ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-৪৮+৪৯

0
205

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৪৮
আজ বোধহয় প্রথম বিনা কারণেই ছুটি নিলো সৌমিক, রবি জানিয়েছে ওকে অফিসের পাশে বাস স্ট্যান্ডে এক্ষুনি এসে দাঁড়াতে, ওকে নাকি এক্ষুনি কোথাও যেতে হবে! ও অবাক হয়েছিলো,

নতুন কিছু ঘটলো নাকি? কোথায় যাবি এক্ষুনি?

এসে বলছে জানিয়ে ফোন রেখে দিয়েছিলো রবি। এমনিতেই মনটা কাল রাত থেকেই ভীষণ চঞ্চল লাগছিলো, এটা শোনার পর থেকেই আরো উত্তেজনা হচ্ছে। রাজীব দাকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে সৌমিক স্ট্যান্ডের সামনে রাখা চেয়ারগুলো তে বসে পড়েছিলো, কাল নিজেকে কোনো রকমে সন্ধ্যে পর্যন্ত ধরে রেখে অপর্ণা নিচে রান্না ঘরে চলে যাওয়ার পরে রবিকে ফোন করেছিলো ও, দুপুরের ঘটনা জানিয়েছিল সবটা, রবি উত্তেজিত হয়েছিলো,

বুঝলি তো, আমিও এতদিন কেনো এটা খেয়াল করিনি জানিনা! ভেবেছিলাম এটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় তাই বয়সের কথাটা মাথাতেই আসেনি, এখন বুঝতে পারছি সবটা। ইনফ্যাক্ট আমি ত্রিদিব কে ফোনে জিজ্ঞেসও করে ছিলাম একবার এখন মনে পড়ছে।

সৌমিক ছটফট করছিলো,

তুই ওই ছেলেটার ছবি দেখে চেনা চেনা লাগছে বলেছিলি তখন, মনে পড়েছে কিছু? তাহলে তো অন্তত কিছু খোঁজ করার চেষ্টা করতে পারতাম নাহয়!

রবি হতাশ গলায় বলেছিলো,

না রে! কোথাও তো দেখেছি বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু কোথায় সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না! কাল অফিসে গিয়ে পুরনো ফাইলগুলো খুলে দেখবো একটু! অপর্ণার রিয়াকশন কিরকম?

সৌমিক দুঃখের গলায় বলেছিলো,

ও তো বুঝতেই পারেনি ব্যাপারটা, ভেবেছে আমি ওকে ভুল ছবি দেখাচ্ছি। আমিও আর ভুলটা ভাঙ্গানোর চেষ্টা করিনি কারণ এমনিতেই ও খুব ডিপ্রেসড হয়ে আছে, বাড়ি থেকে যেতে চাইছে না কিছুতেই।

রবি একটু চুপ করে থেকে বলেছিলো,

তোর জেদটাও বড্ড বেশি! সব বিষয়েই কি জেদ দেখাতে হবে? কাকিমার ওপরে তোর কোনো রাগ নেই আমি জানি, তবু তুই অভিমান দেখিয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে চাইছিস। কাকিমার দিকটাও একটু ভেবে দেখিস, আমরা অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করি তাই অতো ছুটকো ব্যাপারে আমাদের সম্মান যায় বলে মনে করিনা। কিন্তু ওনার কাছে ওটাই হয়ত অনেক বড়ো ব্যাপার, আর এখন বৌদি, রজত দা বা অপর্ণা বাড়িতে এসে যাওয়ার পরে হয়ত সত্যি কাকিমাকে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে।

সৌমিক মাথা নেড়ে ছিলো,

হতেই পারে! তাই তো আমি মাকে দেওয়া কথামতো কাউকে জানাই নি! কিন্তু তাই বলে আমাকেও সেই অন্যায় মেনে নিতে হবে এরকম তো কোনো কথা নেই। আমার পক্ষে সব জানার পরে ওই নোংরা লোকটার সঙ্গে সারাজীবন এক ছাদের তলায় থাকা সম্ভব নয়। এটা আমার প্রতিবাদ বলতে পারিস! লোকটা জানুক আমি ওর স্বরূপটা জানি, আর সেটা কারোর চাপেও মাথা নিচু করে মেনে নিচ্ছি না!

রবি ম্লান হেসেছিলো,

জানিনা তোর এই জেদ শেষ পর্যন্ত তোকে কোথায় গিয়ে থামাবে! একবার এই করে কতো কিছু হলো! অবশ্য তখন খারাপ লাগলেও এখন মনে হচ্ছে যা হয়েছিলো ভালোই হয়েছিলো, নাহলে হয়ত পরে তোর সমস্যাই বাড়তো।

তোরও কি মোহভঙ্গ হলো নাকি! সেদিনও একই কথা বলছিলি শুনলাম!

সৌমিক এর গলায় বিদ্রুপের স্বর রবিকে আঘাত দিয়েছিলো,

আমি তোদের কারো খারাপ চাইনি। মনে হতো ও খুব একা হয়ে গেছে তাই চেষ্টা করেছিলাম একটু সঙ্গ দিতে। এর বেশি কিছু নয়!

সৌমিক হেসেছিলো,

ছাড়! আমার ওই প্রসঙ্গে কথা বলার আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই! নম্বরটা আবার ব্লক করে দিয়েছি, এবার কোনো প্রয়োজনেই আর খুলবো না। শুধু খারাপ লাগছে এটা ভেবেই যে মায়ের ধারণাটা কে মিথ্যে প্রমাণিত করতে পারলাম না। মা সব সময় ভাবতো মিতা আবার আমার জীবনে ঢুকে অপর্ণার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ করবে। আর অদ্ভুত ভাবে ও নিজেই সেটা স্বীকার করলো। ও নাকি মাকে জব্দ করার জন্যে অনেক প্ল্যান এর কথা ভাবতো, যার মধ্যে এটাও ছিলো!

