জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-০১

0
22

#সূচনা_পর্ব
#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই

জ্যৈষ্ঠের এক বৃষ্টিমুখর দিনে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন পুরুষের সাথে বিয়েটা হয়ে গেলো উথমীর। মসজিদে সকলের উপস্থিতি এবং দোয়ার মধ্য দিয়ে দু মেরুর দুজন মানুষ আবদ্ধ হলো পবিত্র একটি বন্ধনে। নব দম্পতির থেকে উপস্থিত মানুষগুলোই যেনো অধিক আনন্দিত হয়ে উঠলো আজকের এই বিশেষ দিনটিতে। এ উপলক্ষে তাদের মধ্যে চলতে লাগলো একে অপরকে মিষ্টি মুখ করানোর তুমুল প্রতিযোগিতা। তারই মধ্যে নব দম্পতির দিকে এগিয়ে এলেন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ। পরনে উনার সাদা জুব্বা, গলা পর্যন্ত কাঁচা পাকা দাড়ি। মুখশ্রীতে তৃপ্তির হাসি নিয়ে তিনি এসে বসলেন বর কনের সম্মুখে। হাতে থাকা মিষ্টির হাড়িটি থেকে কাঁটা চামচের সাহায্যে তুলে নিলেন রসে টইটম্বুর একটি রসগোল্লা। তারপর নতুন জামাতার মুখের সম্মুখে তা ধরে বললেন,“আজকের এই বিশেষ দিনে মিষ্টিমুখ না করলে হয়? দেখি হা করো বাবা।”

শ্বশুরের কথার বিপরীতে কোনো বাক্য বিনিময় করল না শেরোয়ানি পরিহিত নতুন বর। বাধ্য ছেলের মতো গোটা রসগোল্লায় ছোটো একটি কামড় বসিয়ে অর্ধেক টা পুরে নিলো স্বীয় মুখে। তাতেই যেনো অধরের হাসিটা চওড়া হলো রায়হান কবীরের। এবার বাকি অর্ধেকটা ধরলেন নিজ কন্যার সামনে। কোমল স্বরে বললেন,“নে হা কর মা।”

পিতার কণ্ঠস্বর শুনতেই মাথা তুলে তাকায় উথমী।চোখেমুখে তার বেদনার ছাপ। ঘোলাটে আঁখি যুগল পিতার পানে স্থির করতেই রায়হান কবীরের বুকটা ধক করে ওঠে। অধরের সেই তৃপ্তির হাসিটা বিলীন হয়ে যায় চট করে। সন্তানদের দিক থেকে দ্বিতীয় হলেও এই মেয়েটিই হচ্ছে উনার প্রথম কন্যা সন্তান। এই হচ্ছে সেই নারী যাকে তিনি নিজ জন্মদাত্রী মায়ের মতোই এতোকাল ধরে ভালোবেসে এসেছেন। পরম যত্নে আগলে রেখেছেন ভালোবাসার চাদরে। কোলে পিঠে করে শত আদরে বড়ো করা মেয়েটি যে এই মুহূর্ত থেকে উনার পর হয়ে গেলো, কথাটি মস্তিষ্কে হানা দিতেই চোখ জোড়া ভিজে উঠলো রায়হান কবীরের।

পিতার ভেজা চোখ জোড়া দৃষ্টিগোচর হতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো উথমীর। এতক্ষণ ধরে গোপনে রাখা চাপা কষ্টগুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো। আটকে রাখা চোখের জল বর্ষণের ন্যায় ঝরতে লাগলো কপোল বেয়ে। কন্যার চোখের পানি কখনোই সহ্য করতে পারেন না পিতা রায়হান কবীর। বরং সেই মুহূর্তে পুরো পৃথিবীটাই উনার নিকট বিষাদের মতো ত্যক্ত লাগে। বিষের মতো বিষাক্ত লাগে। হাতের অর্ধ খাওয়া মিষ্টি পূর্বের ন্যায় হাঁড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে হাঁড়িটি রেখে দিলেন মেঝেতে। একহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে দিতে চাইলেন সান্ত্বনা কিন্তু পারলেন না। উনার চোখ থেকেও যে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে। কণ্ঠ রোধ হয়েছে। বলার মতো খুঁজে পাচ্ছেন না কোনো শব্দ।

