জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-২০+২১

0
13

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২০]

ভর সন্ধ্যায় শ্বশুর ভিটায় পিতাকে দেখে ভীষণ অবাক হলো উথমী। চমকায়িত দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অন্দরমহলের চাকচিক্যময় সোফায় বসে থাকা পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোকের পানে। কিছুতেই যেনো নিজের চোখকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। একসময় যখন সবটা সত্য মনে হলো তখনি সে ছুটে গিয়ে বসলো পিতার পাশে। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে শুধালো,“বাবা! তুমি সত্যিই কী এসেছো?”

মেয়ের মুখখানি দেখতেই চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠলো রায়হান কবীরের। ঘোলাটে দৃষ্টিতে চেয়ে মেয়ের মাথায় হাত রেখে প্রত্যুত্তর করলেন,“হ্যাঁ মা সত্যিই আমি এসেছি।”

এই ছোট্ট বাক্যটিতেই উথমীর মুখশ্রীর সকল অবাকতা, আশ্চর্য সরে গিয়ে সেথায় ঠাঁই পেলো আনন্দের।অধরে ফোটে উঠলো চমৎকার একটি হাসি। যেই হাসি দেখে অবশেষে দূর হলো এক পিতার সমস্ত মন খারাপ। অধর ছাপিয়ে উঠলো প্রশান্তিতে। সেই দৃশ্যপট এতক্ষণ সিঁড়ির ধারে দাঁড়িয়ে নিরবে অবলোকন করছিল তৈমূর। এবার সেও এগিয়ে এলো। শ্বশুরের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে বসলো সম্মুখে। রায়হান কবীর হাস্যোজ্জ্বল মুখে জামাতার উদ্দেশ্যে বললেন,“সকাল থেকে মেয়েটার কথা খুব মনে পড়ছিল। ইচ্ছে করছিল দুচোখ ভরে দেখতে তাই না জানিয়েই চলে এসেছি বাবা।”

কথাটিতে যেনো খানিকটা অপ্রস্তুত হলো তৈমূর। বিনয়ের সহিত বললো,“আপনার যখন ইচ্ছে তখনি আপনি চলে আসবেন, বেড়াবেন। এটা তো আপনার মেয়েরও বাড়ি। জানানোর প্রয়োজন কী? বরং আমারই উচিত ছিলো সেই যে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছিলাম তারপর উথমীকে কয়েকদিনের জন্য আপনাদের ওখানে পাঠানো।”

জামাতার বিনয়ী কথার ধরণে ভেতরে ভেতরে বেশ প্রসন্ন হলেন রায়হান কবীর। পাশে বসা হারুন সাহেবের সম্মুখে গর্বে যেনো বুকটা ফুলে ওঠলো উনার। হারুন সাহেবকে দেখিয়ে বললেন,“উনি হচ্ছেন হারুন ভাই, আমাদের বিল্ডিংয়েই থাকেন। আমার অবসর জীবনে ঘোরাঘুরির সঙ্গী। তাই ভাইকে নিয়ে ভাইয়ের গাড়িতে করে চলে এলাম। একা একা এসেছি জানলে উৎস আর ওর মা আবার রেগে যাবে।”

শ্বশুরের কথার বিপরীতে অকৃত্রিম হেসে উনাকে সালাম দিলো তৈমূর। হারুন সাহেবও সালামের জবাব নিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে আশেপাশে তাকালেন। কথার মধ্যেই রায়হান কবীর প্রশ্ন করলেন,“আজ কী তোমার অফিস বন্ধ বাবা? এ সময় তো বাড়িতে থাকার কথা নয়।”

অসুস্থতার ব্যাপারটা চেপে গেলো তৈমূর। কৃত্রিম হেসে প্রত্যুত্তরে বললো,“না আমিই ছুটি নিয়েছিলাম।”

“ওহ।”

একাধিক মানুষের কথাবার্তার শব্দে ধীর পায়ে নিচে নেমে এলেন শাহানা। সোফায় বসা ভদ্রলোকদের চিনতে না পেরে ললাটে উনার ভাঁজ পড়ল। কথার ছলে উপস্থিত দাঁড়িয়ে থাকা মাকে দৃষ্টিগোচর হতেই উঠে দাঁড়ালো তৈমূর। উৎসুক হয়ে বলে উঠলো,“ওই যে আম্মাও চলে এসেছেন। আমিই এতক্ষণ আপনাকে ডাকতে যাবো বলে ভাবছিলাম।”

নড়েচড়ে উঠলেন শাহানা। মাথায় দেওয়া ঘোমটাটা আরেকটু সামনে টেনে এগিয়ে এসে সিঙ্গেল সোফায় বসতে বসতে সম্মুখ মানুষ দুজনের উদ্দেশ্যে সালাম দিলেন,“আসসালামু আলাইকুম।”

বিয়ের কথাবার্তা থেকে শুরু করে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত শাহানার সঙ্গে রায়হান কবীরের দেখা সাক্ষাৎ না হলেও বৌ ভাতের অনুষ্ঠানে একবার দেখা হয়েছিল বটে তবে তখন তেমন একটা কথা হয়নি দুজনার। তাই বলতে গেলে এটাই প্রথম উনাদের সামনাসামনি বসা। বিয়ের আগে অবশ্য পাত্রের মায়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলতে চেয়েছিলেন রায়হান কবীর কিন্তু তুরাগ আর জেবা বিভিন্ন বোঝ দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা। নেহাৎ প্রাণপ্রিয় পুত্রের পরিচিত হওয়ায় ব্যাপারটা আর তেমন ঘাঁটেননি তিনি।

প্রত্যুত্তর করলেন,“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছেন বেয়াইন?”

