#চারুকাব্য ১
লেখা : #azyah_সূচনা
“আসতে পারি স্যার?”
চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে।সারা ক্লাসে শতাধিক স্টুডেন্ট।চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এখানে আসা।সবার মধ্যে আকাঙ্ক্ষা,কারো জেদ। সরকারি চাকরির লড়ায়ে কে কার থেকে এগিয়ে যাবে?ঠিক একই স্বপ্ন নিয়ে এসেছে চারু। টিউশনির টাকা জমিয়ে এই ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছে বহু কষ্টে। এখান থেকে প্রতি বছর অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন সরকারি বিভিন্ন পদে চাকরি পায়।উন্নত মান তাদের। পঙ্গু বাবা ও পরিবারের হাল ধরতেই এখানে এসে দাড়িয়ে সে।মাথার কাপড়টা ঠিক করে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে।আজই তার প্রথম ক্লাস।টাকা ঠিক সময়মতো জোগাড় করতে না পারায় পাঁচদিন পিছিয়ে পড়েছে।
ক্লাসে উপস্থিত মেন্টর বললেন, “আপনি এই ক্লাসে?”
“জ্বি?”
“আসুন।নেক্সট টাইম সময়মতো আসবেন।”
“জ্বি স্যার”
পেছন পেছন মাদমুদ স্যার এসে হাজির। তিনি চারুর এলাকাতেই থাকেন।ভালো মেয়ে বলে চেনেন চারুকে।এসে ক্লাসের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এ্যাটেনশন ক্লাস। ও চারু।আপনাদের সাথে আজকে থেকে ক্লাস করছে।যেহেতু সে কিছুটা পিছিয়ে গেছে আশা করি আপনারা তাকে হেল্প করবেন।অ্যান্ড আফনান স্যার?প্লিজ কো অপারেট ”
আফনান স্যার উত্তরে হেসে বললেন, “শিউর”
জমকালো স্মার্ট পোশাকে আবৃত বেশিরভাগ শিক্ষার্থী।কেউ কেউ সাধারণ পোশাকে।তাদের চেয়ে বেশি পরিমাণে সাধারণ চারুর পরিধেয় বস্ত্র। ব্যাগটাও বেশ পুরনো হয়েছে গেছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাস রুমটায় নিজেকে বেমানান লাগছে।চোখ নামিয়ে একা পেছনের বেঞ্চিতে বসে পড়লো।তাদের সাথে উঠবস করার যোগ্য হতে আসেনি সে এখানে।বাবা মার যোগ্য হতে এসেছে।তাদের সকল শখ পুরোনের প্রথম ধাপ পূরণ করতে এসেছে।
প্রথম ক্লাস শেষ হতেই একটি নীল শার্ট পরিহিত ছেলে এগিয়ে এলো।মুখে হাসি টেনে চারুর সামনের বেঞ্চিতে এসে বসলো।বললো,
“হ্যালো আমি রাজ”
“আসসালামু আলাইকুম”
হ্যালো পরিবর্তে হাই আশা করেছিল।সালাম দিয়ে লজ্জায় ফেলে দিলো।তারপরও মুচকি হেসে সালামের উত্তরে বললো,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।এই নাও এগুলো বিগত দিনের নোটস।কপি করে আমাকে আগামী কাল দিয়ে দিও।”
“ধন্যবাদ আপনাকে”
“দেখো মেয়ের অবস্থা।আমি তোমাকে তুমি বলে ডাকছি।আর তুমি আপনি বলছো?শুনো আমরা সমবয়সী।তুমি বলে ডাকো।দরকার হলে তুইও ডাকতে পারো”
চারু হাসলো।তবে কোনো উত্তর দিলো না। নোটসগুলো খুলে দেখছে।রাজ বললো,
“আমাকে আবার ফ্লার্টবাজ ভাববে না কিন্তু।আমি একটু বকবক বেশি করি।তোমাকে দেখলাম ভীত মুখে একা বসে আছো।তাই আসলাম”
নিচু স্বরে উত্তর আসলো, “আমি এমন কিছুই ভাবিনি”
“আচ্ছা। নোটসগুলো কপি করে নিবে কিন্তু।নাহয় অনেকটা পিছিয়ে যাবে”
__
কাঠফাটা রোদে পুড়ে যাচ্ছে চারু। এখান থেকে বাড়ি অনেক দূরে।রিকশা করে যাওয়ার টাকা নেই।মাসের শুরু। সব টাকা ইনস্টিটিউটে দিয়ে দিয়েছে।হাত একদম খালি।যে টাকা ছিলো সেটা দিয়ে বাসেই চলে যেতো।কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না। নোটস কপি করতে টাকা দরকার।হেঁটেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় চারু। উত্তপ্ত গরম তার মধ্যে হেঁটে পা দুটো ফুলে যাচ্ছে।
গাড়ির কাচ নামিয়ে একজোড়া চোখ চারুতে আবদ্ধ হলো।কালো চশমার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে।চারু ফটোকপির দোকানে বেঞ্চিতে বসে।ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ওড়নার সাহায্যে বারবার ঘাম মুছে নিলো।আগন্তুক ড্রাইভারকে ভারী কণ্ঠে বলল,
“এসি বন্ধ করো”
“স্যার আপনার গরম লাগবে।”
“গরম লাগাতে চাই বলেই এসি বন্ধ করতে বলেছি।”
“স্যার?”
