#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৫
আমাদের আশপাশে কিছু অসাধু মানুষ আছে৷ যারা সকলের চোখে নিজেকে সাধু রূপে দেখতে চায়। কিন্তু সে চাওয়া কখনো পূর্ণ হয় না। শুধুমাত্র অন্তরে অসততা পুষে রাখে বলে। ইভান সেই দলেরই একজন সদস্য। যে কিনা শিশু বয়স থেকে অসততা দিয়ে সকলের ভালোবাসা জয় করতে চেয়েছে। ভালোবাসা হলো সততার লড়াই। যাকে জয় করতে হয় সততা নামক অস্ত্র দিয়ে৷ যা সম্পর্কে ইভান শিশু বয়স থেকেই ভীষণ অজ্ঞ। নিজের চাচাত ভাই ইমনের সঙ্গে শিশুকাল থেকে ভালোবাসা নিয়ে দ্বন্দ্ব তার৷ ইমনের মা মারা যাওয়ার পর পরিবারের সবাই ইমনকে বিশেষ যত্ন নিতে শুরু করে। ইভান, ইমন সমবয়সী। তবু সবদিক থেকেই অধিক গুরুত্ব পেত শুধু ইমন৷ ইভান চাইত সবাই তাকে বেশি ভালোবাসুক। বেশি গুরুত্ব দিক। কিন্তু সে যখন বুঝতে পারে সবাই তার চেয়ে ইমনকে বেশি ভালোবাসে৷ তখন থেকেই ভেতরে প্রতিহিংসা সৃষ্টি হয়। সকলের মনোযোগ যখন ইমনের দিকে থাকে সে তখন চেষ্টা করে সেই মনোযোগ নিজের দিকে আনতে। অনেক সময় দেখা যেত সে নিজেই নিজেকে আঘাত করে বসত৷ যাতে ইমনকে ছেড়ে সকলে তার প্রতি মনোগ্রাহী হয়৷ হতোই তাই৷ কিন্তু সেটা দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। যা তার প্রতিহিংসাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিত৷ অবুঝ সে বয়সে ইভানের ধারণা ছিল ইমনের মা নেই৷ তাই সবাই তাকে এত ভালোবাসে, গুরুত্ব দেয়। এমন ধারণার কারণে একসময় সেও চাইত তার মা মরে যাক। মা হারা হোক সে। এরপর সকলে তাকেও ইমনের মতো ভালোবাসবে, গুরুত্ব দেবে। তার অপরিণত বুদ্ধি গুলো পরিণত হয় এক সময়৷ পরিণত হয় ভেতরের প্রতিহিংসাও। ইমন বড়ো হতে হতে তার দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়ে ভালোবাসা, সম্মান অর্জন করতে থাকে। আর ইভান প্রতিহিংসার আগুন বুকে পুষে উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করে সকলের থেকে শুধুই ঘৃণা অর্জন করে। ইভানের মা উচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধমতী মহিলা। তাই এক পর্যায়ে ছেলের মানসিক অস্বাভাবিকতা বুঝতে পেরে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। ইমনের প্রতি তার হিংসাত্মক মনোভাব, মুসকানের প্রতি অমার্জিত আচরণ সমস্তই খেয়াল করেছিলেন তিনি৷ এই পরিবারে থেকে দিনের পর দিন ইমনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ইভানের ভবিষ্যত অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে৷ মা হয়ে সন্তানের এতবড় ক্ষতি সে মেনে নিতে পারেনি। আজ এতগুলো বছর দেশের বাইরে থাকার পর দূর থেকে যতটুকু বুঝেছিলেন এতে চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু দেশে ফেরার পর তার ছেলেটা যে আবারো সেই পুরোনো ইভানে পরিণত হবে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি ইভানের জন্মদাত্রী।
