চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-১১

0
63

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| একাদশ পর্ব ||

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

“তুমি কি শিওর শ্রাবণ, যে তুমি আবার এই কেসটার দায়ভার নিতে চাও?”

গম্ভীর ভাবে প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর রুদ্র চৌধুরী। কিন্তু শ্রাবণ নির্বিকার। সে উত্তর দিলো,

“হ্যাঁ স্যার, আমি শিওর।”

“এই কেসের জন্য একবার তোমার জীবনহানির সম্ভাবনা পর্যন্ত হয়েছে। তারপরেও এই কেসটা নিতে চাও তুমি?”

“এই কেস হ্যান্ডেল করতে গিয়ে যদি আমাকে এবার সত্যি সত্যিই মরেও যেতে হয়, তবুও আমি এই কেসটা চাই স্যার। আমি এই কেসের তদন্ত করতে চাই। আপনি বুঝতে পারছেন না, এটা আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।”

“আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না শ্রাবণ। আমি বুঝতে পারছি না যে কেন তুমি জেনে বুঝে জীবনের ঝুঁকি নিতে চাইছো?”

“আমি আজ অবধি কোনো কেস আনসল্ভড অবস্থায় ছাড়িনি স্যার। এটাও ছাড়তে চাইনা। আমার রেকর্ড ভাঙতে চাইনা আমি। জাস্ট এইটুকুই।”

“জাস্ট এইটুকুই বিষয়টা না সেটা আমি জানি শ্রাবণ। যাইহোক, তোমার কাজের প্রতি ডেডিকেশন দেখে আমি পুনরায় তোমাকে তদন্তে বহাল করছি। আশা করি তুমি আমায় হতাশ করবে না।”

“নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার। এইবার যখন দায়িত্ব নিচ্ছি তখন কেসটা আমি সল্ভ করেই ছাড়বো। আর যদি না পারি, আমার ইস্তফাপত্র আপনার সামনে থাকবে। জয় হিন্দ স্যার।”

শ্রাবণ বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। রূদ্র চৌধুরী চুপচাপ বসে রইলেন। এই ছেলেটা বারবার ওনাকে অবাক করে। এতো বছরের চাকরি জীবনে এরকম কর্তব্য পরায়ণ মানুষ তিনি কমই দেখেছেন। হ্যাঁ, চাকরির শুরুতে তারা সবাই শপথ নেন যে দেশের প্রতি কর্তব্যই তাদের মূল আদৰ্শ। কিন্তু সেটা মেনে চলে কয়জন? শ্রাবণকে সেটা মনে প্রাণে মেনে চলতে দেখছেন তিনি। রূদ্র চৌধুরী মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন, এই ছেলেটা যেন সফল হয়।
_____

তালুকদার সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে রুশিতা। ওর মুখের অভিব্যক্তিতে রাগ – ক্ষোভ স্পষ্ট। চিরকালীন ভদ্রতার দায়ে আজ ও খারাপ ব্যবহার করতে পারছে না, চিৎকার করতে পারছে না। নয়তো নিজের বাবাকেই বেশ কিছু কড়া কথা শোনানোর ইচ্ছা ছিল রুশিতার।

তালুকদার সাহেব নির্বিকার ভাবে বসে আছেন। রুশিতা ভীষণ কষ্টে নিজের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া চিৎকারটাকে গিলে নিয়ে অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বললো,

“আমি কি আপনার উপর বোঝা হয়ে আছি বাবা? আপনার নীতি অনুযায়ীও তো গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগে বিয়ে দেওয়ার কথা না। আর আমার আগে তো উর্মিদি আছে। তাহলে আপনার ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর ছেলের জন্য আমাকেই পছন্দ হলো কেন?”

তালুকদার সাহেব শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন রুশিতার দিকে। তারপর বললেন,

“বিয়েটা জাস্ট ঠিক হয়ে থাকছে। এখনই হচ্ছে না। তোমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার পরেই হবে। আর এই সম্বন্ধটা ভীষণই ভালো। তাই এটা আমি আমার মেয়ের জন্যই চুজ করবো তাইনা? তোমার ভালোর জন্যই যা করার করছি। তুমি তো জানোই তোমায় আমি কতটা ভালোবাসি? তোমার বিয়ে এখানেই হবে, এটাই আমার সিদ্ধান্ত। আর আশা করি তুমি জানো যে, শান্তিনিবাসে আমার সিদ্ধান্তই শেষ কথা।”

রুশিতা হাসলো। সেই হাসিতে বিদ্রুপ মিশে আছে। ও বললো,

“জানি বাবা, এই বাড়িতে আপনার শাসন চলে। তবে কি জানেন তো, আমার ভালোর কথা আপনি কত ভাবেন সে তো ছোট থেকেই দেখছি। কত ভালোবাসেন সেটাও দেখছি। কেন জানি আমার ধারণা হচ্ছে, এই বিয়েটা হলে আমার ভালো হওয়ার থেকেও আপনার ভালো হওয়ার কোনো ব্যাপার আছে।”

ভ্রু কুঞ্চিত হলো তালুকদার সাহেবের। বোধ করি তার মেজাজ উত্তপ্ত হলো সামান্য। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,

“ তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি তোমার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছো? আমাদের পারিবারিক শিক্ষায় তো বড়োদের সাথে অসভ্যতা করতে শেখানো হয়নি।”

“ক্ষমা করবেন বাবা। ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেলেছি। দ্বিতীয়বার এই ভুল আর হবে না।”

