গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক পর্ব-১৫+১৬

0
510

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৫)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

বিকেলে ইমা চলে যায়। ইকরাকে মেহজা অনেক অনুরোধ করে থাকার জন্য পরে সে তার স্বামী তাহসিনকে কল করে বলে দরকারি জিনিসপত্র সহ গুণগুণকে নিয়ে আসতে। তাহসিন প্রথমে অমত করলেও পরে মেহজার কথা ফেলতে পারেনি। গুণগুণকে দিয়ে তাহসিন সন্ধ্যার আগেই ফিরে যায় তার অতি জরুরী কাজ আছে এখন এখানে থাকলে হবেনা তাই!

সন্ধ্যা ৬:৪০, মেহজা ইকরা নামায পরে কিচেনে গিয়ে চা বানাচ্ছে। মেহজা এবং ইকরা দুজনেই দুধ চা খোর! তারা নিজেদের মতো চা বানাচ্ছে আর গল্প করছে তখন ইরফান এসে বলে,

“কফি করবেনা?”

“কেন?”

“কেন আবার! আমি এই সময় স্ট্রং কফি খাই। জানো না?”

“না তো!”

“আচ্ছা না জানলে এখন একটা কফি বানিয়ে দাও তো ফটাফট!”

“খেতে হলে আপনিই একটা কফি বানিয়ে নেন ফটাফট!”

“তুমি আমার মজা উঁড়াচ্ছো?”

“উঁড়াচ্ছি নাকি! আপনার ম-জা!”

“মেহজা? হঠাৎ এমন ফালতুতামি করছ কেন?”

“করছি নাকি!”

“অসহ্য!”

ইকরা মুখ টিপে হাসছে। তার এদের কেমিস্ট্রি খুবই ভালো লাগছে। মেহজা এসব কেন করছে ইকরা ভালোই জানে। সবটা মিলিয়ে ইন্জয় খুব করছে সে।
ইরফান নিজেই কফি বানাতে লেগে গড়ে। কফি সে নিজেই রুমে বানিয়ে খেতে পারত কিন্তু সে মেহজার আশেপাশে থাকতেই নিচে এসেছে। দুপুর থেকেই সে রুমে যাচ্ছেনা। রুমে বললে ভুল হবে। সে তো ইরফানের আশেপাশেই ঘেষছে না। হুট করে কী এমন হলো তা সে বুঝতেই পারছেনা।

মেহজা দু কাপ চা করে ফেমিলি লিভিংটাতে গিয়ে বসে। পেছন পেছন ইকরাও যায়। ইরফান সেদিকে তাঁকিয়েই কফি কাপে ঢালতে থাকে। তারপর সে নিজেও রুমে চলে যায়। এমন ছ্যাঁচড়া স্বভাব তার নেই এবং ছিল না কোনো কালে। তবে এই মেহজার জন্য সে দিনদিন চরম লেভেলের বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কী! কীভাবে পারবে মেহজা নামক মরিচিকা থেকে পালিয়ে বাঁচতে?

রাতে খাবার গরম করে সবাইকে খাবার পরিবেশন করে নিজেও খেয়ে ইকরার রুমে ছোটে মেহজা। আজ সে দূষিত পুরুষের কাছে যাবেইনা। ইরফান দু তিনবার নিচে এসে ঘুরে যায়। মেহজাকে না দেখে ইকরার রুমে যায়। ভেতর থেকে লক করা দেখে কিছুটা ইতস্তত বোধ করে। তারপর দরজায় নক করেই ফেলে। দু’বার নক করতেই ভেতর থেকে ইকরা বলে,

“সমস্যা কী তোর ইয়াজ! এমন করছিস কেন? ঘুমাতেও দিবি না নাকি!”

“মেহজা আছে?”

“হ্যাঁ আছে। ও ঘুমাচ্ছে।”

“ঘুমাচ্ছে মানে?”

“ঘুমাচ্ছে মানে কী? রাত হলে মানুষ ঘুমাবে না নাকি তোর মতো হাশপাশ করবে?”

“ওকে ডেকে দে তো?”

“না পারব না। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে তো।”

“একটু ডাক না!”

“না।”

“চাবি দিয়ে লক খুলে আসব তাহলে।”

“ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে মেহজা। তুই এমন ক্লাসলেস বিহেইভ করছিস কেন?”

