#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ১১
বিবশ শরীরে রাদ এখনো বাইকে থম মেরে বসে, ওর মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন ধপ ধপ করছে। রাদ শান্ত গম্ভীর মানুষ। অথচ আজ আদি ওর সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আগের বুলিগুলো আওয়ালে হয়তো সম্মুখেই পুঁতে ফেলতো! বেঁচে গেলো। রাগান্বিত রাদের বলিষ্ঠ হাতের চাপে মুঠোফোন এবং হাত দু’টোই কাঁপছে। রাগ, হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে রাদের অচিরেই! মাগরিবের আজানের মধুর ধ্বনিতেই রাদ আকস্মিক সম্বিৎ ফিরে! অর্থাৎ দীর্ঘ লম্বা শ্বাস টেনে মনে মনে আল্লাহর কাছে একটাই পার্থনা করে রাদ,” ওর ইরানী যেভাবেই থাকুক অন্তত যেন সুস্থ এবং ভালো থাকে। দ্রুত যেন সব ঠিক হয়ে যায়।”
রাদ বুঝতে পারছে ইরা ওদের সম্পর্কের বিষয়ে বাসায় জানিয়েছে। নাহলে আদির হাতে ইরার ফোন থাকা অসম্ভব ব্যাপার। থাকলেও ওকে জানিয়ে দিতো ইরা। যেহেতু জানায়নি মানে বাসায় অবশ্যই কিছু হয়েছে। কিয়ৎক্ষন আগেই রাদের মন নেগেটিভ ভাবছিলো সেটাই সত্যি হলো। রাদের রাগ পরে গিয়ে মনে দানা বাঁধে একরাশ ভয়, আশঙ্কা! ওরা কী জোড় করে ইরার বিয়ে দিয়ে দিবে আদির সঙ্গে? আদি এতটা কনফিডেন্টলি কথাগুলো বলছিলো। রাদের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে বাইকটাও নিজে চালিয়ে বাসায় যেতে পারবে না। রাদ গাঢ় ঢোক গিলে। হৃদয়যন্ত্র’টা অসম্ভব ভাবে ধড়ফড় করছে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট জোড়া বিজিয়ে নিলো। গলাটা শুষ্ক লাগছে। ওর হাত জোড়া শঙ্কায় মৃদু কাঁপছে। কে বলে ছেলেরা ভয় পায় না। রাদের আজ ভীষণ ভয় করছে। উন্মনা হয়েই কাঁপা হাতে বাইক স্টার্ট দেয় বাসায় চলে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই মুহূর্তে বাহিরে থাকলে রাদ অঘটন একটা ঘটিয়েই ফেলবে! যেটা সুখ বয়ে আনবে না।
_______________
রাত প্রায় ১২-টা বাজে, আজকাল এতো সুন্দর চাঁদ উঠে আকাশে৷ কখনো মাখনের মতো মেঘের ভাঁজে ভাঁজে লুকোচুরি খেলে, কখনো সগৌরবে গোল বৃত্তটি স্বচ্ছ নীল আকাশে চুপটি করে বসে থাকে। তখন শুধু অবাক নেত্রে দেখতে ইচ্ছে করে চন্দ্রসুন্দরীর মোহমুগ্ধ, বিমুগ্ধ রূপ!
বাগানে বিশাল বিশাল আম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রুপালী চাঁদের দ্যুতি যেন ভিন্ন এক খেলায় মেতে থাকে। এ-ই যে একটু হাত বাড়ালে চক্ষে বিঁধে কোথাও চাঁদের রশ্মিতে সব পরিষ্কার, স্বচ্ছ। যেন হাত থেকেই দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আবার কোথাও আঁধারে ঘেরা! সব অন্ধকার! কী অদ্ভুত। দিন-রাত্রি দু’টোই যেন রোজ রোজ দেখা একটি বিস্ময়কর ম্যাজিক। যেই ম্যাজিকে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অথচ একটু গভীরে ভাবলেই এটি চমৎকার এবং বিস্ময়কর!
আদি উন্মনা হয়ে দাঁড়িয়ে সেই আম বাগানে, যেখানে কিছুদিন পূর্বে প্রেমে মত্ত্ব ছিলো দু’টো মানব-মানবী। আদি ভেবে যাচ্ছে সব এলোমেলো ভাবনা। ওর ভীষণ রকম কষ্ট হচ্ছে দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। চক্ষুদ্বয় বারবার রক্তিমবর্ণ ধারণ করছে। পৃথিবীর সব বড্ড নগন্য মনে হচ্ছে, আবার কখনো সেটাই বিস্ময়কর ঠেকছে। এসব ভাবনার একটা-ই কারণ আজ আদি বড্ড এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। উন্মনা হয়েই ইরার ফোনটা হাতে নিয়ে লক খুলে গ্যালারিতে যায় আদি৷ ওখানে সেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা করার সময় ইরা, রাদের সঙ্গে কিছু সেলফি নিয়েছিলো। আদি জুম করে রাদ’কে দেখলো খুটিখুটিয়ে। এক দেখায় ছেলেটাকে ভদ্র ফ্যামিলির, এবং ভালো ছেলে মনে হচ্ছে। নিঃসন্দেহে চমৎকার দেখতেও ছেলেটা। ফর্মাল পোশাকে নিমজ্জিত বলে কী? দেখেই মনে হচ্ছে বড় অফিসের বড় কর্মকর্তা সে! তবে ইরার সঙ্গে বেমানান লাগছে ছেলে’টাকে। ইরার গায়ের রঙ শ্যামবর্ণের, অথচ ছেলেটা একদম ফর্সা! চক্ষে বিঁধে গেলো সেটা। আদি ভারাক্রান্ত হয়ে ভাবনায় পরে গেলো। এই সুদর্শন ছেলেটা ইরা’কে কেন ভালোবাসে?
