জায়া ও পতি পর্ব-১২

0
12

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_১২
#ইসরাত_ইতি

ঘরের এককোণে বসে তখনও কাঁপছিল মেয়েটা ভয়ে। মেঝেতে সর্বোত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচের টুকরো,ভাঙা ফুলদানি, যেগুলো শামির ভেঙেছে।
শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিতে নিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জান্নাত দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে বসে থাকে দু’চোখ বুজে,একটু আগে যা যা হয়েছে আরো একবার ভাবতে থাকে সেসব।

শামির বসে ছিল। জান্নাত নিজের সাফাই দেওয়ার জন্য দুকদম এগিয়ে গিয়ে বলছে,“চাচী আম্মার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল তাই…..”

উঠে দাঁড়ায় শামির। রিজিয়া বণিক আতঙ্কে জমে গিয়ে ছেলে আর ছেলের বৌকে দেখে, ধীরে ধীরে শামিরকে বলে,“ওর কোনো দোষ নেই,আমিই যেতে বলেছি। এই বৌমা, তুমি যাও, রান্নাঘরে।”

জান্নাত কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে,ভুল করেও শামিরের চোখের দিকে চায়না, তার সে সাহস নেই। সুহানাও জান্নাতের হয়ে সাফাই গাইতে মুখ খুলবে ঠিক তখনই শামির চেঁচিয়ে ওঠে,“বেয়াদবটাকে পড়াশোনা করতে দিইনি তাতেই এতো চালু, পড়াশোনা করতে দিলে তো আমাকে কথায় কথায় মুরগি বানাতো।”

জান্নাত হতবিহ্বল হয়ে তার শাশুড়ির দিকে তাকায়, রিজিয়া চোখ নামিয়ে নিয়েছে। শামির এসে জান্নাতের হাতটা ধরতেই জান্নাত কেঁপে উঠল,শক্ত হাতের পেষণে কবজি ব্যাথা করছে, বুক কাঁপছে মাত্রাধিক, কি হবে তার সাথে এখন? লোকটা গাঁয়ে হাত তুলবে? তুলতেও পারে,এই লোককে বিশ্বাস নেই। জান্নাত অসহায়ের মতো তার শাশুড়ি আর বড় জা’য়ের দিকে তাকায়, ততক্ষণে শামির তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দোতলায়, রিজিয়া বণিক পিছু পিছু ছুটছে,“ও শামির। সামান্য ব্যাপার, এতো বাড়াবাড়ি করিস না।”

_দূরে থাকো মা আমাদের ব্যাপার থেকে।

_ছোটো মানুষ,বুঝতে পারেনি। এখন বৌয়ের গাঁয়ে হাতও তুলবি তুই?

কথার জবাব না দিয়ে সুহানা আর রিজিয়ার মুখের সামনে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে শামির জান্নাতের দিকে তাকায়, জান্নাত কাঁদছে, ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে শামির দুকাধ ধরে ঝাকুনি দিয়ে চেঁচায়,“আর কোথায় কোথায় যাওয়া হয়? আর কি কি করা হয়? যা আমি নিষেধ করি, সে সব কিছু?”

_কিছু না, কিছুই করিনা আমি। আম্মাকে জিজ্ঞেস করেন।

ফোপাতে ফোপাতে বলে জান্নাত।

_এই দেখি আমার দিকে তাকাও তো।
জান্নাত ভেজা দু’চোখ তুলে তাকাতেই শামির আবারও চেঁচায়,“আমার নিষেধ সত্ত্বেও কেন গিয়েছো ও বাড়িতে? বারোয়ারি মেয়েদের মতো পাড়া মারাতে না পারলে শান্তি লাগে না তাইনা? ঘরের কোনো কিছুতেই শান্তি লাগে না? তাই তো বলি দিনদিন এতো উদাসীন কেন সংসারের প্রতি,আসলে মনটা তো পরে থাকে রাস্তায়।”

