চারুকাব্য পর্ব-১৩+১৪

0
245

#চারুকাব্য ১৩
লেখা : #azyah_সূচনা

চিরকুট হাতে।এক তিমির রাত্রি কেটে যাচ্ছে বসে থেকেই।চারু অদ্ভুত রকমের চুপচাপ।হিসেব মিলাতে লাগলো কাব্যর লিখে রাখা কথাগুলোর।আসি?আসি মানে কি? কোথায় গেছে সে?আবার কাব্যিক কথাও লিখেছে। হাওয়ায় মিশে নাকি আসবে ভালোবাসা অনুভব করাতে?পাগলের প্রলাপ! সম্পূর্ণ মুখ জুড়ে কালো মেঘের আচ্ছন্নতা।মেঘ মেদুর আকাশের তাতে কি? প্রকৃতির কিছু আসে যায় এতে? তারা তাদের মতন ব্যস্ত। দাপট দেখাচ্ছে।তীব্র বায়ুপ্রবাহে পায়ের কাছে এসে পড়লো কালো কুচকুচে রঙের শার্টটি। আলমারির হাতলে আটকে ছিলো।পায়ের কাছে শিরশির অনুভূতি ধ্যান ভাঙায় চারুর।ঝুঁকে তুলে নিলো শার্টটি।

এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করলো নির্জীব শার্টটিকে,

“সত্যিই চলে গেছেন?ফিরবেন না কখনো?”

তড়াক করে উঠে দাড়ালো চারু। আকষ্মিক ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠে।বারান্দায় হনহনিয়ে পা বাড়ায়।উদ্দেশ্য আমজাদ।রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দেখলো ঠিক সেখানেই বসে।পুকুর পাড়ে দুঃখ বিলাস করছে।
আগ বাড়িয়ে ডাকতে চাইলো।পারলো না। উপলদ্ধি করতে পারলো গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।বিষাক্ত লাগতে শুরু করে চারুর সবকিছু।এই রাত!এই হাওয়া!এই প্রকৃতি।কেমন অনুভূতি এটা? বিরক্তি সৃষ্টি করছে নিজের প্রতি।এক অদ্ভুত পুরুষালি ঘ্রাণ নাকে মুখে এসে লেপ্টে গেলো।দারুন রকমের এক অসস্তি অনুভব হচ্ছে।কেনো?আর কোথা থেকেই আসছে এই সুবাস?বেশ পরিচিত।খুব বেশিই পরিচিত। অস্থির চিত্ত আর দিশেহারা দৃষ্টি।চোখ পড়ে হাতে থাকা কাব্যর শার্টে। হ্যা! এখান থেকেই ভেসে আসছে।পূনরায় আবার দৌড় লাগায় ঘরে। সুইচে হাত চেপে সবগুলো বাতি জ্বালিয়ে দিলো।ঘরের যে পর্যন্ত চোখ যাচ্ছে খুঁজে নিচ্ছে।কোনো কোণা যেনো বাদ না যায়।হাত থাপ্রে আলমারি খুললো। কাব্যর কোনো কাপড় এখানে নেই। আলমারিটাও সম্পূর্ণ খালি।এরই মাঝে মনে পড়লো সেতো কোনো লাগেজ আনে নি আসার পথে।চারুর লাগেজ ছাড়া আর কোনো লাগেজ ছিলো না।নিজের দুনিয়াতে এতটাই মগ্ন ছিলো এসব নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ হয়ে উঠেনি।এখানে রয়ে গেছে মাত্র একটা শার্ট। কাল রাতে পড়ে ঘুমিয়েছিলো।

__

বিশাল আকারের বালতি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে দুজন ব্যক্তি।পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছে।শিকলে আবদ্ধ মানবের জ্ঞান ফেরাবে।আদেশ আসলেই পানির বর্ষণ হবে তার উপর। অর্ধ জ্ঞান থেকে পূর্ণ জ্ঞানে আনা হবে তাকে।অবশেষে আদেশ আসলো।পানির ঝাপটা মুখে এসে বিধছে।বাঘের গর্জন তুলে জ্ঞানে ফিরে।হাত পা আবদ্ধ।কালিতে লেপ্টে রয়েছে সারা দেহ। অজস্র আঘাতের দাগকে এই কালো কালিও লুকাতে পারলো না।নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তও শুকিয়ে গিয়েছিল।পানির সাথে মিশে পূনরায় তরতাজা হয়ে উঠেছে।ভেজা চুলগুলো নুয়ে পড়ল কপালে।আখি পল্লব বেয়ে শিশির বিন্দু গড়িয়ে পড়ে। ধুন্ধলা চোখের সামনে কেনো জেনো একটা মুখ ভেসে উঠে।

“চারুলতা”

বুট জুতো খটখট আওয়াজে এই কল্পনাতও বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না।শব্দ এসে থামে ঠিক কাব্যর নিকটে। একটা হাত ভেজা চুলগুলো বুলিয়ে দিয়ে বললো,

“বাবা আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।কেনো নিজের ভুলে বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হও বলোতো?”

ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাসে মাথা ঝাড়া দিলো কাব্য।হাত,পা, বাহু শক্তভাবে আবদ্ধ চেয়ারের সাথে।পিটপিট চোখজোড়া সামনে দাড়ানো ব্যক্তির পানে তুলে বললো,

“কতবার আঘাত করবেন?একদিন ক্লান্ত হয়ে পড়বেন!”