কিছু বুঝতে না পেরে ছেলের পানে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকান শাহানা। এর আগে একবার দেখা হলেও ভদ্রলোককে চিনতে পারলেন না তিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুখশ্রী ভুলে বসেছেন। তৈমূর মায়ের চাহনি বুঝতে পেরে মৃদু হেসে পরিচয় করায়,“উনি হচ্ছেন আমার শ্বশুরমশাই, উথমীর বাবা। বৌ ভাতে তো উনারা এসেছিলেন। আপনার সঙ্গে পরিচয় করালাম? হয়তো চেহারা ভুলে গিয়েছেন। আর পাশের জন হারুন চাচা, উনার প্রতিবেশী বন্ধু।” তারপর রায়হান কবীরের উদ্দেশ্যে বলে,“আর বাবা উনি হচ্ছেন আমার আম্মা।”

এবার ললাটের ভাঁজগুলো বিলীন হলো শাহানার। পরিচিত হতে পেরে মাথা নাড়ান। শাশুড়ির হাবভাব দেখে মনের ভেতর কু ডেকে ওঠে উথমীর। হানা দেয় ভয়। ভদ্রমহিলার আচরণ সুবিধার নয়। এখন যদি বাবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে বসে? তখন? বাবার থেকে বরং সেই বেশি অপমানিত হবে।লজ্জায় নত হয়ে যাবে মাথা। সেসব ভেবেই গলা শুকিয়ে আসে উথমীর। কিন্তু তার সমস্ত ভাবনা চিন্তাকে পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে মুখভঙ্গি বদলে ফেলেন শাহানা। অধরে হাসি ফুটিয়ে অত্যন্ত কোমল স্বরে বলে উঠলেন,“তখন অতো মানুষের ভিড়ে একবার পরিচয় হওয়ায় মুখটা ভুলে গিয়েছিলাম, তাই চিনতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। কিছু মনে করবেন না ভাই সাহেব। তা মেয়েকে দেখতে এসেছেন নিশ্চয়ই?”

“হ্যাঁ, অনেকদিন দেখি না তাই চলে এলাম। আপনিও কিছু মনে করবেন না আপা। বুঝেনই তো বড়ো মেয়ে! খুব আদরের ছিলো।”

“তা বললে তো আর হয় না ভাই সাহেব। বেয়াইনকেও সঙ্গে করে আপনার নিয়ে আসা উচিত ছিলো। আত্মীয়দের সঙ্গে ওসব অনুষ্ঠানে একপলক দেখা সাক্ষাৎ হলে কী আর ওভাবে মনে থাকে? দুই দিকের মানুষদের মধ্যেই আসা যাওয়া থাকতে হয়। উনাকে নিয়ে এলে উনার সঙ্গেও পরিচয়টা হয়ে যেতো আর অতিথি আপ্যায়নটাও মনমতো করতে পারতাম। কিন্তু আপনি তো সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে দিলেন আমায়।”

ভদ্রমহিলার ব্যবহারে খুব খুশি হলেন রায়হান কবীর। উত্তরে হেসে বললেন,“আপনার বেয়াইনকে জানানো হয়নি। উনি জানলে এভাবে আর আসতে পারতাম না।”

“সে যা হওয়ার হয়েছে, পরেরবার কিন্তু বেয়াইনকে সঙ্গে নিয়ে একেবারে সকাল সকাল চলে আসতে হবে।”

“আচ্ছা তা না হয় আসবো।”

এবার পুত্রবধূর পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান শাহানা। তার উদ্দেশ্যে বলেন,“তুমি এখনো এখানে বসে আছো কেনো? যাও গিয়ে বাবা, চাচার জন্য চা, মিষ্টির ব্যবস্থা করো। কতটা পথ এসেছেন উনারা! শুকনো মুখে বসে থাকলে হয়?”

বিপরীতে রায়হান কবীর বাঁধা দিয়ে বললেন,“ও থাকুক এখানে। চা, মিষ্টির প্রয়োজন নেই।”

তৎক্ষণাৎ তৈমূর বলে উঠলো,“তা বললে কীভাবে হয় বাবা? উথমী বরং এখানেই থাকুক, আমি ফুফুকে বলে আসছি।”

ছেলের কথাটা পছন্দ হলো না শাহানার। নাকোচ করে দিয়ে বললেন,“বাবা এতোদূর থেকে মেয়ের জন্য এসেছে আর মেয়ের হাতের বানানো চা না খেয়ে অন্য কারোর হাতে বানানো চা খাবে? সেই স্বাদ কী আর পাবে? যাও বউমা তুমি নিজ হাতে বানিয়ে আনো। তারপর চা খেতে খেতে না হয় বাবা-মেয়ে গল্প করো।”

বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায় উথমী। এই মুহূর্তে নিজেকে কোনো একটা ঘোরের ভেতরে মনে হচ্ছে তার। শাশুড়ির এতো সুন্দর আচরণে কিছুতেই যেনো মেলাতে পারছে না হিসেব। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। বাবার উদ্দেশ্যে বলে,“তুমি বসো বাবা।আমি আসছি।”

বলেই যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সে। রায়হান কবীর মেয়েকে পিছু ডাকেন। বলেন,“এগুলোও ভেতরে নিয়ে যা মা।”

উনার ইশারায় দেখানো জিনিসগুলোর পানে তাকায় সবাই। টি-টেবিলের উপরে এবং তারই পাশে মেঝেতে বেশ কয়েকটি প্যাকেট আর মিষ্টির হাঁড়ি। প্যাকেটের গায়ের উপরে লেখা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, দামী দামী সব মিষ্টান্ন থেকে শুরু করে প্যাকেট জাতীয় বিভিন্ন খাবার এবং দুটো কাপড়ের ব্যাগ। সেসব দেখে শাহানা আন্তরিক হয়ে বললেন,“এসবের আবার কী প্রয়োজন ছিলো ভাই সাহেব?”

