চৈত্র শেষে পর্ব-১১

0
67

#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১১

অনুর আর কোনো কিছুতে ধ্যান গেল না। তার শুধু মাথায় ঘুরছে বেঁচে থাকলে আদিত্যকে ছেড়েই জীবন এগোতে হবে যা সে এই জীবনে কোনোদিন কল্পনাতেও ভাবেওনি। সবসময় ভেবে এসেছে আদিত্যকে নিয়ে তার একটা সুন্দর ভরা সংসার হবে। সেই জায়গায় আজ আদিত্যর সব পূরণ হবে। কিন্তু অনুর জায়গায় ভিন্ন একজন থাকবে। অনু আর ভাবতে পারলো না। যত ভাববে ততো তার কষ্ট হবে। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ভরে গেছে। অনু চুপচাপ গলায় শাড়ীর কাপড় পেঁচিয়ে ফেলল। এরপরেই ফাঁস নিতে যাবে তখনই দরজা ধাক্কানোর শব্দ পেলো। আনিস মিয়া ডাকছে,

“অনু মা দরজা খোল। মা আমার।”

আনিস মিয়ার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর কানে বাজতেই অনুর কলিজা ধক করে উঠল। তার হুঁশ ফিরে এলো। কী করতে যাচ্ছে সে! সামনে নিজের গলায় ফা’সে’র কাপড় পরিহিত দেখে সে তড়িঘড়ি করে ছিটকে দাঁড়ালো। মুহূর্তের মধ্যে বাবার মুখ ভেসে উঠতেই অনু পেঁচানো শাড়ির থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো। ছি ছি! যে মানুষটা তাকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন বুনছে সে মানুষটাকে সে কষ্ট দিবে! না একদম না!
আদিত্যর কথা মনে আসতেই অনু তাচ্ছিল্য হাসলো। যে মানুষটা তার আংটি চুরি করে তাকে খারাপ সাজিয়েছিল সে মানুষ কেমনে পারবে না বিয়ে করাতে! এখনো কিসের আশা করেছিল অনু! তার তো বোঝা উচিত ছিল ঐদিনই! বুঝেও কেন এতো আশা করেছে! ওই পাষন্ড মানুষটার জন্য তার বাবা নামক ওই প্ৰিয় মানুষটাকে সে আবারো কষ্ট দিতে যাচ্ছিলো! সে কেন শেষ হচ্ছে! প্রতারক তো সে নয়, তবে কিসের জন্য সে নিজেকে শেষ করবে! শুধুই ভালোবাসার জন্য? ভালো তো তাকে আদিত্যর চেয়ে বেশি তার বাবা বাসে। তবে কেন সে একজনের জন্য তার সুন্দর ভবিষ্যত জীবনটা শেষ করবে! তার বাবার তার প্রতি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখাটাকে সে কেন ধূলিসাৎ করে দিবে! তারও তো উচিত ওই মানুষটার কষ্টকে মূল্য দেওয়া।
অনু সামনে থাকা পেঁচানো শাড়িটা টেনে নিয়ে ফেলল। না, সে এই কাজ করতে পারবে না কিছুতেই।

“মা আমার, ভুল কিছু করিস না। বাবাকে দরজা খুলে দেয়। বাবা একটু আসি তোর ঘরে।”
অনু কাপড় লুকিয়ে চেয়ার নামিয়ে ফেলল। তাড়াহুড়োতে চেয়ার খাটের তলায় রাখতে গিয়ে খাটের কিনারায় উল্টে রেখে দিল।
অনু দরজা খুলতেই আনিস মিয়া ঘরে ঢুকলেন। তিনি উদভ্রান্তের ন্যায় এগিয়ে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আনিস মিয়ার এমন বাচ্চামোতে বোঝাই যাচ্ছে উনি অনেক ভয় পেয়েছেন।
অনুর অনুশোচনা হলো। যে বাবা তাকে এতো ভালোবাসে সে বাবাকে সে এতো কষ্ট দিতে যাচ্ছিল! আজ যদি ঝোকের বশে সে নিজেকে শেষ করে দিতো তাহলে তার বাবার কী হতো! যে মানুষটা নিঃস্বার্থ ভাবে তাকে এতো ভালোবাসে!
আনিস মিয়া মেয়ের গাল ধরে আদুরে ভঙ্গিতে শুধালেন,
“তুই ঠিক আছিস তো মা?”

