#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_১৯
আশিক আর আতিয়া সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কী করবে। আগে পুলিশের কাছে গিয়ে জিডি করবে,না সরাসরি ঠিকানা মতো রাতুলের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিবে! যদিও আলো চিঠিতে লিখেছে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে সে যোগাযোগ করবে। কিন্তু রাত হয়ে এলো এখনো আলোর ফোন বন্ধ। আর আশিকের খোঁজখবর মতে আজ রাতুল তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে কোন এক রিসোর্টে যাবে। আতিয়া ভাবে মিসবাহর সাথে আলোচনা করবে কিনা। কিন্তু মাত্র কয়দিন হলো রাগ অনুরাগের। সম্পর্ক একটা সুন্দর মোড়ে আসার অপেক্ষায় হলেও দু’জনই এখনো দুজনের কাছে ততটা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন আর পরিবার নিয়ে উন্মুক্ত হতে পারেনি। এই সময় আলোর মতো ষোল বছরের মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা বলতে কেমন বাঁধে। মিসবাহ কী না কী ভাববে আতিয়ার পরিবার আর বোনকে নিয়ে তাই ভেবে ভয় লাগে। তবে মাথার উপর অভিজ্ঞ কেউ থাকারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে ভীষণ করে। আয়েশা আর খলিল তো রাগ করে চলে যাওয়ার পর কথাই বলছে না। আর দেলোয়ারা বেগমও চান না মেজোমেয়ের জামাই খলিল কিছু জানুক। খলিলকে আর ওনাদের নিয়ে হাসাহাসি করার সুযোগ দিতে চান না। আর মেয়ে আয়েশার উপর তো রাগ ভীষণ। শেষমেশ আশিকের মাধ্যমে মিসবাহর কাছে খবরটা পৌঁছানোর কথা ভাবে আতিয়া। আশিক জানানোর পর যদি মিসবাহ ওকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানতে চায় তো দ্বিধা ঝেড়ে সব খুলে বলবে।
“আশিক, তোর মিসবাহ্ ভাইয়ের সাথে একবার পরামর্শ করবি? ওনারা না ঐ কামরাঙ্গীচরেই থাকেন। তাও অনেক বছর ধরে। ওনাদের তো নিজেদের পরিচিত এলাকা, স্থানীয় মানুষের মতো। হয়তো রাতুলকে তার পরিবারকে চিনবে।”
“চিনবে কী আপা। খুব ভালো করেই চিনেন। তাই তো পরামর্শ চাইতে যাই নাই।”
“কিভাবে চিনেন?আত্মীয়?”
“হ্যাঁ। খুব কাছের আত্মীয়। মিসবাহ ভাইয়ের মেজোভাই হাবিব ভাইয়ের এর শালা রাতুল। হাবিব ভাইয়ের বৌ রত্না ভাবির কথা আমার বন্ধু হাসানের কাছে শুনেছি।।মহিলা নাকি ভারী শক্ত আর ঝগড়াটে। মিসবাহ ভাইয়ের মা পর্যন্ত যার কথার ভাঁজে আর নাটকের সাথে টিকতে পারেন না। অথচ কয়দিন আগে শুনলাম এই অপছন্দের বৌ রত্না ভাবীর মামাতো বোনের সাথে খালাম্মা মিসবাহ ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন। সামনেই বিয়ে।”
“কী বলিস! তোর মিসবাহ্ ভাই জানে এই বিয়ের কথা? না খালাম্মা নিজে নিজে ঠিক করছেন?”
“জানবে না কেন। মিসবাহ ভাইয়ের সাথে হাসান গিয়ে মেয়ে দেখে এসেছে। বিয়ে তো ফাইনাল। হাসান বললো মিসবাহ ভাই কখনও ওনার আম্মার কথা ফেলেন না। এখন তুমি বলো আপা, এই পরিবারের সাথে মিসবাহ ভাই, হাসান ওদের এমন সম্পর্ক সেখানে কিভাবে সাহায্য চাই!”
