#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৯)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
তানজীব আর ঈশিতা একটি টেবিলে একে অপরের মুখোমুখি বসে আছে। ঈশিতা একটু বিস্ময়ের মধ্যেই আছে। ডক্টর তানজীব দুই বছর আগেই একেবারে আমেরিকায় নাকি সেটেলড হয়েছিল। তাহলে এখানে কী করছে সেটাই ভাবছে। আর তানজীব ঈশিতাকে দেখে বাহিরে কিছুটা বিরক্ত প্রকাশ করলেও ভেতরে ভেতরে তার ব্যাপারটা মন্দও লাগেনি। তানজীব আর ঈশিতার প্রথম পরিচয় তানজীবের বন্ধ সোহানের মাধ্যমে। ঈশিতা তাদের তিন ব্যাচ জুনিয়র ছিল মেডিকেলে। সোহান ঈশিতাকে তখন পছন্দ করত অনেক। একদিন সে তার অনুভূতি ঠিঠিতে লিখে নিচে তানজীবের নাম লিখে ফেলে। তাও অনিচ্ছাকৃত ভাবেই। পাশ থেকে তখন কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, “তোর পাশে কে বসেছে ব্যাগ কার?” সোহান ছোট করে উত্তর দেয়, “তানজীব” ব্যাস! ইতি টেনে সেখানেও তানজীবই লিখে ফেলে। অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিল সে তখন। পরে যখন চিঠিটা ঈশিতা পায় তখন সে তানজীবকে যা নয় তা বলে। স্টুডেন্ট অবস্থায় প্রেম ভালোবাসা করলে পড়ালেখা আর হবে না এমনটাই সে আজীবন পোষণ করে এসেছে নিজের মধ্যে এখনও তাই! তবে এখন সে একজনের প্রতি একটু দুর্বল। এটা ভালোবাসা নয় তবে ভালোলাগা বলা যায়। ইরফানকে সে পছন্দ করে। সেদিন ঈশিতাকে রাগের বসে তানজীব থাপ্পড় মারে। ক্যাম্পাসে ভরা মানুষের সামনে সে যেমন তানজীবকে কথা শোনায় তানজীবও তাকে বদলা ফিরিয়ে দেয় একটা চড়ের মাধ্যমে। পরে সেখানে সোহান আসে তখনিই সবটা খোলাসা হয়। তবুও দুজন দুজনের প্রতি একটা রাগ ক্ষোভ রেখে দেয়। তারপর থেকে প্রায় সময় তাদের ঝগড়া লাগে। দিন পেরিয়ে যায় অনেক। তানজীব ইন্টার্নি করা শুরু করে তখন একদিন ঈশিতার সাথে তার দেখা হয় সেদিন ঈশিতা তার কাছে আগের ব্যাপারটা নিয়ে দুঃখীত জানালে সেও ঈশিতাকে চড় মারার জন্য অনুতপ্ত হয়েছে বলে। একটু ভালো কথা হয় তাদের মধ্যে তখন সে জানতে পারে তানজীব আর কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকা চলে যাবে। সেখানে একটা হসপিটালে জয়েন করবে। সেদিন ঈশিতা বিদায় নেওয়ার সময় শুধু বলে, “ভালো থাকবেন ডক্টর তানজীব। আল্লাহ্ হাফেজ।” ঈশিতার মুখে ডক্টর ডাকটা শুনে তানজীব সেদিন শুধুই মৃদু হেসেছিল।
তানজীব ঈশিতার মনের কথা বুঝতে পেরে বলে,
“বিদেশ আর যাওয়া হলো না ডক্টর ঈশিতা। আম্মা আমায় যেতে দেয়নি। তারচেয়ে বড় কথা সরকারি চাকরী পেয়ে গিয়েছিলাম। দেশপ্রেমটাও জাগ্রত হলো বুঝলেন। দেশে পড়েছি তাই দেশের জন্যই কিছু করি। বিদেশে গিয়ে শুধু শুধু তাদের লাভ আর আমাদের ক্ষতি করব কেন বলুন!”
“ভালো সিদ্ধান্ত।”
“আপনি তো ডক্টর হয়ে গেছেন তাইনা!”