“বাবা আমি ঠিক আছি।” অনু নিজেকে সামলে আনিস মিয়ার প্রতুত্তর করতেই তিনি আদুরে ভঙ্গিতে ভরসা কণ্ঠে জানালেন,
“বাবা আছি তো। এতো অল্পতে নিজেকে এভাবে ভেঙে দিলে হবে?উঠে দাড়াও তুমি। আমার মেয়ে সব পারবে। আমার এই দুর্বল মেয়ে একদিন বড়ো হবে। নিজের একটা সুন্দর ভবিষ্যত গড়বে।”

“কাঁদো। কেঁদে হাল্কা হয়ে যাও।”

“বাবা আমি কাঁদতে পারছি না। কোথাও জানি পাথর আটকে আছে মনে হচ্ছে। বাবা আমার এমন কেন লাগছে!” বলতে বলতেই অনু ডুকরে কেঁদে উঠলো। এতক্ষনে চাপা কান্নাগুলো হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো।

আনিস মিয়ার খারাপ লাগলো। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শুধালেন,
“আজকেই কষ্টের শেষ কান্না কেঁদে নেয়। আজকের পর থেকে ওই জা’নো’য়া’রের জন্য আর কোনো চোখের পানি যেন আমি না দেখি। এই বাবা যতদিন আছি, তোমাকে সর্বোচ্চ ভালো রাখবো।”

অনু ডুকরে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেল।
আনিস মিয়া আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না। মেয়ের চোখের পানি যে সে সহ্য করতে পারে না!
তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে ভঙ্গিতে শুধালেন,
“বাবা তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। তুমি পূরণ করবে তো? নিজের একটা পরিচয় করবে। যারা আজ তোমাকে নিয়ে সমালোচনা করছে তারা একদিন তোমার কাছে এসে তোমার মাথায় দোয়ার হাত বাড়িয়ে দিবে।”

অনু বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আনিস মিয়া মেয়েকে বুকে পরম আদরে আগলে নিলেন। খাটের কিনারায় চেয়ার দেখে তিনি চমকে তাকালেন। তার ধারণায় ঠিক ছিল তাহলে! আরেকটু দেরি হলে কী হতো তা ভাবতেই তার গা শিউরে উঠলো। অথচ সে ভেবেছিল, মেয়ে একা কিছুক্ষন সময় কাটাক। তাই তো সময় দিয়ে মেয়ের রুমের বাইরে ডাইনিং এ বসেছিল। কিন্তু কেন জানি মন কু ডাকছিলো। তাইতো হুট্ করে ডাকাডাকি শুরু করেছিল। ভাগ্য ভালো বলেই তো তিনি ডেকেছেন। নাহয় আরেকটু দেরি হলে কী হতো ভাবতে গিয়েও ভাবতে পারলো না।
“এই পৃথিবীতে যদি কেউ আপন হয় তাহলে আমার সবচেয়ে আপন হলে তুমি। সবার আগে তুমি থাকবে। কেউ না থাকুক। তোমার পাশে আমি তো আছি।”

অনু চুপ হয়ে গেল।
“একবারও ভাবলে না এই বাবার কথা? তুমি না থাকলে এই বুড়ো বাবাটা বাঁচবে কিভাবে?”