সেদিন ইমনের অনুরোধে থেকে যায় মুসকান। দাদুভাই বিনা দ্বিধায় অনুমতি দেন৷ দিহান, সায়রী আছে বলেই স্বস্তি সহকারে অনুমতি দিতে পারেন তিনি। এরপর একটা একটা করে চৌদ্দ দিন কেটে যায়। দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করে ইমন৷ তিনবেলা মুসকানের হাতে রান্না খাবার খায়। এই চৌদ্দ দিনে মুসকানের সঙ্গে একাকী, নিভৃতে সময় কাটায়নি ইমন। সে শুধু চেয়েছিল মানুষটা চোখের সামনে থাকুক৷ থেকেছেও। রাত ছাড়া যখনি ইমন ডেকেছে তখনি সামনে এসে চুপচাপ বসেছে মুসকান। যতক্ষন না অনুমতি পেয়েছে ততক্ষণ সামনে থেকে চলে যায়নি। তাদের এই শান্ত, নরম প্রণয়ে অশান্তি হয়েছে দিহানের বুকে। বেচারা চৌদ্দ রাত ধরে বউ ছাড়া পড়ুয়া বন্ধুর ঘরে ঘুমুচ্ছে। দিহানের মুখের দিকে তাকাতে পারে না মুসকান৷ লজ্জায় সামনে যাওয়া থেকেও বিরত থাকে। ইমনের পাগলামির জন্য বউ পাগল দিহান আজ বউ ছাড়া! সায়রীর মনোভাব অবশ্য বোঝা যায় না৷ সে সকলের সম্মুখে ঠিকই দিহানকে ভেঙচি কাটে, মজা নেয়। কে জানে দৃষ্টির অগোচরে সেও হয়তো দিহানের মতোই কেঁদেকুটে একাকার।
একদিকে ইমন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অন্যদিকে চৌধুরী বাড়ির সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিল তার আর মুসকানের বিয়ের। যা সম্পর্কে পুরোপুরি অজানা রয়েছে মুসকান। সে শুধু জানত পরীক্ষার পরপরই বিয়ে হবে তাদের৷ ইমন এবং পরিবারের সকলে মিলে যে তার জন্য সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করছে টের পায়নি
এদিকে নিজের কুবুদ্ধি কাজে লাগানোর পূর্বেই ইমন, মুসকান এক হয়ে যাচ্ছে দেখে মাথা খারাপ হয়ে যায় ইভানের। মুসকানের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল, এখনো আছে। ভবিষ্যতে এই দুর্বলতা থেকেই যাবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ কারণ মুসকান ইমনের বউ হচ্ছে। মুসকান তারও কাজিন। ইমনেরও কাজিন৷ বউ যদি হবারি হয় তার না হয়ে ইমনের কেন হবে? ওদের মধ্যে ভালোবাসা আছে বলে? কেন থাকবে ভালোবাসা? ইমনের আগে সে মুসকানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। বিদেশ যাওয়ার আগে ইমনের হাতের সেই থাপ্পড়টা ভুলে যায়নি৷ যে ভুলে সে শাস্তি পেয়েছে সে একই ভুল ইমনও করেছে। তাহলে শাস্তি শুধু সে একা পেল কেন? এ বাড়ির সকলের ভালোবাসা শুধু ইমনের জন্য। যা দাঁতে দাঁত চেপে হজম করেছিল সে। কিন্তু আজ যেন ধৈর্যহারা হয়ে গেল। তার কেবল মনে হতে লাগল ইমন সব সময়ের মতো মুসকানের ভালোবাসাও ছিনিয়ে নিল তার থেকে। নিজের সঙ্গে নিজে যুক্তি, তর্ক করে যুক্তি, অযুক্তি মিলিয়ে ইভান সিদ্ধান্ত নিল, মুসকানকে সে তার মনের কথা জানাবে৷ এই সময়ে এসে এমন একটি সিদ্ধান্ত কতটুকু যুক্তিপূর্ণ বা গ্রহণযোগ্য সে হিসেব করল না ইভান৷ ত্যাড়ামি করে মুসকানকে কল করল নিজের মনে কথা জানাতে। পুঁথিগত শিক্ষা অর্জন করলেও জ্ঞানহীন ইভান নিজ মনেও স্বীকার করল না মুসকানের প্রতি তার চাহিদাটা দৈহিক। যার সঙ্গে মনের কোনো সংযোগ নেই। একটা মেয়ে কখনোই এমন পুরুষকে মন দিতে আগ্রহী হয় না। যেখানে ইমন চৌধুরী দফায় দফায় তাকে অনুভব করাচ্ছে সে তার চিত্তের প্রবৃত্তি। সেখানে ইভানের ঠুনকো অনুভূতি যা শুধুই দৈহিক এবং ইমনকে পরাস্ত করতে সৃষ্টি। তার প্রতি কীভাবে আগ্রহী হবে?