আশেপাশের সকল কোলাহল থেমে গিয়েছে। স্থানটি হয়ে গিয়েছে নিস্তব্ধ। উপস্থিত সকলে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখছে পিতা এবং কন্যার কান্না। যে কান্না না সুখের আর না দুঃখের। এ কান্না এক পিতার। যিনি তার কন্যাকে আজকের পর থেকে যখন তখন চাইলেই দেখতে পাবেন না। স্নেহ, ভালোবাসার ছায়াতলে আবদ্ধ রাখতে পারবেন না। এ কান্না এক নারীর। যে কিনা চাইলেই আজকের পর থেকে বাবার কাছে আবদার করতে পারবে না। পারবে না উড়নচণ্ডীর মতো নিজ মর্জিতে ঘুরে বেড়াতে। আজ থেকে যে তার ঠিকানা বদলে গেলো। বদলে গেলো গন্তব্য।

সময় গড়ালো। এখন বিদায়ের পালা। বাহিরে মেইন রোডে দাঁড়িয়ে আছে ফুলে ফুলে সজ্জিত বরের গাড়িটি। মসজিদ থেকে বেরিয়ে সকলে চলে গিয়েছে বাহিরে। উথমীর কান্নার বেগও কমে এসেছে। চোখের গাঢ় কাজল লেপ্টে গিয়েছে। নাকের ডগায় ফোটে উঠেছে লাল আভা। রায়হান কবীর সস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এতক্ষণে উনিও সামলে নিয়েছেন নিজেকে। মা কেয়া বেগম এতক্ষণ নিরব দর্শকের ন্যায় বাবা-মেয়েকে দেখছিলেন। লোক সমাগম কমতেই কন্যার উদ্দেশ্যে বললেন,“একসময় না একসময় বিয়ে মানুষকে করতেই হয়। বিয়ের পর মেয়েদের আসল ঠিকানা হয় স্বামীর বাড়ি। কষ্ট পাস না। নতুন সংসারে যাচ্ছিস। সবাইকে নিয়ে সুখে থাকিস। নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করিস।”

ভেজা চোখেই মায়ের পানে তাকায় উথমী। এই বিদায় বেলাও মায়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে আশাহত হয় মেয়েটির মন। কষ্টটা তড়তড় করে বৃদ্ধি পায়। তখনি দ্রুত পায়ে হেঁটে আসে বড়ো ভাই উৎস। তাড়া দিয়ে পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে বলে,“বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে বাবা। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তার উপর অনেকটা পথ যেতে হবে।”

বসা থেকে উঠে দাঁড়ান রায়হান কবীর। পুত্রের কথায় মাথা নাড়ান। মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন,“চল মা তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”

কোনো বাক্য বিনিময় না করে উঠে দাঁড়ায় উথমী। মা, ভাবী, ছোটো বোনসহ ভাতিজির থেকে বিদায় নিয়ে পিতার সাথে এগিয়ে চলে বাহিরে। মেয়ের হাত ধরে বেশ কয়েক কদম পাড়ি দিয়ে ফুলে ফুলে সজ্জিত গাড়িটির নিকট এসে দাঁড়ান ভদ্রলোক।

গাড়ির পাশেই বরবেশে দাঁড়িয়ে আছে একজন লম্বা, চওড়া পুরুষ। পূর্বের সেই মৃদু হাসিটা তার অধর থেকে বিলীন হয়েছে অনেক আগেই। এখন সেখানে স্থান পেয়েছে নিজ সত্তা। তীক্ষ্ণ গাম্ভীর্য আর দৃষ্টিতে প্রখর ব্যক্তিত্বের ছাপ। নিরব দর্শকের মতো তখন সেই যে পিতা কন্যার আবেগঘন দৃশ্যটি দেখে বাহিরে এসেছিল সে,তারপর আর ভেতরে যাওয়া হয়নি। তাদের আগমন ঘটতেই কিছুটা নড়েচড়ে দাঁড়ালো তৈমূর। তার হাতের মধ্যে উথমীর হাতটি সঁপে দিলেন রায়হান কবীর। ভারি কণ্ঠে বললেন,“প্রত্যেক বাবা-মায়ের কাছেই তাদের সন্তান খুব প্রিয়। আমার কাছেও তাই। আমার আদরের এই প্রাণ ভোমরাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা। আজ থেকে ও তোমার আমানত। ওকে কখনো কষ্ট দিও না। ও কষ্ট পেলে যে আমি সারাজীবনের জন্য নিজের কাছেই নিজে অপরাধী হয়ে যাবো। আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখো।”