এক মুহূর্তের জন্য আতিয়ার মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। যদি মিসবাহর বিয়ে ঠিকই হয়ে আর মিসবাহ সব জানেই থাকে তবে তাদের মাঝে সেসব কী ছিল! নৌকার ভেতর সেই ভালোবাসা আর বিয়ের প্রতিশ্রুতি, মিসবাহর আবেগময় চুম্বন। কোনকিছুই তো একমুহূর্তের জন্যও আতিয়ার কাছে মিথ্যা বা নাটক বলে মনে হয়নি। নাকি আসলেই মা ঠিক বলেন! শরীর আর মনের আবেগে আতিয়া অন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাই এই বয়সে এসেও মনে করছে কেউ ওকে শুধু ভালোবেসে জীবনসঙ্গী করতে চাইতে পারে। এর আগে তার জীবনে আসার প্রস্তাব যাদের কাছে পেয়েছে, তাদের সবার চোখের ভাষা আতিয়া পড়তে পেরেছে।কেউ আতিয়ার কাছ থেকে টাকাপয়সা বের করতে চেয়েছে। কেউ শুধুই শরীরী সম্পর্কে টানতে চেয়েছে। বহু বছরের অপেক্ষার পর আতিয়ার মনে হয়েছিল কেউ সত্যি শুধু তাকে ভালোবেসেই হাত ধরেছে। সেই আবেগঘন মুহুর্তে মিসবাহর চুমোকে তাই একমুহূর্তের জন্যও সুযোগ সন্ধানী কারও স্পর্শ মনে হয়নি।
“তুই নিশ্চিত আশিক?”
“কী?”
“মিসবাহ্, মানে তোর মিসবাহ্ ভাইয়ের বিয়ের কথা হয়েছে? না তোর বন্ধু হাসানের?”
“আরে হাসানের কেন হবে! হাসানের প্রেমিকা আছে, কলেজের জুনিয়র। মিসবাহ্ ভাইয়েরই বিয়ে। একবার তো শুনছিলাম যে শুক্রবার কাবিন হবে।”
“আশিক। কারও ভরসা বাদ দে। আমরা চল আগে জিডি করি। থানা থেকেই রাতুলের বাড়িতে খোঁজ নেক।”
রাতদুপুরে বাড়ি মাথায় করলো রত্না। তাদের বাড়িতে পুলিশ এসেছে কোন মেয়ের খোঁজে। তার ভাই নাকি কোন মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে বলে মেয়ের পরিবার মামলা করেছে। জাহনারা বেগম বিরক্ত হোন।
“রত্না, এখন যাওয়া লাগি ফালাফালি কইরো না। রাইত হইছে দশটার বেশি। সকালে যাইও।”
“কী কন আপনে আম্মা। আমার মাসুম ভাইরে কে ফাঁসাইতে পুলিশ পাঠাইছে আর আমি যামু না?”
“তুমি গিয়া কী করবা? তুমি কি উকিল না জজ সাব? তোমার কথা পুলিশ ক্যান শুনবো? কিছু একটা তো নিশ্চয়ই করছে,তা না হইলে এমনে এমনে কেউ পুলিশ পাঠাইবো ক্যান! কার মাইয়ার কী ক্ষতি করছে কে জানে।”
“কিছু করে নাই আম্মা। এসব শত্রুপক্ষের কাম। টুকটাক রাজনীতি করে। এইগুলা চক্রান্ত।”
রত্নার ছটফটানিতে টিকতে না পেরে হামিদ বৌকে নিয়ে বের হয়। মিসবাহ মাথা ঘামায় না। সে আছে অন্য চিন্তায়। আতিয়ার সাথে ঠিকমতো কথা বলার সুযোগই হলো না আজ। আতিয়া কিছু একটা নিয়ে চিন্তায় ছিল। বললো পরে সব গুছিয়ে বলবে। এরপর খবর নেই। সন্ধ্যা থেকে চেষ্টা করেছে কয়েকবার ফোনে। কিন্তু কথা হয়নি।
রত্না ফিরে আসতে আসতে সাড়ে এগারোটা পেরিয়েছে। জাহানারা বেগম আগ্রহ নিয়ে বসে ছিলেন আজ। কী হলো জানার খুব আগ্রহ।
“হামিদ কী হইছে রে? আসলেই কোন মাইয়া নিয়া আইছে?”
