চৈতির ডাইরি পর্ব-০১

0
87

সূচনা পর্ব
#চৈতির_ডাইরি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

সারাদিনের কাজের পর শেষ বিকেলের দিকে তুলির চোখ লেগে এসেছিল। হঠাৎই তার ছোট জা এসে তাকে ডেকে তুললো। তরল গলায় বলল, “তুমি ঘুমিয়েই থাকো! ওদিকে তোমার বর অফিস থেকে ফিরে বড় ভাবীর ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। ভেতর থেকে কিসব আওয়াজ আসছে। দরজায় কান পাতা যাচ্ছে না। কি বিশ্রী ব্যাপার!”

তুলি নড়েচড়ে বিছানায় উঠে বসলো। শুকনো মুখে বলল, “তোমাকে কে বলেছে?”

“এই দেখো! তোমার কথাবার্তা শুনলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমায় কেউ বলতে যাব কেন? নিজের চোখে দেখে এসেছি।”

তুলি কথার জবাব দিলো না। অন্যমনস্ক হয়ে জানালার দিকে বাইরের দিকে তাকালো। দিনের আলো ম’রে এসেছে। পৃথিবীর মতোই কি তার জীবনে রাত নেমে এলো? নববী বলল, “আপা তুমি কিছু বলছ না কেন?”

“কি বলবো?”

“তুমি কেমন মেয়ে মানুষ? স্বামী অন্য নারীর ঘরে আর তুমি কিছুই বলবে না?”

তুমি অল্প হাসলো। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করে বলল, “আচ্ছা, চল দেখি। কোথায় কি হচ্ছে!”

নববী ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। তার মুখ হাসিহাসি। যেন খুব মজার কিছু ঘটতে চলছে। তুলি ধীর পায়ে হেঁটে বড় জায়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘরের দরজা ভেজানো। ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসছে না। তুলি দরজার ওপর হাত রাখতেই আশিক বেরিয়ে এলো। তার শরীর ভেজা, দেখে মনে হচ্ছে সবেমাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। তুলি বলল, “আপনি কখন এসেছেন?”

“কখন এসেছি সে খোঁজ নেওয়ার সময় কি তোমার আছে? এভাবে মুখের ওপর দাঁড়িয়ে না থেকে আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করো। সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফিরেছি। একটু যদি কাণ্ডজ্ঞান থাকে! আমাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেয় না।”

তুলি কিছু বলল না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রান্নাঘরে দিকে হেঁটে চলে গেল। আজকাল তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। হঠাৎ করে নিজেকে অসহায় এবং খুব ক্লান্ত মনে হয়। দু’চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে। বিশেষ করে দুপুরের দিকে। তুলি ভাত বেড়ে আশিককে ডাকতে গেল। হালকা গলায় বলল, “টেবিলের ওপর সবকিছু সাজিয়ে রেখে এসেছি। আর কিছু লাগলে বললেন।”

আশিক জবাব দিলো না। নিজের কাজ করতে লাগলো। ছ’মাস হলো ওদের বিয়ে হয়েছে। অথচ সম্পর্ক দেখলে মনে হয় দু’জনে একসাথে কয়েক যুগ কাটিয়ে ফেলেছে। জীবনের শেষ মুহূর্তে গিয়ে মনে হয়েছে -দু’জন দুজনের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। নিরবে দায়িত্ব পালন করা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বিষন্নতা বুকে চেপে চুপচাপ সংসারের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। সদ্য বিবাহিতদের ক্ষেত্রে এমন বিষন্ন ভাব থাকে না। সবসময় হালকা ফুর্তি ভাব কাজ করে। কারণে অকারণে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকা, হুটহাট হেসে ওঠা, কিছু ভালো মুহুর্ত কাটনো।

তুলির জীবনে এমন সময় আসেনি। বিয়ের পর থেকে মন ম’রা হয়ে ঘরের কোণায় পড়ে আছে। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা জন্মালেও তা প্রকাশের সুযোগ হয়নি। বিয়েটা পারিবারিকভাবে দেখাশুনা করেই হয়েছিল। মফস্বলে মেয়েদের বয়স কুড়ি পেরলেই তাদের বুড়ি মনে করা হয়। লোকজন বাঁকা চোখে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলে। বাবা-মা মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য হন্নে হয়ে সু-পাত্রের সন্ধানে ছুটে বেড়ায়। ছেলের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসলে সোনার হরিণ মনে করে লুফে নিতে চায়।