অনু কেঁদে উঠল। সে নাক টেনে শুধালো,
” তুমি আছো বলেই তো বাঁচার আশা খুঁজে পাচ্ছি। তোমার মতো বাবা প্রতিটা ঘরে ঘরে থাকুক। তুমি অনেক বছর বাঁচবে বাবা। আমি তোমাকে কিছুতেই হারাবো না। ”

“সৃষ্টিকর্তার ডাক এলে যেতেই হবে। হারানো থেকে বাঁচানোর সাধ্য কারো নেই রে মা।”

আনিস মিয়ার কথা শুনে অনুর মুহূর্তের মধ্যে চোখ ভরে পানি নামলো। বাবার এই কথাগুলো সে সহ্য করতে পারছে না। তাহলে এই মানুষটাকে সে কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবলো কীভাবে! মানুষটা তো তাকে নিয়ে কম ভাবে না তাহলে কোন মুখে পারলো এমন সিদ্ধান্ত নিতে! শুধুমাত্র আদিত্যর জন্য! অনু মুহূর্তের মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। আজ থেকে তার জীবনে আর কোনো আদিত্য নেই। আদিত্য নামের কেউ ছিল না। ওই মানুষটার জন্য আর কোনো চোখের পানি সে ঝরাবে না। আজকেই শেষ। এখন থেকে শুধু বাবার কথায় সে মানবে। অন্তত নিজের জন্য না হোক এই মানুষটার জন্য তো তাকে বাঁচতেই হবে। লক্ষ্য সফল করতেই হবে।

——–

আদিত্য বাইরে এসে সিগারেট ধরালো। তার মুহূর্তের মধ্যে মন ঘুরে গেল।
সে ভেতরে এগিয়ে গেল। অনুষ্ঠান সেই কবেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এর মধ্যে সে রিহির সাথে একটিবার কথাও বলেনি।
সে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। খাটে রিহি বসে আছে।
রিহিকে বসে থাকতে দেখে আদিত্যর মেজাজ আবারো বিগড়ে গেল। যতবার রিহিকে দেখছে ততবার তার অনুর কথা মনে পড়ছে।
আদিত্য বিড়বিড় করে আওড়ালো, “অনু ভালো আছে তো? আমাকে ডিভোর্স দিয়ে তুমি শান্তিতে আছো তো?”
আদিত্যর রিহির জন্য খারাপ লাগলো। সে তো অনুর উপর জেদ করে নিজের ইচ্ছেই রিহিকে বিয়েটা করেছিল। তাহলে রিহি কেন ভোগ করবে এসব! অনুর তাকে ঐভাবে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাওয়াটা আদিত্য মেনে নিতে পারেনি। তার মনে আঘাত লেগেছিল। তার উপর তার মাও অনুকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল। তাই তো আদিত্য রাগের বশে রিহিকে বিয়ে করে ফেলেছিল। তবে রিহির তো কোনো দোষ নেই। সে হাতে থাকা সিগারেট নিয়েই রিহির দিকে এগিয়ে গেল।
“এখানে একই কাপড় নিয়ে বসে আছো কেন?”

রিহি অভিমানের সুরে জানালো,
“এতক্ষন বাদে এলে?”

“আর বকবো না। যাও ফ্রেস হয়ে নাও। ”

“তোমার জন্য খাবার আনি?”

“না লাগবে না।” বলেই আদিত্য বারান্দায় চলে গেল।

“আমি নিয়ে আসছি।” বলেই রিহি পা বাড়াতে নিলে আদিত্য হুট্ করে রেগে গেল। সে রাগীসুরে শাসালো,
“এতো ন্যা’কা’মি তোমার সাথে যায় না। এরূপ আদিক্ষেতা আমার সাথে করতে আসবে না।”
রিহি আর চুপ থাকতে পারলো না। সেও সমানতালে চেঁচিয়ে উঠল,
“তোর কার সাথে যায়। অনুর সাথে?”

অনুর নাম রিহির মুখে শুনতেই আদিত্যর হুট্ করে কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেল। সে চুপচাপ বেরিয়ে গেল।
আর রিহি তাকিয়ে রইল। অনুর কথা বলে বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলল না কি! রিহি মনে মনে আওড়ালো। এখনই ওর সাথে অনুর তুলনা করলে বাড়াবাড়ি হবে। আগে নিজের স্থানটা শক্তপোক্ত করে নিক। তারপর নাহয় দুর্বলতা বুঝে পা দিবে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।