চৈত্র শেষে পর্ব-২+৩

0
67

#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ২ + ৩

অনুর চোখ অশ্রুতে টলমল করে উঠল। আদিত্যর হাত ধরেছিলো সে ভালোবেসে। সেই ভালোবাসায় ভরসা করে অনু এতদূর এসেছে আর সেই আদিত্য কিনা! সৎ মায়ের ঘরে ঠিকমতো খাবার পর্যন্ত পেতো না। সেসময় একদিন কলেজ এ আদিত্য তাকে দেখে প্রেমপত্র দিয়েছিলো। এরপরই এক কাপড়ে তাকে তুলে দিয়েছিলো সৎ মা।

“বেলা তো অনেক হলো। খাবার কী পাবো?”
অনু ভাবনায় এতটা মশগুল ছিল যে আদিত্যর বলা কথাটা শুনেও খেয়াল করলো না। সে পিঠ টেকিয়ে বসাতে আদিত্য অনুর মুখায়ব দেখতে পেল না।
আদিত্য অনুর এমন চুপ বনে যাওয়াতে খটকা লাগল। সে লেপটপ রেখে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। উঠেই অনুর কাছে এগিয়ে এলো।
“কী বলছি? কথা কান দিয়ে ঢুকছে না?”

অনু এবার চোখমুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। সে নিজেকে শক্ত করলো। মনে মনে সব উত্তরের জন্য প্রস্তুত হয়ে রইল। হাতে থাকা আংটিটা উপরে তুলে আদিত্যর চোখের সামনে ধরতেই সে চমকে উঠল। তার দৃষ্টি চোরা। এই দৃষ্টি তো অনু চিনে। আদিত্য কোনো সঠিক কথা বেঠিক করতে গেলে এই দৃষ্টি ব্যবহার করে।
অনু কিছু বলার আগেই আদিত্য তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল,

“এই আংটি তুমি কই পেলে?”

অনু হেসে জবাব দিল, “কেন? তুমি নিজেই সরিয়ে ভুলে গিয়েছো না কি?”

“অনু তুমি ভুল বুঝছো। আংটিটা কোথ থেকে আমার পকেটে গিয়েছে আমি জানি না।”

“তুমি কীভাবে জানো এটা যে তোমার পকেটে পেয়েছি?”
অনুর এমন আকস্মিক সোজাসাপ্টা প্রশ্নে আদিত্য মিইয়ে গেল। সে নিভে যাওয়া কণ্ঠে জবাব দেওয়ার চেষ্ঠা করল,
“না মানে…তোমার হাতে আমার শার্ট তাই ভাবলাম ওখান থেকে পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছো।”

“তাই না কি? কিন্তু তোমার দৃষ্টি তো আমি চিনি আদিত্য। এতটা চোরা দৃষ্টি কেন তোমার? কী নিয়ে ভয় পাচ্ছ তুমি?” অনুর এমন শান্ত কণ্ঠে আদিত্য ভড়কে গেল। সে নিজেকে শক্ত করে জবাব দিল,
“তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো অনু। তোমার সীমা অতিক্রম করিও না।”

অনু আর নিজেকে সংযত করতে পারলো না। সে চেঁচিয়ে আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“অহ আচ্ছা? আমি অতিক্রম করছি সীমা? আর তুমি! তুমি যা করেছো তা কী? তা কী সীমার মধ্যে পড়ে?”

“অনু…” বলেই আদিত্য চ’ড় দিতে উদ্যত হতেই পরক্ষনে হাত গুটিয়ে নিল।

অনু আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজনবোধ মনে করলো না। তার আর ইচ্ছেও হলো না। তার কষ্ট লাগল আদিত্য আজ তাকে মারতে হাত উঠিয়েছে! অথচ দোষটা আদিত্যরই। অনুর যা বোঝার ছিল তা সে বুঝে নিয়েছে।
অনু রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পেছনে থেকে আদিত্য বারবার বোঝাতে চেষ্টা করছে কিন্তু অনু শুনলো না। সে ড্রয়ইং রুম পেরিয়ে গেস্ট রুমের দিকে পা বাড়াতে নিলে রিহিকে তার শাশুড়ির সাথে কুশলাদি বিনিময় করতে দেখতে পেল।

ইদানিং রিহির আনাগোনা বেড়েছে এই বাড়িতে। রিহি আদিত্যর আত্মীয় হয়। আগে তেমন না আসলেও ইদানিং অনেক আসছে। শুরু থেকেই আদিত্যর মা রিহিকে বেশ যত্নে রাখেন তা অনু বিয়ের বছরেই টের পেয়েছে।