কাপড়ের ব্যাগ দুটো শাহানার দিকে এগিয়ে দিলেন রায়হান কবীর। বললেন,“কী যে বলেন না? খালি হাতে আসা যায়? এগুলো হচ্ছে আমাদের বাড়ির ওদিককার সবচেয়ে নামী দোকানের মিষ্টি। উথমীর খুব পছন্দের। আর এই ব্যাগ দুটোতে রয়েছে শাড়ি। ওর মা নিজে পছন্দ করে আপনার জন্য কিনেছিল কিন্তু জামাই বাবা আপনার অসুস্থতার খবর পেয়ে হুট করে চলে এলো তাই আর সাথে করে দিয়ে দেওয়া হয়নি। গ্ৰহণ করুন আপা।”

সম্মুখে কৃত্রিম রাগ দেখালেও সদিচ্ছায় তা গ্ৰহণ করলেন শাহানা। মনে মনে বেশ তৃপ্ত হলেন। মালতী ফুফুকে ডেকে এনে উনার সাহায্যে সবকিছু ভেতরে নিয়ে গেলো উথমী। সবার জন্য চুলায় বসালো চায়ের পানি। শাহানা সেখানে বসেই কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন। আর তৈমূর চুপচাপ বসে রইলো। বড়োদের মধ্যে কী বলা উচিত বুঝতে পারলো না সে।
___________

চিন্তিত মুখে ড্রয়িং রুম জুড়ে পাইচারি করছেন কেয়া বেগম। না চাইতেও বারবার উনার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকছে দেয়াল ঘড়িটির পানে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সাতটা বেজে ছাপ্পান্ন মিনিট। অথচ স্বামী কিংবা কন্যা কারোরই এখনো ফেরা হয়নি ঘরে। পাশের মসজিদ থেকে মাগরিবের নামাজ আদায় করে সাড়ে সাতটার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যান রায়হান কবীর। আর ঊষার বেশি দেরি হলে ছয়টা কিংবা সাড়ে ছয়টা। কিন্তু এর থেকে বেশি দেরি করে বাড়িতে ঢোকার সাহস মেয়ের নেই। বাবাকে সে যথেষ্ঠ ভয় পায়। সেই মেয়েরও কিনা আজ কোনো খবর নেই?

মেয়ের নাম্বারে বেশ কয়েকবার কল দিয়েছেন কেয়া বেগম কিন্তু মোবাইল তার বন্ধ। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ঝিম ধরে যাওয়ায় এবার তিনি বসে পড়লেন সোফায়। উচ্চস্বরে ডাকলেন,“বউমা! এদিকে এসো তো একবার।”

বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে মেয়েকে স্বরবর্ণ লেখা শিখাচ্ছিল রিনিতা। শাশুড়ির ডাক শুনতেই ‘আসছি মা’ বলে বিছানা থেকে ধীরে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে। কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙিতে বললো,“জ্বি মা, বলুন।আমি আসলে বসে বসে আপনার নাতনিকে একটু পড়াচ্ছিলাম। মেয়েটা যা দুষ্টুমি করে না?”

সেসব শুনেও যেনো বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না কেয়া। চিন্তিত স্বরে শুধালেন,“তোমার ননদ আর শ্বশুর কোথায়? এখনো ফিরছে না কেনো?”

“ঊষার খবর আমার জানা নেই মা। ও তো বাড়ির কাউকেই আর তেমন গুরুত্ব দেয় না। ছন্নছাড়ার মতো চলাফেরা করে। সেদিন মনোযোগ দিয়ে পড়তে বলায় আমাকেই ঝাড়ি মারলো। ভাবীকে যে আলাদা একটা সম্মান দিতে হয় সেই শিক্ষাটাও ভুলে বসেছে এই মেয়ে। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় আপনার ছেলের কানে নেহাৎ এসব খবর যায় না। নইলে যে ওর কী অবস্থা হতো!”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই পুত্রবধূর পানে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন কেয়া। শাশুড়ির এহেন দৃষ্টিতে চুপসে গেলো রিনিতা। কেয়া পুনরায় শুধালেন,“আর তোমাদের বাবা? উনি কোথায়?সকাল থেকে দেখলাম বাড়িতে থম মেরে বসে রইলেন। আবার দুপুরের দিকে দেখি সেই মানুষটাই হাসিখুশি মনে নতুন পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে গেলেন? জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছো? বললো, এইতো এদিক ওদিক থেকে ঘুরে আসি। সেই মানুষ কিনা এখনো ফিরলো না?”

শাশুড়ির চিন্তা দেখে রিনিতার ইচ্ছে করল সত্যটা উনাকে জানিয়ে দিতে কিন্তু তা আর জানাতে পারলো না।পুত্রবধূকে তুলোধোনা করে চলার মতো মানুষ কেয়া বেগম নন। সেবা যত্ন থেকে শুরু করে ভালো ব্যবহার করতেও যেমন উনার সময় লাগে না ঠিক খারাপ ব্যবহার করতেও সময় লাগে না। তাই বাধ্য হয়েই মিথ্যে বললো রিনিতা,“জানি না মা। জানলে তো আপনাকে বলতামই, তাই না? আপনার থেকে আমি কিছু লুকাই?”

