জায়া ও পতি পর্ব-০৯

0
8

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৯
#ইসরাত_ইতি

জান্নাত মামার বাড়ি যাবে, সকাল থেকে কান্নাকাটি শুরু করেছে, একে তাকে ধরছে। কখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কখনো নিশ্চুপ,শামিরের ধমকের ভয়ে শব্দ করে কাঁদছে না।
শামির বৌয়ের এই অবস্থা দেখে বললো,“মামার বাড়ি যাবে?”

_হু।

_কেন? পড়তে দিচ্ছি না বলে রাগ করে যাবে?

কন্ঠে চাপা ক্রোধ শামিরের,জান্নাত বুঝতে পারে, জান্নাত চুপ থাকে এই প্রশ্নের জবাবে,সে তো যাবে মামা মামী আর তার আব্বার সাথে কথা বলতে,তারা যেন শামিরকে বোঝায়। এ বাড়ির ছোটো থেকে বুড়ো প্রত্যেকেই যে শামিরকে তোয়াজ করে চলে তা জান্নাত জানে, এদের বলে কিছু হবে না। যদি শামির শশুর আর মামা শশুরদের বুঝ নেয়! চেয়ারম্যান চাচাদেরও বলবে জান্নাত, যদি ওনারা শামিরকে বোঝায়! জান্নাত ক্ষীণ আলো দেখে আশার।

শামির জান্নাতের কান্নাকাটি দেখে সকাল থেকে, অফিসে যায়নি, হুট করে বলে,“আমি নিয়ে যাবো, রেডি হও।”

বাড়ির সকলে অবাক, রুহি ফিসফিসিয়ে সবাইকে বলে,“কি আশ্চর্য না? মেজো ভাইয়া ভাবীর প্রতি যথেষ্ট ধৈর্য্য দেখাচ্ছে! কি ঠান্ডা মাথায় মেনে নিলো ভাবীর বাপের বাড়ি যাওয়ার আবদার!”

রিজিয়াও তাই দেখে, সত্যি এটাই যে শামিরের মেজাজের দশভাগের একভাগও জান্নাত দেখেনি, শামির দেখায়নি! তবে কি আল্লাহ একটু সুবুদ্ধি দিলো এই ছেলেটাকে?

বাড়ির কোণে আলোচনা হয় এসব নিয়ে, রিজিয়া কিঞ্চিত বিশ্বাস নিয়ে বলে,“মনে হচ্ছে ছেলেটা ধীরে ধীরে মেনে নেবে,বৌমাকে কলেজে ভর্তি করাবেই,দেখিস!”

মায়ের এসব কথা কানে যায় শামিরের, তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, চাইলেই সে মেজাজ দেখিয়ে জান্নাতকে একেবারে চুপ করিয়ে দিতে পারে, যাতে এতো রাগ দেখিয়ে আর কখনও বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা না ভাবে, তবে সবাইকে বোঝানোর পদ্ধতি শামিরের এক নয়, অন্তত জান্নাতের মতো কোমল চিত্তের মেয়েদের সাথে শামির নিজের উগ্র জেদী রূপটা কম দেখাতে চায়, তাই শামির চিন্তা করলো বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করার।

শামির চৌধুরী অফিস কামাই করে জান্নাতকে নিয়ে নিজে ড্রাইভ করে ছুটলো রুপাতলী। গাড়িতে দু’জনে চুপচাপ, জান্নাত আল্লাহ আল্লাহ করছে,লোকটা যেন মানে, শশুর, মামা শশুরদের সাথে যেন বেয়াদবি না করে!
একটা লাল রঙের হাফসিল্কের শাড়ি পরেছে জান্নাত,বাতাসের দাপটে ঘোমটাটা বারবার পরে যাচ্ছে নিচে। শামির আড়চোখে দেখে হঠাৎ বলে ওঠে,“কদিন রাগ করে মামা বাড়ি থাকবে জান্নাতুল?”