ইরার সঙ্গে বিয়েতে প্রথমে রাজি ছিলোনা আদি এর কারণ সম্পর্কে বোন, এবং ইরা’র গায়ের চাপা রঙ দু’টোই বড়সড় কারণ ছিলো। কিন্তু সেটা কাউকে বলেনি আদি। ইরা’কে ও অনেকটা অন্য চোখেই দেখতো ছোট বেলা থেকে। হয়তো বোনের চোখেই দেখতো না ও৷ মনে হতো এ-ই মেয়ের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। কোনও কিছুতেই ইরা পার্ফেক্ট নয়। পড়াশোনাটাও ওর ভয়েই করতো এ-ই মেয়ে। আলাদা করে ওর কোনও গুণ নেই। তবে ইরা মিশুক, প্রাণবন্ত মেয়ে। সেটাও আদির কাছে ইরেটেটিং লাগতো এতো কথা বলে মেয়েটা। সব মিলিয়ে ওর অবজ্ঞার পাত্রী ছিলো ইরা। কিন্তু ঐযে অন্য চোখে দেখতো আদি ইরা’কে, ইরার মায়ায় আঁটকে গিয়েছিল ও আসলে বহু আগেই। কিন্তু ওর মস্তিষ্কে ইরা’কে নিয়ে ছিলো অনেক অপছন্দের মেলা। তা-ই এসবে কখনো পাত্তাই দেয়নি আদি। কিন্তু বাবা বিয়ের কথা বলতেই মস্তিষ্ক হেরে গেলো। এতো এতো অপছন্দের কারণ থাকতেও মন জিতে গেলো। মেয়ে’টাকে ভালোবাসে আদি! সেটাও অনেক আগে থেকে! শুধু বুঝতে পারেনি বা বুঝার চেষ্টাও করেনি। কিন্তু ইরার কাছে আজ আদি শুধু মাত্র ঘৃণার পাত্র। এবং এই ছবিগুলো প্রমাণ করছে ইরা ওর থেকে ব্যাটার ডিজার্ভ করে এবং ও সেরকম কিছু জীবনে খুঁজেও পেয়েছে! ইরার জীবনে আদির কোনও জায়গা অবশিষ্ট নেই!
আদি একরাশ দমবন্ধ অনুভূতি নিয়েও ইরা, রাদের একের পর এক ছবি দেখতে লাগলো। প্রত্যেকটি ছবিতে ইরা, রাদের প্রাণখোলা হাসি আদির বক্ষঃপঞ্জর ছিন্ন’ভিন্ন খ’ণ্ড’বিখ’ণ্ড করতে যথেষ্ট! হৃদয়ে সূক্ষ্ম ব্যাথা তিরতির করে বাড়ছে। ইরা কখনোই এভাবে ওর সামনে হাসেনা৷ এতটা সান্নিধ্যেও আসেনি! ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। যতই ছবি গুলো দেখছে খারাপ লাগা কয়েকশো গুণ বাড়ছে। ধীরে ধীরে কষ্ট গুলো রাগে, জেদে পরিনত হচ্ছে। মনে মনে জেদ চাপছে ও কখনো ইরার বিয়ে এই ছেলের সঙ্গে হতে দিবেনা। কিছুতেই না। আদি রাগী, বদ-মেজাজি মানুষ। ওর স্বভাব সুলভ ভেবে আদি হনহনিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো!
____________
আফরোজ ছেলের অপেক্ষায় ডাইনিং এ বসে। আদির রাগ সম্পর্কে সবাই অবগত। সেই জন্যেই ইরার রুমের দরজা খোলার সাহস হয়নি কারোর-ই। কিন্তু মেয়েটা সে-ই সকালে খেয়েছিলো এখনো অভুক্ত! সবাই-ই রেগে শুয়ে পড়লেও আফরোজ ইরা আদিকে না খাইয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারছেন না। উনি ইরা’কে কয়েকবার ডেকেছেন মেয়েটা কোনও রা, সারা দেয়নি। একে ছোট মানুষ, তম্মধ্যে এই সময় আবেগ অনুভূতি ভীষণ প্রখর থাকে। সামান্য ধমক গায়ে বাঁধে। সেখানে আজ প্রথমবারের মতো বাড়ির ছেলে হাত উঠিয়েছে মেয়েটার উপর। নিজের ক্ষতি করে ফেলল নাকি সেটা নিয়েও বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন আফরোজ।
উনার রাশি রাশি ভাবনাচিন্তা অবসান ঘটিয়ে আচমকা সশব্দে আদি মেইনডোর খুলে বাড়ি’তে প্রবেশ করে। আফরোজ শব্দ শুনেই বুঝলেন ছেলে এসেছে। ঠাওর হলো ছেলে এখনো যথেষ্ট রেগে! মায়ের মন সন্তানের ভাবভঙ্গি বুঝতে সময় ব্যায় করতে হয়না। আদি নিঃশব্দে ডাইনিং পেরিয়ে সোজা রুমে ঢুকে গেলো। চিন্তিত মায়ের উপরেও ওর গম্ভীর দৃষ্টি একবারের জন্যেও পড়েনি।
চিন্তিত আফরোজ আরও আধঘন্টা বসে রইলেন। আদি যখন ফ্রেশ হয়ে মাত্র বিছানায় গিয়ে বসেছে হয়তো। তখন ছেলের মতিগতি বুঝেই পরে ধীরপায়ে আদির রুমে ঢুকে দেখলেন। ছেলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আফরোজ ছেলের সম্মুখে বিছানায় বসলেন নরম, কোমল হাতটা ছেলের পায়ে রাখলেন। আদি চমকে উঠে চক্ষুমেলে চায়। ঘটনা বুঝে তৎক্ষনাৎ দ্রুত মায়ের হাত ধরে রাগান্বিত গলায় শুধায়,
—” কী করছো মা, তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন!”
আফরোজ ছেলের মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পারলেন উনার ছেলেও ভালো নেই। আজকে ইরার ব্যাবহারে কষ্ট পেয়েছে ভীষণ! তবুও উনি নরম গলায় বললেন,
—” যা হওয়ার হয়ে গেছে বাবা। তুই খেয়েনে। মেয়েটা এখনো রুমবন্দী কিছু খায়নি। এভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে না মেয়েটা!”
ইরার কথা শুনে আদির ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো আদি। কণ্ঠে রাগ ঢেলে বিষণ্ণ, গম্ভীর গলায় বলল,
—” একরাত না খেয়ে থাকলে মরে যাবে না ও। ছোট বাবা ছোট মাও নিশ্চয়ই খায়নি। ওরা কী মরে যাচ্ছে? ওদের কষ্ট হচ্ছে না? ”
আফরোজ বেগম ছেলের অভিমান, রাগ ধরতে পারলেন। কিন্তু ইরা কী কখনো আদির মন বুঝবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি ক্ষীণ আওয়াজে শুধালেন,
—” ইরা সে-ই সকালে খেয়েছিলো। মেয়েটা ইদানীং এমনিতেই ঠিক মতো খায়না। সেদিনও মাথা ঘুরিয়ে পরে যাচ্ছিলো। আমি বরং একটু ওকে দেখেই আসি?”