“হ্যাঁ! একমাস হলো একটা প্রাইভেট হসপিটালে আছি।”
“যাক! ডক্টর সম্বোধন করাটা বৃথা যায়নি।”
ঈশিতা হেসে ফেলে। তানজীব পুরোনো কথা গুলে ভুলে আছে ভেবে সে কিছুটা খুশি হয়েছে। সংকোচ কাটিয়ে ঈশিতাও তানজীবের সাথে আলাপ জুড়ে। সেই সুবাদে তানজীব জেনে যায় ঈশিতা মেহজার কাজিন আর ঈশিতা জেনে যায় মেহজাদের বিল্ডিং এ তানজীবরাও থাকে।
☆☆☆
মেহজা অনাকে সামলাচ্ছে। মেয়েটা কাঁদছে খুব। সিনানের উপর এই মুহূর্তে খুব রাগ উঠছে তার। অনাকে শত বুঝিয়েও যখন লাভ হয়না তখন সেখানে ইরফান উপস্থিত হয়। ইরফান হেসে বলে,
“তোমার মেকআপ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তো অনা।”
অনা চমকে ইরফানের দিকে তাঁকায়। ইরফানকে দেখে তার সব রাগ, ক্ষোভ যেন নিভে যায়। ইরফানকে এখানে দেখবে সে আশা করেনি। আসলে তখনও সে ইরফানকে লক্ষ্য করেনি যখন সিনানের সাথে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। অনা কান্না থামিয়ে বলে,
“আপনি তো ইরফান ইয়াজিদ তাইনা?”
“জ্বি হ্যাঁ!”
“আমি আপনাকে চিনি ভাইয়া। আমার বড় ভাই অনিক আপনাদের দলের। মানে, কীসের সহ সভাপতি হয় মনে হয়।”
“চিনি আমি। তোমাকেও আমি আগেই দেখেছি।”
“তাই নাকি! কোথায়?”
“একদিন ক্লাবে এসেছিলে অনিকের সাথে।”
“ও… আমি আপনার নজরে পড়েছি?”
“হ্যাঁ পড়েছ তো! তা এখন এমন কাঁদছ কেন? দেখতে ভালো লাগছেনা। এত বড় মেয়ের এমন ভরা লোকের ভেতর কাঁদাটা বড্ড বেমানান। বুঝলে?”
অনা মৃদু হাসে ইরফানের কথা শুনে। মেহজা ক্রুদ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে ইরফানের দিকে। প্রথম সাক্ষাতেই অনাকে সে তুমি করে বলছে, অনা নাকি তার নজরে পড়েছে, আবার অনাকে বড়ও বলছে। তাহলে তাকে কেন বাচ্চা বাচ্চা বলতো? এটা কেমন বিচার! তার ফ্রেন্ডকে বড় বলে আর তাকে বলে বাচ্চা! বৈষম্য করে! না! আসলে লোকটা বদ! লুচ্চা।
মেহজাকে কটমট দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে ইরফান ভ্রুঁ কুঁচকায়। মেহজা মুখ বাঁকিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। লোকটা আস্ত অসভ্য!
ইরফান মেহজার যাওয়ার দিকে তাঁকিয়ে থাকে। মেহজা কেন এমন করেছে সেটা তার বুঝতে বেগ পেতে হয়না। তবে এইটুকু ব্যাপারে তার এমন রিয়েক্ট করা বেমানান। ইরফানও মুখ ঘুরিয়েই নিচ্ছিল তখনিই মনে পড়ে গতকাল রাতেই তো সে মেহজাকে দিয়ে ওয়াদা করিয়েছে আজ সারাদিন সে যা বলবে মেহজা বাধ্য হয়ে তা শুনবে এবং পালন করবে। ইরফান দ্রুত কদম ফেলে মেহজার পথ আটকায়। তারপর ভরাট গলায় বলে,
“মেহজা কালকের ওয়াদা ভুলে গিয়েছ?”
মেহজা দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। সে সত্যিই ভুলে গেছে। ইরফানটাও ভুলে যেত পারল না! সে ভেবেছিল এখন সে রাগ আর জেদ ধরে একটা পার্ট নিবে। তা আর হলো কোথায়! ইরফান পুনরায় জিজ্ঞেস করতেই মেহজা জবাব দেয়,
“না মনে পড়েছে।”
“না আবার মনে পড়েছে। তারমানে ভুলেই গিয়েছিলে! সে যাই হোক! তুমি ওয়াদা ভঙ্গ করেছ। প্রথমে তো নয়টায় আমার রুমে যাওনি আর দ্বিতীয়ত আমার সাথে করে গাড়িতে আসোনি। বরং তানজীবের সামনে আমায় লজ্জিত করেছ। এখন তুমিই বল শাস্তি হিসেবে কি নিতে চাও!”
