জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-৬+৭

0
9

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৬]

সকাল সকাল শ্বশুর বাড়ির জন্য একগাদা বাজার করে নিয়ে এসেছে তৈমূর। ড্রয়িং রুমের মেঝেতে রাখা মাছ, মাংস, শাক সবজিগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেনো ছোটোখাটো একটা বাজার বসে গিয়েছে সেখানে। তিল পরিমাণ জায়গাটুকুও আর ফাঁকা নেই সেথায়। কেয়া বেগম আর রিনিতা নির্বিকার ভঙিতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। রায়হান কবীর আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে জামাতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,“এ কী করেছো বাবা! তুমি কেনো আবার বাজার করতে গেলে?”

তৈমূর সৌজন্য হেসে উত্তর দিলো,“নিয়ম অনুযায়ী তো আজ আমারই বাজার করার কথা। তাই নিয়ম পালন করেছি। তাছাড়া আম্মাও বারবার এ বিষয়ে বলে দিয়েছেন।”

“তাই বলে এতো?”

শ্বশুরের কথায় সায় জানিয়ে রিনিতাও বলে উঠলো,
“ঠিকই তো। এতো বাজার করে আনার কী প্রয়োজন ছিলো? এখন এগুলো রাখবো কোথায়?ফ্রিজেও তেমন একটা জায়গা নেই আর এতোকিছু খাবেই বা কে?”

স্ত্রীর কথা শুনে ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো উৎস’র। বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,“বিয়ের পর তোমার বাপের বাড়িতে গিয়ে যখন আমিও রিক্সা ভর্তি বাজার করে নিয়ে গেলাম তখন তো ভদ্রতার খাতিরেও একবার এ কথা বলোনি। তাহলে এখন আবার বাবার কথায় সায় দিচ্ছো কীভাবে?”

এমন একটি সময় স্বামীর এহেন খোঁচা মারা কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো রিনিতা। এতোগুলো মানুষ সামনে থাকায় নিজেকে সংযত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে বিদ্রুপের সুরে উত্তর দিলো,“বাজার বলতে ওই তো এক ব্যাগ পঁচা শাক-সবজি আর দুটো পাকিস্তানি মোরগ নিয়ে গিয়েছিলে। তাতেই কথায় কথায় এতো খোঁটা?”

মিইয়ে গেলো উৎস। তবুও হার না মানার প্রয়াস চালিয়ে বললো,“বাড়িতে ওইতো তোমার মা আর ছোটো একটা ভাই। তাদের জন্য এতো বাজার করে কী লাভ হতো?অযথা অপচয়। তাছাড়া তোমাদের এলাকার মানুষগুলোর কথা আর কী বলবো? সাদাসিধে ছেলে পেয়ে আমার হাতে কিনা পঁচা শাক-সবজি ধরিয়ে দিয়েছিল!”

“হয়েছে হয়েছে। শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকতে হবে না। নিজে যে ঠিকঠাক বাজার করতে পারো না তা এবার স্বীকার করে নাও।”

অবস্থা বেগতিক দেখে গলা ঝেড়ে স্ত্রীকে ইশারা দিলেন রায়হান কবীর। কেয়া বেগম গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,“থামো তোমরা। সবসময় বাচ্চাদের মতো ঝগড়াঝাঁটি চলতেই থাকে। অথচ এরা নিজেরাই কিনা এখন এক বাচ্চার বাবা-মা। চলো এগুলোর একটা ব্যবস্থা করি।”

মায়ের কথার বিপরীতে কথা বলার সাহস পেলো না কেউই। রিনিতা একে একে ব্যাগগুলো নিয়ে হাঁটা ধরলো রান্নাঘরের দিকে। কেয়া বেগম এবার তৈমূরের উদ্দেশ্যে কোমল স্বরে তাড়া দিয়ে বললেন,“ঘেমেনেয়ে কি অবস্থা হয়েছে তোমার! যাও বাবা হাতমুখ ধুয়ে দ্রুত খেতে এসো। বেলা তো পেরিয়ে যাচ্ছে।”

স্ত্রীর সঙ্গে রায়হান কবীরও সহমত পোষণ করে একপ্রকার ঠেলেঠুলে পাঠালেন মেয়ে জামাইকে। বাধ্য ছেলের মতো আর দ্বিমত না করে ঘরে এলো তৈমূর। আশেপাশে খুঁজেও দেখা পেলো না স্ত্রীর। গতকাল রাতের জামাই ভোজ খেয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ফেলতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল তৈমূর। তারপর ভোরে ঘর থেকে বের হওয়ার আগেও দেখে গিয়েছিল ঘুমন্ত স্ত্রীকে। এখন কিনা সেই মেয়েটা উধাও! দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈমূর। চলে যায় ফ্রেশ হতে।

ড্রয়িং রুমের পাশ ঘেঁষে করিডোর। তার পাশেই খোলামেলা বিশাল এক বারান্দা। যার মাঝখানে ঠাঁয় পেয়েছে একটি দোলনা। রেলিংয়ের পাশ ঘেঁষে গোলাকৃতির মতো করে রাখা টবগুলোর মধ্যে হরেক রকমের ফুল, ফল গাছ। কোনো গাছে ফুল, ফল এসেছে আবার কোনোটা ফুল, ফলহীন। বিয়ের আগে রোজ উদাস বিকেলটা চায়ের কাপ হাতে এখানেই কাটতো উথমীর। অথচ এখন সেসব অতীত। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সবকিছু কতটাই না বদলে গেলো? এক লহমায় বদলে গেলো ঠিকানা, পরিচয়, সম্পর্কগুলো। দোলনায় দোল খেতে খেতে সেসব ভাবনায় মশগুল সে।

“বড়ু পুপি, বড়ু পুপি ওই যে তিতি। দ্যাখো দ্যাখো, তিতি তিতি।”

অগোছালো বুলি কর্ণপাত হতেই ছোট্ট তনির পানে তাকায় উথমী। মেয়েটির ডান হাতটা খোলা অন্তরীক্ষে তাক করা। সেই তাক করা আঙুল লক্ষ্য করে এবার ঘাড় উঁচিয়ে সেদিকেই তাকালো উথমী। অন্তরীক্ষে দক্ষিণের দিকে ছুটে চলেছে একঝাঁক নাম না জানা পাখির দল। তা দেখে মুচকি হাসলো সে। একহাতে তনিকে টেনে নিজের কোলে বসালো। মেয়েটি হচ্ছে উৎস আর রিনিতার একমাত্র মেয়ে। বয়স কত হবে? আড়াই অথবা তিন। তাকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে কোমল স্বরে উথমী বললো,“তিতি না। ওগুলো হচ্ছে পাখি। বলো পাখি।”

“না, তিতি।”

“আহা ওগুলো হচ্ছে পাখি। আর তিতি হচ্ছে মুরগি।”

“তিতি মুগী?”