আদি রুদ্ধশ্বাস ফেলে। জোড়ালো গলায় বলে,
—” মা আমি এমন করতে চাইনি। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি ওকে আগলে রাখতে পারিনি? আমার ছায়াতলে থেকেও ইরা এসব কী করে করলো!”
আদির কণ্ঠে হতে স্পষ্ট আফসোস, হতাশা ঝরে ঝরে পড়ছে। আফরোজ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কিঞ্চিৎ হতাশ গলায় বললেন,
—” পাহারা দিয়ে কী ভাগ্য বদলানো যায় বল? যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন সবাই এভাবে মেয়েটার সাথে রাগ দেখালে হবে? ছোট মানুষ ভুল করে ফেলেছে। খাবারটা অন্তত দিয়ে আসি বাবা!”
আদির রাগ উঠে গেলো! আচমকা চিল্লিয়ে উঠলো,
—” মা একদম ওর হয়ে দরদ দেখাতে আসবে না। কান খুলে শুনে রাখো, আসবে না। যাও ঘুমিয়ে পরো!”
বলেই আদি উঠে বসে লম্বা লম্বা দম ফেলে। ছেলে’কে বুঝাতে এসে নিজেও হাল ছেড়ে দিলেন আফরোজ। রাগ হলো উনার আদির এহেন জেদ দেখে। এই ছেলেটাকেও সবাই আদরে আদরে বেশী গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন৷ যার ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে। উনি রাগ সামলাতে পারলেন না কড়া গলায় বলে উঠলেন,
—” বিয়ে করতে আমাদের কথাতেই রাজি হয়েছিলি। তুই তো ইরা’কে পছন্দ করতিনা। তাহলে এতো কিসের রাগ তোর। এই রাগ জেদ না তোকে ধ্বংস করে দেয় বাবা। ”
আফরোজ সশব্দে হেঁটে রুম ত্যাগ করলেন। আদি মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ছাইচাপা রাগ দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। কেউ কেন বুঝতে পারছে না ওর কষ্টগুলো। আদির বুক জ্বলে যাচ্ছে, আঙ্গার হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। মা ঠিক বলেছে ও ধ্বংস হ’য়ে গেছে। এই রাগ, জেদের জন্যেই ইরা’কে নিজের ভালোবাসার সাথে পরিচয় করাতে পারেনি। ও ব্যার্থ! ভাই হিসেবে ব্যার্থ, প্রেমিক পুরুষ তো ও নিজেকে বলতেও পারবেনা। শাসিয়ে, রাগ, জেদ অধিপত্য দেখিয়ে আর যাইহোক ভালোবাসা হয় না। আদি আজ আবিষ্কার করলো, ও ভালোবাসতেই জানেনা। আগলে রাখতে জানে না। ভালোবাসা কী সেটাই হয়তো আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি! অন্তর বিষিয়ে উঠলো আদির। নিজেকে তিরস্কার করতে সময় ব্যায় করে না ও।
_______________
রাত প্রায় ১-টায় আদি ইরা’কে দেখতে ওর রুমে এলো। আফরোজ তখনও ডাইনিং এ বসে কাঁদছিলো। মেয়ের জন্য কাঁদছিলো, না নিজের ছেলের জন্য, আদি জানেনা। মায়ের কান্নার ফলস্বরূপ মা’কে দেখিয়ে প্রথমে নিজে খেয়েছে। এবং বাধ্যতামূলক মা’কে শান্ত করতে ইরার জন্য খাবার নিয়ে ওর রুমে এসেছে।
ইরা বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে তখনও কাঁদছিলো বসে বসে। নিঃশব্দে ক্রন্দনতর ইরা যখন আদিকে রুমে ঢুকতে দেখলো। সশব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো। আদি দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিলো যেন ওর কান্না আজমল খানের কর্ণধার না হয়। তাহলে আদির রাগ আদির উপরেই ভীষণ ভারী পড়বে। ইরা’তে উনি চরম ভাবে দূর্বল। এটা ওদের চোদ্দগুষ্টি শুদ্ধ মানুষ জানেন। শুধু ছোট্ট ফুপি এই মানুষটা এসবের পরওয়া করেন না। তবে শুধু মাত্র আজমল খানের জন্যেই আদি ইরা’কে পেয়েও হয়তো পাবে না। তিক্ততা ভর্তি ভাবনা গুলো আর ভাবতে পারলো না আদি!
