জলফড়িং পর্ব-১৬

0
337

#জলফড়িং
#Roja_islam
#part ১৬

ইরা জান প্রাণ দিয়ে পড়াশোনায় ভীষণ ব্যাস্ত ফলশ্রুতিতে বই খাতা দিয়ে ঘরদোর এলোমেলো যাচ্ছেতাই অবস্থা করে রেখেছে ও। সাপ্তাহ খানিক হবে ঘর গুছিয়েও দেখেনি হয়তো। ইরা ভীষণ অগোছালো এবং অলস ধাচের মেয়ে। মেয়ে’র এ-ই অগোছালো স্বভাব ভীষণ অপছন্দ নীলা বেগমের। তিনি সেদিনও ইরা’কে মীতির সঙ্গে তুলনা করে ভীষণ বকাঝকা করলেন। পিঠে বুঝি দুই একটা চড় থাপ্পড় লাগিয়েও দিয়েছিলেন। মায়ের এহেন কাণ্ডে ইরা হতভম্ব, রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য, একে ছোট বোনের সঙ্গে তুলনা, আবার গায়ে হাত তোলা। ও কী এখনো ছোট বাচ্চা আছে নাকি যে এভাবে গায়ে হাত তুলবে? আত্মসম্মানহীন হয় প্রচণ্ড, তবুও মাকে কিছুই বলল না। নিরবে উঠে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ছাঁদের দিক অস্থির রাগান্বিত পায়ে।

তখন ভোর সন্ধ্যা এ-ই আজান দিলো বলে। চারদিক আঁধার হ্রাস করে নিচ্ছে। পাখিরা দল বেঁধে ফিরে যাচ্ছে আপন নীড়ে। ইরা সিঁড়িতে ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে উঠছিলো ছাঁদের দিক। এক পর্যায়ে ইরা’র পা যেন সিঁড়িতে পড়লো না আর। ফলস্বরূপ ঘটনা যা ঘটার তা-ই ঘটলো। রেলিঙ’কে অবলম্বন করেও ইরা পরে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না। অন্তঃকোণ থেকে বেরিয়ে এলো এক কঠিন আর্তচিৎকার,

–” মা..!”

এ-র পর প্রচণ্ড জোড়ে শব্দ হলো ওর শরীর’টা সিঁড়িতে আছাড় খেয়ে পড়ার! এ-র পরেও শরীরে আঘাত পেয়ে প্রচণ্ড ব্যাথায় আরও দু’টো চিৎকার দিয়েছে ইরা।
_______________

কেউ আগ্রহের সঙ্গে লাগাতার ফোন দিয়ে যাচ্ছে । ফোনটা আপন মনে বেজে নিজ মনেই কেটে কেটে যাচ্ছে। ইরা আলসেমি ভঙ্গিতে চেয়ে রইলো শুধু মুঠোফোন নামক যন্ত্রের দিক। এভাবেই নিস্তব্ধ, নিষ্প্রভ, গুমোট কেটে গেলো মূল্যবান কিছু প্রহর। ফোন তুলে কথা বলার কোনও আগ্রহ নেই ইরা’র মধ্যে। মূলত কল করা ব্যাক্তি’র সঙ্গে কথা বলতে অনিচ্ছুক ও।

গায়ে কম্বলটা আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিস্পৃহ মলিন চক্ষে চাইলো, আম বাগানের দিক। না শীত, না গরম! এমন আবহওয়ায় রোদ না পড়লেও দিনটা কেমন যেন থমকে আছে। যেন এক টুকরো মন খারাপ হয়েছে, তা-ই তো আঁধারের চাদরে মুড়িয়ে ধরছে ধরণী’কে। আবারও ফোনের ব্রাইবেটের শব্দ, স্থির নজর নড়লো ওর। ঐপাশের ব্যাক্তির নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় আলসেমি ভঙ্গিতে’ই ফোন’টা রিসিভ করতে বাধ্য হলো। কানে ফোন চেপে নিরুদ্বেগ, মলিন গলায় শুধালো,

—” হ্যালো, রাইসা কেমন আছো, আমার একটু চোখ লেগে গিয়েছিলো আসলে!”

রাইসা তৎক্ষনাৎ মুখ ঝামটা মেরে কর্কশ, কিঞ্চিৎ রাগান্বিত গলায় বলল,

–” রাখো তোমার ভালো-টালো! ঘুমুচ্ছিলে? সাপ্তাহ খানিক হলো কোচিং এ কেন আসছো না, আগে সেটা বলো? কতগুলো কল দিচ্ছি তোমাকে সেটাও তুলছো না। হয়েছে কী বলো তো?”

ইরা’র শ্যাম মুখটা বিবস হয়ে এলো। এ-ই বুঝি কেঁদে দিবে। ঠোঁট’টা বিশ্রীভাবে কাঁপছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে। বিবর্ণসুরে বলল,

—” আসলে রাইসা, ছোট একটা দূর্ঘটনা ঘটেছে, আমি একটু অসুস্থ! ”

রাইসা সপ্রতিভ হয়, প্রত্যুত্তরে চিন্তিত গলায় শুধায়,

—” দূর্ঘটনা? কী হয়েছে?”

ইরা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। মলিন, নিষ্প্রান, ক্ষীণ আওয়াজে বলে,

—” সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়েছি। পায়ে গুরুতর ভাবে জখম হয়েছে। একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম এ-ই ঘটনায়। এখন জ্বরেও ভুগছি!”

রাইসা ব্যাথিত গলায় বলল,

—” কী বলছো এতসব হয়ে গেলো? এখন কেমন আছো? এড্রেস বলো আমি আসবো তোমাকে দেখতে!”

ইরা এড্রেস দিয়ে বলল,

—” এখন একটু ভালো আছি। কিন্তু পা ঠিক হতে মাস খানিক লাগবে!”