“আমি…

মেহজার পাতলা ঘুমটা ভেঙে যায় দুই ভাই বোনের চিৎকার চেঁচামেচি তে। বিরক্ত হয়ে উঠে দরজাটা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে সোজা ইরফানের রুমে চলে যায়। ইরফানের কমনসেন্স না থাকলেও তার আছে। গুণগুণ ঘুমাচ্ছে উঠে পড়লে খুব কাঁদবে। আর ইকরাও খুব টায়ার্ড। তার নিজস্ব সমস্যার কারণে ওদের আরামের ঘুম হারাম করার কোনো মানে নেই।

রুমে ঢুকেই সে শুয়ে পড়ে এক কাত হয়ে। ইরফান এবার শান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ড্রয়ার থেকে ঔষুধ নিয়ে খায়। এতক্ষণ তার কিছুই ভালো লাগছিল না। ঔষুধটাও রাগ কে খায়নি সে। এখন তার শান্তি লাগছে। লাইট বন্ধ করে মেহজার পাশে শুতেই মেহজা লাফিয়ে উঠে বলে,

“আজ যদি আমাকে স্পর্শ করেন তো আপনার খবর আছে। আমি আপনার লাইফ পার্টনার হলেও বেড পার্টনার না। আপনি কেন বুঝেন না আমাদের সম্পর্ক টা বাকি দশজনের মতো নয়!”

“মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ। তুমি আমাকে কী মনে কর মেহজা? আমি শুধু তোমাকে আমার বেড পার্টনার করে রাখতে চাই? এতটা নিচ ভাবো আমাকে? আমি আজ পর্যন্ত তুমি ছাড়া অন্য নারীর দিকে সেই চোখে তাঁকায়নি।”

“অশ্লীল একটা! সেই চোখ মানে কোন চোখ? ছিঃ আপনি আমার দিকে ঐভাবে তাঁকান?”

রাগ সংবরণ করতে না পেরে ইরফান মেহজার দুই বাহু চেপে ধরে বলে,

“আমি অশ্লীল! আমি তোমাকে দেখে কখনও মাল বলেছি? বলিনি। তুমি আমাকে অসংখ্যবার মাল আর চিজ্ বলেছো। আমি সব শুনেছি। তোমার কীর্তি কলাপ আমি ভুলিনি মেহজা। আমার বডি স্ট্রাকচার দেখে তুমি বলেছো সিক্স প্যাক এবস্ এর বদলে এইট প্যাক আছে। উফফফ! জোস!’ তুমি আমাকে আসতে যেতে দেখা হতেই বলতে। তখন তো আমাকে শার্টলেস দেখনি। তাহলে কীভাবে জানতে আমার সিক্স নয় এইট প্যাক! দ্যাট মিনস্ তুমি আমাকে ঐ চোখে দেখেছো তাইনা! আর একটা কথা সত্যি করে বলবে তো মেহজা! আমার দৃষ্টিতে তুমি কি কখনও অস্বস্তিকর বোধ করেছো? খারাপ বোধ করেছিলে কখনও! স্পিক আপ!”

ইরফানের শেষের কথাটা চিৎকার করে বলাতে মেহজা কেঁপে উঠে। চোখের কোণে পানি চিকচিক করে। সত্যিই তো! লোকটির চাহনিতে তো সে কখনও ঐরকম কিছু অনুভব করেনি। বরং তার এক দেখার জন্য সে মরিয়া হয়ে যেত। ইরফান তার দিকে তাঁকালেই সারা শরীর কেঁপে উঠে। একটা ঝংকার তৈরী হয় তার মস্তিষ্কে। বুকের হৃদস্পন্দন ঢিপ ঢিপ করা শুরু করে। দম আটকে যায়, শরীর ঠান্ডা হয়ে বরফের মতো জমে যায়। এই একণাত্র পুরুষ তার দিকে কখনও অশ্লীল তো দূরে থাক বাঁকা চোখেই চেয়ে দেখেনি। তাকে কীনা সে এভাবে বলতে পারল?

