#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_১৫
#ইসরাত_ইতি
জান্নাতের পেলব হাতটা ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শামির। জান্নাত নিজেকে সামলানোর সময়টুকুও পায়নি। না পেরেছে কিছু জিজ্ঞেস করতে শামিরকে।
আশেপাশে আগুন দেখতে পাচ্ছে না জান্নাত, তবে চিৎকার চেঁচামেচিতে আশপাশটা ভারী হয়ে উঠেছে। জান্নাত বুঝতে পারছে না হচ্ছে টা কি আসলে, সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রশ্ন করলো,“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
_একটা সেইফ প্লেসে। দোতলায় আগুন ছড়িয়ে গিয়েছে, তিনতলায় পৌঁছাতে সময় নেবে না। আমাদের রেলিংয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, মাঝনদীতে আমরা, সারেং চেষ্টা করছে দিশা ঘুরিয়ে কিনারা ঘেঁষার।
_আগুন লাগলো কিভাবে?
_জানিনা। এসো দ্রুত পা চালাও।
জান্নাতের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে শামির। ওকে টেনে নিয়ে একেবারে কিনারায় দাঁড় করালো, চাদর দিয়ে ঢেকে দিলো জান্নাতুলকে। আশেপাশে লোকজন ছোটাছুটি করছে, মহিলা গুলো করছে কান্নাকাটি। পোড়া পোড়া গন্ধে পরিবেশটা গুমোট হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। জান্নাতের বুক কাঁপছে এতো আহাজারি দেখে,শামিরকে বলে,“মানুষ পুড়েছে?”
_দোতলার কেবিন সব লকড ছিলো, আপাতত ট্রেস করা যাচ্ছে না।
কেঁপে ওঠে জান্নাতুলের শরীরটা। দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করে দেয়। লোকজন ছুটছে দেদারসে, জান্নাতুলের গায়ে দু’টো ছেলের ধাক্কা লাগলে শামির ওকে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিচুগলায় বলে,“ভয় লাগছে?”
ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলে জান্নাত। শামির অভয় দিয়ে বলে,“কিছু হবে না। আগুন তিনতলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে লঞ্চ কিনারায় পৌঁছাবে।”
জান্নাত লোকটার বুকে মাথা গুঁজে রেখে হাপাচ্ছে। মানুষজন চেঁচিয়ে বলাবলি করছে আগুন তিনতলায় পৌঁছেছে। নিচতলা আর দোতলার ডেক থেকে অসংখ্য মানুষ যারা প্রাণ বাঁচাতে তিনতলায় উঠেছিল,এরা এবার চারতলার সিঁড়ির দিকে ছুটছে। শামির সিদ্ধান্ত নেয় চারতলায় যাবে, জান্নাতের হাত ধরে দ্রুত পা চালাতেই ওদের সামনে এক বয়ঃজেষ্ঠ্য বৃদ্ধ হুমরি খেয়ে পরে যায়।
জান্নাত ছুটে গিয়ে লোকটাকে টেনে তোলে। লোকটা তাদের সামনের কেবিনে উঠেছিলো,জান্নাত দেখেছে। কন্ঠে দরদ ঢেলে জান্নাত লোকটাকে বলে,“দাদু আপনি ঠিক আছেন?”
লোকটা কাঁদছে,ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না, কোনোমতে বলে,“আমার নাতি। আমার নাতিকে এনে দাও। রুমে ও।”
শামির কয়েকপল জান্নাতকে দেখলো, তারপর বললো,“নড়বে না এখান থেকে।”
বলেই শামির লাউঞ্জের দিকে ছুটলো,গিয়ে ঐ বৃদ্ধের আট বছর বয়সী ঘুমন্ত নাতিকে টেনে তুলে নিয়ে আসলো।
এরপর বৃদ্ধের নাতি আর বৃদ্ধকে ধরেধরে চার তলায় পৌঁছে দেয় ওরা। চারতলায় মানুষ গিজগিজ করছে, জান্নাতকে সামলে নিয়ে ভীড় ঠেলে একপাশে দাঁড় করিয়ে শামির ওকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকে।
এর মাঝে গুঞ্জন শোনা যায় তিনতলায় রিভার সাইডের লাউঞ্জে সাত আটজন হাফিজি মাদ্রাসার বাচ্চা আটকা পরেছে, কয়েকটা কমবয়সী যুবক ছেলে ছুট লাগায় বাচ্চা গুলোকে রেসকিউ করতে। শামির জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,“একা থাকতে পারবে?”