রাইসা প্রত্যুত্তরে বিস্ময় কণ্ঠে আওড়ালো,

—” কী বলছো? তাহলে তো তোমার বিপদ হয়ে যাবে! ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে, প্রচণ্ড বিষণ্ণ অনুভূতি নিয়েও ইরা কথপোকথন চলিত রাখলো। ওপাশে রাইসা ত্রুটি রাখলো না ইরা’র সরল মুখে হাসি ফোটানোর, বুদ্ধিচাতুর্য রাইসা, কিঞ্চিৎ নিগূঢ় নির্দেশনা’য় লক্ষ্য করলো সেটা সম্ভব হয়নি। শ্যামবতী রমণীর মুখে কালো মেঘ স্থগিত আছে! কে যানে কখন এ-ই কৃষ্ণ কালো মেঘ কাটবে?

কিয়ৎ প্রহর পূর্বেই ভিডিও কলের ইতি টেনেছে ইরা। বর্তমানে নীরবে আঁধারে নিস্তব্ধ অম্বরবক্ষ, গভীরতার সঙ্গে পর্যাবেক্ষন করছে! মন খারাপের বিষণ্ণ দিন গুলো কবে ফুরাবে দিন গুনছে।
____________

রান্নাঘর থেকে হরেকরকম খাবারের ঘ্রাণ, টুংটাং শব্দ, সাথে ঝাঝ এসে নাকে, কানে বাড়ি খাচ্ছে! তবুও যেন নীরবতা বিক্ষোভ করে যাচ্ছে সম্পূর্ণ বাড়ি। বড় মা, নীলা বেগম ছাড়া সবাই-ই বাহিরে। ওরাও রান্না ঘরে ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ইদানীং আদি, রাহুল, মীতি তিনজনেই ভীষণ ব্যাস্ত। রাহুল’কে তো বাসায় রাত ছাড়া দেখাই যায় না৷ ইরা পা ভেঙ্গে বসে থাকার পর থেকে যেন ওদের দেখা পাওয়াটাও মুশকিল হয়ে গিয়েছে!

ইরা’র বড্ড একাকিত্ব অনুভব হচ্ছে। এ-ই মুহূর্তে ক্যাম্পাসের আঙ্গিনায় বন্ধুদের সঙ্গে বসে জম্পেশ আড্ডার মত্ত্ব হতে ইচ্ছে করছে! যা এখন অসম্ভব বটে, মন খারাপের রেশটা আরেকটু বাড়িয়ে ফোন হাতে তুলে নিউজফিড’টা ঘুরেফিরে দেখছিলো তখনই রাদের কিয়ৎক্ষণ পূর্বের পোস্ট করা সুন্দর কিছু ছবি সম্মুখে জ্বলজ্বল করে উঠলো। দু’দিন পূর্বেই ঝুলিয়ে রাখা রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করেছে সে।

রাদের থেকেও অধিক বেশী যেটা ইরা’কে আকর্ষণ করলো ছবিতে। সেটা হলো ছবি গুলো ঢাবির প্রাঙ্গণে তোলা। ইরা’র স্বপ্ন ছিলো একদিন সে-ও ঢাবি’তে পড়বে! টিএসসি’তে ঘুরবে। নতুন নতুন বন্ধুমহল তৈরী করবে। একসাথে মিলেমিশে নতুন স্বপ্ন বুনবে। কিছুই হয়তো আর হবে না! দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা কমেন্ট করলো, ” টিএসসি’তে ঘুরঘুর করার, আড্ডা দেওয়ার, বড়বড় স্বপ্ন দেখা কিংবা পূর্ণ করা, কিছুই আর হলো না স্যার!”

ইরা ফোন রেখে কাঁদছিলো। তন্মধ্যে হন্তদন্ত নীরা বেগম রুমে ঢুকে দেখলেন মেয়ে আঁখিপল্লব ব্যাস্ত হাতে বারবার মুছিয়ে নিচ্ছে। মা’কে দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার অদম্য চেষ্টা মেয়েটার। নীলা সাইড টেবিলে লেবুর ঠান্ডা শরবত রেখে কিছু’টা তাচ্ছিল্যের করে বিকৃত সুরে বললেন,

–” মেয়ে মানুষে’র এতো রাগ থাকতে নেই। ধৈ ধৈ করে কে বলেছিলো ছাঁদে যেতে? কিচ্ছু হবে না তোকে দিয়ে! ”

এহেন কটু বাক্যে ইরা’র ভীষণ রাগ হলো মায়ের প্রতি। যখন পড়ছিলো তখন একটু সেক্রিফাইজ করতে পারলো না। ওকে অহেতুক একটুর জন্য কথা শোনালো, গায়ে হাত তুললো। ও কী অন্যায় করছিলো পড়ছিলো-ই তো দিন রাতে এক করে। এখন বলছে কিচ্ছু হবে না তোকে দিয়ে। শুধু ভালো চাইলেই হয়? সন্তানদের মন আছে সেটাও বুঝতে হয়! ইরা শরবত ছুয়েও দেখলো না। একদম মুর্ছা গেছে ওর ছোট্ট আত্মপ্রত্যয়ী মন’টা। মায়ের এহেন আচরণে কনফিডেন্স ভেঙে যায় ওর! ইরা মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে পুনরায়!
________________

রাত তিনটা বাজে, জ্বলজ্বল জ্যোৎস্নায় ভোরা ধরণী। রাত প্রগাঢ় হচ্ছে, হচ্ছে চাঁদের আলো৷ সাথে ঝিনঝিন পোকার ডাক অদ্ভুত বিমোহিত এক রাত! সারাদিন শুয়ে-বসে থাকায় রাতে ভালো ঘুম হয় না। পাশেই মীতি শুয়ে। জানালার পাশ ঘেঁষে বসে ইরা আঁধারে অম্বর পানে স্থির চেয়ে। হঠাৎ টুং করে শব্দ হলো মুঠোফোনে। নিস্তব্ধ, নিরব পরিবেশে সেই ছোট্ট শব্দ টুকু দৃষ্টিকটু শোনালো, ইরা ভ্রুক্ষেপহীন, নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে ফোন হাতে নিতেই ভীষণ চমকপ্রদ হলো! নিরুদ্বেগ, নিরুৎসাহিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কম্পিত হলো কিঞ্চিৎ!

