#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব_০৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
পরদিন সকালে মায়ের সাথে ঢাকা ফিরে আসে মেহের। শুরু হয় তার নিত্যদিনের রুটিনে চলা৷ সকালে কলেজে যাওয়া, দুপুরে বাসায় ফিরে গোসল করে খেয়ে তারপর শায়লার সাথে কোচিং এ যাওয়া। বিকেলে পেরিয়ে যাওয়ার পর বাসায় ফেরা। সন্ধ্যার পর আবারও পড়তে বসা। তার মানে এই নয় সে আমানকে মনে করে না৷ আমান তো তার মনে থাকে। সে প্রতি সেকেন্ড আমানকে মনে করে। উচ্চতর গণিতের সূত্র গেঁটে ফেলে আমানকে ভেবে। তার এই রুটিনের জীবনের মধ্যে পড়ার ফাঁকে খাওয়ার ফাঁকে সে আমানকে মেসেজ পাঠায়। অস্থির মন বার-বার প্রোফাইল চেক করে যদি কোনো পোস্ট আসে। কিন্তু নাহ্ আমানের আইডিতে আর কোনো পোস্ট করা হয়নি। মনে নানান ভয় কাজ করে। সে ঠিক আছে তো? ক্লাসের মনোযোগী ছাত্রীটাও হুট করে অমনোযোগ ও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। কোচিং এর সেরা ছাত্রীটাও সামনের সিট রেখে পেছনে বসে। কখনো একা কখনো বা শায়লাকে নিয়ে। মেহের নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে অনেক। তার দুনিয়ায় মা, বাবা ও আমান ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব নেই। শায়লা ও পাভেল কে সে মাঝেমধ্যে ভুলেই যায়। শায়লা সারাক্ষণ কানের কাছে জ্ঞান দিতে থাকে৷ তিনজন যখন কলেজ ক্যান্টিনে একসাথে হয় তখন ওই দুজন তাকে নিয়ে মজা নিতে ছাড়েনা। ওরা হয়তো ভাবে মজাই তো করছি। কিন্তু ওরা জানে না ওদের এই মজাটাও মেহেরের মনে কি তীব্রভাবে আঘাত করে। এইতো গতকাল পাভেল আমানের ক্যারেক্টার নিয়ে বলছিল। পাকিস্তানের ছেলে, তার উপর এতো বড় অফিসার। টিস্যুর মতো হয়তো মেয়েদের সাথে ডেট করে বেড়ায়। শুনে মেহের রেগে গেছিল। তার চোখ ছলছল করছিল। পাভেল অবশ্য পরে সরি বলেছিল। কিন্তু তাতে কি যায় আসে? মেহের সেই থেকে উদ্বিগ্ন। যদি সত্যিই আমানের জীবনে কেউ থেকে থাকে? এমন ভাবনা আগে যে মনে আসেনি এমন নয়। এসেছিল, তবে মেহের গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু পাভেলের নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ায় মনে চাপ লেগেছে৷ সত্যিই কি আমান অন্য কারো? মেহেরের কোনো অস্তিত্বই কি ওই পুরুষের জীবনে থাকবে না?
মেহের বই বন্ধ করে মোবাইল হাতে তুলে নিলো। টাইপ করে পাঠালো,
‘ প্রিয় আমান, সমুদ্রে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে তোমার কি প্রিয় মুখ মনে পড়ে না? মৃত্যুর মুখে দাড়িয়ে শেষ বারের মতো কাউকে এক নজর দেখতে ইচ্ছে করে না? মনে হয় না তোমার কাউকে তীব্র ভালোবাসা উচিত? তোমার ওয়ালেটের একপাশে কারো ছবিই কি নেই? নাকি আছে, অথচ সে আমি নই! ’
‘ তোমার ব্যাপারে তো জানি না। তবে আমারটা বলি? চট্টগ্রাম থেকে এসে আমি তোমার একটা ফটো বের করেছি৷ আমার স্কুল ব্যাগে খুব যত্নে লুকিয়ে রাখি সেটাকে। মাঝে মধ্যে দরজা বন্ধ করে সেটা হাতে নিয়ে তোমার সাথে কথা বলি। আমি যেখানেই যাই সেখানেই তুমি থাকো। আমার সাথে, আমার অনুভবে মিশে। ’
‘ দেখেছো? আপনি থেকে তুমিতে চলে গেছি। সাত মাসের আপনি ডাকের সমাপ্ত হলো তবে। আমি তোমাকে আজ থেকে তুমি করেই বলবো। ’
জাহানারা বেগম দরজায় করাঘাত করলেন।
‘ মেহের? ’
মেহের মোবাইল টা বালিশের নিচে রেখে দিলো। তারপর পড়ার টেবিলে বসলো বই খুলে।
‘ এসো মা। ’
জাহানারা নুডুলস এর বাটিটা রাখলেন। মেয়ের চুল গুছিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ খেয়ে নে আগে। বিকাল হয়ে এসেছে। আজ তো ছুটির দিন এতো চাপ নিতে হবে না। ’
*
গোধূলি এক বিকেল। কর্নেল মাসুদ রানা তার অফিসের ডেস্কে বসে আছেন। বাইরে রোদের আলো ধীরে ধীরে কমে আসছে। চায়ের কাপ পাশে রেখে তিনি তার বিশ্বস্ত সহকারী মেজর ফারুককে নির্দেশ দিলেন,
‘মেজর, পাকিস্তানের নৌবাহিনী সদর দপ্তরে একটি বার্তা পাঠাতে হবে। একজন অফিসারের বিষয়ে জানতে চাইছি। ’
মেজর ফারুক মাথা নেড়ে বললেন, ‘ জি স্যার, আমি প্রস্তুত। ’
কর্নেল নিজেই বার্তার খসড়া তৈরি করলেন। এতে কোনো আবেগের ছাপ ছিল না, একেবারে আনুষ্ঠানিক ভাষায় লেখা,
‘ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান খান সাম্প্রতিক দায়িত্ব এবং পেশাগত প্রোফাইল সম্পর্কে তথ্য প্রেরণের অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রয়োজন হলে আমাদের সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সহযোগিতার জন্য আলোচনার প্রস্তাব রাখা যেতে পারে। ’