_কোথায় যাবেন?
কেঁদে বলে জান্নাত।
_তিনতলায়, যাবো আর আসবো।
_আমিও যাবো।
ধমকে ওঠে শামির,“হোয়্যাট! তুমি গিয়ে কি করবে? এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। আর এই ফোনটা সামলে রাখো। আমি আসা না পর্যন্ত এখান থেকে নড়বে না।”
বলেই শামির তিনতলার সিঁড়ির কাছে যায়। বাচ্চাগুলোকে শামির লঞ্চে ওঠার সময় দেখেছে, নিদারুণ পবিত্রতা মাখা ছিলো মুখ গুলোতে,একটা ইসলামিক কনটেস্টে অংশ নিতে ঢাকা যাচ্ছিলো। শামির সামনে এগিয়ে যায়, আসলেই তিনতলায় আগুন পৌঁছেছে,তবে তাদের লাউঞ্জ গুলোতে পৌছাতে ঢের দেরী। করিডোর পেরিয়ে শামির ডানপাশের “রিভারসাইড এরিয়ায়” যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়,ঠিক তখনই তার পা থেমে যায়। ঘুরে পেছনে তাকাতেই দেখে জান্নাত ছুটে আসছে। ছুটতে ছুটতে এসেই শামিরের বুকে হুমরি খেয়ে পরেছে। শামির কর্কশ গলায় ধমকে ওঠে,“কথা শোনো না কেন ফাজিল?”
_একটা ছেলে আমার পেট ছুঁলো। ইচ্ছে করে।
ফোপাতে ফোপাতে বলে জান্নাত। রাগে কাঁপছে শামিরের গা,বলে,“চিনিয়ে দিতে পারবে? আজ বেঁচে ফিরলে কুত্তারবাচ্চাকে খেয়ে ফেলবো।”
_আপনি কোথাও যাবেন না ।
_তুমি আমাদের রুমে গিয়ে বসো জান্নাতুল। আমি আসছি।
_আমিও যাবো আপনার সাথে।
শামিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে জান্নাত,স্বামীকে যেতেই দেবে না কোথাও, শামির জান্নাতের থুতনি ধরে উঁচুতে তুলে জান্নাতের চোখে চোখ রাখে, দু’টো নিষ্পাপ চোখ,চোখ বেয়ে দরদর করে পানি ঝরছে।
জান্নাত আবারও নাক টেনে বলে,“আপনার সাথে যাবো।”
শামির ওর কথা শোনে না, ওকে টেনে নিজেদের কেবিনে বসিয়ে শামির বেরোয়, নিচতলা থেকে আরো মানুষ উঠছে, বেশিরভাগই আহত।
হাফিজি মাদ্রাসার বাচ্চা গুলোকে রেসকিউ করা হয়েছে। শামির বয়ঃজেষ্ঠ্য মহিলা,যারা আহত তাদের ধরে ধরে চারতলায় ওঠায়।
আগুন লঞ্চের একপাশে লেগেছে, নিচতলা,দোতলা শেষ করে তিনতলাও পুড়ছে। লঞ্চ তখনও মাঝ নদীতে,কিনারা খুজে পাচ্ছে না, কুয়াশাচ্ছন্ন নদীপথ।
শামির দোতলায়ও গেলো দশ বারোজন পুরুষের সাথে, কোনো মহিলা আটকা পরেছে কিনা দেখতে। জান্নাত রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে ছটফট করছে। দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ার পরে তিনজন লোক যখন দোতলা থেকে আসলো, খুজে খুজেও জান্নাত শামিরকে দেখে না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জান্নাত দোতলায় ছোটে। গিয়ে দেখে সর্বোত্র ধোঁয়া। আগুন তিনটা ইউনিটের দু’টো ইউনিট পুড়িয়ে দিয়েছে একেবারে। বিচ্ছিরি পোড়া গন্ধে গুলিয়ে ওঠে জান্নাতের পেট, জান্নাতের পা খালি, লোহার মেঝেটা অসম্ভব গরম আগুনের তাপে, পা পুড়ে যাচ্ছে জান্নাতের , সে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে,“শুনছেন। আপনি কই?”