মেঘের মতো গম্ভীর প্রশ্ন! জান্নাত আমতা আমতা করে বলল,“আমি বেড়াতে যাচ্ছি!”

হুট করে গাড়ি থামায় শামির, জান্নাত ঘাবড়ায়।

“বেড়াতে যাচ্ছো?”

_হু-জি।

_বেশ!
ঠান্ডা স্বরে জবাব দিয়ে আবারও গাড়ি স্টার্ট করে শামির। এরপর কেউ কোনো কথা বলেনি।
শাহীনুর জান্নাতকে দেখে খুশিতে গদগদ হলো যেন। শামিরের আনা উপহার সামগ্রী দেখে হয়েছে দ্বিগুণ খুশি। শাহীন আকন্দ বাড়ি ছিলেন না, শামির বেশিক্ষণ বসলো না, টুকটাক কথাবার্তা বলে জান্নাতকে রেখে চলে যায়।

শাহীনুর জান্নাতকে ধরলো,“কি রে? জামাই রাইগা আছে নাকি?”

জান্নাত জবাব দেয় না, ধমকায় শাহীনুর,“তুই ওই বা*লের পড়াল্যাহার লইগ্যা বেয়াদবি করছিস জামাইর লগে?”

জান্নাত কিঞ্চিত মেজাজ দেখায় বড় মামীর ওপর,“পড়ালেখাকে এতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না মামী! মামা কোথায়? মামার সাথে আমার কথা আছে।”

_কি কথা তোর মামার সাথে?

_কি কথা আবার? জানতে চাইবো সবাই আমাকে এভাবে ঠকিয়েছো কেনো? আমি কি এতোই ফেলনা ছিলাম? দিতাম তো বাড়ির সব কাজ করে! এভাবে ঠকিয়ে বিয়ে দিলে কেন?

শাহীনুর রাগে গজগজ করে ওঠে,“বাহ রে বাহ! কথা ফোটছে? বেশ করছি বিয়া দিছি! লেখাপড়া কইরা কোন বাল*ডা উগলাইতি রে? ঐতো একটা রেইন্ট টেকার ধইরা ভাইগা যাইতি, তারপর ভুগতি মায়ের নাহান।”

মৃত মায়ের কথা ওঠায় ভীষণ কষ্ট পেলো জান্নাত, কান্না পেলো খুব। শাহীনুর বলতে লাগলো,“শোন জান্নাত, বিয়া দিছি, চুপচাপ সংসার করবি। জামাইর লগে ঝামেলা কইরা তালাক নিলে এরপর আর বিয়া চক্ষে দ্যাহা লাগবো না, গার্মেন্টস কইরা খাওয়া লাগবে,লেহাপড়া তো দিল্লি,বহুত দূর।”

চোখ মোছে জান্নাত, একটু থামে শাহীনুর, এরপর ঠাণ্ডা মাথায় বলে,“কয়দিনের লইগা আইছোস? আইজ থাক, তোর মামা কাইল বরিশাল দিয়া আসবোনে তোরে।”

চূড়ান্ত আহত জান্নাত আর সহ্য করতে পারেনি কথাটা, এতদিন পরে এলো আর তাকে মামী জিজ্ঞেস করছে সে কবে যাবে? শাহীনুর শামিরের কিনে আনা উপহার সামগ্রী দেখতে ব্যস্ত, জান্নাত আর বসে না,পার্স হাতে নিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে যায় আকন্দ বাড়ি থেকে, সে যাবে কদমতলা, তার বাবার কাছে, বাবাকে হাতে পায়ে ধরে বলবে শামিরকে বোঝাতে।
ঘোমটা সামলে চোখ মুছতে মুছতে জান্নাত বড় রাস্তায় উঠতেই থমকাল, শামিরের গাড়িটা বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, শামির তখনও যায়নি। লুকিং গ্লাসে জান্নাত সানগ্লাস পড়া সুদর্শন মুখটা দেখতে পেয়েই অবাক হয়ে এগিয়ে যায় সামনে। শামির চশমা খুলে ফেলে, জান্নাত গিয়ে বলে,“আপনি যান নি?”