“এত বছরে কান্তি স্পর্শ করতে পারেনি আমাকে। আর পারবে বলে মনে হয়?”

ব্যঙ্গাত্মক হাসি মুখে নিয়ে কাব্য জবাব দেয়, “কাপুরুষ!”

শক্ত থাপ্পড় পড়ে গালে।রাগে গজগজ করতে লাগলেন। ভেবেছেন এক থাপ্পড়ে দমে যাবে। নড়বড়ে ঘাড় নিয়ে পূনরায় ফিরে তাকায়।হাসছে তাচ্ছিল্যের হাসি।রাগ দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় কাব্যর চুল টেনে বলতে লাগলেন,

“আমি কাপুরুষ হলে তোর গায়েও ওই রক্তই বইছে।তুইও কাপুরুষ। গা ঢাকা দিয়ে ছিলি এতদিন।যেই তোর দুর্বল জায়গায় আঘাত করলাম লেজ নাড়িয়ে আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছিস।তুই আমাকে ভালো মতন চিনিস কাব্য!আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার ফলে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।ওই তালিকায় নিজের ছেলেকে রাখতে আমি কার্পণ্য বোধ করবো না”

“দম ফুরালেই ফুস!”

“আমার আগে তোর দম ফুরাবে।ভালোয় ভালোয় বলে দে প্রমাণগুলো কই রেখেছিস।তুই মরবি সাথে তোর রক্ষিতাও!”

গর্জে ওঠে কাব্য।চোখ রক্ত লাল হয়ে উঠলো।বললো, “আমার স্ত্রী ও।বিয়ে করেছি ওকে। খবরদার যদি ওর নামে উল্টোপাল্টা কোনো কথা আসে এখানে!”

হাসির ধ্বনি শোনা গেলো।চারদেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে।রসিক কন্ঠে উত্তর এলো, “ওহহো! স্ত্রী! যাক বৌমাও তাহলে মৃত্যু পথযাত্রী ”

“কেনো?সকল হিসেব নিকেশ আমার সাথে। এখানে চারুলতা কেনো আসছে? আমার সাথে লাগার দম নেই কবির সাহেব?”

“বাঘের বাচ্চা বাঘ হয়। আমাকে পুরো দমে টক্কর দিয়েছো বাবা। অ্যাম প্রাউড ওফ ইউ!কিন্তু ভুলে যেও না আমিও তোমার বাবা।আর কি বললে?চারু এখানে আসছে?ভুলে গেলে নাকি চঞ্চল আংকেলকে?”

কেনো দুর্বলতা ঘিরে ঘরছে। মজবুত থাকার চেষ্টা আরো গুড়িয়ে ফেলছে তাকে। যতবার চারুর নাম কানে এসে লাগে ততবারই দুর্বল অনুভব করে কাব্য। তেজহীন হয়ে উঠে সর্বাঙ্গ। এতোটা তাকে তার শরীরের আঘাতও পীড়িত করছে না যতটা চারুলতার নাম। বারবার চোখের সামনে ভেসে আসতে শুরু করলো তার মুখটা।পানির আড়ালে অস্রু ধামাচাপা পড়ে গেলো।

“প্রমাণগুলো আমার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তোমার হাতে মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার সময় দিলাম।যাকে কন্টাক্ট করার করো।আর খবরদার!কোনো চালাকি না”

“আপনি আমার বাবা নন!”

“হোয়াট এভার কাব্য।এখন সম্পর্ক নিয়ে ঘাটাঘাটি করার সময় নেই। ডু ইট ফাস্ট!”

রুমটা সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢেকে গেলো। আঁধার কক্ষে অনুশোচনা গ্রাস করতে ফেলতে শুরু করেছে কাব্যর হৃদয়।কি মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে সে?নিজের হৃদয়ের ঝড় থামাতে তার প্রিয় মানুষের জীবনের ঝুকি হয়ে দাড়ালো?

“আমিতো শুধু ভালোবেসেছিলাম চারুলতা!তোমাকে বিপদে ফেলে দিলাম।কেনো আমার ধূসর হৃদয়ে রং মেশালে? স্বার্থপরের মতন তোমাকে আকড়ে নিয়ে আজ তোমার থেকেই এতটা দূরে চলে আসতে হয়েছে। স্বার্থপর কাব্য!খারাপ! নিকৃষ্ট!বিপদ ডেকে এনেছি তোমার জীবনে।আমি প্রেমিক পুরুষ হতেই পারি না।তুমি সঠিক ছিলে।আমি একটা ভুল!”

___

“বদ ছেলেটাকে দেখছি না যে কাল থেকে?”

“চলে গেছে মা!” সোজাসাপ্টা উত্তর চারুর।

চারুর কথার বিস্তারিত জানতে চেয়ে শায়লা প্রশ্ন করলেন, “কোথায় গেছে?”