রিহি অনুকে ডিঙিয়ে যেতে গিয়ে একটা হাসি দিল। যেই হাসিটা অনুর অনেক বাজে লাগে।
অনুর চোখের সামনেই রিহি আদিত্যর রুমের দিকে পা বাড়ালো। আজ আর অনুর বাঁধা দিতে ইচ্ছে হলো না। কাকে বাঁধা দিবে সে আর কেনই বা দিবে! যে ভয়টা কোনোদিন কল্পনায় ভাবতে চায়নি সে ভয়টাই যে সত্যি হতে যাচ্ছে! আর কী করে আটকাবে সে! আদৌ কী আর আটকানোর উপায় আছে? কাউকে কী জোর করে রাখা যায়!

রিহি আদিত্যর রুমে যাওয়ার পরেও অনু বেশ কিছুক্ষন ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সে আশা করেছিল আদিত্য হয়ত রাগারাগি করবে। চেঁচামেচি করে অনুকে ডাক দিবে। কারণ, রিহি আদিত্যর আত্মীয় হলেও আদিত্য তাকে তেমন একটা পছন্দ করতো না। অনু একদিন এর কারণ জিজ্ঞেস করলে আদিত্য জানিয়েছিল,
“রিহির গায়ে পড়া স্বভাব আমি পছন্দ করি না, আর যখন তখন রুমে ঢুকে যাওয়াটাও ভীষণ অপছন্দের। এই রকমের মেয়ে আমার বিরক্ত লাগে। তাই তো ওকে দেখলেই আমি তোমাকে ডাকাডাকি করে পাশে নিয়ে আসি, যাতে রিহি আর আমার আশেপাশে না ঘেঁষে। পরেরবার থেকে রিহি বাসায় আসলেই তুমি আমার রুমে চলে আসবে।”
সেদিন আদিত্যর এই জবাব অনুর ভীষণ ভালো লেগেছিল। সে মনে মনে বেশ খুশিই হয়েছিল।
অনু উঁকি দিল আদিত্যর রুমের দিকে। সে ভাবল, এখন এখানে থেকে চলে গেলে হয়ত আদিত্য ডাকাডাকি করে ঘর মাথায় তুলবে। যাতে রিহি রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু না… আজকে আদিত্য আর অনুকে ডাকলো না।

“যেটার আশায় দাঁড়িয়ে আছো সেটা আর হবে না। আমার ছেলে তোমাকে আর চায় না।”
আছিয়া বেগমের কথায় অনু ফিরে তাকালো। আছিয়া বেগম কথাটা বলেই ছেলের রুমে চলে গেলেন। আর অনু ঠায় ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। “সে আর তোমাকে চায় না ” কথাটা অনু বার দুয়েক বিড়বিড় করে আওড়ালো। কথাটা সত্যি হলেও তার কেন জানি কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। কথাটা তার এতটাই বি’ষা’ক্ত লেগেছে যে তার মনে হচ্ছে, কানে কোনো পোকা ঢুকেছে। সে উপলব্ধি করছে, আস্তে আস্তে আদিত্য অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তবু বোকা অনুর মন মানতে চাইলো না। তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগলো আজ অনুর শাশুড়িও সব বুঝে গিয়েছে।

অনু ওখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। সে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ করতেই চোখের বাঁধ মানলো না। সে মেঝেতে বসে পড়লো। সে এই বাড়িতে কার আশায় এসেছে! যে কিনা আংটি লুকিয়ে সবার সামনে অনুকে অপরাধী করতে চাইছে তার আশায়! অনুর এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আদিত্য আর আগের মতো নেই। অনু নিজেই বিড়বিড় করে আওড়ালো,
‘মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মানুষ এমন বিশ্রীভাবে পাল্টায়! না কি আমিই ভুল ছিল! আমিই টের করতে পারিনি!’ অনুর চোখ গড়িয়ে অশ্রু নির্গত হতেই সে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। কেন কান্না করছে সে! বাবার কথা না শুনে নিজেই তো বেছে নিয়েছে আদিত্যকে। তাহলে কষ্ট তো তার পাওয়ারই কথা। তার আরো কষ্ট পাওয়ার কথা। শিক্ষা হওয়া দরকার।
সৎ মা তো তাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচে কিন্তু এই বিয়েতে তো বাবা রাজি ছিল না। তিনি আদিত্যর পরিবারকে পছন্দ করেনি। কিন্তু অনুর জোরাজোরিতে রাজি হয়েছিল। আর সেসময় রাজিটাই যে অনুর জন্য অনেক সুখের ছিল। বাবা শেষ দিকে বিদায় দেওয়ার সময় আদিত্যর হাত ধরে সৎ মায়ের আড়ালে বলেছিল,
“বাবা, আমার মেয়ে তোমাকে ভালোবেসেছে। আমার থেকে তোমাকে বেছে নিয়েছে। সেটার অবমূল্যায়ন করিও না।”