ডানপাশ থেকে ছুটে আসে শামির, চোখ বড়বড় করে জান্নাতকে দেখে কয়েক পল, ছুটে এসে ওকে ধরে চেঁচায়,“এই ফাজিল। এখানে এসেছো কেন?”
_আপনি কই কই যান হ্যা?
ডুকরে কেঁদে ওঠে জান্নাত, জবাব না দিয়ে শামির ওকে টেনে তিনতলায় ওঠায়। তিনতলায় উঠেই শামিরের চোখ উঠলো কপালে। আগুন ছড়িয়ে গিয়ে সিঁড়ির কাছে রাস্তা ব্লকড।
শামির এবার ঘাবড়ে যায়, জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,“চলো মিডল লাউঞ্জের করিডোর হয়ে যাই।”
মিডল লাউঞ্জের করিডোরেও আগুন। শামির এবার ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে জান্নাতকে একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখে বলে,“আমি পথ খুজছি।”
জান্নাত কাঁপছে, শক্ত করে শামিরের হাত ধরে রেখে কেঁদে বলে,“আমিও খুজবো।”
_তুমি আমাকে সাফার করাচ্ছো জান্নাতুল।
_আপনি….
কিছু বলার আগেই করিডোরের কাঠের স্লাইডিং ডোর ধপ করে পরে যায়। ওপাশে একটা ভলান্টিয়ার টিম ইতিমধ্যে পানি তোলার, এবং নামানোর ব্যবস্থা করেছে। তবে তিনতলার আগুন নেভানো যাচ্ছে না।
এরমাঝে বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠে জান্নাত। পেছনের এক্সিটের সাথে ঝুলতে থাকা পর্দা পুড়তে পুড়তে কখন তার শাড়ির আঁচলে আগুন লেগেছে সে টের পায়নি। জান্নাতের চিৎকারে শামির ঘুরে তাকাতেই তার পাগল হবার মতো অবস্থা হয়।
চেঁচাচ্ছে শামির,“ও আল্লাহ!”
হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে টেনে টেনে জান্নাতের আঁচল খুলে নিচে ফেলে শামির পা দিয়ে পিষে আগুন নেভাতে ব্যস্ত, ওর লজ্জা ঢাকতে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। আঁচলের অগ্রভাগ পুড়েছে,উঠিয়ে জান্নাতের কাঁধে তুলে এবার বেশ রেগেমেগে শামির চেঁচিয়ে বলে,“কি হতো এক যায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে? কেন আসতে হলো পিছু পিছু। অতি ফাজিল।”
কাঁদছে জান্নাত,তার গায়ে একটু আগে আগুন লেগে যাচ্ছিল, ভাবতেই গা অবশ হচ্ছে, তার মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে,আটকে আটকে কোনো মতে জান্নাত কেঁদে শামিরকে ঐ সময় বলে,“আপনি…আপনি…”
_আমি কি?
_আমি আপনার…আমি আপনার দ্বিতীয় বৌ হতে পারি, হতে পারি অছাদ্রা কেউ, আপনি তো আমার প্রথম স্বামী, এবং আপনিই। আমার শুধু আপনিই আছেন।
শামির অনিমেষে চেয়ে আছে গোলগাল মুখাটার দিকে, ততক্ষণে জান্নাত জ্ঞান হারায়।
এরপর আরো কুড়ি মিনিট লাগে তিনতলার আগুন কিছুটা নেভাতে। একদিক থেকে পানি তোলা হচ্ছে, আরেকদিক থেকে সেটা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এবং শামির,বাকিটা সময় জান্নাতকে বুকের সাথে মিশিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, থমথমে মুখে। রাস্তা পরিষ্কার হলে ওকে কোলে তুলে তিনতলায় নিজেদের কেবিনে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে দরজায় হেলান দিয়ে।