ওদের কথোপকথনের মধ্যেই রত্না ওপরে উঠে এসেছিলো, জানিয়েছিল ও সামনের সপ্তাহে চলে যেতে চায়। সৌমিক একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়েছিলো, ওর আগের দিন দিদির সঙ্গে করা ব্যবহারের জন্যে মনে মনে লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো,

যদি তুই সত্যি যেতে চাস প্রয়োজনে তাহলে কিছু বলার নেই, কিন্তু যদি আমার ব্যবহারের জন্যে চলে যেতে চাস তাহলে বলবো যাসনা এখন। আমি সরি বলছি, হটাৎ করে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিলো তখন! আমি চলে গেলে এমনিতেই মায়ের মন খারাপ হবে, তুই থাকলে ভালো লাগবে একটু। আর আমি জানি মা তোকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে দিদি!

রত্না চোখে জল নিয়ে তাকিয়েছিলো,

এটা অনেকটা ঠিক তবে পুরোপুরি নয় ভাই, সেটা তুইও জানিস! মা এর ওপরে চলা ঝড় ঝাপটা গুলো আমি দেখেছি তো নিজের চোখে তাই মায়ের সঙ্গে আমার একটা আলাদা বন্ডিং আছে, তোরা তখন ছোটো ছিলিস অনেকটা তাই হয়তো মনে নেই। কিন্তু মা বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভরসা তোকেই করে, এই জায়গাটা অন্য কেউ নিতে পারবে না। দেখলি না তোর ট্রান্সফারের খবর শুনে ভাত খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলো, সেই থেকেই শুয়েই আছে। এমনিতেও মায়ের কদিন ধরে কিছু হয়েছে ভাই, সব সময় একা একা বসে থাকে, কারোর সঙ্গে কথা বলেনা। কলকাতায় থেকেও কি আলাদা থাকতেই হবে, যদি একটা ড্রাইভার রেখে গাড়ি নিয়ে যাস, তাহলেও কি বাড়িতে থাকতেই পারবি না?

সৌমিক মাথা নেড়েছিলো,

হবে না রে দিদি! অনেক চেষ্টা করেছি!

টানা হর্ণের আওয়াজে সম্বিত ফিরল সৌমিকের, রবি জানলার কাঁচ নামিয়ে মুখ বার করলো,

কি ভাবছিস বসে বসে এতো? উঠে আয় তাড়াতাড়ি, দেরি করলেই পাখি ফস্কে যাবে!

সৌমিক দৌড়ে দরজা খুলে গাড়িতে উঠলো, গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতে অবাক গলায় বললো,

মানে? খুঁজে পেয়েছিস নাকি ছেলেটাকে?

রবি হাসলো,

না, তবে পাবো পাবো করছি! চল সমরের পার্টনারের বাড়িটা ঘুরে আসি, মামা, ভাগ্নের কিছু খবর তো অন্তত পাওয়া যাবে। মামা যদি সত্যিই মারা গিয়েও থাকেন ভাগ্নে তো আর যাননি।

ঠিকানা মিলিয়ে জায়গাটায় পৌঁছাতে প্রায় ঘন্টাখানেক মতো লাগলো, মোটামুটি বর্ধিষ্ণু পাড়া সেটা আশেপাশের বাড়িঘরের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। পাড়ার মুখেই একটা পান বিড়ির দোকান, সেখানে দাঁড়িয়ে এবং বসে কয়েকজন যুবক। পুলিশের জীপ তার সামনে থামতেই দোকানের সামনের পেতে রাখা বেঞ্চে বসে থাকা যুবকদের মধ্যে দু তিনজন কৌতুহলী হয়ে উঠে এলো,

কাউকে খুঁজছেন স্যার?

রবি গাড়ির দরজা খুলে নামলো, এগিয়ে গিয়ে মোবাইলে তোলা ঠিকানার ছবিটা দেখিয়ে বললো,

আমরা এই ঠিকানাটা খুঁজছি।

ছেলেগুলো একটুও সময় না নিয়ে ঠিক দোকানের উল্টোদিকের বাড়িটার দিকে আঙুল তুললো,

ওইটা স্যার।

সাদা দোতলা বাড়িটা বেশ বড়সড়, সামনে একটা বড়ো বাগান আছে, তবে তাতে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। বাড়িটার ভেতরের এবং বাইরের দুটো গেটেই তালা বন্ধ।

এটার মালিকের নাম প্রসাদ মিত্র তো? উনি তো নেই দেখছি, গেটে তো তালা!

রবির প্রশ্নে ছেলেটা একটু অবাক হলো,

তালা তো থাকবেই স্যার, উনি তো অনেকদিন আগে মারা গেছেন!

রবি কৌতুহলী হলো,

মারা গেছেন! আচ্ছা! আর কেউ নেই ওনার?

ছেলেটা কোমরে হাত দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলো,

হ্যাঁ, মেয়ে, জামাই আছে! কিন্তু তারা তো আমেরিকায় থাকে! তাদের তো পাবেন না! কিছু দরকার ছিলো স্যার? তাহলে এই হরিদার দোকানে জিজ্ঞেস করতে পারেন, মেয়ে বাড়িটা বিক্রির জন্যে বলেছে ওনাকে!

ছেলেটা হাত তুলে ডাকলো, হরি দোকানেই বসেছিল, পুলিশ দেখে শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো, সব শুনে ফোন নম্বর একটা কাগজে লিখে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

এই যে স্যার! ওনার মেয়ের নম্বর!