তবে সে মেহজার অনুমতি না নিয়ে তাকে স্পর্শ করেছে। সেটা কেন করেছে? এই সাধু পুরুষের কী একবারও মনে হয়নি সে মেহজাকে যখন ভালোইবাসেনা তখন তার কুমারিত্বে হাত দেওয়াটা অন্যায় হবে! আর বাকি সব পুরুষের মতো তো সে নয়। তাহলে কেন সে তাদের মতোই আচরণ করে? তার অধিকারটাই কী বড়? মেহজার ছোট্ট মনের সুপ্ত ভালোবাসা গুলো কী কিছুই নয়? মেহজার দিকে রক্তবর্ণ চোখে চেয়ে থাকা ইরফান জানে মেহজার মনে কী চলছে। সে কী এখনও বুঝেনি ইরফান তার প্রতি কতোটা দুর্বল? প্রথমবার রাগের বশে হলেও পরের বার তো সে মেহজাকে ভালো………

ইরফানের অভিমান হলো খুব। মেহজার প্রতি অভিমানের পাহাড় গড়ে তুলল মুহূর্তেই। বিছানা থেকে নেমে সোজা রুম থেকেই বেরিয়ে গেল। তার এখন খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে প্রমাণ করতে সে প্রতিবার ব্যার্থ কেন হয়? কেন এত ব্যার্থতা! সেদিন বাবা-মা উপস্থিত সবাইকেই সত্যিটা বলাতে বিশ্বাস করাতে সে ব্যর্থ হয়েছিল আর আজ আবার ব্যার্থ হচ্ছে। মায়ের প্রতি ক্ষোভটাও তড়তড় করে বেড়েই চলেছে। যদিনা সে সেদিন বিয়েটা দিত তাহলে সেও মেহজার সাথে ঘনিষ্ঠ হতো না আর না তৈরী হতো কোনো গভীর সম্পর্ক।

————————————-

বালিশে মুখ গুজে কেঁদেই চলেছে মেহজা। ইরফান কেন সবসময় নিজের রাগ, জেদ আর গাম্ভীর্য বজায় রাখে! একটু নরম হয়ে মেহজাকে বুঝতে তো পারে! একটু ভালোও তো বাসতে পারে। কেন এমন হলো সে? এতটা সুন্দর, অমায়িক চেহারার পেছনে এমন কঠোর একটা মানুষ লুকায়িত আছে জানলে সে কখনও তাকে ভালোবাসতো না।

২ টার দিকে রুমে এসে ইরফান দেখে মেহজা হু হু করে কাঁদছে। ইরফান চমকে যায় মেহজা কী এতক্ষণ ধরে কেঁদেই চলেছে? কেন কাঁদছে সে! তার আবার এত কীসের কষ্ট? কষ্ট সব তো তার। সে তো একটু কেঁদে নিজের কষ্ট কমাতে পারছেনা।

ইরফান গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,

“দশ সেকেন্ডের মধ্যে যদি কান্না বন্ধ না হয় তাহলে সত্যি দশ তলা থেকে ফেলে দিব।”

এবার কান্নার বদলে মেহজার হিচকি শুরু হয়!

#চলবে।

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (১৬)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

সেই রাতে মেহজা কান্না থামায়নি, উল্টো ইরফানের ধমকে আরো বেশি কেঁদেছে। ইরফানও বিরক্ত হয়ে সেই রাতে গেস্ট রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। পরের দিন ইকরা ইরফানের জ্বর চেক করে দেখে সে একদম সুস্থ আছে। তাই সে চলে যায় আর মেহজাও হোস্টেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তত হয়। এখানে আর এক দন্ডও নয়! সব রাগ, অভিমান, ঘৃণা নিয়ে সে ছোটে হোস্টেলে। ইরফান শুধুই নির্বিকার চেয়ে রয়। তার মনে শুধু একটি কথাই বাজছিল, সে ভেবেছিল মেহজা হয়তো যাবেনা তাকে ছেড়ে। সত্যিই যদি তার জন্য মেহজার ণনে কোনো জায়গা থেকে থাকে তো সে যাবেনা। এখন যেহেতু চলেই গেছে তাহলে একটি কথাই পরিষ্কার! আর সেটি হলো ইরফান মেহজার তথাকথিত ক্রাশ ছাড়া আর কিছুই না।

🍁🍁🍁

ভ্যাপসা গরমে থেকে ঘেমে নেয়ে একাকার মেহজা। হাতের ব্যাগটা নিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। রাদিফ সেই কখন থেকে আসছি আসছি বলেই চলেছে কিন্তু আসছেই না। দুদিন হলো মেহজার ইয়ার চেন্জ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বাসা থেকে সব চাপ দিচ্ছে এখন বাসায় ফিরতে। প্রথি আর অনাও চলে গেছে বাড়িতে তাই এখন না চাইতেও যাচ্ছে। আজকাল তার কিছুই ভালো লাগেনা। সব কিছুতেই তার বিরক্ত কাজ করে। যেমন, এখন সে চরম বিরক্ত হচ্ছে রাদিফের উপর। পঁচিশ মিনিট হয়েছে সে দাঁড়িয়ে আছে হোস্টেলের গেইটের সামনে। অসহ্যকর!