“শাট আপ”
ব্লেজার পড়ে গাড়িতে বসে।সাদা শার্টটা চুপচুপে।কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে অনবরত।অথচ এসি অন করলো না।চেয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে চারুর দিকে।নাজেহাল অবস্থা তার।কাজ শেষে বাড়িতে ঢুকলো।এখন নিশ্চয়ই গরম থেকে রেহাই পাবে।ফ্যানের নিচে আরাম করে বসে।চক্ষু সীমানার বাহিরে চলে গেলে সে বলে,
“আমজাদ? এসিটা ওন করো এবার”
ঠোঁটে মিথ্যে হাসি টেনে প্রটফুল্ল হয়ে ঘরে ঢুকেছে চারু।এত পথ হেঁটে কোনোভাবেই টের পেতে দেওয়া যাবে না বাবা মাকে। সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও ভালোবাসায় কোনো কমতি নেই।এক রুম বিশিষ্ট ঘরটার সামনে দাড়িয়ে একটু জড়িয়ে নেয়। ঘামগুলো শুকিয়ে নেয়।ঘরে আসতে না আসতেই দেখলো মা রান্না করছেন।গরম তেলে বেগুন ভাজছেন।আজ তাহলে দুপুরের খাবারটা জমে যাবে। চারুকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন শায়লা।
বললেন, “এসেছিস?ফ্যানের নিচে বোস।পাশের বাড়ির ফ্রিজে পানি রেখেছি এক বোতল।নিয়ে আসছি দাড়া”
তীব্র গরমে মেয়ে বাড়ি ফিরে একটু ঠান্ডা পানি খেয়ে প্রশান্ত হবে।এই ভেবে প্রতিবেশীর ফ্রিজে পানি রেখে এসেছেন মমতাময়ী মা।এভাবেই ছোটোখাটো ব্যাপারে খেয়াল রেখে আবেগপ্রবণ করে তোলেন চারুকে।
দুই গ্লাস ঠান্ডা পানি ঢকঢক করে গিলে চারু বললো, “বাবা কি করে?”
“ঘুমোয়। কালতো সারারাত গরমে ঘুমোতে পারেনি।এখন একটু শুয়েছে।”
নিজের ওড়না দিয়ে মায়ের কপালের ঘাম মুছে চারু বললো, “আমি একটা চাকরি পাই?তোমার আর চিন্তা করতে হবে না মা।”
“চারু?আমি এই হালেও অনেক খুশি আছিরে।আমার শুধু একটাই চাওয়া।আমরা সকলে যেনো সবসময এভাবেই একসাথে থাকি”
“অবশ্যই থাকবো”
__
“আমজাদ”
মোটা কণ্ঠে আমজাদ এসে দাড়ালেন সুইং চেয়ারের পেছনে।সামনে অদ্ভুত রকমের একজন মানুষ বসে। হাতে একটি যুবতীর ছবি ভেসে আসছে।সেই ছবি!যা আমজাদ নিজ হাতে তুলেছেন।আর পঞ্চাশ কপি দশ মিনিটের মধ্যে প্রিন্ট করে এনেছেন।মাথায় কাপড় টেনে এক নারী কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে।
“জ্বি স্যার?”