খাবার প্লেট ইরার পড়ার টেবিলে রেখে আদি ইরার সম্মুখে গিয়ে বসলো। আদির বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে মাত্রাঅতিরিক্ত ভাবে। যাইহোক কেউ কখনো ইরার উপর হাত উঠায়নি অথচ আজ মেরেছে। তখন ছোট মায়ের আঘাত দেখেই আদির রাগ হচ্ছিলো। এখন নিজেকে আঘাত করতে ইচ্ছে করছে নিজেও একি কাজ করেছে। অতিরিক্ত কান্নার ফলস্বরূপ ইরার শ্যাম মুখশ্রীর বিধ্বস্ত, বিষণ্ণ, পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে। না খাওয়া মুখটা ভয়ে চুপসে আছে। ওকে এভাবে দেখে আদির বক্ষপিঞ্জরের জ্বালাপোড়া অনুভূতি তীব্র যন্ত্রণার রূপ ধারণ করলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো আদি কাঁপা কাঁপা হাতে। ইরা আকস্মিক ঝাপিয়ে পরলো আদির বুকে। হু হু করে কাঁদছে মেয়েটা। বড় বড় শ্বাস ফেলছে। কান্নার তোড়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে কেঁপে উঠছে। অস্পষ্ট, গলায় বার বার বলছে,
—” স্যরি ভাইয়া, আমি তোমাদের কষ্ট দিতে চাইনি..আমি।”
ইরা কান্নার ফলস্বরূপ কথা বলতে পারছে না। আদি ইরার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয়। তৎপরে মাথায় চুমু খেলো। ক্ষীণ আওয়াজে ভরাট গলায় বলে,
—” এসো আমার সঙ্গে, খেতে হবে।”
আদি ওকে উঠিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ইরা ঝাপসা দেখছিলো চক্ষে। আদি ওকে ধরে নিজেই চোখে, মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। কিছুটা ধাতস্থ হয় ইরা আদির অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাবহারে! সব থেকে বড় কথা এতকিছুর পরেও আদি ওকে তুমি সম্মোধন করেছে মানে আদি সম্পূর্ণ আদি রূপে আছে। পূর্ণ রূপটা যে ওর রাগী, গম্ভীর, এবং বদমেজাজি। ইরা শান্ত হয় অনেকটা। চক্ষুদ্বয় সহ সম্পূর্ণ মুখ ফুলে গিয়েছে ইরার কাঁদতে কাঁদতে। সারাদিন অভুক্ত মেয়েটা টলছিলো রীতিমতো। আদি কাঁপতে থাকা ইরা’কে ধরে রুমে নিয়ে যায়। বেডে বসিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে, নিজ হাতে ভাত মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। ইরার যদিও খাবার গুলো গলা দিয়ে নামতে চাচ্ছিলো না ভয়ে, আতঙ্কে। তবুও চুপচাপ খাচ্ছিলো৷ আদি এটা বুঝতে পেরেও অবিচল খাইয়ে যাচ্ছিলো। ইরার খাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি ছিলো। সেটা ইরা’কে দেখে উপলব্ধি করতে পেরেছে আদি। অথচ ওর মা, না দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছে সেটা। এর নাম মা! ইরা’কে সবটুকু খাইয়ে পানি খেতে দিয়ে আদি ক্ষান্ত হলো! গম্ভীর গলায় বলল,
—” শুয়ে পরো, আর হ্যাঁ। গায়ে হাত উঠানোর জন্য এক্সট্রিমলি স্যরি। ”
ইরার চক্ষুদ্বয়ে পুনরায় অথৈজল টলমল করছে! রুদ্ধশ্বাসে জমাটবদ্ধ গলায় কিছু বলতে চাইলো। আদি ওকে কিছু বলতে না দিয়ে পুনরায় গম্ভীর রাশভারী গলায় বলল,
—” আমাকে রিকুয়েষ্ট করতে হবে না। আমি জানি আমি বদমেজাজি মানুষ, ভালো না। আমাকে বিয়ে করা যায় না। তাই বলে আমার কথা শুনতে আমি কাউকে জোড় করিনি। বাবা যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি মাথা পেতে নিবো।”
ব’লে আদি প্লেট হাতে রুম থেকে বেরুতে উদ্বেগ হয়েও আচানক থেমে গেলো, পেছন ফিরে পূর্ণদৃষ্টিতে ইরার উৎসুক জনতা মুখে নির্মিমেষ নেত্র বিদ্ধ করলো। অন্যরকম গলায় বলল,
—” আমি রাগে অনেক কিছু বলি ইরা। কিন্তু কখনো তোমার খারাপ চাইনা! ওতোটা খারাপ না। যতটা তুমি ভাবো আমাকে। ”
বাক্য সম্পূর্ণ করে আদি এক মিনিট দাঁড়ায় না শশব্যস্ত পায়ে রুম ত্যাগ করে। আদির শ্লেষাত্মক বাক্যটি ইরার কানে ঝুমঝুম করে বাজতে লাগলো। ভীষণ করুণ, অপরাধীর ন্যায় শোনাচ্ছিলো আদির কন্ঠ’টা। কিন্তু ইরা আদি’কে নিয়ে দীর্ঘ প্রহর ভাবতে পারলো না। ওর মাথায় শুধু মাত্র ওর প্রাণপুরুষ ঘুরছে। আদি বলে তো গেলো বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিবে। কিন্তু বিকেলে যে ওর ফোনের লক খুলে নিয়ে যায় আদি। নিশ্চয়ই কিছু করেছে ফোন দিয়ে। রাদ’কে উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি তো? যতই এই ছেলে করুণ গলায় কথা বলুক। ইরা জানে রাগলে আদির মাথা ঠিক থাকে না।
চলবে!
#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ১২