রবি হাত বাড়িয়ে ফোন নম্বরটা নিলো, গ্যালারি খুলে ছবিটা বার করে ছেলেটার ফটোর ওপরে আঙুল রেখে জিজ্ঞেস করলো,

আচ্ছা, এই ভদ্রলোককে চেনেন?

লোকটা ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ স্যার! চিনি তো! ও তো শুভ, প্রসাদ বাবুর ভাগ্নে, আগে এখানেই থাকতো।

রবি সোজা চোখে তাকালো,

এখন থাকেনা কেনো?

লোকটা ঘাড় নাড়লো,

বলতে পারবো না স্যার, ওই প্রসাদ বাবু মারা যাওয়ার পরে ওনার মেয়ে জামাই এলো, তারপরেই চলে গেছে। ওরা তো বাড়িটা বিক্রি করে দেবে তাই বোধহয় চলে যেতে বলেছে ওকে।

রবি নিজের ফোন নম্বর লোকটাকে দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো, শুভর সম্বন্ধে কোনো খবর পেলে ওর ফোন নম্বরে জানাতে বলে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে পাড়া থেকে বেরিয়ে এসে ঘড়ির দিকে তাকালো,

এখন কি ওনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলা যাবে? ওখানে রাত তো?

সৌমিক সহমত হলো,

রাত তো বটেই, তবু করেই দ্যাখ একবার।

রবি ডায়াল করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্রমহিলা ফোন ধরলেন, রবি নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

আপনি প্রসাদ বাবুর মেয়ে বলছেন? কয়েকটা ইনফরমেশন চাই একটু!

ভদ্রমহিলা বেশ ভদ্র, একটুও বিরক্ত না হয়েই উত্তর দিলেন,

হ্যাঁ, বলুন, কিসের ব্যাপারে ইনফরমেশন চান?

আপনার বাবা কি সমর চৌধুরী নামে কারোর সঙ্গে ব্যবসা করতেন?

দেখুন, বাবা ব্যবসা করতেন সারাজীবনই, কিন্তু কার কার সঙ্গে করতেন সেটা আমি জানিনা, কারণ আমি বহু বছর বিদেশে থাকি। তবে শেষের দিকে সবটাই আমার পিসতুত ভাই শুভ দেখতো, বাবা খুব বেশি দেখাশোনা করতেন না কারণ ওনার বয়স হয়ে গিয়েছিলো অনেকটাই আর অসুস্থও ছিলেন উনি। কিন্তু কেনো বলুন তো? বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি কিন্তু সব ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছি।

রবির প্রশ্নের উত্তরে একটু চিন্তিত গলায় বললেন মহিলা, রবি তাড়াতাড়ি ওনাকে থামিয়ে দিলো,

না, না চিন্তার কিছু নেই। আসলে সমর চৌধুরী মানে আপনার বাবার পার্টনার বেশ কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন। ওনার কিছু টাকা আটকে আছে তাই ওনার প্রাক্তন স্ত্রী সেগুলো পেতে চান। সেই জন্যেই এইসব প্রশ্ন উঠছে।

ভদ্রমহিলা নিশ্চিন্ত হলেন,

ও আচ্ছা! কিন্তু মুশকিল হলো আমি এসবের কিছুই জানিনা, এগুলো শুভ বলতে পারবে। ওই তো সবটা দেখাশোনা করতো।

রবি উৎসাহিত হলো,

হ্যাঁ, আমরাও সেটাই শুনেছি। তাই আসলে শুভর ব্যাপারে একটু জানতে চাইছিলাম। উনি কি আগে আপনাদের বাড়িতেই থাকতেন? এখন কোথায় থাকেন? ওনার নম্বরটা পাওয়া যাবে?

ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন,

হ্যাঁ, ও তো আমার পিসতুত ভাই, আমাদের বাড়িতেই ছোট থেকে থাকতো পিসির সঙ্গে। পিসি মারা যাওয়ার পরে এখানেই থেকে গিয়েছিলো। বাবার সঙ্গে থেকে ব্যবসা শিখেছিল, এখন বাবা মারা যাওয়ার পরে আর থাকেনা, এখান থেকে চলে গেছে। এখন কোথায় থাকে জানিনা তবে শুনেছিলাম দিল্লিতে। আমার কাছে নম্বর তো ছিলো একটা আপনার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তবে ওটা এখনও আছে কিনা আমি জানিনা।

ওনার সঙ্গে তারমানে যোগাযোগ নেই আপনাদের? কেনো?

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন,

নাহ! আসলে সত্যি কথা বলতে কি ওর সঙ্গে একটু মনোমালিন্য হয়েছিলো আমার। আমি তো অনেকদিন দেশে যাই না, শেষ বাবার কাজে গিয়েছিলাম। ও বাড়িটা বিক্রি করতে চাইছিলো, তাতে আমার খুব একটা আপত্তি ছিলো না যদিও কারণ আমার পক্ষেও ওটা রাখা সম্ভব ছিলো না। কিন্তু আমি পরে পাড়ার লোকের কাছে জানতে পেরেছিলাম, ও ওটা কোনো প্রোমোটারের হাতে দিতে চাইছিলো যেখানে ওর অনেক টাকা কমিশন ছিলো। তাই আমি আপত্তি জানাই, সেই নিয়েই তর্কাতর্কি হয়। তাছাড়া বাবার ব্যবসার হিসেবেও কিছু গরমিল ছিলো যেগুলো আমার হাসব্যান্ড ওকে জিজ্ঞেস করায় ও সদুত্তর দিতে পারেনি। এরপরে আমরা ওকে চলে যেতে বলি, ও চলে যায়।

রবি ভদ্রমহিলার হোয়াটসঅ্যাপে ত্রিদিব বাবুর দেওয়া ছবিটা পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

একটু দেখে জানান ছবিটা, আপনার বাবার পার্টনারের ছবিটা আমি মার্ক করে দিয়েছি।

বাবা আর শুভ কে চিনতে পারছি। এটা তো কাশ্মীর ট্যুরের ছবি, ট্রাভেল এজেন্সি থেকে তুলেছিলো, সম্ভবত আমাদের বাড়িতেও এক কপি আছে! তবে পার্টনার ভদ্রলোককে আমি চিনিনা।

ছবিটা দেখে জানালেন ভদ্রমহিলা, রবি জিজ্ঞেস করলো,

একটা শেষ প্রশ্ন, বাবার অ্যাকাউন্ট কি আপনি ক্লোজ করেছেন?