আড়চোখে নববধূর পানে তাকিয়ে তার হাতটি মুঠোয় নিয়ে নিলো তৈমূর। শ্বশুরের পানে দৃষ্টি স্থির রেখে আশ্বস্ত করে বললো,“কবুল বলার পরমুহূর্ত থেকেই ও আমার অর্ধাঙ্গিনী। ওকে আগলে রাখা, ওর ভালো মন্দ দিক বিবেচনা করা আমার কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনে কখনোই ব্যাঘাত ঘটবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”

এবার যেনো কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন রায়হান কবীর। মেয়েকে তুলে দিলেন গাড়িতে। বিদায় পর্ব শেষ হতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে রাস্তার ধূলো উড়িয়ে শাঁ শাঁ করে বরের গাড়িটি ছুটতে লাগলো অপরিচিত এক গন্তব্যে।
___________

চলন্ত গাড়িটির অর্ধ কাঁচ নামানো জানালা ভেদ করে বাহিরের পানে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে উথমী। পাশে বসা মানুষটির দিকে খেয়াল নেই তার। সে আপন ধ্যানে মগ্ন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথাটা ভার হয়ে এলো তার। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জীবনের হিসাব নিকাশ কষতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বধূ রূপে বসে থাকা প্রাপ্ত বয়স্কা মেয়েটি। বিয়েটা করে কী সে ঠিক করল? পারবে কী নতুন একটি পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে? অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই তার ছোট্ট মস্তিষ্কে ধরা দিতে লাগলো শ’খানেক প্রশ্ন।

ছোটো থেকেই অংকে মেয়েটি ভীষণ কাঁচা। যার দরুন জীবনের হিসাব নিকাশ করতে গিয়েও আজ সে ব্যর্থ হলো। ব্যর্থতা মেনে নিয়ে বন্ধ করে নিলো নেত্র যুগল। কয়েক মাইলের পথ অতিক্রম করে একপর্যায়ে গাড়ি এসে থামলো জমকালো সজ্জিত এক বাড়ির সম্মুখে। খুলে গেলো গাড়ির দ্বার। উথমী তাকালো সেদিক পানে। তৎক্ষণাৎ তারদিকে এগিয়ে এলো একটি পুরুষালি হাত। পরনের পোশাক দেখে চিনতে অসুবিধে হলো না যে হাতের অধিকারী ভদ্রলোকটি তার স্বামী। বাড়ানো হাতটিকে অবজ্ঞা করে ভারি ল্যাহেঙ্গা ধরে গাড়ি থেকে নিজ উদ্যোগেই নেমে এলো উথমী। স্ত্রীর এহেন কাজে স্বামী নামক মানুষটি গুটিয়ে নিলো নিজ হস্ত।

ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো বাড়িটি একদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নিলো উথমী। রজনীর প্রথম প্রহরে হরেক রকমের আলোকসজ্জায় জমিনের উপর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা তিনতলা বিশিষ্ট বিশাল বাড়িটির আসল রঙ কিছুতেই যেনো ঠাহর করতে পারলো না সে। গাড়ির আওয়াজ পেতেই বাড়ির ভেতরে বেঁধে গেলো শোরগোল। শুরু হলো আনন্দঘন উচ্ছ্বাস। তাকে এভাবে একই স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো তৈমূরের। গম্ভীর কণ্ঠে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“ভেতরে চলুন উথমী। সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।”