ভালোবাসা! এই ছোট্ট শব্দটায় আছে সম্মোহনী এক মন্ত্র! যা একবার অনুভূত হতেই। বয়স, সময়, কাল, পাত্র, জাত, ধর্ম এগুলো কিছুই মাথায় থাকে না। মন মস্তিষ্ক মানতে চায়না শত, সহস্ররূপে বাঁধা। ভালোবাসা হচ্ছে আবেগ, তুখোড় যন্ত্রণাময় এক আবেগ। সেই আবেগ অনুভূতিতে সামান্য আঁচ তীক্ষ্ণ ব্যাথায় জর্জরিত হবে আপনার বক্ষঃস্থল, হৃদপিণ্ড। অথচ সেই যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত বক্ষঃস্থল জুড়ে থাকবে শুধু এক জনের বাস। তার জন্যেই ভালোবাসা, চিন্তা, উৎকাণ্ঠা! ভালোবাসার হাওয়ায় একবার গা ভাসালে শত যন্ত্রণাতেও মুক্তি মিলবেনা। মুক্তি দিবেন না আপনি নিজে-ই। কেননা এই যন্ত্রণাতেও লুকিয়ে আছে ভালোবাসা, মায়া, অদৃশ্য শেকল। সেই অদৃশ্য ভালোবাসা, মায়া শুধু ভালোবাসারাই উপলব্ধি করতে সক্ষম। অন্যকারো কাছে সেটা শুধু-ই ক্ষণিকের আবেগ, মোহ কিংবা নেশা মনে হতে-ই পারে।
তুখোড়, যন্ত্রণাময় ভালোবাসায় গা ডুবানো, স্বেচ্ছায় গা ভাসানো রাদ। প্রেয়সী ওর ইরানীর চিন্তায়, উৎকাণ্ঠিত হয়ে বাসায় গিয়ে ক্ষণকালের জন্য স্থীর থাকতে সক্ষম হয়নি। ও না-চাইতেও স্বাভাবিক থেকেও অস্বাভাবিক আচরণে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অস্থিরতায় ক্ষণে ক্ষণে ছন্নছাড়া আচরণ করছিলো। অফিস থেকে সেই সন্ধ্যায় ফিরলেও ফ্রেশ হয়নি। খাওয়া দাওয়া তো দূর-সাধ্য বিষয়৷ গায়ের কোর্ট খুলে ফেললেও অফিসের সাদা ধবধবে ঘামে ভেজা, আয়রন নষ্ট হয়ে যাওয়া শার্ট, প্যান্ট, জুতো সব এলোমেলো হয়ে গেলেও ওগুলো পড়েই রাদ রুমের বারান্দার দরজায় ঠায় বসে থাকে। কখনো বা উঠে ঘরময় পায়চারী করে। বিষাদে ওর মন তিক্ততায় ছেয়ে যায়! যা ওর আদলে স্পষ্ট ফুটে উঠে! এভাবে রাত দশ-টা পর্যন্ত চলার পর। জুহার চক্ষে বিঁধে ছেলের অস্বাভাবিক আচরণ। বিষণ্ণ, বিধ্বস্ত মুখ! তৎপরে জুহা ব্যাস্ত হয়ে পরলো ওকে এভাবে দেখে। অথচ মা’য়ের চিন্তায় রাদ আজ নিজের মন ভোলাতে পারছে না। জুহা বারবার প্রশ্ন করলেও উত্তরেও কোঠা বরাবরের মতোই শূন্য।
কাশিশ আজ কোনও কারণে তখনও বাসায় ফিরেনি। জুহা উপায় না পেয়ে কাশিশ’কে ফোন দিয়ে সব জানায়। কাশিশ তৎক্ষনাৎ কালবিলম্ব না করে আধঘন্টার মধ্যে বাসায় ফিরে। তন্মধ্যে রাদের কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য হয়নি। কাশিশ বাসায় ফিরে একবার প্রগাঢ়, তুখোড় চক্ষে বন্ধু কম ভাই’কে অবলোকন করে। ভ্রুঁদ্বয় কুঞ্চিত করে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে,
—” কিরে? কী হয়েছে? ইরা কী কিছু করেছে? ”
অত্যাধিক নিচু কাশিরের কন্ঠ! যেন বাহিরে থাকা, চিন্তিত মায়ের কানে না যায় কোনও শঙ্কা জড়িত বাক্য। রাদ শুধু ঘাড় উঁচিয়ে বন্ধুর দিকে নেত্র বিদ্ধ করে নির্মিমেষ, নির্লিপ্ত চাহুনি ছুড়ে দিলো! সময় নিয়ে ভারাক্রান্ত, খসখসে গলায় বলল,
—” আমাকে একটু ইরার বাসার সামনে নিয়ে যাবি? আমি বাইক দিয়ে যাওয়ার শক্তি পাচ্ছি না।”
কাশিশ কখনো বন্ধুর এমন রূপ, অভিব্যক্তির মুখোমুখি হয়নি। রাদ বরাবরই শান্ত শক্ত মনের মানুষ ওর জীবনে কষ্ট বলতে ওর মায়ের অতীত। কিন্তু সেটা নিয়েও রাদ কখনো এতটা ভেঙে পড়েনি। আজ রাদ’কে সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে কাশিশের। প্রবল আত্মবিশ্বাসী রাদ’কে আজ মোটেও আত্মবিশ্বাসী লাগছে না। এ-র কারণ কী! কী এমন হলো কাশিশ বুঝতে পারলো না! শুধু ক্ষীণ, ফ্যাকাসে গলায় বলল,
—” চল!”
অতঃপর রাদের হাত ধরে উঠিয়ে দুই বন্ধ বাহিরে যেতে যেতেই জুহার উদ্দেশ্য কাশিশ শুধায়,
—” ওর ইরানী নাকি অসুস্থ বুঝলে, চিন্তা হচ্ছে ওর। তা-ই এমন করছে। তুমি একদম চিন্তা করো না। একটু দেখা করিয়ে আসি ভাবীর সাথে দেখবা তোমার পোলা আগুনের গোলা একদম ঠিক!”
জুহা ছেলের জন্য খাবার নিচ্ছিলো। কাশিশ এসেছে বলে কয়ে খাইয়ে দিবে। কিন্তু এভাবে দু’জনকে চলে যেতে দেখে এবং কাশিশের বুলিতে যতই দুষ্টুমি থাকুক উনি স্পষ্ট বুঝেছেন অবশ্যই জটিল কিছু হয়েছে ইরা সংক্রান্ত। না হলে গম্ভীর, বুঝদার, বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটা এভাবে ভেঙে পরতে পারেনা। এর থেকে-ও যে বড়বড় অসাধ্য সাধন করেছে রাদ। তবে আজ কী এমন হয়েছে এভাবে ভেঙে পরলো ছেলে’টা? ভালোবাসায় যে একবার ডুবলে হয় চিরকালের সুখ, না হয় চিরকালের দুঃখ এই দুঃখের কোনও সমাপ্তি নেই, মৃত্যুর আগে এর সমাপ্তি নেই। এটা জুহার থেকে ভালো’কে জানে? জুহা চান না অতিরিক্ত ভালোবাসা উনার মতো উনার ছেলের জীবনটাও বিষাদে বিষাক্ত হয়ে যাক! কিন্তু ভাগ্য যেন মা ছেলের জীবনটা এক সুতোয় বেঁধে ফেলছেন। ভয়ার্ত আতঙ্কিত জুহা তৎক্ষনাৎ আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে চাইলেন ছেলের জন্য শান্তি, স্বস্তি, সুখ৷ ইরা নামক সুখ। মায়ের দোয়া কবুল হয় নাকি! উনি চান আজ উনার দোয়া কবুল হোক। কবুল হোক রাদের সুখ!
_________
কাশিশ ড্রাইভে সম্পূর্ণ মনোযোগ রেখেও চিন্তিত, ভারী গলায় বলল,
—” কী হলো, এবার খুলে বলতো! তোকে এভাবে কখনো দেখিনি ভাই!”
বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাদ সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল। অতঃপর গাম্ভীর্যের সাথে নিজের অভ্যন্তরে গর্জে উঠা একেকটা প্রশ্ন খুলে বলতে শুরু করলো, প্রান প্রিয় বন্ধুকে। ওর নিষ্প্রভ মলিন গলায়,
—” আমি ভয় পেতাম না কাশিশ, ইরানীর বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক হলেও আমি ম্যানেজ করতে পারতাম সবটা, বিয়ে ভেঙ্গে! কিন্তু আদি ইরার কাজিন। সম্পূর্ণ ফ্যামিলি মিলে সব মিটিয়ে নিলে আমার কিছু করার থাকবে না। আদিত্য আজ যেভাবে বলল ও সব জানে বাট ওর কিচ্ছু যায় আসেনা। তাছাড়া ইরা ওর মা’কে ছাড়া আমাদের কথা কাউ’কে বলতেও পারেনি। বলবেই বা কী করে। আন্টি ওর মন ভেঙে দিয়েছে। ভয় দেখিয়েছে। কাশিশ আ’ম টোটালি ব্রকেন!”
কাশিশ বন্ধু’কে শান্তনা দিবে কী। ও নিজে-ই রুদ্ধশ্বাস ফেলতে শুরু করলো। মন মস্তিষ্কে সব কেমন কমপ্লিকেটেট হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তে! কাশিশ অবশেষে মুখ খুললো! বিবশ গলায় বলল,
—” কোনও ভাবে কী ইরার সাথে যোগাযোগ করার ওয়ে নেই? ”
এই প্রশ্নে রাদের গাঁ জ্বলে উঠে রাগে! উগ্রমেজাজী হয়ে উঠে ভীত, চিন্তিত মন! রাগান্বিত গলায় তেজ ঢেলে বলল,
—“মেয়েটা কাউকে আমাদের ব্যাপারে বলেনি। কী হতো বললে? কী এমন হতো! আমি ওর ফ্রেন্ড সার্কেল সম্পূর্ণ চিনি। কিন্তু এভাবে হুট করে কে হেল্প করবে আমাকে বলতো? মাঝেমধ্যে না আমার ইরা’কে…!”
রাগান্বিত রাদের কণ্ঠেনালী কাঁপছিলো৷ ফলস্বরূপ মুখনিঃসৃত হতো উলটা পালটা বাক্য। যা রাদ চায় না। ফলস্বরূপ থম মেরে বসে রইলো! কাশিশ নিজেও আর কথা বাড়ায়নি! কয়েক মুহূর্তে ওরা পৌঁছে গেলো ইরার বাসার সেই তিন-রাস্তার মোড়ে! কিন্তু এখন কী করবে? কিছু বলার ও নেই৷ রাদ কখনো বিশ্রী ভাষায় কাউকে গালি দেয়নি। কিন্তু আজ মনে মনে আদি’কে ও ভয়ংকর মাত্রায় কিছু গালি দিলো। এ-ই ছেলে’টার জন্য ইরা সর্বক্ষণ ভীতসন্ত্রস্ত থাকতো। আজ ইরার ভয় পরিপূর্ণ হলো। মেরে পুঁতে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে ঐ ডিজাস্টার ছেলেটাকে! কিন্তু..! রাদ মাথা দু-হাতে চেপে ধরে। মুখনিঃসৃত হয় কিছু বিরক্তিকর শব্দ,” উফ!”
সে-ই থেকে দুই বন্ধু ইরার বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে বসে আছে। এবং কাশিশ ভাবছে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের ভাবনা গুলো। ভালোবাসা নিয়ে ভাবনা গুলো। কী অদ্ভুত কত কঠিন মুহূর্ত পারি দিতে দেখেছে রাদ’কে জীবনে অথচ আজ’কের মতো অস্থির, উদ্ভ্রান্তের ন্যায় হতে কখনো দেখেনি! কখনো না। কে বলবে পাশের ছেলেটা বয়স ৩০-ছুইছুই! আবেগের বয়স নেই তার! অথচ কিন্ডারগার্টেন প্রেমিক’দের মতো তার অস্থিরতা। এ-ই যে দেখা হবে না জেনেও রাত সে-ই ১১টায় এসেছিলো। এখন দুই-টা বাজে এখনো প্রেয়সীর বাসার সামনে বসে আছে। একটি বার ফিরে যাওয়ার কথা ভুলেও উচ্চারণ করছে না। কাশিশ যদি ফিরে যাওয়ার কথা বলে ফেলে, সে-ই ভয়ে ওর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। কাশিশ আচমকা ঠোঁট প্রশ্বস্ত করে একটু হাসলো নির্মল, নিঃশব্দ সেই হাসি। আকস্মিক মনে হলো। ভালোবাসা সুন্দর। এ-ই যে রাদের অস্থিরতা, ব্যাকুলতা, উদ্ভ্রান্তের ন্যায় চঞ্চলতা দেখতে খারাপ লাগলেও। কেউ কাউ’কে এতটা ভালোবাসে সেটা ফিল করতেও ভালো লাগছে। অভ্যন্তরে কেমন শান্তি, শান্তি অনুভব হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে ভালোবাসা অনুভব করাও সুন্দর। দেখেও শান্তি!
রাত তিন-টা বাজতেই রাদ গাঢ়, রাশভারি গলায় বলল,
—” আচ্ছা মেডিসিন শোন তুই বস! আমি একটু ওদের গেইট’টা ঘুরে দেখে আসি!”
ভালোবাসা অনুভব করে হাওয়ায় দুলতে থাকা কাশিশ এপর্যায়ে আৎকে উঠে রাদের পাগলামি দেখে৷ ওর বিমুগ্ধ ভাবনা দৌড় চিত্তে পাকিয়ে গেলো। বলে কী এই পোলা? শেষে অতিরিক্ত চাওয়ার বিপরীতে কপালে জুটে লাঠির ঘা! এ-ই রাতে কেউ দেখলে চোর ছাড়া আর কিচ্ছুটি ভাববে না। মাইরও একটা মাটিতে পরবে না! রাদ বেরুতে উদ্বেগ হতেই কাশিশ হকচকিয়ে গেলো উত্তেজিত গলায় তড়বড় করে বলল,
—” বন্ধু প্রেমে অন্ধ, মাথা গেছে সব বুঝলাম। তা-ই বলে রাত করে সেধে সেধে পিটানি খাইতে যাবি তুই? মাথা গেছে তোর? আর, আর গেইট কী ঘুরে ঘুরে দেখবি তুই? জীবনে গেইট দেখোস নাই তুই! বাসায় চল আজ সারা রাত গেইট দেখাবো তোরে ভাই মাইর খাওয়াস না তবুও!”