“জানি না।তবে হ্যা ফিরবে না আর”

মেয়ের উত্তর কাটকাট।এতটা বিরক্তিভরা মুখে কোনোদিন উত্তর দেয়নি।উচু স্বরে কথা অব্দি বলেনি।আজ ভঙ্গিমা ভিন্ন। কাব্য চলে গেছে।আর ফিরবে না।এবারও এই কথার পরিপূর্ণ অর্থ বুঝলেন না।
আবার প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কি বলছিস চারু।অর্ধেক কথা না বলে সম্পূর্ণটা বল।”

“এটাই সম্পূর্ণ কথা মা!কাব্য আফনান চলে গেছেন।চলে না পালিয়ে গেছেন।আমার সাথে হয়তো এতটুক সংসার করার ইচ্ছে ছিলো।ভালোবাসা ভালোবাসা বলে গলা ফাটিয়েছে।মন ভরে গেছে হয়তো!তাই চলে গেছে”

গায়ে আর জোর নেই।জীর্ণশীর্ণ দেহ।তারপরও হাত চালালেন।হুইল চেয়ার টেনে চারুর কাছে এসে দাড়ালেন চঞ্চল সাহেব।মেয়ের হাত টেনে চিন্তিত স্বরে বললেন,

“কোথায় গেছে কাব্য?তোকে বলে গেছে?”

“বলার প্রয়োজনবোধ করেনি”

এদিক ওদিক চেয়ে চঞ্চল সাহেব চয়নকে ডাকেন।আদেশ করেন,

“গিয়ে দেখ আমজাদ আছে কিনা।ডেকে আন দ্রুত”

“বাবা খারাপ ছেলের বন্ধুটা সারারাত পুকুর পাড়ে বসেছিলো।আমি সকালেও দেখেছি ওকে সেখানে।”

“ডেকে আন”

চয়ন বাবার কথা অনুযায়ী ছুটে গেলো।পায়ে জুতোটুকু ঠিকমতো পড়েনি।পড়ে যেতে নিচ্ছিলো।তবে নিজের ছোট্ট দেহকে ভালোভাবেই সামলে নিয়েছে। হাপাতে হাপাতে আমজাদের কাছে দাড়িয়ে জানায় তার বাবা ডেকেছে। ভারাক্রান্ত মুখশ্রী নিয়ে একাকী বসে।বারবার মনে পড়ছে কাব্যর বলা কথাগুলো।

“আমার পরিবারকে দেখে রাখতে পারবে না আমজাদ?তুমি আমার ভাইয়ের চেয়েও আপন।তোমাকে অনেক বড় দায়িত্ব দিলাম।আর হ্যা!বিয়ে করতে চেয়েছিলে না?করে নিও একটা বিয়ে।নিজের সংসার সাজিও।আমি চারুলতার চোখে আমার জন্য মায়া দেখেছি। এতটুকই যথেষ্ট।আমার চারুলতাকে দেখে রেখো।আমি থাকবো না।কিন্তু তোমার মতন একজন মানুষ সারাজীবন আমার হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে থাকবে আমজাআআদদদ”

আবারো ডেকে বসে চয়ন।ধ্যান ভাঙ্গতে বাহু ধাক্কাচ্ছে।উঠে চলে আসে চয়নের সাথে।দরজা ডিঙিয়ে ভেতরে আসলো।

চঞ্চল সাহেব সময় ব্যয় না করেই আমজাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,

“কাব্য কোথায়?”

শক্ত করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাড়িয়ে আছে আমজাদ।উত্তর দেবে না।উত্তর দিতে রয়েছে বারণ। নীরবতাকে বেছে নিলো।দেখাক সেটা বেয়াদবি।

“কিছু জিজ্ঞেস করেছি।কাব্য কোথায়?”

“বলতে পারবো না!”

“কেনো?”

“আদেশ অমান্য করতে পারবো না।”

চারু ঝাঁঝালো বাক্য ছুঁড়ে দেয় আমজাদের দিকে, “আপনাকে রেখে গেছে কেনো? হ্যাঁ!নিজে চলে গিয়েছে আপনাকে কি তামাশা দেখতে রেখে গেছে।কি চান আপনারা বলেনতো?টাকার গরম! সবই টাকার গরম।একটু মনে আবেগ জেগেছিলো।ফুরিয়ে গেছে।এখন সেও লাপাত্তা।”

“ম্যাডাম?”

“চুপ থাকেন। আপনিও আপনার স্যারের মতন একজন মানুষ। থাকবো না এখানে।কাব্য আফনানের দয়ায় বাঁচতে চাই না আমি।আমি ফিরে যাবো ওই ভাঙ্গাচুরা বাড়িতে।আর খবরদার!আমাকে আটকানোর চেষ্টা করেছেন”

“স্যার অনেক কষ্ট পাবেন ম্যাডাম।এগুলো যা দেখছেন সব আপনাদেরই। আপনারাই চলে যাবেন?”

“কি করে আমাদের?আমার বাবার কোনদিন অঢেল সম্পদ ছিল না।আমার পৈতৃক অধিকার নেই এখানে।আমরা এখানে থাকছি না।কক্ষনো না”

চিৎকার চেঁচামেচির এক পর্যায়ে ধপ করে বসে পড়লো চারু। চেয়ারের হাতলে বারি খেয়ে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো। মাথাটা ভনভন করছে।এত রাগের কারণ কি?চারিদিকের সব কিছুতে যেনো বিষ মিশ্রিত!

