#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব_০৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
“ জ্বলসে যাব জানি, মানছে না মনখানি
পাবো না জেনেও মিছি মিছি কেন তোমাকেই ছুঁতে চাই…
আমি কেন বার-বার প্রেমে পড়ে যাই? ”
বিকেল পর্যন্ত নোটস পড়ার কথা থাকলেও পড়া হলো না। শায়লাকে দিয়ে মাকে পটিয়ে শাড়ি পড়ে রুমে দরজা লাগিয়ে দুজন নাচছে। শায়লা হাঁপিয়ে বিছানায় বসে পড়লো।
আকাশী রঙের শাড়ি পরিহিত মেহের মোবাইল হাতে নিয়ে নাচছে। নাচের তালে ঠোঁট নড়ছে। গুনগুন করতে করতে মাঝে মধ্যে মোবাইল স্কিনে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিচ্ছে। শায়লা ফ্যালফ্যাল করে বান্ধবীর নির্লজ্জতা দেখছে। শায়লার মুখ লাল হয়ে গেলো। হাত ধরে টেনে বসালো মেহেরকে।
‘ মোবাইলের কাঁচে ভাঙন ধরে যাবে দোস্ত। ’
মেহের একটা ঘোরে চলে গেছে। বলল,
‘ ধরে যাক। ’
শায়লা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ ওহ্ দোস্ত বাস্তবে ফিরে আয়। কি কল্পনা করছিস তুই?’
মেহেরের জড়ানো গলা,
‘ দোস্ত সে যদি কখনও আমার সামনে আসে আমি সেদিন মরে যাবো নিশ্চিত। ’
শায়লা চোখ বড়বড় করে তাকালো। মেহের বলল,
‘ আমি তাকে এক পলক দেখার জন্য শতসহস্র বার মরে যেতে রাজি। ’
শায়লা কপাল চাপড়িয়ে ব্যাগ থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করলো। বলল,
‘ বাস্তবে ফিরে আয়। এটা দেখ। ’
মেহের তখনও বলে চলেছে,
‘ আমি দেখছি সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না দোস্ত। ’
‘ প্লিজ কল্পনা থেকে বের হো। ’
মেহের মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে শায়লার দিকে তাকালো। তার চোখ থেকে অশ্রুর বন্যা নেমে এলো। ঢুক গিলে বলল,
‘ সে যদি আমাকে কখনও এসে ছুঁয়ে দেয়, সেদিন বোধহয় অক্সিজেনের অভাবে আমার মৃত্যু হয়ে যাবে। ’
‘ তুই থামবি? ’
‘ আমি এখনই তাকে ভাবলে শ্বাস নিতে পারি না। আমাকে আজীবন শ্বাসকষ্টের রোগী বানিয়ে দেওয়ার অপরাধে সে কি শাস্তি হিসেবে আমাকে একটু ছুঁয়ে দিতে পারে না ? ’
শায়লা কঠিন স্বরে বলল,
‘ না পারে না। তুই কল্পনার জগতে বাস করছিস। কোথায় তুই আর কোথায় সে। সে সুদূর দেশের রাজকুমার। কোন সমুদ্রে জাহাজ ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে কে জানে। সমুদ্রের গভীরে কখন হারিয়ে যাবে কেউ জানে না। ’
বাস্তবতায় আছড়ে পড়লো মেহের। শায়লা পাশে বসে কাগজটি দেখিয়ে বলল,
‘ এটা আমাদের ক্লাসের আদনান দিয়েছে। ’
‘ কেন? ’
‘ পড়েই দেখ। ‘
মেহের তীব্র অনিচ্ছায় কাগজের ভাজ খুললো। বিরবির করে পড়ে কাগজটি টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললো। শায়লা বলল,
‘ তোকে দেওয়ার আগে আমিই পড়েছি। ও তোকে পছন্দ করে। ’
মেহের নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
‘ এরপর থেকে কেউ এসব দিলে হাতেও নিবি না। ’
‘ আচ্ছা। কিন্তু দোস্ত.. ’
‘ কোনো কিন্তু নয়। ’
শায়লা মিনমিন করে বলল,
‘ রেগে যাচ্ছিস কেন? ’
‘ ওর কত বড়ো সাহস আমাকে লাভ-লেটার দেয়! ’
‘ দিতেই পারে। ’
মেহের ফুঁসে উঠলো,
‘ না পারে না। আমার দিকে তাকালে আমি ওর চোখ তুলে ফেলবো। ’
‘ আরে রিলাক্স। পছন্দ করতেই পারে। তাতে কি আসে যায়? ’
‘ আসে যায়। আমাকে একজন ছাড়া আর কেউ পছন্দ করতে পারবে না। কারও অধিকার নেই আমাকে পছন্দ করার। ’
‘ এটা কিন্তু ওভার হয়ে যাচ্ছে মেহের। আমি বলে হয়তো তোর পরিস্থিতি বুঝতে পারছি। বাট অন্য কেউ শুনলে তোকে পাগল ভাববে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখ। ‘
মেহের এমন ভাবে শায়লার দিকে তাকালো যে শায়লা ভয় পেয়ে গেলো। অপমানবোধ করে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে গেলো মেহেরদের বাসা থেকে।
মেহের শাড়ি খুলে নিচে ফেলে দিলো। মাথার চুল টেনে কাদলো কিছুক্ষণ। জাহানারা বেগম বিকেলের এই সময়টা ঘুমিয়ে কাটান। মেয়ের কান্নার স্বর কানে যেতেই ঘুম ছুটে গেলো তার। মেয়ের রুমে এসে হায় হায় করে উঠলেন।
‘ মেহের! আম্মা কি হইছে? ’
মেহের ঠোঁট ফুলিয়ে আহ্লাদী হয়ে ডাকলো,
‘ মা! ’
জাহানারা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এলোমেলো চুলে হাত ভুলিয়ে বললেন,
‘ তোর কি হয়েছে মেহের? মাকে বল সোনা। ’
মেহেরের কান্নার স্বর বাড়লো। অনেকক্ষণ কাঁদার পর তার শরীর ছেড়ে দিলো। জাহানারার চোখে জল চলে আসলো।
‘ তোর এ কি হলো মেহের! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে সোনা? মাকে বল? ’
ভীষণ চঞ্চল, নরম প্রকৃতির মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা গেলো। জাহানারা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন।
‘ তার চঞ্চল মেয়েটা ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেলো কেন? ’
মেহের এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জাহানারা শায়লাকে ফোন করলেন। শায়লা মেহেরের অবস্থার কথা জেনে আঁতকে উঠলো। সামান্য একটি লাভ লেটার পেয়ে কেউ এমন পাগলামি করে!