রাদ নিজেও ভয় পেয়ে গেলো আসলেই যদি কেউ দেখে ফেলে! তাছাড়া আদি আজ ঠাণ্ডা গলায় ওকে থ্রেট শুদ্ধ দিয়ে দিলো৷ ভেতরটা গর্জে উঠে ক্ষণকালেই যাই হয় হোক! রাদ ভীতু প্রেমিক নয়। ভালোবাসি চিল্লিয়ে বলার মতো বুকের পাটা, সাহস ওর আছে। দেখে ফেললে আরও ভালো! চিল্লিয়ে বলে আসবে ও এ-ই বাসার মেয়ের প্রেমিক। কাঙ্গাল প্রেমিক। বেয়াদব, অসভ্য ভাববে ভাবুক! অসভ্য বেয়াদব হয়ে যদি ঐ খবিশ ছেলের থেকে প্রেয়সী’কে বাঁচানো যায়! উদ্ধার করা যায়, বিয়ে ভাঙ্গা যায় তবে বেয়াদব, অসভ্যাতাই অন্নেক ভালো!
—” ভাই কই হারায় গেলি! দেখ ভাই কাল যা করার করমু আজ হাত-পা অক্ষত থাকতে বাড়ি ফিরে যা-ই তা-ই ভালো৷ হাত-পা না থাকলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার! এখনো বিয়ে করি নাই ভাই! দোয়া কর!”
কাশিশ ভয়ে উল্টাপাল্টা আওড়াচ্ছে। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে নিজেকে ধাতস্থ করে রাদ। ও যে মনে মনে ভয়ংকর সব ভাবনা ভাবছে, এগুলো কিচ্ছুতেই কাশিশ’কে বলা যাবেনা। তাহলে ধরে বেঁধে এক্ষুণি তুলে বাসায় নিয়ে যাবে। কিন্তু রাদের মন মানছে না। ওর মনে হচ্ছে ইরা কাঁদছে, কষ্টে আছে। আদি ফোন দিয়ে এসব বলল নিশ্চয়ই ইরা’কেও কিছু বলেছে, করেছে! কে জানে এই ছেলের দ্বারা সব সম্ভব! রাদের মন মস্তিষ্কে ভুরভুর করে অন্য চক্রান্ত চললেও। কাশিশ’কে নির্ভেজাল, গা ছাড়া ভাব করে নির্মল গলায় বলল,
—” আরে না ভাই, এমন কিছু হবে না। আমি কিছুদিন আগেও ওর সাথে বাসায় দেখা করে এসেছি!”
কাশিশ বিস্ফোরিত চক্ষুদ্বয় অক্ষিকোট উঁপচে বেরিয়ে আসতে চায়৷ হতভম্ব, অবিশ্বাস্য গলায় শুধায়,
—” রাদেলের বাচ্চা। তোলে তোলে ট্যাম্পু বাড়ি পর্যন্ত আইসা পড়ছে! এতবড় কলিজা! তুই তো দেখি জাতে মাতাল তালে ঠিক। এত্ত প্রেম যে মাইর খাওয়ারো ভয় নাই!”
রাদ নিজেও গম্ভীরমুখে ভাবে। ঐদিন কিভাবে কী হয়ে গেলো অবিশ্বাস্য। ঐদিন ওর ইরানীর অনেকটা কাছেও চলে গিয়েছিলো ও! সেই রাতে একেকটা মুহূর্ত চক্ষে ভেসে উঠতেই, রাদের মন, মস্তিষ্ক আবারও বেসামাল হয়ে যায়! গাঢ় শ্বাস ফেলে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় শুধু বলে,
—” মেডিসিন তুই বস প্লিজ। পড়ে বলছি সব। এখন একটু দেখে আসি। আমি এভাবে ফিরে যেতে আসিনি।”
কাশিশ রাদের হাত পর্যন্ত টেনে ধরে রাখে ভয়ে। কিন্তু রাদ’কে আঁটকে রাখতে ছেলেটা সম্পূর্ণ ব্যার্থ!
__________
রাত প্রায় তখন ৩-টার উপরে৷ ইরা’কে খাইয়ে বেশক্ষণ হয়েছে আদি নিজের ঘরে চলে গিয়েছে! ইরার রুমের দরজা এখন সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। ওকে রুমবন্দী করে যায়নি আদি! তখন আদির মুখের বুলি অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও ইরা মন খচখচ করছে! ঘুম পাচ্ছে না! মনে হচ্ছে একটি বার রাদের সঙ্গে কথা বলা অত্যন্ত জরুরি! ও বারবার দরজায় তাকাচ্ছে! কিছু ভাবছে, আকস্মিক সাহসা উঠেও দাঁড়ায়, উচাটন মনে বিড়াল পায়ে রুম থেকে বের হয়। উদ্দেশ্য বড় মার বাটন ফোনটা কিচেনের থাকে, সেটা চুরি করা! কিন্তু বাহিরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কাউ’কে নজরে না পড়লেও কিচেনে যেতে হলে মীতি আদি দু’জনের রুম পাস করে যেতে হবে। সাহসা বুকটা ধ্বক করে উঠে, অত্যন্ত ভীত হয় মন আদি যদি কোনও ভাবে একবার টের পায়। আজ হয়তো মেরে ফেলতেও দ্বিতীয় বার ভাববেনা! তাছাড়া এখনো বড়বাবা, বাবা কোনও অভিব্যক্তি প্রকাশ করেনি ওরা কী করবে কে জানে! রুমে ঢুকে আস্তে করে দরজা লক করে দেয় ও। আজ অনেক বড় ঝড় গিয়েছে সবার উপর। আবারও কোনও অঘটন ঘটাতে চায় না ইরা। এমনিতেই বাবা-মা আজ ওকে ভুল বুঝেছে হয়তো। রাহুল ভাইয়ার মতো হয়তো ওকে ও আর ভালোবাসাবে না আগের মতো! কিন্তু ইরা কী করবে কেমন করে যেন সব হয়ে গেলো। ভালোবাসাটাও মনের অজান্তেই এতটা গাঢ়তর হয়ে গেলো! যে এখন পিছু ফিরে কাউ’কে প্রশ্নবিদ্ধ করার উপায় নেই। শুধু জানে ও ভালোবাসে! খুব ভালোবাসে রাদ’কে! আবার ঠিক ততটাই মা-বাবা’কেও ভালোবাসে৷ এবং ওদের জন্যেও! ওদের দিকটা ভেবেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! মা-বাবার দিকটা ইরা সর্বদা আগে ভেবেছে তা-ই তো এসব জানাতে চায়নি বাসায়! কিন্তু ও নিরুপায় ঐযে পিছনে ফিরে তাকানোর কাউকে প্রশ্নবিদ্ধ করার উপায় নেই ইরা এই গল্পে সব থেকে বেশী দোষী! তা-ই সবার মন ওকে ঠিক রেখে চলতে হচ্ছে। না বাবা-মা’কে কষ্ট দিতে পারছে, না রাদ’কে!