কথাটি শ্রবণাতীত হতেই ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর পানে তাকায় সে।আগে থেকেই লোকটি তার দিকে তাকিয়ে থাকায় মিলিত হয় দুজনার দৃষ্টি। উথমী খেয়াল করে উচ্চতায় লোকটি তার থেকে বেশ লম্বা। লম্বা বললে ভুল হবে বরং লোকটি তার নিজ উচ্চতায় সঠিক শুধু উথমীই যেনো কিছুটা খাটো। এহেন দৃষ্টিতে হতচকিত হলো পুরুষটি। শুকনো ঢোক গিলে তাড়া দিয়ে বললো, “আমাকে দেখার জন্য গোটা একটা জীবন পড়ে আছে উথমী। এবার ভেতরে চলুন।”

কথাটায় খানিকটা লজ্জা পেলো উথমী। হালকা মাথা নাড়িয়ে ধীর পায়ে অগ্ৰসর হলো বিশাল ভবনটির পথে। সদর দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়াতেই দেখা মিললো বেশ কয়েকজন রমণীর। এতো এতো অপরিচিত মুখের ভিড়ে একটা মুখই শুধু পরিচিত ঠেকলো তার নিকট। পরিচিত মুখের অধিকারিণী মুচকি হাসলো। বরণ করে ভেতরে আমন্ত্রণ জানালো তাকে। বসানো হলো অন্দর মহলে। এই পরিচিত মুখের অধিকারিণী ভদ্রমহিলার নাম জেবা। সম্পর্কে উথমীর বড়ো জা। বড়ো ভাইয়ের সহকর্মীর স্ত্রী হওয়ার সুবাদে এর আগে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল দুজনার। সাথে হয়েছিল পরিচয়। ভেতর থেকে ডাক এলো জেবার। যাওয়ার আগে সদ্য বাড়িতে পা দেওয়া ছোটো জায়ের উদ্দেশ্যে বলে গেলো,“ওই যে ডাক পড়েছে আমার। তুমি এখানে বসো আমি বরং ওদিকটা দেখে আসি।” সাথে আশেপাশের ব্যক্তিদেরও বলে গেলো,“আপনারা ওর কাছেই একটু বসুন। আমি আসছি।”

কথার পিঠে শুধুই মাথা নাড়ায় উথমী। দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখে চারিদিক। বাড়ির ভেতরটা সাদা আলোয় আলোকিত। বিভিন্ন বয়সী নারীরা উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে নববধূকে। এরই মধ্যে নতুন বর অদৃশ্য হয়েছে সেখান থেকে। তারপর কিছুক্ষণ পুরো দমে চললো পিনপতন নিরবতা। এই নিরবতার অবসান ঘটাতেই ভিড়ের মধ্য হতে এক বয়োজ্যেষ্ঠা কারো উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“কী ব্যাপার? বাড়ির গিন্নি গো তো একবারও দেখলাম না। কই তারা? মেজ গিন্নি কই? তার পোলায় বউ লইয়া বাড়িত আইছে আর সে-ই কিনা লাপাত্তা?”

প্রশ্ন করা শেষ হতে না হতেই তৎক্ষণাৎ ভিড় ঠেলে এক চাপা নারী কণ্ঠস্বর থেকে বয়োজ্যেষ্ঠার প্রশ্নের উত্তর এলো,“সে কী চাচী আপনি কিছু জানেন না? এই বিয়ে তো মেজো গিন্নির অমতে হয়েছে। মেয়ে নাকি তার পছন্দ নয়। এ নিয়ে বাড়িতে কত কাণ্ড! নেহাৎ ছেলেদের জেদের কারণে বিয়েটা আর শেষমেশ আটকাতে পারেনি। এই জন্যই রাগে জিদে দরজায় খিল এঁটেছে।”

মুহূর্তেই যেনো ভারি হয়ে উঠলো পরিবেশ। শুরু হলো কানাঘুষা। জম্পেশ খবর পেতেই উপস্থিত নারীরা সেই বিষয়টিকে আরো মশলাপাতি সহকারে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে লাগলো একে অপরের নিকট। উথমী নির্বাক শুনে যাচ্ছে সেসব কথা। ভেতরে ভেতরে চরম আশ্চর্য হচ্ছে। ভার হয়ে আসছে বুক। বড়ো ভাইয়ের কাছে শুনেছিল ছেলের পিতা গত হয়েছেন বছর চারেক আগে। মা-ই এখন পরিবারের সর্বেসর্বা।সেখানে তিনিই কিনা বিয়েতে রাজি নন? বাবা-মা, ভাই-ভাবী কী জানতো না সেসব কথা? খোঁজখবর না নিয়েই তাকে ঠেলে দিলো এমন আগুনের দ্বারপ্রান্তে?