__
ইমনের পরীক্ষা শেষ। গোছগাছ শুরু হয়েছে রাত থেকেই। প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে শাওয়ারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল মুসকান৷ এমন সময় সায়রী ঘরে এলো কয়েকটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। মুসকানের হাতে সবগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ম্যাডাম আপনাকে শাড়ি পরতে হবে। স্যারের অর্ডার।’
মুসকান শীতল দৃষ্টিতে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘এই গরমে শাড়ি!’
কণ্ঠ ঈষৎ বিস্ময়ে ভরপুর। সায়রী ওর কাঁধ চেপে ধরে বলল,
‘কী আর করবে, পুরুষ মানুষের মন। কখন কী করে, কী চায় বোঝা দায়।’
কিয়ৎক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে বিছানায় বসল মুসকান। দেখতে পেল, কালো একটি রঙের শাড়ির সঙ্গে প্রয়োজনীয় সবকিছুই রয়েছে। এত আশা নিয়ে পাঠিয়েছে না পরলে কেমন দেখায়? দ্বিমত না করে ঝটপট গোসল সেরে শাড়ি পরে নিল। সাজগোজের ইচ্ছে একেবারেই ছিল না। সায়রীর অনুরোধে চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক আর হালকা জুয়েলারি পরল। সায়রী ফটাফট নিজের ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলল কৃষ্ণবর্ণ শাড়ি পরিহিত শ্যামলিমা রমণীকে। প্রথমে কথা ছিল ইমন আর মুসকান চলে যাবে। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলো। দিহান আর সায়রীও যাবে। দাদুভাই ফোন করে বলেছেন ওদের যাওয়া বাধ্যতামূলক। তাই ওরা দু’জন গোছগাছ করে তৈরি হচ্ছে। এদিকে ইমনের কফির প্যারা ওঠেছে। রুম থেকে চ্যাঁচিয়ে ডাকছে,
‘মুসকান কফি নিয়ে এসো।’
শাড়ি পরে সাজগোজ করে এমনিতেই লজ্জায় নেতিয়ে ছিল মুসকান৷ ইমনের ডাক পেয়ে হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করল৷ কৃষ্ণবর্ণ শাড়িটা তার উজ্জ্বল শ্যামলা ত্বকে দারুণ মানিয়েছে। ইমনের পছন্দের রঙ বলতেই সাদা, কালো। তাই প্রেয়সীর জন্য শাড়ি নির্বাচনে কালো রঙকেই প্রাধান্য দিয়েছে। সেই রঙে যে প্রেয়সী তার স্বর্গের অপ্সরা রূপেই ধরা দেবে৷ টের পেয়েছিল আগেই৷ তাই ছল, কৌশল করে কাছে টানার চেষ্টা করল ইমন। মুসকানের আর কী করার? মানুষটা কফি চাইছে আর সে দেবে না? শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে মুহুর্তেই কফি বানাতে রান্নাঘরে চলে গেল। ইমন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কখন মুসকান আসবে। আর সে চোখভরে দেখবে। পাক্কা গিন্নির মতো সামনে এলো মুসকান। কফির মগ বাড়িয়ে দিল। ইমন তার কাজল কালো চোখে তাকাল প্রগাঢ় চাহনিতে। হাত বাড়িয়ে কফি নিতে নিতে বলল,
‘ঘেমে করুণ অবস্থা হয়ে গেছে দেখছি! ফ্যানের নিচে বসো গিয়ে৷’
কথামতো বাইরে যেতে উদ্যত হয় মুসকান। একহাতে কফি নিয়ে অন্যহাতে মুসকানের হাত টেনে বাঁধা দেয় ইমন৷ শান্ত, গভীর কণ্ঠে বলে,
‘এ ঘরেও ফ্যান চলছে।’