সন্ধ্যায় বাবার সাথে কথা বলতে গিয়ে মেহের জানতে পারলো বিষয়টি। মনে দারুণ এক উত্তেজনা তার। কর্নেল মাসুদ রানা বললেন,
‘ শীগ্রই তার বিষয়ে সব চলে আসবে। ’
মেহের বাবার সাথে কথা শেষ করে মোবাইল বুকে চেপে ধরে বসে রইলো। অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে? ’
পাকিস্তানের করাচি নৌ নিবাসে যখন বার্তাটি পৌঁছাল, তখন এটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হলো। এমনিতে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে পেশাদার যোগাযোগ থাকলেও এটি কিছুটা ব্যতিক্রমী মনে হলো। বার্তাটি সরাসরি নৌবাহিনীর একটি উচ্চপদস্থ কমান্ডারের কাছে পাঠানো হলো।
সেখান থেকে নির্দেশ এলো, ‘লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান মির্জার বর্তমান দায়িত্ব এবং সাম্প্রতিক রেকর্ড প্রস্তুত করুন। প্রয়োজন হলে তাকে সরাসরি জানিয়ে দিন। ’
একদিন সকালে, আমান তার শিপে দায়িত্ব পালন করছিল। তখন এক জুনিয়র অফিসার এসে জানাল,
‘ স্যার, এক পায়গাম আয়া হ্যায়। বাংলাদেশ আর্মি আপ কি বারেহ মে জান্না চাহতি হ্যায়। ’
আমান কিছুটা অবাক হলো। ‘বাংলাদেশ আর্মি? কিউ?’
কিন্তু তার পেশাদার মনোভাবের কারণে সে বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই নিল।
‘ উনকো জরুরি মালুমাত ভেজ দো। কোই মদদ জরুরত হো তো বতানা। ’
*
পাকিস্তান নৌবাহিনী, হেডকোয়ার্টার, اسلام آباد (Islamabad) থেকে মাসুর রানার নিকট মেইল গেলো।
পাকিস্তান নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে আপনাকে জানানো যাচ্ছে যে, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান খান সম্পর্কে আপনার অনুরোধ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠানো হলো।
আমান খান বর্তমানে পাকিস্তান নৌবাহিনীর একজন দায়িত্বশীল এবং অত্যন্ত দক্ষ অফিসার। তার সামরিক ক্যারিয়ার পর্যালোচনা করে আমরা নিচের তথ্য প্রদান করছি:
1. পেশাদার দক্ষতা:
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান খান একজন অভিজ্ঞ এবং উচ্চমানের অফিসার, যার পেশাদারী রেকর্ডে কোনো বিতর্ক নেই। তার নেতৃত্বে একাধিক অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, বিশেষ করে জলদস্যু দমন এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে।
2. অভিযান এবং প্রশিক্ষণ:
তিনি বিভিন্ন সমুদ্র অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন, এবং বিভিন্ন সেনা ও নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণে তার যোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছে। তার সামরিক কৌশল এবং নেতৃত্বের গুণাগুণ প্রশংসনীয়।
3. বিশ্বস্ততা এবং নেতৃত্ব:
তিনি একজন বিশ্বস্ত এবং ধারাবাহিকভাবে সফল অফিসার। তার মধ্যে নেতৃত্বের এক অনন্য গুণ রয়েছে, যা তাকে তার সহকর্মীদের মধ্যে শ্রদ্ধার স্থান এনে দিয়েছে।
4. বিশেষ অর্জন:
তিনি নৌবাহিনীর “অ্যাকশন মেডেল” এবং “গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড” অর্জন করেছেন, যা তার সাহসিকতা এবং নেতৃত্বের প্রশংসা স্বরূপ।
আমাদের পক্ষ থেকে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান খান সম্পর্কে আরও কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রয়োজন হলে, দয়া করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
অপেক্ষায় রইলাম।
সৌজন্যে,
পাকিস্তান নৌবাহিনী
ইংরেজি মেইলটি পড়ে সেটা বাংলাতে টান্সলেট করে তিনি মেহের কে পাঠালেন। মেহের সেদিন কলেজ কোচিং শেষে বাড়িতে ফিরে সবে সন্ধ্যার নাস্তা করতে বসেছিল। তখনই তার মোবাইলে মেইল আসে। মেইলটি পড়ে তার মাথায় হাত। এসব তো সে জানেই। আমানের প্রোফাইল ঘুরলেই কিছু কিছু জানা যায়। সে তো ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাইছিল। হতাশ মেহেরের গলা গিয়ে নাস্তা ঢুকলো না। বাবাকে ও সে কিছু বলতে পারবে না। কারণ পেশার দিক থেকে বাবা এর থেকে বেশি কিছু করতে পারবেন না। আর কারও ব্যক্তিগত জীবনে কারও নাক গোলানোর অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি।
(চলবে)