ক্রাশ ইন দ্য সি পর্ব-০২

0
33

#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব_০২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

মেহেরের রুম থেকে চমৎকার গলায় গান শোনা যাচ্ছে। জাহানারা বেগম মুগ্ধ হয়ে মেয়ের গাওয়া গান শুনছেন। মেহের আজকাল গান গায়, নাচে। মুখে সবসময়ই হাসি লেপ্টে থাকে। মেয়েই আকস্মিক পরিবর্তনে তিনি খুশি হলেও চিন্তিত অনেক। মেহেরের বয়সটা সর্বনাশী বয়স। এই বয়সেই সব অঘটন ঘটে যায়।

মেহেরের রুমের সাথে বারান্দা আছে। সেখানে বসে সে মোবাইলের স্কিনে থাকা ছবিটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গুনগুন করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে। ধীরে ধীরে গলার স্বর মোটা হচ্ছে। এক সময় মেহের সবকিছু ভুলে হারিয়ে গেলো। সে দেখলো সমুদ্রের তীরে হেঁটে আসছে নেভির ইউনিফর্ম পড়া একজন যুবক। মেহের তার জন্য দাড়িয়ে আছে অন্ততকাল ধরে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যুবকটি নিজের মাথার ক্যাপটি মেহেরের মাথায় পড়িয়ে দিলো। মেহেরকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর কানে কানে বলল,

“ ভালোবাসি মেহেরুন্নেসা! ”

মেহেরের ঠোঁটের হাসি ছড়িয়ে পড়েছে সেই যুবকের ঠোঁটেও। পুরুষটি তার কপালে গভীর প্রেম নিয়ে চুম্বন করলো। তারপর হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো মাটিতে। একটি আংটিসহ হাত বাড়িয়ে মেহেরকে নিজের করে নিতে চাইলো।

“ আমার বেগম হবেন মেহেরুন্নেসা? ”

মায়ের ডাকে মেহের কল্পনা থেকে বেরিয়ে এলো। তার গলায় তখনও রবীন্দ্র সঙ্গীত। দ্রুত হাতে প্রিয় আইডির ইনবক্সে টাইপ করে পাঠিয়ে দিলো উক্ত সঙ্গীতের কয়েক লাইন।

“ ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে,
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে,
আমারো পরাণে যে গান বাজিছে, তাহার তালটি শিখো তোমার চরণ মঞ্জিরে…. ”

মোবাইল রেখে মেহের চোখমুখ স্বাভাবিক করলো। তার চোখে জল জমেছিল। দরজা খুলে হাসি মুখে দাড়িয়ে রইলো। জাহানারা বেগম গালে হাত রেখে বললেন,

‘ খেতে আয়। ’

মা চলে যেতেই মেহের আবারও দরজা দিলো। মোবাইল হাতে নিয়ে ইনবক্সে গেলো। তার সব মেসেজই বাংলাতে করা। সে জানে না কখনও তার মেসেজ রিকুয়েষ্টে লেখা মেসেজ গুলো আইডির মালিক দেখবে কি না। উর্দুতে টাইপ করতে পারলেও মেহের নিজের ভাষাতেই মনের কতশত অনুভূতি মেসেজে লিখে পাঠিয়েছে। সেগুলো কি কখনও বুঝতে পারবে ওই মানুষটি?

মেহের একটি মেসেজ টাইপ করলো,

“ আপনার মনে কি কখনও আমার জায়গা হবে? আপনি কি কখনও জানতে পারবেন আমি কে? কখনও আগ্রহ দেখিয়ে কথা বলবেন আমার সাথে? আপনার জন্য পাগল একটি মেয়েকে কি ঠাঁই দিবেন নিজের জীবনে? ”

কত-শত মেসেজের মতো এটাও পড়ে রইলো সেই রিকুয়েষ্ট অপশনে। মেহেরের ফুরফুরে মনটা বিষন্নতায় ভরে গেলো। রাতের খাবার খেয়ে এসে চেক করে দেখে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমের মধ্যে সে নানানরকম স্বপ্ন দেখলো। এরকম সবসময়ই দেখে। তবে আজকের টা একটু অন্যরকম। একটি পুরুষালি হাত তার গালে হাত রেখে ফিসফিস করে ডাকছে,

“ মেহেরুন্নেসা, আমার বেগম চলে এসো আমার কাছে। চলে এসো। আমি যে অপেক্ষায় তোমার। ”

মেহেরুন্নেসা যখন চোখ মেলে তাকিয়েছে তখন আশেপাশের মসজিদে আজান হচ্ছে। কয়েক মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে মেহের নামাজের পর বই নিয়ে পড়তে বসলো। এক ফাঁকে সেই আইডিতে লিখে পাঠালো,

“ শুভ সকাল। আমার আজ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে। আমি দেখলাম একটি পুরুষালী হাত আমার গাল ছুয়ে আমাকে ডাকছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সে আপনি। আচ্ছা আপনি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন? আমি কিন্তু আপনার কাছে আসবো। অবশ্যই আসবো। অপেক্ষা করুন হ্যাঁ? ”

মেহের জানে না সে ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে কি না। মা সন্দেহ করছেন। তার উড়ু উড়ু ভাব দেখে যে কেউই সন্দেহ করবে। মেহের স্বভাবতই চঞ্চল৷ কিন্তু আজকাল অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। বাহিরে খুব কমই থাকে। সারাক্ষণই ঘরে চুপটি করে বসে থাকতে তার ভালো লাগে। আজ শুক্রবার হওয়ায় কলেজে যাওয়ার তাড়া নেই। মেহের ঠিক করলো সে দুপুরের পর মায়ের একটি শাড়ি পড়বে। কিন্তু সেটা আর হলো না। সকাল নয়টার পরই শায়লা এসে উপস্থিত। একগাদা নোটস নিয়ে এসেছে। জাহানারা বেগমকে বলেছে,