আদিত্যও সেদিন মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে জানিয়েছিল, “আমি এটার মূল্য অবশ্যই দিবো। আপনার মেয়েকে সুখে রাখবো। ভরসা করতে পারেন।”
সেদিনের আদিত্যর বলা কথাগুলো অনুর এতদিন যাবৎ ভালো লাগলেও আজ আর ভালো লাগছে না। তার ঘৃ’ণা হলো নিজের প্রতি। সেদিনের কথায় অনুর ভালো লাগা কাজ করে ভরসা হলেও তার বাবা নামক প্ৰিয় মানুষটার হয়ত হয়নি। তাই তো তিনি বারবার সংকোচ করে আদিত্যকে পিছু ডেকেছিল।
আদিত্যর কথায় আনিস মিয়া ভরসা করতে পারেননি। তাইতো উনি গাড়িতে তুলে দিতে গিয়েও একই সুরের কথা আবারো আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,
“যদি কোনোদিন মনে হয় ও তোমার কাছে বোঝা। কোনো কারণে কোনোদিন ওর গায়ে হাত তুলিও না। ও আমার অনেক শখের মেয়ে। প্রয়োজন পড়লে আমার মেয়েকে আমার কাছে দিয়ে যেও। আমার দরজা ওর জন্য সবসময় খোলা।”
অনু সেদিন হেসে বাবাকে আশ্বাস দিয়েছিল,
“এমন কোনোদিন আসবে না বাবা। ও অনেক ভালো।”
বিনিময়ে আনিস মিয়া বলল, “তাই যেন হয়। তোর বাবার দরজা তোর জন্য সবসময় খোলা।”
আদিত্যর সাথে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিলো সেদিন। কিন্তু সেই দিনটা যে সত্যি হবে তা কী করে জানতো সে!

অনু তাচ্ছিল্য হেসে আপনমনেই বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“বাবা! ও তোমার কথা রেখেছে। ও আজ তোমার মেয়ের গায়ে হাত তুলতে গিয়েও তুলেনি। ফিরিয়ে নিয়েছে সেই হাত। শুধু আমিই পারলাম না তোমার কথাটা মানতে। তাই তো আজ এই পরিস্থিতিতে এসে পড়েছি। এখন আমার কী করা দরকার?”বলেই সে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
কাকে বিশ্বাস করেছিল সে! বাবা নামক মানুষটার কথা সে এতটা অবজ্ঞায় উড়িয়ে দিয়েছিল! এখন কার জন্যইবা কষ্ট পাচ্ছে সে! যে মানুষটা তাকে সবার সামনে কথা শোনাতে ছাড় দেয়নি!সে মানুষটার জন্য তার কষ্ট কেন হবে! যেটার দায়ভার অনুর নয়, সেটার দায় অনু কেন নিবে! ঐদিনের ঘটনাটা দ্বিতীয়বার মনে পড়তেই অনুর নিজের জন্য মায়া হলো। তার মনের অন্তরস্তলে ভালোবাসাগুলো ঘৃনারূপে ফিরে আসতে লাগলো।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। দরকার হলে ধরিয়ে দিবেন, আমি শুধরে নিবো। শিখবো তো আপনাদের কাছ থেকেই। অগোছালো হওয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।)

#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৩

ক্ষুদায় অনুর পেট চৌ চৌ করে উঠল। এখন বাজে বেলা বারোটা। আজ সে তার পছন্দের রান্না করেছিল। তাই তো পেট পুরে খাওয়ার জন্য সকালের নাস্তাটাও করা হয়নি। অনুর একটা অভ্যাস সে ক্ষুদা পেটে থাকতে পারে না। যেকোনো মূল্যে তার ক্ষুদা নিবারণ করতে হয়। কিন্তু তবুও বিয়ের পরে সে এই অভ্যাসটাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের শুরুতে প্রথম প্রথম আদিত্য অনেক তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরত। কিন্তু পরবর্তীতে দিন বাড়ার সাথে সাথে আদিত্যর ফেরাটাও দেরিতে হতে শুরু করে। প্রথম প্রথম অনু জিজ্ঞেস করতো কিন্তু আদিত্য কোনো সঠিক জবাব দিতে পারতো না। পরবর্তীতে অনু আর ঘাটতো না। তার মনে হয়েছিল, হয়ত বেশি ঘাটলে সন্দেহ বাড়বে। এতে সংসারে দুঃখ বয়ে আনবে। তাই সে কোনো আশার মতো উত্তর খুঁজে না পেয়ে আর জিজ্ঞেস করতো না। নিজেকে দমিয়ে নিতো। ক্ষুদা পেট সহ্য করতে না পেরেও অনু আদিত্যর জন্য অপেক্ষা করতো। শুকনো খাবার মুড়ি বা কুকিজ খেয়ে সে ক্ষুদা নিবারণ করতো তাৎক্ষণিক। যাতে আদিত্যর একা খাওয়া না লাগে। সারাদিন পরে আদিত্য অনেক রাত করে ফিরত। আর অনু রাতে আদিত্যর জন্য খাবার নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকত। কোনো কোনো সময় অনু আর অপেক্ষা করতে না পেরে টেবিলে হাতের উপর ঐভাবেই ঘুমিয়ে পড়তো।
কথাগুলো মনে হতেই অনু একটা মলিন শ্বাস ফেলল। সাথে দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো।