“হুম সোনা।”

সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে এলো বিড়াল ছানার ম্যাও ম্যাও ডাক। মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে ছোট্ট বিড়াল ছানা। গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে উথমী আর তনির পানে। মুচকি হাসলো উথমী। দুষ্টুমির ছলে বললো,“ওই যে তোমার বাচ্চা তোমায় ডাকছে। সকালে খাবার দাওনি?”

ফুফুর কোল থেকে নেমে গিয়ে বিড়াল ছানাকে কোলে তুলে নিলো তনি। তার স্পর্শ পেতেই থেমে গেলো বিড়াল ছানা। মিশে গেলো তনির গায়ের সাথে। তার পিঠে হাত বুলিয়ে তনি শুধালো,“খুদা পেয়েছে তোল? দুধ খাবি?”

কথার বিপরীতে বিড়াল ছানাটিও ম্যাও করে উঠলো। আশানুরূপ উত্তর পেয়ে বিড়ালটিকে কোলে নিয়েই তার সাথে কথা বলতে বলতে ভেতরে চলে গেলো তনি। মেয়েটির কর্মকাণ্ড দেখে শব্দহীন হাসলো উথমী। এই বাচ্চা মেয়েটির কাণ্ড কারখানায় মাঝেমধ্যেই চরম মন খারাপগুলো ভালো হয়ে যায় তার। অনিচ্ছাকৃতভাবেই প্রাণখোলে হেসে ফেলে।

ছোটো ছোটো পায়ে রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলো তনি। ড্যাবড্যাড করে তাকিয়ে দেখলো মা আর দাদীকে। ছুটা বুয়া মেঝেতে বসে সবজি কাটছে। কেয়া বেগম পাশেই বসা। রিনিতা চুলায় বসিয়েছে ভাত। নাতনিকে দেখতেই কেয়া বেগম শুধালেন, “আপনাকে তো সারাদিন খুঁজেই পাওয়া যায় না তনি বুড়ি। তা এখন এখানে কী?”

“আইতকিলিমের খুদা পেয়েছে। ওকে দুধ দাও।”

মেয়ের কথা শুনতেই কোমরে হাত গুঁজে পেছন ফিরে তাকালো রিনিতা। চোখ রাঙিয়ে বললো,“একটু আগেই না খাওয়ালাম। এখন আবার কীভাবে ক্ষুধা লাগে?”

“লেগেছে তো‌। দাও তুমি।”

“কে বলেছে ওর খিদে পেয়েছে?”

“ও বলেছে।”

“কীভাবে বললো শুনি?”

“ম্যাও ম্যাও।”

মেয়ের কথায় আশ্চর্য হলো রিনিতা। কেয়া বেগম শব্দ করে হেসে উঠলেন। নাতনিকে প্রশ্রয় দিয়ে বললেন,
“তুমি ড্রয়িং রুমে গিয়ে তোমার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বসো। আমি ওর জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”

দাদীর কথায় ডানে ঘাড় কাত করে ‘আচ্ছা’ বলে তারপর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায় তনি। রিনিতা মুখ ভার করে বলে,“আপনিও না মা! এই দুষ্টুটাকে সবসময় প্রশ্রয় দেন।”

“বাচ্চা মানুষ। ওদের কাজ দুষ্টুমি করা আর আমাদের কাজ হচ্ছে প্রশ্রয় দেওয়া। বড়ো হলে ঠিক হয়ে যাবে।”

সোফায় এসে পা তুলে বসলো তনি। পাশে বসালো ছানাটিকেও। ওখানেই তখন বসা ছিলো তৈমূর আর রায়হান কবীর। উৎসও ছিলো তবে অফিস থেকে প্রয়োজনীয় ফোনকল আসতেই সে চলে গিয়েছে নিজ কক্ষে।

“একি রাজকুমারী আপনি আপনার বাবু নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছেন কেন?”—-আগ্ৰহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন রায়হান কবীর।

“ওর খুদা পেয়েছে। তাই দাদী এখানে এসে বসতে বলেছে।”

কথা বলতে বলতেই তনির দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো তৈমূরের পানে। সঙ্গে সঙ্গেই মুখটি তার অত্যন্ত গম্ভীর হলো। রায়হান কবীর নাতনির উদ্দেশ্যে হেসে বললেন, “তোমার ফুফাজি হয়। ফুফাজিকে সালাম দাও।”

দাদার কথায় মোটেও তাকে সালাম দিলো না তনি। আঙুল তাক করে রাগত স্বরে বলে উঠলো,“তুমিই আমার বড়ু পুপিকে নিয়ে চলে গেচিলে তাই না? তুমি কী রাক্ষস?”

সশব্দে হেসে উঠলেন রায়হান কবীর। তৈমূরের উদ্দেশ্যে বললেন,“ইনি হচ্ছেন আমাদের বাড়ির পাকা গিন্নি। এক মুহূর্তেই কিনা তোমায় রাক্ষস বানিয়ে ছাড়লো?” কথাটা বলতে বলতে আরো একচোট হাসলেন তিনি। হাসতে হাসতে বসা থেকে উঠে এগিয়ে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। তৈমূর এগিয়ে বসলো তনির কাছাকাছি। দুষ্টুমি করে বললো,“রাক্ষস না তবে মেয়েধরা। তোমার বড়ো ফুপি সুন্দর তাই তুলে নিয়ে গিয়েছি।”

“আর ফেলত দিবে না পুপিকে?”