“জানি না আম্মা। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলো। থানায় ডাকতে পারে। মাইয়ারে খুঁইজা পায় না।”
“মিছা কথা আম্মা। মাইয়া কার সাথে ভাগছে কে জানে! মাইয়ার পরিবারের কাছে কোন প্রমাণ নাই যে রাতুলের সাথে কোন সম্পর্ক আছিল। আন্দাজে আমার ভাইরে ফাঁসানোর চেষ্টা। পুরা ধান্ধাবাজ পরিবার। বাপ নাই, মায়ের শাসন নাই। এসবই তো কইরা বেড়ায়।”
“মাইয়া কি তোমার ভাইয়ার ভার্সিটির?”
“নাহ। সবে নাকি এসএসসি দিব। ষোল সতেরো বছরের মাইয়া। কেমন পাকনা চিন্তা করেন। মাইয়া কে জানেন?”
“কে?”
“আপনের ছেলে চিনে।”
“কেরো হামিদ?”
“ভাইয়ার দোকানে কাজ করে যে আশিক। তার ছোটোবোন আলো।”
মিসবাহ এতক্ষণ চুপচাপ কথা শুনলেও হামিদের কথায় তড়াক করে উঠে যায়।
“আশিকের ছোটো বোন হামিদ?”
“জ্বি ভাইয়া।”
“খুঁজে পায়নি এখনো?”
“শুনলাম তো পায়নি। ফোনও বন্ধ। রাতুল বন্ধু বান্ধব নিয়ে যে রিসোর্টে ছিল আজ পুলিশ ঠিকানা নিয়ে সেখানেই খোঁজ করেছে। কিন্তু রিসোর্ট থেকে বলেছে আলো নামে কেউ রিসোর্টে রাতুলের সাথে যায়নি। ওদের গ্রুপে কোন মেয়েই ছিল না। ওরা কয়েকজন কয়েকজন ছেলেবন্ধু মিলে গিয়েছিল।”
জাহনারা বেগম বুঝতে পারেন আলো আতিয়ার বোন।
রত্নাকে সমর্থন করে তাই বলেন।
“রত্না ঠিকই বলছো। এইসব পরিবারের মাইয়াগো কাজই হইলো পোলা ধরা। নিজেই কোথাও গিয়ে লুকাইছে যেন রাতুলরে চাপ দিতে পারে। চিন্তা করো এইটুকু মাইয়া, চিঠি লিখে যায় যে শ্বশুরবাড়ি যাইতেছে। কেমন অসভ্য মাইয়া। রাতুল কোন দোষ না করলে ডরাইতে না করবা। আমরা আছি। কিছু হইবো না।”
রত্না শাশুড়ির পরিবর্তনে অবাক হলেও খুশি হয়। যদিও রাতুল সত্যি বলছে না মিথ্যা জানে না রত্না। কিন্তু ভাইয়ের মমতায় সে ভাইয়ের পক্ষই নেবে।
“হ্যালো, আতিয়া। সারাদিন এতবার ফোন দিলাম ধরো নাই কেন? আলোকে খুঁজে পাচ্ছ না জানালে না কেন?”
“এই তো জানতে পারলেন। জানতাম জানতে পারবেন।”
“আতিয়া কী হয়েছে? তুমি চিন্তায় আছ বুঝতে পারছি। আমাকে আগে জানালে না কেন? সারাদিন পার হয়ে গেল। জানালে আমি একটা ব্যবস্থা করতাম। আলোকে খোঁজার চেষ্টা করতাম। এতটুকু বিশ্বাস নেই আমার উপর?”