“এখানেই থাকতে হবে আপনাদের।এটাই আপনাদের বাড়ি।আর একটা কথা ম্যাডাম। স্যার কোনো ভুল করেনি।”

চারু এক মুহুর্ত দারায়নি।ঘরে দৌড়ে গেছে।শব্দ করে দরজা বন্ধ করেছে।এই বিকট আওয়াজে উপস্থিত সবাই কেপে উঠলো।চঞ্চল সাহেব কপালে হাত রাখলেন।কাব্যর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলেন গতকাল থেকেই।সুযোগ হলো না।নাকি কাব্য ইচ্ছে করে সুযোগ দেয়নি।এড়িয়ে গেছে খুব সাবধানে।সে কি আন্দাজ করতে পেরেছিলো চঞ্চল সাহেবের চিন্তা?

“কবির অনেক খারাপ ধরনের লোক।মানুষ নয় জানোয়ার সে।প্রার্থনা করি শায়লা যেনো কাব্য যেখানেই আছে সুস্থ থাকুক।”

“আমি এখনও কাব্যকে বিশ্বাস করতে পারছি না চারুর বাবা”

“ভুল করছো শায়লা।একদিন পস্তাবে। অনুশোচনা হবে।কাব্যকে প্রশ্ন করেছিলাম। ও কি ওর বাবার মতন?সে উত্তর দেয়নি।কিন্তু আমি আজ বলছি।কাব্য ওর বাবার মতন নয়!”

__

মাঝরাতে দরজায় করাঘাত এর শব্দ আসছে। গভীর ঘুম থেকে জাগ্রত করার জন্য যথেষ্ট। অতিরিক্ত রাগের ফলে মাথা ধরেছিল।মাথা ব্যাথা নিয়ে কোনো রকম চোঁখটা বুঝতেই বাধাপ্রাপ্ত হয়। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে চুল বাঁধতে বাঁধতে দরজা খুললো।সামনে দৃষ্টি পড়তেই চক্ষু ছানাবড়া।কাকে দেখছে চোখের সামনে?দৃষ্টিভ্রম নয়তো?

মাদক মিশ্রিত কন্ঠস্বরে প্রশ্ন এলো দরজার ওপার থেকে, “ঘুমিয়ে পড়েছিলে চারুলতা?”

উত্তর দিতে পারলো না।শুধুই চেয়ে রইলো চারু।কাব্যর দিকে।ফিরে এসেছে তাহলে।হৃদয়ে কোনো স্থানে যে শূন্য অনুভব করছিলো সেটা পূর্ন হলো।

কাব্য শার্টের হাতা গুটিয়ে ভেতরে আসতে আসতে বললো, “শুনলাম রেগে গিয়েছিলে আমজাদের উপর?আমি নাকি তোমাকে ফেলে পালিয়েছি?আমি এই কাজ করতে পারি বলো?তোমাকে ছাড়া যে আমার এক মুহুর্ত চলে না”

“তো গিয়েছিলেন কেনো?যত্তসব ঢং!”

“দেখলাম কতটা ব্যাকুল হতে পারে তোমার হৃদয় আমার জন্য।আমার নিজেকে জয়ী মনে হচ্ছে চারু জানো?অবশেষে তোমার মনে একটু হলে জায়গা করতে পারলাম।”

“একদমই না ভুল ভাবছেন।”

“তারপর বলো?”

ভ্রু উচিয়ে চারু প্রশ্ন করলো, “কি বলবো?”

“বলো যে – আপনি ভুল”

“হ্যা আপনি ভুল।”

“আর চারুলতা সঠিক”

কাব্যর মুখের হাসি চারুকেও হাসতে বাধ্য করলো। সস্তি পেয়েছে বটে। সেটাকি স্বীকার করবে?কক্ষনো না।তাকে ধন্যবাদ দেবার কথা ছিলো। দিবে না।একদম দিবে না।এতবড় নাটকটা করলো কেনো? ঠিকইতো আবার ফিরে এসেছে। অসভ্য লোক। সত্যিই একটা ভুল মানুষ সে।

কানে বাজলো আরো একটি কন্ঠ।বাহুতে ঝাকুনি অনুভব করছে।মায়ের আওয়াজ।ঘুমটা ভেঙে যায় চারুর।চক্ষু সম্মুখে সব স্পষ্ট হয়। এইমাত্রতো রাত ছিলো?দিনের আলো এলো কোথা থেকে?আর কাব্য!বিছানার এই দিকটায় কাব্য দাড়িয়ে ছিলো। কোথায় গেলো? মা কি করছে এখানে? ঝিম ধরে গেলো মাথায়।কি হচ্ছে?সবটা পরিষ্কার হওয়ার আগেই শায়লা বলে উঠলেন,

“আমজাদ অজ্ঞান হয়ে গেছে চারু।দ্রুত আয়।”

চলবে…

#চারুকাব্য ১৪
লেখা : #azyah_সূচনা

আমজাদ অজ্ঞান হয়েছে শুনে আর কিছু ভাবনা চিন্তার সুযোগ নেই। তরিহরি করে বেরিয়েছে। পুকুর পাড়ে জ্ঞানহীন পড়ে আছে।তাকে ঘেরাও করে দাড়ানো কয়েকজন গার্ড।বোঝা গেলো আমজাদের পাশাপাশি গার্ডরাও রয়ে গেছে এখানেই।শুধু তাদের বসই নেই।এতখন যেই কল্পনার রাজ্যে ডুবে ছিলো?সেটা ছিল মূলত স্বপ্ন। মিথ্যে স্বপ্ন। আমজাদের কাছে গিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে চারু।কি করে অজ্ঞান হলো?বাকি গার্ডরা মুখে পানি ছিটিয়ে কাজ হয়নি।চারু এই অবস্থায় ডক্টর ডাকার জন্য আগ বাড়ে।একজন গার্ড এসে সামনে দাড়িয়ে বললো,

“কোথায় যাচ্ছেন ম্যাম?”