“না, একবার যাকে নেই তাকে আর ফেরত দেই না।”

“কেনো দিবে না? বড়ু পুপিকে রেখে ছুটু ফুপিকে নিয়ে যাও।”

“কেনো?”

“ছুটু পুপি পঁচা। শুধু বকে।”

“বকে? এমনি এমনি তো কেউ বকে না। নিশ্চয়ই দুষ্টুমি করেছো?”

“উহুম তনি দুত্তুমি করে না। আমি তো শুধু পুপির ঘর থেকে লিপিস্টিক এনে আইতকিলিমকে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এই জন্য বকবে?”

থতমত খেয়ে গেলো তৈমূর। পিচ্চিটার কথা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো তার। বুঝতে পেরেই ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,“আইসক্রিমকে আবার লিপস্টিক লাগানো যায়? কীভাবে সম্ভব? আইসক্রিম গলে যায় না?”

বিড়াল ছানাটির দিকে আঙুল তাক করে বললো,“ওর নাম আইতকিলিম।”

“বিড়ালের নাম আইসক্রিম?”

“বিড়াল বলবে না।”

“আচ্ছা বললাম না। তা এতো নাম থাকতে এই খাবারের নাম কেনো রাখলে?”

“আইতকিলিম খেতে আমার ভালো লাগে। আর ওকেও ভালো লাগে।”

“ওহ।” সাথে বিড়বিড় করে বললো,“বাচ্চকাচ্চাদের মন বোঝা বড়োই দায়।”

খোলা বারান্দার একপাশে ঠাঁই পেয়েছে তুলসী, ধনিয়া, কারি আর মেহেদী গাছ। বিড়ালের জন্য আনা দুধের বাটিটা নাতনির হাতে দিয়ে বারান্দায় দিকে ব্যস্ত পায়ে ছুটলেন কেয়া বেগম। হাত দিয়ে তুলে নিলেন কয়েকটা ধনিয়া আর কারি পাতা। তারপর আবারো ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই দৃষ্টিগোচর হলো উদাস মনে বসে থাকা বড়ো কন্যাকে।

আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। সূর্যের উত্তাপ ছড়িয়ে ধরণীকে করেছে গ্ৰাস। গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত। এই অবস্থায় কন্যাকে আকাশের নিচে বসে থাকতে দেখে বড়োই আশ্চর্য হলেন তিনি। কিছুটা এগিয়ে এসে শুধালেন,“এই রোদ আর গরমের মধ্যে তুই এখানে বসে আছিস কেনো? এখনকার রোদ একদম ভালো না। জ্বর চলে আসবে তো।”

অনুভূতি শূন্য দৃষ্টিতে একপলক মায়ের পানে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো উথমী। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। কেয়া বেগম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে তোর? মন খারাপ?”

“মন খারাপ কেনো হবে? এতো সুন্দর বর, এতো বড়ো বাড়ি, আর বরের বিশাল চাকরি! তারপরেও মন খারাপ কেনো থাকবে? তোমার মেয়ের সুখ আর সুখ মা।”

কথাটি শুনতেই কেয়া বেগম আর উথমীর দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো দরজার দিকে। মা-বোনের দু জোড়া দৃষ্টি নিজের উপর নিবদ্ধ হতেই সামনের দিকে এগিয়ে এলো ঊষা। বড়ো বোনের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের সুরে বললো,“কী? ঠিক বলেছি না আপু? নাকি পুরোনো প্রেম এখনো ভুলতে পারিসনি?”

ছোটো বোনের এমন খোঁচা মারা কথাটিতে রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও রাগলো না উথমী। বরং তার অধরে ফোটে উঠলো চমৎকার হাসি। মেঝের সাথে পায়ের ঘর্ষণে দোলনা দোলাতে দোলাতে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,“জ্বলছে নাকি খুব? বড়ো বোনের ভালো সহ্য হয় না বুঝি?”

হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেলো ঊষার। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“তোকে দেখে জ্বলবো কেনো? কোথাকার কোন মহারাণী তুই?”

“মহারাণী না হলেও কম কিছু নই। সারাজীবন তো আমায় দেখে জ্বলেই গেলি, আমার মতো হওয়ার চেষ্টা করলি কিন্তু পারলি কী হতে? পারবিও না। তাই আমায় নিয়ে ভাবা বন্ধ করে নিজেকে নিয়ে ভাব। আর হ্যাঁ, যেই ছেলের সাথে রাত জেগে ফিসফিসিয়ে কথা বলিস। ক্লাস বাদ দিয়ে ঘুরঘুর করিস, বিশ্বাস কর সে কিন্তু তোকে কখনোই বিয়ে করবে না। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। ক্যারিয়ারে মনোযোগ দে। বোন হয়ে বোনকে হিংসা করা ভালো নয়।”

দু বোনের মধ্যকার বাক বিতন্ডায় চমকালেন কেয়া বেগম। বললেন,“ছোটো বোনের সাথে এ কী ধরণের আচরণ উথমী? আর ছেলে! কোন ছেলের সাথে ও ঘুরঘুর করে?”

“এতোদিন ধরে যে বড়ো বোনের সাথে ও যেই আচরণটা করল সেটা তো তোমার চোখে কখনো পড়েনি। অথচ আমার আচরণ, আমার করা সামান্যতম ভুলগুলোও তোমার চোখে খুব ভালো করেই পড়ে। সারাটা জীবন তুমি শুধু আমার সাথে একপাক্ষিক আচরণই করে গেলে মা। জন্ম দিয়েও তুমি আমার মা হতে পারলে না। সবসময় তোমার কাছে তোমার বড়ো ছেলে আর ছোটো মেয়ের গুরুত্বই ছিলো বেশি।”

“উথমী!”—-কম্পিত কণ্ঠ।

“যদিও তোমার থেকে এখন আর আমি সেসব আশা করি না। একটা সময় খুব খারাপ লাগতো কিন্তু বোঝ হওয়ার পর, নিজের খারাপ সময়ে এসে বুঝেছি বাবা আর ভাই আমায় ভালোবাসে। ভাবী আসার পর সেও তো কম যত্ন করেনি। এতো মানুষের ভিড়ে দুয়েকজন ভালো না বাসলে কিই বা আসে যায়?”