রাদ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মেসেঞ্জারে ওকে একটি বড়সড় ম্যাসেজ লিখে পাঠিয়েছে। স্যার মানুষ ওকে কী ম্যাসেজ দিতে পারে সেটা ভেবেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গও অস্বাভাবিক কম্পন! ইরা’র মধ্যে তৎক্ষনাৎ চঞ্চলতা ফিরে এলো। ঘাম ছুটে যাওয়া জিবজিবে হাতে দ্রুত ম্যাসেজ সিন করলো। ছোট্ট ছোট্ট গুটিগুটি যান্ত্রিক অক্ষরে লিখা,

–” টিনএজ প্রবলেম অল্পতেই ভেঙে যাওয়া। এবং অদ্ভুত বিষয় পা ভেঙ্গে যাওয়া আর স্বপ্নের যোগাযোগ! পা ভেঙ্গে গেলেই বুঝি স্বপ্ন ইচ্ছে ভেঙ্গে যায়? আর যদি যায় সেটা আবার কেমন স্বপ্ন? যেটা এতটুকুতেই ভেঙ্গে যায় সেটা স্বপ্ন হতে পারেনা। সেটা হয়তো ভুল মনা জেদ। স্বপ্ন হতে হবে চাঁদের মতো ধরাছোঁয়ার বাহিরে! ছুঁতে পারবোনা যানি, তবুও হাল ছাড়া যাবে না। বছরের পর বছর যে-ই স্বপ্ন বুকে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা করবো, কিন্তু আফসোস করা যাবে না। যেমন ‘হাজার বারণ, অসংখ্য কারণ
তবু সে দ্বারেই আসি!’। একদিন হুট করে ঘুমিঘুমিয়ে স্বপ্নে দেখবো চাঁদের দেশে ঘুরতে গিয়েছি। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে চাঁদের উপর ঘুমিয়ে পড়েছি, ব্যাস স্বপ্ন পূর্ণ হয়ে গেলো৷ বরং স্বপ্নের থেকেও কল্পনা সত্যি হয়ে গেলো..।অভাবনীয় স্বস্তি তা-ই না! ”

ইরা বিমূঢ় ম্যাসেজ পড়ে, এলোমেলো বাক্যগুলো যেন মজা করেই লিখেছে। সত্যি শুধুই মজা করে লিখেছে? রাদ কী কিছু বোঝাতে চাইলো? কোথায় কিভাবে পড়ছি ব্যাপার না। স্বপ্ন দেখাটাই জরুরি? হ্যাঁ স্বপ্ন ছাড়া যে মানুষ বাঁচে না! ও থমকে রইলো কিয়ৎক্ষণ! অতঃপর কিচ্ছুক্ষণ ভেবে নিজেও লিখলো,

–” ঢাবি’তে পড়াটা-ই আমার স্বপ্ন ছিলো স্যার। এ-র আগে আমি কখনো স্বপ্ন দেখিনি তাহলে আমি বেঁচে আছি কী করে?”

সঙ্গে সঙ্গে জবাব এলো না। ম্যাসেজ সিন ও হলো না। স্যার কী মজা করে ম্যাসেজ পাঠিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো? ইরা হাফসাফ করতে লাগলো বসে। অচেতন মন অপেক্ষা করছে একটি ছোট্ট রিপ্লাই পেতে। ইরা’র বিশ্বাস রিপ্লাই অবশ্যই আসবে। কেন, কার উপর এ-ই বিশ্বাস বুঝতে পারলো না। কিন্তু ৩০-মিনিট উত্তেজক মুহূর্তে’র অন্তিম পর্ব ঘটিয়ে। রাদের প্রত্যুত্তর এলো,

–” এক্স্যাক্টলি, একবার কিছুতে আসক্ত হ’য়ে গেলে। মানুষ সে-ই দ্বারে বারবার ফিরে যায়। তুমি বুদ্ধিমতী, আমার বিশ্বাস তুমি নতুন করে স্বপ্ন দেখবে!”

ইরা যেন অকারণে-ই ম্যাসেজটি দেখে মুগ্ধ হলো। ছোট রিপ্লাইতে হয়তো তেমন মুগ্ধ হওয়ার মতো কিছু ছিলো না। তবুও ইরা’র মনে হলো ওকে কেউ কখনো এভাবে বুঝায়নি! ও ছোট্ট করে লিখলো,

–” ধন্যবাদ স্যার!”

সঙ্গে সঙ্গে রাদে’র সহজ স্বীকারোক্তি এলো,

–” আমার ভীষণ জ্বর, আই নো আবোলতাবোল লিখছি। তবুও বলে যেতে চাই আমি তোমার স্বপ্ন’টি পূর্ণ করে দিবো! আই থিংক তুমি পারবে। ”

ইরা’র প্রথমে খারাপ লাগলো রাদে’র জ্বর শুনে। তবুও মুগ্ধ, বিমোহিত হলো। সঙ্গে অবাক ও। স্যার কী করে ওর স্বপ্ন পূর্ণ করবে? তবে রাদের বিশ্বাস দেখে ইরা নিজের কনফিডেন্স কিঞ্চিৎ ফিরে পেলো।

__________

সে-ই ঘটনার সাপ্তাহ খানিক পড়ের কথা। রাদ আবার ওকে নক দেয়। ইরা ভেবেছিলো। ভাগ্যক্রমে রাদ কমেন্ট দেখে ম্যাসেঞ্জারে সান্ত্বনামূলক বাণী ছুড়লেও। হয়তো ভুলেই যাবে ওর কথা। কিন্তু ইরা’কে বিস্ময়, নির্বাক করে দিয়ে রাদ নিজে ওর অনলাইন ক্লাস নিবে বলল। রাদ ওকে বুঝালো কোচিং করলে’ই ঢাবি’তে এডমিশন হবে এ-ই মনোভাব ছেড়ে দিতে। যেহেতু পা ভাঙা তা-ই ও যেভাবে বলে সেভাবে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে, রাদ ওকে গাইড করবে আজ থেকে। ইরা দু’দিন কিংকর্তব্যবিমুঢ় ছিলো। এরপর রাদে’র চাপে পড়ে স্বাভাবিক হ’য়ে রাদের কথামতো আবারও পড়াশোনায় মনোযোগী হলো। এ ছাড়া অপশন ইচ্ছেও তো ওর ছিলো না।

