চারুকাব্য পর্ব-২১+২২

0
233

#চারুকাব্য ২১
লেখা : #azyah_সূচনা

“আমাকে দেখা শেষ হয়নি আপনার?”

সাবিনা বরাবরের মতনই চোখ নুয়ে।সকাল সকাল এমন প্রশ্নে বিব্রত।কাব্য চোখে মাত্রাতিরিক্ত ঘৃনা আর বিরক্তি।

“হ্যা হয়েছে”

“দেখেন আমি সুখে আছি।ভালো আছি।আগের কোনো কিছুই টেনে আনার এবং সম্পর্ক জোড়া লাগানোর চেষ্টা করবেন না।আমি বেচে থাকতে সেটা সম্ভব নয়।যতই অনুশোচনাবোধ থাকুক না কেনো আপনার মধ্যে আমি আর নতুন করে কোনো সম্পর্ক শুরু করতে চাই না।”

“তুমি যা ভালো মনে করো।”

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে কাব্য।মাঝেমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়ে। নাড়ির টান।যতই হোক মা তো? অনুভূতির বিচিত্র মিশ্রণ। কখনো ক্ষীণত্ব আবার কখনো শক্ত খোলসে আবৃত। পুরোপুরি হৃদয়ের ক্ষয় হওয়ার আগেই ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানালো। সাবিনাও বুঝতে পেরেছেন।

কাব্য আবার বললো, “আপনার সংসার আছে,ছেলে মেয়ে আছে।আমারও একটা ছোট সংসার আছে।আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে মনোযোগী হই।তাতেই আমাদের মঙ্গল।”

সাবিনা গত রাতেই মুহিত সাহেবকে বলেছেন আজই ফিরে যাবেন। কাব্য তাদের এখানে চাচ্ছে না। অপমানজনক পরিস্থিতি হলেও সাবিনার কৃতকর্মের কাছে এটাও তুচ্ছ।নিজের ভালো ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেলেকে অনিশ্চিত পথে একা ফেলে পাড়ি জমিয়েছিলেন অন্যত্র।প্রথম স্বামীকে ছেড়েছেন তার অপকর্মের কারণে।সেখানে ভুল না থাকলেও ছেলের দায় আছে।এখন তার ফিরে আশা মেনে নেওয়া হবে?কখনোই না।

ঘুম থেকে জাগ্রত হতে বেশি সময় নিয়ে ফেলেছে চারু।উঠেই প্রথমে গোসলটা সেরে নেয়।ভেজা কাপড় হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসলে কাব্যকে বারান্দায় আনমনা হয়ে বসে থাকতে দেখলো।বারান্দার কাছাকাছি দড়িতে কাপড় মেলতে মেলতে প্রশ্ন করলো,

“কি হয়েছে আপনার?”

এতক্ষন যাবৎ নিজের মধ্যেই মগ্ন ছিলো।চারুর আওয়াজে দৃষ্টি তোলে।চোখ পড়ে সাদা লালের মিশ্রণে নিজেকে রাঙিয়ে রাখা নারীর দিকে।চুলে সাদা তাওয়াল পেচিয়ে আছে।কাপড় মেলতে মেলতে গুনগুন আওয়াজটাও শ্রবনেন্দ্রিয় এড়িয়ে যায়নি।হাতের কাজ শেষে মুক্ত করলো কেশমালা।গ্রামীণ কন্যার ন্যায় ঝেড়ে নিচ্ছে ভেজা চুল।মনোযোগ ঘুরতে সময় নেয়নি কাব্যর।ঘোর মিশ্রিত নয়ন আটকেছে এরূপ দৃশ্যে। মুগ্ধতায় বাঁধা তার চঞ্চলতা। স্থির নেই একজায়গায়।এদিক ওদিক দুলে চলেছে।টানে পা জোড়া আর থেমে থাকেনি।এগিয়ে গেছে আরো কাছ থেকে অক্ষির তৃষ্ণা মেটাতে।

ব্যস্ত চারুর হাত সন্তপর্নে টেনে নিজের মুখোমুখি দাড় করায়। আরত্ত কায়া নিবৃত্ত হয়েছে।নিজের অজান্তে এসে থেমে যাওয়া চারুর মুখে বিস্ময়বোধ।প্রশ্নসূচক নেত্র।তার আগেই পুরুষালী আঙ্গুল এসে চোখের পাপড়িতে জমে থাকা শিশির বিন্দু মুছে দেয় কাব্য।

বলে, “স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছ না কেনো?”

“আমি কি করলাম?”

“আমার চোখকে বারবার তোমাকে দেখার তৃষ্ণা মেটাতে বাঁধা দিচ্ছিলে।”

ভ্রূদ্বয় উচু করে চারু বললো, “দিন রাত চব্বিশ ঘন্টাই দেখেন আমাকে।নতুন করে দেখার কি আছে?”

চারুর দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “ভিন্ন রূপে উপভোগ করি তোমাকে বারবার।যেমন এখন?এই সাদা লালের আবরণে তোমায় সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের মতন লাগছে।”

লাজুক আভা ছড়িয়েছে মুখে। নিম্নগামী স্মিতে প্রাচুর্য্যপূর্ন। কাব্যও তাল মিলিয়ে বলে উঠে, “এই হাসি আর আমার চোখকে বাঁধা দেওয়ার দায়ে শাস্তি কি হতে পারে চারুলতা?”

“আমাকে শাস্তি দিবেন?”

“হ্যা অবশ্যই।কপালে তোমার ঠোঁটের স্পর্শ চাই।দ্রুত!এটাই তোমার শাস্তি।”

এমন আবদারে হাসবে না অবাক হবে ভেবে পাচ্ছে না চারু।কি সুন্দর করে মর্জি করে বসলো।শাস্তির ছুতোয় ভালোবাসা পাওয়ার ধান্দা।মুখ ভেংচিয়ে চারু বলে উঠলো,

“মিস্টার লোভী কাব্য আফনান।শুধু ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে তাইনা?”