কথাটা বলেই স্থান ত্যাগ করল উথমী। পেছনে রেখে গেলো প্রশ্নে জর্জরিত মাকে আর ধরা খেয়ে অপমানিত হয়ে চুপসে যাওয়া বোনকে। তৎক্ষণাৎ কেয়া বেগম ছোটো কন্যার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“ও কী বলে গেলো এসব? কে ছেলেটা? কার সাথে ঘুরে বেড়াস?”

“তুমি আমায় অবিশ্বাস করছো মা? ও কি না কি বলে গেলো সেসব ধরে লাভ আছে?”—-কোনোমতে কথাটা বলে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়ল ঊষা।

বিছানায় বসে ম্যাগাজিন ঘাটছে তৈমূর। কিন্তু মনটা তার পড়ে আছে অন্য কোথাও। এখানে তার মোটেও ভালো লাগছে না। টিকছে না মন।

“কার কথা ভাবছেন?”

প্রশ্নটা শুনে সামনে তাকালো তৈমূর। দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো স্ত্রীর পানে। সোজা হয়ে বসলো সে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?”

“বারান্দায়।”

“কোথায়? পেলাম না তো।”

“করিডোরের ছাদ বারান্দায়।”

“চোখমুখ এভাবে লাল হয়ে আছে কেনো? রোদে বসে ছিলেন?”

“হুম।”

বিছানা থেকে নেমে স্ত্রীর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো তৈমূর। কপালে, গলায় হাত ছুঁয়ালো। মুহূর্তেই যেনো সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো উথমীর। কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে ভ্রু কুঁচকালো। বিচলিত কণ্ঠে তৈমূর বললো, “শরীর তো গরম হয়ে গিয়েছে! বোকার মতো কেউ গিয়ে রোদে বসে থাকে?”

“আমি থাকি।”

“জ্বর আসলে?”

“আপনি আছেন না? দিন রাত এক করে বধূ সেবা করবেন।”—-বলেই নিজের পোশাক নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো সে। তার যাওয়ার পথে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো তৈমূর।
__________

দুপুরের ভোজন শেষে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য যে যার ঘরে শুয়ে আছে। বুয়াকে নিয়ে এঁটো বাসন গুলো ধুয়ে রাখছে রিনিতা। উথমী টেবিল থেকে একটা চেয়ার টেনে বসে আছে সেথায়। ননদ ভাবী মিলে গল্প করছে। মোবাইলটা হাতে নিতেই কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল তৈমূরের। স্ক্রীনে ভাসছে বুবু নাম দিয়ে সেভ করা নাম্বার থেকে আসা বেশ কিছু কল। বেশি কিছু ভাবলো না সে। কল লিস্টে গিয়ে কল ব্যাক করল বড়ো বোনের নাম্বারে। সেকেন্ড পাঁচেকের ব্যবধানেই রিসিভ হলো কল। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে বিপরীত পাশ হতে রাগত স্বরে তিথিয়া বলতে লাগলো,“কোথায় ছিলি তুই? এতোগুলো কল দিলাম ধরলি না কেনো?”

“মোবাইল সাইলেন্ট ছিলো। বাড়িতে কিছু হয়েছে কী?”

“কতকিছুই তো হয়েছে। তোর কী আর সেসবের দিকে খেয়াল আছে? বিয়ে করতে না করতেই তো এখন গিয়ে শ্বশুরের বাড়িতে পড়ে রয়েছিস।”

“এসব কী ধরণের কথা বলছো বুবু? এলামই তো গতকাল। আর আম্মাকে জানিয়েই এসেছি। হেঁয়ালি না করে কী হয়েছে সেটা বলো।”

“আম্মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না, খেতে পারছেন না। সারাক্ষণ মরে যাবো, মরে যাবো বলে প্রলাপ বকছেন।”

গম্ভীর মুখখানা মুহূর্তেই অশান্ত হয়ে উঠলো তৈমূরের। শঙ্কিত হলো তার মন।বিচলিত কণ্ঠে শুধালো,“অসুখ! গতকাল আসার সময়ও তো দেখে এলাম ভালো। কী হয়েছে? ভাইয়া কোথায়? ডাক্তার দেখিয়েছো?”

“শ্বশুর বাড়ির মন রক্ষা শেষ হলে নিজে এসেই দেখে যা কী হয়েছে। রাখলাম আমি।”—-কথাটা বলেই চট করে কল কেটে দিলো তিথিয়া।

বোনের এমন আচরণে অবাক হলো তৈমূর। মায়ের চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল মন।

চলবে ________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৭]

বিছানায় বসে পা নাচাতে নাচাতে পান চিবোচ্ছেন শাহানা। উনার ঠিক সামনে একটি চেয়ারে বসে আছেন বড়ো জা জয়নব। বুড়ো আঙুলে লাগানো চুনটুকু মুখে নিয়ে শাহানার দিকে তাকিয়ে তার হাবভাব পরখ করছেন। ছোটো জা করবী দুপুর পর্যন্ত অবশ্য এখানেই ছিলেন। এরপর খেয়েদেয়ে সেই যে নিজের ঘরে গিয়েছেন আর এমুখো হননি।‘ফুলকুঞ্জে’ আজ আত্মীয়-স্বজনদের ভিড় কমেছে। যে যার মতো ফিরে গিয়েছে নিজেদের আবাসস্থলে।

বড়ো জায়ের হাবভাব অনেকক্ষণ ধরে আড়চোখে লক্ষ্য করছেন শাহানা। এবার আর হেরফের না করে সোজা উনার দিকে ফিরে শুধালেন,“কী ব্যাপার ভাবী? বারবার এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো? কিছু বলবেন?”

“না।”

“তাহলে হঠাৎ আজ এই অসময়ে আমার ঘরে?”

