এই প্রাসাদসম বাড়ি ছেড়ে তার মেয়ে আরেকজনের ছোট ফ্ল্যাটে যেয়ে পরে আছে। নিজের ভাইয়ের থেকেও সৎভাইয়ের ওপর দরদ বেশি! আজ আসুক ও।
এদিকে শহিদ আহমেদও আজ বাসায় আছে। কখন যেন সে শুভর কথা জিজ্ঞেস করে। ভয়ে আকলিমা জুবুথুবু হয়ে গেছে।
রাজিয়া খানমের অবস্থাও তাই। শুভর চিন্তায় সে-ও অস্থির। তারউপর আজকে তার ছেলে বাসায় আছে।
আকলিমা খানম উপায় না পেয়ে তার ভাই রশিদ বেগকে ডাকে কথা বলার জন্য।
” ভাই, শুভ এখনও বাসায় ফিরেনি। তুমি একটু খোঁজ নিয়ে দেখবে? কিন্তু ওর বাবাকে কিছু জানিওনা। ”
” তুই এসব কি বলছিস, আকলিমা? শুভ বাসায় ফিরেনি, এটা আমি শহিদ ভাইকে জানাবনা! সবার আগে জানার অধিকার তার। কোথায় তুই ছেলেটাকে শাসন করবি। কিন্তু সেটা না করে তুই ওকে সব সময়ই প্রশ্রয় দিস। এটা একদমই ঠিক নয়। তাছাড়া শহিদ ভাই জানলে, তাকে কি জবাব দিবি? ”
” আমি তোমার কাছে সাহায্য চাইছি, কিন্তু তুমি সেটা না করে, আমাকেই দোষারোপ করছ! পারলে সাহায্য কর না পারলে চুপ থাক। ” আকলিমা খানম রে’গে গেছে।
” ঠিক আছে। আমি দেখছি ও কোথায় আছে। তুই চিন্তা করিসনা। ” রশিদ বেগ শুভর খোঁজে বেরিয়ে যায়।
রশিদ বেগ বেরিয়ে যেতেই আকলিমা তার মেয়েকে ফোন করে। দুইবার রিং হতেই শ্রীজা ফোন রিসিভ করে।
” হ্যাঁ, মা, বলো। তুমি এখন ফোন দিলে যে? তোমরা সবাই ঠিকঠাক আছো? ”
” আমরা ঠিক আছি কিনা সেটা দেখার সময় তোর আছে? নিজের বাবার বাড়ি রেখে, তুই পরে আছিস দরদের ভাইয়ের খুপড়ি ঘরে। আমাদের থেকে সে-ই তোর কাছে সব সময়ই আপন, সেটা আমি ভালো করেই বুঝি। কিন্তু যখন বিপদের সময় তোর পাশে তোর দরদের ভাই থাকবেনা, সেদিন বুঝবি কে তোর আপন ছিল। তুই কখন আসবি? তারাতারি বাসায় আয়। এত ঘনঘন সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আর তাদের সাথে তোর এত পিরিত কিসের তা আমি বুঝিনা। ”
” মা, তুমি আর দাদিমা সারাজীবন মানুষকে খুঁ’চি’য়ে শান্তি খোঁজ। কিন্তু এতে কি আদৌ শান্তি মেলে? আমি ভাইয়ার বাসায় এসেছি, তাতেও তোমার সমস্যা! তুমি কি চাও বলতো? ভাইয়ার ঐ বাড়িতে থাকা নিয়ে তোমার সমস্যা ছিল। আবার যখন সে সবকিছু ছেড়েছে, এখানেও তোমার সমস্যা? আমি আমার ভাইয়ের কাছে আসতেই পারি। এখানে তোমার কাছে জবাবদিহিতার কিছু নেই। তাই তোমার কথায় আমি এখান থেকে যাচ্ছিনা। আমি বাবার কাছ থেকে হুকুম নিয়ে এখানে আসি এবং কালকেও তা-ই করেছি। তাই তুমি বললেও আমি যাবনা। এখন রাখছি। ”
শ্রীজা ভেবে পায়না ওর মা ভাইয়ার ওপর কেন এতটা হিং’স্র মনোভাব পোষণ করে।
গতরাতের পর থেকে কান্তা আরমানের সামনে যেতে লজ্জা পাচ্ছে। কাল রাতে লোকটা কিভাবে ওকে লজ্জা দিল! অথচ তাকে দেখে মনে হয়, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেনা। কিন্তু এ-তো দেখা যায় মাছ ভাজায় সিদ্ধহস্ত!