“বিশ্বাস তো আমার সবসময়ই ছিল। হয়তো আপনার ছিল না। তাই তো বিয়ে করছেন, এত বড়ো সুসংবাদটা জানালেন না। স্যরি আপনার শ্বশুর বাড়ি, শালা সবাইকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম। কিন্তু আমার বোনের জন্য বাধ্য হয়েছি। বাচ্চা মেয়ে কোন বিপদে পড়েছে কে জানে। আমার বোনকে পেয়ে গেলে আপনাদের কোন সমস্যা আর করবো না। মামলাও তুলে নেব।”
“তুমি আয়নার কথা বলছো?”
“নাম জানতাম না। সুন্দর নাম।”
“আতিয়া, ক্ষমা চাইছি। জানি আয়নার বিষয়টা আগেই জানানো উচিত ছিল। আমি তোমাকে জানাতাম।”
“কোন বিষয়টা? আয়নার সাথে বিয়ের বিষয়টা? কবে জানাতেন! বিয়ের পর?”
“আয়নাকে আম্মা পছন্দ করেছে। তাও জিদের বশে। কিন্তু আমি আম্মাকে স্পষ্ট করে বলেছি আমি অন্য কোথাও বিয়ে করছি না। আম্মার চাপে ঐ বাড়িতে গিয়েছিলাম। আর কিছু না।”
“আপনি কি বাচ্চা ছেলে মিসবাহ্! আপনি নিজেই একটা সাত বছরের মেয়ের বাবা। আপনাকে কেউ জোর করে কোথাও নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে!”
“জানি আতিয়া, যাই বলবো এখন, তোমার বিশ্বাস হবে না। কিন্তু অনুরোধ করবো বিশ্বাস রাখো। আর আলোর বিষয়টা বলো। পুলিশের সাথে আমি কথা বলছি। বাচ্চা একটা মেয়ে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে। বিপদে আছে ও। ওকে খুঁজে বের করার পর তুমি যা মন চায় বইলো।”
আতিয়া ভাবে, মিসবাহর সাথে বোঝাপড়া করার আগে আলোকে খুঁজে পেতে হবে। যতই শক্ত হোক, ছোট্ট বোনটার চিন্তায় কিছু ভালো লাগছে না। রাতুল কিছুতেই স্বীকার করলো না যে আলোর সাথে ওর আজ দেখা হয়েছে। কোথায় গেল বাচ্চা মেয়েটা! কেমন আছে! বেঁচে আছে না নেই! আর ভাবতে পারে না আতিয়া। আজকের রাতটা বড়ো দীর্ঘ মনে হচ্ছে। পাশের রুম থেকো দেলোয়ারা বেগমের কান্নার করুণ স্বর ভেসে আসছে।
(চলবে)
#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_২০
ঢাকার আশেপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। ইট পাথরের নগরী ঢাকাতে সবুজের দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে। তাই গাজীপুরের ভাওয়াল মধুপুরের সবুজকে কেন্দ্র করে ভালো ভালো রিসোর্ট তৈরি হওয়া শুরু হয়। শুরুতে বিষয়টা ভালোই ছিল। একদিনের জন্য শহরের কোলাহল থেকে দূরে নিজের মতো সুন্দর সময় কাটানো যায়। কিন্তু ভালো মানের রিসোর্টগুলো সবার সাধ্যের ভেতর থাকে না, তাছাড়া সব জায়গায় প্রকাশ্য অনৈতিক কাজগুলো করাও যায় না, তাদের রেপুটেশনের ভয় থাকে। অবৈধ ড্রাগস, নারী, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে থাকা নরনারীদের সুযোগ দেওয়ার সুবিধা এসব কেন্দ্র করে তাই গড়ে উঠতে থাকে মানহীন ফার্মহাউস, ছোটো ছোটো রিসোর্ট। যাদের ক্লায়েন্ট সার্ভিস কেমন তা বিষয় না, তাদের লক্ষ্যই থাকে যারা একটু অনৈতিক কিছুর খোঁজ করে, তাদের জায়গা দিয়ে আয় করা। এসব জায়গাগুলোয় তাই পরকীয়ারত জুটি, অবৈধ সম্পর্কে জড়িত তরুণ তরুণী, কিশোর, কিশোরী, দেহপসারণীদের ব্যবসার উত্তম স্থান হয়ে দাঁড়ায়।