সবটাই শুভ করেছে তবে আমিও কলকাতাতেই ছিলাম ওই সময়, আমিই নমিনি ছিলাম বাবার সব কিছুর।

থ্যাংক ইউ,

ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলো রবি। সৌমিক এতক্ষন পাশে বসে সবটাই শুনছিল এবার একটু উত্তেজিত হয়ে বললো,

তারমানে এখানে এসেই সব শেষ, ওই শুভ শেষ পর্যন্ত এখন কোথায় থাকে সেটা জানা আর সম্ভব হবে না তাই তো? ফোন নম্বরটা আদৌ আছে কিনা কে জানে!

রবি একটু রহস্যের ভঙ্গিতে তাকালো,

নিশ্চয়ই সম্ভব হবে, দিল্লি শুনেই সব মনে পড়ছে। মনে আছে মেদনিপুর যাবার দিন ট্রেনে মিতা কয়েকটা প্রোফাইল দেখিয়েছিলো আমাকে, তার মধ্যে এটাও ছিলো। তাই ছেলেটাকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছিলো আমার।

সৌমিক সোজা হয়ে উঠে বসলো,

তাহলে? এবার কি করতে চাস?

রবি হাসলো,

আমাকে ঠিক কোন ভূমিকায় মানাবে বলতো? পাত্রীর বাবা না দাদা?

সৌমিক অবাক হয়ে গেলো,

তুই কি পাত্রীর বাবা, দাদা হয়ে ওর সঙ্গে কথা বলবি?

হ্যাঁ, সেতো বলবোই তবে আগে আরো কিছু কাজ আছে বুঝলি! ছেলেটা বেশ ধুরন্ধর, অতো সহজ হবে না সবটা। আগে ত্রিদিব বাবুর কাছ থেকে আসল সমর চৌধুরীর ফোন নম্বরটা নিতে হবে। তুই অপর্ণার কাছ থেকে ওই সমরের মোবাইল নম্বরটা নে তো, এই মহিলার পাঠানো নম্বরটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। তবে আমার মনে হয় দুটো এক হবে না, ছেলেটা তো নিশ্চয়ই দুটো পরিচয়ে একটা সিম ব্যবহার করেনি!

কি হবে এগুলো করে, এতদিন পরে আর এসব কি কাজে আসবে?

চিন্তিত গলায় বললো সৌমিক, রবি ভ্রু নাচালো,

আসবে, আসবে! একটু অপেক্ষা কর! ছেলেটা নিশ্চয়ই দুটো মোবাইল নিয়ে কখনো রসূল পুরে যায়নি তাহলে অপর্ণা দুটো নম্বরই জানতো, কারণ ও যথেষ্ট ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে। কিন্তু কোনো একটা নম্বর নিয়ে তো সমরের সঙ্গে দেখা করতে যেতো প্রয়োজনে, তাই সমরের ফোনের লোকেশন এর সঙ্গে কোনো একটা সিমের লোকেশন নিশ্চয়ই মাঝে মাঝেই এক হবে। এগুলো সব বার করতে হবে আগে তারপরে ওর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবো, নাহলে বোকা বানিয়ে বেরিয়ে যাবে, কারণ আমাদের হাতে এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনো প্রমাণ নেই যে ওই সমর চৌধুরী সেজে রসুলপুরে যেতো। আর একটা কাজ আছে, সমরের ব্যাংকের সইগুলো আর রসূলপুরের করা সই গুলো এক কিনা সেটাও মিলিয়ে দেখতে হবে। বেশি সময় নেওয়া যাবে না, দু একদিনের মধ্যেই এগুলো করে ফেলতে হবে, তারপরে দিল্লিতে গিয়ে ধরতে হবে ওকে।

কিন্তু প্রমাণ নেই কেনো? অপর্ণা আছে, রবীন বাবু আছেন, রসুলপুরে তো কম লোক ওকে দেখেনি! ওরা তো সাক্ষী আছেন, তাহলে?

সৌমিক এর প্রশ্নের উত্তরে রবি একটু থমকালো,

হুঁ, ওগুলো তো শেষ ধাপ, তার আগে আরো কিছু পোক্ত প্রমাণের দরকার আছে। শুধু আইডেন্টিফাই করলে হবে না, শুভর রসুলপুরে উপস্থিতির কিছু সলিড প্রমাণও প্রয়োজন।
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৪৯
আলোচনা পর্ব শেষ করে ওই পাড়া থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় বারোটা বাজলো। রবি এর পরে সৌমিকের সঙ্গে ব্যাংকে গিয়ে সমরের সই নিলো, সেখান থেকে দুজনে বেরিয়ে ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে গিয়ে শুভর সই এবং সমরের মোবাইল নম্বর নিলো। ওখান থেকে বেরিয়ে এসে রবি সৌমিক কে বললো,

আপাতত কাজ শেষ, তুই চলে যেতে পারিস। বাড়ি ফিরে দীপা দি কে জানিয়ে দিস আমি ওনার কাছ থেকে ওনার ডিভোর্সের কাগজটা আর সমর বাবুর ফোন নম্বরটা নেবো সই আর লোকেশন যাচাইয়ের জন্যে। সব সই আর নম্বরগুলোর লোকেশন মিলিয়ে দেখতে হবে। আর তোকে যে বললাম অপর্ণার কাছ থেকে নম্বরটা চেয়ে দে, আমার তাড়া আছে। ভুলে গেলি নাকি?