হকচকিয়ে তাকায় মুসকান। ইমনের সুগভীর চোখজোড়ার কবলে পড়ে হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। ভুলে যায় ঢোক চিপে শুকিয়ে ওঠা গলাটা ভেজাতে। অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয় ঠাঁই। ইমন বুঝতে পারে তার অনুভূতি। গাঢ় চোখে আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখে একবার৷ সহসা চোখে ইশারা করে কিছু। মুসকান বুঝতে পেরে দম আঁটকে দাঁড়িয়েই রয়। একটুখানি নড়ার সাহস বা শক্তি কোনোটাই পায় না৷ তার শোচনীয় এই অবস্থা দেখে আনমনে হাসে ইমন। ধরে রাখা হাতটায় টান দেয় নরম করে। মুসকানের চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে যায়৷ পলক ফেলতে ভুলে যাওয়া সে প্রিয়তমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে হাসফাস করতে থাকে৷ পাতলা মসৃণ ঠোঁট দু’টি কেঁপে ওঠে তির তির করে। সে দৃশ্য দেখে ইমনের ঠোঁট দু’টো বাঁকা হাসে। ধরে রাখা প্রেয়সীর বাহু ছেড়ে আচমকা পেঁচিয়ে ধরে কোমর। পেশিবহুল শক্ত হাতের নরম বাঁধনে আটকা পড়ে চোখ দু’টি খিঁচে বদ্ধ করে নেয় মুসকান। তার বদ্ধ চোখের পাতাজোড়ার কম্পমান দৃশ্য দেখে ইমনের অনুভূতি গুলো টগবগিয়ে ফুটতে শুরু করে। অবাধ্য হয় বেঁধে রাখা ইচ্ছেরা। এক হাতেই ধীরে ধীরে শূন্যে তুলে নেয় প্রিয়তমাকে। কৌশলে হেঁটে চলে যায় বিছানার সাইট টেবিলের সামনে। বা’হাতে ধরে রাখা কফির মগ আলগোছে টেবিলে রেখে হাতটা আলতো ছুঁয়ে দেয় মুসকানের নরম গালে। নিমেষেই চোখ খুলে তাকায় মুসকান। ধীরে ধীরে বিস্ময় চাপে তার দৃষ্টিতে। ছিল দরজার কাছটায় চলে এসেছে রুমের ভেতরে কীভাবে এসেছে? প্রশ্নের উত্তর মিলতেই গা শিউরে ওঠে। তার চোখে বিস্ময় দেখে আবারো চোখে ইশারা করে ইমন৷ কেন জানি তীব্র কাঁপুনি জাগে দেহে৷ সীমাহীন লজ্জায় আরক্ত হয় গাল দু’টো। ইমন হাসে তার লজ্জা দেখে। প্রেমিকাকে কারণে, অকারণে লজ্জা পেতে দেখলে প্রেমিকরা হাসে। প্রাণখোলা হাসি। এই প্রাণ খোলা হাসি যে হাসে সে যেমন ভাগ্যবান। এ হাসির পেছনে কারণ যে হয় সেও খুব ভাগ্যবতী৷ তার হাসি দেখে ঢোক গিলল মুসকান। দৃষ্টি নত করে বারকয়েক বড়ো বড়ো শ্বাস নিল। খেয়াল করে মুখ নিচু করল ইমন৷ সহসা মস্তক উপরে তুলতেই চোখে চোখ পড়ল দু’জনার। ইমন সন্তর্পণে ওর কপালে কপাল ঠেকাল। নাকে নাক ঠেকতেই মুখ ফেরাতে চাইল মুসকান৷ কোমর প্যাঁচানো হাতটা দৃঢ় করল ইমন। অন্যহাতটি উঁচিয়ে আলতোভাবে স্পর্শ করল কাঁপতে থাকা প্রেয়সীর অধর। ফের হৃৎস্পন্দন থমকে গেল মুসকানের। ইমনের ধারাল দৃষ্টির কবলে পড়ে যেন খু ন হয়ে গেল সে। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রেমিকের দৃষ্টিতে শতসহস্রবার খু ন হতে থাকা প্রেমিকাটিকে তখন ফিসফিস করে প্রেমিক বলল,
‘চোখের ইশারায় যদি হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। মন তো এই ঠোঁটে প্রেম ছোঁয়াতে চায়।’
চলবে.।
#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৬ ( খণ্ডিত অংশ)
প্রণয়ের উষ্ণ ছোঁয়ায়, আর্দ্র বাক্যে প্রচণ্ড আবেগে বিগলিত হয় মুসকান। হৃদয় জুড়ে শিহরণ জাগে। একচ্ছত্র লজ্জায় নুইয়ে পড়ে দেহ শ্রী। প্রেয়সসীকে প্রগাঢ় অনুভূতিময় বাক্য বলে আবেগঘন হয়ে রয় ইমন নিজেও। লজ্জাবনত মুখশ্রী দেখে হৃৎপিণ্ড কাঁপতে থাকে। একে অপরের অতি নিকটে দাঁড়িয়ে সংগোপনে অনুভব করে গভীর প্রণয়ানুভূতিকে। কিছু স্পর্শ হয় উন্মাদনার, কিছু বাক্য হয় আলোড়নের। আর কেউ একজন হয় সর্ব সুখের। দু’টি হৃদয় যখন একে অপরের মাঝে সুখ খুঁজে পায়। দুঃখের কি সাধ্য থাকে তাদের আলাদা করার?