তুলির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সেদিন ছিল শুক্রবার। ছোট মামি তার মা’কে কল দিয়ে বলল, “আপা, মেয়ে তো বড় হইছে। আমার দূরসম্পর্কের এক ভাই আছে। সরকারি চাকরি করে। ফ্যামিলিও খুব ভালো। ছেলের বাবা স্কুলের শিক্ষক। তিন ভাই। বাকি দুই ভাই বিয়ে করছে। আমি তাদের তুলির কথা বলেছি। তারা মেয়েটাকে একটু দেখতে চায়। এমনি একটা রেস্তোরাঁয় দেখাশোনা হলো, ছেলে-মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ের কথা আগানো যাবে। এখন আপনারা মতামত দেন।”

রেহানা বেগম অমত করলেন না। উৎসাহী গলায় কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন। মেয়ের বয়স হয়েছে। একদিন না একদিন বিয়ে দিতেই হবে। এখনই যদি ভালো ছেলে পাওয়া যায় তবে মন্দ কি! শুভ কাজে দেরি করতে নেই।

রেস্তোরাঁয় দেখাদেখির একপর্যায়ে আশিক বলল,” মেয়ের সাথে আলাদা কথা বলা যাবে?”

তখন কেউ অমত করেনি। আশিকের প্রথম কথা ছিল- বড় ভাবী আমার বোনের মতো। আমার কিন্তু কোন বোন নেই। আমার মা আর বড় ভাবী হচ্ছে আমার সবকিছু। আপনি আমায় কিছু বললে হয়তো আমি কষ্ট পাবো না বা ওইভাবে কিছু মনে করবো না। তবে তাদের কিছু বললে তারা খুব কষ্ট পাবে। আমি চাই না ওরা কোন কষ্ট পাক। বুঝতে পারছেন?”

তুলি অবাক হয়নি। বিস্মিত চোখে কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। তবু ভালো! ছেলেটা সোজাসাপটা কথা বলতে পারে। নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার যোগ্যতাটুকুও সবার থাকে না। আশিকের ছিল। সে প্রশংসার দাবীদার। মজার ব্যাপার হচ্ছে তুলির অতিরক্ষণশীল মা’য়েরও এই কথার ব্যাপারে কোন দ্বিমত ছিল না। উল্টো তিনি বললেন, “ছোট থেকে ভাবীর কাছে মানুষ হয়েছে তো তাই অমন বলে। তুই কিছু মনে করিস না।”

বিয়ের পর থেকেই দেবর ভাবীর সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা নজরে পড়েছে। দীর্ঘসময় গল্পগুজব, কারণে অকারণে হেসে ওঠা, কোন কিছুই তার নজর এড়ায়নি। দেখেও না দেখার ভাব করে গেছে। যেখানে নিজের বাবা-মা বোঝা মনে করে সেখানে অন্যের প্রতি প্রত্যাশা জন্মায় না। তুলি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করে আকাশের দিকে তাকালো। সূর্য ডুবে গেছে, ধরনীতে আঁধার ঘনীভূত হচ্ছে। পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারা ফুটেছে। অপূর্ব লাগছে তারাটাকে!

জাহানারা বললেন, “এভাবে বসে আছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”

তিনি সম্পর্কে তুলির শাশুড়ি। সরল সোজা ধরনের মেয়ে মানুষ। তুলি বলল, “না মা, এমনিতেই ভালো লাগছে না। আপনার কি কিছু লাগবে?”

“আমার কিছু লাগবে না। ছেলেগুলোর বায়নায় নাশতার আয়োজন করেছিলাম। ভাবলাম তোমাকেও ডেকে নিই।”

মেঝেতে শীতলপাটি বিছানো হয়েছে। জাহানারা নাশতার অনেক আয়োজন করেছেন। পনিরের সমুছা ছাড়াও ডালের বড়া বানিয়েছেন। আলুর চপ তৈরি হয়েছে। একটা বাটিতে পেঁয়াজ, মরিচ, শশা, টমেটো কুঁচি করে কে’টে রাখা হয়েছে। সেসব দিয়ে মুড়ি মাখা হবে। আশিক হাসিহাসি মুখ করে রজনীর পাশে বসে আছে। বেশিরভাগ সময়ই তাকে বড় ভাবীর কাছে বসতে দেখা যায়। এই নিয়ে বাড়ির কারোর কোন অভিযোগ নেই। রজনীর স্বামী আলতাফ হোসেন মুখ গম্ভীর করে চেয়ারে বসে আছেন। বোধহয় এইমাত্র দোকান থেকে ফিরেছেন। জাহানারা বললেন, “তুলি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আশিকের পাশে গিয়ে বসো।”

তুলি অল্প হাসলো। স্বাভাবিক গলায় বলল, “না মা। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি বরং ঘরে যাই।”
কথাগুলো বসে সে আর এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। হঠাৎই তার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হতে শুরু করেছে। সে তার চোখের পানি কাউকে দেখাতে চায় না।

রাত এগারোটা দিকে আশিক ঘরে ঢুকলো। তার চোখজোড়া র’ক্তের মতো লাল হয়ে আছে। তুলি বলল, “এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?”