অনু দুহাত দিয়ে ভালোভাবে মুখ মুছে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। অনেকদিন ভালো আদর্শ বউ সাজা হয়েছে কিন্তু আর না। এমনিতেও ও কারোর মনে আর নেই, তাই আজকের দিনটি নিজের মতো করেই নাহয় কাটাক। আজ অনু নিজের পছন্দের জিনিস রান্না করেছে। সে কেন না খেয়ে থাকবে! এই মাছ তো তার বাবাই তার জন্য পাঠিয়েছে। তবে কেন সে তার শখের মাছ ওদের জন্য রেখে দিবে!
আনিস মিয়া অনুকে ফেলে কিছু খায় না। তার মন না কি কচকচ করে। গত পরশুদিন উনি এসে একটা ইলিশ মাছ দিয়ে গিয়েছে। যদিও উনি মাছটা বাসায় গিয়ে রাখতে পারতেন। কিন্তু না। উনি জানেন, বাসায় নিয়ে গিয়ে অনুর জন্য রাখতে বলা হলে উনাকে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে আর আড়ালে অনুর উপরও এর তির্যক প্রভাব পড়বে। এতে আরো কথা বাড়বে যা উনি চাননি। তাই দুইটা নিয়ে সোজা অনুর শশুরবাড়ির বাইরে থেকে একটা মেয়েকে দিয়ে গিয়েছেন। উনি অনুর শশুরবাড়িতে ঢুকেন না কারণ উনার মনে হয় অনুর উপর তার শাশুড়ির করা কড়া ভাষাগুলো উনি দেখে ফেললে মেয়েকে এখানে আর রাখতে মন সাঁই দিবে না কিন্তু তার মেয়ে তো এখানেই সুখী। তাই উনি এদের মাঝে যাতে না পড়ে সেজন্য যা আনে মেয়েকে বাড়ির উঠান থেকেই দিয়ে চলে যেত।
অনু আজ খুব স্বাদ করে মাছটা রান্না করেছিল।
কিছুক্ষন পরে হলে আদিত্য খেতে আসবে আর এতে তার আদিত্যর ওই ঘৃ’ণার মুখটা দর্শন করা লাগবে তাই অনু আগেই নিজের জন্য নিয়ে আসতে এগিয়ে গেল। অনু নিজে রান্নাঘর থেকে মাছের পাতিল থেকে সবচেয়ে বড়ো পিসটা নিজের পাতে নিল। পিসটা নিতে গিয়ে তার খারাপ লাগা কাজ করলো। কারণ অন্যদিন হলে এই পিসটা সে আদিত্যকে দেয় কিন্তু আজ! অনু জানে আজ ভাত তার গলা দিয়ে নামবে না কিন্তু তবুও সে এমনভাবে প্লেটটা নিল যেন মনে হচ্ছে সে অনেক খাবে।
অনু রান্নাঘরে থেকে চলে আসতে নিতেই দেখল, তার শাশুড়ি আছিয়া বেগম ঢুকছে।
অনু তাকালো। এই মানুষটা সে থাকাকালীন একটা কাজেও হাত দেয় না। রান্নাঘর তো দূরে কিন্তু আজ একদম সোজা এখানে। উনার পিছু পিছু পরোক্ষনে রিহিকে দেখতেই তার টনক নড়লো। রিহি এসে বলল, “তুমি করো না ফুপি। আমি করবো। আমাকে দাও। আমি নিয়ে যাচ্ছি ভাত টেবিলে।” বলতে বলতে ঢুকতে নিতেই অনুকে দেখে চমকে গেল। আর আছিয়া বেগম তো আগে থেকেই ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। বোঝাই যাচ্ছে উনারা কেউই অনুকে এই সময়ে এখানে আশা করেনি। দুজনের এভাবে তাকানো দেখে অনুর খারাপ লাগা কাজ করলেও সে সেটা ঠেলে আড়াল করে ফেলল।
অনুর ভালো লাগলো এই ভেবে যে ওদের মনমতো সে নরম হয়নি। অনু বেশ টের পেল যে ওরা ভেবেছে অনু আজ কান্না করে সারাদিন রুমে বদ্ধ অবস্থায় থাকবে। তাই তো ওরা ওদের মনের ভাবনার উল্টোটা হতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। বিস্ময় যেন কাটছেই না তাদের।