“আমি ঠিক নয়টায় আপনার বাসায় গিয়েছিলাম। আর আজ আমার ভাইয়ের বিয়ে! ভাইয়ের বিয়েতে বোন তার ভাইয়ের গাড়িতেই যায়। এটা স্বাভাবিক!”
“তুমি আমার বাসায় গিয়ে আমার সাথে তো আর দেখা করনি। আর তুমি আমাকে লজ্জিত না করে ঠিকভাবে আমার অনুমতি নিয়েও রাদিফের গাড়িতে আসতে পারতে। ছোট্ট করে বড় একটা অপমান করেছ তুমি আমার। শোনো মেয়ে! তুমি এখন কঠিন শাস্তি পেতে চলেছ।”
“যেমন?”
“শাড়ি খুলে দাঁড়িয়ে থাকবে।”
“কিইইইইইই! পাগল হয়ে গেছেন নাকি? কি যা তা বলছেন।”
“হুম সেটাই করব। আমার থার্ড অর্ডার পূরণ না করলে এই শাস্তিটাই পাবে।”
“আচ্ছা আচ্ছা! বলুন আপনার নেক্সট কাজ।”
“দুটো বেজে এসেছে। টাইমলি খাওয়া আমার অভ্যাস। এখন আমি খাব আর তুমি আমার পাশেই বসে থাকবে। আমার কি লাগবে না লাগবে তুমি সব এগিয়ে দিবে।”
“আজব! আপনার খাওয়ার হলে আপনি খান না। আমাকে জড়াচ্ছেন কেন? এতদিন একা কীভাবে খেতেন?”
“বউ ছিল না বিধায় খেতাম একা একা। এখন বউ আছে সাথে একা কেন খাব?”
“বউকেই খান।”
“আচ্ছা চল তাহলে।”
“কোথায়?”
“তোমাকে খেতে হবে তো।”
“আপনি একটা অসভ্য মানুষ তা কী জানেন?”
“এখন জানলাম।”
মেহজা রেগে লাল হয়ে যায়। ইরফান মুঁচকি হেসে তার হাত টেনে নিয়ে যায় খাবার খাওয়ার জায়গাতে। ইরফান সেখানে গিয়ে দেখে সিনান একটা টেবিলে বসে একের পর এক বিয়ার খাচ্ছে। ইরফান সেই টেবিলে গিয়ে বসে।
“মেজর সাহেব? বিয়ার ও খান নাকি!”
সিনান হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর বলে,
“এটা বিদেশি ড্রিংক। ড্রিংক মানেই মদ আর বিয়ার নয় বুঝলেন। এটা ফলের জুস এবং এটি সম্পূর্ণ হালাল উপকরণ দিয়ে তৈরি। ক্যানটা এমন যে কেউ দেখলেই বিয়ার বলবে। এটা আমি আর রাদিফ আনিয়েছি। আমরা কয়েকজন খাব বাকিদের জন্য অন্য ড্রিংকস্ এরেন্জ করা। নিন আপনিও দুইটা খান। তিন চারটা খেলেও খারাপ লাগবেনা। রিফ্রেশমেন্ট কাজ করে বুঝলেন।”
ইরফান হাসিমুখে একটা নেয়। মেহজারও খেতে ইচ্ছে হয় তাই সেও একটা নেয়। সিনান বলে,
“তুমি আরো তিন চারটা নিয়ে নাও মেহজা।”
“কেন? আমি একটাই খাব ভাইয়া।”
“না বলছিলাম কি তোমার বান্ধবীদের জন্য নিয়ে নাও।”
“আচ্ছা।”
“মেহজা!”
সিনানের গলায় কিছু একটা ছিল যাতে মেহজা কিছুটা অবাক হয়। সিনান ইরফানের দিকে একবার চেয়ে বলে,
“তোমার সেই বান্ধবীটা কোথায়?”
“কোনটা?”
“ঐ যে তখন …..
“অনা! হুহ, এখন তার খবর নিচ্ছেন কেন? অপমান তো কম করেন নি।”
“তুমি শুধু আমার করা অপমানটাই দেখলে সে যে আমাকে করেছে সেটি দেখলেনা?”
“আপনি একটু বেশিই করেছেন।”
সিনান অসহায় দৃষ্টিতে ইরফানের দিকে তাঁকিয়ে বলে,
“দেখলেন মি. ইয়াজিদ! আমরা ছেলেরা এই সমাজে কতটা অবহেলিত!”