রাদিফ অবশেষে দু’মিনিটের মাথায় এসে পৌঁছায়। মেহজাকে বারবার করেসরি বলে ব্যাগ খাড়ির ডিকিতে তুলে রওনা দেয় গুলশানের পথে। সন্ধ্যার একটু আগেই পৌঁছে যায় বাসায়। এদিক ওদিক চেয়ে মেহজাকে বলে,

“বাসায় চলে যেতে পারবিনা? ট্রলি নিয়ে লিফ্টে উঠে গেলেই তো সব সমস্যা শেষ!”

“হুম। তুমি কোথায় যাবে?”

“একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।”

“কার সাথে?”

“রাতে এসে বলব। ঠিক আছে?”

“আচ্ছা তবে তুমি যদি রেস্টরন্ট গিয়ে থাক তাহলে আমার জন্য ডাবল পেটি বার্গার নিয়ে আসবে।”

“আচ্ছা আনব। এখন আমি আসি তাহলে!”

“এসো।”

মেহজা যতক্ষণ না লিফ্টের কাছে যায় ততক্ষণ রাদিফ চেয়ে রয় সেই পানে। বোনটির চেহারা আর আগের মতো উজ্জ্বল নেই। চঞ্চলতা তো সেই কবেই হারিয়েছে! নাদুস নুদুস মেহজা এখন শুঁকনো কাঁঠ বলা চলে। পরিস্থিতি সব পারে। সব! একটা উঁড়নচন্ডীকেও এক মুহূর্তের মধ্যে শান্ত শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট করে দিতে সক্ষম।

বাসার কলিংবেল চাপতেই রাফসান দৌঁড়ে এসে দরজা খুলে “মেহজা তুই এসেছিস!” বলে চিৎকার করে ওঠে। মেহজা ভাইকে অনেকদিন পর দেখে জড়িয়ে ধরে বলে,

“হ্যাঁ তো! তোকে জ্বালাতে এসেছি। নিশ্চয়ই তুই নাখোশ!”

“একদম না! আমি চাই তুই আমাকে জ্বালা অনেকদিন হলো আমরা ঝগড়া করিনারে আপু।”

ভাইয়ের মুখে আহ্লাদী কন্ঠে আপু ডাকটা শুনে নিজেকে সামলাতে পারেনা মেহজা। জড়িয়ে ধরে শক্ত করে রাফসানকে। রাফসান মেহজার কানে ফিসফিস করে বলে,

“রাদিফ ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে জানিস?”

মেহজা কথাটা শুনে মনে হয় আকাশ থেকে পড়ল। রাদিফ ভাইয়ের বিয়ে মানে! কোথায়? রাদিফ ভাই তো কিছুই বলেনি। মেহজার সবার উপরে রাগ হলো সবচেয়ে বেশি রাগ হলো রাদিফের উপর। সে একবারও মেহজাকে জানালো না? সে এখন এতোটা পর! বাহ! দারুন তো! রাগে ফুসতে ফুসতে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। বাবা মায়ের সাথেও দেখা করেনা। এরা সব পেয়েছেটা কি! কেউ কিছুই জানায়না তাকে সব কিছু তাকে হুট করে জানতে হয়। এটা কেন? ওর কী কোনো গুরুত্ব নেই এখন আর!