খানিকটা ইতস্ততবোধ করলেন জয়নব। আমতা আমতা করে বললেন,“শুনলাম সকাল থাইক্কা নাকি তুই অসুস্থ? বাড়িতে ডাক্তার পর্যন্ত আইয়া পড়ছে। কিন্তু তোরে দেইখ্যা তো তেমন মনে হইতাছে না।”

শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন শাহানা। উত্তর দেন,“সব অসুখ কী আর দেখা যায় গো বুবু? এ হলো গিয়ে মনের অসুখ। যা চোখ দিয়ে দেখা যায় না।”

জায়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলেন না তিনি। ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত করে বললেন,“তোর মতিগতি আমি বুঝি না। কহন কি করস নিজেই জানোস না।”—বলেই মুখ বাঁকালেন। ধীর পায়ে হেঁটে জায়ের কক্ষ ছেড়ে চলে গেলেন তৃতীয় তলার উদ্দেশ্যে।

এর মিনিট পাঁচেক পরেই হন্তদন্ত হয়ে কোত্থেকে যেনো ছুটে এলো তিথিয়া। হাঁপাতে হাঁপাতে মায়ের উদ্দেশ্যে এলোমেলো বাক্যে বলে উঠলো,“আম্মা, তৈমূর তো বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। নিচে ওদের গাড়ি দেখে এলাম।”

মেয়ের কথায় টনক নড়ে উঠলো শাহানার। কাঁসার বাটিটায় মুখে থাকা অবশিষ্ট পান আর পিকটুকু ফেলে মুখটা মুছে নিয়ে তা খাটের নিচে ঠেলে দিলেন। তারপর লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে অসুস্থতার ভান করে পড়ে রইলেন। ফোনকলে বড়ো বোনের কাছ থেকে মায়ের অসুস্থতার খবর শুনেই চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে গিয়েছিল তৈমূর। ওই মুহূর্তে আর বেশি কিছু না ভেবেই রায়হান কবীরকে বুঝিয়ে উথমীকে নিয়ে রওনা দিয়েছিল বাড়ির উদ্দেশ্যে।

এখন সন্ধ্যা। মাগরিবের আজান পড়েছে মিনিট দশেক আগে। খয়েরি রঙের গাড়িটি গেইট পেরিয়ে ভেতরে এসে থামতেই গাড়ি থেকে নেমে গেলো তৈমূর। ড্রাইভারকে লাগেজগুলো ভেতরে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে বাগান পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল সে। উথমীর মধ্যে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সে আপনমনে ধীর পায়ে এগিয়ে চলছে দালানটির দিকে।
এইটুকু সময়ে আশপাশটা যতটুকু দেখা যায় ঘাড় ঘুরিয়ে তা দেখে নিচ্ছে। যদিও এই অল্পস্বল্প আঁধারে সবকিছু ভালো করে দেখা যাচ্ছে না তবুও চারিপাশটা বেশ সুন্দর। উথমীর এই গা ছমছমে পরিবেশটাই বড্ড মনে ধরেছে। ইচ্ছে করছে এখানেই থম মেরে বসে থাকতে।

অন্দরমহলে একটা কেদারায় বসে আছে তুরাগ। তার সামনেই সোফায় বসে অংক কষছে তুরাগ আর জেবার একমাত্র ছেলে জোহান। আর একটু পরপর জানা অংকগুলোই ভুল করছে ছেলেটা। ছেলের এই অবস্থা দেখে চরম বিরক্ত তুরাগ। এতোবার বুঝিয়ে দেওয়ার পরেও কিনা এই অবস্থা তার? রাগটাকে আর সংযত রাখতে পারলো না সে। ধমকের সুরে বলে উঠলো,“এই সহজ সহজ অংকগুলো আবার ভুল হয় কী করে? রোজ রোজ যে টিচার এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়িয়ে যায় তখন মন কোথায় থাকে? নাকি অংক বোঝায় না ভালো করে? না বোঝালে বলিসনি কেনো? সামনে না তোর পরীক্ষা? পরীক্ষায় ফেইল করলে কিন্তু খুব মার খাবি জোহান।”

ভয়ে কেঁপে উঠলো জোহান। ভিতু দৃষ্টিতে পিতার পানে একপলক তাকিয়ে নামিয়ে নিলো দৃষ্টি।

জেবা রান্নাঘর থেকে গরম দুধের গ্লাস আর চায়ের কাপ ট্রে তে করে এনে রাখলো টি টেবিলের উপর। পিছু ঘুরতেই এই অসময়ে বাড়িতে দেবরের আগমনে অবাক হলো বেশ। চমকায়িত কণ্ঠে শুধালো,“এ কী তৈমূর! তুমি? তোমাদের না দুদিন থাকার কথা ছিলো? তাহলে গতকাল গিয়েই আজ ফিরে এলে যে?”

তুরাগও ফিরে তাকালো ছোটো ভাইয়ের দিকে। স্ত্রীর কথায় সহমত পোষণ করে জিজ্ঞেস করল,“ঠিকই তো। হঠাৎ ফিরে এলি যে? কিছু হয়েছে? উথমী কোথায়?”

সেসবের কোনো উত্তর দিলো না তৈমূর। বিচলিত কণ্ঠে শুধালো,“শুনলাম আম্মা নাকি অসুস্থ? ডাক্তার দেখিয়েছো? কী হয়েছে আম্মার? আর তোমরাই বা কেমন? অসুস্থ একটা মানুষকে ফেলে রেখে এখানে বসে আছো?”

তার এহেন কথায় দম্পতি যুগলের মুখশ্রীতে ফোটে উঠলো বিষ্ময়। একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে কয়েক সেকেন্ডের নিরবতার পালন করল। তারপর গলা ঝেড়ে তুরাগ বললো,“আজকে একটু বেশিই গরম পড়েছে। তার উপর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কারেন্ট ছিলো না। ওদিকে বিয়ে বাড়ির এতো ঝক্কি ঝামেলায় আইপিএসেও চার্জ দেওয়া হয়নি। সব মিলিয়েই আর কি গরমের জন্য আম্মার প্রেশারটা একটু বেড়ে গিয়েছিল।”

“একটু বেড়েছিল?”