“একটা বাড়ি খালি করতে হবে”
“কোন বাড়িটা স্যার?”
“আজ যে বাড়িতে ওই মেয়েটা প্রবেশ করলো?ওই বাড়ি খালি করিয়ে দাও।”
“আর বাড়ির মানুষগুলো?”
“তাদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা করবে।শুধু এই মেয়ে আর তার পরিবার ছাড়া।তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা হবে। স্পেশাল ব্যবস্থা!”
আজও দেরি হয়ে গেছে।ঢাকার রাস্তায় বাস পেতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়।গতকাল বলা হয়েছিলো চারুকে।যেনো ঠিক সময়মতো আসে।সেটা আর হলো কোথায়। কাধে ব্যাগ শক্ত করে চেপে দৌড়ে পৌঁছালো। ইতিমধ্যেই ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই আফনান স্যার এর চোখ পড়লো।
“আপনি আজও লেট?”
“সরি স্যার।”
“আচ্ছা আসুন। এমনিতেও আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম। নেক্সট টাইম খেয়াল রাখবেন।ঠিক আছে?”
“জ্বি স্যার”
আফনান স্যারের ক্লাস সবার পছন্দের। তিনি পড়ার পাশাপাশি গল্প করতেও পছন্দ করেন।আজ ক্লাসে আমেজ।নতুন আরো স্টুডেন্ট এসেছে।সবার সাথে পরিচয় পর্ব চলছে।চারুর জন্য রাজ আগে থেকেই জায়গা রেখেছে তার পাশে।রাজের হাসিমাখা মুখ দেখে তার পাশে এসে বসে পড়লো চারু।একে একে সবার পরিচয় জানা হলো।এবার চারুর পালা।স্যারের কথা অনুযায়ী সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
“আপনার নামটা বলুন”
“স্যার আমার নাম চারু”
“বাহ বেশ সুন্দর নামতো! সিজিপিএ কত?”
“৩.৮৪”
“গ্রেট!ক্লাসে মনোযোগী হবেন।রেজাল্ট ভালো আপনার।আশা করা যায় চাকরির ডাক পেয়ে যাবেন”
“ইনশাল্লাহ”
“বসুন”
রাজের সাথে আরো দুয়েক জনের সাথে বন্ধুত্ব হয় চারুর।তাদের মাঝে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে।সজীব নামের ছেলেটি প্রতিদিন গাড়ি করে আসে। রাজও কোনো অংশে কম নয়।সুপ্রভা মেয়েটি এক সৌন্দর্যের মহিমা।না ভেবেচিন্তে বন্ধুত্ব করে ভুল করে ফেললো নাতো?তারা একেকজন অনেকটা ফ্রি।হটাৎ করেই চারুর কাধে কনুই ঠেকিয়ে দাড়ালো সজীব।বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে হাসছে।
চারুর অসস্তি সুদূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছে একজোড়া চোখ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।তার এই নিঃশ্বাস বড্ড ভয়ানক।এসির নিচে বসে ঘামতে শুরু করলো আমজাদ।
আবারো ডাক পড়েছে, “আমজাদ?”
“জ্বি স্যার?”
“ছেলের কনুইটা ভেঙে ফেললে কেমন হয়?”
“ভালো না স্যার। পঙ্গু হয়ে যাবে।”
“ঠিক বলেছো।আচ্ছা হলকা পাতলা ব্যথা দিও।যেনো দশ পনেরো দিন হাত নাড়াতে না পারে।”
চোখ বুজে নিলো আমজাদ। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলেছে। খুবই বিপদে আছে এমন একজন মানুষের এসিস্ট্যান্ট হিসেবে থেকে।পুরোই পাগলের কারবার।বিগত পাঁচদিন যাবৎ একটা মেয়ের পেছনে নাকানি চুবানি খাইয়ে ছাড়ছে।
“আমজাদ তুমি কি রাগ করছো আমার উপর?”
শুকনো ঢোক গিলে উত্তর দিলো, “নাতো স্যার!”
“রাগ করো না।আমার তুমি ছাড়া কে আছে বলো?”
