#কৃষ্ণডাহুক – ৩১
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)
‘ উনি মা হচ্ছেন। কংগ্রেচুলেশনস! ‘
ডাক্তারের কথায় উপস্থিত সকলে চমকালো,থমকালো! মার্জিয়ার চোখে পানি এসে পড়লো, সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো, আদ্রিক চেঁচিয়ে উঠলো! উঠে আদিলকে ফট করে জড়িয়ে ধরে বলল,’ বাবা! আমি বাবা হচ্ছি! তোমার মতন! ‘
আদিল খুশিতে জবাব দিতে পারলেন না ততক্ষণাৎ, দাদা হবেন তিনি! খুশি হবার নয় কি? ধীরে ধীরে বললেন,’ আলহামদুলিল্লাহ! এখনই মিষ্টির ব্যবস্থা করছি! সবাইকে দিতে হবে তো! ‘
আদিল দাঁড়ালেন না সেখানে যায়! হন্তদন্ত করে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। তার যেতেই মার্জিয়া চোখের জল ফেলে দিলেন সাথে সাথে, আদ্রিককে জড়িয়ে ধরে বললেন,’ কত বড় হয়ে গেছিস তুই বাবা! তুই নাকি এখন বাবা হবি! কত বড় দায়িত্ব তোর কাঁধে পড়বে! আমার সেই বাচ্চা ছেলেটা দেখতে দেখতে কতোখানি বড় হয়ে গেলো! আল্লাহ! ‘
আদ্রিক হাসলো, মীরার তখন সবে জ্ঞান ফিরেছে, সবার চিৎকার চেঁচামেচিতে যা বুঝার বুঝে নিয়েছে সে! খুশিতে চিৎকার করার মতো ও জোর পেলো না কণ্ঠে মীরা! ঠায় হয়ে বসে রইলো এক জায়গায়। তখন সাহিল এগিয়ে এলেন আদ্রিককে বললেন,’ তোমাদের মা-বাবা হওয়ার খবরটা শুনে খুশি হয়েছি আমি, অনাথ আশ্রমে খবরটা পাঠিয়ে দিও আর সাথে মিষ্টিও পাঠিয়ে দিও সেখানে। ‘
মীরা শুনলো, ধীর কণ্ঠে বলল,’ আপনারা আপত্তি না করলে একটা কথা বলতাম। ‘
সবাই উৎসুক চোখে তাকালো মীরার দিকে, মীরা বললো,’ আমি অনাথ আশ্রমে যেতে চাই, ঘুরার জন্য! আমার পরিবার নেই, ছোট থেকেই আমার বড় হওয়া সেখানে! তাই আমি চাই সেখানে যেতে যদি আপনারা আপত্তি না করেন! ‘
মার্জিয়া বললেন,’ হে আল্লাহ! এতে আপত্তির কি আছে? তুমি আমাদের এতো বড় সুখবর শোনালে আর আমরা তোমার সামান্য ইচ্ছা পূরণ করবো না! শোনো অনাথ আশ্রমে তুমি একাই যাবে না, আমরা সবাই যাবো, মিষ্টি নিয়ে! ‘
মীরা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। চুপ করে রইলো, অনুভব করতে লাগলো নতুন নতুন মা হওয়ার অনুভূতি। আস্তে করে পেটে হাতে ছোঁয়ালো, মীরার হাত কাঁপছে! হ্যাঁ তার সন্তানটা তো এখানেই! এখন থেকে আগামী কয়েকমাস এইখানেই থাকবে! তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত মূহুর্তটি দেখবে! যখন সে সজ্ঞানে এসে নিজের সন্তানকে ছোঁবে! সন্তানের কোমল, ছোট নরম হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খাবে, সন্তানকে বুকে নিয়ে প্রশান্তির সাথে চোখ বুজে নিবে। ইশ! কবে আসবে এই দিন? কবে এই স্বপ্ন পূরণ হবে?
মীরা আবেশে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো, টের পেলো না আদ্রিককে, আদ্রিক আস্তে আস্তে মীরার পাশে, শ’খানেক দূরত্ব কমিয়ে বসলো। মীরার পেটের উপরের হাতটার উপর নিজের হাতটা রাখলো। মীরা চোখ বন্ধ করেই সেই স্পর্শ চিনতে পারলো, ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা গেলো মীরার। আদ্রিক তা দেখলো, বড় শ্বাস ফেলে বলল,’ আমার নিজেকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। ‘
‘ হ্যাঁ? ‘ হচকিয়ে বলল মীরা। আদ্রিক বলল,’ খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি! আমি ভয়ংকর একটা কাজ করে ফেলবো এই মূহুর্তে! ‘
বলেই মীরার জবাবের অপেক্ষা করলো না একদমই! ফট করে মীরার মুখের কাছে নিজের মুখ নিয়ে, মীরার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে নিলো! মীরা থমকে গেলো মূহুর্তেই! মিনিটের মাঝেই আদ্রিক মীরার কাছ থেকে সরে এলো, মীরার পেটের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল,’ আজ, এই মূহুর্তে থেকে আমি হয়ে গেলাম বাবা! ‘
‘ তাহলে আপনাকে অভি-নন্দন জানানোই লাগে! ‘
‘ অবশ্যই! আমার সাথে তোমাকেও জানানো উচিত কারণ তুমিও মা হচ্ছো! ‘
মীরা হাসলো, কি সুখকর সেই মূহুর্ত!