রাতে রাদিফ আসলেই মেহজা রুম থেকে বের হয়। কথার মধ্যে সে আরেকটি ব্যাপারেও অবগত হয় তার ভাইয়ের সাথে রিমির বিয়ে হতে চলেছে। শুধু তাতেই সীমাবদ্ধ নয় তারা চার বছর যাবৎ চুটিয়ে প্রেমও করেছে। শেষমেশ রিমিও সব গোপন রেখেছে দেখে তার রাগটা মাত্রাতিরিক্ত হয়। পরে রাদিফ অনেক বলে কয়ে রাগ ভাঙায় তার। এখন রাগ অভিমান ভুলে যে কয়টা দিন আছে ভাইদের সাথে আড্ডা মাস্তি করে কাটানোটাই বেস্ট বলে মনে হচ্ছে মেহজার।

মেহজা বাসায় এসেছে তিনদিন হয়েছে। ইরফানের মা মাহিমা বেগম আর বাবা আহনাফ মজিদ এসে তার সাথে দেখা করে গেছে কারণ সে নিজে একবারও যায়নি। এবং যেতেও চায়না তাই তারাই এসেছিল।
মেহজা ছাঁদে গেল। এখন সে সেই সোফাটায় বসেছে যেখানে শেষ ইরফানের সাথেই এসেছিল একবছর আগে। একবছর! দেখতে দেখতে তো একবছর হয়ে গেছে খেয়ালই ছিল না। তার বয়সও আঠারোতে পড়েছে চার মাস আগে। সময় কত দ্রুতই না চলে গেল। কিন্তু সম্পর্ক গুলোর এখনও কোনো সমাধা হয়নি। হয়নি কোনো মনের মিলন। আশ্চর্য! ইরফান কেন তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছে না! এভাবে থাকলে কারোরই জীবন আগাবে না। একটা অদৃশ্য মায়াজালে আটকে থাকবে আজীবন, তবুও কোনো গতি হবে না। মেহজার ভাই রাদিফের আগামীকাল গায়ে হলুদ। সেই সুবাদে ছাঁদ সাজানো হচ্ছে মেহজা সেদিকে তাঁকিয়ে আছে আর ভাবছে বিয়ে নিয়ে তার হরেক রকম স্বপ্ন ছিল। যার রং কখনো লাল কখনো নীল কখনো সবুজ কখনো গোলাপী ছিল। চোখ ছলছল করছে এই মুহূর্তে কাঁদতে তার একদমই ইচ্ছে করছে না। এখন সে শপিং করবে রিমি অলরেডি কল দেওয়া শুরু করে দিয়েছে।

আজ রাদিফ আর রিমির গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। মেহজা আজ খুব সেজেগুজে এসেছে ছাঁদে। হলুদ আর সোনালী কারুকার্য খচিত লেহেঙ্গা তুলে হাঁটছে সে। একটু বেশিই ভাড়ি আর লম্বা লেহেঙ্গাটা। ভাইয়ের হলুদের অনুষ্ঠানে সে খুব ভালোই তদারকি করছে। এদিক ওদিক দেখছে কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না!

ইরফানের পুরো পরিবারকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। শুধু তাদেরই নয় পুরো বিল্ডিং এর সবাই উপস্থিত আছে আজ। চৌদ্দ তলায় থাকে মেহজার কাছের বন্ধু তূর্ণা। তার মা বাবা আর বড় ভাই তানজীব ও এসেছে। প্রথম প্রথম মেহজা যখন এই এলাকায় আসে তখন সবার আগে সেই পরিবারের সাথেই তাদের পরিবারের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।

মেহজা ছবি তুলতে ব্যস্ত প্রতি আর অনার সাথে। তখন সেখানে তানজীব আসে। পেশায় সে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। মেহজা তাকে সবসময় ডক্টর বলেই ডাকে। আগে অবশ্য ভাইয়া বলতো তখন তানজীব মানা করে ভাইয়া ডাকতে। সে নাকি তার ভাই হয়না তার বোন তূর্ণা ছাড়া আর কোনো বোন নেই। আর কেউ তাকে ভাইয়া ডাকুক সেটা সে একদম পছন্দ করেনা। কিন্তু কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা সে কেবল মেহজার মুখ থেকেই ভাইয়া ডাক শুনতে চায়না। কারণটাও স্পষ্ট মেহজার কাছে। সে জানে তানজীব তাকে পছন্দ করে। তবুও কিছু না বোঝার ভান করে থাকে কারণ সে বুঝতে চায়না। যদি না সে প্রথম দিন এই বিল্ডিং এ ইরফানকে না দেখতো তাহলে হয়তো তানজীবকে সে সুযোগ দিত। তানজীব যথেষ্ট সুদর্শন। ইরফানের থেকে কোনো অংশে কম নয় সে। পার্থক্য একটাই! ইরফান গৌড় বর্ণের আর তানজীব শ্যাম বর্ণের। কালোও বলা চলেনা আবার ফর্সাও বলা যায়না দুটোর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করছে সে। চোখে সবসময় চশমা থাকবে যার জন্য সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায়। তবুও সেই পুরুষকে সে ভালোবাসতে পারবেনা কখনও। ইরফানকেই সে শেষ অব্দি ভালোবেসে যাবে ইরফান না বাসলেও হবে। এখন সে আর ইরফানের ভালোবাসা চায়না।