__
মা আর ছোটো ভাই দাড়িয়ে আছে দরজার বাহিরে।বাবা হুইল চেয়ারে।ঘরের সব জিনিস বের করে নিচ্ছে একদল লোক।দুর থেকে দেখে ঘাবড়ে উঠলো চারু।এরা সব কিছু বের করে নিচ্ছে কেনো? ভাড়াতো পরিশোধ করাই আছে।তাহলে?দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো।একজন লোক স্যুট পড়ে দাড়িয়ে। কোন জিনিস কিভাবে তুলবে আদেশ করছে।চারু তার দিকে চেয়ে মায়ের কাছে গেলো।
প্রশ্ন করলো, “এগুলো কি মা?”
“জানি নাতো চারু।ওই সাহেবের মতন লোকটা এসে বললো এখানে থাকা যাবে না।এই বাড়ি নাকি ভেঙে ফেলবে”
“এটাতো সরকারি জায়গা না মা!আর ভেঙে ফেললে আমাদের আগে জানায়নি কেনো?”
উত্তরের অপেক্ষা না করে এগিয়ে গেলো লোকটির দিকে।প্রশ্ন করলো,
“আমাদের জিনিস কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
আমজাদ চোখ নামিয়ে বললো, “আপনাদের নতুন বাসায় ম্যাম ”
“নতুন বাসা মানে?”
“আপনারা আর এখানে থাকতে পারবে না।”
“আপনি কে?”
“আমাকে চিনবেন না ম্যাডাম।প্লিজ আমার সাথে চলুন”
রেগে গেলো চারু।কথা নেই বার্তা নেই তার সাথে চলে গেলেই হলো?কপাল কুঁচকে বললো, “কেনো যাবো আপনার সাথে?বললেই হলো!হচ্ছেটা কি এসব?”
আমজাদ কাচুমাচু হয়ে বললো, “আপনাদের যেতে হবে ম্যাম”
“আমি আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই”
চারু কিছুতেই যাবে না।এটা আমজাদ কেনো একটা বাচ্চাও বুঝবে।কিন্তু বসের আদেশ মান্য না করলে চাকরিতো যাবে সাথে জানটাও না চলে যায়।বুদ্ধি খাটিয়ে বললো,
“ম্যাডাম এটা সরকারি জায়গা।ভেঙে ফেলার আদেশ এসেছে।আপনাদের জানানো হয়নি বলে সাময়িকভাবে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে অন্য জায়গায়।আপনারা নতুন বাসা খুঁজে পেলে সেখান থেকে চলে যাবেন।”
__
নতুন বাড়ি।বাড়ি নয় এক টুকরো রাজপ্রসাদ।খয়েরী কাঠের আবাবপত্রের পরিবর্তে এখানে সাদা চাকচিক্যে জ্বলছে প্রতিটি জিনিস। মাটির ফর্শ এর পরিবর্তে বিলাসবহুল টাইলস। এ যেনো চারুর স্বপ্নের ঘর।কিন্তু এখানে এসে শান্তি পাচ্ছে না।বিশ্বাস করতে পারছে না কিছুতেই।এভাবে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের এত দামী ঘরে কেনো রাখবে?সন্দেহ বারবার হানা দিচ্ছে মনে।চারুকে এক প্রকার হাতে পায়ে পড়েই নিয়ে এসেছে আমজাদ।মেয়েটা বড্ড জেদি।এভাবে কেইই বা অপরিচিত কারো সাথে চলে আসবে?বাবা,মা ও ভাইয়ের চোখ ছানাবড়া! এসব আগে কখনো সচ্ছক্ষে দেখা হয়নি।মানুষের মন সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হবেই।তাদেরও হয়েছে।হোক সেটা অল্প সময়ের জন্য।
আমজাদ চারুকে আলাদা করে বললো, “নিচে একটা ডাকবাক্স আছে।প্রতি রাতে সেখানে গিয়ে একটা করে চিঠি চেক করবেন।”
“কিসের চিঠি?”
“সরকারি চিঠি ম্যাম।আজকের চিঠি এইযে!”