এই মানুষগুলোর বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্য দিয়েই ঘণ্টা পেরোলো। শোনা গেলো এক পুরুষালি কণ্ঠস্বরের হাঁক ডাক,“তোমার কী কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই বুবু? এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে মেয়েটা এসেছে বাড়িতে। আর তাকে কিনা এভাবে অন্দরমহলে বসিয়ে রেখেছো?”

পুরুষালি এমন তেজস্বী কণ্ঠে নিরব হয়ে গেলো সকলে। বুবু সম্বোধন করা মধ্য বয়সী মহিলাটির ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হলো। মুখশ্রীতে বিরাজমান তার উপচে পড়া রাগ। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,“তো কি করবো? কোলে নিয়ে বসে থাকবো? দেখ তুরাগ সাফ সাফ জানিয়ে দিচ্ছি, এসবের মধ্যে আমায় একদম ডাকবি না। ওদিকে আমার আম্মা দরজা আটকে বসে আছেন আর এদিকে উনারা আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে।”

বড়ো বোনের এমন কথায় নিভে গেলো তুরাগ। কণ্ঠস্বর নিচু হলো,“বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীতে ভরা। এখানে এভাবে সিনক্রিয়েট করো না বুবু। নতুন বউ কী ভাববে?”

“এতোই যেহেতু অন্যের ভাবনা নিয়ে চিন্তা তাহলে আমায় ডাকলি কেন? তোর বউ কোথায়? পটের বিবি সেজে কোথায় ঘুরছেন উনি? ওকে গিয়ে হুকুম কর। একটা কাল নাগিনী এনে সংসারে ভাঙন তো আগেই সৃষ্টি করেছিল এখন আবার নতুন কাল নাগিনীর আবির্ভাব।”—-শেষের কথাখানা বিড়বিড় করে বলতে বলতেই স্থান ত্যাগ করলেন ভদ্রমহিলা।

ভাসুর এবং ননদের কথোপকথনে হতভম্ব হয়ে গেলো উথমী। ননদেরও তাকে পছন্দ নয়? এই জন্যই কী তবে বিয়েতে তাদের দেখা পায়নি সে!

কয়েক মিনিট বাদে হন্তদন্ত পায়ে অন্দরমহলে এসে উপস্থিত হলো জেবা। ক্লান্ত স্বরে বললো,“দেখো কাণ্ড! ওদিক সামলাতে গিয়ে এদিকের কথা বেমালুম ভুলে বসেছিলাম। বিয়ে বাড়ি মানেই শুধু কাজ আর কাজ।”

কথার পিঠে নিরব রইলো উথমী। চুপচাপ শুধু শুনলো। মৃদু হাসলো জেবা। উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললো,“ওকে বরং আমি তৈমূরের ঘরে দিয়ে আসি। এই ভারি পোশাক, গহনাগাটি পরে কী আর এভাবে বসে থাকা যায়? আমরা যাই, আপনাদের কিছু প্রয়োজন হলে কিন্তু অবশ্যই মালতী ফুফুকে ডাকবেন।”

বরাবরের মতো এবারও বউটির কথায় মন্ত্রমুগ্ধ হলো উপস্থিত সকলে। তাদের থেকে বিদায় নিয়ে উথমীকে সঙ্গে করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলো জেবা। একতলা থেকে দুতলায় উঠে পরপর তিনটে ঘর পেরিয়ে চতুর্থ ঘরটার সম্মুখে এসে থামলো সে। বদ্ধ দরজা ঠেলে প্রবেশ করল ভেতরে। পঙ্খও বাধ্য মেয়ের মতন তার পিছুপিছু ভেতরে এলো। দৃষ্টিগোচর হলো বিশাল একটি গোছানো কক্ষের। ঘরের মাঝখানে ঠাঁই পাওয়া বিশাল পালঙ্কটি ফুলে ফুলে সজ্জিত।