মেহজার দিকে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে তানজীব মৃদু হেসে বলে,

“সুন্দর লাগছে অনেক।”

“থ্যাংকস্ ডক্টর! আপনাকেও আজ অনেক বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ।”

“থ্যাংকস্ ফর দ্যা কমপ্লিমেন্ট ম্যাম!”

“ম্যাম?”

“বলতেই পারি আমার মুখ।”

“আপনার মুখে যা আসবে তাই বলবেন নাকি?”

“সব তো আর বলতে পারবো না। কিছু কথা বলায় যায়।”

“আচ্ছা ডক্টর আমার অনেক কাজ বাকি আছে। এখনও হলুদটাই আনিনি বাসায় যেতে হবে।”

“শিউর, বাট!”

“বাট?”

“আমি তোমাকে বাসা পর্যন্ত সঙ্গ দিতে পারি?”

“অবশ্যই! আসুন।”

তানজীব হেসে মেহজার সাথে নিচে নামে। মেহজাই সিঁড়ি বেয়ে নামার জন্য অফার করে। তানজীবও খুশি মনে গ্রহণ করে। আরেকটু বেশি সময় কাটানো যাবে মেহজার সাথে। তানজীব মেহজার দিকে তাঁকিয়ে প্রশ্ন করে,

“হোস্টেলে উঠেছো কেন মেহজা? আমার জানা মতে তোমার কলেজের দূরত্ব এখান থেকে আধা ঘন্টার। কিছু হয়েছে নাকি?”

মেহজা আহত দৃষ্টিতে তাঁকায় যেন তানজীব এমন প্রশ্ন করে তাকে অনেক আঘাত করে ফেলেছে। আসলেই তানজীব তাকে আঘাত করেছে তবে সেটা শারীরিক নয় মানসিক ভাবে। এই প্রশ্নর উত্তরটা তার কাছে খুবই কষ্টের। সে চায়না কেউ জানুক তার এই কষ্টের কথাটি। মেহজা তবুও আলতো হেসে বলে,

“ঢাকা শহরের জ্যাম আছেনা! আধা ঘন্টার রাস্তা দুই ঘন্টা লাগিয়ে দেয়। আর তাছাড়া আমার বেস্টফ্রেন্ডরা হোস্টেলে থাকতো ওদের রুমের একটি সিট খালি ছিল তাই আমিও চলে গেলাম তাদের সাথে থাকার জন্য।”

তানজীব কিছুটা অবাক হয়। তার জানা মতে মেহজার কলেজ সকাল আটটায় শুরু হয়। আর এদিকের রাস্তাটায় অতোটাও জ্যাম হয়না। সময় এবং রাস্তা দুটো বিচার করলে মিনিমাম পয়ত্রিশ মিনিট সময় লাগবে হয়তো। আর বেস্টফ্রেন্ডের সাথে থাকার জন্য পরিবার ছেড়ে যাবে কেন? কোনো বড় কারণ আছেই। এমনিতে হোস্টেলে থাকা অসম্ভব! মেহজা তানজীবকে চিন্তিত হতে দেখে বলে,

“গিটার এনেছেন আজ ছাঁদে?”