এ কথার জবাবে জান্নাত কিছুই বলে না, আবারও চেঁচায় শামির,“ও বাড়িতে কটা পুরুষ মানুষ, জানো না? তাদের সাথে আমাদের কেমন সম্পর্ক। সব জানো না? একেবারে মুখ দেখাতেই গিয়েছো ওদের? ভালোমন্দ বুঝেই আমি বারণ করেছি। সুযোগ পেয়ে আমার বৌয়ের আঁচল ধরে টানতেও ছাড়বে না ওরা। আশেপাশের বাড়িতে যেতে দিইনা আমি? দিই তো! এই জবাব দিস না কেন? এতো সাহস দিলো কে তোকে! ”

ধমকে ধমকে গুটিয়ে যাচ্ছে জান্নাত। শামির কাঁপছে রাগে। দুইটা চ’ড় থাপ্পড় মেরেই দিতো ,বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করেছে সে। কিন্তু রাগ মিটিয়েছে ঘরের জিনিসপত্রের ওপর, কিছুক্ষণ ভাঙচুর করে হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানায় বসে বলে,“এই বেয়াদব শোন! এটা প্রথম এবং শেষ বার। এরপর এমন দুঃসাহস করলে ঠ্যাং ভেঙে ফেলবো!”

শামির চেঁচামেচি করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে জান্নাত দ্রুত ঘরের দরজা বন্ধ করেছে, রিজিয়া বণিক শত অনুরোধ করলেও খোলেনি,চিল্লিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে চুপ হয়ে গিয়েছে। তখন থেকে কক্ষবন্দী সে।

দুপুর দুইটা নাগাদ জান্নাত উঠে দরজা খুলে দেয়, বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টানা তিনদিন ধরে এমন সময় বৃষ্টি হচ্ছে। রেনু এসে ঘর পরিষ্কার করছে। রিজিয়া আর সুহানা এসে জান্নাতকে বোঝায়, রিজিয়া ছেলেকে বিশ্বাস করে না, জান্নাতের শরীর দেখতে থাকে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। জান্নাত নড়েচড়ে ওঠে, শাশুড়িকে ছোটো করে বলে,“মারে নি আম্মা।”

রিজিয়া মলিন মুখে দেখে মেয়েটাকে, মেয়েটার জন্য তার অগাধ মায়া, অযথা মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করলো তারা, এই মেয়েটি আরো ভালো, হাসিখুশি থাকতে পারতো।

শীতকালে হঠাৎ এতো বৃষ্টি হয়না,বৃষ্টি যেন থামছেই না। আড়াইটা পেরিয়ে গেলেও আজ যখন শামির এলো না দুপুরের খাবার খেতে তখন জান্নাতের চিন্তা হলো, কখনো তো এমন হয় না। আজ কি কোথাও যাওয়ার কথা ওনার? নাকি রাগ করেই আসছে না? আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জান্নাত ঠিক করলো একটা কল করবে সে, আজ সদররোডে হরতাল, শামিরকে ঐ রোড দিয়েই আসতে হয়, রেগে থাকলে থাকুক, রাগ তো জান্নাতেরও আছে, তাই বলে খোজ নেবে না?
দ্রুত আঙুল চালিয়ে জান্নাত শামিরকে কল লাগায়, তিনবার রিং বেজে কলটা রিসিভ হতেই জান্নাত কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে মেয়েলি স্বর বলে ওঠে,“হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম?”

জান্নাতের পুরো শরীরটা কেপে উঠল, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,“হ্যা-হ্যালো কে?”