_
‘ আমি তোমাকে, ভালোবাসি অরিন। ‘
অনয়ের কণ্ঠস্বর থমকাচ্ছে! অরিন তাকালো, সাদামাটা প্রস্তাব অনয়ের! অতি সাদামাটা, সাধারণ! গোলাপ দিয়ে প্রোপোজ করেছে! আজ কেনো জানি, ভালো লাগছে তার সব! অথচ সাদামাটা,সাধারণ কোনো কিছুই কখনো তার পছন্দ ছিলো না! সে ছিলো এক্সট্রা অর্ডিনারী! কিন্তু এইসব সাদামাটা,সাধারণ জিনিসগুলোই তার প্রিয় হয়ে উঠেছে! অনয়ের জন্য! হ্যাঁ শুরুমাত্র তার জন্য!
অরিনের ভাবনার মাঝে অনয় বলল,’ অরিন! জবান দেবেনা? ভালো লাগেনি? ‘
‘ লেগেছে। ‘
‘ উত্তর দিবে না? ‘
‘ কিছু কিছু প্রশ্নের যেমন উত্তর হয়না তেমনি কিছু প্রস্তাবেরও জবাব থাকে না। ‘
‘ তারমানে আমাকে তোমার পছন্দ নয়? ‘ মূহুর্তেই মনমরা ভাব এলো অনয়ের চেহেরায়। আড়ালে হাসলো অরিন, কিন্তু গম্ভির হয়েই বলল,’ যেসব প্রশ্নের উত্তর নেই, সেসব প্রশ্নের নিজ থেকে একটা পজিটিভ উত্তর বের করি আমরা, সেই হিসেবে যেসব প্রস্তাবের জবাব নেই সেসব প্রস্তাবের পজিটিভ উত্তর করতে হবে! উত্তর খোঁজার জন্য ব্রেন লাগবে। ‘
অনয় চমকালো! চমৎকার হাসলো উত্তর পেয়ে যাওয়ার আশায়! ফট করে উঠে অরিনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো। অরিন চমকালো, পরক্ষণেই পরম আবেশে মুখ লুকালো অনয়ের বুকে! যে বক্ষে তার শান্তি!
_
‘আজমীরা শিশুনিবাস’ ছোট এই অনাথ আশ্রমে খোদাই করে লেখা নামটি। সাহিল চশমা ঠিক করলেন, চোখ ভিজে এলো আজমীরা নামটা দেখে। সবাই ভেতরে গেলো অনাথ আশ্রমের। মীরাকে দেখেই ছোট ছোট সবাই চলে এলো, আস্তে আস্তে বড়রাও আসলো। সর্বপ্রথম এলেন, আলমগীর সাহেব, মীরার যখন ষোলো বছর তখন এসেছিলেন আশ্রমে! মেয়েটি ভদ্র! তিনি মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’ কত বড় হয়ে গেছিস! সেই ষোড়শী মেয়েটা আজ মা হবে! ভাবা যায়? মাশাল্লাহ! ‘
মীরা লাজুক হাসলো। আলমগীর এইবার আদ্রিকের কাছে এসে বললেন,’ বাবা, খুশি হয়েছি খুব খবরটা শুনে। সুখে থাকো! ‘
আদ্রিক উত্তরে হাসলো। একে একে সবাই এলো মীরার সাথে দেখা করতে, সবাই দোয়া দিলো! সবশেষে আলমগীর বললেন,’ আরেকজনের সাথে দেখা করবি? অনেক অসুস্থ! ‘
‘ কে, চাচা? ‘ মীরা বলল!
আলমগীর বললেন,’ এই অনাথ আশ্রমের মালিক! রুবাইদা আপা! উনি অসুস্থ বিছানায় পড়ে আছেন, দেখা করে যা। কয় বছর যে হলো ঘর থেকে বের হন না! বাহিরের আলো দেখেন না। তুই তো চলেই যাবি আর কবে না কবে আসবি ততদিনে চলে গেলে? উনার আর আতিফার কোলেপিঠেই মানুষ হয়েছিস! আতিফা গত হলো, উনি না জানি কবে! ‘
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আলমগীর। মহিলাটা ভালো বড্ড! ঘর থেকে বের হন না, অসুস্থার জন্য, ঘরেই পড়ে থাকেন। বয়স হয়নি ততটাও কিন্তু তারপর অসুস্থ! মৃত্যু কাছে বলেই হয়তো। রুবাইদার কথায় মীরা খুশি হলো,এই অনাথ আশ্রম যখন খোলা হয় তখন এই অনাথ আশ্রমের প্রথম অনাথ মেয়ে ছিলো সে! যার জন্য তাকে সবাই ভালোবাসতো খুব! বিশেষ করে আতিফা আর রুবাইদা। কিন্তু ৩ বছর হতে চললো মানুষটাকে দেখে না সে! তার বিয়েতেও আসেনি!
মীরার সাথে পিছে পিছে গেলো সবাই, রুবাইদার ঘরে। সবাই প্রবেশ করলো, মোটামুটি আকারের ঘর, পরিপাটি ঘর, দেয়ালের রঙ খসে পড়েছে যদিও। বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে ছিলেন রুবাইদা। গায়ে কাঁথা জড়ানো আলমগীর বললেন,’ আপা, দেখেন কে আসছে! আমাদের মীরা। ‘
ভদ্রমহিলা উঠে বসলেন এবার শোয়া থেকে। জেগেই ছিলেন বোধহয়! তাই কথাটা কানে গিয়েছে। মীরা পাশে যেয়ে তার হাত ধরলো, তিনি মীরার স্পর্শে মীরার হাত আরো শক্ত করে ধরলেন, বললেন,’ মীরা! সোনা মা! এসেছিস তুই! এতোদিন পরে এই মার কথা মনে পড়লো? ‘
চাপা স্বরে কেঁদে উঠলো মীরা। পাশ ফিরে মীরার দিকে তাকালেন। মীরার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকেই তাকালেন তখনই চোখ আটকে গেলো একজনের দিকে, অস্ফুট সুরে বললেন,
#চলবে?