আরমান সকাল থেকেই লক্ষ্য করছে কান্তা ওর আশেপাশে ভিড়ছেনা। এমনকি ওর দিকে তাকাচ্ছেনা পর্যন্ত। ও ঠিক বুঝে গেছে কান্তা কেন এমন করছে।
আরমানকে বাইরে যেতে দেখে কান্তা রুমে আসে টুকটাক কাজ করতে। আরমান বলেছে, টুকিটাকি জিনিসপত্র তাকে দিতে। আজ যতটা পারে কাপড়চোপড় ও হালকা কিছু জিনিস সে নিয়ে যাবে। এরপর সামনের মাসে এসে একবারে ওদেরকে নিয়ে যাবে। সে মতই কান্তা ব্যাগ গোছাচ্ছে।
” এইযে, লজ্জাবতী রমনী, সকাল থেকেই এত পালাই পালাই করছ কেন? এখনই এত লজ্জা পেওনা। কিছুটা লজ্জা বাকি রাখ আগামীদিনের জন্য। লজ্জা ছাড়া বউ আমার আবার ভালো লাগেনা। ” আরামানের ঠোঁটে দুষ্টু হাসির ঝিলিক।
আরমান হঠাৎ রুমে আসায় অপ্রস্তুত হয়ে গেছে কান্তা। এই মানুষটা সব সময় এমনভাবে কথা বলে কেন! একে আর ছাড় দিলে হবেনা। কান্তা তেজী চোখে আরমানের দিকে তাকায়।
” লজ্জা আমার, তাই আমিই বুঝব কখন তাকে সামনে আনব আর কখনইবা ভেতরে রাখব। এতে আপনার কোন সমস্যা? বদ লোক একটা। ”
” উঁহু আমার কোনই সমস্যা নেই। তবে আমার মুড বুঝে তোমার লজ্জা সামনে এনো, কিংবা ভেতরে রেখ। তোমার লজ্জা দেখলে আমি রোমান্টিক মুডে যেমন তোমার লজ্জা হরণ করার ক্ষমতা রাখি, তেমনি নিরামিষ মুডেও অনায়াসে তোমার সর্বাঙ্গে প্রেমের বর্ষন বইয়ে দিতে পারি। অপশন তোমার। তুমি আমার কোন মুডে আমাকে কাছে ডাকবে। আমি আবার এসব বিষয়ে ভিষণ দয়ালু। ”
” আবার শুরু করেছেন? আপনি রুম থেকে এক্ষুণি বের হন। বাইরে যেয়ে শ্রীজাপুর সাথে গল্প করেন। ফাজিল একটা। মুখের কোন লাগাম নেই। ” কান্তার গলায় তেজস্বীভাব আবার ফিরে এসেছে। সে কটমট চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে।
” এই মুহূর্তে আমার বাইরে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। ভিষণ ঘুম পেয়েছে। এখন একটু ঘুমাব। আমাকে একলা পেয়ে তুমি আবার আমার দিকে নজর দিওনা। ” আরমান হাই তুলে বিছানায় ধপাস করে শোয়।
” আমার বয়েই গেছে আপনার দিকে নজর দিতে। আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তার দিকে নজর দিতে বসে থাকব। ” মুখ ঝামটা দিয়ে কান্তা অন্যদিকে ঘুরে কাজে মনোনিবেশ করে।
সেইদিন বিকেলে শুভ বাসায় ফিরে। রশিদ বেগ ওকে অনেক জায়গায় খুঁজেছে, কিন্তু ওর দেখা মেলেনি। সে এসে আকলিমাকে জানায়, শুভকে সে পায়নি।
চিন্তায় অস্থির আকলিমা খানম ছেলেকে দেখে হাঁফ ছাড়ে।
শুভ ঢুলতে ঢুলতে বাসায় প্রবেশ করে। ওকে দেখে আকলিমা খানম সেদিকে এগিয়ে যায়।
” শুভ, তুই কোথায় ছিলি? গতকাল সকালে তুই বাসা থেকে বের হয়েছিলি, আসলি এখন! তুই ঠিক আছিসতো? এভাবে হাঁটছিস কেন? ” আকলিমা খানমের গলায় নিখাদ উৎকন্ঠা।
” উফ্ মম। এভাবে ঝামেলা করছ কেন! তোমার প্রশ্নের উত্তর পরে দিলেও তো হবে নাকি? সব সময় তোমার এমন ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগেনা। এসব করে কি প্রমান করতে চাও? নিজেকে আদর্শ মা ভাব নাকি! এসব ফালতু সেন্টিমেন্ট আমাকে দেখাবেনা। সামনে থেকে সর। আমাকে রুমে যেতে দাও। ” আকলিমা খানমকে ঠেলে