বিছানার মাঝখানটায় তাকে নিয়ে বসিয়ে দিলো জেবা। থুতনি পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দিয়ে দুষ্টু হেসে ফিসফিস করে বললো,“আমি গিয়ে তৈমূরকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। স্বামী না আসা পর্যন্ত কিন্তু এখানেই চুপটি করে বসে থাকবে মেয়ে।”—-বলেই সাদা আলো নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে কক্ষ ত্যাগ করল সে।

আশেপাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উথমী। শরীরটা খুব ক্লান্ত। এই বিয়ের চিন্তায় গতকাল রাতেও তার ঘুম হয়নি। মায়ের উপরে রাগ দেখিয়ে দুপুরেও মুখে তুলেনি একটা দানা পানিও। তবে এই মুহূর্তে তার পেট কামড়াচ্ছে। খুব ক্ষুধা লেগেছে। চোখ জোড়াও বন্ধ হয়ে আসছে ঘুমে। এতশত সমস্যা নিয়েও বধূ রূপেই তাকে ঠাঁয় বসে থাকতে হলো বিছানায়। ধীরে ধীরে সময় বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা ছুটছে একঘর থেকে আরেকঘরে। অবশ হয়ে আসছে উথমীর দেহ। বারবার বন্ধ হয়ে আসছে নেত্র যুগল। একটা সময় এই ঘুমের নিকট হার মেনে নিয়েই ঘুমের তলদেশে পাড়ি জমালো সে।
__________

রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। থেমে গিয়েছে বাহিরের সকল কোলাহল। যে যার যার মতো বিছানা পেতে ঘুমের রাজ্যে ডুব দিয়েছে। এই নিস্তব্ধতায় দূর হতে ভেসে আসছে পেঁচার ডাক।

বাসরঘরের প্রবেশ দ্বারে নব বরদের বিভিন্ন বাঁধার সম্মুখীন হতে হলেও তৈমূরকে হতে হলো না তেমন কোনো কিছুর সম্মুখীন। বিনা বাঁধায় কক্ষে প্রবেশ করে নিঃশব্দে সে আটকে দিলো দ্বার।

দরজা আটকে লাইট জ্বালিয়ে পেছন ফিরতেই ললাটে উদিত হলো বেশ কয়েকটি ভাঁজ। বাসরঘরে বর প্রবেশ করেই দেখতে পায় বিছানার মধ্যিখানে ঘোমটা টেনে বসে থাকা নববধূকে। ধীরে ধীরে বর এগিয়ে গিয়ে সরায় বধূর ঘোমটা। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিগোচর হয় লাজে রাঙা একটি নারী মুখশ্রী।কিন্তু তৈমূরের ক্ষেত্রে তেমনটি হলো না। বরং সে দেখতে পেলো বিছানায় এলোমেলো, গভীর নিদ্রায় বিভোর থাকা তার সদ্য বিয়ে করে ঘরে তোলা স্ত্রীকে।

ছোটো ছোটো কদম ফেলে সে এগিয়ে এলো পালঙ্কের নিকটে। কোনো প্রকার শব্দ না করেই বসলো বিছানার একপাশে। মাথাটা একটু নিচু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাক করে দেখতে লাগলো মেয়েটিকে।মেয়েটি যে অত্যন্ত রূপবতী তা তৈমূরের অজানা নয়। তবে বিয়ের সাজসজ্জায় তার সৌন্দর্য বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

বড়ো ভাই তুরাগের কলিগের ছোটো বোন হচ্ছে উথমী। উৎসর আমন্ত্রণে স্ত্রী বাচ্চা সমেত বেশ কয়েকবার তাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল তুরাগ। সেখানেই এই মেয়েটিকে খুব মনে ধরে ভাবী জেবার। তারপর স্বামীর সাথে বিভিন্ন শলা পরামর্শ করে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে তাদের বাড়িতে।