“হ্যাঁ ভয়াবহ রকমের অবহেলিত।”
মেহজা দুজনের দিকে চোখ গরম করে তাঁকিয়ে পুরো একটা বক্স নিয়ে চলে যায়। সিনান নির্বিকার চেয়ে রয় সেদিকে। তারপর মনে পড়ে সেই বক্সে নেশা জাতীয় কিছু ড্রিংকস্ ও আছে যা খেলে ভয়ানক কিছু ঘটতে পারে। ইরফানকে বলবে বলবে করেও বলা হচ্ছেনা। আসলে এই ড্রিংকস্ গুলো স্পেশালি রাদিফ আর তাদের গ্যাং এর কিছু বিবাহিত বন্ধুদের জন্যে এনছিল। নেশা জাতীয় ড্রিংকস্ আছে শুনলে ইরফান হয়তো মাইন্ডে নিতে পারে। তাই সে উঠে গিয়ে মেহজার থেকে বক্স আনতে যাবে তখন ইরফান তাকে ডেকে ইরফানের পাশে বসিয়েই একসাথে খাবার খাওয়ায় জোরপূর্বক। গল্পে মশগুল সিনানও বক্সের কথা বেমালুম ভুলে যায়।
বিয়ে শেষে সবাই যে যার বাসায় ফিরে শুধু অনা, প্রথি আর সিনান ও মেহজার বাকি কাজিনরা মেহজাদের ফ্ল্যাটেই যায়। রাতে সবাই ঘুমালে মেহজা অনা আর প্রথি ব্যাগ থেকে সেই ক্যান গুলো বের করে নিয়ে বারান্দায় বসে। সফট্ মিউজিক ছেড়ে ড্রিংক করতে থাকে। প্রথম চুমুকেই মাথা ভনভন করে উঠে। পরে আর কোনো থামাথামি না করে একে অপরের সাথে কাড়াকাড়ি করে ছয়টা ক্যান খালি করে দেয়।
নেশায় চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে সবার। প্রথি ঘুমিয়ে পড়লেও মেহজা আর অনা বিরাট কান্ড ঘটায়!
#চলবে!
#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২০)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
পানির বোতলটা নিয়ে শোবার ঘরটায় যাচ্ছে সিনান। রাফসানের রুমে সে আর রাফসান থাকবে আর বাকিরা ড্রয়িং ডাইনিং এ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেহজাদের ফ্ল্যাটটি ইরফানদের ফ্ল্যাটের মতো ডুপ্লেক্স না হলেও ছোট নয়। চৌদ্দ তলা থেকে প্রত্যেকটি ফ্ল্যাট একটা করেই। তেরো পর্যন্ত প্রতি তলায় পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট হলেও চৌদ্দ থেকে পুরোটা জুড়েই একটি ফ্ল্যাট। তন্মধ্যে ঊনিশ থেকে চব্বিশ সব ডুপ্লেক্স। মেহজাদের বাসায় বেডরুম ছয়টি পার্সোনাল লিভিং সহ বড় ড্রয়িং ডাইনিং আছে। তাই সবারই থাকার জায়াগা বেশ ভালোই হয়ে গেছে। মেহজার রুমে ঈশিতা, রুম্পা আর প্রথি ঘুমিয়ে আছে। তারা বেডেই শুয়েছে আর নিচে ফ্লোরিং করেছে মেহজা আর অনা। বড় সোফাটায় ও একজন শুয়েছে তিনি হলো মেহজার খালামণি। মেহজার দাদা-দাদু, ফুফুরা নিজ নিজ বাড়ি চলে গেছেন। তাদের বাসা কমিউনিটি সেন্টার থেকে কাছে ছিল তাই আর এদিকে আসেননি তখন। আবার কাল আসবে। রাদিফ-রিমিকে তাদের রুমে ঢুকিয়ে সবাই যে যার মতো যেখানে পেরেছে শুয়ে পড়েছে। তবে সিনান আর রাফসানই সবচেয়ে আরামে আছে বলা চলে। তারা দুজন ছাড়া এই রুমে আর কেউ আসেনি। কারণ সিনান কাউকে আসতে দেয়নি। তার এক কথা!
“আমি এত ভিড়ে ঘুমাতে পারিনা। যদি আমাকে সুন্দর ভাবে রিল্যাক্সে জায়গা দিতে পারো তো আমি আছি নইলে আমার বাসা এখান থেকে বেশি না আধা ঘন্টার দূরত্বে।”
নিজাম বেজার মুখে বলে “শালা! ভালো হয়ে যা বলে দিলাম। সবসময় কোনো না কোনো কিছুর ফায়দা না তুললে তোর হয়না বুঝি?”