চারুর হাতে একটি খাম ধরিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো আমজাদ।কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া যাবে না।প্রশ্ন করলেই ফেঁসে যাবে সে। চারু খামটা খুলে দেখলো।কালো কাগজে সাদা কালির লেখা।
“আমার চারুলতা!তোমাকে ওই ছোট্ট ঘরটায় দেখতে আমার ভীষণ কষ্ট হয় জানো?তুমি রানী!আমার রানী।আমি আমার রানীর জন্য রাজপ্রাসাদ সাজিয়েছি।কেমন লাগলো জানাবে।”
কিছুই বুঝল না চারু।সবই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।সরকারি চিঠি এটা?নাকি প্রেমপত্র! চিঠির অর্থ না বুঝলেও এটা বেশ বুঝেছে কোনো সরকারি লোক তাদের বাড়ি ভাঙছে না।এসব পূর্ব পরিকল্পিত।কেউ আড়ালে এসব করছে।সিদ্ধান্ত নিলো সে কিছুতেই এখানে থাকবে না। কালই নতুন ঘর খুঁজতে লেগে যাবে।
ক্লাসে বিষণ্ণ মনে বসে চারু।রাজ, সুপ্রভা, সজীব তার পাশেই। পূর্ন মনোযোগী ক্লাসে।কিন্তু চারু কিছুতেই পারছে না মনোযোগ দিতে।সর্দি লেগেছে।নাক টানছে।তার পাশাপাশি ঘর ভাড়া পাচ্ছে না।আজকাল সব কিছুর দামই বেশি। দশ হাজার টাকার নিচে কোনো ঘর খুঁজে পাচ্ছে না।এত সামর্থ্য নেই। টিন শেডের ঘর দেখেছিল কয়েকটা সেখানকার পরিবেশ পছন্দ হয়নি।স্যার তার মতন করে লেকচার দিতে লাগলো।
চারুকে নাক টানতে দেখে সজীব বললো,
“স্যার এসির পাওয়ার কমানো যাবে?”
আফনান স্যার উত্তর দিলেন, “কেনো সজীব?”
“চারুর সর্দি স্যার।”
চারু গোলগোল নয়নে চাইলো।সেতো বলেনি এসির পাওয়ার কমাতে?তাহলে সে কেনো নিজ থেকে বললো।নিচু স্বরে চারু বললো,
“সমস্যা নেই।আমি ঠিক আছি”
আফনান স্যার প্রশ্ন করলেন, “চারু আপনার বেশি সমস্যা হচ্ছে?”
“না স্যার?”
“আচ্ছা বেশি সমস্যা হলে বলবেন।আমি পাওয়ার কমিয়ে দিবো।সবাই অ্যাটেনশন প্লিজ!”
বাড়ি ফিরে এলো।এই বাড়িতে আসতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু কিছু করার নেই।মন মত বাড়ি খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এই বিলাসবহুল ঘরেই ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে।হুট করে নজর গেলো ডাকবক্সে।সেই লোকটি বলে গিয়েছিল প্রতিদিন এখানে চিঠি আসবে।রাতে।আজও কি এসেছে?ঢোক গিলে এগিয়ে গেলো।ডাক বক্স খুলে আজ শুধু চিঠি না।একটি শুষ্ক গোলাপও পেয়েছে।ধীর হাতে চিঠি খুলে পড়তে লাগলো,
“চারুলতা?আমার মনোহরী!তুমি রাস্তায় হেঁটে হেঁটে নতুন বাড়ি খুজছো?আমার বানানো বাড়িটা তোমার পছন্দ হয়নি?কি চাই তোমার আমাকে বলো?আমি পৃথিবীর সমস্ত কিছু এনে হাজির করে দিবো।শুধু থাকো আমার এই যত্নে গড়ে তোলা আবাসস্থলে।আমার হৃদয়ের কাছাকাছি থাকো!হারালে খুব খারাপ হবে কিন্তু!”
