#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব-০৯
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
মাকে নিয়ে মেহের সমুদ্রের কাছে গেলো। কিন্তু কোথাও সেই দূরবীনে চোখ রাখা মানবটাকে দেখতে পেলো না৷ জাহানারা বললেন,
‘ দেখলি তো? তুই সারাক্ষণ চিন্তা করিস সেজন্য এমন হচ্ছে তোর। ’
মেহের কিছু বললো না। জাহানারা বললেন,
‘ চল ফিরে যাই। সকালে আসবো না-হয়। ক্ষিধে ও পেয়েছে নিশ্চয়ই? ’
মেহের পেছনে একবার তাকিয়ে হোটেলের দিকে হাঁটা শুরু করলো।
রুমে ফিরে আমানের ইনবক্সে লিখে পাঠালো,
‘ আপনি কি বাংলাদেশে এসেছেন আমান? আমি বারান্দায় দাড়িয়ে দূরবীনে চোখ রেখে অদূরে তাকিয়ে থাকা যে যুবকটিকে দেখলাম সে কি তবে আপনিই? নাকি আমার কল্পনা সব? ’
★
চট্টগ্রামে যৌথ মহড়া চলতে থাকে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নৌবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের এই সুযোগ আমানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। মহড়ার বিভিন্ন সেশনে তিনি বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান এবং কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারেন।
বাংলাদেশের নৌবাহিনীর একটি নতুন প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার সময়, আমান এবং তার দল একটি প্রযুক্তিগত ত্রুটি শনাক্ত করে। এটি দ্রুত সমাধান না করা হলে মহড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাধাগ্রস্ত হতে পারত। আমানের নেতৃত্বে একটি বিশেষ দল আজ রাতভর কাজ করে সমস্যাটি সমাধান করে। এই কাজের জন্য বাংলাদেশি অফিসাররা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
মহড়ার মাঝেই আসে একটি জরুরি খবর—বাংলাদেশের জলসীমার কাছে একটি বিদেশি ট্রলার সন্দেহজনক কার্যকলাপ করছে। এই পরিস্থিতিতে আমান এবং তার বাংলাদেশি সহকর্মীদের একটি এক্সপিডিশনারি টিম পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
অভিযানে গিয়ে তারা দেখতে পান, ট্রলারটি অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ করছে এবং সম্ভবত এটি মানবপাচারের সাথেও জড়িত। আমান দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অফিসারদের সাথে সমন্বয় করে তারা ট্রলারটিকে আটকায় এবং জড়িতদের গ্রেপ্তার করে।
রাতের পর যখন ভোর নেমে আসলো তখনই আমান শরীরে ক্লান্তি অনুভব করলো৷ বিদায় নিয়ে হোটেল রুমে এসে শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলো।
–
আজ একটি অনুষ্ঠানে তাদের যেতে হবে। কর্নেল মাসুদ রানা সেটারই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মেহের জিজ্ঞেস করলো,
‘ কিসের অনুষ্ঠান বাবা? ’
‘ পাকিস্তানের কিছু অফিসার এসেছেন তাদের সম্মানে একটি অনুষ্ঠান হবে। ’
মেহের সাদা গাউন পড়ে নিলো। উপরে লং কটি। তারা অনুষ্ঠানে পৌঁছালো সন্ধ্যার পর।
অভিযান শেষ হওয়ার পর আমান তার বাংলাদেশি সহকর্মীদের কাছ থেকে একটি ভিন্ন ধরনের আতিথ্য পান। চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি প্রাসাদোপম গেস্ট হাউসে তাদের সম্মানে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আমান বুঝতে পারেন, এই দেশে আতিথ্য কেবল শারীরিক নয়, বরং মানসিক আনন্দও দেয়।
মেহের মায়ের পাশে দাড়িয়ে স্তব্ধ বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কাঁপা হাতটি দিয়ে সে মায়ের হাত ধরলো।
‘ মা! ’
‘ বল? ’
মেহের হাতের আঙুল দিয়ে দেখালো,
‘ আমি তবে গতকাল ভুল দেখিনি মা! ’
জাহানারা তাকাতেই তার চোখে ধরা দিলো লম্বাচওড়া বলিষ্ঠ দেহি তীক্ষ্ণ চেহারার একটা যুবক। তিনি নিজেও অবাক হলেন।
‘ এটাই সেই অফিসার? ’
মেহেরের গাল ভিজে গেছে। সে ঢুক গিলে বলল,
‘ আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি মা। ’
জাহানারা আঁতকে উঠলেন,
‘ একি কথা মা? কি হয়েছে বল আমাকে। শরীর খারাপ করছে? ’
‘ মা আমি কি সত্যি দেখেছি? ’
‘ আমি তো তাকে এর আগে দেখিনি। যদি এটাই সে হয় তো তুই সত্যিই দেখছিস। আমি কি তাকে ডাক দিবো? ’
মেহের বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলো না। নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিলো মায়ের উপর। জাহানারা সবটুকু দিয়ে মেয়েকে ধরে রাখলেন। গলার স্বর একটু বাড়িয়ে ডাকলেন,
‘ শুনুন! ’