ওপাশ থেকে কল কাটার আওয়াজ আসে। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে জান্নাত দাঁড়িয়ে থাকে, অতঃপর হাত থেকে তার ফোন পরে, মেঝেতে পরে যায় সেও। মাথাটা এলোমেলো হয়ে ছিলো আগেই, তাই কিছু খতিয়ে দেখার কথা মাথায় আনলো না অতটুকু মস্তিষ্ক। মামী যে তাকে সবসময় বলে,“অবাধ্য হইস না, অবাধ্য হইস না। এতে পুরুষ মাইনষের মন উইঠ্যা যায়। আর বড়লোক পুরুষের জন্য সবসময় রেডিই থাহে বিকল্প নারী। তোরে ভালো কইরা কইতাচি জান্নাত, অবাধ্য হইস না। চান্দের নাহান স্বামী পাইছো, নিজের ওপর থেইক্যা এর মন উঠতে দিসনা।”

কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে একটা বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠে জান্নাত।
নিচতলা থেকে ছুটে আসে রিজিয়া বণিক, ছুটতে ছুটতে এসে দেখে জান্নাত মেঝেতে বসে কাঁদছে আর দেয়ালে কপাল ঠুকছে।

রিজিয়া ছুটে এসে ছেলের বৌকে ধরে,“এই বৌমা,কি হয়েছে? এমন কেন করছো?”

হাপাচ্ছে জান্নাত, হাঁপাতে হাঁপাতেই কোনরকমে আর্তনাদ করে উঠলো,“আম্মা….আম্মা আমার সব শেষ হয়ে গিয়েছে।”

_সব শেষ হয়ে গিয়েছে মানে?

_আপনার ছেলে…

_আমার ছেলে কি?

_আপনার ছেলে একটা মেয়ের কাছে গিয়েছে আম্মা ।

বলতে বলতে আবারও কান্নায় ভেঙে পরলো জান্নাত। তবে কি এমনই হয় সব মেয়ের জীবনে? যেমন তাদের গ্রামের অনেকের সাথে হয়েছে? এমনই মেয়েদের জীবন? দু হাতে উজাড় করে দিলেও পুরুষ মানুষ ভুলিয়ে রাখা যায়না, জান্নাত তো দু হাতে উজাড় করেই দিলো আনুগত্য, তবুও কি করে পারলো লোকটা এমনটা করতে!

কান্না থামছে না জান্নাতের। রিজিয়া বললেন,“একটু শান্ত হও, আগে বোঝো তুমি, কি উল্টা পাল্টা ভাবছো?”

ওসব কথার জবাব না দিয়ে জান্নাত ডুকরে ওঠে,“আম্মা আমি কি অনেক বড় দোষ করেছি যে এতটুকু সময়ের মধ্যে আরেকজনের কাছে যেতে হবে?”

বাড়িতে একটা পুরুষ লোক নেই, রিজিয়া আর সুহানা পরেছে মহাবিপদে, জান্নাতের থেকে যেটুকু শুনতে পেলো তাতেই মাথা ধরেছে, শামিরকে লাগাতার ফোন করে যাচ্ছে তারা, শামির ফোনটা ধরেনি।

সারাদিনের কাজের চাপে কাহিল অবস্থা শামিরের, অফিস থেকে বেরিয়েছে রাত নয়টার দিকে, সেখান থেকে চলে এসেছে তানভীরের বাড়িতে, তানভীরের বৌ গিয়েছে বাপের বাড়ি তাই সে সুযোগে সব বন্ধুরা মিলে রাত দেড়টা অবধি সেখানে কার্ড খেলেছে।

তানভীর একফাকে জিজ্ঞেস করে,“কি হয়েছে? রাত দেড়টা বাজে, বেচারীকে যথেষ্ট তড়পেছিস। এবার যা বাড়িতে।”

_যাবো সময় হলে, শিক্ষা হোক ভালো করে তারপর যাবো। আগে বুঝুক।

শুধুমাত্র জান্নাতকে শিক্ষা দিতে শামির সেদিন লাঞ্চে বাড়িতে যায়নি, অল্পবয়সী আবেগপ্রবণ বৌকে জব্দ করার উপায়ও শামির চৌধুরীর ভালো করে জানা আছে, তার জন্য বৌয়ের গায়ে হাত তুলতে হয়না। এভাবে নিয়ম করে তিনদিন রাত করে বাড়িতে ফিরলেই শিক্ষা হয়ে যাবে।
জান্নাতকে শিক্ষা দিতে রাত দু’টো নাগাদ বাড়িতে পৌছায় শামির, রিজিয়া আর সুহানা শুকনো মুখে ড্রয়িং রুমে বসে ছিলো, রিজিয়ার মাথায় হাত, শামিরকে দেখেই তাড়াহুড়ো করে বলে,“কই ছিলি সারাদিন? ফোন ধরিস নি কেন?”