কথায় কাজ দিলো। মাথা নাড়ালেন কেয়া বেগম। তারপর থম মেরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। কিছু একটা চিন্তাভাবনা করে আচমকা বলে উঠলেন,“ঊষার নাম্বারে কল দিয়েছিলাম, নাম্বার বন্ধ বলছে। একবার তোমার শ্বশুরের নাম্বারে কল দাও তো। যদি ধরে তাহলে মোবাইল আমার হাতে দিবে আর যদি না ধরে তাহলে সোজা উৎসকে কল দিয়ে পুরো ঘটনাটা জানাবে।”

শাশুড়ির আদেশ মেনে নিয়ে পেটে হাত চেপে ধরে ঘর থেকে গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে আসে রিনিতা। সরাসরি কল বসায় শ্বশুরের নাম্বারে। কিন্তু রিসিভ হয় না কল। বাজতে বাজতেই কেটে যায় বারংবার। পরপর বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন ঘুরেফিরে এক অবস্থা তখন সে ব্যর্থ কণ্ঠে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে,“বাবা তো কল রিসিভ করছেন না মা। বাজতে বাজতেই কেটে যাচ্ছে।”

“তাহলে এবার উৎসকে ফোন করো।”

“আচ্ছা করছি।”—কথাটা বলতে বলতে এবার স্বামীর নাম্বারে কল দিলো রিনিতা।

টেবিলের উপর একপাশে জমেছে বিভিন্ন কাগজের স্তূপ। অপরপাশে একটি কম্পিউটার। ডান হাত দিয়ে মাউস নাড়াতে নাড়াতে একবার কম্পিউটার স্ক্রিনে তো আরেকবার বাম হাতের কাগজে দৃষ্টি স্থির করছে উৎস। কাজের সময় মোবাইলের আওয়াজে দুই ভ্রুয়ের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা হ্রাস পেলো তার। কল রিসিভ করে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,“আমি ব্যস্ত আছি, যা প্রয়োজন ম্যাসেজ করে রেখে দাও। ফেরার পথে নিয়ে আসবো।”

“ম্যাসেজে বলা যাবে না, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। মা এখনি তোমায় তা জানাতে বলেছেন।”

“আচ্ছা জানাও তবে, সময় কম।”

দ্রুত শাশুড়ির থেকে কিছুটা দূরে সরে গেলো রিনিতা। কণ্ঠস্বর নিচু করে বললো,“এদিকে বিরাট একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। সকাল থেকে উথমীর জন্য বাবার মন কেমন করছিল, তাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই দুপুরে হারুন চাচা আর তার গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছে উথমীর শ্বশুরবাড়ি। যা মা জানেন না। জানলেই আমার উপর শুরু করবেন হইচই। আবার উনার চিন্তিত মুখও আমার ভালো লাগছে না। কী করি বলো তো?”

“তা তুমি এতো পাকনামি করে শুরুতেই কেনো মা কিংবা আমায় জানাওনি? উথমীর শ্বশুরবাড়ি একেবারে কাছেপিঠে নাকি? ঘণ্টা খানেকের পথ। তার উপর জ্যাম পড়লে তো আর কথাই নেই।”

“আহা রাগ করো না তো। উথমীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। বাবা সেখানেই আছেন। সাবধানে পৌঁছেছেন। কিন্তু ওদিকে তো ঊষাকেও পাওয়া যাচ্ছে না।”

“কী! ঊষাকে কেনো পাওয়া যাবে না?”

“তেমন কিছু বলে যায়নি। এতো রাত পর্যন্ত তো বাড়ির বাইরে সে থাকে না। ফোনটাও বন্ধ বলছে। বিপদ আপদ কিছু ঘটলো না তো? তুমি প্লিজ একটু খোঁজ নাও না।”

সারাদিনের ব্যস্ততা তার সাথে এতোশত কাগজ আর ডাটা চেক করতে করতেই শরীরে ঝিম ধরে গিয়েছে উৎসর। তার সাথে বাড়ি থেকে পাওয়া এমন খবরে ঘাম ছুটে গেলো তার। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে স্ত্রীকে বললো,“আমি লাইনে আছি। তুমি এখনি একবার ঊষার ঘরে যাও। আলমারি, পড়ার টেবিল সব চেক করো।”

“কিন্তু কেনো?”

“যা বলছি তাই করো।”

“আচ্ছা।”

স্বামীর কথা মোতাবেক ঊষার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় রিনিতা। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে,“আপনার ছেলে একবার ঊষার ঘরটা দেখতে বলছে, চলুন মা।”

বিপরীতে কোনো প্রশ্ন না করেই পুত্রবধূর পিছুপিছু ছোটো কন্যার ঘরে প্রবেশ করলেন কেয়া। অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালালেন। মেয়ের অনুপস্থিতিতে তার ঘরে তেমন একটা আসা হয়না উনার। যা পরিষ্কার করার প্রতি শুক্রবারে বুয়াকে নিয়ে নিজেই করে ফেলে ঊষা।

“তুমি চেয়ারে গিয়ে বসো।আমি দেখছি।”—রিনিতার উদ্দেশ্যে কথাটা বলে নিজেই প্রথমে পড়ার টেবিল চেক করে তারপর আলমারিতে হাত লাগালেন।