সরিয়ে দিয়ে, শুভ টলোমলো পায়ে নিজের রুমে যায়।
এদিকে ছেলের এমন আচরনে আকলিমা খানম স্তব্ধ। এতদিন শুভ তাকে টুকটাক কথা শোনালেও আজ সে সীমা ছাড়িয়েছে। এসব কথা তার স্বামীকে না জানালেই নয়।
সন্ধ্যার পর আরমান কান্তা ও খালার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। ওর সাথে শ্রীজা আছে। শ্রীজাকে বাসার সামনে ছেড়ে দিয়ে তবেই ও চিটাগংয়ের পথে রওনা দিবে।
প্রতিবারের ন্যায় এবারও কান্তা চোখের পানিতে আরমানকে বিদায় দিয়েছে। মেয়েটার এমন কান্না আরমান সহ্য করতে পারেনা। তাই এবার ও সব ব্যবস্থা করেই এসেছে। বাড়িওয়ালাকে জানিয়ে দিয়েছে, সামনের মাসেই ওরা বাসা ছাড়বে।
মেয়েটাকে আর এভাবে দূরে রাখতে চায়না আরমান। সে নিজেও মেয়েটার মায়ায় গভীরভাবে ডু’বে’ছে। এ মায়ার কোন তল নেই। একটা দিন মেয়েটাকে না দেখতে পেলে, এক ঘন্টা তার সাথে কথা বলতে না পারলে, নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল লাগে। এ যেন গভীর সমুদ্রে ডু’বে থাকার মত অবস্থা। যেখানে কোন অক্সিজেন নেই, নেই কোন আলো। আলো আর অক্সিজেন বিহীন প্রতিটা দিন কাটাতে হয় আরমানকে। ঠিক তেমনই মেয়েটাকে দেখার সাথে সাথে মনে হয়, এইমাত্রই গভীর সমুদ্র থেকে উপরে ভেসে উঠেছে সে। সেখানে অফুরান আলো, বাতাস। যার ছোঁয়ায় নিমেষেই উবে যায় সকল অপ্রাপ্তি।
আজকাল জাবেদের বাড়িতে শান্তি লাগেনা। মন টিকেনা বাড়ির চৌকাঠে। শিখার আবদারের শেষ নেই। আজ এটা নিব , কাল ওটা নিব, এভাবেই চলছে। নিষেধ করলেও কিছুতেই শুনছেনা।
আবার ওর ছোট দুই ভাই-বোনের যাবতীয় খরচ আবার শিখার বাবা-মা’র সকল খরচ জাবেদকে বইতে হচ্ছে।
এদিকে ওর ছোট ভাই তার সকল সম্পত্তির ভাগ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। সে আগে সংসারে টুকিটাকি খরচ দিত। কিন্তু এখন সে আলাদা হয়ে যাওয়ায় সেই টাকা আর দিচ্ছেনা। তাই শিখার আবদার আর ভাই-বোনের খরচ মেটাতে জাবেদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। শিখার বড় বোন তার বাবা-মা, ভাই-বোনের কোন খরচই দেয়না। একা একটা মানুষ দুই-দুইটা সংসার চালাতে যেয়ে কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছেনা। এ নিয়ে শিখাকে কিছু বললেই শুরু হয়ে যায় অশান্তি।
তাই সে বাড়িতে খুব একটা সময় কাটায়না। স্কুল থেকে ফিরে কোচিং করিয়ে রাত এগারোটার দিকে বাড়িতে আসে। তখনও তার শান্তি নেই। এটা লাগবে, ওটা লাগবে বলে শিখা কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে।
বেশ কয়েকদিন থেকেই বোনটার কথা মনে হচ্ছে। কিন্তু ফোন দেয়ার সাহস পাচ্ছেনা। শেষবার মেয়েটার সাথে কথা বলে, ওকে অনেক কটু কথা শুনিয়েছিল। তাই আরেকবার বোনের কাছে ফোন দিতে ওর সংকোচ হচ্ছে।
চলবে…