দরজা খোলাই ছিল। ওরা একে অপরের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। মুসকানের কোমল ঠোঁটজোড়া থেকে তর্জনী সরিয়েছে ইমন। তৃষ্ণার্ত কাকের মতো এগিয়েছে নিজের পুরুষালি ঠোঁটজোড়া। ঠিক সেই মুহুর্তেই আচমকা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সায়রী। মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। দু’হাতে চোখজোড়া ঢেকে মুখ ঘুরিয়ে চ্যাঁচিয়ে ওঠেছে,
‘সরি, সরি দোস্ত!’
আকস্মিক সায়রীর আগমনে মুসকানকে বাহু বন্ধনী থেকে মুক্ত করে তড়াক করে সরে দাঁড়ায় ইমন। চোখ দুটো কিঞ্চিৎ বড়ো বড়ো করে তাকায় দরজার বাইরে সায়রীর দিকে। এরপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে তীব্র লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠা মুখশ্রী, আর আকস্মিক ভয় পেয়ে কম্পমান নারীদেহের পানে। ধাতস্থ হতে কিয়ৎক্ষণ সময় লাগে ওদের তিনজনেরই। এরপর সায়রী বিস্মিত চোখে ইমনের দিকে তাকায়। রয়েসয়ে ঢোক গিলে হাতে থাকা ফোনটা এগিয়ে ধরে বলে,
‘মুসকানের ফোন বাজছিল, অনেক্ক্ষণ ধরেই। তাই নিয়ে এলাম। তোরা দরজা বন্ধ… ‘
সহসা কেশে ওঠল ইমন। থেমে গেল সায়রী। ইমনের দিকে আড়চোখে তাকাল মুসকান। মুহুর্তেই ইমনও তাকাল। ইশারা করল সায়রীর থেকে ফোনটা নিতে। জরুরি কল এসেছে বোধহয়। সন্তর্পণে এক ঢোক গিলে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল মুসকান। লজ্জায় তাকাতে পারল না সায়রীর দিকে। সায়রীও আর ওর সামনে থেকে লজ্জা দিতে চাইল না। ত্বরিত ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। বলে গেল,
‘আমরা রেডি৷ বেরুচ্ছি.. তোরা রেডি থাকলে চলে আসিস।’
_________
ঘন্টা হতে চলল ইভান কল করে যাচ্ছে মুসকানকে। অথচ ধরার নাম নেই। রাগে, ক্ষোভে নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ছে ইভান। এমন সময় তার দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিল মেজো কাকি। বলল,
‘ইভান আসব?’
উত্তপ্ত মেজাজে উত্তর দিল ইভান,
‘আসো।’
সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো মেজো কাকি। বসল ইভানের পাশে। ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছে ইভান৷ তার এই উত্তপ্ত আচরণের কারণ জানে সে। ইভানের বুকের ভেতর ঠিক কোন আগুন জ্বলছে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। তাই তো সেই আগুনে ঘি ঢালতে চলে এলো সে। আর পু ড়িয়ে ছাঁই করার পায়তারা করল সতীনের মেয়েকে। মুসকানকে সে কোনো কালেই সহ্য করতে পারেনি। যেদিন থেকে জেনেছে মুসকান তার স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। সেদিন থেকে অসহ্যের মাত্রাটা আকাশ ছুঁয়েছে। বুকের ভেতর যে জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে তা কেবল থামাতে পারে ছোটো জায়ের ছেলে ইভান৷ তাই ইভানের মাথায় হাত, পিঠে হাত বুলিয়ে কিছু সময়ের জন্য রাগ নামানোর চেষ্টা করে বলল,
‘আজকে ওরা আসছে৷ কাল গায়ে হলুদ পরদিন বিয়ে।’
সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল ইভান। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,
‘তুমি কি এসব বলতেই এসেছ?’
