#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| চতুর্থ পর্ব ||
[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]
“সখী, ভাবনা কাহারে বলে?
সখী, যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
ভালোবাসা, ভালোবাসা
সখী, ভালোবাসা কারে কয়?
সে কি কেবলই যাতনাময়?”
পড়তে বসে গুনগুন করে গান গাইছিলো রুশিতা। গানের গলাটা তার মন্দ নয়। বরং, ছোট থেকেই সে বেশ ভালোই গান গায়। অন্তত, লোকে তো তাই বলে।
পড়তে বসলেও আজ পড়ায় মন লাগছে না রুশিতার। অনেকদিন হয়ে গেলো, বিকেলের পর বাড়ি থেকে বেরোয় না। রণজিৎ তালুকদারের কড়া নিষেধ, বিকেলের পর সব মেয়েরা বাড়ির ভিতরেই থাকবে। প্রয়োজন পড়লে ছেলেরা বাইরে যাবে কিন্তু মেয়েরা না।
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো রুশিতা। পরিষ্কার আকাশে অনেক তারার মাঝে চাঁদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। রুশিতা চাঁদ দেখতে ভালোবাসে। মাঝেমাঝেই ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে ও। এখন যদিও ছাদে যাওয়া সম্ভব হলো না। বই ছেড়ে উঠলেই মা পিঠে লাঠি ভাঙবে! তাই জানালা দিয়েই তাকিয়ে রইলো ও।
কিছুক্ষণ পর, ঘরে ঢুকলো উর্মি। রুশিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কি করছিস রুশু?”
রুশিতা জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো উর্মির দিকে। মৃদু হেসে বললো,
“পড়ছিলাম গো উর্মিদি। কিছু বলবে?”
উর্মিও হাসলো। তারপর বললো,
“খবর আছে একটা।”
“এখন আবার কি খবর?”
“শুভ্রাদির বিয়ের কথা বার্তা চলছে। আগামী কাল পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে ওকে।”
“বলো কি গো? শুভ্রাদি জানে? কি বলছে ও? আর হঠাৎ বিয়ে ঠিক হলো যে, কে ঠিক করলো?”
“এই বাড়িতে সবকিছু কে ঠিক করে? জেঠুমনি, মানে তোর বাবাই ঠিক করেছে। আর শুভ্রাদি কি বলবে বল তো? ওর পড়াশোনা শেষ, আর আমাদের বাড়ির মেয়েদের চাকরি করতে দেওয়া হবে না। তাই এবার তো বিয়ের কথা উঠতোই। আর দুই এক বছর পর আমার সাথেও এটাই হবে। তাছাড়া শুনলাম, ছেলে নাকি ভালো ফ্যামিলির, ভালো চাকরি করে।”
“ওহ, আচ্ছা। নাম কি ছেলের?”
“অনিক চক্রবর্তী।”
রুশিতা আর কিছু বললো না। শুভ্রার এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাক সেটা ও চায়নি। তবে এটাও সত্যি যে, এরকমটাই হওয়ার ছিল। ওদের সবার সাথেই এমনই হবে। রণজিৎ তালুকদার বাড়ির মেয়েদের অশিক্ষিত রাখবেন না, তারা যতটা পড়তে চায় তিনি পড়াবেন। কিন্তু চাকরি করতেও তিনি দেবেন না। তাই পড়া শেষ হওয়ার পর বিয়ে হওয়াটাই ওদের ভবিতব্য।
উর্মিই নীরবতা ভাঙলো। বললো,
“আড্ডা দিবি রুশু? সবাইকে ডেকে আনি তাহলে? কদিন পর তো শুভ্রাদি থাকবে না, তখন তো এভাবে আড্ডা দেওয়া হবে না। একজন মিসিং থাকবে।”
রুশিতা ভেবে দেখলো, কথাটা একেবারেই ঠিক। শুভ্রাদি ওদের দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সব আড্ডায় তার সরব যোগদান থাকে। তাকে ছাড়া আড্ডা কতটা জমবে সেটা ভাবার বিষয়। তাই যতদিন শুভ্রা বাড়িতে আছে, সেই সময়টা কাজে লাগানোই ভালো। ও তাই বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সবাইকে ডেকে আমার ঘরে নিয়ে চলে আসো। আদিত্যদা,উদিত, আয়ুশ ওদেরকেও ডেকো।”
“আদিদা বাড়ি আছে কিনা জানিনা। উদিত আর আয়ুশকে ধরে আনছি, চিন্তা নেই।”
উর্মি বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। রুশিতা তাড়াতাড়ি বইপত্র গুটিয়ে নিলো। ওর পড়া ফেলে বেরোনো বারণ ঠিকই, কিন্তু বাকিদের তো ওর ঘরে আসতে বারণ নেই। তাই মা চাইলেও ওকে বকা দিতে পারবেন না। কথাটা ভাবতেই আনন্দ হলো ওর।
কিছুক্ষণ পর সবাই এসে ঘরে ঢুকলো। আদিত্যও বাড়িতেই আছে, তাই সেও আসলো। সবাই গুছিয়ে বসার পর রুশিতা শুভ্রার দিকে তাকিয়ে বললো,
“শুভ্রাদি, কাল নাকি তোমায় দেখতে আসবে?”