“এতে দোষের কি?আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না?”

“আমি কাধে মাথা রাখলে অব্দি ছটফট করেন।আজ মনে হয় প্রথম আমার সুনাম করলেন।জানেন স্ত্রীর সুনাম করলে ভালোবাসা বাড়ে?শুধু ভালোবাসি ছাড়া আর কোনো সুন্দর কথা আপনার মুখে শুনিনি।শুধু তাকিয়ে থাকেন।আপনি একটা লজ্জাবতী আনরোমান্টিক লোক!প্রতিদিন সুনাম করবেন আমার। প্রতিদিন ভালোবেসে দুয়েকটা কাব্যিক লাইন আমাকে ডেডিকেট করবেন।আমাকে স্পেশাল ফিল করাবেন।মূর্তির মতন শুধু তাকিয়ে থাকবেন না।তাহলেই আমি আপনার।তাহলে আমি আপনার দেওয়া শাস্তি ভোগ করতে রাজি।”

বলেই চারু দ্রুত পা বাড়ায় ঘরের দিকে।বাড়িতে মেহমান উঠেছে কিনা কে জানে।তাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে।রান্না ঘরের দিকে এগোতে এগোতে আনমনে হেসে উঠলো। কাব্যকে এতগুলো কথা বলে এসেছে।নিজের সুনাম করার জন্য নিজেই বলে আসলো?ভারী লজ্জাজনক কর্মকাণ্ড।চিন্তার পরিবর্তন হতেও সময় নিলো না।নিজের চিত্তকে শায়েস্তা করে মনে মনে বলে উঠে,

“আমার স্বামীকে আমি যা ইচ্ছা তাই বলবো।এতে এত ভাবাভাবির কি আছে?”

রান্না ঘরে রুনা আছেন।পাশেই তার মেয়ে টুনি।জমিনে পাটি বিছিয়ে পড়াশোনায় মশগুল।মেয়েটিকে কাব্যই স্কুলে ভর্তি করিয়েছে।ভালো লাগলো তার পড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে।নাস্তা আগেই রেডি করে নিয়েছেন সে।

চারু প্রশ্ন করল রুনাকে, “ওনারা উঠেছেন?”

“কারা আফা?”

“মেহমানরা?”

“ওনারাতো সকালেই চইলা গেছে।আপনি জানেন না?”

অজ্ঞ চারু রুনার কথায় অবাক হয়।চলে গেছে?না জানিয়েই?এখন সকাল এগারোটা বাজে। নিশ্চয়ই এর আগেই বেড়িয়েছেন।এত সকাল সকাল না জানিয়ে চলে যাওয়ার কারণটা কি হতে পারে?

“আপনার সাহেব জানে ওনারা চলে গেছেন?”

“হ সাহেবের কাছ থেকা বিদায় নিয়া গেছে”

হোক না হোক তাদের চলে যাওয়ার জন্য কাব্যর হাত।এখানে এক মুহুর্ত না দাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়।বুকে হাত গুজে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ব্যাস্ত কাব্যর পানে,

“ওনাদের আপনি তাড়িয়ে দিয়েছেন?”

“হ্যা”

“কেনো?”

“এমনেই চারুলতা!ভালো লাগছিলো না।সহ্য হচ্ছিলো না তাদের।”

“ওনারাতো চলেই যেতো।নিশ্চয়ই অপমানিত বোধ করেছেন?”

তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে কাব্য বলে উঠলো, “আমার সহ্য হচ্ছিলো না চারু।তাদের সুখী সংসার আমার ভালো লাগছিল না।এখানে আমি আর আমরাও হতে পারতাম।জানি তাদের হয়তো কোনো দোষ নেই।আমি পূনরায় দুর্বল হতে চাই না।আমার তোমাকে ছাড়া আর করো প্রয়োজন নেই।মিসেস সাবিনাকে চোখের সামনে দেখেই আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো।আমি শুধু তোমার কাছেই নতি স্বীকার করে থাকতে চাই।আমাদের মাঝে কোনো অতীত যেনো না আসে।আমরা একে অপরের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ।”

হঠাৎই গাড়ি নিয়ে আমজাদ এসে হাজির। হর্ন দিচ্ছে।কাব্য মাথায় হুডি তুলে মুখে মাস্ক পড়ে নিলো।দেখে বোঝা গেলো কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“কাজ আছে।তুমি নাস্তা করে নিও।আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।”

মুহুর্তেই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে চারু।বারণ করার সুরে বলল, “না না যাবেন না আপনি।আপনার জন্য বাহিরে যাওয়া কতোটা রিস্ক জানেন?”

“গার্ডরা যাচ্ছে সাথে চারু। আমজাদও আছে।আর আমি বেশি দূরে যাবো না।তুমি কোনো টেনশন নিও না।আসছি”

“আসবেনতো নাকি আবার…”

আশ্বাস দিয়ে কাব্য বললো, “তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।আমি ফিরবো এবার।সত্যিই ফিরবো। অপেক্ষায় থেকো।”

___

বিকেল গড়িয়েছে।চরম সাহসিকতা দেখিয়ে কাব্য বাহিরে।কি করতে গেলো সেটাওতো জানায়নি। গার্ডরা সাথে গেছে তাতে কি?ভয়ের কোনো গার্ড আছে?চারুর মন মানে না।কখনো বসে,কখনো পায়চারি করে সময় কাটাচ্ছে। বিদঘুটে সব চিন্তারা ভর করছে মাথায়।এমন টেনশনে মস্তিষ্কও যেনো রসিকতায় মেতে উঠে।কত সময় হয়ে গেলো?এখনও ফিরে আসার নাম গন্ধ নেই।হাত কচলে একটু আগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে নিশ্চয়ই আসন্ন কালো গাড়িটা দেখা যাবে।একবার হারিয়ে ফিরে পেয়েছে।এখন যেনো তাকে নিয়ে আরো দ্বিগুণ ভয়।ওড়না শক্ত হাতে চেপে ঠায় দাড়িয়ে রইলো।পণ করেছে কাব্য না ফেরা পর্যন্ত এখানেই দাড়িয়ে থাকবে। ইতিমধ্যে রুনা এবং টুনি দুইজনই ঘরে আসার জন্য ডেকে গেলো।লাভ হয়নি।