আমান তখন তার টিমের সাথে কথা বলছে। ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করে ডাকা হলো বুঝা গেলো না। কর্নেল জাহিদ এগিয়ে এলেন।
‘ কোনো সমস্যা ভাবি? ’
আমানকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ ওই অফিসারের নাম কি জানেন? ’
‘ পাকিস্তানের নৌ বাহিনীর একজন অফিসার৷ আমান খান। ’
মেহের মায়ের বুকে মাথা রেখে অল্পস্বল্প করে তাকাচ্ছিল। নামটা তার কানে বজ্রাঘাতের মতো বাজলো।
জাহিদ বললেন,
‘ চলুন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। ’
জাহানারা বললেন,
‘ মেহের দাঁড়াতে পারছে না। ওর শরীর খারাপ করছে। আমি যেতে পারবো না। আপনি একটু ওর বাবাকে ডেকে দিবেন? ’
জাহিদ চিন্তিত হয়ে বললেন,
‘ বেশি খারাপ লাগছে কি মামনি? আমাদের ডাক্তার আছেন। চলো দেখিয়ে নিবে। ’
তারপর কর্নেল জাহিদ ডাকলেন,
‘ কমান্ডার! ’
আমানের সাথে পরিচয় হবার পর থেকে তাকে এই সম্মোধনেই ডাকেন জাহিদ। আমান পরিচিত স্বর শুনে এগিয়ে এলো। মেহেরের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো। সে তলিয়ে গেলো অন্ধকারে।
শরীর ছেড়ে দিতেই জাহানারা আঁতকে উঠলেন।
‘ আমার মেয়ে! ’
জাহিদ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কিন্তু মেহেরের কোনো রেসপন্স নেই। আমান বলল,
‘ এনিথিং রং? ’
‘ আমাদের একজন ডাক্তার প্রয়োজন কমান্ডার। আমাদের একজন কর্নেলের মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ’
জাহানারা কেঁদে ফেললেন। আমান স্পষ্ট বাংলাতে বলল,
‘ তাকে বসিয়ে দিন প্লিজ। ডাক্তার আসতে আসতে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করা উচিত। ’
জাহানারা সোফায় বসে পড়লেন। জাহিদ চলে গেছেন ডাক্তার ও মাসুদ রানাকে ডাকতে। আমান বলল,
‘ মাথাটা সোজা করে দিন। ’
মেহেরের মুখ চুল দিয়ে ঢাকা। তার মাথা সোজা করে সোফায় রেখে চুলগুলো সরিয়ে দিলেন জাহানারা। তারপর মেয়ের হাত ঘষতে লাগলেন।
আমানের চোখে ধরা দিলো সাধারণ একটি বাঙালি মেয়ের মুখ। কাধ পর্যন্ত চুল, গালে চোখের জল শুকিয়ে গেছে। আমান বলল,
‘ আমি কি চেষ্টা করতে পারি? ’
জাহানারা তখন সব ভুলে গেছেন। বললেন,
‘ একটু দেখো বাবা। ’
আমান তার পুরুষালি হাত দিয়ে টিপে ধরলো মেহেরের নাক। সেকেন্ড পেরিয়ে যেতেই মেহের মুখ দিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে আর্তনাদ করতে লাগলো। গোলা চোখে তাকিয়ে সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো।
জাহিদ ততোক্ষণে চলে এসেছেন। আমান উঠে দাড়ালো। মাসুদ রানা মেয়ের আরেক পাশে বসলেন। ডাক্তার নিজের কাজ করতে লাগলেন।
আমানের কেমন হাসফাস লাগছিল। অনুষ্ঠানের মধ্যেও আমানের মন সমুদ্রের প্রতি তার গভীর টান অনুভব করে। অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে সে একা সমুদ্রের ধারে চলে যায়। সেই শান্ত রাতের বাতাসে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য, দায়িত্ব, এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে। বাংলাদেশের সমুদ্রের ঢেউ যেন তাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করায়—সীমান্ত, জাতীয়তা বা যুদ্ধের বাইরেও পৃথিবী এক।
অনুষ্ঠানে আর ফিরে না গিয়ে আমান হোটেল রুমে চলে যায়। কর্নেল জাহিদের সাথে তার দেখা হয় অনেক রাতে৷ জাহিদ বললেন,
‘ স্যরি কমান্ডার। আপনাকে কোম্পানি দিতে পারিনি ভালো করে। ’
আমান জিজ্ঞেস করলো,
‘ সেই অসুস্থ হয়ে পড়া মেয়েটি কেমন আছে এখন? ’
‘ ওহ্ আপনি মেহেরুন্নেসার কথা জিজ্ঞেস করছেন? সে ভালো আছে। ডাক্তার রেস্ট নিতে বলে গেছেন। শরীর অনেক দূর্বল। ’
আমান বির বির করে কয়েকবার আওড়ালো ‘মেহেরুন্নেসা! ’
এরপর আমান তার মহড়ার কাজ শেষ করে পরেরদিন সন্ধ্যাতেই পাকিস্তানে ফিরে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের সমুদ্র, আতিথ্য, এবং অভিজ্ঞতার স্মৃতি তার মনের গভীরে থেকে যায়, যা তাকে ভবিষ্যতে বারবার মনে করিয়ে দেবে মানুষের সাথে সম্পর্ক এবং সহযোগিতার গুরুত্ব। সাথে মনের অজান্তে হোক বা নিজের অজান্তে সেই একটি নাম বারবার তার মনে পড়তে থাকে। সেই বিধ্বস্ত মুখ, ভালো করে তাকাতে পারেনি মেয়েটি কিন্তু তবুও কেমন আকুতি নিয়ে আমানের দিকে তাকিয়ে ছিল। হয়তো কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু বলতে পারলো না।
(চলবে)