“ডাক্তার ডাকতে”

“আপনি বাহিরে যেতে পারবেন না।সরি ম্যাম।আমরা ডাক্তার ডেকে ডাকছি”

তেতে উঠে আবারো। গার্ডকে ধমকে বলে উঠলো, “তাহলে এতক্ষন কি সার্কাস দেখেছেন?একটা মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এখনও ডাক্তার আনার প্রয়োজন বোধ করেননি!”

“সরি ম্যাম ভুল হয়ে গেছে।”

বিড়বিড় করে চারু বললো, “ভুল মানুষের সাথে থাকলে ভুলতো হবেই!”

আমজাদ এর জ্ঞান ফিরেছে। বিগত সারাদিন না খেয়ে থাকায় জ্ঞান হারিয়েছিলো।পানি অব্দি মুখে তোলে নি।এটাই জানালো ডাক্তার।তাকে খাবার আর মেডিসিন দিয়ে গেছে।চারু বুকে হাত বেধে দাড়ালো আমজাদের সামনে।মুখটা কঠিনতায় ভরা।এখনই কিছু বলবে বলে ভেবে নিলো আমজাদ। হলোও তাই।

চারু বলে উঠে, “শোক পালন করছেন?নাকি এটা বোঝাতে চাচ্ছেন আপনাকে আমরা খাবার দেই না?আমাদের এই অধিকারটাও নেই।আমরা নিজেই আপনার স্যারের টাকায় চলছি। সেখানে আপনাকে না খাইয়ে রাখার দুঃসাহস করতেই পারি না।চুপচাপ সামনে রাখা খাবার খাবেন।”

বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে আরো কিছু যোগ করে বললো, “ঘরের বাহিরে থাকেন কেনো সারাদিন?এখানে থাকবেন।খাবেন, দাবেন আর ঘুমোবেন।আর কোনো কাজ নেই আপনার।”

চারু চলে গেছে।যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো আমজাদ। কথার ঝাঁজ ঠিক কাব্যর মতন।শুধু চারুর কাছেই চুপ বনে থাকতো। মাতোয়ারা ছিলো চারুলতায়।তবে চারু কাব্যর মতন মোলায়েম হৃদয়ের না। রুষ্টতার মাঝেও অন্যরকম তৃপ্তি ছিলো।আর চারুর রুষ্টতায় বিষাদ।

চারুর মন মেজাজ খিটখিটে। ক’দিন হতে চললো। ঠিকঠাকমত কথা বলে না। অথচ গল্পের ঝুড়ি খুলে বসার অভ্যাস ছিলো। বাবা মা ছিলো তার প্রথম বন্ধু।কখন মেয়ে থেকে অভিভাবক হয়ে উঠতে শুরু করেছিলো।কাব্য যাওয়ার পর থেকে মুখটা তেতো হয়ে গেছে।আগুন বর্ষণ করে কথায় কথায়।প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কথা বলা হয়না।ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকতে থাকতে একগুঁয়ে হয়ে যাচ্ছে মেয়েটি।দিন রাতের পরিবর্তনে আজ সাতদিন। কাব্যর হারিয়ে যাওয়ার সাতদিন।বিকেলেই পরিক্ষার ফলাফল আসবে।কোনো মাথা ব্যথা নেই চারুর।না আছে কোনো চিন্তা।একাকী বারান্দায় বসে রাগ বিসর্জন করছে।বাহিরে যেতে চেয়েছিলো।নতুন ভাড়া বাড়ি খোঁজার উদ্দেশে।যেতে পারেনি।তাকে যেতে দেওয়া হয়নি।বিশেষ কোনো কাজ আর অর্ডার ছাড়া এক পা বাহিরে দেওয়া নিষিদ্ধ।যেভাবে কাছে থেকেও আটকে রেখেছিলো।ঠিক একইভাবে হারিয়ে গিয়ে বেড়াজালে বেধে রেখে গেছে।

চারু আকাশপানে চেয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “আসলে কি চায় এই লোক?চলে গেছে।তারপরও তার নিয়মমাফিক কেনো চলবো আমরা?বাহিরের জগৎ কি দেখতে পারবো না আর?”

চয়নের স্কুল বিশেষ কারণে বন্ধ।নাহয় তার উসিলায় বের হওয়া যেতো।নানান চিন্তা চারুর মাথায়।ফলাফল আসলেতো তার বের হতেই হবে।তখন?তখন কি করে আটকাবে?