_না, গাড়িতে ওঠো।

জান্নাত দাঁড়িয়ে থাকে, শামির আদেশের সুরে বলে,“আমি বলেছি গাড়িতে উঠতে।”

ধীরে ধীরে জান্নাত শামিরের পাশের সিটে গিয়ে বসে, শামির ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়,“কোথায় যাচ্ছিলে?”

_কদমতলা,আব্বার কাছে।

কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে শামির বলে,“কি লাভ? তোমার সৎমা জানতে চাইতো, তুমি কবে যাবে! বিবাহিতা কোনো মেয়েকে একদিনের বেশি বাড়িতে রাখতে চায়না কেউ!”

জান্নাতের চোখ বেয়ে পানি পরে, শামির একহাতে তা মুছিয়ে দিয়ে জান্নাতকে কাছে টানে,কপালে ছোটো একটা চুমু খেয়ে কন্ঠে গম্ভীরতা বজায় রেখে বলে,“বাস্তবতা বোঝো জান্নাতুল, বাস্তবতা হচ্ছে তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এবং ওনাদের কাছে তুমি স্রেফ একটা বোঝা! এসব লোকের দরজায় গিয়ে কি লাভ? তোমার স্বামী আছে, সংসার আছে, সব আছে!”

জান্নাত নিশ্চুপ কাঁদছে, শামির চুপচাপ সে কান্না দেখে, বলে,“পড়াশোনা করতে দিচ্ছি না বলে রাগ করে একেবারে রূপাতলী চলে আসলে, কি লাভ হলো? বুঝে গিয়েছো বাস্তবতা? বাস্তবতা হলো আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই জান্নাতুল!”

জান্নাত চুপ হয়ে গিয়েছে একেবারে, শামির বলে, “চলো বাড়িতে। এই গরমে এখানে বেড়াতে হবে না, গায়ে ঘামাচি হবে, গরম কমলে এসে দুদিন থাকবে। কেমন?”

_______

“তো সেদিনের পর থেকে ভাবী আর কান্নাকাটি করেনি?”

_না!
বরফ ঠাণ্ডা জবাব দিলো শামির। তানভীর ওর দিকে তাকিয়ে বললো,“ছোটো মানুষ। একটু যদি মানিয়ে নিতি!”

_পুরুষের ডিকশনারিতে মানিয়ে নেয়া কথাটা থাকা উচিত নয়,ওটা মেয়েরা করবে!

তানভীর রীতিমতো বিরক্ত,জেদী বন্ধুর সামনে নিজের বিরক্তি প্রকাশ না করেই বললো,“চাকুরী না হয় নাই-ই বা করতে দিলি, অন্তত লেখাপড়াটা! তুই মান্ধাতার আমলের পুরুষের মতো ব্যবহার করছিস! স্ত্রী কি শুধু বিছানাতেই গুরুত্ব পাবে? তাদের সকল মৌলিক অধিকার পূরণ করাও তো স্বামীদের কর্তব্য!”

_তোর কেনো মনে হচ্ছে আমি স্ত্রীকে শুধু ভোগবস্তু মনে করছি? স্ত্রীকে স্ত্রীই মনে করছি, শুধু এই বেহুদা জিনিসটার কোনো প্রয়োজন নেই আমার স্ত্রীর!

_শিক্ষা বেহুদা?