___
এক মাস চোখের পলকে কেটে গেছে।এই একমাসে চারু পড়ায় অনেকটা পিছিয়ে।সর্ব মনোযোগ হরণ করে রেখেছে এক রহস্যময় আগন্তুক। পঞ্চান্নটা চিঠি জমা হয়েছে এই কটা দিনে।সবগুলোই অদ্ভুত!রহস্যময়। কোনোটায় আবার হুমকি।
শেষ রাতের চিঠিতে লিখা ছিলো, “যদি আমার মৃত্যুর কারণ না হতে চাও চারুলতা!এই বাড়িকে আপন করে নাও।যেদিন এবাড়ি ছাড়বে।সদর দরজায় আমাকে মৃত পাবে”
সেদিনইতো সজীবের হাত ভাঙলো।তার এই হাত ভাঙার পেছনে কোনো না কোনোভাবে চারু দায়ী।আরো একটি চিঠিতে লেখা ছিলো,
“তোমাকে স্পর্শ করার শাস্তি কেমন দিলাম?আগামীবার ওর হাত না ওকে সম্পূর্ণ ভেঙে গুড়িয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিবো”
দরজার বাহিরে থাকে কিছু লোক। প্রতিনিয়ত ফলো করে যাচ্ছে চারুকে।চারুর মনে একটাই প্রশ্ন কে করছে এসব?আর কেনো?কেনো তাকেই চোখে পড়লো?নিজেকে লুকিয়ে রেখেও ছায়ার মতন তার পাশে।আমজাদ লোকটারও কোনো খবর নেই।তাকে জেরা করলে নিশ্চয়ই এসব রহস্যের সমাধান হতো!রাজ নয়তো?নাকি অন্য কেউ?পরিচিত নাকি অপরিচিত কেউ?
__
নিত্যদিন এর মতই বাড়ি ফিরছে চারু। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ।ক্লাস শেষে চারটে টিউশন করতে হয়।দেহে কুলায় না।আজ রাত নয়টা বেজে গেছে।মাথার কাপড় টেনে বাড়ির রাস্তায় হাঁটতে থাকলে একটি বড় গাড়ি এসে দাঁড়ায় তার সামনে।খুব দ্রুতই আমজাদ বেরিয়ে আসলো।এসে বললো,
“ম্যাম গাড়িতে উঠেন”
“কেনো?গাড়িতে উঠবো কেনো?আর হ্যা আপনার সাথে আমার কথা আছে”
“ম্যাম প্লিজ এসব কথা পড়ে!স্যার চটেছেন।আজ অনেক বড় কান্ড ঘটে যাবে নাহয়।”
“আপনারা কি পেয়েছেন খেলার পুতুল।আমাকে বাড়ি ছাড়া করে এখানে আনলেন?আমাকে কোনোভাবে শান্তি দিচ্ছেন না।রাস্তায় বের হলে দু চারজন পিছু নেয়।একের পর এক চিঠি।হুমকি!আমার সাথে এমন করছেন কেনো?”
“সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন আজ!”
বিশাল এক ঘরে বসে আছে চারু।ঘরটা সম্পূর্ণ অন্ধকার নয়।আবার আলোকিতও নয়।ভয়ে দুরুদুরু কাপছে বুকটা।সামনে একজন মানুষ বসে।মুখটা তার অস্পষ্ট।উল্টো ঘুরে চেয়ারে বসে আছেন।আড়াল করে আছে নিজেকে।আরো দুজন ব্যক্তি উপস্থিত এখানে।একজন লম্বা দাড়িওয়ালা পাঞ্জাবি পড়া লোক। হাতে কাগজ কলম নিয়ে। আরেকজন আমজাদ।কপালের ঘাম ওড়না দিয়ে মুছে প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলে।তার আগেই একটা ভারী জেদি কন্ঠ এলো তার দিকে,
“তোমার ছেলেদের সাথে মেলামেশা আমার পছন্দ না চারুলতা।সজীব!রাজ! এদের সাথে তোমার এত কিসের কথা?”
“আপনি কে?”
“আমার কোনো পরিচয় নেই।”
“বিগত একমাস যাবৎ এমন কেনো করছেন আমার সাথে?কি ক্ষতি করেছি আপনার?”
“বিরাট ক্ষতি করেছো!আমার ভোলাভালা মন চুরি করে নিয়ে গেছো!”
চারু কিছু বলতে যাবে তার আগেই সে আবার বললো, “হুশ!কাজী সাহেব?বিয়েটা পড়াবেন?নাকি শুট করবো?”
সাদা পাঞ্জাবি পড়া লোকটি নড়েচড়ে উঠে। খাতা কলম নিয়ে এগিয়ে গেলো চারুর দিকে।কোনো নামে উল্লেখবিহীন তাকে কবুল বলতে বলছে।বিয়ের কথা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়ে চারু। বিয়ে?কিসের বিয়ে?চেচিয়ে উঠে দে।পুরো ঘরে তার আওয়াজ বাড়ি খাচ্ছে।
চিৎকার করে বললো, “কিসের বিয়ে?ফাজলামো করেন?আমি কেনো বিয়ে করবো!আর কাকে করবো?”