লঞ্চ চাঁদপুরের কিছুটা আগে একটা নির্জন চরে ঘাটি গাড়ে,তখন ফজরের আজান দিয়েছে, লোকজন হুরমুরিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে লঞ্চ থেকে। ফায়ার সার্ভিসের দু’টো বিশেষ টিম ততক্ষণে পৌঁছে আগুন নিভিয়ে দিয়েছে। চারতলা বিশিষ্ট লঞ্চটাকে ভোরের আলোয় ভুতুড়ে লাগছে পুরো।
জান্নাতের জ্ঞান ফিরতেই ওকে পানি খাইয়ে দেয় শামির। ফায়ার সার্ভিসের রেসকিউ টিম আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে করে চাঁদপুর সদর হসপিটালে নিয়ে যায়, বাকিদের জন্য সদরঘাট থেকে ভোর পাঁচটা নাগাদ আরেকটি লঞ্চ চলে আসে।
ভলান্টিয়ার টিম লোকজন এবং বেঁচে যাওয়া মালামাল অন্য লঞ্চে তুলে দেয়। সৌভাগ্যবসত সেরাতে একজনও মারা যায়নি, বড়জোর গুরুতর আহত হয়েছিল কেউ কেউ।
একটা রুদ্ধশ্বাস ভয়াবহ রাত কাটিয়ে জান্নাত জমে আছে, জ্ঞান ফেরার পর তার শরীর আরো বেশি করে কাঁপছিল, ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হবার সাথে সাথে শামির ওকে জোর করে একটা মাফিন খাইয়ে দিল, আর জান্নাত শুধু পাগলের মতো শামিরের শরীর হাতিয়ে যাচ্ছিলো, দেখছিলো তার স্বামী ঠিক আছে কি না। বৌয়ের ছটফটানি দেখে শামির নিরুদ্বেগ ঠান্ডা গলায় বলে,“লাগেনি আগুন। আ’ম সেইফ।”
একটার পর একটা ফোনকল রিসিভ করতে করতে ক্লান্ত শামির। রিজিয়া বণিক দূর্ঘটনার খবর পেয়ে রাতেই তিনবার বেহুঁশ হয়েছেন, শারাফাত চৌধুরীর বুকে ব্যথা উঠেছে।
ভিডিও কলে ছেলের মুখটা দেখে কান্নায় ভেঙে পরে রিজিয়া,“তুই বৌমাকে নিয়ে চলে আয়। ঘুরতে হবে না বাপ।”
_মা আগে ঢাকা পৌছে নিই। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
নির্লিপ্ত জবাব শামিরের, দৃষ্টি জান্নাতের দিকে, চোখে কি নিদারুণ সরলতা। শামির অবচেতন মনে গতকাল রাত থেকে সেসবই দেখছে। বাড়ির সবাই নির্ঘুম একটা রাত কাটিয়েছে, ভিডিও কলে শামিরকে প্রমাণ দেখাতে হলো তারা দু’জনে আসলেই অক্ষত।
সদরঘাট পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল নয়টা বেজে গিয়েছে, চিন্তিত আতঙ্কিত বন্ধু ও বন্ধু পত্নীরা সকলে ছুটে এসেছে শামির আর তার বৌকে রিসিভ করতে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বসুন্ধরা আবাসিকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর এগারোটা প্রায়।
_____
এটা শামিরের খুব কাছের বন্ধু নিলয়ের অ্যাপার্টমেন্ট, ট্রিপে তারাও যাচ্ছে জান্নাতদের সাথে।
হালকা নাস্তা সেরে জান্নাত শুয়ে রইলো তাদের যে ঘরটা দেয়া হয়েছে সেখানে গিয়ে, খানিক বাদে শামির ঘরে ঢুকলো, জান্নাত উঠে বসলো। ওর কাছে এসে বসলো শামির, আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,“শরীর ঠিক আছে?”
_জি। আমরা কি বরিশাল ফিরে যাচ্ছি?