_নারীর উচ্চশিক্ষা বেহুদা, মস্তিস্কে পোকা ধরায়, নারীর সরলতা কেড়ে নেয়, দূষিত করে অবলা মস্তিষ্ক! একটা সময় এরা নিজেদেরকে সর্বেসর্বা ভাবতে শুরু করে, পুরুষদের থেকে দুই কাঠি ওপরে উঠে।

_ভাই মাফ চাই, তোর সাথে কথায় পারবো না। তোর স্ত্রী,যা মন চায় কর, শুধু একটা কথা,বেচারীকে ধমকাধমকি কম করিস, সহ্য করতে না পেরে যদি তালাক চেয়ে বসে! আই মিন, কয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসবি তুই! ভাবী খুবই চমৎকার মানুষ!

ফিচেল হাসলো শামির,“ঐ যে বললাম! আমার স্ত্রী পুরোপুরি আমার নিয়ন্ত্রিত। ওকে তো বুকে রাখি আমি।”

_শা’লা! তুই রোমান্টিক আছিস! আচ্ছা একটা কথা বল, একান্ত সময়ে ভাতের হাঁড়ির মতো মুখ করেই রাখিস? দু’টো কথা হেসে বলিস না মেয়েটার সাথে?

_বলি তো! তোরা আমাকে কি ভাবিস?

_ভাবতাম তো অ্যাংরি ম্যান শামির,যার কপালে বৌ থাকবে কি থাকবে না সে নিয়ে আমরা ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই টেনশনে থাকতাম!

শামির গম্ভীর হয়ে কফিটা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়,বলে,“উঠছি!”

_হানিমুনে যাচ্ছিস কবে?

_সামনের মাসের শুরুর দিকে, সময় বের করে। এ মাসে কাজের চাপ প্রচুর।

_তুই হানিমুনে গিয়ে কি করবি ভেবে পাইনা! বেচারিকে ধমকা ধমকিই তো করবি! তার জন্য সুদূর সিলেট নিয়ে যাওয়ার কি প্রয়োজন!

টিটকারি মেরে কথাটা বলে তানভীর। শামির কোন কথা না বাড়িয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়ি স্টার্ট দেয়। সেসময় তানভীরের স্ত্রী সুপ্তি সেই রেস্তোরাঁয় চলে আসে, তানভীরকে বলে,“তোমার সেই নারীবিদ্বেষী বন্ধুটি! আহা কি সুদর্শন দেখতে অথচ কি রুক্ষ!”

_নারীবিদ্বেষী বলো না,একটু যা রাগী!

_হুম, সেজন্য বৌকে পড়াতে চায়না? কেমন মানসিকতা!

_আসলে অমন মাইন্ড সেট হয়েছে ওর।

_কেন? এর পেছনে কারণ কি? শুনতাম ভার্সিটির মেয়ে শুনলেই নাক সিঁটকায়। এতো ঘৃণা কেনো?

_এর কারণ বর্তমানের হালচাল, ঢাকা পড়াশোনা করে ও দিন দিন এমন হয়েছে, ওর ধারণা ভার্সিটির ষাট পার্সেন্ট মেয়েদের সুগার ড্যাডি থাকে, একশো পার্সেন্টের পনেরো পার্সেন্ট ভার্সিটি পড়ুয়া অবিবাহিতা মেয়েরা নিজেদের কুমারীত্ব ধরে রাখে! ও খুব কাছ থেকে একটা নষ্ট ছাত্রগোত্র দেখেছে, কনসার্টে মেয়েদের বেহায়াপনা, বা ক্লাসমেটদের মধ্যে,যাস্টফ্রেন্ডদের মধ্যে গিভ অ্যান্ড টেক রিলেশনশিপ দেখে একসময় ও চিন্তিত হতে শুরু করে, নিজেকে ও এতো কষ্টে সংযত রেখেছে, কখনো প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়নি, শুধু পড়াশোনা আর ফুটবল নিয়ে থেকেছে, ও চিন্তায় পরে গিয়েছিল একটা ভালো মেয়ে জুটবে তো কপালে! নাকি এসব মেয়েদের মধ্যে থেকেই কাউকে গ্রহণ করতে হবে! এসব কথা প্রায়ই বলতো ও।

_কি অদ্ভুত! হ্যা মানছি দুনিয়াটা নষ্ট হচ্ছে,তাই বলে সব ছেলে মেয়ে তো এমন নয়! এরকম আন্দাজী ধারণা পোষণ করা তো ঠিক নয়!