“না হয়না!”
যেহেতু আরো জায়গা আছে তাই কেউ আর আপত্তি করেনি। রাফসান তার সমবয়সী কাজিন রাতুলের সাথে গল্প করতে করতে ড্রয়িং রুমের বড় সোফাটায় দুজন দুদিকে ঘুমিয়ে পড়েছে। সিনান তা দেখে ভ্রু কুঁচকায় দু তিনবার রাফসানকে ডাকলেও সে নড়ে না। এখানে সে বিন্দাস ঘুমিয়ে আছে দেখে সিনান আর কিছু না বলে ছুটল ঘুমাতে। চোখে খুব ঘুম তার। এখনই বিছানায় গা এলিয়ে না দিলে নয়। মেহজার রুম ক্রস করে সে রাফসানের রুমে ঢুকে পড়ে। অনাও ঠিক তখনিই ঢুলুঢুলু অবস্থায় রুমের দরজা খুলে সিনানকে দেখে তার পিছু নেয়। উদ্দেশ্য সিনানকে পেটানো! তখনকার ব্যবহারটা যা করেছে সে তার জন্য শাস্তি পেতেই হবে। অনাও সিনান রুমে ঢোকার পর সেই রুমে ঢুকে পড়ে। তারপর দরজাটা শুধু হালকা ভিড়িয়ে দেয়। নেশা এখনও পুরোপুরি হয়ে উঠেনি তাই কিছুটা বোধ বুদ্ধি এখনও আছে। দরজা ভেড়ানোর শব্দে সিনান পেছন ফিরে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অনার দিকে তাঁকানো দায়। লেহেঙ্গার ওড়নাটা গায়ে নেই শুধু উপরের ব্লাউজটা আর নিচের স্কার্টটা পড়া শুধু। সেগুলোর অবস্থানও এখন মার্জিত নেই। কেমন একটা দেখাচ্ছে তাকে। অনাকে ঢুলতে দেখে তার মাথায় একটা কথা নড়াচড়া দিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম পালিয়ে যায়। ক্যানগুলোর কথা তো তারমনেও ছিল না। তারমানে ওরা ড্রিংকস্ করে নিয়েছে। এখন কেউ যদি এই অবস্থায় দেখে ফেলে অনাকে তাহলে নিশ্চয়ই সিনানের খবর হয়ে যাবে। সিনান অনাকে ধমক দিয়ে বলে,
“এই মেয়ে এখানে কী করছ তুমি? কমনসেন্স যে তোমার নেই তা আমি আগেই বুঝেছি। এখন আবার কী প্রমাণ করতে এসেছ?”
অনা সিনানের এমন কথায় রেগে বলে,
“তোকে কেলাবো তাই এসেছি। আয় কাছে আয়! আজ তোর হাঁড় না ভাঙলে আমিও অনা না।”
“এই এসব কী কথা বলছ? যাও রুমে যাও। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবেনা বলে দিলাম। বেরিয়ে যাও!”
“না। বের না হলে কী করবি? বল কী করবি!”
“মেরে হসপিটালাইজড্ করে দিব অসভ্য মেয়ে কোথাকার।”
সিনান অনার হাত ধরে টেনে নিয়ে বের করে দিতেই অনা কিছুটা জোরেই বলে ওঠে,
“আমি চিৎকার করব এখন। বলব তুই আমায় বের করে দিচ্ছিস।”
সিনান অনার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে আসে। দরজাটা পুরোপুরি লাগিয়ে অনার বাহু চেপে ধরে বলে,
“নেশা হয়ে গেছে তোমার। কী সব আবোল তাবোল বকছো তুমি নিজেও জানো না। দেখ অনা! ভালো মেয়ের মতো এখান থেকে চলে যাও।”
“কেন যাব?”
অনা এক ভ্রুঁ উঁচু করে তাঁকিয়ে আছে সিনানের দিকে। সিনান না চাইতেও অনার স্পর্শকাতর জায়গা গুলোতে বারবার তাঁকাচ্ছে। অনাকে এই মুহূর্তে বোঝানো যাবেনা তা সে ভালো করেই জানে। অনা যদি আর কিছুক্ষণ থাকে তখন তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেতে পেরে। সিনান বিরক্ত সূচক শব্দ প্রকাশ করে অনাকে বলে,
“আচ্ছা আমাকে মারতেই তো এসেছো তাই না! দু ঘা দিয়ে চলে যাও।”
“না থাক। আমি মারবোনা আপনাকে।”
“তাহলে তো ভালোই হলো। যাও এবার এখান থেকে চলে যাও।”
“চলে যাব বলিনি তো একবারও! এখানে ঘুমাবো আমি। মেহজার বিছানায় প্রথি শয়তান টা শুয়ে সব জায়গা দখল করে আছে। এখানে অনেক জায়গা আছে। আমি এখানেই ঘুমাবো।”
“না!”