এর মধ্যে পড়াশোনার পাশাপাশি একে অপরের সঙ্গে অনেক কথা-ই হতো! রাদ ইরা’র সম্পর্কে অবগত হলো পরিচয় যানলো। ইরাও রাদে’র সম্পর্কে নতুন অনেক কিছু যানতে পারলো। প্রথম দিন রাদ’কে দেখে যা ক্রাশ খেয়েছিলো সেটা কয়েকগুণ বেড়ে গেলো মানুষটার সঙ্গে কথা বলার পর। কিঞ্চিৎ অহংকার নেই সুন্দর, স্বাভাবিক, চমৎকার ব্যাক্তিত্ব মানুষটার, যে কেউ রাদের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হতে বাধ্য! ইরা প্রেমেই পড়ে গেলো। রাদের সঙ্গে কথা বলাটা, হেল্প নেওয়াটা একপ্রকার বদ অভ্যাস হয়ে গেলো ইরা’র। অন্যদিকে রাদের মনোভাব সম্পর্কে ইরা অবগত নয়! তবুও নিজেকে রাদের উপর দূর্বল করা থেকে নিজের রক্ষা করতে সম্পূর্ণ অক্ষম ও। কী বা করবে ও রাদ নামক মানুষ’টাই এমন! অদ্ভুত সুন্দর চমৎকার।
__________

পড়াশোনা’র ব্যাস্ততার মধ্যেই মাস খানিক পর ইরা’র পা খোলার সময় এলো। একটু পর ও ডক্টরের কাছে যাবে। রাহুল এলো বোনের রুমে। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে সম্পূর্ণ স্বভাবের বিপরীতে গম্ভীরমুখে বলল,

–” হেঁটে যেতে পারবি? কোলে নিবো?”

ইরা সরল হেসে। মিষ্টি গলায় বলল,

–” প্রয়োজন নেই ভাইয়া, হেঁটে যেতে পারবো আমি। ”

–” চল তাহলে বড় বাবা গাড়ি পাঠিয়েছেন বেড়িয়ে যাই। ”

–” আচ্ছা, তুমি শুধু আমার হাত’টা একটু ধরো! ”

রাহুল তা-ই করলো। ইরা নরম পায়ে ড্রইংরুমে এলো। প্রায় ১-মাস সাতদিন পর ও রুম থেকে বেরুলো। এ-ই একমাস ইরা রাদের দুনিয়ায় কাবু ছিলো যেন! বড় মা এবং রাহুল ওকে নিয়ে গেলো হসপিটাল। ডক্টর ব্যান্ডেজ খুলে কিছু মেডিসিন দিয়ে দিলো। এবং অল্প অল্প করে হাঁটাহাঁটি করতে বলল।

বাসায় ফিরতেই ইরা’র সঙ্গে সবাই ওর রুমে বসলো। সবাই এটা সেটা বলছিলো৷ ইরা ভাই’কে লক্ষ্য করলো কেমন গম্ভীর, থমথমে মুখভঙ্গি। ইদানীং বাসায়ও তেমন থাকেনা যতটুকু থাকে ফোনে ব্যাস্ত হয়ে থাকে। কিছু হয়েছে আন্দাজ করে। নীলা বেগম বড়’মা বেরিয়ে যেতেই ও মীতি’কে সাবলীল গলায় বলল,

–” আদি ভাইয়া কখন ফিরবে মীতি!”

–” ৮-টার আগে না! ইদানীং হয়তো ভাইয়ার কাজের চাপ বেশী। ”

–” ওহ্, একটু পানি এনে দেনা প্লিজ, গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে!”

–” এক্ষুণি এনে দিচ্ছি, মিষ্টিপু!”

ইরা মিষ্টি করে হাসলো। মেয়েটা ভালোবেসে প্রায় মিষ্টি ঢাকে ওকে। মীতি বেরিয়ে যেতেই। ইরা ভাইয়ে পাশে বসে চিন্তিত গলায় শুধালো,

–” ভাইয়া, তুমি ঠিক আছো? ”

রাহুল প্রথমে হকচকালো। অতঃপর নিজেকে তৎপরে স্বাভাবিক করে। নিরুদ্বেগ গলায় বলল,

–” আমার কী হবে? ”

ইরা চক্ষুদ্বয় বরবর্ণিনী করে বলল,

–” সত্যি তো? ”

রাহুল দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বিগলিত গলায় বলল,

–” একদম পিচ্ছি!”

পিচ্ছি ডাক শুনে ইরা অপ্রতিব হ’য়ে পড়লো। মনে পড়ে গেলো রাদের কথা, রাদ প্রায় ওকে টিনএজ পিচ্ছি ডাকে! অধর প্রশ্বস্ত করে মুচকি হাসলো ইরা। আজ সকাল থেকে কথা হয়নি রাদের সঙ্গে। ততক্ষণে রাহুল বেরিয়ে গেছে বোনের কক্ষ হতে! মীতি পানি হাতে রুমে এসে হাজির। ইরা তখন ফোন হাতে তুলে ওয়াই-ফাই অন করতে ব্যাস্ত। মীতি ক্রমাগত পা এগিয়ে বোনের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। চটপটে গলায় আওড়ালো,

—” এ-ই নিন ম্যাডাম পানি! আজকে থেকে আমাদের ছুটি নিয়ে নিলাম। এবার নিজের কাজ নিজে করে নিতে শিখুন! কোমড় ভেঙে গেলো তোমার সেবা যত্ন করতে করতে। ”

ইরা হেসে আওড়ালো,

—” আমার শখ আহ্লাদ নেই তোদের খাটানোর, হুহ। ”

মীতি মুখ ভেংচি কাটে। কিয়ৎক্ষণ পরেই আবার শুধায়,

—” কিছু খাবে? নিয়ে আসবো?”