_না,সিলেটই যাবো। দূর্ঘটনা ঘটার ছিলো,ঘটে গিয়েছে,ফিরে গিয়ে কি লাভ? আজ রাতটা এখানে থেকে আগামীকাল সকালে রওনা দেবো।
শুয়ে পরলো জান্নাত, আবারও উঠলো, উঠে চলে গেলো জানালার কাছে, উঁচু দালান থেকে ঢাকা শহরটা দেখছে। নতুন পরিবেশে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে তার, গতরাতের ঘোর থেকে বেরুতে যদিও পেরেছে। অ্যাপার্টমেন্টে আরো অনেক মানুষ রয়েছে। বসার ঘরে আড্ডা দিচ্ছে তারা। ওরা শামিরের বন্ধু এবং বন্ধু পত্নীরা। জান্নাত যায়না সেখানে, ঘুরে তাকিয়ে দেখে শামির কে, যে শুয়ে শুয়ে ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। বিগত একদিন পরে একটু হাঁফ ছেড়েছে সে।
হঠাৎ কি হলো জান্নাত বুঝতে পারলো না,শামিরের সহজ মুখভঙ্গি পাল্টে গেলো মোবাইল দেখতে দেখতে, পর পর জান্নাতের দিকেও এক পলক তাকাল এবং চোখের দৃষ্টি ফের মোবাইলের স্ক্রিনে রেখে পড়তে শুরু করলো,“স্বামী বৌকে পড়ায় , এদিকে বৌ সহপাঠীর সাথে জড়িয়ে যায় প্রণয়ের সম্পর্কে, অতঃপর তালাক চাইলো স্বামীর কাছে,স্বামী তালাক দিতে রাজি না হওয়ায় মিথ্যা নির্যাতনের মামলায় ফাসালো স্বামীকে।”
ওটা নিউজ ২৪ ঘন্টার ফেসবুক পেজ থেকে প্রকাশিত একটি খবর। শামির ইচ্ছে করে জান্নাতকে শুনিয়ে পড়ল। জান্নাত নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পর পর শামির নিজে নিজে ঐ ভিক্টিম স্বামীকে গালি দিয়ে বলল,“শা’লা বলদ,পড়াতে গিয়েছিলি কেন? বেশ হয়েছে। তোর সাথে এটাই হওয়া উচিৎ।”
একটা সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস বইল জান্নাতের অন্দরে, জান্নাত নিজেও বুঝলো না তা,খানিক বাদে আবারও শামিরের কন্ঠ,আজ-ই তার চোখ পরেছে একটা মনস্তাত্ত্বিক কনসালট্যান্টের গ্রুপে। পরিচয় লুকিয়ে এক ভদ্রমহিলা পোস্ট দিয়েছেন,“আমি একজন হাউস ওয়াইফ, ইদানিং বেশ মানসিক চাপে ভুগছি। আমার স্বামীর থেকে আমি ভারবাল এবিউজের শিকার হই,রোজ। এই যন্ত্রনা আমি সহ্য করতে পারছি না, পান থেকে চুন খসলেই গালি দেয়, এমনিতে সে আমার ব্যাপারে যত্নশীল,ভালোবাসে এটা অস্বীকার করবো না, তবুও অফিস থেকে ফিরেই শুরু করে ধমকা ধমকি আর গালাগাল, দিন দিন সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে সব। সাত বছর ধরে ধৈর্য্য ধরেছি,তাকে ঠিক করার চেষ্টা করেছি। আর সম্ভব হচ্ছে না,মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাবো। আমি এখন কি করবো? তালাক চাইবো?”
পোস্টটা শামির গভীর মনোযোগে পড়ল, পর পর লম্বা শ্বাস ফেলে চোখ মুখ কঠিন করে আপনমনে বলে,“দাও তালাক, তোমার মতো অধৈর্যশীল নারী এক স্বামী কেন? সাত স্বামীর ঘর বদলালেও শান্তি পাবে না। ধমকা ধমকি করে তো কি হয়? আবার বলো ভালোও বাসে, একটা পুরুষ বাইরে খাটনি দিয়ে এসে তোমাকে মাথায় উঠিয়ে নাচানাচি করবে? ফালতু মহিলা।”
জান্নাত জানালার কাছে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখতে থাকে স্বামীর কান্ড। এবার প্রকাশ্যে ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস।
মোট চার জুটি যাবে, বন্ধুদের মধ্যে জাহিদ এবং গালীব অবিবাহিত। ওদের নিয়ে দশজনের একটা গ্রুপ।
খেতে খেতে বাকি পরিকল্পনা জানিয়ে দেয় তানভীর। পুরো ট্রিপের জার্নিটা হবে উপভোগ্য, ট্রেনে জেনারেল প্যাসেঞ্জারি থেকে শুরু করে পায়ে হেঁটে ট্রিপটা উপভোগ করবে তারা। ইতিমধ্যে একটা রিসোর্টে পাঁচটা কটেজ বুক করে রেখেছে।
রাতের খাবার টেবিলে আড্ডার আসর বসেছে। জান্নাত অবশ্য দূরেই থাকছে, শামির তার বন্ধুদের সাথে কোনরকম হাসাহাসি করতে নিষেধ করে দিয়েছে কড়া গলায়।
লম্বা ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে শুধু খাচ্ছিল জান্নাত। শামিরের চারজন বিবাহিত বন্ধু তানভীর,নিলয়, সিয়াম,রকিবের স্ত্রীদের আড়চোখে দেখছিলোও সে, ওনারা সবাই কেউ ডাক্তার নয়তো ডাক্তারি পরছে, জান্নাতুলই সবথেকে ছোটো। জান্নাতের সাথে এদের সবার বয়সের ব্যবধান এগারো-বারো বছরের।
তানভীরের বৌ সুপ্তি আলোচনার মাঝে জান্নাতকে বলে,“ভাবী কি একটুতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন? শুনেছিলাম বাসরঘরেও জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন শামির ভাইকে দেখে।”
সবাই উচ্চশব্দে হেসে ওঠে, জান্নাতুল এধরণের কথার কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না। শামির বলে ওঠে,“মেয়ে মানুষ, কথায় কথায় জ্ঞান হারাবে স্বাভাবিক,নয়তো কি পুরুষ কথায় কথায় জ্ঞান হারাবে?”