সৌমিক একটু চিন্তা করলো,

এখন তো অপর্ণা ক্লাসে আছে, রাতে তোকে জানিয়ে দিচ্ছি।

এরপরে রবিকে ওর অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে সৌমিক বাড়ির রাস্তা ধরলো। প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে মনে হলো এখন এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে প্রচুর কৈফিয়ত দিতে হবে সবাই কে। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে সৌমিক অপর্ণাকে মেসেজ করলো, ফ্রি আছে কিনা জিজ্ঞেস করে, তাহলে ও কথা বলতে চায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মেসেজে নীল টিক পড়লো, আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অপর্ণা ফোন করলো, গলায় উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো

কি হয়েছে? এখন ক্লাসের মধ্যে ফোন করলে?

সৌমিক হাসলো,

এমনই! তোমার ক্লাস আছে কিনা জিজ্ঞেস করছিলাম, না থাকলে চলে এসো, আমি আজ অফিসে যাইনি।

আর একটা আছে তবে খুব ইম্পর্ট্যান্ট নয়, না করলেও চলে। কিন্তু তুমি অফিসে যাওনি কেনো? শরীর খারাপ নাকি?

চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো অপর্ণা, সৌমিক হাসলো,

না, এমনই! রবির সঙ্গে এক জায়গায় গিয়েছিলাম। আমি তোমার ইউনিভার্সিটির বাইরে দাঁড়াচ্ছি, বেরিয়ে এসো তাহলে।

কিছুক্ষনের মধ্যেই অপর্ণা হন্তদন্ত হয়ে চিন্তিত মুখে বেরিয়ে এলো, ভ্রু কুঁচকে সৌমিকের আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বাইকে উঠতে উঠতে বললো,

দেখে তো ঠিকই লাগছে! তাহলে অফিস কামাই করে যেতে হলো কি এমন হলো? আগে তো রবিবার করে যেতে?

প্রবল গরমে কোথায় যাবে বুঝতে না পেরে একটা শপিং মলের ফুড কোর্ট এ গিয়ে বসলো দুজনে। কুপন কেটে খাবার নিয়ে এসে বসতে বসতে বললো সৌমিক,

তুমি কি হলো জানতে চাইছিলে না? আসলে সমরের ব্যাপারে অনেকটা এগিয়েছি বুঝলে তো। ওই পার্টনারের বাড়িতে গিয়েছিলাম আজ, উনি সত্যিই মারা গেছেন তবে ওনার ভাগ্নে বেঁচে আছে। ওনার কাছ থেকে কি খবর পাওয়া যায় দেখা যাক। রবি হয়ত দিন তিনেকের মধ্যেই নিজের কাজে দিল্লিতে যাবে তখন ওর সঙ্গে কথা বলবে। সমরের ফোন নম্বরটা দাও তো, রবি কে পাঠাতে হবে।

অপর্ণা সমরের নম্বরটা হোয়াটসঅ্যাপ এ পাঠিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

ওই ভদ্রলোক কি দিল্লিতে থাকেন?

সৌমিক নম্বরটা সেভ করতে করতে অন্য মনস্ক গলায় উত্তর দিলো,

হুঁ! কিন্তু এই নম্বরটা তো হোয়াটসঅ্যাপ দেখাচ্ছে না অপর্ণা, ও কি হোয়াটসঅ্যাপ ইউজ করতো না?

অপর্ণা মলিন হাসলো,

ওর তো স্মার্ট ফোন ছিলোই না, অতো বড়লোক ও ছিলো না। যদি খুব সাকসেসফুল হতো তাহলে কি আর ওই ধ্যাদধেড়ে গোবিন্দপুরে ব্যবসা করতে আসতো? তবে পরের দিকে ও দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো, আমাকে বলেছিলো এখন ওর আর না আসলেও চলে।

তাহলে আসতো কেনো?

উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করলো সৌমিক, অপর্ণা মুখ নামালো, সলজ্জ ভঙ্গিতে বললো,

ও বলতো ও আমার জন্যে আসে, বিয়ের পরে আর এতদূরে ওকে আসতে হবে না।

সৌমিক মুচকি হাসলো,

আজকের যুগে দাঁড়িয়ে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক এসব কিছুই ইউজ করতো না এটা অবাক লাগছে! তবে বললে হবেনা, এটা মানতে হবেই যে সমর খুব রোমান্টিক ছিলো!

অপর্ণাও মুচকি হাসলো,

সে আমাদের ওখানে কেউই সেরকম করেনা, আমারও বিয়ের আগে ছিলো না হোয়াটসঅ্যাপ। আর করবে কি করে বলতো, ইন্টারনেট তো দূরের কথা এমনি নেটওয়ার্কই ভালো করে পাওয়া যায়না, মায়ের সঙ্গে কথা বলতে যা বিরক্ত লাগে আমার। তবে এটা তুমি ভুল বললে, শুধু সমর রোমান্টিক ছিলো না, তুমিও কম রোমান্টিক নও। বউ কে লুকিয়ে এক্স গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে কফি শপে দেখা করে এসেছো!

আচমকা এরকম একটা কথার জন্যে সৌমিক একটুও প্রস্তুত ছিলো না, সে চমকে উঠে অপর্ণার মুখের দিকে তাকালো,

তুমি কি করে জানলে? তোমাকে এসব কথা কে বললো? মিতা কি তোমাকে ফোন করেছিলো? এতো সাহস ওর! আমি ওকে ব্লক করে দিয়েছি বলে ও তোমাকে ফোন করে বলছে!

