চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-০১

0
11

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| সূচনা পর্ব ||

“গত একমাসে ষোলোটা ধ’র্ষ’ণ হয়েছে এই শহরে। প্রতিটা নির্যাতিতার শরীরে অমানুষিক অ’ত্যা’চা’রের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। এবং ঘটনাক্রম পর্যালোচনা করে যা দেখা গিয়েছে, তার থেকে একটাই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, প্রতিটি ধ’র্ষ’ণ সংঘটিত হয়েছে একটিই মানুষের দ্বারা। কিন্তু কে এই সাইকো? এই সাইকোকে খুঁজে বের করার দায়ভার আপনার, ইন্সপেক্টর মল্লিক।”

উর্দ্ধতন অফিসারের কথাগুলো নিঃশব্দে শুনলো শ্রাবণ। ইন্সপেক্টর মল্লিক বলতে তাকেই বোঝানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের একজন অফিসার সে। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন পুলিশের ধর্ম। যদিও বর্তমানে অনেক পুলিশই সেই ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছে। কিন্তু শ্রাবণ এখনও ওর মেরুদন্ডটা বিক্রি করে দেয়নি। রোজ পুলিশের খাঁকি পোশাকটা পরার পর নিজের দায়িত্বে অটল থাকার প্রতিজ্ঞা করে সে।

শ্রাবণের সৎ এবং পরিশ্রমী চরিত্রের প্রভাবে সে অল্প সময়েই উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে। ফলবশত, বর্তমানে কলকাতা শহরের সর্বাধিক চর্চিত মামলার দায়িত্ব আজ ওর হাতেই তুলে দেওয়া হচ্ছে। শ্রাবণ জানে, এই দায়িত্বটা অনেক কঠিন একটা দায়িত্ব। ষোলোটা মেয়ে জীবন হারিয়েছে, সম্মান হারিয়েছে। ষোলোটা পরিবার সন্তানহারা হয়েছে। এই ঘটনা সম্পূর্ণ বাঙালি জাতির মুখে কলঙ্ক লেপে দিয়েছে। শ্রাবণকে খুঁজে বের করতেই হবে অপরাধীকে। সারা বাংলা ওর মুখ চেয়ে থাকবে আজকের পর থেকে।

ইতিমধ্যেই এই বিষয়টা নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয়েছে। প্রথম প্রথম প্রতিবাদী মিছিল নেমেছিল শহরের রাজপথে। কিন্তু বর্তমানে তাও বন্ধ। কারণ, বর্তমানে কলকাতার জনজীবনই প্রায় স্তব্ধ হতে চলেছে। এই ষোলোজন নারীর মধ্যে সব বয়সী মেয়েই আছে, বারো বছরের কিশোরী থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের মহিলা পর্যন্ত। আর, এদের মধ্যে সাতজন তীব্রভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল তাদের আগে হওয়া ধ’র্ষ’ণগুলোর। ফলত, তারাও বলি হয়েছে এই পাশবিক নৃ’শং’সতার।

কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারকে চাপ দেওয়া হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব মামলার নিস্পত্তি করার। রাজ্য সরকার চাপ দিচ্ছে পুলিশের উপর। কিন্তু পুলিশ নিরুপায়। এই প্রথম, কেন্দ্র, রাজ্য এবং পুলিশের মিলিত উদ্যোগের পরেও অপরাধীকে ধরা যাচ্ছে না। কারণ এই অপরাধী নিখুঁত ভাবে সম্পূর্ণ অপরাধ সংঘটন করে। সে কোথাও কোনো ফাঁক রেখে যায়না। এমন কোনো ক্লু রাখে না যার রেশ ধরে তাকে ধরা যায়।

যদিও শ্রাবণের ধারণা, সর্ষের মধ্যেই ভুত রয়েছে। নাহলে এতো তৎপরতার পরেও এই মামলার কিনারা করা যাচ্ছে না কেন? এই তদন্তের গোড়াতেই গলদ রয়েছে। আর এখন যেহেতু সম্পূর্ণ তদন্ত প্রক্রিয়া লিড করবে শ্রাবণ, তাই সেই গলদটা ও সহজেই খুঁজে বের করবে। নিজের সমস্ত প্রচেষ্টা দিয়ে এই মামলার নিস্পত্তি ও করেই ছাড়বে।

ইন্সপেক্টর রুদ্র বসুর থেকে বিদায় নিয়ে লালবাজারের বিশেষ কক্ষ ত্যাগ করলো শ্রাবণ। হ্যাঁ, গত একঘন্টা ধরে লালবাজারেই সমস্ত আলোচনা হচ্ছিলো। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সদর কার্যালয় যে এটিই। স্বাভাবিক ভাবেই এই ভীষণ মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে এখানেই আলোচনা হবে।

