ক্রাশ_ইন_দ্য_সি পর্ব-০৭

0
25

#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব_০৭
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

অন্ধকার রাত। ভারত মহাসাগরের উত্তাল ঢেউয়ে ঝড়ের মতো একটি ছোট যুদ্ধজাহাজ এগিয়ে চলেছে। এটি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান নেভির একটি মিশন। তাদের কাজ একদল জলদস্যুকে আটকানো, যারা একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজকে হাইজ্যাক করেছে এবং জাহাজটি তাদের ঘাঁটিতে নিয়ে যাচ্ছে।

জাহাজের ব্রিজে দাঁড়িয়ে আমান খান গভীর চিন্তায় মগ্ন। পরিস্থিতি জটিল। জলদস্যুরা তাদের হাতে থাকা বাণিজ্যিক জাহাজে ২০ জন ক্রু সদস্যকে বন্দি করেছে এবং যে কোনো মুহূর্তে তাদের ক্ষতি করতে পারে। তার ওপর রাতের ঘন কালো অন্ধকার, বজ্রপাতের গর্জন এবং সাগরের ভয়াল ঢেউ মিশনকে আরো কঠিন করে তুলেছে।

জাহাজে থাকা রাডার সংকেত দেখাচ্ছে, জলদস্যুর জাহাজ মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে। আমান দ্রুত একটি কৌশলগত পরিকল্পনা করে তার টিমকে নির্দেশ দেন। নীরবে কাছাকাছি যেতে হবে, কিন্তু ধরা পড়া যাবে না। মিশনটি দুঃসাহসিক হলেও, আমানের অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাস তার টিমকে উজ্জীবিত করে।

কিছুক্ষণ পরে তাদের যুদ্ধজাহাজ জলদস্যুর জাহাজের কাছাকাছি পৌঁছায়। সাইলেন্ট মোডে নেভিগেশন চালু রেখে তারা পানির নিচে সাবমারসিবল ড্রোন পাঠায়, যাতে জাহাজের নিচের কাঠামো ও অস্ত্রের তথ্য পাওয়া যায়। তথ্য অনুযায়ী, জলদস্যুদের কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে।

আমান সিদ্ধান্ত নেন, সরাসরি আক্রমণ নয়। প্রথমে তারা ধোঁয়া বোমার মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে, এরপর তার টিম তিন দিক থেকে আক্রমণ চালাবে।

যখন ধোঁয়া বোমা নিক্ষেপ করা হয়, তখনই জলদস্যুরা বুঝতে পারে তারা তাড়া খাচ্ছে। গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসে। বন্দিদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে আমান তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করেন। তিনি নিজেই একটি ছোট র‍্যাপিড বোটে করে আরো তিনজন নেভি কমান্ডো নিয়ে জলদস্যুর জাহাজে উঠেন।

জাহাজের ডেকে লড়াই শুরু হয়। জলদস্যুরা সংখ্যায় বেশি এবং তাদের পেছনে প্রাণঘাতী লক্ষ্য। কিন্তু আমান ও তার টিম প্রশিক্ষণে পারদর্শী। আমানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং সুনিপুণ শারীরিক কৌশল কাজে আসে। একের পর এক জলদস্যুকে তারা নিস্তেজ করে।

ঠিক যখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে, তখন জলদস্যুদের নেতা বন্দিদের জিম্মি করে একটি বিস্ফোরক ডিভাইস সক্রিয় করার হুমকি দেয়। আমান ধৈর্য ধরে নেতার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। তার ঠান্ডা মাথার কৌশল এবং নেতার মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা কাজে আসে। ধীরে ধীরে আমান তাকে বিশ্বাস করিয়ে দেন, তাদের পালানোর সুযোগ আছে।

জলদস্যুদের নেতা অবশেষে আত্মসমর্পণ করে। বন্দিরা মুক্ত হয়, জলদস্যুরা গ্রেফতার হয়, এবং মিশন সফল হয়।

জাহাজে ফিরে, আমান তার টিমের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটি হাসি দেন। কিন্তু তার চোখে ক্লান্তির ছাপ। তিনি জানেন, সমুদ্র যেমন রহস্যময়, তেমনই বিপদসংকুল। এই মিশন তাকে আবার মনে করিয়ে দিল, একটি সিদ্ধান্তে শুধু একটি মিশন নয়, অনেকের জীবন নির্ভর করে।

সমুদ্রের জলের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আমান ভাবলো, তার নিজেরও জীবন নির্ভর করে। আম্মি ও তার পরিবারের সবাই তাকে ভালোবাসে। তার কিছু হলে সকলেই কষ্ট পাবেন৷ পিছুটান বলতে আমানের আপাতত এতোটুকুই।