“হ্যাঁ একটুই। তার জন্য তোমার ভাই বাড়িতে পরিচিত ডাক্তার আনিয়ে আম্মার চেকআপ পর্যন্ত করিয়েছে। যা বলার ডাক্তারই বলেছেন। দুপুরে তো খাবার নিয়ে গেলাম উনার ঘরে। কিন্তু তোমাদের আম্মার তো যত রাগ সব ছেলের বউয়ের উপর। তাই আমার হাতে আর খেলেন না। উল্টো নতুন করে আপাকে দিয়ে খাবার আনিয়ে খেয়েছেন। অথচ রান্নাটা কিন্তু আমিই করেছিলাম। তা তোমায় এ খবর কে দিলো শুনি?”—-জেবার কণ্ঠে তাচ্ছিল্য।

“দুপুরের দিকে বুবু ফোন করল। তখনি জানালো।”

মুহূর্তেই জেবার মুখভঙ্গি বদলালো। জমা হলো তাতে রাগ, ক্ষোভ। সেই রাগত দৃষ্টিই সে তৎক্ষণাৎ নিক্ষেপ করল স্বামীর পানে। স্ত্রীর এই রণচণ্ডী রূপ দেখে যা বোঝার বুঝে গেলো তুরাগ। কপালের ঘাম মুছে ছেলের উদ্দেশ্যে কড়া স্বরে বললো,“বই-খাতা নিয়ে ঘরে যা। আমি এসে সবগুলো অংক কিন্তু দেখবো। ভুল হলেই মার হবে।”

পিতাকে বরাবরই খুব ভয় পায় জোহান। তাই চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল সে। তৈমূরও আর দাঁড়ায় না। সিঁড়ি বেয়ে চলে যায় মায়ের ঘরে। দরজায় নক করে অনুমতি চায়,“আসবো আম্মা?”

ভেতর থেকে মায়ের কণ্ঠস্বরের বদলে ভেসে আসে বড়ো বোনের কণ্ঠস্বর,“আয়।”

অনুমতি পেয়ে আর বিলম্ব না করে ভেতরে প্রবেশ করল তৈমূর। পূর্ণ দৃষ্টিতে মাকে দেখে চেয়ার টেনে বসলো। বোনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,“আম্মা কী ঘুমাচ্ছেন?”

“দেখতেই তো পাচ্ছিস।”

“খুব অসুস্থ?”

“হুম, ডাক্তার বিছানা থেকে নামতে নিষেধ করেছেন।”

“ওহ, তা দুপুরে খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়েছেন?”

“আর খাবার! অনেক চেষ্টা করে অল্প একটু খাইয়ে ওষুধ খাইয়েছি। বাড়িতে এতোগুলো মানুষ থাকতেও আমার আম্মার সেবা করার মতো কোনো মানুষই নেই। মাঝেমধ্যে তো আমার খুব চিন্তা হয়। আমি না থাকলে কী হবে আমার আম্মার?”—-দীর্ঘশ্বাস ফেলে আঁচলে মুখ গুঁজলো তিথিয়া।

এই মুহূর্তে কেমন অনুভূতি প্রকাশ করা উচিত তৈমূর ঠিক বুঝতে পারলো না। নিচে বড়ো ভাই আর ভাবীর থেকে শুনে এলো এক কথা আর উপরে এসে বোনের থেকে শুনছে আরেক কথা। কার কথা বিশ্বাস করবে সে? ভাই আর ভাবীও যে মিথ্যা বলার মানুষ নন তা সে জানে। আর বোন? দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তা-ভাবনার সমাপ্তি টেনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় তৈমূর। মায়ের ঘুম ভাঙলেই যা বোঝার বোঝা যাবে। তাই বিনয়ের সহিত বললো,“আম্মা ঘুমাচ্ছেন, ঘুমাক তবে। তুমি তো আম্মার কাছে আছোই। আমি বরং ফ্রেশ হয়ে আসি।”

কথা শেষ করে মায়ের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো তৈমূর। সঙ্গে সঙ্গে শোয়া থেকে উঠে বসলেন শাহানা। চোখেমুখে উনার বিশ্বজয়ের হাসি। সেই হাসি বজায় রেখেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,“দেখেছিস?মায়ের অসুস্থতার খবর শুনেই আমার ছেলে সব ফেলে চলে এসেছে। বলেছিলাম না? আমার তৈমূ তুরাগের মতো নয়। হ্যাঁ মানছি বিয়েটা না হয় আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে করেছে কিন্তু বউয়ের জন্য মাকে ও কখনোই ছেড়ে যাবে না।”

মায়ের এই আনন্দ উল্লাস মোটেও পছন্দ হলো না তিথিয়ার। ক্রোধের অনলে দগ্ধ হলো সে। চোখেমুখে ছাপিয়ে গেলো মলিনতায়। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,“এতো খুশি হইয়েন না আম্মা। এখনো কিন্তু অনেক সময় পড়ে আছে। আরো কয়েকদিন যাক তারপর সব টের পাবেন।”

ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম গুলো রয়েসয়ে খুলছে তৈমূর। বাথরুম থেকে ভেসে আসছে পানির টুপটাপ শব্দ। কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিধেয় পোশাক বদলে ফেললো সে। বিছানার এককোণে চুপটি করে বসে দৃষ্টি স্থির করে রাখলো মেঝেতে। দরজা খোলার আওয়াজ হলো। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো উথমী। চেনা মানুষটিকে দেখেও না দেখার ভান করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তৈমূর পুরো সময়টা মনোযোগ দিয়ে স্ত্রীকে দেখলো। গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বললো,“এ অসময়ে আবার গোসল করতে গেলেন কেনো? দিনে তো করেছিলেনই একবার। এখন শুধু হাত-মুখ ধুয়ে নিলেই হতো।”

সবটাই শুনলো উথমী কিন্তু উত্তর দেওয়ার কোনোরূপ প্রয়োজনবোধ করল না। স্ত্রীর থেকে আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে মিইয়ে গেলো তৈমূর। হুটহাট এভাবে ফিরে আসায় কী রাগ করেছে মেয়েটি? নাকি অভিমান করেছে? জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করল না। শুধু বললো,“আম্মা অসুস্থ। খবরটা শোনার পরেও কীভাবে ওখানে থাকি বলুন তো? মন খারাপ করবেন না। পরেরবার গেলে না হয় আপনার যতদিন ইচ্ছে ততদিনই থেকে আসবেন।”

এবারো নিরবে শুনে গেলো উথমী। স্ত্রীর নিরবতায় কথা বাড়ানোর সুযোগ পেলো না তৈমূর। চলে গেলো ফ্রেশ হতে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বের হয়েই হাত-মুখ মুছে আবারো সোজা চলে গেলো মায়ের ঘরে।
_________

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। নিজ তত্ত্বাবধানে মাকে খাইয়ে সেখানেই ওষুধ হাতে বসে রইলো তৈমূর।
ছেলের এতো সেবা যত্নে একদিক দিয়ে আনন্দিত আবার অন্য দিক দিয়ে বিরক্ত শাহানা। আমতা আমতা করে বললেন,“আমি এখন ঠিক আছি। ওষুধের কোনো প্রয়োজন নেই। রেখে দে এটা।”

“তা বললে কীভাবে হয় আম্মা? বুবুর থেকে শুনে যা বুঝলাম আপনি খুবই অসুস্থ।ওষুধ না খেলে পুরোপুরি সুস্থ হবেন কীভাবে বলুন তো?”