সন্ধ্যা নামার ঠিক আগ মুহূর্তে হলদে বাতির আড়ালে কালো গাড়িটি চোখে পড়ে। ভারাক্রান্ত মনটা নিমিষেই শীতলতায় ভরে গেছে।তার কথা মোতাবেক ফিরে এসেছে।এত সময় আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেলে চারু।গাড়ি চারুর পাশে দাড় করিয়ে কাব্য নেমে আসে।

প্রশ্ন করে, “এখানে কি করছো?”

ভোঁতা মুখে উত্তর দেয় চারু, “আপনার অপেক্ষা”

“তাই বলে এখানে?চলো ঘরে চলো”

কাব্যর হাত ধরেই ঘরের দিকে আগাতে থাকে চারু।কাব্য আড়ালে পিছু ঘুরে আমজাদকে ইশারা করলো। আমজাদও কাব্যর চোখের ভাষা মুহুর্তেই বুঝে নেয়।গাড়িতে আনা সরঞ্জাম সবার চোখ থেকে বাঁচিয়ে গাড়িতেই লক করে রাখে।ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো কাব্য।সাথে জানালাও। হঠাৎ তার এমন কাণ্ডে চারু বলে উঠে,

“সব বন্ধ করে দিচ্ছেন কেনো?”

কাব্য এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বললো, “ঘুমাবো”

“এই সন্ধ্যায়?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা তাহলে ঘুমোন আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে”

বলেই চারু দরজার দিকে এগোয়।বাঁধ সাধলো কাব্য। সটাং হয়ে দাড়িয়ে গেছে দরজার সামনে। কাব্যর এই কাজ আরো অবাক করে চারুকে।দরজার কাছে এভাবে চুপচাপ দাড়িয়ে পড়ার কারণ কি?

“কি হলো?”

“তুমিও ঘুমাও এসো।”

কাব্যর আবোল তাবোল কথাবার্তার বিপরীতে চারু বললো, “আজব!আমি কেনো ঘুমাবো?আমার ঘুম আসছে না। আপনিই ঘুমোন।”

“চারুলতা..আসলে আমার.. মাথা ব্যাথা করছে। মাথাটা টিপে দাও।তোমার ঘুমোনো লাগবে না।”

কাব্যর কথাই মেনে নিলো। তাছাড়াও তার সাথে সময় কাটানো আজকাল সবচেয়ে পছন্দের কাজ।চারুর কোলে মাথা পেতে আরাম করে শুয়ে পড়লো কাব্য।যে করেই হোক তাকে এখানে আটকে রাখতে হবে। অন্তত এক থেকে দুইঘন্টা। মিথ্যে অভিনয় করার চেষ্টায় ধরা পড়ে যাওয়ার সুযোগ আছে।মাথা ব্যথার মিথ্যে বাহানায় কতক্ষন তাকে আটকে রাখা যায় সেটাই কাব্যর জন্য টাস্ক হয়ে দাড়ালো।
আধ ঘন্টা পেরিয়েছে।মেয়েলি মসৃণ হাতের স্পর্শে ঘুমঘুম ভাবটা ঝেকে বসছে বারবার।কিন্তু ঘুমোলে চলবে না।চারুর প্রতি বিশেষ নজরদারি করা দরকার।কোনোভাবেই যেনো বাহিরে যেতে না পারে।ফোনের দিকেও নজর দিতে লাগলো কাব্য বারবার।আমজাদ কল করছে না কেনো?এত সময় লাগে কাজ করতে। সেটাও বেশি সময় পারলো না।চারু সোজাসুজি ফোন ঘাটতে বারণ করেছে।এতে নাকি মাথা ব্যথা বেড়ে যাবে।

__

রাত আটটায় ছাড়া পেয়ে নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে চারুর।কেমন অদ্ভুত লোক সে।মাথা ব্যথার কথা বলে দেড় ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছে।নানান বাহানায়, অজুহাতে বাধ্য হয়ে বসে থাকতে হয়েছে তার পাশে। সন্দেহজনক মনে হচ্ছে তার এই কাজ।চারু কয়েকবার জেরা করার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি।একটা শব্দ বের হয়নি মুখ থেকে। রুনা এসে দরজা নক করে গেছে।লজ্জায় পড়তে হয়েছে চারুর।কোনোভাবেই দরজা খুলতে দেয়নি কাব্য।

স্বাধীন পাখির ন্যায় বেরিয়ে যাওয়ার আগে আবারো কাব্য ডেকে বললো, “আর পাঁচটা মিনিট থাকবে চারুলতা?আমি আসছি”

“না আর এক মিনিটও না।”

“প্লিজ!”

“কি চলে আপনার মাথায় বলেনতো?ইচ্ছে করে আটকে রাখছেন নাতো?”

“হ্যা ইচ্ছে করেই রাখছি।সেটা কেনো একটু পরই জানতে পারবে।আমি এক মিনিটে যাবো আর আসবো।তুমি বাহিরে আসবে না ওকে?”

চারুকে দাড় করিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায়।যত দ্রুত গিয়েছে তত দ্রুতই ফিরে এসেছে। হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে। হাসি মুখে চারুর দিকে এগিয়ে দেয়।

বিস্ময়ভরা নয়নে চারু জানতে চাইলো ,”এগুলো কি?”