অপর্ণা হাত তুললো,

আস্তে আস্তে, অতো উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। তুমি মিতা কে ব্লক করে দিয়েছো নাকি আবার? বলো নি তো আমাকে? তবে মিতা দি আমাকে ফোন করে কিছু বলেনি, আমি তো দুয়ে দুয়ে চার করেছি।

সৌমিক অবাক হয়ে বললো,

কি বললে? বুঝলাম না! দুয়ে দুয়ে চার মানে কি? কে বলেছে তোমাকে এগুলো?

অপর্ণা হাসলো, টেবিলের ওপরে রাখা সৌমিকের হাতের ওপরে নিজের হাতটা রেখে বললো,

মা বলেছেন! তবে এটা বলেন নি, অন্য কথা বলেছেন। কিন্তু ওনার কাছ থেকে যখন জানলাম মিতা দি সেই কথাগুলো তোমাকে বলেছে তখনই বুঝেছি তুমি অ্যাকসিডেন্ট কেন করেছো, আর মিতা দি সেটা জানলো কি করে।

সৌমিক অস্বস্তি নিয়ে তাকালো,

মা তোমাকে কি বলেছে? আর মা যদি না বলে থাকে তাহলে মিতার সঙ্গে কফি শপে যাওয়ার কথা তুমি জানলে কি করে?

অপর্ণা হাসলো,

ওটা আমি নিজেই শুনেছিলাম সেদিন সন্ধ্যায়, তুমি আর রবিদা আলোচনা করছিলে। শুধু ঘটনাগুলো মেলাতে পারছিলাম না, এখন মায়ের সঙ্গে কথা বলে সবটা ক্লিয়ার হয়েছে। মা অবশ্য তোমাকে বাড়িতে থাকার জন্যে রাজি করতে বলতে এসেছিলেন আমাকে, সেই প্রসঙ্গেই উনি বললেন কথাগুলো। মিতা দি খুব খারাপ কাজ করেছে তোমাকে বাবার কথা বলে দিয়ে এটা ঠিকই তবে ওর দিকটাও ভাবতে হবে।

সৌমিক গলা নিচু করলো,

মা তোমাকে এসব বললো কেনো? মাকে তো যা বলার আমি বলে দিয়েছি।

অপর্ণা সৌমিকের চোখের দিকে তাকালো,

আমাকেই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছেন হয়ত কারণ এগুলো অনেকদিন আগেই জানা সত্বেও আমি কাউকে বলিনি, এমনকি তোমাকেও নয়!

সৌমিক উত্তেজিত হয়ে তাকালো,

তুমি জানতে অথচ বলো নি! অদ্ভুত তো! কেনো?

এই জন্যেই বলিনি, কারণ জানলে তো তুমি এরকমই একটা ভুল ডিসিশন নেবে জানতাম! সেটাই নিলে! এতে লাভ কার হলো ভেবে দেখেছো একবারও? যে লোকটা যেটা পেতে চায়, যার কাছে থাকতে চায় অথচ সমাজের ভয়ে, নিজের সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে পিছিয়ে যাচ্ছে তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে ওখানেই যেতে বাধ্য করে তুমি আসলে তাকে এবং তার সঙ্গে আরেকজন কে লাভবান করছো। এতে রীতা পিসি তার পছন্দের জীবন কাটাতে পারবে, উল্টে সবাইকে বলে বেড়াবে যে শেষ বয়সে আমরা একটা অসুস্থ লোককে বাড়িছাড়া করেছি। আমরা তো আর জনে জনে ডেকে সত্যিটা বলতে পারবো না, তাহলে তো বদনাম আমাদেরই হবে তাই না?

তাতে আমার কিছু যায় আসে না! ওই লোকটা জাহান্নামে যাক, যার সঙ্গে খুশি থাকুক তাতে আমাদের কি?

অপর্ণা সৌমিকের উত্তেজনা দেখে ওর হাতে চাপ দিলো,

ঠিক বলেছো আমাদের সত্যি কিছু নয়। কিন্তু যে লোকটা সারা জীবন অন্যায় করেছে তাকে শুধু মাত্র বাড়ি থেকে বার করে দিলে হবে না তাকে তার করা অন্যায়ের সাজাও পেতে হবে। সে যদি রীতা পিসির বাড়িতে গিয়ে ওঠে তাহলে সে আরামে থাকবে, সেটা তার সাজা নয়। এমনিতেও তো বাড়িতে ওনার কথার খুব বেশি মূল্য কেউ দেয়না, মাও নিজের মতোই থাকেন। উনি এখন জানেন যে তুমি এবং আমি দুজনেই সবটা জানি। এখানে থেকে বাকি জীবনটা যখন উনি বুঝবেন যে উনি আসলে সবার করুণার পাত্র, আমাদের চোখে ওনার জন্যে কোনো সম্মান নেই তখন ওনার নিজের মনের মধ্যে যে আফসোস হবে, অপমানিত লাগবে, নিজের কৃতকর্মের জন্যে প্রতি মুহূর্তে অনুশোচনা হবে সেটাই ওনার জন্যে বড়ো শাস্তি। ওনাকে কিছুতেই বাড়ি ছাড়া করে সিম্পথী ক্রিয়েট করতে দেওয়া যাবে না! আর তুমি চলে গেলে সেটা ওনার শাস্তি হবে না বা তোমার প্রতিবাদও হবে না সেটা আসলে মায়ের শাস্তি হবে। তাতে উনি এবং রীতা পিসি দুজনেই মনে মনে খুশি হবেন।

সৌমিক এতক্ষন চুপ করে শুনছিল, এবার নিচু গলায় বললো,

ওই লোকটা যে আমরা জানি বলে জেনেছে সেটা কার কাছ থেকে? মা বলেছে নাকি তুমি?