“বন্ধুদের সাথে ছিলাম। কেন? সে কথা দিয়ে তোমার দরকার কি?”

“তখন মা জানতে চাচ্ছিলেন।”

“মা জানতে চাইলে সোজাসুজি আমার কাছে জিজ্ঞেস করত, মাঝে তোমার ভাড়াটিয়া রাখত না। যাইহোক বাড়ির সবাই কোথায় গেছিল? অফিস থেকে ফিরে কাউকে ঘরে দেখলাম না।”

“বাবা-মা বড় ভাইয়ার দোকানে গিয়েছিলেন। আমরা তিন বউ বাড়ি ছিলাম।”

আশিক ভালো-মন্দ কিছুই বললো না। লাইট নিভিয়ে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলো। তুলি হতাশ গলায় বলল, “একটা কথা জানতে চাইবো?”

“কি কথা?”

“আপনি তখন বড় ভাবীর ঘরে কি করছিলেন? নববী বলল.”

তুলি কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই আশিক তার গলা চে’পে ধরলো। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “কি নববী? নববী তোমায় কি বলেছে?”

“নববী কিছু বলেনি। শুধু আমায় ডেকে দিয়েছে।”

আশিক তুলি গলা ছেড়ে একটু সরে গেল। কঠিন মুখে বলল,”এই বাড়িটা আমার বাবার। বড় ভাবীর ঘর বলতে কিছু নেই। তাছাড়া আমি ভাবীর ঘরে যাইনি। বাথরুমে গোসল করতে গেছিলাম।”

তুলি কথা বলতে পারছে না। সমানতালে কাশছে। আশিক তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, “আর কখনও এমন অবান্তর কথা বলবে না। এসব ফালতু কথা শুনলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। তুমি তো জানো বড় ভাবী আমার বোনের মতো। তাছাড়া নববীকে আমার সহ্য হয় না।”

“আমি সেভাবে কিছু বলতে চাইনি।”

“তুমি কোনভাবে কি বলতে চাইতে পারো, তা আমি খুব ভালো করেই জানি। নববীর মতো চরিত্রহীনার কথায় তুমি আমায় সন্দেহ করলে? যে মেয়ে প্রেমিকের সাথে ধরা পড়ার পর বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় তার কথায়? আমি তো ভাবতেই পারছি না!”

“দুঃখিত!”

“আমি যেন আর কখনও তোমায় নববীর আশেপাশে না দেখি। আর যদি কখনো দেখছি তুমি ওই মেয়ের সাথে গাল-গল্প করছ, সেদিন বুঝতে পারবে আমি কি জিনিস!”

তুলি হাসলো। আলোর সল্পতার জন্য সে হাসি আশিকের নজরে পড়লো না। প্রেমিকের সাথে একান্ত সময় কাটাতে গিয়ে ধরা পড়লে দোষটা কি শুধু মেয়েটার ওপর বর্তায়?একার হ ছেলের কোন দোষ থাকে না? নববীকে বাড়ির কেন মানুষ পছন্দ করে না। এমনকি তার স্বামীও তাকে খুব একটা পছন্দ করে না। গত বর্ষায় একান্তে কিছু সময় কাটাতে তালেব নববীর বাড়িতে গিয়েছিল। নববীর মা-বাবা কেউ বাড়ি ছিলেন না। দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা দু’জনে খুব দ্রুত ফিরে আসে। তালেব ওই বাড়িতে ধরা পড়ে যায়। তারপর নানান ঝামেলা শেষে ওদের দুজনের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকে তালেব কেমন বদলে যেতে শুরু করেছে। নববীকে আগের মতো সময় দেয় না, গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। তুলি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলো। শেষরাতে একটু ঝিমুনির মতো এসেছিল, স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। তখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। তুলি খেয়াল করল আশিক বিছানায় নেই। রুমের সাথে লাগানো বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। প্রতিটি শব্দ খুব সাবধানে উচ্চারণ করছে যেন কেউ শুনতে পারে। তবুও কয়েকটা কথা স্পষ্ট শোনা গেল। সে বলছে – মেয়েটার সাথে ছয় মাস বিয়ে হয়েছে। কয়েক রাত একসাথে ছিলাম। সমস্যা হবে না তো?”

চলবে