_ব্যস্ত ছিলাম।
অল্প কথায় জবাব দিয়ে শামির দোতলার দিকে পা বাড়ায়, তার হাতে জান্নাতের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, যার লিস্ট আজ সকালে নিয়েছিলো, বৌয়ের প্রতি রাগ থাকলেও বৌয়ের জিনিসপত্র কিনতে ভোলেনি শামির চৌধুরী। রিজিয়া আর সুহানা শামিরের পিছু পিছু যায়। ঘরে ঢুকেই জান্নাতকে ঘরের কোথাও দেখতে না পেয়ে আবারও মাথাটা গরম হয়ে যায় শামিরের, মায়ের দিকে ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,“কোথায় গিয়েছে? রুপাতলী নাকি?”

_না, ছাদে।

_ছাদে মানে? এতো রাতে? ঝুম বৃষ্টিতে?

রিজিয়া চুপ থাকতে পারলেন না, রেগেমেগে বললেন,“না বিকাল তিনটার পর থেকেই ছাদে তোর বৌ, সেখানে বসে কাঁদছে, শত বুঝিয়েও আনতে পারিনি নিচে।”

শামির হাত থেকে শপিং ব্যাগ গুলো ফেলে রেখে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে হন্তদন্ত হয়ে ছাদের দিকে যেতে যেতে বলে,“আমার শাসনের ওপর রাগ দেখায়! আজ ওর একদিন কি আমার একদিন।”

_তার আগে বল মেয়েটা কে!

শামির দাঁড়ায়,মায়ের দিকে ফিরে বলে,“কোন মেয়েটা?”

_যার সাথে তুই আজ দুপুর থেকে ছিলি। ছিঃ !

কথাটা বলেই রিজিয়া বণিক মুখ ঘুরিয়ে নেয়। শামির হতভম্ব হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ,“হোয়্যাট! এসব কি বলছো তুমি?”

সুহানা এগিয়ে যায়,“জান্নাত তোমার ফোনে কল করে তিনটায়,তখন একটা মেয়ে কলটা রিসিভ করে, জান্নাতের আওয়াজ পেতেই কল কেটে দেয় সেই মেয়ে। শামির ভাইয়া হচ্ছে কি এসব বলবে?”

শামির ঘুরে রুমে ঢুকে জান্নাতের ফোনটা হাতে তুলে নিতে নিতে বলে,“জান্নাতুলের ফোন থেকে কোনো কল আসেনি,এসেছে তোমাদের নাম্বার থেকে।”

_তবে বৌমা যে বললো?

শামির জান্নাতের ফোন চেক করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললো,“জান্নাতুল তো আমার অফিশিয়াল নাম্বারে কল করেছে দেখছি, ওটা তো অফিস চলাকালীন অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট রিতা আপা অপারেট করে। হয়তো তার কন্ঠ পেয়েছে জান্নাত।”

_তবে কেটে দিলো কেন?

_সেটা তো কাল অফিসে গেলে জানতে পারবো।

রিজিয়া আর সুহানা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, শত দোষ থাকলেও শামির চৌধুরীর মেয়েলি দোষ নেই এটা তারা বিশ্বাস করে। রিজিয়া এবার হাঁফ ছেড়ে বলল,“দেখেছো, মেয়েটা কিছু না বুঝেই বিকাল থেকে অযথা কষ্ট পেলো।”

_তো তোমরা একটু চেক করতে পারতে না?

_সেজন্যই তো তোকে কল দিলাম,ধরলি না তো!

শামির হন্তদন্ত হয়ে ছাদের দিকে যায় আবারও,“উদ্ধার করে দিয়েছো, বিকাল থেকে ছাদে, থাপ্পড় মেরে আনতে পারলে না? কতবড় সাহস রাত দুইটা বাজে, এখনও ছাদে! বেয়াদব একটা!”