_সেটাই ওকে বুঝিয়েছি। অনেক দেখেশুনে এক ডাক্তার মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছি সবাই, বিয়ের পনেরো দিনের মাথায় ঝামেলা শুরু । ঐ ডাক্তার মেয়ে মানে ফারিন ওর কাছে কোনো কিছুর জবাবদিহিতা করতো না, কিছু জানতে চাইলেই বলতো,“আমি জব করি! হ্যান ত্যান! এতো কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই!”
ব্যস হয়ে গেল, শামির প্রচন্ড রাগে দু’দিন সময় নিলো না ডিভোর্স দিতে। এরপর থেকে ও চূড়ান্ত বিতৃষ্ণ কোনো আত্মনির্ভরশীল মেয়ের প্রতি! আর আমাদের বন্ধুমহলে পর পর পাঁচ জনের ডিভোর্স ঠিক একই কারণে হয়েছে, এই ব্যাপারটাতে শামির প্রভাবিত।

সুপ্তি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলে,“হুম! বুঝলাম। পুরো ব্যাপারটাতে আমি তোমার বন্ধুটির দোষ দিতে পারছিনা একতরফা, তবে তোমার বন্ধুটিকেও তো বুঝতে হবে তার চোখে দেখা, নারী নিয়ে অভিজ্ঞতার সাথে জান্নাতুলের কোনো সম্পর্ক নেই।”

_কে বোঝাবে ওকে বলো! যা জেদী!

_দুঃখজনক! খুবই দুঃখজনক! আসলে বিষাক্ত নারীবাদীত্বের অসুখে জর্জরিত বেলাল্লা নারীদের জন্য ভুগতে হয় সাধারণ শ্রেণীর,আই মিন জান্নাতুলের মতো নারীদের! শুধু তোমার বন্ধু শামির নয়, আশেপাশে তাকিয়েই দেখো, এক নারীর উগ্রতার শিকার হয়ে পুরুষ আক্রোশ মেটাচ্ছে আরেক সাধারণ নারীর ওপর। তোমাকে একটা উদাহরণ দিই, পুরুষের সাইকোলজি এমনভাবে গঠিত হচ্ছে, দেশের সব স্থানে নারীর অগ্রাধিকার বেশি হওয়ায় হীনমন্যতায় ভুগছে এক শ্রেণীর পুরুষ, যার আক্রোশ গিয়ে পরছে সমস্ত নারীর ওপর! আধুনিক রাষ্ট্রে নারী পুরুষ সমান অধিকারের আন্দোলন সুক্ষ্মভাবে নারী পুরুষেরই বৈষম্য করে দিয়েছে যার কোনো সমাধান নেই। এবং এটা পারতপক্ষে কোনো সমস্যা মনে না হলেও একটা বিশাল বড় সামাজিক সমস্যা। মহামারীর মতো ছড়িয়ে পরছে, তাই তো শামিরের মতো শিক্ষিত নারীবিদ্বেষী পুরুষের অভাব নেই।

কথাগুলো উদাস গলায় আওড়ায় সুপ্তি। পরপর বলে,“বাদ দাও, তোমার বন্ধু পত্নীর কথা বলো, সে কি ঝামেলা করছে?”

_আরে ধূর! ছোটো মানুষ, আবেগী, অসহায়, স্বামীর কথা মেনে নিয়ে সংসার করা ছাড়া এদের সামনে আর রাস্তা আছে কোনো?