প্রত্যেক বাবা-মা চান নিজ কন্যাকে সৎ পাত্রে ন্যস্ত করতে। বড়ো ভাই চায় বোনের জন্য দায়িত্ববান, সুপুরুষ। উৎসও তাই চেয়েছে। বাবা-মায়ের সাথে আলোচনা করে গোপনে পাত্র সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ের দিকে এগিয়েছে। যদিও বিয়েতে উথমীর ঘোর আপত্তি ছিলো। কিন্তু এক পর্যায়ে ভাইয়ের বিভিন্ন যুক্তি তর্কের সম্মুখে হার মেনে নিতে হয় তাকে।

তৈমূরও রাজি ছিলো না বিয়েতে। তার প্রধান কারণ তার মা। মা সরাসরিই এ মেয়েকে নাকোচ করেছিলেন। মায়ের উপরে কী করেই বা কথা বলবে সে? তবুও ভাই-ভাবীর জোরাজুরিতেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল তৈমূর। মেয়েটির আচার, ব্যবহার, জড়তাহীন কথাবার্তা এবং রূপ তাকে মুগ্ধ করে। এতেই তার কঠোর মনের পরিবর্তন হয়। শেষমেশ মা-বোনের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বড়ো ভাইয়ের সিদ্ধান্তেই সে বিয়ে করে নেয় এই রূপবতী রমণীকে।

মেয়েটির সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে এক অজানা মোহে আটকে পড়ে তৈমূর। বুড়ো আঙুলের সাহায্যে ছুঁয়ে দেয় তার লিপস্টিকে রাঙা ওষ্ঠদ্বয়। নিজেকে হারিয়ে ফেলে অজানা এক ঘোরে। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে জমা হয় তীব্র নেশা। প্রেমময়ী নেশা। শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে আসে। স্পর্শ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতেই নড়েচড়ে উঠে বধূ রূপে শয়নে থাকা উথমী। কারো স্পর্শে মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে ওঠে তার। কিন্তু চট করেই সে খুলতে পারে না নিজ আঁখিদ্বয়। তার নড়চড় দেখে ঘোর ভাঙে তৈমূরের। গুটিয়ে নেয় নিজ হস্ত। বেরিয়ে আসে ভেতরের গম্ভীর সত্তা। সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে উঠে যায় বসা থেকে। তারপর আলমারি হতে পরনের পোশাক নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।

খানিকক্ষণ বাদে তন্দ্রাকে সরিয়ে চোখ মেলে তাকাতে সক্ষম হলো উথমী। শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। চোখ দুটো অঙ্গুলি দিয়ে ঘষা দিতেই অবশিষ্ট কাজলটুকুও লেপ্টে গিয়ে বিশ্রী রূপ ধারণ করল। আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে পূর্বের ন্যায় ফাঁকা কক্ষটি দেখে মনঃক্ষুন্ন হলো। দেয়ালে ঝুলন্ত বিশাল ঘড়িটিতে বারোটা বেজে আটাশ মিনিট। এতো রাত হয়ে গেলো অথচ এখনো লোকটি এলো না? ভীষণ রাগ হলো তার। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,“মা-বোনের মতো এই লোকটিরও কী আমাকে অপছন্দ? অপছন্দ হলে বিয়ে হলো কীভাবে? আর এতো এতো অপছন্দের ভিড়ে আমিই বা কী করে এলাম?”

বিড়বিড় করতে করতেই দরজা খোলার শব্দ হলো। শব্দের উৎস খুঁজতে পাশ ফিরে তাকায় উথমী। দৃষ্টিগোচর হয় কালো রঙের ট্রাউজার আর সাদা রঙের টি-শার্ট পরিহিত একজন পুরুষকে। লোকটিকে দেখেই চমকায় সে। এ আবার ঘরে এলো কখন? স্ত্রীকে এভাবে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্লান হাসে তৈমূর। শুধায়,“ঘুম শেষ?”

খানিকটা লজ্জা পায় উথমী। নুইয়ে নেয় মাথা। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে,“কখন এলেন আপনি?”