আলমারির দরজাটা খুলতেই যেনো ভীষণ অবাক হলেন কেয়া। একে একে ড্রয়ার গুলো খুলতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো উনার। উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “ঊষার এতো এতো জামা-কাপড় কোথায় গেলো? ভালো ভালো জামা-কাপড়গুলো তো ভেতরে নেই বউমা! যা আছে তাও এলোমেলো।”

শাশুড়ি মায়ের চিৎকার সূচক বাক্যে অবাক হয় রিনিতা। এগিয়ে গিয়ে নিজেও একবার সবকিছুতে দৃষ্টি বুলায়। তারপর হাতের মোবাইল কানে ধরে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে,“ঊষার জামাকাপড় সব উধাও হয়ে গিয়েছে। কিছু বুঝতে পারছো তুমি?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় উৎস। নিজের কেবিন থেকে বেরোতে বেরোতে উত্তর দেয়,“হ্যাঁ বুঝে গিয়েছি, রাখলাম এখন। আম্মাকে চিন্তা করতে নিষেধ করে দাও।”—-বলেই কল কাটলো সে।

গল্পের আসর বেশ জমে উঠেছে। আজ বহুদিন পর বাবা-মেয়ে একসঙ্গে বসে কথা বলতে বলতে অনেক হেসেছে। বিয়ের পর এই প্রথম স্ত্রীকে মন খুলে হাসতে দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো তৈমূরের। সে উপলব্ধি করল মেয়েটির হাসি প্রাণোবন্ত এবং সুন্দর। তাদের আড্ডায় অবশ্য বশিরউদ্দিনও যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই আবারো তিনি চলে গিয়েছেন উপরে। ঘরে অসুস্থ স্ত্রী শুয়ে আছে। তাকে রেখে এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়? মালতী ফুফু অতিথিদের জন্য রান্না বসিয়েছেন চুলায়। আর শাহানা ডাইনিং টেবিলে বসে সেই রান্নারই বিভিন্ন তদারকি করছেন।

একসময় মোবাইল বাজার শব্দে সেখান থেকে উঠে দূরে সরে গেলো তৈমূর। পরিচিত নাম্বারটি দেখতে পেয়ে দ্রুত হাতে তা রিসিভ করে কানে ধরলো, “আসসালামু আলাইকুম উৎস ভাই। কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা কেমন আছো? আর বাবা কোথায়?”

“আমরাও আলহামদুলিল্লাহ। বাবা, উথমী, হারুন চাচা উনারা সবাই বসে গল্প করছেন। কেনো কিছু হয়েছে?”

“ওহ, বাবার নাম্বারে অনেকবার ফোন করছিলাম কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। ওদিকে উথমীর মোবাইলের অবস্থাও এক, তাই তোমায় কল দিলাম।”

“হয়তো মোবাইল সাইলেন্ট করা। আমি দিচ্ছি উনার কাছে। তবে আজ কিন্তু বাবা এখানেই থেকে যাবে ভাইয়া। কাল সকালে না হয় বাড়ি ফিরবে।”

“কিছু মনে করো না তৈমূর, এভাবে না বলে কয়ে চলে গিয়েছেন উনি। ওদিকে মা খুব চিন্তায় আছে। আজই বাবাকে ফিরতে হবে, নইলে দেখা যাবে চিন্তায় চিন্তায় মা হার্টফল করে বসে আছে। কখনো থাকেনি তো বাবাকে ছাড়া। ওদিকে মাকে এখনি সত্যিটা জানালে তোমাদের ভাবীর উপর খুব রাগ করবে। বুঝতেই তো পারছো সমস্যাটা?”

“হ্যাঁ তা তো পারছি, আচ্ছা দেখি।”

সোজা হেঁটে এসে শ্বশুরের দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিলো তৈমূর। বললো,“উৎস ভাই ফোন করেছেন, আপনাকে ফোনে পাচ্ছিলেন না তাই।”

রায়হান কবীর মোবাইলটা নিয়ে কানে ধরলেন। শুধালেন,“কী বলবি বল।”

“এখনি বাড়িতে ফিরে এসো বাবা। মা তোমার জন্য চিন্তা করছে।”

“চিন্তা কেনো করবে? দাঁড়া আমি ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।”

“আহা বাবা, বললাম তো এখনি চলে এসো।”

“এভাবে হুট করে আসা যায়? তার উপর বেয়াইন বলে দিয়েছেন, আজ রাতে এখানেই নাকি থাকতে হবে।”

বাবার অবাধ্যতায় শেষমেশ আর না পেরেই উৎস বলে দিলো সত্যটা,“ঊষাকে পাওয়া যাচ্ছে না বাবা। তুমি এসো প্লিজ। উথমীকে এখনি কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই। কোনো একটা বাহানা দিয়ে চলে এসো। এখানে ঝামেলা হয়ে গেছে।”

চলবে _______

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২১]

তখন প্রায় মধ্যরাত। চেনা জানা সব জায়গায় ঊষাকে খোঁজাখুঁজি শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত দেহখানা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো উৎস। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপতেই দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলেন কেয়া বেগম। এতক্ষণ যেনো ছেলের অপেক্ষাতেই চাতক পাখির ন্যায় বসেছিলেন তিনি। বিচলিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“পেয়েছিস? পেয়েছিস আমার ঊষাকে? কোথায় ও?”