_কাদছিলো খুব আর মাথা ঠুকছিলো দেয়ালে,ও নিজের মধ্যে ছিলো না।

শামিরের পা থামলো, মায়ের দিকে ফিরে বললো,“কিছু বলেছে?”

_ঐ তো, “আম্মা আমার সব শেষ হয়ে গিয়েছে” এটা বলেই কাঁদছিল। সে কি কান্না! বাবা শোন, ও তো লক্ষি মেয়ে, একটু বোঝালেই তো বুঝে যায়, একটু রাগারাগী কম কর। মা মরা মেয়ে, এমনিতেই ছোটো থেকে হেলা ফেলায় বড় হয়েছে….

_আচ্ছা ঠিকাছে,তোমরা যে যার ঘরে যাও। আমি আনছি…

রিজিয়া আর সুহানা ছাদের সিঁড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে পরলো। শামির দরজা ঠেলে পা রাখলো ছাদে, বাইরে তখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সোডিয়াম আলোতে শামির দেখলো ওদিক ফিরে ছাদের রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে চুপচাপ জান্নাত। গায়ের গোলাপি রঙের সুতি শাড়িটা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।

শামির কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলো, পরপর জলদগম্ভীর স্বরে বলল,“জান্নাতুল।”

জান্নাত জবাব দেয় না। শামির আবারও বলে ওঠে,“জান্নাতুল! তোমার ঠান্ডার ধাত আছে,উঠে এসো।”

আবারও নীরবতা, শামির এবার ধমকের মতো করে বলে,“জান্নাতুল,আমার মেজাজ খারাপ করো না আর,উঠে এসো!”

থেমে থেমে আবারও বলে,
“ঘরে এসো,তোমাকে বুঝিয়ে বলছি কি হয়েছিল।”

সাড়া নেই জান্নাতের।

“আরে ধ্যাত্তেরিকি! আচ্ছা বেয়াদব হয়েছো তো! আচ্ছা শোনো,আমি কোনো মেয়ের কাছে ছিলাম না, এসো, তোমাকে প্রমাণ দেখাই।”

জান্নাত তখনও নীরব। শামির এবার রেগেমেগে এগিয়ে যায়, ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,“এই হচ্ছে তোমার সমস্যা, ভালোবেসে বললে গায়ে লাগে না, এক সেকেন্ডের মধ্যে ওঠো নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে!”

জান্নাত উঠলোই না, শামির গিয়ে জান্নাতের পাশে বসে ওর দিকে ফিরে ওর হাত ধরতেই চমকায়। ঠান্ডায় জমে গিয়েছে পুরো মেয়েটা, অচেতন কি না তা বলা যাচ্ছে না। পুরো গা নীল হয়ে আছে। শামির তৎক্ষণাৎ জান্নাতকে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে, হতভম্ব হয়ে বলে,“ইশশ কি অবস্থা! জান্নাতুল? শুনছো?”

জান্নাতুল শুনলেও কিছু বোঝার বা বলার অবস্থায় নেই। কাঁপছে ভীষণ। শামির আর দেরী না করে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়, দাঁতে দাঁত চেপে ধমকে ওঠে,“চেয়েছিলাম তোমাকে জব্দ করতে, উল্টো আমাকেই জব্দ করে ছাড়লে।”

সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত পায়ে নামছে শামির। রিজিয়া সিঁড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো, শামিরকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো,“হায় আল্লাহ জ্ঞান হারিয়েছে?”