ইরা চক্ষুদ্বয় উল্টে বোনের দিক চাইলো। মীতি মাথা চুলকালো। অতঃপর দু’জনেই হেসে উঠলো। মীতি বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

—” বোনের একটু যত্ন করাই যায়। সবেই সুস্থ হলো। ”

ইরা আনমনে মিষ্টি করে হাসলো। পাগলী মেয়ে একটা। ইরা মেসেঞ্জার চ্যাক করে একটু আশাহত হলো। রাদের কোনো ম্যাসেজ আসেনি। তাকে এক্টিভ দেখাচ্ছে। একটু কষ্ট পেলো। অতঃপর ঠোঁট উলটে ইরা পায়ের ছবি তুলতে ব্যাস্ত হলো। পায়ের পিকচার সহ পোস্ট করে নিজের সুস্থতা সবাই’কে যানালো। সেখানে কমেন্টের ছোটখাটো বন্যা বইলো। সেগুলো নিয়েই দিন’টা পার হলো।
____________

রাদ একটু ঢাকা গিয়েছিলো আজ কাজের সুবাদে! অনাকাঙ্ক্ষিত একটি কারণে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, রাগান্বিত রাদ বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় একটা বেজে গেলো। ততক্ষণে কাশিশ, মা ঘুমিয়ে কাঁদা। তাদের ডেকে তোলার কোনো ইচ্ছা, অবকাশ রাদের মধ্যে নেই। নিজের কাছে থাকা বরাদ্দকৃত চাবির সুবিধার্থে কাউকে না যাগিয়েই নিজের মতো রুমে ঢুকে গেলো সে। অতঃপর প্রথমেই লম্বা শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। বলিষ্ঠ ভেজা দেহে থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট, উদোম বুক। ভেজা সিল্কি চুল এলোমেলো পুরুষয়ালী হাতে মুছতে মুছতে বেডে গিয়ে বসলো। অসংখ্য ক্লান্তিতে শরীর ছেঁয়ে থাকলেও চক্ষে ঘুমের লেশমাত্র নেই।

কারণ বসত ভীষণ রেগে সর্বদা শান্তশিষ্ট গম্ভীর রাদ। নিজের বংশের মতো স্বার্থপর মানুষ রাদ আর একটি দেখেনি। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে নিজের মনের সকল ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো। তিক্ত অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে মনোযোগ ফিরাতে ফোন হাতে শুয়ে কিয়ৎকাল ফোন ঘাটাঘাটি করতে শুরু করলো। কিয়ৎকাল এটা সেটা চ্যাক করার পর ফেইসবুকে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম ইরা’র পায়ের পিকচার’টা সামনে এলো।

শ্যাম নিটোল পায়ে জ্বলজ্বল করছে একটি সুন্দর নূপুর। সুন্দর পা’টা নিসন্দেহে আকর্ষণীয়। স্ক্রোল করে নিচে চলে যেতে নিয়েও হাইলাইট একটি কমেন্ট সম্পূর্ণ নজর কেড়ে নেয় রাদের। ইরা ক্লাসমেট হয়তো এক ছেলে কমেন্ট করেছে। ” সে* পা! ” প্রথমেই রেগে ছিলো এবার বিরক্তিকর অনুভূতি’টাও যোগ হলো। কিঞ্চিৎ জ্ঞানশূন্য হলো মস্তিষ্ক! তৎক্ষনাৎ ইরা’কে নক করে ভয়েজ ম্যাসেজ সেন্ড করলো।

—” শুধু কী পায়ের ছবি তুলতে ব্যাস্ত ছিলে নাকি পড়াশোনা কিছু করেছ? এক্ষুণি এ-ই সব পিকচার ডিলিট দাও!”

ইরা তখন ওয়াশরুমে ফ্রেশ হচ্ছে। আজ রাতে একটা বিয়ের দাওয়াত ছিলো! আধঘন্টা পূর্বেই ফিরেছে সম্পূর্ণ পরিবার! ফ্রেশ হচ্ছিলো বিদায় রাদের ম্যাসেজ তৎক্ষনাৎ দেখতে পায়নি ও।

এদিকে রাদ অধৈর্য হয়ে পড়লো। মেয়েটা’কে এক্টিভ দেখাচ্ছে তাহলে সিন করছে না কেন? ও তৎপর হাতে ইরা’কে কল লাগালো। রিংটোনের শব্দে ইরা ওয়াশরুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলো। ফোন হাতে নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় চমকে গেলো। এতরাতে রাদ কল দিচ্ছে অবিশ্বাস্য। সে-ই সঙ্গে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের তীব্র কম্পন টের পেলো। হৃদস্পন্দন হলো বেসামাল! কম্পিত শুকনো ঢোক গিলে কল রিসিভ করেই ও ভীতু গলায় সালাম দিলো,

—” আসসালামু আলাইকুম স্যার। ”

ইরা’র মিষ্টি কণ্ঠে রাদ কিছুটা নরম হলো। সালামের জবাব নিয়ে। প্রগাঢ় গলায় বলল,

—” এক্ষুণি, তোমার ফেইসবুক লাস্ট পোস্ট ডিলিট করো। ”

বলে-ই কল কেটে দিলো। ইরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় এটা কী হলো? পায়ের ছবিতে এমন কী হলো? যাইহোক আদেশ মতো ইরা সঙ্গে সঙ্গে পিকচার ডিলিট করে নিলো। ও দেখেওনি ঐ বিশ্রী কমেন্ট। ও অন্যকিছু ভেবে নিলো। যেটা একটা ভুল বুঝাবুঝি ছিলো আসলে। ইরা ভেবেছিলো রাদ জেলাসি থেকে পোস্ট ডিলিট করতে বলেছে ওকে।
_________