রাতুল আর তার গ্রুপ এই রিসোর্টগুলোয় আগেও এসেছে। টুকটাক ছাত্র রাজনীতিতে জড়ানোর সুবাদে বড়ো ভাইদের বদৌলতে এখানে বেশকিছু রাজনৈতিক গেটটুগেদারে অংশ নিয়েছে, কখনো আনন্দভ্রমণে এসেছে। এখানকার লোকজনের সাথে তাই তার ভালো পরিচয় গড়ে উঠেছে। সেদিন আলোকে রুমে রেখে বের হয়ে এসে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় রাতুল। কী করবে প্রথমে ঠিক করতে পারে না। রিসোর্টের ম্যানেজারের সাথে রাতুলের ভালো বন্ধুত্ব থাকায় তাকেই খুলে বলে। আলোর কাছে মাত্র দশ হাজার আছে জানায়। গয়নাগুলোর কথা চেপে যায়। গয়নাগুলো রাতুলের প্রয়োজন। সনাতনী হলেও বর্তমান বাজার মূল্যে আড়াই লাখ টাকার গয়না প্রায়।
ম্যানেজারকে সেই দশ হাজার টাকা দিতে চেয়ে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার হওয়ার পথ খোঁজে রাতুল। আলোকে সে কিছুতেই বাড়িতে বৌ করে নিয়ে যেতে রাজি নয়। আবার খুন করতেও ভয় পায়। এর আগে রাজনৈতিক মিছিলে টুকটাক মারামারি করলেও খুনী নয়। কাউকে কখনো খুন করার কথা ভাবেনি, সেই সাহসই নেই। ম্যানেজার রাতুলকে আশ্বস্ত করে। সবার আগে রিসোর্টের ওয়েলকাম লাউঞ্জের সিসিটিভির গত পনেরো দিনের সমস্ত ফুটেজ ডিলিট করে। যেন পুলিশ আসলে বলতে পারে যে সিসিটিভি হঠাৎ ক্রাশ করে সমস্ত ফুটেজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুলের কাছের সিসিটিভি কিছু করে না। যেহেতু আলো সরাসরি রুমে চলে গিয়েছে, তাই পুলের ক্যামেরায় ও নেই। পুলিশ চাইলে সেই ফুটেজ দেখিয়ে দিবে। খাবার ঘরেও আলো আসেনি। ম্যানেজার জানায় আলোকে অন্য ব্যবস্থায় দিয়ে দিবে। তাদের আরও সাইড বিজনেস আছে। দশ হাজার টাকা নেয় না ম্যানেজার। বরং রাতুলকে আরও ত্রিশ হাজার দেয়। যেন পরবর্তীতে বন্ধু বান্ধব কোন ঝামেলা করলে ম্যানেজ করে নিতে পারে।
আলোকে দিয়ে অভাবিত ভাবে আরও কিছু টাকা আয় হবে, আবার এই ঝামেলা থেকে এত সহজে ছাড়াও পাবে ভাবেনি রাতুল। খুশি মনেই আলোর জন্য রুমে খাবার নিয়ে যায়। রাতুলের ভালোবাসায় গলে গিয়ে খাবার খেয়েও নেয় আলো। খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণের ভেতরই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঔষধ ড্রিংসে মেশানোই ছিল। চুপচাপ নিজের সমস্ত জিনিস নিয়ে বের হয়ে যায় রাতুল। নিজের বাকি দুই বন্ধু ও তাদের গার্লফ্রেন্ডদের বলে আলো রাগ করে চলে গিয়েছে। কারণ আলো ওর সাথে বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সে নিতে রাজি হয়নি। সবার মাঝে কিছুটা অবিশ্বাস আর ভয় দেখতে পেয়ে শাসিয়ে দেয় রাতুল। বলে আলোর কথা ভুলে যেতে। ও চলে গিয়েছে যাক, কোন বিপদআপদ হলে তার দায়দায়িত্ব তারা কেউ নিবে না। তারা স্বীকারই করবে না যে আলো তাদের সাথে ছিল। কেউ এ নিয়ে কথা বললে সবাই একসাথেই ফেঁসে যাবে। তাই কারওই এ নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