শামির দ্রুত পা চালিয়ে রুমের দিকে যেতে যেতে সুহানাকে বলে,“টেম্পারেচার ফল করেছে ভাবী, আরো দু’টো কম্ফোর্টার নামিয়ে দাও ঘরে এসে ফাস্ট।”

সুহানা তাই করলো। রিজিয়া আর সুহানা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে শামির দ্রুত দরজা লাগিয়ে আলমারি খুলে গরম কাপড় বের করলো। শামির কাজ গুলো করছে খুবই দ্রুত। ভেজা শাড়ি পাল্টে গরম পোশাক পরিয়ে দিয়ে শামির কম্ফোর্টার দিয়ে ঢেকে দিলো জান্নাতকে। নিজে পোশাক পাল্টে গিয়ে বিছানায় একপাশে বসলো। তার বেশ গরম লাগছিলো, একটা হ্যান্ড ফ্যান নিয়ে বসে আছে সে। ওদিকে জান্নাতের কাঁপুনি থামছে না, কাঁপুনির সাথে কোকিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। শামির আবারও দাঁতে দাঁত চেপে বলে,“সকাল হোক, তারপর বোঝাবো তোমাকে। আজ যা যা করেছো না? সবকিছুর শাস্তি দেবো। এতো জেদ আমি বরদাস্ত করবো না।”

জান্নাত সে হুমকি গায়ে মাখে না, জান্নাত তো শুনতেই পায়না সেসব। শামির কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হাত থেকে হ্যান্ড ফ্যান সরিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেললো, অতঃপর খুলে ফেললো নিজের গা থেকে টি শার্ট। সাইন্স বি তে আর্টিকেলটা দেখেছে শামির, মানুষের শরীরে তাপের পতন হলে দ্রুত তা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার উপায়। দেরী না করে কম্ফোর্টারের নিচে ঢুকে সরিয়ে দিলো জান্নাতের ওড়না, কিছুটা উন্মুক্ত করে ওকে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে।
ধুন্ধুমার কাঁপছে ছোটোখাটো শরীরটা,আর কি ঠান্ডা। শামির চুপচাপ মিশিয়ে রাখলো নিজের সাথে দীর্ঘসময়।
দীর্ঘসময় পরেই,সে রাতে জান্নাতের কাপুনি থামলো, শামির ঘুমায়নি। সাড়ে তিনটা নাগাদ জান্নাতের গা গরম হয়ে উঠলো আচমকা, এভাবে তাপমাত্রা “আপ-ডাউন” করছে দেখে দুশ্চিন্তায় পরলো শামির, বিয়ের পর থেকে ঠান্ডা জ্বরে বেশ ভুগতে দেখেছে,তবে এমন কিছু কখনো হয়নি। অবশ্য আজ টানা আট ঘন্টা ভিজেছে!

এক পর্যায়ে জ্বর বাড়লে জান্নাত তড়পাতে থাকে। শামির টের পায় জান্নাত তাকে কিছু বলছে। সে কান আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যায় জান্নাতের মুখের কাছে। এবার বেশ নরম গলায় বলে,“কিছু বললে জান্নাতুল?”

জান্নাত সেকথার জবাব না দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ করে, পরপর বলে,“মাই মুনা। এই বুড়ি!”

শামির তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে জান্নাতের মুখের দিকে,বুঝতে পারে জান্নাত প্রলাপ বকছে। এর আগেও সামান্য ঠান্ডা জ্বর হলেই উল্টো পাল্টা বকতে দেখেছে মেয়েটাকে। স্বপ্ন দেখেও কথা বলে। পুরো বাচ্চাদের মতো স্বভাব এখনও মেয়েটার।

জান্নাত কাঁপতে কাঁপতে বলতে থাকে,“তোর নাতির মাথায় গোবর, বুড়ি।”

শামির চ’ম’কে তাকায় ওর মুখের দিকে। জান্নাত আবারও বলে,“জিহাদ আমাকে এসে নিয়ে যাবি?”

শামির এইবার নড়েচড়ে উঠলো, ভ্রু যুগল গুটিয়ে এলো তার, গম্ভীর হয়ে বললো,“জিহাদ কে? এই জিহাদ কে? তোমার প্রেমিক ছিলো? এই এতটুকু মেয়ে তুমি, তোমার প্রেমিক ছিলো?”