______

বাংলা দ্বিতীয় পত্র, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র, গণিত, জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান…..
আজ সোমবার,রূটিন অনুযায়ী বইগুলো সব ব্যাগে ভরে নেয় জান্নাত, দুদিন ধরে শামার পড়ার টেবিল সে গোছাচ্ছে। টেবিলের ওপর শামার হোমওয়ার্ক খাতাটায় চোখ পড়তেই দেখলো পঞ্চম অধ্যায়ের একটা অংক অসমাপ্ত, শামা করতে পারেনি, কিন্তু জান্নাত চোখ বুজে এই অংকটা করতে পারে।

জান্নাতের ভালো লাগে শামার বই গোছাতে, সে নিজে থেকেই এই কাজটা করে, শুধু এই কাজটা নয়, সংসারের যাবতীয় কাজ সে নিজে থেকেই করে, বড়লোকের বৌ কি না! কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বাধ্যতামূলক কাজ হলো শুধুমাত্র শামিরের মন মতো একটা একটা দিন কাটানো। যদি বলে বারান্দায় যেওনা জান্নাত বারান্দায় যায়না, যদি বলে ছাদে যেও না জান্নাত ছাদে যায়না, যদি বলে এখন উঠো না শুয়ে থাকো জান্নাত শুয়ে থাকে।

সেদিনের পর জান্নাত ওভাবে শামিরের কাছে কান্নাকাটি করেনি পড়াশোনা নিয়ে, লোকটার যা মেজাজ, মামীর কথা অনুযায়ী যদি রেগে জান্নাতকে তালাক দেয়? তালাকের কথা মনে হলেই জান্নাতের বুক কাঁপে, তালাক খুবই ভয়াবহ একটা ব্যাপার সে এটুকু বোঝে। যেমনই হোক কিশোরী নরম মেয়েটি তার স্বামীকে ভালোবেসে ফেলেছে, তার জীবনের প্রথম পুরুষ,তার স্বামী,তার জীবনের প্রথম পরম স্পর্শ দাতা, রোজ রাতে যার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে হয়, একটু একটু করে ওর সর্বস্ব জুরে যে মানুষটা আছে,ওর ভালোতে,মন্দতে, সেই মানুষটাকে রাগিয়ে জান্নাত তালাক চায়না, কোনো মতেই না। স্বামী ভালো হোক, খারাপ হোক, ত্যাড়া হোক, স্বামী তো স্বামীই, এই জীবনের একমাত্র আপন মানুষ।

জান্নাত কতটা কি হারিয়েছে জান্নাত সে হিসেবে যায়না,এটুকু মেনে নিয়েছে সম্পর্ক সুন্দর রাখতে হলে দু’জনের একজনকে একটু ত্যাগী হতেই হবে। জান্নাত না হয় একটু ত্যাগ করলো তার সংসার বাঁচাতে। তাও তো কম চেষ্টা করেনি সে, কত চোখের জল ফেলেছে, লোকটার মনই গললো না। মামীর কথামত বরের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেও পড়ার কথাটা তুলেছিলো, শামির কানে নেয়নি। গত পরশু রাতেও তো, ঘনিষ্ঠতার চরম মুহুর্তে, শামিরের মন যখন ফুরফুরে ছিলো, জান্নাত শামিরের গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করে বলেছিল,“শুনছেন!”

শামির তখন তৃপ্তিতে সন্তুষ্ট,খুশি খুশি জান্নাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,“বলুন ম্যাডাম!”

একান্ত সময়ে শামির জান্নাতের প্রতি অতিরিক্ত খুশি হলে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করে, জান্নাত খুব সাহস পায়, অন্যান্য বৌদের মতো মোক্ষম সময়টাকে কাজে লাগিয়ে আবদার করে,“আমি পড়ি?”