কে শোনে কার কথা! অনা ঢুলতে ঢুলতে বিছানার মাঝ বরাবর শুয়ে পড়ে। এবার তার পুরো পেট দৃশ্যমাণ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সিনান লাইট নিভিয়ে দেয়। অন্ধকার তবুও হয়নি চাঁদের আলো এসে পড়ে ব্যাপারটা আরো মোহনীয় করে তুলেছে। সিনান ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে। তার হাত পা অশাড় হয়ে যাচ্ছে। অনা হুট করে উঠে এসে সিনানকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আপনি মানুষটা কত সুন্দর। আপনার ব্যবহার এত খারাপ কেন বলুন তো?”
সব কিছুর মাঝেও সিনানের মুখে হাসি ফুটে উঠে। অনার দিকে তাঁকাতেই অনার কান্ডকলাপে সে তায্যব হয়ে যায়। অনা এক টানে ব্লাউজ খুলে ফেলে তারই সামনে। সিনান উল্টো দিকে ফিরে যায়। অনা বলে,
“উফফফ্ এত গরম লাগছে কেন আমার!”
সিনান খেয়াল করে ফ্যান এসি কিছুই চালু নেই। সে দ্রুত এসি ফুল স্পীডে দিয়ে বলে,
“ব্লাউজ পড় প্লিজ! আমি এসি অন করেছি এখন আর গরম লাগবেনা।”
“না আপনি পড়িয়ে দিন। আমার ইচ্ছে করছেনা পড়তে।”
সিনান বুঝলো অনার নেশা হয়ে গেছে খুব বেশিই। সে অনার দিকে না তাঁকিয়েই জানালার পর্দা টেনে দিল। এবার ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে অনেকটা। সিনান দরজাটা লক করে দিয়ে অনার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“অনা! আমার ক্যারেক্টার কিন্তু ঢিলা! আমি আমার প্রফেশনে যতটা কর্তব্যপরায়ণ ঠিক ততটাই ক্যারেক্টারের দিকে আমি লুজ এন্টেনা! আই নিড ইউ! এখন কী করা যায় বলবে?”
অনা টলতে টলতে বলে “কী?”
সিনান এবার অনার দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে বলে,
“ইব্রাহীম আবরারের ছেলে সিনান আবরারকে বিয়ে করতে রাজি? রাজি হলে বল কবুল!”
অনা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সিনানের দিকে। সিনান ভয়েজ রেকোর্ড অন করে তারপর সেখানে অনাকে দিয়ে বলানো “কবুল” আর “আলহামদুলিল্লাহ্” শব্দগুলো রেকর্ড করে নেয়। অনার দেহের ভর ছেড়ে দিলে অনা বিছানায় হেলে পড়ে। সিনান সেদিকে একবার তাঁকিয়ে অনার অতি নিকটে গিয়ে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
“তোমাকে আমি ওয়ার্ন করেছিলাম আমার ক্যারেক্টার ঢিলা। তুমি শুনোনি! এন্ড নাও আই হেভ নো মোর অপশন!”
☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆
মেহজা বারান্দায় পড়ে আছে এলোমেলো ভাবে। মাথাটা ভার হয়ে আছে তার, নড়ার শক্তি পাচ্ছেনা সে। অতি কষ্টে উঠে বসে সে। তখনিই কা কা করে ফোন বেজে ওঠে তার। স্ক্রিনে “হাজবেন্ড” লেখাটি দেখেই সে ভুবন ভুলানো হাসি দেয়। নম্বরটি সেইভ করা বোধ হয় এবার স্বার্থক হয়েছে। এই প্রথম তার ফোনে কল এসেছে ইরফানের নম্বর থেকে। ফোনটি কোনোরকম রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইরফান বলে,
“দরজা খোলো মেহজা!”
“কীসের দরজা?”
“তোমাদের মেইন ডোরের কথা বলছি।”
“আপনি সেখানে কেন?”