“খুলে দেখো”

সাদা আবরণের শপিং ব্যাগ ধীর হাতে খুলতে লাগলো চারু।বক্স খুলতেই বেরিয়ে এসেছে লাল সাদার মিশ্রণে একটি সুন্দর শাড়ি।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না চারু।কাব্য শাড়ি এনেছে তাও চারুর জন্য?এর জন্যই বুঝি বাহিরে গিয়েছিল?

“তুমি বলেছিলে না তোমাকে স্পেশাল ফিল করাতে?এটা ফার্স্ট স্টেপ।জলদি শাড়িটা পড়ে নাও।”

স্পেশাল ফিল করানোর জন্য শাড়ি কিনে এসেছে।তাও আবার নাকি ফার্স্ট স্টেপ! মৃদু হাসলো চারু।প্রশ্ন করলো,

“এখন কেনো পড়বো?”

“আমি দেখতে চাই। শাড়িতে তোমাকে কেমন দেখায়।দ্রুত পড়ো আরো অনেককিছু বাকি।আমি বাহিরে দাড়িয়ে আছি।আর হ্যাঁ কোনো প্রশ্ন করবে না।”

শাড়ী পড়ার অভিজ্ঞতা নেই চারুর।ইচ্ছে পূরণ করার আগেই ঘাড়ে শতশত দায়িত্ব এসে চেপেছিলো।কখনো শখ পূরণের কথা মাথায়ই আসেনি।রাস্তায় সুন্দরী মেয়েদের শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াতে দেখে ভীষণ ভালো লাগলো।ছোটবেলায় মায়ের শাড়ি পরে অনেক ঘুরা হয়েছে।এখন সময়ের সাথে ইচ্ছেরাও বদলে গেছে।ভাবনা চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে কোনো রকম গায়ে জড়িয়েছে শাড়িটা।সঠিকভাবে পড়তে না পারলেও খারাপ দেখাচ্ছে না আয়নায়।

বারবার হাতের সাহায্যে শাড়ি ঠিক করতে করতে বেরিয়ে আসলো।মনে বিশাল আকারের সঙ্কোচ বোধ।শাড়ি পরতে পারা ও না পারার চিন্তায় ভুলতে বসেছিলো এক ভয়ঙ্কর গভীর দৃষ্টির কথা।এই মুহূর্তে যে দৃষ্টি তার মাঝেই আটকে। দুরুদুরু বুক কেপে উঠে মুহুর্তেই।যেনো বধ হয়ে যাবে এখনই চোখ জোড়া আর কিছু সময় এভাবেই চেয়ে থাকলে।

নিজেকে রক্ষা করতে চারু বললো, “দেখেছেন?এবার আমি চেঞ্জ করে আসি।”

পালানোর পূর্বেই শক্ত হাত এসে থামায় তাকে তৎক্ষনাৎ। শব্দবিহীন তাকে শূন্যে তুলে নেয়। নির্বিকার ভঙ্গিতেই এগিয়ে যেতে লাগলো সামনের দিকে।কাব্যর শার্ট খামচে ধরে খিচে চোখ বুজে নেয় চারু।মিনিট খানেক পর স্থির অনুভুত হলো।কাব্য আর সামনের দিকে এগোচ্ছে না। পায়ের গতি থেমে আছে।চোখ খুলে চাইলেই কাব্যর ভাসমান চোখে চোখ পড়ে। দ্রুততম গতিতে চোখ সরিয়ে ফেললো চারু।অন্যপাশে ভেসে উঠেছে আলোকসজ্জা। সমুদ্রের চরে বিভিন্ন আলোর সমারোহ। মরিচা বাতির আভায় চকচক করছে সমুদ্র জলের একাংশ। চারুকে নামিয়ে দিয়েছে।

পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নিচু স্বরে কাব্য বলে উঠলো, “একটা ভুল বিয়ের সঠিক পরিণয়।শুভ বিবাহ বার্ষিকী চারুলতা”

বিবাহ বার্ষিকী?ভিন্নভাবে হওয়া বিয়েটার এক বছর পূর্ণ হয়েছে।যেখানে ঘৃনা ছাড়া আর কোনো অনুভূতির জায়গাই ছিলো না।আজ এই মুহূর্তে আকাশ পাতাল তফাৎ। কাব্যর হারিয়ে যাওয়ার ভয় ঘৃণার উর্ধ্বে এসে দাঁড়িয়েছে।দিন কে দিন বৃদ্ধি করছে ভালোবাসা।

চারুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো, “এটা দ্বিতীয় স্টেপ”

“আপনার আর কত স্টেপ বাকি আমাকে স্পেশাল ফিল করানোর?”

“অনেকগুলো!তোমার পছন্দ হয়েছে চারুলতা?”

“খুব”

দূরত্ব ঘুচিয়ে আরো কাছে টেনে এনেছে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ স্থাপন করেছে চারুর চোখে। অদ্ভুতভাবে লজ্জা পাচ্ছে মেয়েটি।দৃষ্টি নত করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আছে।তার লজ্জাকেও গাঢ় নজরে উপভোগ করতে শুরু করে কাব্য। ছাড়া পাওয়ার চেষ্টায় হাসফাস করা চারুকে আটকে রাখার মধ্যেও আলাদা সুখানুভূতি।

“আমি তোমার জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্যে হারিয়ে না গেলে হয়তো আজ তুমি আমার এতটা কাছাকাছি থাকতে না।ঠিক আগের মতই ঘৃণার চোখে দেখতে।যখন আমার উপর রেগে যাবে তখন এই টেকনিকটা আবার এপ্লাই করতে হবে।”