“তুমি আজ এতো তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচ্ছ যে!” আছিয়া বেগমের মুখ বিকৃতি করে কথা বলার ধরণে উনি কী বোঝাতে চাইলো তা অনু বেশ বুঝতে পারলো।

সে কী বুঝে আবারো পাতিলের দিকে ফিরে যেতে যেতে জবাব দিল,
“কী করবো বলুন? আমাকে তো কেউ চায় না। তাই নিজেরটাতো নিজেরই খাওয়া লাগবে।” বলেই সে তার প্লেটে পাতিল থেকে মাছের বড়ো মাথাটা আরেকটা বাটিতে নিয়ে ফেলল।
আছিয়া বেগম ভেবেছিল, অনু তাদেরকে দেখে প্লেট রেখে দিতে ফিরেছে কিন্তু অনু তা না করে যখন পাতিল থেকে মাছের মাথাটা নেয় তখন আছিয়া বেগম দ্বিতীয়বারের মতো বিস্ময় হলেন। তার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, এটা অনুই তো?

অনু প্লেট আর মাছের মাথার বাটিটা নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। সে ইচ্ছাকৃত ভাবে আছিয়া বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,
“তাকিয়ে রইলেন যে?”

আছিয়া বেগম অনুর প্লেটে মাছের মাথাটার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এটা খাবে?”

“হ্যাঁ, আমার বাবা এনেছে আর আমি খাবো না তা হয় না কি! আমার বাবা তার মেয়ের জন্য এনেছেন আর সেটা দিয়ে আমি না খেয়ে থেকে অন্যরা ফুর্তি করে খাবে এটা তো হয় না।”বলেই সে দুজনকে অবাক দৃষ্টিতে রেখে রুমের দিকে পা বাড়ালো। শেষ কথাটা সে রিহির উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবেই বলেছিল। এইবার তার একটু হলেও শান্তি লাগছে। মনের কথা বলে দিলে অনেক হাল্কা লাগে। মনে আর চাপ সৃষ্টি হয় না। কিছুটা হলেও নিজেকে মুক্ত মনে হয়।

আছিয়া বেগম বিস্ময়ে হা হয়ে গেলেন। যে তার ছেলেকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়া করে না সে আজ নিজে আগে খেয়ে নিচ্ছে। তাওবা একদম ভালো পিসটা নিয়ে! এটা তার হজম হচ্ছে না।

রুমে গিয়েই অনু মাছের বড়ো পিস আর মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইল। বিয়ের এই দুই বছরে সে কোনোদিন মাছের বড়ো পিস আর মাথাটা নিজের প্লেটে নেয়নি। আদিত্যকে বড়ো পিস দেওয়ার পাশাপাশি শাশুড়িকে মাছের মাথাটা দিতো। যাতে সে আদর্শ বউ হতে পারে। তবুও যখন শাশুড়ির মন পেল না তখন এসব করে তো আর লাভ নেই। কতই না ভালো বউ হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কিছুতেই হতে পারলো না। অনুর নিজের উপর রাগ হলো। সে ব্যর্থ হয় জেনেও বারবার একই কাজ করতো কারণ ভেবেছিল হয়ত এটাই তার স্থায়ী ঠিকানা। যত তাড়াতাড়ি আপন করে নিবে ততো তারই ভালো। সে ভেবেছিল, আদিত্যর পাশাপাশি তার শাশুড়িও একদিন তাকে কাছে টেনে নিবেন। তাই তো বারবার ওদের চোখে ভালো হওয়ার চেষ্টা করতো। বাধ্য মেয়ে হয়ে থাকতো। আর আজ যখন কাছেরটাই পর হয়ে গেল তাহলে তার তো এসব করার আর মানে হয় না। এতদিন যাবৎ এসব করার জন্য তার নিজের উপর ঘৃণা হলো। অনুর এখন নিজের জন্য তীব্র আফসোস হচ্ছে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।