“হ্যাঁ এনেছি।”

“আপনি গান গাইতে পারেন আগে জানতাম না।”

“জানতে চাইলে জানতে পারতে।”

মেহজা হাসে সেই হাসিতে তানজীবের প্রতি একটু মায়া থাকে। লোকটি তাকে পছন্দ করে নাকি ভালোবাসে? কোনটা!
হলুদের বাটি নিয়ে উপরে গেলে সবাই হলুদ পর্ব শেষ করে। তারপর গান, নাঁচের পালা শুরু করে। মেহজারা কয়েকজন মিলে নাঁচে। রুম্পা, মেহজা, ঈশিতা একই সাথে সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করে। তারপর অনেকেই নাঁচে আর গায়। পরিশেষে সবাই তানজীবের গান শুনতে গোল হয়ে বসে ছাঁদের এক কর্ণারে। যেখানে গোল করে সোফা সেট রাখা হয়েছে। মধ্যমণি তানজীবও গিটারের টুংটাং শব্দ তুলে গান গাইতে শুরু করে যার প্রতিটি কথায় মেহজার দিকে তাঁকিয়ে বলে। প্রত্যেকটি লাইনের অর্থে তানজীব সুস্পষ্ট ভাবে মেহজাকে সব বুঝিয়ে দিতে চাইছে। মেহজার তখন হার্টবিট দ্রুত গতিতে হতে থাকে বারবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকে সে যা বুঝছে তা যেন মিথ্যা হয়। সে চায়না কারো মন ভাঙতে কারণ সে জানে এর কষ্ট কি পরিমাণ! সে না চাইতেও তার কানে লাইন গুলো বারবার বাজছে,

“ডার্লিং জাস্ট হোল্ড মাই হ্যান্ড!
বি মাই গার্ল, আই উইল বি ইউর ম্যান
আই সি মাই ফিউচার ইন ইউর আইস,

বেইবি, আই এম!

ড্যান্সিং ইন দ্যা ডার্ক, উইথ ইউ বিটউইন মাই আর্মস
বেয়ারফুট অন দ্যা গ্রাস,
লিস্সেনিং টু আওয়ার ফ্যাভরিট সং
হোয়েন আই স্য ইউ ইন দ্যাট ড্রেস,
লুকিং সো বিউটিফুল
আই ডোন্ট ডিসার্ভ দিস,
ডার্লিং, ইউ লুক পার্ফেক্ট টুনাইট!

এক এক করে সব ছাঁদ থেকে নেমে যায়। একটা বেজে গেছে তাই সকলে ঘুমাতে যায়। তানজীবও মেহজাকে বাই বলে চলে যায়। এখন ছাঁদ খালিই বলা চলে। মেহজা কেন ছাঁদে একা বসে আছে সে জানেনা। তবে এটা বুঝতে পারছে তার মনের অবস্থা ভালো নয়। মেহজা ছাঁদের কর্ণারে রেলিং ধরে দাঁড়ায় তখনিই পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করে। ভয় পেয়ে যায় খুব। সবাই তো চলে গেছে তাহলে এখন এখানে কে এসেছে? জ্বীন মনে আসতেই সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তখনই একটা গরম নিঃশ্বাস তার ঘাঁড়ে আঁচড়ে পড়ে। সে শিউরে উঠে আচমকা এই কাজে। তখনিই কানের লতিতে কেউ কাঁমড় বসায় অমনি মেহজার চোখ থেকে টুপ করে পানি পড়ে যায়। পেছনে থাকা ব্যক্তির গায়ের পারফিউমের গন্ধ আর তার কাজ কারবারে সে একজনের কথায় মনে করছে। পেছনে ফিরে অনেক সাহস করে তারপর দেখে ইরফান একটি হলুদ পান্জাবী পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অসাধারণ দেখতে লাগছে ইরফানকে। এই মানুষটি বরারবরই কোনো না কোনো নতুন লুকে হাজির হয় আর মেহজার হৃদয় কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যায়। মেহজা অনুভব করছে তার সারা শরীর কাঁপছে। হাতগুলো জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে, শুধু হাতই নয় সারা শরীর জমে যাচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন? মেহজা এটাও খেয়াল করল যে তার ভয়টা হুরহুর করে বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী? ইরফান শীতল দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে বলে,

“হোয়েন আই স্য ইউ ইন দ্যাট ড্রেস,
লুকিং সো বিউটিফুল
আই ডোন্ট ডিসার্ভ দিস,
ডার্লিং, ইউ লুক পার্ফেক্ট টুনাইট!
লাইনগুলো আমার একদম পছন্দ হয়নি মেহজা। তোমার উচিত ছিল নিজের সেই সৌন্দর্য ঢেকে রাখা। যা তুমি কর নি। এখন তোমাকে কী সাজা দেই তুমিই বল।”

#চলবে।