“ আমরা আজ বিকেল পর্যন্ত একসাথে পড়বো আন্টি।”

ব্যস। জাহানারা বেগম খুশি হয়ে একটু পর পর এটাসেটা মেয়ের রুমে দিয়ে যাচ্ছেন খাওয়ার জন্য। শায়লাও সেগুলো গিলছে। মেহের দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নোটসে মনোযোগ দিলো। তার গোমড়া মুখ দেখে শায়লা জিজ্ঞেস করলো,

“ মুখটা অমন পেঁচার মতো করে রেখেছিস কেন? ”

মেহেরের বলতে ইচ্ছে করলো,

“ তুই প্লিজ চলে যা। আমি একা থাকতে চাই। ”

কিন্তু বলা হলো না। বরং মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ দোস্ত ভেবেছিলাম আজ শাড়ি পড়বো। কিন্তু তুই একগাদা নোটস নিয়ে এসেছিস পড়ার জন্য। শাড়ি পড়ার কথা বললে মা আমাকে আস্ত রাখবে না। ‘

শায়লা চোখ বড়বড় করে ফেললো। মেহের গোমড়া মুখে বলল,

‘ এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? ’

‘ সিরিয়াসলি দোস্ত? তুই শাড়ি পড়বি! আমি কি ঠিক শুনছি? ’

‘ তার মানে কি? আমি শাড়ি পড়তে চাইতে পারি না? ’

‘ নবনীবরণে এতো করে বলেও শাড়ি পড়াইতে পারি নাই। সেই তুই কি না আজ নিজ থেকে শাড়ি পড়ার কথা ভেবেছিলি। কাহিনি কি মামা? ’

‘ কোনো কাহিনি নেই। ‘

শায়লা মেহেরের মুখ এদিক সেদিক ঘুরিয়ে বলল,

‘ তুই কি সিরিয়াস? ’

‘ কোন বিষয়ে? ’

‘ ফেসবুকের সেই ক্রাশটার বিষয়ে। ‘

মেহের দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। দীর্ঘ ছয়মাস তাকে এই প্রশ্নটা অনেকবারই শুনতে হয়েছে। তবুও প্রতিবারের মতো উত্তর দিলো,

‘ সবটুকু দিয়ে সিরিয়াস দোস্ত। ছয়দিন আইডি বন্ধ ছিল আমার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়েছিল। ’

শায়লার মুখে কালো মেঘ জমলো। বান্ধবীর জন্য মায়া হলো তার। প্রতিবারের মতো এবারও বলল,

‘ এসব বাদ দে না দোস্ত। পাকিস্তানের অফিসার সে। তুই বাংলাদেশি ভুলে যাস কেন? যদি এমনি সাধারণ পাবলিক হতো তবে আমার এতো চিন্তা হতো না বিশ্বাস কর। তুই আমাদের দেশের আর ওদের দেশের ইতিহাস জানিস না? ওই দেশের একজন দক্ষ অফিসার হয়ে বাংলাদেশের কাউকে পাত্তা দিবে বলে তোর মনে হয়? আর সে তো তোর মেসেজই কখনও দেখেনি। জানেও না তোর অনুভূতি সম্পর্কে। কতোদিন অপেক্ষা করবি? ’

‘ যতোদিন সে রিপ্লাই না করে ততোদিন। ’

‘ ধর কখনোই রিপ্লাই করলো না। তবে? সারাজীবন অপেক্ষা করে থাকবি? তুই ভুলে যাস কেন তুই আঙ্কেল আন্টির একমাত্র মেয়ে? ’

মেহের বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। শায়লার বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। মেহেরকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো।

‘ দোস্ত আমি বলছি না যে এখনই এসব থেকে বেরিয়ে আয়। তুই চেষ্টা কর। সামনে আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা। আইডি ডিলিট করে এসব থেকে বেরিয়ে আয়। পরীক্ষার পর অনলাইনে এক্টিভ হবি না-হয়। ’

‘ শায়লা! ’

‘ হু? ’

‘ তুই কখনও কাউকে ভালোবেসেছিস? একটা মানুষ কেমন আছে কি করছে তুই জানিস না। কিন্তু প্রতিদিনের মোনাজাতে দোয়া করছিস মানুষটা যেন সবসময়ই ভালো থাকে। সুস্থ থাকে। শায়লা এটাকে কি ভালোবাসা বলে? ’

শায়লা জবাব দিতে পারলো না। মেহের কাঁপা ঠোঁটে বলল,

‘ আমি যতোক্ষণ তার কোনো পোস্ট না দেখি ততোক্ষণ শান্ত থাকতে পারি না। তুই জানিস শায়লা? তার একেকটা পোস্ট আমার মনে শান্তি ফিরিয়ে আনে। আমাকে বলে দেয় সে বেঁচে আছে, সুস্থ আছে। ’

শায়লা স্তব্ধ হয়ে গেলো। মেহেরের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ বিগত কয়েকদিন আমার কিভাবে কেটেছে আমি জানি না রে। ’

শায়লার গলা কাঁপছে,

‘ এ কেমন ভালোবাসায় তলিয়ে গেলি দোস্ত! ’

মেহের তখন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। তার গলায় করুণ স্বর,

“ ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে… ”

(চলবে)