অপর্ণা তাচ্ছিল্যের গলায় বললো,

আমি? আমি তো সেই থেকে ওনার সঙ্গে একটা কথাও বলিনা, যেটুকু আমার ডিউটি সেটুকুই করি। উনিও সব বোঝেন তাই একবারের জন্যেও আমার মুখের দিকে তাকান না। তবে মাও বলেন নি ওনাকে। ওনাকে জানিয়েছে রীতা পিসি!

রীতা পিসি জানিয়েছে সেটা তুমি জানলে কি করে?

বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো সৌমিক, অপর্ণা মুচকি হাসলো,

কারণ আমিই তো গিয়ে রীতা পিসির হাতে টাকার খাম দিয়ে বলে এসেছিলাম ভবিষ্যতে আর এক পয়সাও দেবো না বলে। ওনার তো সেই শুনে মাথায় হাত, সঙ্গে সঙ্গেই বাবাকে ফোন করতে চাইছিলো। আমিও বললাম করে নিতে, জানি তো ওই লোকটা নিজের কমফোর্ট ছেড়ে বেরোতে চাইবে না একটুও। তখন করেনি তবে পরে করে নিশ্চয়ই বলেছে সবটা, হয়ত মিতা কেও বলেছে। তাই মিতা জেনেছে।

সৌমিক অন্য মনস্ক হলো,

ওই জন্যেই রবি একদিন বলছিলো আমাকে, রীতা পিসিকে কোনো কাজ খুঁজে দিলে আপত্তি আছে কিনা! পিসি নাকি মিতার কাছে কাজ খুঁজে দেওয়ার কথা বলেছে। তারপরে যা হলো এসব মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিলো।

অপর্ণা আদুরে গলায় বললো,

রীতা পিসিকে যা দিয়েছি না, এখন ওকে সারাজীবন লোকের পয়সায় বসে খাওয়ার ধান্দা ছাড়তে হবে। প্লিজ ওই লোকটার ওপরে রাগ দেখাতে গিয়ে মাকে কষ্ট দিওনা। উনি তো আর রীতা কেও একটা পয়সাও দিতে পারবেন না, ওনাকে নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। প্রতি মুহূর্তে ছেলে, বউ এর চোখে ছোটো হয়ে যাওয়াটাই কি কম শাস্তি নাকি! প্লিজ আমরা বাড়িতেই থেকে যাই!

সৌমিক কোল্ড কফি তে ডোবানো স্ট্র এ মাথা নিচু করে চুমুক দিতে দিতে বললো,

হুঁ, দেখছি!

অপর্ণা টেবিলের ওপর দিয়ে দুহাতে সৌমিকের হাত দুটো চেপে ধরলো,

প্লিজ দেখছি নয়, হ্যাঁ বলো।

সৌমিক মুখ তুলে তাকালো,

একটা কথা বলো, তুমি এসব কথা কি করে জানলে? আমি তো এতো বছরেও বুঝিনি কখনো!

অপর্ণা রহস্যের হাসি হাসলো,

চোখ কান খোলা রাখতে হয় বুঝলে! তুমি বাড়িতে থাকো কতক্ষন যে এসব তোমার চোখে পড়বে! আমার একটু একটু সন্দেহ হচ্ছিলো, তারপরে একদিন সুবোধ দাদু দের বাড়িতে গিয়ে সবটা জানলাম।

সৌমিক অবাক হলো,

যাবে বলেছিলে আমাকে, কিন্তু গিয়েছিলে সেটা বলো নি তো! ওনারা এসব কথা বললেন তোমাকে! অথচ আমাদের সঙ্গে তো যোগাযোগ রাখেন না!

অপর্ণা ঘাড় কাত করলো,

বলবেন না কেনো? সেইভাবে জানতে চাইলেই বলবেন! ওনাদের তো ক্ষোভ কম নেই! সত্যিই তো, তোমার বাবা, ঠাকুমার জন্যে তো ওনাদের গ্রামে থাকতে অনেক সমস্যা হয়েছে, সেগুলোর একটা এফেক্ট তো থাকবেই। কিন্তু ওনারা এখন যোগাযোগ রাখতেই চান, বলছিলেন ছেলে বিদেশে থাকে, তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে এখন কোনো চিন্তাই থাকতো না। বিপদে পড়লেই ডাকতে পারতেন! আর যোগাযোগ রাখার কথা বলছো, তোমরাই বা কি যোগাযোগ রেখেছ আজ পর্যন্ত বলো তো? মায়ের কথা থেকে বুঝেছি ওনার তো মামা শ্বশুরের ওপরে কোনো ক্ষোভ নেই, তাহলে ঠাকুমা মারা যাওয়ার পরে তোমরাই বা যোগাযোগ রাখো নি কেনো?

সৌমিক হাসলো,

আসলে ঠাকুমার ওপরে তো আমরা সবাই বিরক্ত ছিলাম তাই অতো ভেবে কিছু করিনি, ঠাকুমার কোনো আত্মীয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতে চাইনি কখনো আর। মনে হতো সবাই একই রকম হবে নিশ্চয়ই। আর এমনিতেও সবাই বলে কাকিমা খুব রাগী মানুষ! তোমার সঙ্গে কথা বললেন?