একনাগাড়ে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দরজার বাইরে মাথা বের করে আশেপাশে তাকিয়ে খোঁজ করলেন মেয়ের। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলেন না স্বীয় কন্যাকে। মায়ের এমন আহাজারিতে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো উৎসর। মাকে নিয়ে কোনোমতে ভেতরে প্রবেশ করে দরজাটা আটকে দিলো সে। দৃষ্টিগোচর হলো সোফায় চিন্তিত মুখে বসে থাকা নিজ পিতা এবং স্ত্রীকে। ছেলের থেকে খবরটা পেয়েই আর দেরি না করে তখনি বড়ো কন্যার শ্বশুরবাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন রায়হান কবীর। তারপর বাড়ি ফিরতে ফিরতে যতক্ষণ সময় লাগলো। তিনিও উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধালেন,“কী রে খুঁজে পেলি? কোথায় গিয়েছিল? আর কেনোই বা গিয়েছিল?”

ঘর্মাক্ত মুখটা বা হাতের শার্টের হাতা দিয়ে মুছে সোফায় বসে পড়ল উৎস। মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে উত্তর দিলো,“না পাইনি, কোথাও পাইনি। ইউনিভার্সিটির অফিসে গিয়ে কথা বলে এসেছি কিন্তু আজ নিয়ে টানা তিনদিন নাকি ও যায়নি ওখানে। অনুপস্থিত ছিলো। ওখান থেকেই ওর বেশ কয়েকজন বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তারাও বললো তারা নাকি কিছু জানে না। আশেপাশে ছবি দেখিয়ে লোকেদের জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেছি। তাদেরও এক কথা, দেখিনি, চিনিনা, জানি না।”

“তো থানায় গিয়ে কেনো নিখোঁজের ডায়েরি করলি না?”—-রায়হান কবীরের প্রশ্ন।

“গিয়েছিলাম কিন্তু ওরা আজ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছে। এও বলেছে, দেখুন গিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে কোথায় যেনো পালিয়ে গিয়েছে। এমন কেস তো রোজ রোজই দেখছি।”

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না কেয়া বেগম।
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বসে পড়লেন স্বামীর পাশে। বিলাপ ছেড়ে বলতে লাগলেন,“ওরা বললেই হলো? আমি চিনি আমার মেয়েকে। আর যাই করুক না কেনো আমাদের মান সম্মান নষ্ট হবে এমন কিছু অন্তত ঊষা করবে না। তোমাদের জন্যই ও রাগ করে কোথাও চলে গেছে। কথায় কথায় মেয়েটাকে ধমকাও তোমরা। সেদিনও কতকিছু বললে ওকে। কী দরকার ছিলো? ভালো করে বোঝালে কী হতো না?”

রায়হান কবীর নিশ্চুপ রইলেন। নিরবে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামানোর প্রয়াস চালালেন। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো রিনিতা। তুলে দিলো স্বামীর হাতে। তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সেথায়। গ্লাসটি ফাঁকা হতেই সেটা পুনরায় নিজ হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠলো,“মাফ করবেন মা। আজ একটা কথা বলতে আমি বাধ্য হচ্ছি, আপনি আপনার এই মেয়েকে সঠিক কোনো শিক্ষাই দিতে পারেননি। আর সে যদি রাগ করেই চলে যেতো তাহলে ভালো ভালো সব পোশাক-আশাক, সোনা-দানা, টাকা-পয়সা নিয়ে কেনো গেলো? এটাকে তো রীতিমতো পালিয়ে যাওয়া বলে।”

তার কথা শেষ হতে না হতেই জায়গাটিতে যেনো বিস্ফোরণ ঘটলো। মুহূর্তেই চমকে গেলো সকলে। ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত করে রায়হান কবীর জিজ্ঞেস করলেন, “কিহ! সোনা-দানা, টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে মানে?”

“হ্যাঁ বাবা। মায়ের সকল গহনাগাটি এমনকি আপনার ছেলের গাড়ি কেনার জন্য জমানো টাকা, যেটা প্রতি মাসে মায়ের কাছে জমা রাখতো সেটাও নিয়ে গিয়েছে। আমি সন্দেহবশত আপনাদের লকার খুলে দেখি সেসব কিচ্ছু নেই ওখানে।”

হতভম্ব হয়ে গেলো দম্পতি যুগল। উৎস ততক্ষণে সোজা হয়ে বসেছে, তার মুখভঙ্গিও বদলেছে। সাথে যেনো কেঁপে উঠেছে বুকটাও। শুধালো,“কী বলছো রিনি? আমার টাকা! এতো বছর ধরে জমিয়ে আসা এতোগুলো টাকা নিয়ে ও চলে গেলো? তুমি এতক্ষণ কেনো এসব বলোনি আমায়?”

“বাবা ফেরার পর আমার মনে হুট করে সন্দেহ জাগে। তখনি তল্লাশি চালিয়ে দেখি এই অবস্থা। তুমি বাইরে ছিলে বলে জানাইনি। বাবা-মাকেও এতক্ষণ জানাইনি আরো কষ্ট পাবেন বলে।”