“তিথির কথা ছাড় তো। ও তো আমার অল্প কিছু হলেই চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে যায়। তাই ফোন করে অসব বলেছে। আর তুই বা কেমন ছেলে? এই সামান্য একটা কারণে এভাবে বাড়ি চলে আসবি?”

মায়ের এমন নমনীয়তায় আশ্চর্য হয় তৈমূর। ভেতরে কোথাও সৃষ্টি হয় সগৌরবের। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অযথা মাকে এতক্ষণ ধরে ভুল বোঝার কারণে নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানায়। চমৎকার হেসে কোমল স্বরে বলে,“আমার আম্মা অসুস্থ আর সেই খবর শোনার পরেও আমি শ্বশুরবাড়িতে বসে জামাই আদর নিবো? এ কী হতে পারে আম্মা? আমার কাছে পৃথিবীর সব কিছুর ঊর্ধ্বে আপনি। এখন নিন ওষুধ খান। তারপর চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়ুন। সকালবেলা উঠে দেখবেন একেবারে সুস্থ হয়ে গিয়েছেন।”

পুত্রের প্রতি এতোদিনের জমা সব রাগের পারদ নিমিষেই গলে গেলো শাহানার। সবার ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতা, রাগ দেখাতে পারলেও সন্তানদের বেলায় এসব তিনি পারেন না। এ পৃথিবীতে নিজের বলতে যে এই সন্তান তিনজন ছাড়া কেউ নেই শাহানার। আর কোনো কিছু না বলে ওষুধটি খেয়ে নিলেন তিনি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,“এই গরমের মধ্যে কতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিস! ঘরে যা বাবা। বিশ্রাম নে গিয়ে।”

“গাড়িতে এসি ছিলো আম্মা। আপনি আমার জন্য চিন্তা করবেন না তো। আপনি না ঘুমানো পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাচ্ছি না।”

কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়লেন শাহানা। নিজের আনন্দটা পুত্রের সম্মুখে প্রকাশ করলেন না। বাধ্য নারীর মতো বালিশে মাথা রেখে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলেন।

নিশ্চিন্তে বিছানায় পড়ে ঘুমাচ্ছে জোহান। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রাগে ফুঁসছে জেবা। সন্ধ্যার সেই রাগটা এখনো গলেনি তার। স্ত্রীর রাগ সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবগত তুরাগ। এমনিতে তার বউটা কোমল হৃদয়ের নারী হলেও রেগে গেলে হয়ে ওঠে বাঘিনী। তাই তো সে এখনো চুপ। অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার ভং ধরে বসে আছে ঘরের এককোণে পড়ে থাকা সিঙ্গেল সোফায়। স্বামীর এই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রাগের পারদ তড়তড় করে বৃদ্ধি পেলো জেবার। বিছানা থেকে নেমে সোজা গিয়ে দাঁড়ালো স্বামীর সম্মুখে। কোমরে দু হাত রেখে গমগমে স্বরে বললো,“তোমার মা-বোনের কাণ্ড দেখে রীতিমতো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। এমন কেনো উনারা? সংসার তো নিজেরাও করেছে নাকি? আমরা এতোগুলো মানুষ বাড়িতে থেকে উনার দেখভাল করার পরেও তৈমূরকে ফোন করেই বাড়ি নিয়ে আসতে হলো? সে কী চিরকালের জন্য শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছিল? আর তোমার বড়ো বোনের কথাও বলিহারি। নিজে তো জীবনেও শ্বশুর শাশুড়ির খেদমত করল না। উল্টো শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আলাদা সংসার পেতেছে। এমনকি স্বামীকে নিজের কথায় উঠবস পর্যন্ত করায়। তার উপর মাসের অর্ধেকটা সময় পড়ে থাকে বাপের বাড়ি। সেসবে কোনো সমস্যা নেই। সব সমস্যা শুধু ভাইয়ের বউদের নিয়ে?”

“আমায় যা ইচ্ছে বলো কিন্তু আমার মা-বোন নিয়ে কিছু বলবে না জেবা।”

“খুব গায়ে লাগে তাই না? আর উনারা যখন বাড়ির বউদের সাথে খারাপ আচরণ করেন তখন গায়ে লাগে না? সব পুরুষ মানুষই এক।”

“সব পুরুষ এক মানে? সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করলাম। নিজের বাড়ি ছেড়ে আলাদা ফ্ল্যাট নিলাম। তোমাকে সুন্দর একটা সংসার দিলাম আর তুমি বলছো আমার গায়ে লাগে না?”