“এসেছি তো অনেকক্ষণ। এসে দেখি আপনি ঘুমে বিভোর।”

“ডাকলেন না কেন?”

“ইচ্ছে করেনি।”

কথার পিঠে কথা খুঁজে পায় না উথমী। তাই নিরব থাকে। ভেজা তোয়ালেটা চেয়ারের উপর মেলে দিয়ে বিছানায় এসে বসলো তৈমূর। তৎক্ষণাৎ কিছুটা ঘাবড়ে গেলো উথমী। যা ঠিকই দৃষ্টিগোচর হলো তৈমূরের। তবে সেদিকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে স্ত্রীর ডান হাতটি টেনে ধরলো সে। কেঁপে উঠলো উথমী। চট করেই মস্তিষ্কে নিষিদ্ধ সকল চিন্তা ভাবনার উদয় হলো। প্রাপ্ত বয়স্কা রমণী হওয়ার পরেও ভেতরে তার অস্থিরতায় ছেয়ে গেলো। তার এই অবাধ্য কম্পন টের পেলো তৈমূর। তবে ছাড়লো না। দু হাত ভর্তি একগাদা চুড়িগুলো ধীরে ধীরে খুলে একপাশে রাখলো। ফাঁকা হাতে পরিয়ে দিলো সোনার দুটো বালা। বললো, “শুনেছি বাসর রাতে নাকি স্ত্রীদের উপহার দিতে হয়? তাই উপহার হিসেবে এই সুন্দর হাত জোড়ায় বালা পরিয়ে দিলাম।”

লোকটির কথায় অজানা এক অনুভূতি ছুঁয়ে গেলো উথমীর হৃদয় প্রাঙ্গণে। লোকটির চাহনি দৃষ্টিগোচর হতেই কিছুটা ইতস্ততবোধ করল সে। তৈমূর যেনো খুব সহজেই মেয়েটির মুখশ্রী পড়ে ফেললো। আশ্বস্ত করে বললো,“লজ্জা পাচ্ছেন নাকি ভয়? লজ্জা পেলে ঠিক আছে তবে ভয় পাওয়া কিন্তু চলবে না। আমি আপনার নিজের মানুষ উথমী। আমার সাথেই বাকিটা পথ আপনাকে চলতে হবে। পুরো জীবন কাটাতে হবে। তাই সকল ভয়ভীতি, জড়তা দূরে ঠেলে দিয়ে প্রথম সাক্ষাতের মতো সহজ হন।”

কথার বিপরীতে মাথা নাড়ায় উথমী। ফিসফিস করে তৈমূর বলে,“আপনি যেসব ভাবছেন সেসব কিছুই এই মুহূর্তে আমি আপনার সঙ্গে করছি না উথমী।”

এবারো চমকে গেলো উথমী। লোকটি কী মনের কথা পড়তে জানে? সে জানুক বা না জানুক তবে এই মুহূর্তে ভীষণ লজ্জা লাগছে তার।

স্ত্রীর এহেন অবস্থায় কৃত্রিম হাসলো তৈমূর।আশেপাশে তাকিয়ে পুনরায় বললো,“আপনার লাগেজটা তো দেখছি না। মনে হয় নিচেই রয়ে গেছে। তবে সমস্যা নেই, আলমারিতে শাড়ি আছে। গিয়ে ওখান থেকে একটা পরে নিন। এই ভারি পোশাক, গহনা পরে কীভাবে এখনো বসে আছেন বলুন তো? কষ্ট হচ্ছে না?”

উত্তর দেয় না উথমী। নিরবে বাধ্য মেয়ের মতো বিছানা থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে এগোয় ড্রেসিং টেবিলের সামনে। আড়চোখে স্ত্রীর পানে তাকিয়ে বিছানার একপাশে জায়গা রেখে অপরপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল তৈমূর। চোখ জোড়া বন্ধ করে বলে উঠলো,“ফ্রেশ হয়ে নির্দ্বিধায় বিছানায় এসে শুয়ে পড়বেন। আশা করি পাশে শুতে আপত্তি নেই? আমি কিন্তু একদম হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করি না। আর করলেই বা কী? পরপুরুষ তো নই।”

চলবে ______