সুপ্তি আর নিলয়ের বৌ রাফিয়া বলে,“আমরা কিন্তু জ্ঞান হারাই না।”
শামির সাথে সাথে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,“আপনারা মেয়ে?”
সবাই হাসছে, জান্নাত ব্যতীত। জাহিদ জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,“আরে ভাবী খাচ্ছেন না কেন?”
শামির একপলক জান্নাতকে দেখে গম্ভীর হয়ে বলে,“শরীর খারাপ লাগলে ঘরে গিয়ে শুয়ে পরো জান্নাতুল।”
এখন বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেবে, শামির চাচ্ছে না সবার বৌয়ের মতো তার বৌও এখানে বসে একটু পর পর হাহা হিহি করুক,তাই আগেভাগেই সিগনাল দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে ঘরে।
আট ঘন্টা টানা ঘুমিয়েছে জান্নাত ক্লান্তিতে, সকালে উঠে বুঝতে পারল শরীরটা সম্পূর্ণ ঠিক তার, ওরা খুব ভোরে রওনা দিয়েছে, শামির জান্নাতের দু’টো ব্যাগই অক্ষত অবস্থায় আনতে পেরেছে। ট্রেনের একটা লোকাল বগিতেই সবাই উঠেছে, ওদের সাথে কিছু কলেজ স্টুডেন্ট রয়েছে এই বগিতে। শামিরের অবশ্য এভাবে জার্নি করাতে আপত্তি ছিলো কিন্তু বন্ধুদের কাছে ওর সেই আপত্তি টেকেনি।
কলেজ স্টুডেন্টরা পরের স্টেশনে নেমে যাবে। ভীষণ ফুর্তিবাজ ওরা সবাই, একটা ছেলে গিটার হাতে গান গাইছে ওদের গ্রুপে। শামিরের বন্ধু জাহিদ ক্যামেরা হাতে ভিডিও করছে ছেলে মেয়েগুলোকে। শামিরের পাশে,জানালার কাছে চুপচাপ বসেছিল জান্নাত, তার গায়ে বেগুনী একটা সুতির শাড়ি, শাড়ির ওপর চাদর, মাথায় ঘোমটা। আড়চোখে সে শুধু কলেজ ড্রেস পড়ুয়া মেয়েগুলোকে দেখছিলো। কিশোরী মেয়েগুলো তারই বয়সী।
আকাশী রঙের কলেজ ড্রেস,গলায় স্টুডেন্ট আইডি কার্ড, দুপাশে দু’টো বেনী আর একরাশ চঞ্চলতা। মুগ্ধতা সরছে না জান্নাতের দু’চোখ থেকে। মেয়েগুলো হাসছে, একজন আরেকজনের বেনী ধরে টানছে, ওদের হাসি, খুনসুটি দেখে জান্নাতও হেসে ফেলে উচ্চশব্দে।
শামির তৎক্ষণাৎ জান্নাতের দিকে তাকাতেই জান্নাত মুখ ঘুরিয়ে জানালায় দৃষ্টি দিয়ে রাখে। আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা সাদা মেঘ গুলো দূরে সরে যাচ্ছে,ওরা লুকোচ্ছে,যেমন করে জান্নাতের মন খারাপের কথা গুলো লুকিয়ে যায় দ্রুত।
______
সিলেটে পৌঁছাতে বিকেল, যে যার পছন্দ মতো কটেজ বেছে নিয়ে উঠে যায়, শুরুতেই গোসল সেরে ভিডিও কলে শাশুড়ি ননদের সাথে কথা বলে নেয় জান্নাতুল। রিজিয়া বণিক নানা আদেশ উপদেশ দেন পুত্রবধূকে, কোথাও বের হবার আগে কি কি দোয়া পড়তে হবে বলে দিলেন। হাতটাকে সবসময় শামিরের হাতের মুঠোয় রাখতে বললেন। যাতে করে জান্নাত হারিয়ে না যায়।
ওরা সবাই সেদিন বেশি দূরে গেলো না,চা বাগান দেখার পরিকল্পনা সকালের জন্য তুলে রাখে, সন্ধ্যেটা আশেপাশের একটা টিলার কাছ থেকে ঘুরে আসে।