ওঠে দাঁড়াল মেজো কাকি। ইভানকে আরো বেশি উত্তেজিত করতে বলল,
‘আমি এসেছি তোমাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিতে।’
চ্যাঁচিয়ে ওঠল ইভান৷ বলল,
‘কী পরামর্শ দেবে? শা”লির মেয়ে ফোনই ধরছে না। ফোন না ধরলে প্রভাবিত করব কীভাবে?’
ইভানের ক্রোধের তোপে পড়ে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল সে। দরজার দিকে তাকাল ভীত চোখে। এই ছেলের উদ্ধত আচরণের জন্য সে আবার ধরা না পড়ে যায়। যেদিন থেকে শুনেছে মুসকান ইমনকে বিয়ে করতে রাজি। তাদের মনোমালিন্য সব দূর হয়ে গেছে। সেদিন থেকেই প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে সে। তাছাড়া ইমনের বাসায় মুসকান দু সপ্তাহ ধরে থাকছে। এ নিয়ে ইভানের মাঝে কম ক্রোধ দেখতে পায়নি। ইমনকে ইভান হিংসে করে ছোট্টবেলা থেকে। জানত সে৷ মুসকানকেও খুব একটা পছন্দ করে না। এ কথাও জানত৷ কিন্তু এর বাইরেও যে কিছু আছে তা টের পেয়েছে এই চৌদ্দ দিনে। তাই ইভানের মাথায় কুমন্ত্রণা ঢুকায়৷ মুসকানকে ভয় দেখিয়ে বা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে যেভাবেই হোক এই বিয়ে থেকে সরে যেতে বলতে বলে। ইভানও সেই মোতাবেক মুসকানকে লাগাতার ফোন করে যাচ্ছে। অথচ মেয়েটা ফোন ধরছেই না৷ মেজো কাকিও ভীষণ চিন্তায় পড়ল। ইভান যদি মুসকানকে আটকাতে না পারে তাহলে ইমন, মুসকানের বিয়েটা হয়ে যাবে৷ এ বাড়ির মেয়ের পরিচয় পেল এখন বউ পরিচয়ও পাবে৷ তাছাড়া ইয়াশফার এখনো বিয়ে দেয়নি। মুসকানের বিয়ের খরচ সব তার স্বামীই দিচ্ছে। দেবে না কেন? মুসকান তারও মেয়ে। ইয়াশফার কথা ভেবেই কেঁদে ফেলল মেজো কাকি। বাবার আদুরে মেয়েটার বাবাতে ভাগ বসাল ঐ মেয়ে৷ এখন সবকিছুতেই ভাগ বসাচ্ছে। ইমন ছেলে হিসেবে যেমন পাত্র হিসেবেও তেমন। এমন মেয়ে জামাই লাখে একটা মেলে। ঐ ফকিন্নির ঝি, সতীনের মেয়ের কপাল সোনায় সোহাগা হবে। আর তার মেয়েটা বাবার থেকে পাওয়া আঘাতে ঘর আঁটকে ধুকে ধুকে মরবে? মা হয়ে এসব সে সহ্য করবে? কক্ষণো না৷ মেজো কাকি গভীর চিন্তায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে। ইভান কিয়ৎক্ষণ বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকার পর শেষবারের মতো চেষ্টা করল। ফোন দিল মুসকানকে।
সায়রী চলে গেল৷ মুসকান মিসড কল চেক করে নাম্বারটা চিনতে পারল না। ইমন তার ব্যাগপত্র চেক দিচ্ছে। এমন সময়ই ফোন বেজে ওঠল আবার৷ মুসকান কিছু না ভেবেই রিসিভ করে সালাম দিল। ওপাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে ইভানের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
‘মুসকান, তুমি ফোন ধরেছ! কতক্ষণ ধরে ট্রাই করছি।’
‘আপনিহ!’