পুকুর পাড়কে নিজের সময় কাটানোর স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে।এখানেই বসে থাকতে ভালো লাগে।এই জায়গায় বসবাস ছিলো কাব্যর।ঢাকা আসলে এখানেই থাকতো।বাকিটা সময় পাড় করতো সন্দ্বীপে।চারুদের জন্য বাধ্য হয়ে অন্যত্র থেকেছে।পুকুর পাড়ে বসে গল্প শোনা হয়েছে।কাব্যর অতীতের গল্প। হেসেছে সে বহুবার।সে ফিরবে?এই প্রশ্নটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।নিজেকে সেচ্ছায় যেখানে ঠেলে দিলো সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব।চারুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করার ডিসিশন?আদৌ কতটা যুক্তিসঙ্গত।এতটা গভীর তার ভালোবাসা? ভয়হীনভাবে চলাফেরা মানুষের বুকে আতংক ছড়িয়ে গেলো।

ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে মুখ জুড়ে বিরক্তির ছাপ এসে ধরেছে আমজাদের। ফোনে চোখ রাখতেই অপরিচিত নাম্বার দেখতে পায়।এটা তার ব্যক্তিগত নাম্বার।বিশেষ কিছু মানুষ ছাড়া কেউ জানে না।ভাবনা চিন্তায় ছেদ ঘটিয়ে আবার বেজে উঠে ফোন। কানে গুজে আমজাদ কিছু বলার আগেই অন্যপাশ থেকে আওয়াজ আসে,

“আমজাদ”

চোখের পলকে ধরে ফেললো কার আওয়াজ হতে পারে।কাব্য কথা বলছে।উঠে দাড়ায়।দ্রুত গলায় বলে,

“স্যার!স্যার আপনি ঠিক আছেন?”

লাউড স্পিকারে ফোন রাখা। সাথে কথোপকথন রেকর্ডের জন্য একটি বিশেষ যন্ত্র বসানো।দুজন তীক্ষ্ম চোখ কাব্যর দিকে আবদ্ধ।সাথে কবিরেরও।

কাব্য তাদের দিকে এক পলক চেয়ে বললো, “চারুলতা কেমন আছে?”

কবিরের কপালে ভাজ পড়লো।এই বলার জন্য ফোন করতে দেওয়া হয়েছে তাকে?কাজের জন্য ফোন করে প্রেমের আলাপ জুড়ে বসলো।
আমজাদ অন্যপাশ থেকে উত্তর দেয়, “দেখাচ্ছে ভালো আছে।কিন্তু অনেক রেগে।আমাকে অনেক বকে।চলে যেতে চায় এখান থেকে।বারবার বলে আপনার আবেগ ফুরিয়ে গেছে বলে আপনি পালিয়ে গেছেন।”

নিঃশব্দে হাসলো কাব্য।চোখ কটমট করে চেয়ে থেকে কবির আঙ্গুলের সাহায্যে ইশারা করে বললো আসল কথায় আসতে। কবিরের নজরকে উপেক্ষা করে কাব্য বললো,

“শুনো আমজাদ।বাড়ির স্টোর রুমে একটা পেন ড্রাইভ আর কিছু ডকুমেন্ট আছে।সেগুলো…. হ্যা সেগুলো নিয়ে আসো।তোমাকে কবির সাহেবের চামচারা অ্যাড্রেস টেক্সট করে দেবে।”

কবির বলে উঠলো, “নাহ!আমজাদ আসবে না।তোদের আমি একবিন্দু ভরসা করিনা। চঞ্চলকে পাঠা।”

রাগের ছাপ দেখা গেলো কাব্যর মুখে এবার।জেদী গলায় বললো,

“উনি হাটতে পারেন না।আর কতবার বলেছি হিসেব নিকেষ আমার সাথে আপনার। চঞ্চল আংকেল আসবে না।”

“হাটতে পারে না তো কি হয়েছে।ওর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে।গাড়ি পাঠাবো।লক্সারিয়াস কার।আরাম আয়েশ করে আসবে।তাছারাও কতদিন দেখি না আমার ম্যানেজারকে।একটু চোখ ভরে দেখবো!”

“উনি আসবেন না।”

“আমার মাথা বিগড়ে দিও না বাবা।যা বলছি করো।আর এই আমজাদ?কথা কানে গেছে?”

আমজাদ হন্তদন্ত হয়ে বললো, “স্যার কাব্য স্যার আপনি ফিরবেন না?”

“আমার ফিরে আসা অনিশ্চিত!”

__

“বাবা”

চঞ্চল সাহেবের বিসন্ন মন।প্রকাশ করছেন সে।তবে চারু নয়।সে নিজের কাছ থেকেই লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।রাগের আড়ালে কি চায় তার মন?সেটা স্বীকার করতে নারাজ।মেয়ের ডাকে চোখ তুলে চাইলেন।
হাত তুলে ডাকলেন নিজের কাছে। চারু বাবার সামনাসামনি বসে বললো,

“বাবা আজ আমি তোমাকে প্রশ্ন করবো।আর তোমার জবাব দিতে হবে”

“কাব্যর ব্যাপারে?”

“হ্যা বাবা।কি করে চেনো তুমি তাকে? বলো?আমরা সাধারন মানুষ।এত রহস্য ভালো লাগেনা বাবা।”

দীর্ঘশ্বাসের সাথে চঞ্চল সাহেব বলেন, “মা জানিস শায়লাকে আমি উনিশ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলাম। ভালোবেসে।ওর বাবা ছিলেন না।মামার বাড়িতে থাকতো।অবহেলায়।”

“এর সাথে কাব্যর কি সম্পর্ক?”

“আসছি কাব্যর কথায় আসছি।তোর সবটা জানা উচিত।শুরু থেকে শুরু করি?”