গালীব সব জুটিদের সুন্দর সুন্দর কিছু ছবি তুলে দেয়। শামিরের পাশে জান্নাতকে দাঁড়াতে বলে গালীব জান্নাতকে বলে,“ভাবী? আরে হাসুন একটু? হাসার জন্যও শামিরের অনুমতি নেবেন?”
জান্নাত মলিন হাসে। গালীব ওদের দুজনের সুন্দর কিছু ছবি তুলে দেয় সে মুহুর্তে।
রাতের ডিনার সেরে শামির জান্নাতকে নিয়ে কটেজে ফেরে,বাকিরা রিসোর্টের বাগানে আড্ডা দিচ্ছে, শামির তাতে অংশ নেয়নি, গতরাতের ধকল,সারাদিন জার্নি শেষে খুব মাথা ধরেছিলো।
কটেজটা জান্নাতের ভীষণ পছন্দ হয়েছে,ঠিক একটা কুঁড়েঘরের মতো, কাঠের পাটাতন। ঘুরে ঘুরে জান্নাত সেসব দেখছিলো, শামির শার্ট না ছেড়েই বিছানায় এসে সোজা হয়ে শুয়ে পরেছে, লাগেজ দুটো ঘরের এককোণে রাখা তখনও। শামির বলে,“লাগেজ থেকে জামাকাপড় বের করে কাবার্ডে রাখো জান্নাতুল,আমরা এখানে সাতদিন আছি।”
জান্নাত মাথা নেড়ে লাগেজ খালি করছে, শামির শুয়ে শুয়ে ওকে দেখছে, হঠাৎ বলে,“ওটা কি শপিং ব্যাগে?”
উঠে বসে শামির। শপিং ব্যাগ নেয়া হাতটা জান্নাতের কাঁপছে, লজ্জা সংকোচে মাটিতে মিশে যাচ্ছিলো সে। শামির চিন্তিত ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে খপ করে জান্নাতের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়, জান্নাত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, শামির ব্যাগের ভেতরে কি আছে দেখতে বিছানায় ঢেলে দেয় সেসব।
তিন রঙের তিনটা ট্রান্সপারেন্ট নাইটি,সাথে তিনটা শ্রাগ। শামির জান্নাতের দিকে তাকায় ত্বরিৎ, থরথরিয়ে কাঁপছে জান্নাত, শামির কিছু বলার আগেই কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,“বড় ভাবী জোর করে দিয়ে দিলো, বারণ করেছি তবুও।”
শামির একবার নাইটি গুলো দেখছে, একবার দেখছে জান্নাতকে। জান্নাত চোখ তুলে তাকাচ্ছেই না,তার ইচ্ছা করছে ছুটে কোথাও বেড়িয়ে যেতে। লোকটা কি এখন তাকে ধমকাবে? বলবে,“এসব বেহায়া পনা শিখছো বড় ভাবীর থেকে বেয়াদব মেয়ে? এক চড়ে দাঁত খুলে ফেলবো।”
কিন্তু শামির সেরকম কিছুই বলে না, খানিকটা সময় চুপ করে থেকে হঠাৎ জলদগম্ভীর স্বরে বলল,“গোলাপীটা পরে এসো।”
জান্নাত চকিতে চোখ তুলে তাকায়, শামিরের চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক। জান্নাত হাশফাশ করছে, দু’পাশে ঘন ঘন মাথা নেড়ে কাতর স্বরে বলে,“না।”
শামির বিছানায় চুপচাপ বসে, জান্নাতের দিকে তাকিয়ে আবারও ঠান্ডা গলায় বলে,“দেখবো।”
দশ মিনিট বাদে, চেঞ্জিং কর্ণারের পর্দার আড়াল থেকে জান্নাত বেরোচ্ছিলো না। শামির বিছানায় বসে ওকে ডাকলো,“জান্নাতুল বেড়িয়ে এসো।”
জান্নাত বেরুলো,তবে পর্দা টেনে নিয়ে আড়াল করে রাখলো নিজেকে। শামির কিছুপল তাকিয়ে থেকে বলে,“পর্দা সরাও।”
দু’পাশে মাথা নাড়ে জান্নাত।
_আমি উঠবো?