ইরা অশ্রুসিক্ত চক্ষে রুমের লাইট’স অফ করে উন্মনা পায়ে গিয়ে বেডে বসে। জানালার দিকে বেখেয়ালি দৃষ্টি মেলে রাখে। এবং হঠাৎ উপলব্ধি করে সামনে একটি পুরুষ অবয়ব! পরমুহূর্তেই চিরচেনা ভরাট গম্ভীর গলা ভেসে আসে শ্রবণেন্দ্রিয়ে,
—” চিৎকার করো না! ইট’স মি রাদ। জাস্ট হুঁশ! কিপ কাম!”
রাদ অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠেও রিলাক্সে বাক্যগুলো উচ্চারণ করছিলো। আকস্মিক ইরা ভয় পেয়ে যেন চিৎকার চেঁচামেচি না করে উঠে। ইরা ভয়ে চিৎকার করবে কী! কয়েক মুহূর্তের জন্য মূর্তির মতো তাকিয়ে থাকে রাদের আঁধারে আবৃত অবয়ব’টির দিকে। তৎপরে তড়বড় করে উঠে রাদের জানালার গ্রিলে রাখা হাতের উপর হাত রাখে শক্ত করে। প্রাণপুরুষের সান্নিধ্যে কষ্টে দ্বিগুণ উদ্বেগে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। রাদ নিজেও ইরার হাতটা শক্ত করে ধরে অপর হাতে! কিন্তু মুখে একটি শব্দ উচ্চারণ করে না। শুধু ঘামের নহর মুখে নিয়ে চিন্তিত, ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত চক্ষে কিয়ৎপলক ইরার ক্রন্দনরত, ফ্যাকাসে, মলিন মুখশ্রীতে চেয়ে থাকে নির্মিমেষ নিষ্পলক! ইরা ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইলে আঙুল তুলে ঠোঁটে রেখে চুপ থাকার নির্দেশ দেয় রাদ। অতঃপর নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় প্রেয়সীর হাত থেকে। পকেট হাতড়ে একটা ফোন বের করে এগিয়ে দেয় গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ইরার সম্মুখে। ইরা সেটা হাতে তুলে নিতেই। গ্রিল দিয়ে হাত গড়িয়ে ইরার চোখ মুছে দেয় যত্নের সাথে। এবং অত্যন্ত ধীর, নিচু কণ্ঠে সান্ত্বনা সরূপ শুধায়,
—” লিসেন এই ফোনের লক। ‘ইরারাণী’ লক খুলে কাশিশের ফোনে কল দাও। ফোনে কথা বলছি ওকে। কাঁদবে না, কিচ্ছু হবে না। আমি আছি না! এভ্রিথিং উইল বি ফাইন! আই লাভ ইউ!”
ইরা মাথা দুলায়। রাদ আবারও ফোনের দিকে ইশারা করে এক মুহূর্ত সময় ব্যায় না করে স্থান ত্যাগ করে। ইরা জানালায় মাথা সেঁটে রাদের যাওয়া দেখে মনে মনেই শুধায়,” আই লাভ ইউ টু!”
ইরা মনে মনে বাক্যটি সম্পূর্ণ করতেই৷ আৎকে উঠে। কেউ ভয়ানক থাবা ফেলে দরজায় শব্দ করে নক করছে! আদি কী টের পেলো রাদ এসেছে? ভীতসন্ত্রস্ত ইরা তৎপর হয়ে হাতের ফোনটা লুকাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে! বুকটা অসম্ভব গতিতে ধড়ফড় করছে। ভূপৃষ্ঠ কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে না ওর শরীরে বুঝতে পারছে না। থরথর কাঁপতে কাঁপতেই দ্রুত ফোন লুকানোর একটি সঠিক জায়গা খুঁজে চলেছে তড়িঘড়ি করে। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক স্থান খুঁজে পাওয়া বড্ড মুশকিল!
রাত তীব্র হওয়ায় ইরার রুমের দরজায় করা এক-এক’টা আঘাতের ঠক ঠক রাদ ইরাদের গেইট দিয়ে বেরুবার ঠিক আগ মুহূর্তে শুনতে পায় স্পষ্ট। কিন্তু দাঁড়ানোর অবকাশ নেই! জোড়ালো পায়ে রাদ গলি দিয়ে বেরিয়ে যায়। অভ্যন্তরে গর্জে উঠে প্রশ্ন কেউ দেখে ফেলল! এভাবে হুটহাট ভেতরে ঢুকে যাওয়া বুঝি উচিৎ হয়নি! নিজের কষ্ট কমাতে গিয়ে না প্রেয়সীর কষ্ট দ্বিগুণ বাড়িয়ে ফলল!
এদিকে কাশিশ নিজের গাড়িতে নিজেই মুখে লুকিয়ে বসে ও হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর। এক্ষুণি একদল দানবীয় আকারের লোক রাদ’কে পিটাতে পিটাতে রাস্তায় নিয়ে আসবে। এবং গাড়ি নিয়ে অপেক্ষারত, মালমশলা নিয়ে পালানোর দোষে ও নিজেও দূষিত হবে। এবং জব্বর কেলানি খাবে দুই বন্ধু মিলেমিশে! ইতিহাসের পাতায় দু-বন্ধু পাকাপোক্ত ভাবে নতুন করে নাম লিখাবে। প্রেমিকার বাসায় চুড়ি করতে এসে ধরা খেলো চোর এবং তার সহপাঠী! নাইস!
চলবে!