সেসব কিছুই শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না উৎসর। শরীর তার রীতিমতো কাঁপছে। ভেতর থেকে বের হচ্ছে উত্তাপ। মনে হয় জ্বর আসবে। সেই কলেজে পড়াকালীন থেকেই বন্ধুদের দেখাদেখি তারও স্বপ্ন ছিলো একটা বাইকের। কিন্তু স্বপ্ন থাকলেও বাবার কাছে আবদার করার মতো সৎ সাহস অন্তত ছিলো না। গোটা পরিবার থেকে শুরু করে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা খরচা চালিয়ে নিজের গাড়ি খরচা, হাত খরচা বাঁচিয়ে বাড়ি কেনার জন্য অল্প অল্প করে সঞ্চয় করা বাবার কাছে কীভাবেই বা এমন বিলাসী আবদার করতো সে? তখন থেকেই সে শুরু করল টিউশন পড়ানো। প্রথমে একটা, দুইটা তারপর থেকে শুরু করে আরো কত! ধীরে ধীরে সেখান থেকেই বেশ পরিচিতি পেয়ে বেতনও বাড়লো। বাবার উপর থেকে নিজের খরচের ভার কমিয়ে নিজেই নিজের খরচা চালানোর পাশাপাশি জমানো শুরু করল টাকা। হঠাৎ করেই একদিন বাইক এক্সিডেন্টে এক বন্ধুর মৃত্যুতে বাইকের স্বপ্নটা ভেঙে গেলো উৎসর। সেখানে জন্ম নিলো নতুন স্বপ্ন। আর তা হলো একটা চার চাকার গাড়ি। তারপর লেখাপড়া শেষে ভালো একটা চাকরি পেলো সে। বেশ কয়েকবার অবশ্য প্রমোশনও পেয়েছে, সাথে বেড়েছে বেতন। সেই জমানো টাকার পরিমাণ এতো বছরে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। হয়তো সামনের বছর পূরণও হতে যাচ্ছিল তার স্বপ্নটা, কিন্তু! কিন্তু নিজের আপন বোনই কিনা সেই টাকা নিয়ে চলে গেলো?

সেসব ভাবতেই হিংস্র হয়ে উঠলো উৎসের মন। চিৎকার করে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “নিজের ভাইয়ের সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতা কীভাবে করতে পারলো ও? আমি ওকে খুন করে ফেলবো বাবা। একবার শুধু সামনে পেয়ে নেই। আমার এতো বছরের কষ্ট, সাধনা তোমাদের মেয়ে এতো সহজে আত্মসাৎ করবে? কিছুতেই তা আমি হতে দিবো না। ওর নামে চুরির মামলা দিবো।”

স্বামীর চিৎকারে ভয় পেয়ে গেলো রিনিতা। কাঁপা কাঁপা হাতে তার কাঁধ স্পর্শ করে বলতে লাগলো, “শান্ত হও। তনি ঘুমাচ্ছে ঘরে। তোমার এমন অবস্থা দেখলে মেয়েটা ভয় পেয়ে যাবে।”

স্ত্রীর কথায়ও শান্ত হলো না উৎস। রাগে রীতিমতো কাঁপছে সে। কেয়া বেগম নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে। চোখের পানি থেমে গিয়েছে উনার। উঠার মতো শরীরে পাচ্ছেন না কোনো জোর। রায়হান কবীরের ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে ভারি কণ্ঠে বললেন,“ওকে আর এসব বলে কী হবে মা? আমার নিজেরই তো খুব রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ওই বখে যাওয়া মেয়েকে খুন করতে।”

শ্বশুরের কণ্ঠস্বরে ব্যথিত হলো রিনিতার মন। জিজ্ঞেস করল,“উথমীকে জানিয়েছেন এ ঘটনা?”

“না জানাইনি, এমন লজ্জার কথা সবার সামনে জানানো যায়? কী ভাববে ওর শাশুড়ি?”

“তাও ঠিক।”
___________

সকালের নাস্তা সেরে তৈরি হচ্ছে উথমী। তৈমূরের তৈরি হওয়া প্রায় শেষ। শরীরে পারফিউম স্প্রে করে বিছানায় বসে হাতঘড়ি পরছে সে। হিজাবের শেষ পিনটা গুঁজে সেদিকে ফিরে তাকালো উথমী। তাড়াহুড়ো করে মাঝারি আকারের ভ্যানিটি ব্যাগটি নিতে নিতে বললো,“একটা কথা বলবো বলবো বলে আর বলাই হচ্ছে না।”

“কী কথা?”

“ঘরে এই চেয়ার টেবিলটা আর মানাচ্ছে না। এটা একদম অকাজের। এর থেকে এখানে যদি অটবি সোফা বসানো যায় তাহলে ভালো হবে না? আরামে বসা যাবে। আর তার সামনে ছোটো একটা সেন্টার টেবিল।”

“কী বলছেন? অকাজের হবে কেনো? আমার কলেজ লাইফের চেয়ার-টেবিল এটা। এখানে বসে ছাত্র জীবনে আমি লেখাপড়া করতাম। লেখাপড়া শেষে অফিসের কাজ করি। আর আপনি বলছেন অকাজের?”

“হ্যাঁ অকাজেরই, আমার যখন মনে হয়েছে এটা সরানো উচিত তো সরাতেই হবে।”

অসহায় হয়ে গেলো তৈমূরের মুখ। মিনমিনে স্বরে বললো,“এমন করছেন কেনো উথমী? একবার ভেবে দেখুন, কলেজ থেকে পাওয়া পরীক্ষার খাতা কিন্তু এখানে বসেই দেখতে পারবেন আপনি।”

“বিকেলে কী সময় হবে আপনার?”

“কেনো?”

“নতুন নতুন সোফার কালেকশন দেখতে যাবো।”

“উথমী! না গেলে হয় না?”

“না হয় না, যত ভালোবাসার বউকে বাসুন। অবশিষ্ট কিছু বাকি থাকলে নিজেকে বাসুন কিন্তু এসব চেয়ার- টেবিলের প্রতি ভালোবাসা চলবে না। বলুন সময় হবে কিনা?”