চমৎকার মুহূর্তে কাব্যর শেষ বাক্যটি তীরের মতন এসেছে কানে। ক্রিয়াভাব পরিবর্তন হতে সময় নেয়নি। রোষে ভরে উঠে চারুর মুখমণ্ডল।কাব্যর বুকে দুহাত ঠেকিয়ে বল প্রয়োগ করে। দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টায়। সক্ষমও হয় চারু। কাব্যর কাছে সেই বল বেশিক্ষণ টিকলো না। পূনরায় ঘনিষ্ট হয়েছে। অভিমানে কাপতে থাকা অধরে উত্তপ্ত অধরের গভীর স্পর্শে কম্পন থেমে যায়। হিমায়িত হয়ে উঠে শিরদাঁড়া আর অকার্যকর মস্তিষ্ক। কাটকাট হয়ে দাড়িয়ে রইলো চারু।প্রতিক্রিয়া বিহীন কাব্য নামক ভ্রমে আটকে।

“এটা আমাকে লজ্জাবতী আর আনরোমান্টিক বলার শাস্তি। থার্ড স্টেপ।”

চলবে…

#চারুকাব্য ২২
লেখা : #azyah_সূচনা

এক বিমোহিত চোখের বাসনা।প্রণয়িনীকে দেখবে নয়নের জ্যোতি ফুরানোর পূর্ব অব্দি। পিপাসার্ত ভ্রমরের সমভাবে ঘুরে বেড়াবে চতুর্দিকে। অনুরাগের অমৃত পান করবে।ধাপে ধাপে পদার্পণ করে খানিক রয়ে যাওয়া দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে উদ্যমী। ব্যতিক্রমী লোভ জাগছে মনে।নিবিড় স্পর্শে মেতে উঠার লালসা। অর্ণবের জলতরঙ্গ আগুনে ঘি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।ইশারা করছে নিসর্গও।প্রবল উদ্দীপনাপূর্ণ হৃদপিণ্ডকে অমত্ত করছে কাব্য।চিত্ত চেতনাকে শান্তনা দিলো এই বলে, ‘ মনোহরীর প্রাণো-অন্তর তারই মধ্যাস্হে নিষণ্ণ।’

লাজে রাঙা অননে লালচে আভা জড়ানো।এক টুকরো রক্ত জবা যেনো নিজস্ব।অতি নৈকট্য বুঝি সহ্য করে উঠতে পারেনি।গভীর আসক্তি ছড়িয়ে দিয়ে গেছে এই স্পর্শন।অতিরিক্ত হৃদ স্পন্দনের সাথে তাল মিলাচ্ছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কম্পন।

প্রগাঢ়তা বিজড়িত গলায় নীরবতা ভাঙতে বাধ্য হয় কাব্য।বললো,

“আমার চারুলতা মোটেও নির্লজ্জ নয়।সে অত্যন্ত মূল্যবান লাজুকলতা।…আমার!একান্ত আমার।

চোখে পড়লো এক ভিন্ন রূপ।প্রথম প্রেমে পড়েছিল যে রূপে। সাদাসিধে অমিশ্র চেহারাখানা।আজকাল ভীষণ রকমের রাগী সে।এই মুহূর্তে যে মুখটা অনাড়ম্বরতায় প্রাচুর্য্যপূর্ণ?সে চেহারাই সবচেয়ে প্রিয় কাব্যের। তবে সবরূপেই চারুলতা সে। মনোহরী। আদুরে।

“তোমার থেকে শেখা নির্লজ্জতা পড়ে অবলম্বন করবো।এখন অন্য কিছু?ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করিয়েছি।ভদ্র থেকে অভদ্রে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য সারারাত্রি ব্যাপী সময় আছে।এই সমুদ্র আছে,এই হিমেল হাওয়া আর ওই চাঁদটাও আছে।”

কথা বলার ভঙ্গিতে বেজায় ভিন্নতা। আসলেই কাব্যর সামনে দাড়িয়ে আছেতো?কোনো জড়তা নেই।উল্টো তার বাক্য যুগলের মাধ্যমে চারুকে আড়ষ্টতায় পতিত করছে।চারুকে নির্লজ্জ বলা হতো।আর সে যে নির্লজ্জতার কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে তার বেলায়? মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হতো চারুলতাকে।সে মোটেও নির্লজ্জ নয়।উল্টো কাব্য আফনান অতি মাত্রায় ধৃষ্ট লোক। ভোলাভালো লাজুক মুখের আড়ালে চরম বেহায়া একটা লোক। আনরোমান্টিক বলেছে বলে সরাসরি চুমু খেয়ে বসবে?

খাবার মুখে এগিয়ে দিয়ে কাব্য বলে, “খাও”

গলা দিয়ে ঢোক অব্দি গিলতে পারছে না। খাবার নামবে? অসম্ভব।নীরব মাথা নত হয়ে বসে রইলো চারু।

“হয়েছে!খাবারের সময় অন্তত লজ্জাকে পাশে সরিয়ে রাখো।আবার পড়ে মন ভরে লজ্জা পেও ”

রাগ মিশ্রিত নয়নে কাব্যর দিকে চাইলো চারু।বেশি বকবক করছে না আজ?এর চেয়েতো আগের কাব্য ভালো।অন্তত দ্বিধায় ফেলতো না।

“আপনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলুন।”

“স্বাভাবিক ভাবেইতো বলছি”

“নাহ এটা আপনার গলার টোন না।মনে হচ্ছে নেশা টেশা করেছেন”

ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটেছে কাব্যর।গলার স্বরে নাকি পরিবর্তন তার।এই পরিবর্তন এনেছে কে?খোদ চারু। সুপ্ত অনুভূতিকে জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছে।কণ্ঠে গভীরতা বজায় রেখেই কাব্য জবাব দেয়,

“সত্যিইতো চারুলতা।নেশাতো করেছি।সেটা ভিন্ন নেশা। মনোহরীর চোখ,মুখ, সৌন্দর্যের মদ্যপান করেছি সেই কবে।শুধু প্রকাশ আজ করলাম”

চারুর মুখে খাবার পুড়ে দিলো।ডান কপোলে আবার ঠোঁট ছোঁয়ায়।আজ পরিমাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসা উজাড় করছে।হয়তো পূর্ন করতে চাচ্ছে অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়া সময়ের শূন্যস্থান।একাধারে এত স্নেহশীলতা কি সহ্য করা যায়?