মেহেরের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে তিনদিন হলো। তার মোবাইল জাহানার কাছে। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল হাতে নিতে পারবে না সে। সারাদিন পরীক্ষা, পড়াশোনা করে মধ্যরাতে যখন বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় তখন তার বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠে। বিগত কতদিন সে আমানকে একটাও মেসেজ করতে পারেনি। কতদিন আগে সমুদ্রের মধ্যে জাহাজে রিলাক্সে দাড়িয়ে থাকা একটি ছবি পোস্ট করেছিল আমান। সেটা দেখেই সে স্বস্তি পেয়েছিল মনে। কিন্তু এ কদিন ধরে তার কোনো খোঁজ নিতে পারছে না মেহের। মন সারাক্ষণই গুমরে মরে। অনেকবার অনুনয় করে মায়ের কাছে মোবাইল চেয়েছে। জাহানারা বারবারই অবাক বিস্ময় নিয়ে বলেছেন,

‘ তুমি তো এমন ছিলে না। পরীক্ষা চললে তুমি নিজেই আমার কাছে মোবাইল জমা দিয়ে দিতে। কি হয়েছে তোমার? ’

মেহের কিছু বলতে পারে নি। কি বলবে সে? যে মা আমার একজনকে মেসেজ করা প্রয়োজন। সে কোনো পোস্ট করেছে কি না, স্টোরি দিয়েছে কি না দেখা প্রয়োজন। সমুদ্রের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা সেই পুরুষ বেঁচে আছে কি না, তার কিছু হলো কি না। সবই যে ওই একটাতেই দেখা ও বোঝা সম্ভব। মা নিশ্চিত তাকে চড় মারতেন। বলতেন, নির্লজ্জ মেয়ে। ’

রাতের আঁধারে কলেজ ব্যাগ থেকে আমানের সেই ফটো বের করে চোখের জল ফেললো মেহের। তার একটি গোপন ডায়েরি আছে। মেসেজে অনুভূতি লিখে পাঠাতো বলে সেটাতে মাঝে মধ্যেই সে আমানকে নিয়ে লিখতো। মোবাইল থেকে দূরে থাকায় এ কদিন ধরে সে ডায়েরিতেই আমানকে নিয়ে লিখে। আজও লিখলো। ডায়েরির পাতাগুলো তার চোখের পানিতে ভিজে উঠলো। মেহের চোখ মুছে বার-বার লিখলো, কতশত অব্যক্ত কথা সেগুলো। অব্যক্ত অনুভূতি। যা আমান কখনও জানবে কি না কেউ জানে না। পৃথিবীতে তো কতরকমই মিরাক্কেল ঘটে। একদিন কি আমানের সাথে তার দেখা হয়ে যেতে পারে না?

পরীক্ষার পরপরই মাসুদ রানা ঢাকা এলেন। চট্টগ্রামে নিজের কোয়ার্টারে স্ত্রী ও মেয়ে নিয়ে থাকবেন তিনি। সব ব্যবস্থা করেই এসেছেন৷

তখনও হাতে মোবাইল পায়নি মেহের। মাকে নিজ থেকে বলেনি সে। পাছে যদি আবার কথা শুনতে হয়। বাবা যেদিন এলেন সেদিন সন্ধ্যার পর মা তখন কিচেনে রাতের রান্না করছিলেন, তখনই বাবা তাকে প্রশ্ন করেন,

‘ তুমি বলেছিলে আমাকে বলবে। ’

মেহের কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল,

‘ কি? ’

‘ যেই অফিসারের বিষয়ে ইনফরমেশন এনে দিতে বলেছিলে। তার বিষয়ে বলবে বলেছিলে। চিন্তা হচ্ছে মা, তোমার বয়সটা অনেক বিপদজনক। বাবা হয়ে আমি কিভাবে চিন্তামুক্ত থাকবো বলো? তবে তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে পারো। এই বিষয়ে শুধু আমি ও তুমিই জানবো। ’

মেহের হুট করে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে৷ ফুপিয়ে কেঁদে বলল,

‘ আমি তোমাকে মেসেজে সব বলি বাবা? ’

‘ ঠিক আছে। ’

‘ মা এখনও আমার মোবাইল ফেরত দেননি। তুমি কি সেটা এনে দিবে? ’

মাসুদ রানা মোবাইল এনে দিলেন। মেহের সেটা নিয়ে নিজের রুমে গেলো৷ তারপর ঝড়ের গতিতে ফেসবুক, মেসেঞ্জার সব ইন্সটল করলো। প্রিয় আইডির সবকিছু চেক করে মেসেজ পাঠালো দীর্ঘদিন পর।