এরপর থেকেই ইরা’র মনে রাদের জন্য অন্য অনুভূতি’রা আশকারা পেলো। কড়াকড়ি ভাবে পেলো৷ রাদ ইরা’র ভালো’র জন্য কিছু বললেও ইরা ভালোবাসা’ই ধরে নিতো৷ এভাবে মাস খানেক চলে গেলো। চঞ্চল, প্রাণবন্ত ইরা প্রায় রাদের ব্যাস্ততা মেনে নিতে পারতো না। ওর ছোট চঞ্চল মন খারাপ হয়ে যেতে, নেতিয়ে পরতো, চক্ষে মুখে ফুঁটে উঠতো একাকিত্ব, বিরহ।

একবার ব্যাস্ততার জন্য রাদের সঙ্গে প্রায় দু’দিন কথা হলো না ওর। দু’দিন যন্ত্রণায় হাফসাফ করে অতিবাহিত করলো ইরা। সেই সঙ্গে কল ম্যাসেজ দিয়েই যাচ্ছিলো রাদ’কে ক্রমাগত।

ব্যাস্ত রাদ একটু নিস্তার পেয়ে যখন অনলাইনে এলো এতো এতো কল ম্যাসেজ ইরা’র থেকে পেয়ে কিঞ্চিৎ বিমূঢ় হলো। ব্যাস্ততার মধ্যেও সময় করে নিজেও কেন যেন তৎক্ষনাৎ কল ব্যাক করেছিলো ইরা’কে। বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, ” কী হয়েছে, কী হয়েছে?”

ইরা মাত্রাতিরিক্ত মন খারাপ দুশ্চিন্তা থেকেই রাদে’র ফোন পেয়ে নিঃশব্দে কেঁদে দিয়েছিলো। রাদে’র বার বার প্রশ্নে ইরা শব্দ করে কেঁদে ফেলল। রাদ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। ইরা’কে রিলেক্স করে কিয়ৎকাল কথোপকথন চালিয়ে গেলে। ধূর্ত, বুদ্ধিমান রাদ সেদিন ইরা’র অনুভূতি স্পষ্ট টের পেলো। রাদ প্রচণ্ড বিস্মিত হলো। এবং তৎক্ষনাৎ ভেবে চিনতে নিলো ওর কী করা উচিৎ।

এরপর থেকেই ইরা’র মনে রাদের জন্য অন্য অনুভূতি’রা আশকারা পেলো। কড়াকড়ি ভাবে পেলো৷ রাদ ইরা’র ভালো’র জন্য কিছু বললেও ইরা ভালোবাসা’ই ধরে নিতো৷ এভাবে মাস খানেক চলে গেলো। চঞ্চল, প্রাণবন্ত ইরা প্রায় রাদের ব্যাস্ততা মেনে নিতে পারতো না। ওর ছোট চঞ্চল মন খারাপ হয়ে যেতে, নেতিয়ে পরতো, চক্ষে মুখে ফুঁটে উঠতো একাকিত্ব, বিরহ।

একবার ব্যাস্ততার জন্য রাদের সঙ্গে প্রায় দু’দিন কথা হলো না ওর। দু’দিন যন্ত্রণায় হাফসাফ করে অতিবাহিত করলো ইরা। সেই সঙ্গে কল ম্যাসেজ দিয়েই যাচ্ছিলো রাদ’কে ক্রমাগত।

ব্যাস্ত রাদ একটু নিস্তার পেয়ে যখন অনলাইনে এলো এতো এতো কল ম্যাসেজ ইরা’র থেকে পেয়ে কিঞ্চিৎ বিমূঢ় হলো। ব্যাস্ততার মধ্যেও সময় করে নিজেও কেন যেন তৎক্ষনাৎ কল ব্যাক করেছিলো ইরা’কে। বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, ” কী হয়েছে, কী হয়েছে?”

ইরা মাত্রাতিরিক্ত মন খারাপ দুশ্চিন্তা থেকেই রাদে’র ফোন পেয়ে নিঃশব্দে কেঁদে দিয়েছিলো। রাদে’র বার বার প্রশ্নে ইরা শব্দ করে কেঁদে ফেলল। রাদ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। ইরা’কে রিলেক্স করে কিয়ৎকাল কথোপকথন চালিয়ে গেলে। ধূর্ত, বুদ্ধিমান রাদ সেদিন ইরা’র অনুভূতি স্পষ্ট টের পেলো। রাদ প্রচণ্ড বিস্মিত হলো। এবং তৎক্ষনাৎ ভেবে চিনতে নিলো ওর কী করা উচিৎ।

রাদ এ-ই বিষয়টি নিয়ে লুকোচুরি খেলতে চায়নি। সে অল্পতেই ঝামেলা মিটিয়ে নিতে চাইছিলো বলে এ-ই বিষয়ে ইরা’কে স্পষ্ট প্রশ্ন করতেই ধাক্কা খেলো। ইরা কেন যেন নিজের মধ্যে ছিলো না। ও নিজের অনুভূতি লুকায়নি। যানিয়ে দিয়েছিলো। মনকুঠুরি’র গোপনীয় সব কথা রাদ’কে নিয়ে। রাদ হকচকিয়ে জ্ঞানশূন্য হয়েছিলো হঠাৎ এহেন পরিস্থিতিতে পরে। অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ করে রাগান্বিত গলায় স্পষ্ট বলেছিলো সেদিন।

—” ইরা আমি তোমাকে বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম। বাট আই ওয়াজ রঙ। এমন বোকামি তুমি কী করে করতে পারো। এসব ঠুকনো ভাবনা দূরে ঠেলে পড়াশোনায় মনোযোগী হও। এক্সাম এর ডেট সন্নিকটে। আমি চাইনা আবেগের বশে তুমি নিজের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করে ফেলো। এজ এ টিচার। আমি শুধু-ই তোমার টিচার এবং তুমি আমার স্টুডেন্ট নাথিং এলস। ”

ইরা’কে নিয়ে রাদের মনে কোনো অনুভূতি নেই। ইরা রাদের জন্য শুধু মাত্র ওর স্টুডেন। বাক্যটুকু বারবার বেজে উঠে কানে। অপর দিকে বাক্যগুলো শেষে যান্ত্রিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাদ।