সমুদ্র তীর এক টুকরো আলোক প্রজ্জ্বলনে মাতোয়ারা। গভীর প্রণয়ের পার্বণে রঞ্জিত হয়ে আছে রাতের আমোদ।যুগ্ম মানব ছায়া মেটে জমিনে শোভা পেয়ে আছে।অপরাপর পরোয়াসহিত মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। মুখে লেগে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ মুছে দিয়েছে পরম যত্নে।

“জানো চারুলতা?এই দীর্ঘ সময়ে প্রেম নামক অনুভূতিটা আমার মধ্যে কখনো আসেনি।আসার পথ পায়নি।আমি এটাও জানি তোমার জীবনেও প্রেম আসার সুযোগ পায়নি।একই পথে তবে ভিন্ন গন্তব্যে চলেছি আমরা। তুমিও চেয়েছিলে জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে আর আমি চেয়েছিলাম গোছাতে।এলোমেলো ছিলাম।বাল্যকাল থেকে যে কালো মেঘের ছায়ায় বড় হয়েছি সেটা কাটিয়ে ঝলমলে আকাশ দেখার শখ ছিলো।সেটা পূরণ হয়েছে তোমার সাথে।তোমার জন্য। উপভোগ করছি একটা সাধারণ স্বাভাবিক জীবন।আমি আর পূর্বের কোনোকিছুই ফিরে পেতে চাই না।”

এক দৃষ্টিতে কাব্যর কথাগুলো শুনে আপনাআপনি চারুর মুখ ফুটে বেড়িয়ে আসলো, “আপনি আমার প্রথম প্রেম।”

“জানি।যেদিন তোমাকে দেখেছি সেদিনই মনের এক কোণে লিখিত হয়ে গিয়েছিল যে তুমি আমার জন্যই বরাদ্দ।”

“এভাবে বিয়ে না করলেও পারতেন।”

“আমি যেমন জীবনচারিতায় অভ্যস্ত তুমি আমাকে কখনো মেনে নিতে না।ভালোবাসা ছিলো সত্যি! কিন্তু পাওয়ার জেদটা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।”

“আঘাত করেছেন কিছু মানুষকে।”

চারুকে বাজিয়ে দেখতে কাব্য প্রশ্ন করে, “তোমার সামনে যদি কোনো মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে,চুমু খায়,হাত ধরে তুমি কি করবে?”

কণ্ঠে রুষ্টতা এনে চারু বললো, “হাত পা মুখ ভেঙে ফেলতাম।”

তুলতুলে গালে বৃদ্ধাঙ্গুল স্পর্শন করে কাব্য বললো, “আর আমি সত্যি সত্যি হাত ভেঙ্গে ফেলেছি। ভেঙেছি বললে ভুল হবে। একটু ব্যাথা দিয়েছি”

বলেই হেসে উঠে কাব্য। সশব্দে!সে কিছুই করে না একটু ব্যথা দেয়।পেছনে ফেলে আসা সময়ে এই ডায়লগ শোনা হয়েছে।সামান্য আঘাত করে শাস্তি প্রদান করে শুধু।বড় কোনো ক্ষতি করেনা আবার।কণ্ঠের পাশাপাশি হাস্যোজ্জ্বল মুখটাও ভীষণ সুন্দর।সেখানে আঘাতের দাগগুলো বেমানান।সুযোগ হলে আবারও মলমস্বরূপ দু চারটে চুমু বসাতো।কিন্তু সেই সাহস কাব্য অবশিষ্ট রাখে নি।এখন এই দুঃসাহসের পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে।

“অতীতের কিছু ভুল থাকুক। গ্লানিও থাকুক।যেটা চলে গেছে তাকে নিঃশেষ হিসেবেই ধরে নিন।আমাকে শুধু এই আশ্বাসটুকু দিন কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না?”

“চারুলতা তোমার মনে এত ভালোবাসার মজুদ আছে?আগে কখনো বুঝতে দাওনি কেনো?”

উৎসুক কন্ঠ টেনে চারু উত্তরে বললো, “লুকিয়ে রেখেছিলাম।জমিয়ে রাখছিলাম তার জন্য যাকে ভালোবাসার জন্য আমার হৃদয় তৎক্ষনাৎ অনুমতি দিবে।বোঝার জন্য,জানার জন্য সময় নিবে না।শুধু বলবে এই সেই ব্যক্তি যার সাথে তুমি বাকি সারাটা জীবনের জন্য আটকা পরে যাবে।আমি তোমাকে তোমার অতীতের উর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসি।”

সম্মোহনী শ্রী তার,তার থেকেও বেশি সম্মোহনী তার ডাক।তুমি বলে ডাকছে?ধাঁধিয়ে উঠছে কর্ণ।এই ডাকে আফিম মেশানো।কম্পন ধরে পুরুষালি বক্ষ পিঞ্জিরার অন্তরালে লুকয়িত চিত্তে।মন-মস্তিষ্ক দুয়ে মিলে আরেকটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।তার নতুন নাম হবে ‘সম্মোহনী লতা’।

আবদারসুলভ গলায় কাব্য বলে উঠে, “আবার তুমি বলে ডাকবে?”

“নাহ আর না। একবার সাহস করে ডেকেছি এটাই অনেক!”