“আমাকে করবে চারুলতা!”
“বাহ! বেশতো! একজন লোক হুট করে এসে বলবে বিয়ে করতে আর আমি করে নিবো?”
“করবে না?”
“একদম নাহ!”
উল্টো হতেই পিস্তল নিলো সেই রহস্যময় আগন্তক। মাথার ঠিক ডান পাশে ঠেকিয়েছে।বলে উঠলো,
“এবার?”
চারু ছলছল নয়নে বললো, “ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে?”
সাথেসাথে পিস্তলের গুলি বেরিয়ে আসে। কাচের জনালর লম্বা গ্লাসটি ভেঙ্গে চুরমার।ঘাবড়ে লাফিয়ে উঠে চারু।বুক কাপছে অনবরত।ভয়ে কাঁপতে থাকা চারুর পানে আবার গলার সুর ভেসে আসছে।বলা হলো,
“আসল বন্দুক!এক শুটে মরে যাবো”
“আপনি কি পাগল!কি করছেন নিজে জানেন?আমি আপনাকে কখনো দেখিনি।চিনি না।কেনো বিয়ে করবো আপনাকে?”
“আমাকে তুমি চেনো! জানো! দেখেছো।আমি এক থেকে দশ গুনবো।তুমি তিন কবুল বলে সই করবে”
“প্লিজ বোঝার চেষ্টা করেন।আমার বাবা মা আছে।”
“আমার শুধু তুমি আছো মনোহরী”
এবার মুখ খুলে আমজাদ।বলে, “আমি ওনাকে চিনি উনি সত্যি সত্যি শুট করে ফেলবে ম্যাম!”
এতটা অসহায় নিজেকে জীবন যুদ্ধেও মনে হয়নি।আজ যেনো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তার হেরে যাওয়ার উৎসব।এক আগন্তুকের সাথে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হলো।এটাকি হওয়ার ছিলো?অন্যের প্রাণ বাঁচাতে নিজের জীবন বিসর্জন?বাবা,মা ও ভাইয়ের মুখ ভেসে আসছে সামনে।কি হচ্ছে তার সাথে? এমনটা হওয়ার কথা ছিলো?
কাজী সাহেব দূরে দাঁড়িয়ে কবুল পড়িয়ে নেয় আড়ালে থাকা লোকটির কাছ থেকে। সব কাজ শেষে মাথা নুয়ে বসে আছে চারু।কি ঘটে গেলো কয়েক মুহূর্ত আগে সেটাই ভাবছে।সবই যেনো ভ্রম। মিথ্যে!এটা যেনো একটা স্বপ্ন হয়।ভেঙে গিয়ে নতুন সকাল আসে।আবছা আলোয় হাত দিয়ে ইশারা করে আমজাদকে।আমজাদ চলে গেলো।কাজী সাহেবও চলে গেছে।ঘরটি আরো অন্ধকারে তলিয়ে গেল। এখন আর ভয় হচ্ছে না। রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি।নিজের ভাগ্যের প্রতি! হুহু করে কেঁদে উঠে চারু।
গলার আওয়াজ তুলে বললো,
“খুশি হয়েছেন আমার জীবন নষ্ট করে?কি অপরাধ করেছি আমি?কেনো করলেন আমার সাথে এমন?”
উত্তর আসলো না।শুধু বু জুতোর খটখট আওয়াজ দ্রুত বেগে কাছে আসছে।নিজেকে পিছু হটিয়ে নেয় চারু।ভয়ের চেয়ে বেশি মাথা চওড়া হয়েছে তার কষ্ট।ওড়না দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ আবৃত করে দূরে সরে কাতর কন্ঠে বলল,
“সবতো আপনার মনমত হলো!এবার নিজের পরিচয়টা দিন।কে আপনি?”
লাইটার এর আলোয় ভেসে উঠলো একটি সুদর্শন চেহারা।চারু চোখ সরাতে পারলো না।সে যে তার পরিচিত একটা মুখ।ভারী গভীর কণ্ঠে চারুর প্রশ্নের জবাব এলো,
“কাব্য!… কাব্য আফনান।”
চলবে।
[এটা অনুগল্প ছিলো।পাঠকদের অনুরোধে বড় করেছি।ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন]