#চিত্তবৃত্তি
#পর্ব_১৬
‘ এখানটায় একটি চুমু দিতে পারবে মুসকান? ‘
ইমনের আকুল আবদনে মুসকানের হৃদয় হলো ব্যাকুল। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করে ওঠল তার। নীরস গলাটা ঘনঘন ঢোক গিলে ভিজিয়ে নিল। চোখের পলকও ফেলল ঘনঘন। ইমন অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সমস্ত ক্রোধ যেন হঠাৎই বিলীনতায় রূপ নিয়েছে। দু’চোখে ভর করেছে এক আকুল নেশা। ঐ মাদক চাহনিতে মুসকানের সমস্ত সত্তা কেঁপে ওঠল৷ জড়ীভূত হয়ে বসে রইল সে। ইমন নিজের আবেদনীয় প্রশ্নের উত্তর পেল না। আর না পেল কোনো প্রতিক্রিয়া। সহসা বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মুখে ফুটে ওঠল তাচ্ছিল্য মাখা হাসি। যে হাসি চোখ এড়াল না মুসকানের। বিনিময়ে বুকের খুব গভীরে টনটনে অনুভূতি হলো তার। কী করবে? ইমনের আবদার মেটাবে? কিন্তু মন থেকে একদমই সায় আসছে না। জাগ্রত হচ্ছে না কোনো অনুভূতি। আবার লজ্জাও লাগছে। এমন পরিস্থিতিতে এমন আবদার তীব্র অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে তাকে। মুসকানের সে অস্বস্তি টের পেয়েই ইমন তাচ্ছিল্যতার সঙ্গে হাসল৷ সহসা ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ বাড়ি ফিরতে হবে। ‘
চমকে ওঠল মুসকান৷ বাড়ি! ইমন কী ভুল করে এটা বলল? তার তো আশ্রমে ফেরার কথা। ইমন আবার জেদ করে তাকে চৌধুরী বাড়ি নিয়ে যাবে না তো? আঁতকে ওঠল মুসকান। ভীতগ্রস্থ হয়ে সেও ওঠে দাঁড়াল। কাঁপা কণ্ঠে শুধাল,
‘ বাড়ি মানে? ‘
আচমকা শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ইমন। যেই দৃষ্টি দেখে বুক কেঁপে ওঠল মুসকানের। ইমন দৃষ্টি স্থির রেখেই জবাব দিল,
‘ বাড়ি মানে বাসস্থান। যেখানে আমি সহ আমার পরিবার বাস করে। আর বাড়ি মানে আমি বুঝিয়েছি তুমি যে বাড়িতে বেড়ে ওঠেছ। ‘
মস্তক নত করে অপরাধী মুখে মুসকান বলল,
‘ আমি ওখানে যাব না। ‘
‘ যেতে তোমাকে হবেই। ‘
নিঃশ্বাস আটকে গেল মুসকানের। ক্রুদ্ধ ইমন চৌধুরীর ক্রুদ্ধতার সীমানা আঁচ করে তিরতিরিয়ে ঘামতে লাগল সে৷ দেহ কেঁপে ওঠল মৃদুভাবে। সেই কম্পন তার পাতলা মসৃণ ঠোঁটজোড়াতে দৃশ্যমান হলো। ইমন খেয়াল করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। রাশভারি গলায় বলল,
‘ আমাকে মুক্ত করে চলে যাবার অপশন দিয়েছিলাম। ওটা যখন বেছে নাওনি। এবার দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নাও। ‘
ইমনের কঠিন দৃষ্টিজোড়ায় এক পলক তাকাল মুসকান পরোক্ষণেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ইমন আর সময় অপচয় না করে আচমকা তার হাত ধরল। কাঠ কাঠ স্বরে বলল,
‘ কী ভেবেছিলে? চোরের মতো পালিয়ে যাবে ইমন চৌধুরী এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? এটা ভেবে থাকলে কতটা ভুল ভেবেছ নিশ্চয়ই টের পেয়েছ? চোরের মতো নয় বাঘিনীর মতো পালানোর সুযোগ তোমাকে দেয়া হয়েছে। যদি পারো আমার দৃষ্টিকে সাক্ষী করে চলে যেও। আমার হৃদয়কে নিহত করে বিদায় নিও। আর এসব যদি না পারো সারাজীবনের জন্য আমার হয়েই থেকে যাও। ‘
ভারিক্কি বাক্যগুলো আওড়ে সামনের পথে অগ্রসর হলো ইমন। থমকানো মুসকানের হাতে টান পড়তেই তাকেও যেতে হলো তার সঙ্গে। ইমন এক হাতেই ফ্ল্যাটের মেইন ডোর বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দিল। এরপর সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল নিচে। উদ্দেশ্য নিজ বাড়িতে ফেরা। এরপর বোঝাপড়া হবে বাবার সঙ্গে!
প্রচণ্ড গম্ভীর ভঙ্গিতে বাইক স্টার্ট দিল ইমন। মুসকানের মনে পড়ে না জীবৎকালে কখনো ইমনকে ঠিক এতটা গম্ভীর মুখে দেখেছে কিনা। এর মানে স্পষ্ট হয় যে এ প্রথম ইমন চৌধুরী সাংঘাতিক রেগে গেছে৷ যে রাগ তার পুরো ভাবমূর্তিকেই বদলে দিয়েছে। মুসকানের বুকটা দুরুদুরু করছে। সেই দুরুদুরু বাড়িয়ে দিল ইমনের কঠিন এক বাক্য,
‘ কাঁধে হাত রাখতেও সমস্যা? ‘
চমকাল মুসকান। ঢোক গিলে আলতো করে স্পর্শ করল ইমনের ডান কাঁধ। ইমনের মেজাজ বিগড়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত ধমক দিল,
‘ ভালোভাবে ধরো মুসকান। আর কোনো বিপদ ঘটানোর চিন্তা মাথাতেও এনো না৷ ‘
দু-চোখ গলে দুফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়ল মেয়েটার। কাঁপতে থাকা অধর কামড়ে ধরে বল প্রয়োগ করেই কাঁধ ধরল সে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বাইক টান দিল ইমন। সামনের আয়নায় মুসকানের চোখে জল স্পষ্ট দেখল সে। ফলশ্রুতিতে চোয়ালদ্বয় সর্বোচ্চ শক্ত করে, দম আঁটকে সর্বোচ্চ স্পিডে বাইক টানতে লাগল। চলতি পথে একসময় হঠাৎ ব্রেক কষলে মুসকান ভারসাম্য হারিয়ে ভয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে জাপটে ধরল তাকে৷ মুখ থুবড়ে রাখল পিঠে। ইমন অনুভব করল সবই। কিন্তু তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না৷ বাইক স্বাভাবিক ভাবে চললে মুসকান স্বাভাবিকই থাকে৷ হঠাৎ হঠাৎ ব্রেক কষলে ইমনকে একই ভাবে জাপ্টে ধরে। একবার, দুবার এভাবে অসংখ্যবার। সহসা ইমনের মস্তিষ্কে প্রশ্ন জাগে, মুসকান কি আচমকা ভয়ে এমনটা করছে? নাকি সুযোগ পেয়ে স্বেচ্ছায়ই৷ যদি স্বেচ্ছায় হয়ে থাকে তবে চরম বিরক্ত হবে সে। কারণ তীব্র কষ্টে, দগ্ধীভূত হৃদয়কে শান্তি দিতে সে যে আবদারটি করেছিল। তা পূর্ণ না করে প্রকোট অপমান করেছে মুসকান। যা সে ভুলেনি, ভুলতে পারবেও না। তাই নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছে। এ জীবনে মুসকান স্বেচ্ছায় তাকে ধরা না দিলে সে ধরার আগ্রহ প্রকাশ করবে না। এতে বিয়ে করেও যদি তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক দৈ হি ক সম্পর্কটা না হয় না হবে। তবুও সে বুঝিয়ে দেবে আজকের চাওয়াটায় কোনো কামুকতা ছিল না। ছিল শুধুই প্রগাঢ় ভালোবাসার অনুভূতি।
.
.
মুসকানকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল ইমন। দাদুভাই অশ্রুসিক্ত নয়নে বসার ঘরে সোফার মাঝ বরাবর বসে। বাড়ির প্রত্যেকের মুখটাই থমথমে। ইতিমধ্যে মোজাম্মেল চৌধুরী খবর পেয়েছে। অম্লানের নানু বাড়ি থেকে মুসকানের পালিয়ে যাবার খবর। ইমন মুসকানকে খুঁজে পাওয়ার অপ্রত্যাশিত ঘটনা সম্পর্কেও অবগত হয়েছে। এরপর ঠিক কী ঘটতে চলেছে বা এরপর ঠিক কী কী ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে। ভাবতেই তার প্রেশার বেড়ে গেছে। আপাতত সে ঠিক কোথায় কোন অবস্থানে আছে কেউ জানে না।
বাড়ির সবাই আজ শুধু নীরব দর্শক। দাদুভাইয়ের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে মুসকান। দাদুভাই পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। অশ্রুসিক্ত চোখ দু’টো মুছলেন সন্তর্পণে। এরপর মলিন মুখে মুসকানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ তোমার ঘরে যাও। আরাম করো। ‘
এ কথা বলেই একটু দূরে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ইয়াশফার দিকে তাকালেন। বললেন,
‘ ইয়াশফা ওর ঘরে কিছু খাবার পাঠাই দেও। ‘
ইয়াশফা মাথা কাৎ করল। মুসকান ক্রন্দনরত মুখে তাকাল। অপরাধ সূচক চোখে। দাদুভাই ম্লান হাসল। মুসকান কিছু বলতে উদ্যত হলে সে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ভুল অবুঝ আর ছোটোদের দ্বারাই হয়। ওদের ভুল হয় বলেই ওরা অবুঝ, ছোটো৷ আর আমরা ওদের ভুলগুলো শুধরে দিই বলেই আমরা বড়ো, বুঝদার। ‘
দাদুভাইয়ের ভালোবাসা, উদারতায় শিউরে ওঠল মুসকান। এই মানুষটার ভালোবাসাকে কীভাবে তুচ্ছ করতে পারল সে? ভীষণ লজ্জিত হয়ে দৃষ্টি ফিরাতে নিয়ে আরো একবার কেঁপে ওঠল৷ পাশেই পাথরের ন্যায় শক্ত শরীরে দাঁড়ানো ইমনকে দেখে। যার চোখ দু’টো ভয়াবহ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চোয়ালদ্বয় প্রচণ্ড শক্ত। কপালে ছড়ানো এলোমেলো চুল, পরনের শার্টের করুণ অবস্থা তার বুককে মারাত্মক কাঁপিয়ে তুলল। বুকের গহিন থেকে উপচে এলো কান্নার দমক। মুসকানের অপরাধী চোখ, বিধ্বস্ত মুখ দেখে সরে পড়ল ইমন। বাড়ির সকলেই সরে গেল তার সামনে থেকে৷ একমাত্র দাদুভাই ছাড়া। সে বললেন,
‘ গিন্নি, ঘরে যাও। ‘
রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল মুসকান। মাথা নাড়িয়ে পা বাড়াল পরিচিত সে ঘরটায়। যে ঘরে দীর্ঘ বছর কাটিয়েছে সে৷
.
.
চলবে…
#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৭
জ্যোৎস্না রাত৷ বেলকনির কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে ইমন৷ বাড়ির সবচেয়ে বিচক্ষণ, রুচিশীল ছেলের এই রূপ চোখে বাজছে খুব৷ যতক্ষণ সময় স্কুলে থাকে ঠিক ততক্ষণই চেনা পরিচিত ইমন চৌধুরীর দেখা মেলে। বাকি সময়টুকু চেনা ইমনের মাঝে অচেনা ইমনের বিধ্বস্ত আবির্ভাব লক্ষ করা যায়। ইদানীং সে রাত করে বাড়ি ফেরে। পরিবারের সঙ্গে এক টেবিলে খেতে বসে না। নিদ্রাহীন রাত, আহার বিহীন কত বেলা কাটিয়ে দেয় অনায়াসে। কেউ খাবার নিয়ে জোর করলে চোখ গরম করে নিয়ন্ত্রণ করে। সিগারেটের প্রতি দারুণ আসক্ত হয়ে পড়েছে সে। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকে সিগারেট। মুসকানকে চৌধুরী বাড়িতে ফিরিয়ে আনার এক মাস পূর্ণ হয়েছে। দাদু ভাইয়ের আদেশে ইমন, মুসকানের বিয়ের কথা ওঠেছিল। কিন্তু প্রবল আত্মসম্মান সম্পন্ন মুসকান সে কথা থামিয়ে দিয়েছে। সে জানিয়েছে এই বিয়েতে তার মত নেই৷ এতকিছুর পরও মুসকান এমন একটি কথা বলতে পারে। ধারণার বাইরে ছিল ইমনের। মেয়েটার থেকে একের পর এক আঘাত পেতে পেতে যেন সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে। মুসকান আত্মমর্যাদার চেয়েও ধারালো ইমনের আত্মমর্যাদা। তাই তো মুসকানের সিদ্ধান্ত জানার পর নিজেকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। তবু ঐদিনের পর আর ভালোবাসার আকুতি জানিয়ে সামনে দাঁড়ায়নি। মুসকান যখন বিয়েতে পুরোপুরি অসম্মতি জানালো। আর বলল, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিলে সে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তখন দাদু ভাই তাকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘ গিন্নি তুমি ঠিক কোন কারণে এই সিদ্ধান্তে অটল রইছ বলবা? ‘
অকপটে জবাব দিয়েছিল মুসকান,
‘ আমি তোমার নাতির যোগ্য নই দাদু ভাই। তার স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আমার স্ট্যান্ডার্ড যায় না। সে আমার চেয়ে ব্যাটার কাউকে ডিজার্ভ করে। ‘
মুসকানের জবাব শুনে দাদু ভাই বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল,
‘ স্ট্যান্ডার্স বলতে তুমি কী বুঝাইতেছ গিন্নি? ‘
বাঁকা হেসে মুসকান বলল,
‘ আমার আর তার মাঝে স্ট্যান্ডার্ড বলতে তো এটুকুই বোঝানো হয়েছে, সে এ বাড়ির মালিক আর আমি চাকরানি। তাহলে এ সম্পর্ক কীভাবে সম্ভব দাদু ভাই? আমি এতটা লোভি নই, আমি এতটা লোভি হতে চাই না। তুমি উনাকে বোঝাও প্লিজ। তুমি বুঝালে ঠিক বুঝবে। ‘
এ কথাগুলো বলেই দাদু ভাইয়ের রুম থেকে প্রস্থান করে মুসকান। তারপর থেকেই ইমনের মাঝে শুরু হয় আমূল পরিবর্তন। যে পরিবর্তন দেখে দাদু ভাই খুবই হতাশ। এ হতাশা চাপে ইমনের বাবার মনেও। সে অসহায় ভাবে তার বাবার কাছে আকুতি জানায় ছেলেকে সামলাতে। একমাত্র তার কথাই শুনবে ইমন৷ দাদু ভাইয়েরও এটাই বিশ্বাস ছিল। ইমন তার বাধ্য। কিন্তু সে বিশ্বাস ভেঙে যায় যখন ইমন তাকেও তোয়াক্কা না করে৷ দিন দিন পরিস্থিতি জটিল দিকে মোড় নিতে থাকে। মুসকানের সিদ্ধান্তে যতটা না আত্মসম্মান জড়িত তার চেয়েও বেশি জড়িত তীব্র অভিমান। এই অভিমান অর্থের প্রাচুর্যে ডুবে গিয়ে মানুষকে মানুষ না মনে করা চৌধুরী পরিবারের সদস্যদের ওপর। যে অভিমান ভাঙাতে পারবে একমাত্র দাদু ভাই। তাই কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নেয়। যে সিদ্ধান্ত আরো বহু বছর আগেই নেয়া উচিত ছিল। তার সেই সিদ্ধান্তের প্রতাপে আকস্মিক চৌধুরী বাড়ির সকল সদস্যই মুসকানকে বোঝাতে শুরু করে বিয়েতে রাজি হতে। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় মুসকান৷ হঠাৎ কী হলো সবার? শুধুমাত্র ইমনের ছন্নছাড়া জীবনের জন্যই সবাই এতটা মরিয়া হয়ে ওঠেছে? সবাই এতটা ভালোবাসে ইমনকে? কই আগে কখনো এই ভালোবাসা চোখে পড়েনি তো!গোটা চৌধুরী পরিবার মুসকানকে রাজি করাতে ব্যস্ত৷ আর ইমন ব্যস্ত নিজেকে শত ভাবে আঘাত করায়। আঘাতে আঘাতে সেই আঘাত খুঁজতে ব্যস্ত সে। যে আঘাত ভালোবাসার মানুষের থেকে প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা শুষে নিতে সক্ষম হবে। মৃত্যু ছাড়া কীভাবে সম্ভব এই যন্ত্রণা নিঃশেষ করা?
নিদ্রাহীন আরো একটি রাত কাটল ইমনের৷ বেলকনি থেকে রুমে এসে ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে। দীর্ঘক্ষণ শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হতেই দেখল কফি হাতে মুসকান দাঁড়িয়ে। এক পলক দেখেই গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চুল মুছতে মুছতে চলে গেল বেলকনিতে। এতকিছু হওয়ার পরও মুসকানের মধ্যে ভাবান্তর নেই৷ সে পূর্বের ন্যায় এ বাড়িতে কাজ করছে। সেই খাতিরেই ইমনের কাজও করে দেয়। ইমন নিষেধ করেছিল। শুনেনি নিষেধ। কারণ, এ বাড়িতে তার পরিচয় কাজের মেয়ে৷ তাই কাজের বিনিময়েই এ বাড়িতে সে থাকতে চায়। বিনে পয়সায় আজকাল কেউ কাউকে দেখে না৷ আর সে চায় না তাকে কেউ বিনে পয়সায় দেখুক। তার বক্তব্য শুনে কিছু বলতে পারেনি ইমন৷ নিরব দর্শকের মতো শুধু দেখে যাচ্ছে সব। কফি রেখে রুম ঝাড় দিয়ে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল মুসকান৷ তক্ষুনি রুমে এলো ইমন। ত্বরিত হেঁটে দরজার কাছাকাছি ছুটে গেল। ধীর পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে মুসকান। আড়ালে দাঁড়িয়ে সে যাওয়া দেখে আরো এক দফা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। এরপর গিয়ে কফির মগ হাতে নিল। আফসোসের সঙ্গে বিড়বিড় করে বলল,
‘ এর সঙ্গে যদি একটু বিষ মেশানো থাকত। ‘
ফরমাল ড্রেসআপে পরিধান করে নিচে এলো ইমন। মেজো কাকি বলল,
‘ ইমন বসো, খেতে দিচ্ছি। ‘
‘ সময় নেই। বাইরে খেয়ে নিব। ‘
হাত ঘড়ি দেখতে দেখতে অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে কথাটা বলল ইমন। রান্না ঘর থেকে আসার পথে শুনতে পেল মুসকান৷ থমথমে মুখে তাকাল ইমনের দিকে। ইমন সে দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গেল। মেজো কাকি তখন বিরক্ত মুখে মুসকানকে বলল,
‘ তোর এত দম্ভ কিসের মুসকান? এখনো তুই জেদ ধরে থাকবি? আমরা যে তোকে এ বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিয়েছি এই তো তোর সৌভাগ্য। আর তুই সে সৌভাগ্যকে পায়ে ঠেলছিস? ‘
‘ আমার কপালে সৌভাগ্য সয় না কাকি। ‘
মুখ বাঁকিয়ে মেজো কাকি বলল,
‘ হ্যাঁ কু’ত্তার পেটে ঘি হজম হবোই না। ‘
মুসকান সরে গেল। বাড়ির সবাই যে যার মতো সকালের নাস্তা সেরে ফেলল। দাদু ভাই জানতে পারল ইমন না খেয়ে বেরিয়ে গেছে। মুসকান এখনো সকালের খাবার খায়নি। আর নেয়া যায় না এসব। এবার কিছু একটা করতেই হবে। ভেবেই মেজো ছেলেকে কল করলেন তিনি৷ বললেন,
‘ তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। ‘