শুভ্রা কিছু বলার আগেই আদিত্য বলে উঠলো,
“হ্যাঁ, কাল ছেলে আর ছেলের মা বাবা আসবে। তবে যাই বলিস, শুভ্রার হবু বরকে দেখতে কিন্তু দারুন। বেশ একটা হিরো হিরো টাইপ দেখতে।”
উর্জা বললো,
“তাই নাকি? কই, ছবি দেখাও তো। আমাদেরও দেখা উচিত আমাদের হবু জামাইবাবুকে।”
আদিত্য ফোন থেকে ছবি বের করে দেখালো। সবাই মিলে আলোচনা শুরু করে দিলো অনিককে নিয়ে। শুভ্রাকে খোঁচানোও চললো তাল দিয়ে। সে বেচারি লজ্জা পেয়ে মুখ লাল করে বসে থাকলো!
____
গুরুত্ত্বপূর্ণ দলীয় মিটিংয়ে যোগ দিতে যাচ্ছেন রণজিৎ তালুকদার। আজকের মিটিংটা তার জন্য ভীষণই জরুরি। আজকের মিটিংয়ে দলের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু নতুন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যে সব সিদ্ধান্তের ফলে দলের ভিতরের অনেক কিছু পাল্টে যেতে পারে। দলের একজন বিধায়ক এবং দক্ষ সংগঠক হিসেবে রণজিৎ তালুকদারের এই মিটিংয়ে উপস্থিত থাকা আবশ্যিক।
নিজের বিলাসবহুল চারচাকা গাড়ির পিছনের সিটে গা এলিয়ে বসে রইলেন রণজিৎ তালুকদার। আর ভাবতে লাগলেন, আজকের মিটিংয়ে কিভাবে নিজের জন্য একটা উঁচুদরের পদ বাগিয়ে নেওয়া যায়। নিজের লাভ ছাড়া অন্য কিছু দেখতে উনি রাজি নন। তাই এখনও তিনি নিজের লাভই খুঁজবেন।
বিশেষ দলীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে থামলো তালুকদার সাহেবের গাড়ি। উনি গাড়ি থেকে নামতেই দলের কিছু তরুণ কর্মী এসে ওনাকে অভ্যর্থনা জানালো। তালুকদার সাহেব মৃদু হাসলেন। ক্ষমতায় থাকার এই এক সুবিধা, সবাই তোষামোদ করে। এই বিষয়টা উনি সব সময়ই বেশ উপভোগ করেন।
কার্যালয়ের ভিতরে ঢুকে গেলেন তালুকদার সাহেব। সাথে সাথে বাকি কর্মীরাও ঢুকলো। তালুকদার সাহেবের মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলো বিভিন্ন কূট বুদ্ধি। অবশ্য, সে তো সব সময়েই ঘোরে!
____
ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে উর্মি। আজ তাড়াতাড়িই ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এসেছে ও। দুপুরের ঠাঠা রোদে প্রায় দশমিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে ও, কোনো রিকশা, টোটো বা অটোর দেখা নেই। আজ বিকেলে শুভ্রাকে দেখতে আসবে, তাই উর্মির তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা প্রয়োজন। কিন্তু কপাল খারাপ, তাই দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
এতক্ষণ চড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকায় সামান্য অসুস্থ বোধ হচ্ছে উর্মির। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এভাবে বেশিক্ষণ থাকা উচিত হবে না, সেটা ও বুঝতে পারছে। কিন্তু উপায় নেই। ওকে বাড়ি ফিরতে হলে এখানে রিকশা বা টোটোর জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। কারণ এখান থেকে ওদের বাড়ি হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। আর বাসে উর্মি উঠবে না, কারণ বাসে উঠলে ওর বমি পায়।
আরও বেশ খানিকক্ষণ পরে হঠাৎই উর্মির মাথাটা ঘুরে গেলো। ভারসাম্য হারিয়ে পরে যাওয়ার মুহূর্তে একটা শক্ত হাত ধরে সামলে নিলো ওকে। তীব্র মাথাব্যথায় উর্মি তখন চোখ বুজে ফেলেছে। সেই অবস্থাতেই টের পেলো, কেউ ওকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে বেঞ্চ জাতীয় কিছুতে বসালো।
মিনিট কয়েক পরে চোখ খুললো উর্মি। সামনে দেখতে পেলো উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক সুপুরুষ যুবককে। উর্মি সামান্য অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। এই লোকটাই তাহলে পরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে ওকে? উর্মি লজ্জা পেলো। ইসস, এভাবে একজন লোকের কোলের মধ্যে ঢলে পড়লো ও! নিজের প্রতি নিজেরই রাগ উঠলো ওর।
উর্মিকে চোখ খুলতে দেখেই যুবকটি ব্যস্ত ভাবে বলে উঠলো,
“ঠিক আছেন আপনি? বাবা, ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন তো!”
“হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। দুঃখিত, আপনাকে সমস্যায় ফেলার জন্য।”
“না না, ঠিক আছে। আমি অরূপ সামন্ত। আপনার নাম কি?”
“উর্মি তালুকদার।”
“ওহ। আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?”
“আমি বাড়ি ফিরবো, তাই রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অনেকক্ষণ রোদে দাঁড়িয়েছিলাম তো, তাই মনে হয় মাথা ঘুরে গিয়েছে।”
“বুঝলাম। আপনি যদি চান, আমি আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে আসতে পারি। আমার গাড়ি আছে সাথে।”
উর্মি একটু ইতস্তত করলেও পরে রাজি হয়ে গেলো। কারণ এই অবস্থায় ওর পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা একেবারেই সম্ভব নয়। তাই এই লোকটি যদি গাড়িতে করে ওকে বাড়ি পৌঁছে দেয়, তাহলে ওর খুবই উপকার হবে। তাই উর্মি অরূপের সাথে গিয়ে গাড়িতে উঠলো।
____
পোস্ট মর্টেম রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে চিন্তিত ভাবে বসে আছে শ্রাবণ। সে বুঝতে পারছে, এই রেপিস্ট সত্যিকারেরই একটা সাইকো। অনেক ভেবেচিন্তে, প্ল্যানিং করে সে ধ’র্ষ’ণগুলো করছে। রেপিস্টের ঠান্ডা মাথার প্ল্যানিংএর সামান্য আঁচ করতে পেরেই শিউরে উঠছে শ্রাবণ।
সতেরোটা রেপ কেসের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এই মুহূর্তে শ্রাবণের হাতে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, মেয়েগুলোর যৌ’না’ঙ্গ বা জরায়ুতে কোনো স্পার্মের হদিশ পাওয়া যায়নি। অথচ, ধ’র্ষ’ণ যে হয়েছে তা স্পষ্ট। যৌ’না’ঙ্গ, স্ত’ন ইত্যাদি জায়গায় অত্যাচারের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে, এমনকি ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু রেপিস্টের স্পার্ম, চুল বা কোনো কিছুই মৃতদেহের সাথে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, রেপিস্ট কোনো সুযোগই রাখেনি তাকে ধরার।
শ্রাবণ আগেই বুঝতে পেরেছিলো যে সাধারণ ভাবে এই কেস সল্ভ করা যাবে না। তাই অন্য পন্থা ও আগেই গ্রহণ করেছে। শ্রাবণ ইতিমধ্যেই ওর বিশ্বস্ত কিছু পুলিশকে লাগিয়ে দিয়েছে বিশেষ নজরদারিতে। সারা শহর জুড়ে তল্লাশি চলছে, সন্দেহজনক কোনো মানুষকে ধরার জন্য। হঠাৎ করে শহরে আসা মানুষ খোঁজা হচ্ছে।
শ্রাবণের ধারণা, এই রেপিস্ট কলকাতার পার্মানেন্ট বাসিন্দা নয়। মাস দেড়েকের মধ্যে সে কলকাতায় এসেছে। আর যেহেতু বোঝাই যাচ্ছে এই লোক একটা সাইকো, সেহেতু তার আচরণ এমনি সময়েও সন্দেহজনক হবে। তাই শ্রাবণ তার ফোর্সকে নির্দেশ দিয়েছে, এক – দেড় মাসের মধ্যে শহরে এসেছে, এবং যুক্তিসঙ্গত কোনো কাজে আসেনি এমন লোককে খুঁজে বের করতে। যদিও কাজটা ভীষণই কঠিন। হয়তো বাকিদের চোখে হাস্যকরও। কিন্তু এছাড়া শ্রাবণ এখন আর কোনো উপায় দেখতে পারছে না।
চলবে…..