“তোমার কথা এমন শুনাচ্ছে কেন মেহজা? আর ইউ ওকে?”
“উহু! নট ওকে। আপনি দাঁড়ান আমি আসছি। আজকে আপনার খবর করে ছাঁড়ব আমি বেটা বদ! আমার বেস্টফ্রেন্ডের সাথে রসের কথা বলা তাই না!”
“হোয়াট? কি বলছ এসব তুমি? মাথা ঠিক আছে তো তোমার!”
মেহজা উত্তর দিল না। মোবাইলটা সেখানেই ফেলে কোনো রকমে উঠে দাঁড়ায়। তারপর হেঁটে সোজা ড্রয়িং রুমে যায়। ড্রয়িং রুমে গিয়ে সে ঘুমন্ত নিজামের পায়ে পারা দিয়ে যায়। নিজাম ঘুমের ঘরেই অহ্ করে উঠে। মেহজা রেগে গিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
“অহ্ অহ্ করছিস কেন? চুপ করে ঘুমা। সবকয়টা হাঁড়বজ্জাত!”
নিজাম শুনতে পায়নি কারণ সে আবারও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। ব্যাথা পেয়েও সে কীভাবে ঘুমাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছেনা মেহজা। মূল দরজার কাছে গিয়ে তা খুলতেই ইরফানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহজা মিটিমিটি হাসে। ইরফান মেহজাকে টেনে বাসা থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দেয়। তারপর লিফ্টে উঠে সোজা তাদের বাসায় গিয়ে তার রুমে নিয়ে যায়। তারপর মেহজাকে সোফায় বসিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
“কি হয়েছে তোমার? এমন বিহেইভ করছ কেন? পাগল টাগল হলে নাকি!”
“আপনিই তো পাগল করে দিচ্ছেন আমায়। আজ আপনাকে আমি খাব।”
“হোয়াট? খাবে মানে?”
“ক্ষিদে পেয়েছে ইয়াজিদ ভাইয়া!”
ইরফান এবার রেগে যায়। সেই তখন থেকে ভাইয়া ভাইয়া করছে সে। স্বামীকে ভাইয়া ডাকতে পারে কীভাবে কেউ! ইরফান বুঝতে পারে মেহজা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তার নেশা হয়েছে কিন্তু কীভাবে সম্ভব! ইরফানের মনে পড়ে সিনানের দেওয়া ড্রিংক্স গুলোর কথা। কিন্তু সেগুলো তো নরমাল ফ্রুট জুস ছিল। ইরফান নিজেও তো খেয়েছে দুইটা। তার তো নেশা হয়নি। তাহলে মেহজার নেশা হয় কীভাবে? মেহজাকে দেখে মনে হচ্ছেনা সে অভিনয় করছে। মেহজার চোখ লাল হয়ে গেছে। ইরফান মেহজার সামনে নিজের মুখ নিয়ে যায় তারপর ভোদকা গন্ধে নাক কুঁচকায়। “ছিঃ এত বাজে জিনিস মেহজা মুখে তলল কীভাবে!” এই কথা বলে সে উঠে দাঁড়ায়। তাকে দাঁড়াতে দেখে মেহজা কাঁদো কাঁদো মুখে বলে,
“বললাম না ক্ষিদে পেয়েছে! সেই কোন দুপুরে খেয়েছি রাতে কিছু খাইনি। এখন খাব আমি।”
ইরফান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটা ধরে কিচেনের দিকে। তেঁতুলের শরবত গুলে এনে মেহজাকে খেতে বলে। মেহজা তাকে আবারও ভাইয়া ডাকতে নিলে সে বলে, “ভাইয়া ডাকলে কিচ্ছু খেতে দিব না বলে দিলাম।” মেহজা মুখ বেজার করে তেঁতুলের শরবত টা মুখে দিয়ে দ্রুত গিলে ফেলে। খুব টক থাকায় খেতে পারেনা। ইরফান জোর করে খাওয়ায় পুরোটা। দু মিনিটের মাথায় মেহজা বাথরুমে ছোটে বমি করতে।
মেহজা বিছানায় বসে আছে। নেশা কেটেছে বলা চলে তবে তার মাথা কাজ করছেনা। ধোঁয়াশার মধ্যেই আছে সে। ইরফান ভাত মাখিয়ে মেহজার মুখের সামনে ধরে। বমি করাতে বোধ হয় ক্ষিদে আরো বেড়ে গেছে। মেহজা হা করে ভাত মুখে নেয়। ইলিশ মাজ ভাজা সাথে গরম ভাত আর পেঁপে দিয়ে রান্না করা ডাল। আপাতত ইরফান এগুলোই হাতের কাছে পেয়েছে আর ওভেনে এক প্লেটে নিয়ে গরম করে নিয়েছে। মেহজার কাছে চমৎকার লাগছে খেতে। ইরফান হেসে মেহজার মুখে আরেক লোকমা ভরে দেয়।
“কেমন লাগছে মেহজা?”
