চৈত্র শেষে পর্ব-০১

0
118

#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১

স্বামীর শার্টের পকেট থেকে অনুর হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটিটা গড়িয়ে পড়তেই সে বেশ চমকে গেল। এই আংটিটা হারানোতে দুইদিন আগে অনুকে কতই না অপবাদ সহ্য করতে হয়েছিল! আংটিটার জন্যই তাদের সম্পর্কের এতো অবনতি আর সেই আংটি কিনা তারই স্বামীর পকেটে! এমন কী সেদিন সবাই যখন অনুকে ছোটোলোক বলে কথা শোনাতে ব্যস্ত তখন আদিত্যও তার সাথে ছিল না। সেও কথা শোনাতে ছাড় দেয়নি। এগুলো ভাবতেই চক্ষুদ্বয়ে আদিত্যর সেদিনের বলা কথাগুলো ভেসে উঠল।

সেদিন ভরা বাড়ির মেহমান ছিল। আদিত্যরই বোনের অনুষ্ঠান ছিল। ভরা মেহমানদের সামনে শাশুড়ি বলেছিল অনু যাতে তার বিয়ের আংটিটা নিয়ে আসে। যদিও তিনি বিষয়টা লুকোচুরি করেই বলেছেন কিন্তু অনু যখন সেটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পেল না তখন সে কথা শাশুড়িকে জানাতেই তিনি উঁচু আওয়াজে গালির সহিত বলে উঠল,
“সামান্য বিয়ের আংটিটাকেও রেহায় দিলা না বৌমা?”

অনু শাশুড়ির হুট্ করে এমন চিৎকার করে এমন কথা বুঝতে পারেনি। তাই সে উত্তর কী দিবে বুঝে উঠেনি। বুঝবে কীভাবে! সে তো জানতো না এসবের মূল কী! সে না বোঝার ভঙ্গিমায় শাশুড়ির জবাব দিল,
“বুঝিনি মা!”

শাশুড়ি আরো আওয়াজ বাড়িয়ে চিৎকারের সহিত প্রতুত্তর করল,
“বুঝোনি? না কি না বোঝার ভাণ করছো?”
তার চিৎকার শুনে আশেপাশের সবার দৃষ্টি অনুর উপর এসে পড়লো। সবাই সিনেমার কোনো দৃশ্য দেখার মতো করে অনুর চারপাশে এসে দাঁড়ালো। তখন অপমানে অনু মাথা নিচু করে ফেলল।

আছিয়া বেগম আরো চিৎকারের সহিত শুধালো,
“এখনো সময় আছে বৌমা। আংটি কই? স্বীকার করো।”

অনু এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। শাশুড়ি তার কাছ থেকে কেমন জবাব আশা করছে তা সে গভীরভাবে ভেবেও পাচ্ছে না। চারদিকে থেকে সবার দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ। অপমানে তার সারা শরীর কাঁপছে। এতটা অপমান সে তার জীবনে কোনোদিন হয়নি। তার চোখ বেয়ে ঝর্ণার স্রোতের মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে প্ৰিয় মানুষ বাবাকে স্মরণ করছে। আজ যদি বাবা এই জায়গায় থাকতো তাহলে কী তিনি তার মেয়ের এমন অপমান দেখতে পেতেন! কীই বা করতেন তিনি!

অনুকে মাথা নিচু করা অবস্থায় দেখে তার শাশুড়ি আছিয়া বেগম আঁচলে মুখ ঢেকে কান্নার ভাণ করে আরো উঁচু আওয়াজের সহিত বলে উঠেছিল,
“এটা আমার ছেলে প্রথম বেতন থেকে কত কষ্ট করে কিনেছিল আর তুমি কিনা সেটা হারিয়ে ফেললে! আদৌ হারিয়ে ফেললে নাকি কোথাও কাউকে দিয়ে দিয়েছো?’

উনার শেষ কথাটা শুনে অনু কান্না চোখেই তাচ্ছিল্য হাসলো। এতক্ষনে তার সব ক্লিয়ার। এজন্যই উনি আন্টি খুঁজে ভরাবাড়ির সামনে অনুর একটা খুঁত বের করার চেষ্টা করেছিল। উনার স্বার্থ হাসিলের জন্য। উনি বৌমা এই সম্বোধনটা শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য বলেছে। উনি তো এমনিতে অপয়া ছাড়া কথাই বলতে পারেন না।

আছিয়া বেগম আর অপেক্ষা করলেন না। তিনি উপরোক্ত কথাগুলো বলেই ছেলের কানে আরো বি’ষ ঢাললেন,
“দেখেছিস বাপ্? তোর সেই প্রথম স্মৃতিটাও যত্নে রাখতে পারলো না। কেমন মেয়ে এনেছিস?”

অনু চোখ তুলে আদিত্যর দিকে ভরসার চোখে তাকালো। এতো এতো অচেনা মানুষের ভিড়ে সেই একমাত্র আপন চেনা মানুষটিকে এগিয়ে আসতে দেখে অনুর চোখেমুখে তীব্র আশা ভেসে উঠল। কিন্তু না, আদিত্য এগিয়ে এসেছিলো ঠিকই কিন্তু সান্ত্বনা বা ভরসা দেওয়ার জন্য নয়। অনুর এখনো সেই নতুন আদিত্যর কথা কানে ভাসে। সেই প্রথম অনুর চেনা আদিত্য সম্পূর্ণ অচেনা আর নতুনরূপে ধরা দিয়েছিল।
আদিত্য এগিয়ে এসে সবার সামনে অনুর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“যে এতসুন্দর বিয়ের দিনের ভালোবাসার যত্ন করে রাখতে পারে না সে আমার কী যত্ন করবে!”বলেই এরপরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
“মা তুমি ঠিকই বলেছিলে, আমিই শুধু শুধু ওর পেছনে দৌড়াচ্ছি। আজ থেকে আর তোমার অমান্য হবো না আমি।” বলেই সে অনুকে এতো গুলো মানুষের মাঝে প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় ফেলে চলে গিয়েছিল। অনুর সেদিন এতো এতো মানুষের প্রশ্নের কোনো জবাব দেওয়ার মতো ভাষা ছিল না। সব নতুন পরিচিত মানুষদের সামনে অপমানে সে ঐভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। পা যেন মেঝের সাথে কেউ আটকে রেখেছে তেমন অবস্থা হয়েছিল।