‘ আমি তো কিছু জানি না আন্টি। ’
‘ ও তো তোমাকে সব বলে মা। আমাকে বলতে পারো। আমি তো তোমাদের বন্ধুর মতোই। ’
‘ আসলে আন্টি! আমাদের ক্লাসের একটি ছেলে মেহেরকে লাভ লেটার দিয়েছে। সেটা দেখার পর থেকে ও অদ্ভুত বিহেভ করছিল। ’
‘ ঠিক আছে মা। আমি তবে রাখছি। ’
জাহানারা ফোন রেখে মেয়ের পাশে বসে রইলেন। সামান্য একটি লাভ লেটার পেয়ে মেহের কান্না করতে পারে এ অসম্ভব।
রাতে মেহেরের ঘুম ভাঙতেই তিনি চেপে ধরলেন। মেহের আমতা আমতা করলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
‘ আমার মুড সুইং হয়েছিল মা। ’
জাহানারা আশ্চর্য হয়ে বললেন,
‘ তোমার কথাটা কতোটা যুক্তিযুক্ত মেহের? ’
মেহের অসহায় গলায় বলল,
‘ জানি না মা। তবে আমার এমন মুড সুইং মাঝে মধ্যেই হয়। ’
‘ কবে থেকে? ’
‘ অনেক মাস ধরেই। ’
জাহানারা চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
‘ তোমার তখন ঠিক কিরকম ফিল হয়? ’
সিরিয়াস কথা বলার সময় জাহানারা তুমি বলে সম্মোধন করেন। মেহের শুঁকনো ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে বলল,
‘ আমার অনেক একা লাগে মা। দমবন্ধ হয়ে আসতে চায়। সবকিছু অসহ্য লাগে। কাউকে সহ্য হয়না। ’
‘ তোমার কেন এমন হচ্ছে তুমি কি বুঝতে পারছো? ’
‘ আই থিংক একটু ঘুরাঘুরি করলে ঠিক হয়ে যাবে। ’
জাহানারা ভাবলেন। মেহের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। সারাক্ষণই পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থাকে। কোথাও তেমন যাওয়া আসা করে না। অনেকদিন এক রুটিনে থাকতে থাকতে হয়তো একঘেয়েমি চলে এসেছে।
‘ তোমার বাবা কোয়ার্টারে আমাদের কবে থেকেই বেড়াতে যেতে বলেন। তোমার সামনে পরীক্ষা সেজন্য যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। আগামীকাল আমরা চট্টগ্রামে যাবো। কয়েকটা দিন ঘুরবো। ’
মেহের মাথা নাড়ালো। জাহানারা দীর্ঘক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর চলে গেলেন। মেহেরের বাবা কর্নেল মাসুদ রানা চট্টগ্রামে চাকরিসূত্রে থাকেন। কখনও তিনি ঢাকা আসেন, তো কখনও স্ত্রী সন্তানকে চট্টগ্রামে আসতে বলেন। মেহেরের পরীক্ষার জন্য এইবার যাওয়ার সিদ্ধান্তটা বাদ দিতে হয়েছিল। কিন্তু মেয়ের মন ভালো করতে জাহানারা সিদ্ধান্তটা আবারও নিলেন। সবার আগে মেয়ের মন ভালো হওয়াটা জরুরি। এরকম হতে থাকলে মেহের পড়াশোনায় মন দিতে পারবে না।
মা চলে যেতেই মেহের হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইলো। তার পড়োনে ব্লাউজ ও জিন্স। পেটিকোট পড়েনি সে। শরীরে একটি কাঁথা জড়ানো। মেহেরের চোখ থেকে টপটপ করে পানি কাঁথার উপর পড়তে লাগলো। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে আবারও ফেসবুক গিয়ে সেই ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। যেটা তখন শায়লা চলে যাওয়ার পরই দেখেছিল সে।
ফর্মাল গেটআপে দাড়িয়ে থাকা পুরুষটা পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির কাঁধ জড়িয়ে ধরে রেখেছে। দুজনের মুখে মুচকি হাসি। নিচে ক্যাপশনে ‘ হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার’ লেখা। মেয়েটির মুখে একটি ইমোজি। মেহের প্রিয় আইডির ইনবক্সে লিখে পাঠালো,
‘ আপনি অন্য কাউকে ছুঁয়ে দিলে আমার শরীরে কাঁটার আঘাত পাওয়ার মতো যন্ত্রণা হয়। ’
(চলবে)