গম্ভীর স্বর মৃদু ধমকায়।
_এটা বাজে।
ক্ষীণ আওয়াজে জান্নাত বলে।
শামির হোহো করে হেসে উঠলো আচানক। জান্নাত অবাক হয়ে দেখলো লোকটাকে, এই প্রথম জান্নাত এমন করে হাসতে দেখলো লোকটাকে। বিস্ময়াভিভূত হয়ে চেয়েই থাকল সে। কিছুক্ষণ হেসে হাসি থামিয়ে শামির বলে,“সরাও।”
_আমি মরে যাবো।
আকুতি নিয়ে বলে জান্নাত, শামির তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়, জান্নাত পর্দা টেনে নিয়ে পিছোতে থাকে। পালাতে চায় যেন । শামির ভ্রু কুঁচকে ফেলে, পরপর চওড়া হাসি হেসে লম্বা কদমে এগিয়ে যায়, কিছুক্ষণ ঘরময় ছোটাছুটির পর জান্নাত যখন ধরা দিলো, শামির ওকে নিয়ে বিছানায় পরলো। এতক্ষণ বৌয়ের সাথে ছোটাছুটি,খুনসুটি করে হাসি উঠেছে শামিরের, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,“কি বললে? এটা বাজে?”
জান্নাত চোখ বুজে আছে, বুক কাঁপছে সবেগে, শামির পর্দার কাপড়টা সরিয়ে ধীরে ধীরে অনাবৃত করলো জান্নাতকে। গোলাপী পোশাকটায় জান্নাতকে একেবারে অন্যরকম লাগছে, এমন আগে কখনো লাগেনি, এভাবে কখনো দেখেনি জান্নাতকে। আলাদা সৌন্দর্য। শামির নেশালো দৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,“আমার তরফ থেকে বড় ভাবীকে ধন্যবাদ দিও।”
জান্নাত চোখ মেলে না, হৃদস্পন্দন সামলাতে ব্যস্ত সে। শামির আরো কিছুক্ষণ ওকে দেখে বলে,“কেমন লাগছে বলবো?”
এরপর জান্নাতের কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতেই জান্নাত দু কান চেপে ধরলো। শামির তখন হাসতে হাসতে ভেঙে পরে, সে হাসি আর থামছিলোই না। জান্নাত চোখ খোলে তখন। চেয়ে চেয়ে লোকটার হাসি দেখে, এ এক অন্যরকম শামির, সম্পূর্ণ অন্যরকম। ধীরে ধীরে জান্নাত এক হাতে শামিরের একটা গাল ছোঁয়, শামির তখনও হেসে যাচ্ছে। জান্নাত মুগ্ধ চোখে শামিরকে দেখছে, মনে মনে ভাবছে, সময় এখানেই থেমে যেতে পারে না? লোকটা যদি সবসময় এভাবে হাসতে থাকতো? যদি এভাবেই লোকটাকে দেখে জান্নাতের ভয় না হতো? যদি আর না বকতো সবার সামনে? হঠাৎ হঠাৎ তুই তোকারি না করতো? মাঝরাতে রাগ দেখিয়ে জান্নাতকে যদি না ছুতো? খুব ভালো হতো তবে! জান্নাত এটুকু সুখ নিয়েই কাটিয়ে দিতো বেলা, পড়াশোনা পড়াশোনা করেও হেদিয়ে মরতো না তবে।
চলমান……