“বলো বাবা”

“বিয়ের পর এই কক্স বাজারে ঠায় হয়েছিলো আমাদের। হাতে টাকা ছিলো মাত্র এগারোশ।এখানে এত সহজে কাজ পাওয়া যায়না।টিকে থাকা অত্যন্ত মুশকিল। অলৌকিকভাবে একদিন কনস্ট্রাকশনের কাজ করতে করতে এমন একজনের সাথে দেখা হয় যাকে আমি প্রথম পরিচয়ে মহামানব ভেবে ফেলি।আমার হাতে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে আমাকে পূনরায় দেখা করতে বলেছিলো।”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চারু বললো, “কে ছিলেন সে?”

“কবির আফনান”

আফনান নামটি শুনে চমকে উঠলো।পরিচিত শোনাচ্ছে কর্ণকুহরে।কবির আফনান আর কাব্য আফনান!দুটোই কেমন জানে অদ্ভুদভাবে জড়িত মনে হলো।

“তারপর কি হলো বাবা?”

“কবির আফনানের সাথে আমার ঘনঘন দেখা হতে শুরু করে।আমাকে নানান ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে শুরু করে।তাকে আমি এতটাই মহৎ ভাবতে শুরু করেছিলাম যে সে আমার জন্য এতকিছু কেনো করছে কখনো চিন্তা করতে পারিনি।অতি সরল মনে ভেবে নিয়েছি অন্যান্য কর্মীদের মতন আমাকেও সাহায্য করে সে।আমিও সাহায্যের বিনিময়ে তার টুকটাক কাজ করে দিয়েছি।প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার আর শনিবার আমাকে বর্ডার থেকে কিছু জিনিস এসে কবিরকে দিতে হতো।”

জানার আগ্রহ ব্যপকমাত্রায় প্রকাশ পাচ্ছে চারুর মনে।ভালো রকম মনোনিবেশ করে আছে বাবার কাছ থেকে আসা সব কথাগুলো।

“কি জিনিস ছিলো সেগুলো বাবা?কখনো জেনেছো?”

“জানার ফলেইতো আমার এই অবস্থা।আমি জানতাম জাহাজে করে পণ্য আসে।আর কবির ব্যবসা করেন।যেদিন জানলাম সে ড্রাগ সাল্পাইয়ার, স্মাগ্লিং,মানুষ হত্যা এর কাজে লিপ্ত!সেদিন থেকে আমি পথ আলাদা করার কথা ভেবে নেই। তাছাড়াও রাজনৈতিক দলের মধ্যে অনেক কীটপতঙ্গ ছিলো এখনও আছে। যারা দেশের হয়ে দেশেরই বিনাশ করছে।কবির আফনানের তাদের সাথে উঠাবসা ছিলো। অনৈতিক কাজ আর ক্ষমতালোভী মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সে!আর তোর বাবা স্ত্রীকে একটা ভালো জীবন দেওয়ার জন্য অজান্তেই অপরাধের সাথে জরিয়ে গিয়েছিল।”

“কাব্য?”

হতাশ গলায় চঞ্চল সাহেব বলে উঠলেন, “ওই নরপুরুষের ছেলে কাব্য।সে নিজের ছেলেকেও ছাড় দেয়নি চারু।কাব্যর বাবা মার ডিভোর্সের পর কাব্য ওর দাদীর কাছে বড় হয়েছে।বছরের পর বছর ছেলেকে বেহালে ফেলে রেখে হটাৎ একদিন মনে পড়লো তার একটা ছেলেও আছে।আঠারো বছরের এক কিশোরকে নিজের দলে সামিল করে নেয়।এমনকি কাব্যকে দিতে না চাইলে সে নিজের আপন খালাকে অব্দি খুন করেছে।”

“আঠারো বছরে একটা মানুষের নিশ্চয়ই হিতাহিত জ্ঞান হয়েছিলো?ভালো খারাপ বাছ বিচার করার ক্ষমতা জন্মেছিলো?তারপরও নিজের বাবার দলে যোগ দিলো?”

“কাব্যতো এসব কিছুই জানতো না।তাকে মিথ্যে বলা হয়েছিল।তার দাদীকে হত্যা করা হয়েছে সেটাও কাব্য জানতো না।তাকে বলা হয়েছিল তার দাদীকে বিদেশ পাঠাবে উন্নত চিকিৎসার জন্য।কিন্তু পাঠায়নি।কাব্যর চোখের সামনে স্লো পয়জন দিয়ে তিলেতিলে শেষ করেছে মহিলাটিকে।কারণ কবির জানতো আছিয়া বানু থাকলে কাব্য কোনোদিন কবিরের কথামত চলবে না। মিথ্যে অসুখের অজুহাতে মেরে ফেলেছে তাকে।ততদিনে তোর তেরো বছর। আট বছর অপেক্ষা করিয়ে এসেছিলি আমার ঘরে।আর দেখ?তোর বাবা কত বড় অপরাধের সাথে জড়িয়ে ছিলো।”

চারু বাবার দুহাত আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।দুর্বল হৃদয়ের মানুষ চঞ্চল সাহেব।পূর্বে থেকেই। পুরুষ মানুষও এমন হতে পারে এটা তার বাবার কাছ থেকেই জেনেছে চারু।

“তুমিতো ইচ্ছে করে এসব করোনি তাইনা বাবা?”