এরপর পকেট থেকে টাকা বের করে সবার হাতে পাঁচ হাজার করে বিশ হাজার দেয়। হঠাৎ এতগুলো টাকা পেয়ে কেউ আর কোন আপত্তি তোলে না। মেয়েগুলো টাকা নিতে চায় না। তারা ভয়ই পেয়ে যায়। কিন্তু রাতুল জোর করেই টাকা দিয়ে দেয়। এরপর আলোর কী হয়েছে জানে না রাতুল। পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে এতটুকুই স্বীকার করে রাতুল।
যদিও রাতুলের এই স্বীকারোক্তি পর্যন্ত আসাটা আতিয়া, আশিকের জন্য সহজ ছিল না। মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় পনেরো দিন। মিসবাহ্ সাথে না থাকলে বোধহয় এই পর্যন্ত আসতে ওদের মাস, বছর পেরিয়ে যেত। হয়তো এইটুকু খোঁজও আর পাওয়া হতো না। পুরো পরিবারের বিপক্ষে গিয়েই মিসবাহ দাঁড়িয়েছে আতিয়ার পাশে। মিসবাহ এতটা না জড়ালে পুলিশও বোধহয় এই কেস নিয়ে এতটা কাজ করতো না। রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ করে অন্য কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতো।
পুলিশ রাতুলের সব বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তারা কেউই আলোকে ভালো ভাবে চিনতো না। তবে সেই এলাকার এক লোকাল কাজী অফিসে আলো আর রাতুলের বিয়ের সাক্ষী হয়েছিল সেই দুই বন্ধু। নাবালিকা মেয়ের বিয়ে পড়ানোর অভিযোগে সেই কাজীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ বেশিরভাগই নষ্ট করে ফেলেছিল ম্যানেজার। কিন্তু করিডোরের ফুটেজের কথা ভুলে গিয়েছিল। সেখানে রাতুলের সাথে একটা মেয়েকে হোটেল রুমে ঢুকতে দেখা গিয়েছে। চেহারা স্পষ্ট না হলেও মেয়েটা আলো বলেই ধারণা করেছে পুলিশ। এরপর মেয়েটা আর রুম থেকে বের হয়নি। রাতুল দুপুরে বের হলেও একা বের হয়েছে, আর ঢুকেছে খাবার নিয়ে। এর কিছুক্ষণ পর একাই ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। তার কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার আর একজন লোক,যে রিসোর্টের স্টাফ না, তারা ধরাধরি করে বোরখা পরিহিত একজনকে নিয়ে যেতে দেখে গিয়েছে। তবে সামনের দিকে না গিয়ে পেছনের সিঁড়ির দিকে গিয়েছে। পুলিশ ধারণা করছে সেখান দিয়ে নেমে নিচে থাকা কোন পণ্য পরিবাহী কাভার্ড ভ্যানে করে আলোকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এই বড়ো শহরে আলোর বয়সী কত মেয়ে হারিয়ে যায়। প্রভাবশালী পরিবারের না হলে তাদের বেশিরভাগেরই আর কোন হদিস পাওয়া যায় না। তাদের