‘ আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। মা আমার মোবাইল নিয়ে গেছিল। আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি। আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ সো মাচ আমান। মিস ইউ। আমি তোমাকে অনেক বেশি মিস করছি। ’

বাবাকে মেসেজে সব বলার কথা থাকলেও বললো না মেহের। চোখের জলে মোবাইল স্কিন ভিজে গেলেও সে আমানকে মেসেজ করা থামালো না।

রাতের খাবার টেবিলে বাবার মুখোমুখি হয়ে মেহের অপরাধীর মতো বসে রইলো। তারপর রুমে এসে ভাবলো বাবাকে বলাই যায়। দীর্ঘ একটি মেসেজে সে সব লিখে পাঠালো। সাথে বাবা যে আমানের ইনফরমেশন জানতে চেষ্টা করেছে সেটার জন্য ও ধন্যবাদ দিলো।

তখন মধ্যরাত। মাসুদ রানা ঘুমিয়ে পড়েছেন। মোবাইল স্কিনের আলো জ্বলতেই জাহানারা সেটা হাতে তুলে নেন। স্কিনে মেহেরের নাম্বার দেখে কৌতূহল হয়ে মেসেজটা ওপেন করেন। তারপর! তারপর জাহানারার পা টলছিল। তার মুখ দিয়ে মৃদু জোরে চিৎকার বেরিয়ে আসে। মাসুদ রানা জেগে গেলেন তখনই। জাহানারা মোবাইল এগিয়ে দিতেই স্কিনের দিকে তাকিয়ে তিনি যা বুঝার বুঝে গেলেন। মনোযোগ দিয়ে দীর্ঘ মেসেজটি পড়লেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

‘ আমি এমনটাই ধারণা করেছিলাম। ও আমাকে বিশ্বাস করে সব শেয়ার করেছে। তুমি ওর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করবে হানি। মেয়েকে যা বলার, যা বুঝানোর আমি বুঝাবো। ওর ভীষণ যত্ন প্রয়োজন। ’

জাহানারা বিস্ময় নিয়ে বললেন,

‘ এতসব জেনেও তুমি এতো শান্ত! ’

মাসুদ রানা হেসে বললেন,

‘ কোনো দোষ তো দেখছি না। এই বয়সে প্রায় সবাই এমন করে। তবে আমাদের মেয়ে অনেক নরম, আমার নরম মেয়েকে হয়তো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে। আমি সেটা নিয়েই চিন্তিত। ’

‘ কিরকম? ’

‘ ও যাকে ভালোবেসেছে সে যোজন যোজন দূরে। কখনও দেখা হবে কি না তারই নিশ্চয়তা নেই। আর যদি ছেলেটার পক্ষ থেকেও কিছু থাকতো তবে আমরা পারিবারিক ভাবে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারতাম। কারণ আমরা তো ওইসব ট্রিপিকাল মা বাবা নই। কিন্তু যেখানে সব এক তরফা, সেখানে সবকিছু দিনশেষে আমাদের মেয়েকেই সহ্য করতে হবে। আরও দেরি হয়ে যাওয়ার আগে মেহেরকে এসব থেকে দূরে নিয়ে আসতে হবে। মুভ অন করাতে হবে। আমাদের একটাই তো সন্তান হানি। ’

জাহানারার মনে পড়ে গেলো মেহেরের মুড সুয়িং এর বাহানাসহ কতশত বাহানা। তার মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কতটা কষ্টে থাকে। ছলছল চোখে তাকিয়ে বললেন,

‘ হ্যা গো মেয়েটা এতো বড় হলো কবে? ’

পরদিন ভোরে কফি নিয়ে মেয়ের রুমে গেলেন জাহানারা। মেহের তখন নিজের ব্যাগ গোছাচ্ছিল। জাহানারা মেয়েকে পাশে বসিয়ে সারামুখে হাত বুলিয়ে দিলেন। গালে হাত রেখে বললেন,

‘ তোর কোথাও কষ্ট হচ্ছে মা? ’

মেহের কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে হেসে ফেললো। সে হাসলে তার চোখ ও হাসে। কি সুন্দর লাগে দেখতে। মেয়েটা শ্যামলা হলেও যেন দুনিয়ার সব মুগ্ধতা নিয়ে জন্মেছে। ওর গায়ের রঙ ফর্সা হলে হয়তো এতো মুগ্ধতাই থাকতো না। জাহানারা বিরবির করে বললেন,

‘ আমার বাচ্চার নজর না লাগুক।

(চলবে)