“দারুন! মাছ ভাজিটা বেশি ভালো লাগছে।”
“ইমা আপু রেঁধেছে আব্বার জন্য। আপার রান্না বরাবরই অসাধারণ!”
“হ্যাঁ খেয়েই বুঝতে পারছি।”
মেহজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইরফানের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
“আপনি খেয়েছেন?”
ইরফান যেন এমন একটি প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল। সে প্রশস্ত হেসে বলে,
“আমি টাইমলি খাই। দশটার আগেই খেয়ে নিয়েছি আমরা সবাই। তুমি খাওনি কেন?”
“মন ভালো ছিল না তাই।”
“বিদায় তো রিমির হয়েছে তো তোমার মন খারাপ কেন থাকবে?”
“ছিল এমনিতেই।”
“এমনিতে কারো মন খারাপ হয়?”
“আমার হয়!”
“বলবেনা কী হয়েছে?”
মেহজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“তখন আপনি আসার সময় আমাকে কেন নিজের সাথে করে আনেন নি?”
“কারণ তুমিই তো বলেছিলে তোমার ভাইয়ের বিয়ে তাই তুমি তার গাড়িতেই যাবে।”
“আসার সময় তো নতুন ভাবি ছিল। তখন তো আর আমি সেই গাড়িতে করে আসবো না। তখন বুঝি একটু বলতে পারেননি!”
“নতুন ভাবি থাকলে যে তুমি সেই গাড়িতে করে আসবেনা তা আমি কীভাবে জানবো বল!”
“এখানে না জানার কি আছে?”
“না জানারই তো অনেক কিছু আছে। আমার বিয়েতে তো আমার বউ আমার গাড়িতে করে আসেনি আর আমার বোনরাও গাড়িতে আমার সাথে যায়নি তাকে আনতে। সে লিফ্টে উঠে এসেছে আবার লিফ্টে করেই নিচে মানে তার বাসায় নেমে গেছে।”
মেহজার রাগ হয়। ইরফান টিটকারি করছে নাকি তার সাথে! করছেই তো…. মেহজা উঠতে নিলে ইরফান তার হাত চেপে ধরে বলে,
“আর এক লোকমা বাকি আছে খেয়ে নাও। খাবার নষ্ট করা আমি পছন্দ করিনা।”
সেই লোকমা খেয়ে মুখ ধুঁয়ে, মুছে মেহজা সোফায় বসে পড়ে। ইরফান তাকে পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এখানেই থাকো আজ। বাসায় তো অনেক মানুষ। নিশ্চয় শোবার জায়গা নেই।”
মেহজা পানি খেয়ে মাথা নাড়ায়। ইরফানকে গ্লাসটা দিয়ে সে কিছুক্ষণ পায়চারি করে তারপর শুয়ে পড়ে। খাবার সাথে সাথেই শোয়া ঠিক নয়। এই ভালো অভ্যাসটা মেহজার মধ্যে দেখে ইরফান মুঁচকি হাসে।
মেহজাকে বুকে নিয়ে ঘুমায় ইরফান। মেহজা অবাক নয়নে তার দিকে তাঁকাতেই ইরফান হেসে বলে,
“কিছু করব না আমি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারো।”
মেহজা মৃদু হেসে চোখ বুজে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে সিনানের বাহু বন্ধনে দেখে থমকে যায় অনা। তলপেটে কাঁমড় বসে যেন! সারা শরীর জমে যায়। নিজের দিকে তাঁকাতেও তার ভয় করছে। শরীরের পরিবর্তন সে বেশ ধরতে পারছে!
“না” বলে চিৎকার দিতেই সিনান ধড়পড়িয়ে উঠে বসে। তারপর অনাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
“লিসেন আই ক্যান এক্সপ্লেইন!”
সাথে সাথেই গালে তীব্র ব্যাথার আভাস পায়। অনার সমস্ত সঞ্চিত শক্তিতে তৈরি করা থাপ্পড়টা খুব বেশিই জোরে ছিল কীনা!
#চলবে।