কেউ মারা যায়, কেউ বহু হাত ঘুরে বিক্রি হয়ে যায় পতিতালয়ে। কখনো কখনো পরিবার শেষ পর্যন্ত হদিস পেলেও আর ফিরিয়ে আনে না। সেই অন্ধকার জগতেই মেয়েকে ত্যাগ করে আসে। ম্যানেজার পলাতক। অন্য লোকটা কে তা এখনো জানা যায়নি। রিসোর্টের মালিক এই বিষয়ে তার কোনরূপ সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন। ওনার বিরুদ্ধে সরাসরি কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। আলোর খোঁজ তাই এখানেই আটকে আছে।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। আলো আধাঁরিতে দাঁড়িয়ে চেনা এই ঢাকা শহর কেমন অচেনা লাগে আতিয়ার। সাইন্সল্যাবের এই ফ্লাইওভারটা বেশ বড়ো। চারদিকে বিস্তৃত। চারদিক থেকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে গাড়িগুলোর আসা যাওয়া দেখতে দেখতে দু চোখের কোল ঘেঁষে অশ্রু নামে আতিয়ার। মিসবাহ আতিয়ার হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করে।
“আতিয়া, এতটুকু যখন জানা গিয়েছে। বাকিটাও জানা যাবে। আলোর খোঁজ পাব আমরা।”
“এখন সেই খোঁজ পাওয়ারই ভয় লাগে মিসবাহ। এই যে ও কোথায় আছে আমরা কেউ জানি না। এর মাঝে একটা নির্ভরতা আছে। ও নিখোঁজ এই স্বস্তি আছে। ভয় লাগে এখন খোঁজ পেতে। খোঁজ পেলে ও কোথায় আছে তা কী মেনে নিতে পারবো?”
“কেন পারবে না। ও তো সেই জায়গায় নিজের ইচ্ছায় যায়নি। একটা ভুল করেছে বয়স আর আবেগের বশে। তার জন্য শাস্তিটাও তো পাচ্ছে কঠিন ভাবে। এরপর ওকে ফিরিয়ে আনতে পারলে তোমরাও যদি ওকে সহজ ভাবে গ্রহণ না করতে পারো, তবে ও কোথায় যাবে!”
“আর যদি ওর খোঁজ এমন জায়গায় পাওয়া যায় যেখান থেকে আর কাউকে ফিরিয়ে আনা যায় না!”
“আলো বেঁচে আছে আশা রাখো আতিয়া। মেরে ফেলার কথা না।”
পরম নির্ভরতায় মিসবাহর হাতের উপর আরেকটা হাত রাখে আতিয়া।
“মিসবাহ, আপনি খুব ভালো মানুষ। আয়নাকে আমি দেখিনি। কিন্তু আপনার কাছে যতটুকু শুনলাম মেয়েটা ভালো। ওর একটা ছেলে আছে, আপনার একটা মেয়ে। আপনাদের দু’জনের বিয়ে হলে একটা পরিবার চমৎকার রূপ পাবে। পলিনও মা পাবে। আয়নার জীবনটাও গুছানো হবে।”
“আর তোমার জীবন?”
“আমার জীবনটা দেখেছন? আমি আসলে খুব অপয়া একজন। আপনার জীবনের সাথে জড়িয়ে আপনার জীবনটাও কেমন কঠিন করে তুললাম। আমার সাথে পরিচয় না হলে আয়নাকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার হয়ে যেত এরই মাঝে। অথচ এখন আপনার পরিবার কত বিরক্ত আপনার উপর। শুনোন, অনেক করেছেন।রাতুল তো স্বীকারোক্তি দিয়েছেই। বাকি পুলিশ তাদের মতো করে আলোকে খুঁজুক। আপনি আর এসবে না জড়িয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান।”
“আতিয়া, আগেও বলেছি। আজও বলছি। বিয়ে করবে আমাকে? তুমি চাইলে আজই, এই মুহূর্তে কাবিন করবো।”
(চলবে)