লালবাজারের বাইরে বেরিয়ে নিজের বাইকের উপর বসে মাথায় হেলমেট পরে নিলো শ্রাবণ। পুলিশে চাকরি করার সুবাদে ওকে গাড়ি অফার করা হয়েছে অনেক আগেই। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গাড়ি ওর জন্য নির্ধারণ করাও আছে। কিন্তু শ্রাবণ সাধারণত সরকারি টাকায় কেনা মূল্যবান পেট্রোল বা ডিজেল খরচ করে না। বরং নিজস্ব রয়্যাল এনফিল্ডেই ঘুরতে স্বছন্দ বোধ করে সে।

শ্রাবণ এখন যাবে সর্বশেষ ধ’র্ষি’তার বাড়িতে। যে ধ’র্ষ’ণটা হয়েছে গত পরশু। নির্যাতিতার পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ আগেই করা হয়েছে। কিন্তু শ্রাবণ মল্লিকের তদন্ত এবং জিজ্ঞাসাবাদের ধরণ আলাদা। তাই মামলার দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথেই শ্রাবণ নিজস্ব ভঙ্গিমায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে চলেছে। যা ওর তদন্তে বিশেষ ভাবে সাহায্য করবে।

শ্রাবণ বাইকে স্টার্ট দিলো। এর আগেও অনেক কেস হ্যান্ডেল করেছে ও। কিন্তু এইবারেরটা অনেকটাই আলাদা। এবার ওর লড়াই অনেক বড় অপরাধীর বিরুদ্ধে। যে কিনা ওর মা, বোনদের সম্মান নিয়ে প্রতিনিয়ত খেলা করে চলেছে।
____

প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলো রুশিতা। সন্ধ্যা ছটা বাজে। সাড়ে ছটা থেকে নটা অবধি ওর পড়া। টিউটর ম্যাডামের বাড়ি ওর বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে হওয়ায় যাতায়াতে অনেকটাই সময় যায়।

রুশিতা যখন সম্পূর্ণ তৈরী বেরোনোর জন্য, তখনই ওর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন ওর মা, সোহিনী দেবী। ওনার পায়ের আওয়াজ টের পেলো রুশিতা। ও দরজার দিকে ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

“কি ব্যাপার মা, কিছু বলবে?”

“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

“পড়তে যাচ্ছি, আবার কোথায়? প্রতি বুধবারই তো পড়া থাকে আমার।”

“আজ আর কোথাও পড়তে যেতে হবে না। আর এবার থেকে সন্ধ্যায় পড়া বন্ধ। তোমার টিউটরদের সাথে কথা বলে সব পড়া সকালে করার ব্যবস্থা করা হবে।”

রুশিতা বিস্মিত হলো মায়ের কথা শুনে। ও অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

“কেন মা? হঠাৎ এমন করার কারণ কি?”

“এটা তোমার বাবার সিদ্ধান্ত। আমি এই বিষয়ে বেশি কথা বলতে চাইনা। তবে হ্যাঁ, সিদ্ধান্তটা তোমার ভালোর জন্যই।”

সোহিনী দেবী চলে গেলেন। রুশিতা বিরক্ত হলো, রেগেও গেলো সামান্য। এসবের মানে কি? এমন হঠাৎ করে ওর সন্ধ্যার পর বাইরে যাওয়া বন্ধ করা হচ্ছে কেন? এটা ঠিক যে ওদের পরিবার রক্ষণশীল প্রকৃতির, কিন্তু তবুও রুশিতার ব্যাপারে সেইরকম কোনো কঠোরতা এতদিন ওর বাবা দেখাননি। তবে আজ হঠাৎ কি হলো?

রুশিতা ঠিক করলো ওর বাবার সঙ্গে কথা বলবে। মুখোমুখি কথা বলে জানবে ওর পায়ে শিকল লাগানোর কারণ। সেই উদ্দেশ্যেই ঘর থেকে বেরোলো রুশিতা। কিন্তু মাঝ পথেই দেখা হয়ে গেলো উর্জার সাথে। উর্জা ওর মেজো কাকার মেয়ে, যে বয়সে ওর সমান। সমবয়সী হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই ওদের দুজনের মধ্যে ভীষণই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।

রুশিতাকে দেখে উর্জা প্রশ্ন করলো,

“কোথায় যাচ্ছিস?”

“বাবার সাথে কথা বলতে।”

“এখন হঠাৎ?”

রুশিতা এবার সম্পূর্ণ বিষয়টা খুলে বললো। উর্জা মনোযোগ সহকারে শুনলো সবটা। রুশিতার কথা শেষ হওয়ার পর ও বললো,

“তুই কি খোঁজ খবর কিছুই রাখিস না রুশু?”

“কেন, কি হয়েছে?”