ইরা ভীষণ কেঁদেছিল সেদিন। সাথে রাদের ইস্পাত-দৃঢ় ব্যাবহারে কষ্ট পেয়েছিলো৷ যন্ত্রণা’য় বুকে যেন তরতাজা রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। তাহলে ও কী ভুল ভাবতো! রাদের কেয়ার, শাসন ভালোবাসা ছিলো না! রাদের স্পষ্ট জবাবের পরেও বেহায়ার মতো সম্পূর্ণ রাত ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিলো ইরা, এই বুঝি রাদ কল দিবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। পূর্ণতা পাবে ওর ভালোবাসা। কিন্তু বাস্তবতা বড্ড কঠিন এমন কিছু হয়নি রাদ কল দূর অলাইনের আর আসেনি। ভোরে’র দিকে ক্রন্দনরত অবস্থায় এক সময় ঘুমিয়ে পরে ইরা।
_________

সেদিনের পর একেকটা দিন ছিলো ভয়াবহ কঠিন। সম্পূর্ণ দিন টেবিলে বই নিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকতো ইরা। কখন বা কেঁদে উঠতো শব্দ করে কখনো বা রাতের আঁধারে নিরব কান্নায় বালিশ ভেজাতো ফোনের উপর দৃষ্টি রেখে। সেদিনের পর রাদের সঙ্গে কোনো প্রকার কথা হয়নি। রাদ মাঝেমধ্যে শুধু নোট পাঠাতো। ইরা সিন করতো না। কী হবে সিন করে ইরা তখন সুস্থ স্বাভাবিক ছিলো না। পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলো না। শুধু অপেক্ষা করতো রাদ কল দিবে হয়তো এক্ষুণি। সব আগের মতো হয়ে যাবে স্বপ্নের মতো। কিন্তু তেমন কিছু-ই হতো না। কখনো বা আফসোস হতো সেদিন নিজের দূর্বলতা প্রকাশ না করলে-ই বুঝি ভালো ছিলো। আজ এরকম কষ্ট পেতে হতো না। রাদ অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব বাড়িয়ে দিতো না! ইরা’র বুকে যন্ত্রণা’র আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতো না।

এভাবেই অস্বাভাবিক যন্ত্রণার মধ্যে বেশ কিছু দিন চলে গেলো। একদিন রাতে ইরা সবার সঙ্গে অনিচ্ছাকৃত ভাবে ডিনার সেরে রুমে ঢুকতেই ফোনে টুংটাং শব্দ হলো। অনাগ্রহী হাতে ফোন তুলে চ্যাক করে দেখলো রাদ ম্যাসেজ করেছে। ইরা সিন করলো। যান্ত্রিক অক্ষরে বাংলায় লিখা,

—” নোট গুলো কমপ্লিট করেছো? প্রিপারেশন কেমন? এক্সামের আর দু’দিন বাকি! কে নিয়ে যাবে তোমাকে? ”

বাসায় যদি-ও কথা হয়েছে ইরা’কে রাহুল নিয়ে যাবে ঢাকা এক্সাম দিতে। কিন্তু ইরা ধীরস্থির ভঙ্গিতে রিপ্লাই করলো।

—” এক্সাম দিবো না আমি স্যার। আপনাকে কষ্ট দেওয়া জন্য দুঃখিত। ”

শান্ত গম্ভীর রাদ ইরা’র রিপ্লাইকৃত ম্যাসেজটিতে ইস্পাত কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ। অতচ হৃদয় ছলাৎ করে উঠলো ওর। কোথায় একটা তীব্র খারাপ লাগা কাজ করছে। রীতিমতো পুড়িয়ে মারছে ভেতর’টা।

রাদে’র থেকে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ইরা হাফসাফ করে উঠলো। অস্থির ভঙ্গিতে কাঁদতে শুরু করলো এক পর্যায়ে। এতটা জঘন্য অনুভূতি হচ্ছে হৃদপিণ্ডে। কাউকে একটু বলতেও পারছেনা নিজের অসহায়ত্বের কথা। কী ভীষণ কষ্ট, যন্ত্রণা।
_______________

তপ্ত কাটফাটা দুপুরে ইরা’র ঘুম ভাঙ্গে তীব্র চেঁচামেচির শব্দে। রাঁতে দীর্ঘ সময় কান্নার ফলস্বরূপ ভারী আঁখিপল্লব জোরা খুলতেও কষ্ট হচ্ছিলো ইরা’র। যখন শ্রবণেন্দ্রিয়ে বিকৃত, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ভেসে এলো ঝট করে উঠে বসলো। কিয়ৎকাল শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ রেখে বুঝার চেষ্টা করলো আসলে কোথা থেকে ভেসে আসছে এ-ই শব্দ। অতঃপর ঠাহর হতে-ই গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে দৌড়ে বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে ইরা হতভম্ব, বিস্ময়ে বিমূঢ়। ড্রইংরুমে থেকে শুরু করে গেট পর্যন্ত মানুষে গিজগিজ অবস্থা। একটা ২৬/২৭-বছরের পুরুষের সঙ্গে আদি’র রীতিমতো হাতাহাতি লেগে গিয়েছে। লোক’টা আদি’সহ আজমল, আজিম খান’কে সমানে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছে। কিছু লোকেরা আদি’কে এবং অচেনা পুরুষ’কে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। যদি-ও কিছুতে কিছু হচ্ছে না। ফলাফল আরও হৈচৈ বেঁধে যাচ্ছে। ইরা’র হাত পায়ে কম্পন ধরে গেলো এহেন দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে। আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে দেখলো দুই মা কাঁদছে ওদের পিছনে মীতি ভয়ে মুক লুকিয়ে কাঁদছে। আজমল এবং আজিম খান ড্রইংরুমের সোফায় ঠায় মাথানিচু করে বসে। রাহুল’কে কোথাও দেখতে পেলো না ইরা। ওর বুক’টা ধ্বক করে উঠলো দুইবাবা’র নতমস্তক দেখে।
___________