হ্যাঁ, বললেন তো! রাগী নন স্পষ্টবাদী! আমার এরকম মানুষ পছন্দ! সবাই হয়তো স্পষ্ট কথা মেনে নিতে পারে না তাই এরকম বলে! তবে আমি নিজেও সোজা কথা সোজা ভাবেই বলতে ভালোবাসি, তাই আমার এরকম মানুষ ভালো লাগে।

সৌমিক অপর্ণার চোখের দিকে তাকালো,

সোজা মানুষ ভালোবাসো বললে, কিন্তু নিজে কি আদৌ মানুষ চিনতে পারো তুমি? কে সোজা আর কে বাঁকা বোঝার ক্ষমতা রাখো?

অপর্ণা থমকালো, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো,

কি প্রসঙ্গে এরকম একটা প্রশ্ন এলো? মানুষ চেনার কথা উঠছে কেনো? কাকে চিনতে ভুল করলাম আমি? যদি ভেবে বলি হয়তো সত্যিই পারিনা! এই যে তোমার বাবার কথাই ধরো না! ওনাকে তো আমি এবাড়ির সবচেয়ে শান্ত, ধীরস্থির, ভালো মানুষ ভেবেছিলাম প্রথমে! রীতা পিসির প্রসঙ্গ বাদ দিলে, তুমি না বললে কখনো হয়ত জানতেও পারতাম না লোকটা তার বউয়ের সঙ্গে এতো খারাপ ব্যবহার করতো! তাহলে? তবে তুমি কি নির্দিষ্ট ভাবে কারোর কথা বললে? যদি হয় তাহলে খুলে বলো, কে সে? তাকে বিশ্বাস করে হটাৎ চোট খাওয়ার থেকে আগে জেনে রাখলে সুবিধা হবে, ঠকে যেতে হবে না তাহলে।

সৌমিক হাসলো,

না ঠকে যাওয়ার ভয় তোমার নেই! সেসব তুমি আমার ওপরে ছেড়ে দাও! আমি থাকতে তোমাকে আর কেউ ঠকাতে পারবে না। তবে একটা কথা বলতে পারি আজ সমরের সম্বন্ধে খোঁজ নিতে গিয়ে বুঝলাম সে কিন্তু খুব সুবিধার ছেলে নয়। তুমি কি জানো বেশ কয়েকজন মেয়ের নিখোঁজ হবার পেছনে হাত আছে বলে ওর নামে রসূলপুরের থানায় অভিযোগ আছে?

অপর্ণা দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চাপলো,

একটা মৃত মানুষের নামে অভিযোগ করে দেওয়ার মতো সহজ কি আছে বলো তো? তোমাকে বলা হয়নি, যেবার আমি একা গেলাম ট্রেনে, সেখানে কয়েকজন এটা নিয়ে আলোচনা করছিলো। রবীন কাকুকেও বলছিলো এসব কথা। সৃজা বলছিলো ও ও নাকি আমার আড়ালে সমরকে অনেক মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে, এমনকি একটা মেয়েকে দেখিয়েও ছিলো আমাকে। আমি সেটা শুনে মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করে একটু ঘুরিয়ে জানতে চেয়েছিলাম সমর সম্পর্কে, ও কিন্তু প্রশংসাই করছিলো, বলছিলো ওর বাবার অসুখে ওকে হেল্প করেছে অনেক। ওকে চাকরি করে দেবে বলেছিলো কিন্তু হটাৎ এসব ঘটায় আর হয়নি।

সৌমিক আঙুল তুললো,

ঠিক এই কথাটাই তোমায় বলতে চাইছি! সমর খুন হয়ে গেছে তাই হয়তো ওই মেয়েটার চাকরি হয়নি, কিন্তু তুমি কি এমন কাউকে চেনো যাকে সমর চাকরি করে দিয়েছে? আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর, তুমি চেনো না!

অপর্ণা একটু চুপ করে থাকলো, তারপর বললো,

তুমি কি বলতে চাও সমর মেয়েদের সঙ্গে এই রকম করে ভাব জমাতো? চাকরি দেবার নামে তাদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতো? কিন্তু বিশ্বাস করো একটা মৃত মানুষের নামে মিথ্যে বলতে আমার বাধছে! সমর আমাকে কখনো চাকরি করে দেবার কথা বলেনি! ও তো জানতো আমি আরো পড়তে চাই, ও বরং বিয়ের পরে আমাকে কলকাতায় ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কথা বলতো। আমি বলতাম কলকাতায় মা আমাকে হোস্টেলে থাকতে দেবে না, ও তার উত্তরে বলতো ওই জন্যেই ও তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায় যাতে মা কিছুতেই আমার পড়া বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দিতে না পারে!

সৌমিক মাথা নামালো, এই মুহূর্তে আর প্রমাণ ছাড়া কথা বলে লাভ নেই। অপর্ণা শুভকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে! শুভ অত্যন্ত ধুরন্ধর, অপর্ণা কে চাকরি করে দেবার নামে ফাঁসানো যাবে না বুঝেই হয়তো প্রেমের জালে ফাঁসাতে চেয়েছিলো। তাতেও তার পাচারের ছকে কোনো অদল বদল ঘটতো না! বিয়ের নামে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া খুব বেশি অসুবিধের ছিলো না। অপর্ণার বাবা এতটাই সহজ সরল যে কোনো খোঁজ না নিয়েই বিয়েতে সই করতে যাচ্ছিলেন! শাশুড়ির কথা মনে পড়ছিলো সৌমিকের, তিনি মাঝে মাঝেই স্বামীকে বড্ড বেশি সরল বলেন! এতোটা সরলকে সরল না বলে বোকা বলাই উচিত বোধহয়। সৌমিককে চুপ করে যেতে দেখে অপর্ণা কৌতুহলী গলায় বললো,

কি হলো? আর কিছু বললে না?

সৌমিক উঠে দাঁড়ালো,

চলো ফিরি এবার বাড়িতে, রোদ কমে এসেছে।
ক্রমশ