সেদিনের পরে সম্পর্কের অবনতি শুরু। আর সেই সম্পর্ক ভালো হয়নি। দিন দিন দুরুত্ব। অনুর অভিমান। রাগ হয়েছিল কিন্তু ভালোবাসার মানুষের সাথে রাগ থাকে না, থাকে শুধুই অভিমান। অভিমানটাও কাটিয়ে যেত যদি না আদিত্য সেদিন এসে ক্ষমা চেয়ে নিজের দোষ স্বীকার করতো। কিন্তু না। আদিত্য সেদিন সম্পূর্ণ নতুন রূপে অনুর কাছে ধরা দিয়েছিলো। অনুকে ভুল প্রমাণিত করে আগের আদিত্য ঐদিনই পাল্টে যেতে শুরু করলো।
আর বোকা অনু বুঝতেই পারলো না এসব কিসের জন্য! সে ভাবলো তার সেই স্মৃতি আন্টিটার জন্য হয়ত আদিত্য এমন করেছে। হয়ত আদিত্য অনেকটা কষ্ট পেয়েছে ভেবে অনু তার নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিলো। সেদিন ভেবেছিল ভুল তো তারই। আদিত্যর কথায় তো সঠিক। সেই তো বিয়ের আংটিটা যত্নে রাখতে পারেনি কিন্তু অনুর মন মানতে চাইলো না কারণ সেই বিয়ের আংটিটা অনু অনেক যত্নের সহিত রাখতো। আদিত্যর অনুপস্থিতিতে প্রতিদিন সেই আংটি বের করে স্মৃতিস্মরণ করতো। এরপর যত্নের সহিত একই জায়গায় রেখে দিতো। তাহলে কীভাবে সেটা সরলো!
কিন্তু অনু এই প্রশ্নের উত্তর অন্যকিছু ভাবতে চাইলো না তাই তো সব দোষ মাথা পেতে নিয়েছিল। নিজের মনকে বুঝাতো, হয়ত সেদিন কোনো কারণে অন্য জায়গায় রেখেছে। মনে পড়ছে না হয়ত নাহয় কোথাও হারিয়ে ফেলেছিল। অনু সেদিন পুরো রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেটা আর পেল না। নিজের মনকে বুঝ দিল, তারই দোষ এটা। তাই তো আদিত্য এতো অবহেলার পরেও অনু পেছনে পেছনে ঘুর ঘুর করেছিল। কিন্তু আদিত্যর অনুর উপস্থিতি বিরক্ত হতো সেটা বুঝিয়ে দিতো কিন্তু বো’কা অনু এসবের পেছনে তার হারিয়ে ফেলা আন্টির ঘটনা লুকায়িত ভেবে আরো ঘুরঘুর করতো। ভালোবাসতো, যত্ন নিতো আদিত্যর। কিন্তু সেই আদিত্য কিনা এসবের পেছনে! তবু অনুর বো’কা মন বিশ্বাস করতে চাইলো না।

অনু পেছনে ফিরে খাটে বসা স্বামীর দিকে তাকালো। আদিত্য লেপটপে নিজের মতো করে এক ধ্যানে কাজ করছে। দেখতে কী নিষ্পাপ লাগছে! অথচ… অনু কিছু সময় তাকিয়ে রইল আদিত্যর দিকে।
আদিত্যকে কী জিজ্ঞেস করবে! সে এই আংটিটা কোথায় পেল! আর পেলেও এটা লুকিয়ে কেন রেখেছে! যেটার সূত্র ধরে তাদের সম্পর্কের এতো অবনতি সেটাই বা লুকানোর কী আছে! না কি এর পেছনে আদিত্যর হাত! দ্বিতীয়বার এটা ভাবনাতেই আসতে অনু ভড়কে গেল। এগুলো কী ভাবছে সে! আদিত্য কেন শুধু শুধু আংটিটা সরাতে যাবে! আর সরালেও সে তো কথা শোনাতো না। অনু ভুল ভাবনাগুলো সরিয়ে দিয়ে তার ভাবনাটা ধামা চাপা দিতে চাইলো কিন্তু তবুও কোথাও জানি খটকা লাগলো। ঘুরেফিরে সেই একই উত্তর আসছে অনুর মনে কারণ সেই আংটি আদিত্যর শার্ট এর পকেটেই বা কীভাবে এলো! এই প্রশ্নের উত্তর অনুর কাছে বারবার আসছে। কিন্তু সেই উত্তর সে বিশ্বাস করতে চাইছে না। তাহলে কী সত্যিই আদিত্য তার উপর বিরক্ত? ভালোবেসে যার হাত ধরে এসেছে সেই কিনা সত্যিকারে পাল্টে গিয়েছে! তাহলে তার বাবাই কী সত্যি ছিল!
অনুর মনে এঁকে এঁকে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। সবকিছুর পেছনে কী আদিত্যরই হাত!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।