শামির সে রাতে ধমকা ধমকি করেনি যদিও, তবুও জান্নাত শামিরের মুখভঙ্গি দেখে চুপ হয়ে গিয়েছিলো একেবারে, বিছানায় স্বামীর পাশে চাদরের নিচে অর্ধনগ্ন শুয়ে থাকা নিজেকে তার একটা কাঠপুতুলি মনে হয়েছিলো ক্ষণিকের জন্য, মাঝে মাঝেই মনে হয় এমন, কিন্তু যখন আবার শামির পরেরদিন রাতে মিষ্টি মিষ্টি ব্যবহারে আগলায়, জান্নাত ভুলে যায় সবকিছু, তার মনে হয় সে এই লোককে ছাড়া বাঁচবে না, সবকিছু মেনে নেবে, শুধু এই লোক খুশি থাকুক।
মোটকথা জান্নাত নয় শুধু,জান্নাতের আবেগ অনুভূতি প্রতিক্রিয়াও ছিলো পুরোপুরি তার স্বামী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।

নিজের এই অবস্থায় সে শামিরকে দোষারোপ করেনি মোটেই, কেনো করবে? দোষারোপ করতে হলে তো সেটির তালিকা লম্বা হবে, প্রথমেই দোষারোপ করতে হয় তার মা’কে,যে জান্নাতের ছোটো বেলায় মরে গিয়েছিল, তারপর দোষারোপ করতে হয় জান্নাতের বাবাকে,যে বিয়ে করে জান্নাতকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, তারপর তার মামা মামীকে যারা জান্নাতের বিয়ে দিয়েছে, এরপর আসে এই লোক…যে তার স্বামী, কিভাবে কিভাবে যেনো জান্নাত লোকটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে।

শামার ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জান্নাত সকাল সকাল চুলে খোপা করছিলো, আয়নায় নিজেকে দেখছিল, বিয়ের একমাস চলছে, জান্নাত কিছুটা স্বাস্থ্যবতী হয়েছে, নিজেকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে জান্নাত হঠাৎ উদাস হয় আবারও,বাইরে থেকে তখন শামিরের হাকডাক,“জান্নাতুল! অ্যাই জান্নাতুল!”

চেঁচিয়ে সাত বাড়ি মাথায় করে ফেলার মতো অবস্থা, যেনো পৃথিবী উলটে যাচ্ছে! লোকটার ভীষণ হম্বিতম্বি,অযথাই। জান্নাত এ কদিনে বুঝেছে, একটা অতি সাধারণ কাজেও নিজের মেজাজ দেখিয়ে দেয়। জান্নাত ধীরে ধীরে উপরে উঠছে, তার কোনো তাড়া নেই, সে জানে এই এতো চেঁচামেচির কারণ খুবই সামান্য হবে, হয়তো লোকটা নিজের আন্ডারওয়্যার খুজে পাচ্ছে না কিংবা অফিসে যাওয়ার আগে বৌকে কিছুক্ষণ চটকাতে মন চাইছে। তাই সাত পাড়া শুনিয়ে গর্জন করছে, পুরুষ পুরুষ জাহির করতে নিজেকে।

আসলেই তাই,জান্নাতকে দেখেই শামির গুরুগম্ভীর গলায় বলে,“আমার আন্ডারওয়্যার কই?”

জান্নাত একটা লম্বা শ্বাস ফেলে আলমারি থেকে বের করে দেয়। শামির বলে,“কোথায় গিয়েছিলে? বাগানে?”

_জি না, শামার ঘরে!

_ঠিক আছে, শোনো সকালে এই টাইমে বাগানে যাবে না, শিকদার আঙ্কেলের ছোটো ছেলে আর ভাগ্নে এই সময়ে ওখানে আসে। ভুলেও যাবে না ঠিকাছে?

জান্নাত মাথা নেড়ে চলে যেতে নিলে শামির ওর হাতটা খপ করে ধরে, জান্নাত চোখ তুলে তাকাতেই বলে,“আমি যেতে বলেছি?”

চুপচাপ মাথা নাড়ে জান্নাত।

“তাহলে দাঁড়িয়ে থাকো।”

চলমান…..