কিঞ্চিৎ ভয়, সীমাহীন বিস্ময়ে শিউরে ওঠল মুসকান। ব্যাগপত্র চেক দিতে দিতে তাকাল ইমন। মুসকানের মুখো ভঙ্গি দেখে ভ্রু গেল। মুসকান ঢোক গিলে তাকাল ইমনের দিকে। ফোনের ওপাশে থাকা ইভান বলল,
‘মুসকান লিসেন, তুমি এই বিয়েটা করো না। তোমার সাথে আমার খুব জরুরি কথা আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেসব জানার পর এই বিয়ে তুমি করতে পারবে না৷ তোমার মতো প্রবল আত্মসম্মান সম্পন্ন মেয়ে কিছুতেই ইমনকে জীবনসঙ্গী করবে না।’
মুসকান ঘামতে শুরু করল। সন্দেহের বশে ওঠে আসল ইমন। দাঁড়াল মুসকানের পাশে৷ খেয়াল করল মুসকানের শরীরে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে। হাত দু’টো মৃদু মৃদু কাঁপছে। কেন জানি খটকা লাগল তার৷ কোনোকিছু না ভেবেই মুসকানের হাত থেকে কেড়ে নিল ফোনটা৷ ধরল নিজের কানে। শুনতে পেল,
‘এই বিয়েটা করলে খুব বড়ো ভুল হয়ে যাবে মুসকান৷ আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। আমাকে বিশ্বাস করো তুমি।’
আকস্মিক চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল ইমনের। কঠিন দৃষ্টিতে একবার তাকাল মুসকানের ভয়, দুঃশ্চিন্তা মিশ্রিত মুখশ্রীতে। এরপরই দৃষ্টি ফিরিয়ে মেঝেতে স্থির করল৷ একহাতে ফোন চেপে ধরল শক্ত করে৷ অন্য হাত মুঠো মন্দি করে গমগমে কণ্ঠে উত্তর দিল,
‘করলাম বিশ্বাস। এবার বল, বিয়েটা করলে ঠিক কী ভুল হবে মুসকানের?’
ভয়ে থরথর করে কাঁপছে মুসকান। এ জীবনে এমন ভয় সে কখনো পায়নি৷ পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেবে বোঝা দায়। হৃৎস্পন্দন রোধ করে শুধু ভীত চোখে ইমনের কঠিন মুখটায় তাকিয়ে রইল সে। এদিকে ইমনের কণ্ঠ পেয়ে ভয়ে সংকুচিত হলো ইভান। ইমন কি তার সব কথা শুনতে পেয়েছে? ঘাবড়ে গেল খুব৷ আমতা আমতা করে বলল,
‘ইমন, তুই আমাকে ভুল বুঝিস না৷ আসলে মেজো কাকি বলছি ভাই, বোনদের মধ্যে বিয়ে করা নাকি ঠিক না। মুসকান তো আমাদের বংশেরই মেয়ে। আমিও শুনেছি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে রক্তের কানেকশন থাকলে বাচ্চা, গাচ্চা হতে ঝামেলা হয়।’
নিমিষেই চোখ দু’টো বুজে ফেলল ইমন। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘তোকে এত পন্ডিতি করতে হবে না৷ আমারটা আমি বুঝে নিতে জানি।’
ফোন কেটে দিল ইমন। এপাশে ইভান আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ ফোনটা ছুঁড়ে ভেঙে চুরমার করে দিল। ইভানের ক্ষিপ্ততা দেখে ত্বরিত পালালো
মেজো কাকি। মনে মনে ভাবল,
‘এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে।’
মুসকানের ফোন আর মুসকানের হাতে দিল না ইমন৷ বন্ধ করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল৷ এরপর কঠিন চোখে তাকাল মুসকানের দিকে। বলল,
‘এ কয়েকটা দিন আমার হুকুম ছাড়া এক পা নড়া তো দূরে থাক এক গ্লাস পানিও খাবে না৷ ওকে?’
ইমন ভেবেছিল মুসকান ত্যাড়ামি করবে। তাই নিজেকে তৈরি করেই রেখেছিল। কিন্তু না সে ত্যাড়ামি করল না। ইমনকে অবাক করে দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বোঝাল ‘ওকে’ যা ইমনের সমস্ত ক্রোধ নিমিষেই দূর করে দিল৷ ভালোবাসার আবেশে ডুবে রইল কিছু সময়।
চলবে…