_______
স্কুল ছুটির পর ইমন বাড়ি ফিরতেই দাদু ভাই জানান সামনের বৃহস্পতিবার তার বোনের বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে৷ এক রাত থেকে পরেরদিনই এসে পড়বে। ইমন প্রথমে রাজি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন শুনতে পারে মুসকানকেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন কড়া গলায় না করে দেয় সে যাবে না। দাদু ভাইও কড়া গলায় হুকুম করে যেতেই হবে। ইমন তবু নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। তাই বাধ্য হয়ে দাদু ভাই তার উদ্দেশ্যের কথা জানিয়ে দেয়। সব শুনে ইমন বলে,
‘ এই কাজটা আরো আগে করা উচিত ছিল দাদুভাই। এতে এই তিক্ততা গুলো তৈরি হতো না। ‘
দাদু ভাই বলেন,
‘ দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে ক’জন রুখে দাঁড়াতে পারে? ‘
দুপুরবেলা ছাদে কাপড় নেড়েছিল মুসকান। সেগুলো আনতে গেল বিকেলবেলা। অমনি মুখোমুখি হলো ইমনের। ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে সে। এতক্ষণ ধীর গতিতে সিগারেট ফুঁকলেও
মুসকানকে দেখে তার গতি বেড়ে গেল। এমনিতেই ইদানীং ইমনের মুখোমুখি হতে অস্বস্তি লাগে। দৃঢ় চোখজোড়া কাঁপন ধরিয়ে দেয় বুকে। এতদিন ইয়াশফার মুখে শোনা ঘটনা প্রত্যক্ষ দর্শনে তীব্র অস্বস্তি, ভয়, অবিশ্বাস একসঙ্গে বুকে ঘুরপাক খেতে লাগল। ত্বরিত কাপড় তুলতে গিয়ে কয়েকটা ফেলে দিল নিচে। সেগুলো পুনরায় তুলে চলে যেতে উদ্যত হলে ওড়নায় পা প্যাঁচিয়ে পরে গেল সে। মুহুর্তেই সিগারেট ফেলে ছুটে এলো ইমন। দু’হাতে মুসকানকে ধরে তুলে শক্ত একটা ধমক দিল,
‘ সমস্যা কী? বাঘ তাড়া করেছে? খেয়ে ফেলবে তোমায়? ‘
এতক্ষণের ভয় এবার কান্না হয়ে ঝড়তে শুরু করল। ইমন অধর কামড়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে অসহ্য কণ্ঠে বলল,
‘ আর কত জ্বালাবে আর কত? ‘
মুসকান ফুপিয়ে ওঠল। থেমে গেল ইমন। ছেড়ে দিল মুসকানকে। ওঠে চলে গেল ছাদের ওপাশে। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছেড়ে রাগ দমন করার চেষ্টা করল। মুসকান চোখের পানি মুছে কাপড় গুছিয়ে ওঠে দাঁড়াল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে গেল নিচে। সে চলে যেতেই চিলেকোঠার ঘরের দেয়ালে সজোরে কয়েকটা ঘুষি দিল ইমন। আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল,
‘ কেন বুঝে না ও! কেন! ‘
রহস্যময় এ পৃথিবীতে বিচিত্র মানুষের বসবাস। সেই বিচিত্র মানুষের জীবনের বিচিত্র গল্পের ভেতর থাকে অগাধ রহস্য। যে রহস্য ভেদ হলে কেউ হাসে কেউ কাঁদে। গল্পের নায়িকা মুসকানের জীবনেও রয়েছে অগাধ রহস্য। জীবনের সেই রহস্য উদঘাটন হলে সে কী হাসবে? যদি সে হাসে কাঁদবে কে?
চলবে…
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।