বাড়ি’তে নিরবচ্ছিন্ন পরিবেশ। রাহুল মাত্রই বাড়িতে ফিরেছে। সর্বদা প্রফুল্লচিত্তে, পরিপাটি বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ, এলোমেলো অপরিপাটি। ড্রইংরুমে অস্থিরচিত্তে সবাই বসে। মা-চাচিরা কান্না কাটি করছে। বড় সোফায় আজমল খান বসে। আজিম খান’কে এ-ই মুহূর্তে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রাহুল আশপাশে নরজ বুলিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় ব্যাস্ত ভঙ্গিতে আওড়ালো,

—” কী হয়েছে বড় মা! তোমরা সবাই এভাবে কেন বসে। বাড়ি’র এ-ই হাল কী করে হলো? কী হয়েছে? ”

রাহুলের কণ্ঠ শুনতে দেড়ি ক্ষুব্ধ, ক্রোধান্বিত আদি রুম হতে বেরিয়ে আসতে দেড়ি হয়নি। তেড়ে রাহুলের সম্মুখে আসতে আসতেই আদি ক্ষিপ্র গলায় আওড়ালো,

—” জানোয়ার, অসভ্য এলাকায় ভালোমানুষি করে বেরাস, এ-ই তোর ভালোমানুষি। একটা বিবাহিত মেয়ে’কে তার হাসবেন্ড থাকাকালীন অবস্থায় ঐ মেয়ে’র সঙ্গে নোংরা সম্পর্কে জড়িয়েছিস৷ তোর লজ্জা করলো না এ-ই বাড়িতে পা রাখতে! ”

ততক্ষণে ক্ষিপ্রগতিতে আঘাত করে বসেছে আদি রাহুলের। অতর্কিত হামলায় রাহুল করুণ ভাবে আহত হয়৷ ওর পরনের শুভ্র নির্মল শার্ট রক্তে ভিজে গিয়েছে নাকের রক্তে। বড় মা দৌড়ে এসে রাহুল’কে বুকে চেপে ধরেন চিৎকার করে উঠেন তিনি,

—” বেয়াদব ভাইয়ের গায়ে হাত তুলিস! রক্ত পরছে নীলা কিছু করো। ”

আদি কক্ষাট্ট করে চেঁচালো,

—” একদম দরদী সাজতে আসবে না মা। আজ ওর জন্য লোকে আমার বাসায় এসে আমার বাবা’কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে গিয়েছে। ওদের শিক্ষায় আঙুল তুলে গিয়েছে। ও এ-ই বাড়িতে থাকলে আমি এ-ই মুখের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো বলে দিলাম। ”

ইরা দুই ভাইয়ের দিক তাকিয়ে ভয়ে থরথর কাঁপছে। এতটুকু বয়সে ওদের বাসায় এতবড় ঝামেলা কখনো হয়নি। এটা চিরন্তন সত্যি ওদের বাবা’দের নিয়ে লোকে কটু কথা কখনো বলতে পারেনি। আজ রাহুলের জন্য সে-ই অবাধ্যতা হয়েছে। লোকে বাড়িতে ঢুকে গালাগালি করে গিয়েছে। তা-ই ভয়ে ভাইকে দৌড়ে গিয়ে ধরতে পারছে না। আদি রাগের কাছে সকলে পারস্ত।

রাহুল একটু সামলে নিলো নিজেকে। অতঃপর বড় মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বড়বাবার সম্মুখে বসলো। ব্যাথিত গলায় শুধালো,

—” আমি কোনো অন্যায় করিনি বাবা। চরিত্রহীন লোকটা এখানে অব্ধি এসে যাবে…! ”

রাহুল নিজের মধ্যের কথাগুলো সম্পূর্ণ করতে পারলো না। এ-র আগেই কোথা থেকে আজিম খান এসে মারতে শুরু করলেন ছেলে’কে। রাহুল সেদিন বাপ, চাচা, ভাই সকলের কাছেই চরমভাবে অপদস্ত হয় তীব্র রাগে’র বশীভূত। কেউ ওর কথা শুনতেই চায়নি। বরং ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়। রাহুল এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সোজা খান বাড়ি ত্যাগ করে। ইরা তখন শব্দ করে কাঁদছিলো রাহুল তৎক্ষনাৎ তিক্ত গলায় ধমক দিয়ে উঠে,

—” ভেতরে যা ইরা। ”

___________

সেদিন সকলে রাগের বশীভূত আদি’কে চলে যেতে বললেও। ভেবেছিলো কোথায় আর যাবে রাগ পড়লে বাড়ি’র ছেলে বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু দু’দিন পরে-ও রাহুলের ছায়া বাড়ি পড়েনা এবং খবর আসে রাহুল সে-ই মেয়ে’কে বিয়ে করেছে যে-ই মেয়ে’র জন্য এতো এতো কাণ্ড, তখন সকলেই মনে মনে ওর সঙ্গে সম্পূর্ণ ছিন্ন করে। এরপর থেকে রাহুলের নাম নেওয়াও বাসায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

যদিও যোগাযোগ ছিলো ইরা’র সঙ্গে। রাহুল যদিও রাজি ছিলো না ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে কিন্তু বাধ্য হয় ইরা’র কান্নাকাটি’তে। বিয়ের খবর শুনে যখন ইরা ঝটপট ভাই’কে কল করে।

—” ভাইয়া সত্যি তুমি বিয়ে করেছো? সে-ই মেয়ে’কে? ”

রাহুল অকপটে স্বীকার করে,

—” হ্যাঁ আমি বিয়ে করেছি সে-ই মেয়ে’কেই করেছি। আমি কোনো অন্যায় করিনি ইরা। এ-ই পৃথিবীতে সকলের ভালো থাকার রাইট আছে। ”

—” ভাইয়া প্লিজ খুলে বলো না। আমি জানি তুমি অন্যায় কিছু করোনি? কে সে-ই মেয়ে আর ঐ মেয়ের হাসবেন্ড..? ”

চলবে!