ক্রোধ নিয়ে তাকালো জেবা। সঙ্গে সঙ্গে আবারো মিইয়ে গেলো তুরাগ। এমনিতে সে মোটেও বউকে ভয় পায় না। বলতে গেলে সিংহ পুরুষ। কিন্তু বউ রেগে গেলে যেনো সে সিংহ থেকে রূপান্তরিত হয় বিড়াল ছানায়। এরও অবশ্য একটা কারণ আছে। জেবার পিতা রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। উনার আবার বৈধ একটা বন্দুকও রয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকা থাকাকালীন রাতের বেলা প্রেমিকার রাগ ভাঙাতে গিয়ে কতবারই না ভদ্রলোকের তাড়া খেয়ে এসেছিল তুরাগ! সেসব ভাবতেই এখনো ভয়ে আত্মা কেঁপে ওঠে তুরাগের। তার উপর জেবা উনার একমাত্র মেয়ে। মেয়ের প্রতি পিতার অনেক ভালোবাসা। সে মেয়েকে তুরাগ কষ্ট দিয়েছে জানলে তো তাকে নির্ঘাত গুলি করেই মেরে ফেলবে।যতোই হোক নিজেকে তুরাগ খুব ভালোবাসে। এই অকালে সে শ্বশুরের বন্দুকের গুলিতে শহীদ হতে চায় না। গলার আওয়াজ খাদে নামিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললো,“আম্মা আমায় জন্ম দিয়েছেন। বুবু ছোটো থেকে কোলে পিঠে করে বড়ো করেছে। ছেলে- মেয়েদের হাত খরচা দেওয়াটা বাবা পছন্দ করতেন না। কিন্তু হাত খরচা ছাড়া চলা যায়? স্কুল, কলেজে থাকাকালীন সেই হাত খরচাটা পর্যন্ত আপাই দিতো। এই যে বিয়ের আগে প্রেম করার সময় তোমাকে রোজ গাজরা দিতাম, বিভিন্ন ওকেশনে উপহার দিতাম, সেসবের টাকা কোথায় পেতাম বলো তো? সব বুবুই দিতো। সেই আম্মা আর বুবুকে কীভাবে কী বলবো? আমি জানি উনারা ভুল। কিন্তু সবসময় সবার ভুল ধরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সম্পর্কগুলো নিমিষেই নষ্ট হয়ে যায়। তবে কম তো আর বোঝানোর চেষ্টা করিনি। তারা না বুঝলে আমি আর কী করি বলো তো?”

সবটাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো এবং বুঝলো জেবা। ভুল কিছু বলেনি তুরাগ। সত্যিই তার আর কিই বা করার আছে? তবে জেবার মস্তিষ্ক থেকে চিন্তা সরে না। উথমীর ভবিষ্যৎ নিয়ে বড়োই চিন্তিত হয় সে। তৈমূর কী পারবে সব সামাল দিতে?

রাত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কক্ষের দ্বার ভিড়ানো। বিদ্যুৎ থাকার পরেও ঘর হয়ে আছে নিকষ কালো আঁধার। ব্যালকনিতে আলো জ্বলছে। একা একা সেখানে বসে আছে উথমী। বাগানের আনাচে কানাচে থেকে ভেসে আসছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। সাথে ভেসে আসছে নাম না জানা পাখির সুরেলা কণ্ঠের গান।তৈমূর এখনো আসেনি ঘরে। হয়তো মায়ের ঘরে আছে।রাতে খাওয়ার আগে শাশুড়িকে একবার দেখতে গিয়েছিল উথমী। যদিও জেবার কথায় নিয়ম রক্ষার্থে। ভালো মন্দ জিজ্ঞেসও করেছিল কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি শাহানা।

সেসবে কিছু যায় আসে না উথমীর। সে বসে আছে আপনমনে নিজের ভাবনাতে বিভোর হয়ে। হাতে একটি বেগুনী রঙের ডায়েরি তার। এই ডায়েরিটি আঠারোতম জন্মদিনে বড়ো ভাইয়ের নিকট থেকে উপহার স্বরূপ পেয়েছিল উথমী। উচ্চ শিক্ষার জন্য যখন ঘর ছেড়ে ওই দূর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মলিন হলে গিয়ে উঠার সময় হয়ে এলো তখনি উৎস তাকে ডায়েরিটা দিয়ে বলেছিল,“যখন নিজেকে একা মনে হবে। মনের কথা বলার মতো কাউকে পাবি না তখনি সবকিছু এই ডায়েরিতে লিখে রাখবি।” ভাইয়ের কথা সবসময়ই শুনে এসেছে উথমী। তাই তার পরবর্তী জীবনের অনেক ঘটনা, কতশত অনুভূতি যে এতে ঠাঁই পেয়েছে তার হিসেব নেই।

গতকাল বাড়িতে গিয়ে নিজের আলমারি খুলতেই একটি ড্রয়ারে এই ডায়েরিটির দেখা পায় উথমী। তখনি যত্ন সহকারে লাগেজের কাপড়ের ভাঁজে তা রেখে দেয় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে। ডান হাতের সাহায্যে একটা একটা করে পৃষ্ঠা উল্টায় সে। লেখাগুলোর উপর চোখ বুলায়। আঁখি পটে ভেসে ওঠে পুরোনো সব স্মৃতির বহর। পরের পৃষ্ঠাগুলো পড়ার দুঃসাহস আর হয় না তার। পরের ঘটনাগুলো সে জানে। ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারেনি অনেককিছু। তবে সেসব আর ভাবতে চায় না উথমী। অবহেলার সহিত একসঙ্গে অনেকগুলো পৃষ্ঠা উল্টিয়ে চলে যায় শেষের দিকে। দৃষ্টি গিয়ে থমকে যায় নিজের লেখা অনুভূতি, আবেগে জর্জরিত কিছু শব্দে,

❝আমাদের একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর হবে। টিনের চালে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি পড়বে। জারুল ফুলের গন্ধে মোহময় হয়ে উঠবে আমাদের বাড়ি। সকল ক্লান্তিকে দূরে ঠেলে রাত বিরেতে নকশিকাঁথা গায়ে জড়িয়ে পরম শান্তিতে তোমার বুকে মাথা রেখে আমি ঘুমাবো। আর তুমি? তুমি এক সমুদ্র স্নেহ, মায়া, আদর নিয়ে আমার চুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে আমায় ভালোবাসবে। কী বাসবে না?❞

চোখ জোড়া ভিজে ওঠে উথমীর। ঠোঁটের কার্নিশে ফোটে ওঠে বিষণ্ণ হাসি। আলতো করে শব্দগুলো ছুঁয়ে দিয়ে চোখ বুজে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। তারপর এক নির্দয়া রমনীর ন্যায় ডায়েরি থেকে আলাদা করে ফেলে পৃষ্ঠাটি। টুকরো টুকরো করে তা ছিঁড়ে ফেলে দেয় ঘরে থাকা ময়লার ঝুড়িতে। মুহূর্তেই প্রণয়মাখা শব্দগুলোর স্থান হয় অপ্রয়োজনীয় ময়লার স্তূপে।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)