“গত একমাস ধরে শহরে কি চলছে জানিস না? ষোলোটা মেয়ের জীবন শেষ হয়ে গেলো। জেঠুমনি তো তোর ভালোর জন্যই বাইরে যেতে বারণ করেছে। আর শুধু তোকে না, আমার, উর্মিদি, শুভ্রাদি, তাপ্তি, প্রজ্ঞা সবারই সন্ধ্যার পর বাইরে যাওয়া বারণ। আর আমাদেরও বোঝা উচিত, এটা আমাদের ভালোর জন্যই। এই শহরে আমাদের মেয়েদের স্বাধীনতা নেই রে রুশু!”

রুশিতার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। হ্যাঁ, গত একমাস ধরে চলা ঘটনার সবটাই ও জানে। আর এর জন্য বাড়ির লোকদের চিন্তা করা খুবই স্বাভাবিক। একের পর একটা মেয়ে শিকার হচ্ছে এই পাশবিক অত্যাচারের। আর পুলিশ কিছুই করতে পারছে না। যেন চোখে রুমাল বেঁধে রেখেছে পুলিশ। এখন মা বাবাদেরই বা কি দোষ? কোন ভরসায় নিজেদের কন্যা সন্তানকে সন্ধ্যার পর একা ছাড়বেন তারা?

উর্জা বুঝতে পারলো রুশিতার মন খারাপ হচ্ছে। ও তাই রুশিতার কাঁধে একটা হাত রেখে বললো,

“যা, জামাকাপড় পাল্টে বাড়ির পোশাক পরে নে। তারপর উর্মিদির ঘরে চল, সবাই ওইখানেই আছে। আড্ডা দেওয়া যাক সবাই মিলে।”

রুশিতা উর্জার কথা শুনলো। ও ঘরে গেলো তাড়াতাড়ি। বাড়ির পোশাক পরে নিয়ে উর্জার সাথে উর্মির ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো।

উর্মির ঘরে শুভ্রা, তাপ্তি, প্রজ্ঞা, আদিত্য, উদিত, আয়ুশ সবাই বসে রয়েছে। এরা সবাই রুশিতার কাজিন। এদের মধ্যে শুভ্রা রুশিতার পিসির মেয়ে। ওর পিসেমশাই মারা যাওয়ার পর থেকে পিসি এবং শুভ্রা ওদের বাড়িতেই থাকে। তাপ্তি আর আদিত্য রুশিতার বড় জেঠুর সন্তান। উর্মি, উর্জা, উদিত রুশিতার মেজো কাকার সন্তান। প্রজ্ঞা ও আয়ুশ রুশিতার ছোট কাকার সন্তান। রুশিতার বাবারা চার ভাই এক বোন, ওর বাবা রণজিৎ তালুকদার মেজো।

রুশিতা আর উর্জা সমবয়সী, ওরা গ্র্যাজুয়েশন ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। উর্মি মাস্টার্স ফার্স্ট ইয়ার এবং শুভ্রা সদ্য মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। তাপ্তি ক্লাস ইলেভেনে পড়ে, প্রজ্ঞা ক্লাস নাইন। আদিত্য পিএইচডি করছে, উদিত আর আয়ুশ ক্লাস টুয়েলভে পড়ে।

রুশিতা গিয়ে উর্মির পাশে বসলো। উর্মি ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলো। রুশিতা বললো,

“কি গল্প হচ্ছে?”

উর্মি কিছু বলার আগেই আদিত্য বললো,

“সাম্প্রতিক কেসটায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা চলছে।”

রুশিতা বললো,

“পুলিশের আদৌ কোনো ভূমিকা আছে কি? আমার তো মনে হয়না। পুলিশ তদন্ত করছে বলেই তো মনে হচ্ছে না। নাহলে এতোদিনেও অপরাধীকে খুঁজে পেলো না? আর ক্রমাগত ভিক্টিম মেয়েদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।”

ওর কথায় সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লো সকলেই। শুভ্রা বললো,

“তদন্ত হবে না রে। এই পোড়া দেশে মেয়েদের বিচার হয়না। এখানে মেয়েরা শুধু ভোগের সামগ্রী এবং পুরুষের দাসী হয়েই থেকে যায়। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি।”

শুভ্রার কথায় সবার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। একেবারে বাস্তব কথাটা বলেছে শুভ্রা। এটাই তো হচ্ছে এখন দেশে। মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই এখন যেন পাপ।

ওদের আলোচনা এগোতে থাকলো। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের বিভিন্ন ঘটনা ঘিরে আবর্তিত হতে থাকলো ওদের গল্প। মাঝে মাঝে হাসিঠাট্টাও হলো। একে অপরকে নিয়ে মজা করাও হলো। ওদের কাজিনদের মধ্যে সম্পর্কটা ভীষণই মধুর। ওরা সারাক্ষণই একসাথে থাকে, একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করে।

চলবে…..