রুশিতা বেরিয়ে এলো তালুকদার সাহেবের ঘর থেকে। ওর দুইচোখ ফেটে জল আসছে। কিন্তু নাহ্, ও কাঁদবে না। দুর্বল হওয়া চলবে না। বরং ভাবতে হবে, কিভাবে এই বিয়ে ভাঙা যায়। বেঁচে থাকতে এই বিয়ে রুশিতা করবে না। কারণ ও জানে, এটা বিয়ে হবে না, হবে একটা সওদা। তালুকদার সাহেব এমন তাড়াহুড়োয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মানেই এর পিছনে তার বড় কোনো স্বার্থ আছে। আর তার স্বার্থের প্রয়োজনে নিজেকে শেষ করতে পারবে না রুশিতা।

তালুকদার সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে এক প্রকার দৌড়েই নিজের ঘরে পৌঁছালো রুশিতা। ঘরে ঢুকেই ছিটকিনি আটকে দিলো ও। এই মুহূর্তে ও কারোর মুখোমুখি হতে চায়না। নিজের বিদ্ধস্ততা দেখাতে চায়না কাউকে। এখন ও একা থাকতে চায়।

বিছানায় বসে চাদর খামচে ধরলো রুশিতা। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। চেষ্টা করেও শক্ত থাকতে পারলো না ও। নিজের ভাগ্যের প্রতি ভীষণ রাগ হলো ওর। সবাই ভাবে, ও বিধায়কের মেয়ে, কতই না সুখী ও। কিন্তু বাস্তবটা যে বড়োই ভিন্ন। রুশিতার ধারণা, এর থেকে সাধারণ কোনো গরিব পরিবারে জন্ম নিলেও মনে হয় সুখে থাকতো ও। একটু বাবার ভালোবাসা তো পেতো। লোক দেখানো ভালোবাসা নয়, সত্যিকারের ভালোবাসা।

তালুকদার সাহেব কখনোই ওদের ভালোর কথা চিন্তা করেন না। ছোট থেকে দেখে আসছে রুশিতা, তালুকদার সাহেব এমন কাজই করেন যেগুলোতে শুধুই ওনার ভালো হয়, বাকি কারো নয়। এই যেমন শুভ্রাদির বিয়ের বিষয়টা। শুভ্রাদির বিয়ের সাথে সাথে একটা বড় বিজনেস ডিল ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছে ওনার। শুধুমাত্র ভাগ্য ভালো যে অনিকদা মানুষটা ভালো।

আজ অবধি রুশিতা বা বাড়ির অন্য কেউ তালুকদার সাহেবের বিরোধীতা করেনি। কিন্তু এবার করবে। করবে ওনার নিজের মেয়েই। নিজের জীবন নিয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত ওনাকে নিতে দেবে না রুশিতা। প্রয়োজনে বাড়ি ছাড়বে ও। কিন্তু বাবার কথায় চোখ বুজে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে ও পারবে না। ও জানে, এই বিরোধিতার পরিণাম ভালো হবে না। কিন্তু এখন যেন ও ভয় ভীতির উর্দ্ধে চলে গিয়েছে। ঝুঁকি নিতে এখন আর ভয় লাগছে না ওর। প্রতিবাদ করতেও না।
_____

আজ নিজের উপর ভীষণ বিরক্ত SB। বিরক্ত, আড়াই মাস আগে নিজেরই করা একটা কাঁচা কাজের জন্য। এখন যে কারণে কপাল চাপড়াচ্ছে ও। বারবার নিজেকে গালমন্দ করছে যে, এরকম ভুল ও কিভাবে করতে পারে? ওর মতো মানুষের থেকে কি আধা খাপচা কাজ আশা করা যায়?

আড়াই মাস আগে শ্রাবণ মল্লিকের এক্সিডেন্ট করিয়েছিলো SB। চূড়ান্ত ভাবেই আহত হয়েছিল শ্রাবণ সেই দুর্ঘটনায়। কিন্তু SB-র ভুল যেটা ছিল, সেটা হলো শ্রাবণের মৃত্যু হয়েছে কিনা না দেখেই ও ওখান থেকে চলে এসেছিলো। SB ভাবতেও পারেনি ওরকম বীভৎস ভাবে আহত হওয়ার পরেও শ্রাবণ বেঁচে যাবে। অদ্ভুত জীবনীশক্তি বটে ছেলেটার।

শ্রাবণ বেঁচে যাওয়াতেই হয়েছে যত সমস্যা। আর বেঁচে গেছে তো গেছে, এই আড়াই মাসে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে চাকরিতেও জয়েন করেছে গতকাল থেকে। এবং আবারও SB-র কেসটারই দায়িত্ব নিয়েছে। SB বুঝতে পারছে না, এই ছেলেটা কোন ধাতু দিয়ে গড়া? মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ঘুরে এসেও সামান্য ভয় নেই এর? আবারও জীবন নিয়ে খেলতে নেমেছে?

SB জানে, শ্রাবণ এবার শুধুই রেপিস্টকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে না, বরং তাকেও খুঁজে বের করতে চাইবে, যে ওকে মারার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দুটো মানুষই SB। যদিও শ্রাবণকে ও ভয় পায়না, কিন্তু তবুও, ওর কাজে একটা বাঁধা তো সৃষ্টি হবে। এই বিষয়টাতেই বিরক্ত হচ্ছে SB। গত বার যদি শ্রাবণকে মেরে ফেলতে পারতো, তাহলে আজ আর এতো চিন্তা করতে হতো না ওকে।

নাহ্, হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না। মনে মনে ভাবলো SB। যেভাবেই হোক, শ্রাবণকে এবার রাস্তা থেকে সরাতেই হবে। এবার আর কাজে কোনো ভুল করা যাবে না। এবার ওর কাজ হবে নিখুঁত, যেমনটা সব সময় হয়।

চলবে…..