সরাসরি প্রত্যাখ্যানে দমে যাবার নয় কাব্য।ইচ্ছে হচ্ছে সামান্য জোর খাটিয়ে নিজের আবদার মানিয়ে নেওয়ার।এতে ভুলতো কিছু নয়।অধিকার আছে।

“আমার কথা শোনো চারু।নিশ্চয়ই চাইবে না আমি কাছে এসে তোমাকে লজ্জায় ফেলি।”

“হুমকি দিচ্ছেন?”

“হ্যাঁ”

চারুও বেকে বসে।শুনবে না তার কথা।লজ্জা দিতেও দিবে না।হাত এটে নিজেকে পূর্ব প্রস্তুত করলো।বললো,

“শুনবো না কথা।”

বলেই দ্রুত মুখ ঢেকে নেয়।মুখের কোনো অংশে যেনো হামলা না চালাতে পারে এই সদ্য অসভ্য হওয়া পুরুষ।কাব্য ঝুঁকে। পাজাকোলে তুলে নেয় এক ঝটকায়।এগিয়ে চলতে লাগলো সমুদ্রের দিকে। আশ্চর্য্য আর ভয় মিশ্রিত চারুর মনোভাব।দ্রুত হাতে শার্টের কলার চেপে ধরেছে।সমুদ্রে ফেলে দিবে নাতো?ফেলে দিয়ে বলবে একটু ভয় দেখিয়েছি শুধু। সমুদ্র গর্ভে অর্ধ ডুবে আছে উভয়ই।কাব্য এনে দাঁড় করিয়েছে তাকে। এটা কি শাস্তি ছিলো।কোমরে হাত পেঁচিয়ে নিজের দিকে টেনে আনে।

বলে, “চারুলতা পুরুষ মানুষ দ্রুত ফসকে যায় প্রেয়সীর কাছে।সত্য!আর প্রিয় নারীর কাছে তার নিজস্ব বলে কিছুই থাকে না।সেখানে সে অসহায়।এতটা দিন তোমার পাশে থেকে তোমার সঙ্গ পেতে ইচ্ছে হয়েছে বহুবার।স্বীকার করিনি।বুঝতে দেইনি।তুমি কাছে এলে মনে হতো এই বুঝি ভুল করে বসলাম।অস্থির হয়ে উঠতাম।… সেচ্ছায় ভুল করতে ইচ্ছে হচ্ছে।যে ভুল এই ত্রিভুবনে ভুল বলে গণ্যই হবে না। গভীরভাবে ছুয়ে দেই সুন্দর চারুলতাকে?নাহয় হৃদয় ধুকে ধুকে মরবে।”

জলে ডুবে থাকা পা দুটো আসাঢ়।তার চেয়ে আবেদনময়ী কাব্যর চাওয়া।উপেক্ষা করারতো জো নেই।ভালোবাসা পাওয়ার কাতর সে নিজেও। কাব্যর বুকে আটকে থাকা হাত তার হৃদপিণ্ডের গতিবেগ পরিমাপ করতে অক্ষম।চারু হয়তো ভয় পাচ্ছে।এমনটাই চট করে ভাবতে শুরু করে কাব্য।

চারুর অভ্যন্তরীণ অদৃশ্য অস্থিরতাকে দুর করতে দ্রুত বাক্যে বলতে লাগলো, “বাদ দাও চারুলতা।আমি তোমাকে সময় দিবো।বছরের পর বছর সময় চাইলেও দি…”

কাব্যর কপালে বিশেষ রাজত্ব চারুর। অধর ছোঁয়াতে পিছিয়ে থাকে না। কাব্যও বাধ্য মাথা ঝুঁকাতে।দ্রুত কাব্যর বুকে মাথা গুঁজে নিলো।নিচু গলায় বললো,

“যেখানে ভালোবাসা আছে সেখানে পরিপূর্ণ আপনার হতে আমার কোনো অসুবিধে নেই।”

শশাঙ্কও কি আজ লাজে রাঙা?কালো মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো যে?অথচ সমুদ্র তার মতই উত্তাল।সে রাতের মতন ঝড় উঠেছে।যেই রাতে কাব্যতে ভুলবশত জড়িয়ে যেতে বাধ্য করেছিলো চারুকে।আজ হয়তো ভুল শুধরে গিয়েছে। ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের যথাযথ পরিণাম,পরিণয়।কাব্য ভুল নয়।সঠিক!চারুর জন্য সম্পূর্ণরূপে সঠিক।ভুল ছিলো তাকে জানার ভুল, উপলদ্ধি করার ভুল।ঘায়েল হচ্ছে সেই পরিণামে।যাকে ভেবে বসেছিলো নরপুরুষ তার কাছেই নিরাপদ মনে হচ্ছে নিজেকে।নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে আবদ্ধ করে ফেলছে সম্পুর্ণ চারুকে।ভিন্ন কাব্যর রূপে পাগলপ্রায় নাজুক চারুলতা।বুঝে উঠলো তার উন্মাদনার কাছে চারুর জেদ শক্তিহীন। জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় নিজ থেকে পা বাড়িয়েছে চারু।জ্বলে পুড়ে ছারখারতো হওয়া অনিবার্য।তবে ধৈর্য্য ধারণ করা কাব্য এত অধৈর্য্য হলো কি করে? প্রেমসুধায় মাতালের মতন ডুবে আছে।সম্পূর্ণ চারুলতা ডুবে থেকেও তার অস্থিরতা কমছে না। দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত নিঃশ্বাসের ঘনত্ব।

আকস্মিক গালে ভেজা অনুভব করলো চারু।বেয়ে চলেছে এক ফোঁটা জল। বদ্ধ চোখজোড়া চটপট মেলে দিলো।কাব্য কাদঁছে?