জান্নাতের উত্তপ্ত শ্বাস আছড়ে পরছে শামিরের গায়ে, পুনরায় বলে,“তিন সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের একটি দৈর্ঘ্য ও লম্ব যার প্রস্থ।”

_এসব কি বলছো?
অবাক হয়ে অস্ফুটে বলে শামির।

আবারও মুহুর্মুহু কাঁপছে জান্নাত, ছটফট করে বলে,“আমি সতীনের ঘর করবো না।”

এবার শামিরের বড্ড হাসি পেলো । মুখ থেকে গম্ভীরতা সরে গেল মুহুর্তেই, কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হেসে বলে,“আচ্ছা। করতে হবে না সতীনের ঘর।”

_বিষ দিয়ে মারবো আমি।

_ও বাবা ভয় পেয়েছি!
হাসতে হাসতে বলে শামির।

চুপ হয়ে যায় জান্নাত,আবারও কিছুক্ষণ গোঙানির মত আওয়াজ করে। শামির আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয় জান্নাতের। জান্নাত হঠাৎ দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,“শামিরের শামি কাবাব বানিয়ে খাবো।”

শামির এবার হাসি থামিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলে, জান্নাতের গালে চাপর মেরে বলে,“এই? ওষুধ খাবে?”

_পিঠা খাবো।

_এখন পিঠা কোথায় পাবো?

জান্নাতের প্রলাপ বকুনি থেমে যায়,প্রায় মিনিট দশেক পর জান্নাত আবারও নড়েচড়ে ওঠে, বলে,“আপনার মতো স্বামী যেন আমার শত্রুরও না হয়!”

দীর্ঘসময় শামির জান্নাতের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়, বলে,“কেন?”

জান্নাত আবারও রিপিট করে কথাটা,“আপনার মতো স্বামী যেন আমার শত্রুরও না হয়।”

_আমিও চাইনা কেউ আমাকে কপি করুক জান্নাতুল, শামির চৌধুরী এক পিসই থাকুক।

জান্নাতের কপাল থেকে চুল গুলো আঙুলের সাহায্যে সরিয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে জবাব দেয় শামির।

জান্নাত আবারও শুরু করে তার প্রলাপ বকুনি ,“একটা ছোটো বাচ্চা….ওনার মানিব্যাগ পুতুল….উনি চুমু দেয়…. ওনার মাথায় সমস্যা…..পাবনা মেন্টাল হসপিটালে..পেয়াজ খেলে রাগ হয়।”
ইত্যাদি ইত্যাদি। আর শামির চুপচাপ ওকে দেখে।

একসময় জান্নাত বলে,“আমি পড়তে চাই।”

শামির সাথে সাথে জবাব দেয়,“দরকার নেই পড়াশোনার।”

_দড়িলাফ খেলবো।

_লাফালাফি বন্ধ!

_শামি কাবাব খাবো।

_সকাল হোক।

_মামী আমি ওনার আন্ডারওয়্যার ধোবো না।

_আচ্ছা।

_ডান পাশের ঘরে এক্সের মান বসিয়ে আমরা ওয়াই পেলাম।

এইবার একটা লম্বা শ্বাস ফেলে শামির। জান্নাত আবারও বলে ওঠে।

_আমার বাবু লাগবে।

_এসব কথা বলে না, তুমি ছোটো।

_আম্মা উনি আরেকটা বিয়ে করছে।

_এবার চুপ করো জান্নাতুল , অনেক ধৈর্য্য ধরেছি। আর একটা কথা বললে স্কচ টেপ লাগিয়ে দেবো মুখে।

জান্নাত থামে না,সে বলতে থাকে,“ঐ মহাসিন্না আমারে পাগলের কাছে বিয়া দিছে মা।”

_জান্নাতুল স্টপ!

ওকে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো শামির।

সে রাতে জান্নাত আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,“শামিরের বাবু লাগবে। বলদটার বাবু লাগবে।”

চেঁচিয়ে ওঠে শামির,“লাগবে না! প্লিজ হুশে আসো,নয়তো ঘুমাও! প্লিজ!”

চলমান…..