“বিশ্বাস কর মা!আমি যদি জানতাম ভালো মুখোশের পেছনে এই চেহারা?সারাজীবন নুন পান্তা খেয়ে জীবন পাড় করে দিতাম।হয়তো আমার মনেও টাকার লোভ জন্মে গিয়েছিল মা।”

“এটা লোভ না বাবা। পরিবারের জন্য চিন্তা!”

দীর্ঘ পলক ফেলে চঞ্চল সাহেব আবার বলতে লাগলেন, “কাব্য সরল সোজা ছেলে ছিলো।অপরাধের দুনিয়াতে তাকে আমি দেখেছি মাত্র দুই বছর।এরপরই মনে সাহস জুগিয়ে পথ আলাদা করেছি।কিন্তু জানতাম না খারাপ কাজ ত্যাগ করতে গিয়ে আমি হবো সর্বহারা।আমার ব্যাংকে যত টাকা ছিলো সব নিজের নামে নিয়ে নিয়েছে।মেরে ফেলতে চেয়েছিলো আমাকেও।নিজের হারাম টাকায় কেনা গাড়ি দিয়ে কচলে দিতে চেয়েছিল আমাকে।কিন্তু পারেনি।কে রক্ষা করেছে শুনবি?”

ধীর কণ্ঠে চারু প্রশ্ন করে,

“কে?”

“কাব্য!রাস্তায় পড়ে কাতরাতে দেখে ওই ছেলেটা চঞ্চল আংকেল বলে দৌড়ে এসেছিল।মানুষ ডেকেছে। হাসপাতালে ভর্তি করেছে আমাকে।সেদিন থেকে সব বাদ দিয়ে আমি তোকে আর তোর মাকে নিয়ে ঢাকা চলে আসি।ভুল বললাম!তোর মা আমাকে নিয়ে।আমিতো পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলাম।যাওয়ার আগে কাব্যকে একটা কথা বলেছিলাম।সেটা হলো নিজের জীবনে সুস্থভাবে বাঁচতে চাইলে নিজের বাবার কাছ থেকে চলে আসো।তোমার দাদীকে তোমার বাবা খুন করেছে।সবটা জানিয়ে দিয়েছিলাম তাকে।ওকে ভালো স্কুলে পড়ালেখা,ওর শখ পূরণের আড়ালে ওর বাবা যে ওকে ব্যবহার করছে সেটাও বলেছি।জানি না কাব্য সেদিন আমার কথা মাথায় নিয়েছিলো নাকি। তবে চুপ করে ছিলো।”

জীবনটা এত পেঁচানো না হলেও পারতো।এই মুহূর্তে চারুর মনে এই বাণী ঘুরপাক খাচ্ছে।সারাজীবন একটা সহজ পথে চলতে চেয়েছে।হয়তো ছিলো অনেক অভাব অনটন।তারপরও এতো রহস্যময় ছিলো না।আজ বাবার মুখ থেকে জানতে পেরে প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে উঠেছে।খোলাসা হয়েছে অনেককিছুর।জানতে পারলো তার বাবার পঙ্গু হয়ে যাওয়া কোনো দূর্ঘটনা ছিলো না। সুপরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো তাকে। নির্মমভাবে।

“আমাকে বিয়ে করা কি কোনোভাবে এসবের সাথে জড়িত?”

“জানি না আমি মা। কাব্য বেচেঁ আছে আমি এটাও জানতাম না।আমি খুব কাছের একজনের থেকে জানতে পেরেছিলাম কাব্য তার দাদীর মৃত্যুর আসল রহস্য জানতে পেরে ওর বাবার বিরোধিতা করেছে।তাকেও মেরে ফেলার পরিকল্পনা চলছিলো।”

চারুর চোখের সামনে ভেসে আসলো কাব্যর হাতের আঘাতের চিহ্ন।বেশ পুরাতন ক্ষত। ঘাড়ে, হাতে যতবার দৃষ্টিপাত হয়েছে এই ক্ষতগুলোই বেশি ধরা দিয়েছে চোখে।হাহাকার জাগছে মনের অন্তরালে।বাবার আর কাব্য উভয়ের কথায় জর্জরিত হচ্ছে মস্তিষ্ক।

চঞ্চল সাহেব আবার বলে উঠলেন, “আমার অনেক ভয় হচ্ছে!যদি কাব্য সত্যিই ওর বাবার মতন না হয় তাহলে ওর জন্য অনেক বিপদ। ছেলেটা কখনো খারাপ ছিল না।ওকে খারাপ পথে টেনে হিচড়ে আনা হয়েছিলো।আমি দেখেছি।যেদিন প্রথম ওর বাবা ওর হাতে পিস্তল ধরায়।সেদিন থেকে প্রতিবার ওর হাত কেপেছে।”

সস্তি নামক অনুভূতিটা নিজের মধ্যে পাওয়া দায় হয়ে পড়ছে। প্রতিনিয়ত মনে হয় দম আটকে মারা যাবে।পিছু টান বোধ হয়। যন্ত্রণা চলছে মর্মে।রাগ হয়ে যা প্রকাশ্যে আসে।ঠোঁট ভিজিয়ে চারু কাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

“বিপদ মানে?কেমন বিপদ?”

“যে পরিকল্পনা তখন পূর্ণতা পায়নি…সেটা যদি এখন”

চঞ্চল সাহেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই চারু বললো,

“আমি উঠলাম বাবা!”

চলবে…