“কি করে সেদিন ভেবেছিলে তোমাকে আমি মেরে ফেলবো?আমার চোখের দিকে কখনো চেয়ে দেখেছিলে?তোমাকে মৃত্যু দেওয়ার আগে আমার মৃত্যু কামনা করি আমি।”

সম্পর্কের প্রথম দিকে চারু কাব্যকে বলেছিলো। মনেপ্রাণে মানতো চারু। কাব্যর চরিত্র যেমনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে?সে হয়তো একদিন চারুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে।

কাব্যর নিভু নিভু কন্ঠ।তারপরও জোর খাটিয়ে বলে উঠছে, “তোমার জীবন নষ্ট করিনি চারু। সত্যিই চাইনি এভাবে পদার্পণ করতে।করে ফেলেছিলাম ভুল বশত।আমাকে ক্ষমা করে দাও।আমি একটা লোভী আর খারাপ লোক”

কাব্য পূনরায় বলে উঠে, “আমার তোমাকে ছাড়া চলেনা।একদম চলে না। বিগত এক বছর হসপিটালের বেডে শুয়ে তোমাকে কাছে কল্পনা করে কেঁদেছি,হেসেছি।অভিনয় করেছি নিজের সাথে।ভুল বুঝিয়েছি মনকে।চারুলতা কাছেই আছে।হাঁটছে,চলছে,কথা বলছে তোর সাথে।”

কান্নারত কাব্যকে থামানোর কোনো ভাষা খুজে পেলো না চারু।তার কথাগুলো চারুর হৃদয়কেও ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করছে।চাইছে না কোনো কষ্ট এই মুহূর্তে।কাব্যকে থামাতে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলো চারু।এলোমেলো চুলের গভীরে হাত ডুবিয়ে কাব্যও মগ্ন হতে শুরু করলো চারুতে।

____

“তোমার জন্য গুড নিউজ আছে আমজাদ”

কাব্যর কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আগ্রহী দৃষ্টিতে চাইলো আমজাদ। গুড নিউজ তাও আবার আমজাদের জন্য?তার জীবনে গুড বলে কিছু আছে নাকি?সব কিছুই ব্যাড।

“জানতে চাইবে না কি গুড নিউজ?”

“জ্বি স্যার অবশ্যই”

হাসিমাখা মুখে কাব্য জবাব দেয়, “খুব শীগ্রই তোমার বিয়ে হতে চলেছে।আমি নিজে খুজবো তোমার জন্য মেয়ে।উকিল দিবো তোমাকে”

আগ্রহী,খুশি, আশ্চর্য্য উভয়ের উত্থান পতন হয়ে গেলো আমজাদের মনে।প্রথমত গুড নিউজ শুনে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিল।বিয়ের কথা শুনে খুশির জোয়ার বইয়ে শুরু করেছিল তার আগেই কাব্য উকিল দেওয়ার কথা বলে সেই খুশির অনুভূতিকেও দমিয়ে দেয়।উকিল কাব্য দিলে সে হবে আমজাদের উকিল বাবা।এটাও কি সম্ভব!

রুক্ষ মুখে বলে উঠে আমজাদ, “আপনিতো আমার বয়সে ছোটো স্যার।আপনি আমাকে উকিল দিলেতো বাবা সমতুল্য হয়ে যাবেন।”

“বাবা নয়।লিগ্যাল গার্ডিয়ান”

“যেটাই হোক স্যার।আপনার বয়সের সাথে অভিভাবক শব্দটা যায় না।কেমন দেখাবে বলেন ছোটোখাটো চারু ম্যাডাম এত উনচল্লিশ বছরের ছেলে আর ছেলের বউকে বরণ করছে?”

“তোমাকে উকিল দিতে হলে আমাদের বুড়ো হতে হবে নাকি?কি যাতা বলো।তোমাকে উকিল আমিই দিচ্ছি এটা ফাইনাল।আমি হবো তোমার উকিল বাবা। ছোট উকিল বাবা।নিজের বিয়ে ভালোয় ভালোয় চাইলে আমার কথা মানো।”

ঠাট্টা করে নাকি সিরিয়াস কিছুই বোঝা যায় না।নিজেতো উকিল বাবা ছাড়াই শুভ কাজ সেরেছে।দিব্যি সংসার করছে বউয়ের আঁচলে লেপ্টে।তার বিয়েতেই এত ঝামেলা কেনো?কেনো এতো শর্ত। সামাজিক জীব হিসেবে তারও বিনা ঝটঝামেলায় বিয়ে করার অধিকার নেই?কাব্যর দোষ এসব।এখন তাকে বাবার নজরে দেখার পালা।বয়সে আট নয় বছরের ছোট বাবা।

কাগজে কলমে গত বছরের কাজের হিসেব মিলাতে বসেছে।কলম চালাতে চালাতে এক পর্যায়ে কাব্য বলে,

“বুঝলে আমজাদ কাজ এমন করবে যেনো সারাদিন ঘরে থাকলেও টাকার কমতি না হয়”

আমজাদ এর মন আবার সজাগ হয়েছে।বলছে, “সব কাজ আমার উপর চাপালেতো হবেই। আগে সারাদিন ভবঘুরের মতন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতো।এখন সারাদিন বউয়ের সাথে পড়ে থাকে।তাকে ছাড়া কর্মীদের সামাল দিতে কত কষ্ট হয় সে জানে?সপ্তাহে অন্তত দুই থেকে তিনবার গিয়ে দেখতে হয়।”

কাজ ও আমজাদের মনে মনে কথা বলার উপর ব্রেক কসলো কাব্যর ফোনের আওয়াজ। ঘাড় বেঁকিয়ে একবার নাম্বারটা দেখে নিলো।মুহিত কল দিয়েছে।হয়তো কাজের কোনো কথা বলবে নয়তো তার মায়ের কথা বলে ঘ্যানঘ্যান করবে। দ্বিতীয়টা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও প্রথমটা গুরুত্বপূর্ণ।ভেবে চিন্তে ফোন রিসিভ করে।

অন্যপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে আসে, “কাব্য রেডি থাকো।কবিরকে পরশু দেশে আনা হবে”

চলবে…