“এখনি বলতে পারছি না। আসতে পারলে ফোনে জানিয়ে দিবো।”

তৈমূরের মুখশ্রীতে ফোটে উঠেছে মলিনতা। কিন্তু উথমী সেদিকে পাত্তা দিলো না। দরজার দিকে এগোতে এগোতে কড়া গলায় বললো,“চলুন এবার।”

সকালে গিয়ে ঊষার যাবতীয় তথ্য দিয়ে থানায় ডায়েরী করে এসেছে রায়হান কবীর এবং উৎস। বাবার কথা উপেক্ষা করে সাথে টাকা-পয়সা, গহনাগাটি চুরির মামলাও দিয়ে এসেছে উৎস। সেসব শুনে মেজাজটা তুঙ্গে উঠে গেলো কেয়া বেগমের। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,“শেষে কিনা নিজের বোনের নামে চুরির মামলা দিয়ে এলি? বিবেকবোধ কী লোপ পেয়েছে তোর? একটুও কষ্ট হয়নি?”

মায়ের ধমকে মুখভঙ্গি বদলালো না উৎসর। সোফায় শরীর হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছে সে। প্রত্যুত্তর করল,“কষ্ট তাও আবার ওই স্বার্থপর মেয়ের জন্য? পালিয়ে গিয়েছে তাও মেনে নিলাম কিন্তু সঙ্গে করে আমার টাকাগুলো কেনো নিয়ে গেলো? ও জানতো না যে এই টাকাগুলো কত কষ্টে জমিয়েছিলাম আমি? জানতো না ওখানে কত স্বপ্ন ছিলো আমার? বরং জেনেও সব নিয়ে চলে গেলো। ছেলে-মেয়েদের সমান চোখে দেখার চেষ্টা করো মা। বয়স তো আর কম হলো না। এখনো যদি এক সন্তানের জন্য সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য হিসেবে দেখো তাহলে কিন্তু সামনে তোমার কপালে খুব দুর্ভোগ লেখা আছে বলে দিলাম।”

বাক্যগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন কেয়া বেগম। পুত্রের নিকট থেকেও যে এমন সব কঠিন কঠিন কথা শুনতে হবে তা তিনি কষ্মিনকালেও ভাবতে পারেননি অথচ আজ কিনা? চোখের সামনে এভাবে ছেলে-মেয়েদের বদল দেখে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো উনার। হতাশ দৃষ্টিতে তাকালেন স্বামীর পানে। কিন্তু রায়হান কবীর সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে হাঁটা ধরলেন কক্ষের দিকে।
__________

দুপুর তখন দুইটা। টিং টিং করে লাস্ট ঘণ্টার শব্দ হতেই ক্লাসে থাকা শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের থেকে তুলে নিলো পরীক্ষার খাতা। তার ঠিক কয়েক মিনিট বাদে কলেজ বিল্ডিংয়ের সম্মুখের ফাঁকা সবুজ মাঠটি ভরে গেলো সাদা ইউনিফর্মের মেয়েদের পদচারণায়। দারোয়ান গেইট খুলে দিতেই হনহনিয়ে এক এক করে বের হতে লাগলো সকলে।

কলেজে পদার্থবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক উথমীসহ মোট তিনজন। তার মধ্যে একজন আবার রয়েছেন ছুটিতে। তাই আজকে হয়ে যাওয়া পরীক্ষার খাতাগুলো দুই ভাগ করে এক ভাগ নিজে আরেক ভাগ অন্য স্যারকে দিয়ে নিজেরগুলো আলাদা একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে এলো উথমী। আশেপাশে তাকিয়ে পার হলো রাস্তা। সর্বপ্রথম কল দিলো তৈমূরের নাম্বারে।

ড্রাইভার আশফাক আজ সকালেই এক সপ্তাহের জন্য ছুটি নিয়েছে। ছেলেটার মা নেই। বাবা থাকে বড়ো ভাই- ভাবীর সঙ্গে গ্ৰামের বাড়িতে। ঢাকা শহরে আপন বলতে তার তেমন কেউই নেই। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে গতকাল মাঝরাতেই ছেলেটা ছুটে গিয়েছে বাড়িতে। তবে তৈমূরকে সেকথা জানিয়েছে আজ সকালে। তাতে অবশ্য রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও রাগারাগী করেনি তৈমূর। কাজের চেয়েও একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার পরিবার। তাই বাধ্য হয়ে নিজেই ড্রাইভ করে কলেজ পর্যন্ত স্ত্রীকে পৌঁছে দিয়ে ছুটে গিয়েছে নিজ অফিসে।

পরপর তিনবার কল দেওয়ার পরেও কলটা রিসিভ করল না তৈমূর। বরং বাজতে বাজতেই কেটে গেলো কল। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উথমী। হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া ম্যাসেজটাও সে চেক করল কিন্তু বিপরীত দিক থেকে আসেনি কোনো রিপ্লাই। তাহলে কী তৈমূর দেখেনি ম্যাসেজটা? দেখলে যে অবশ্যই রিপ্লাই দিতো তা উথমী জানে। হয়তো কাজের চাপে ব্যস্ত আছে সে। মনে মনে সেসব ভেবেই মোবাইলটা ব্যাগে ভরে আশেপাশে রিক্সার খোঁজ করল। এই সময় রিক্সা পাওয়া খুবই দূরুহ ব্যাপার। আবার পেলেও রিক্সাওয়ালারা ভাড়া চায় বেশি।

“মিফসা! এই মিফসা!”

দূর থেকে ভেসে আসা কারো ডাক শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই ভ্রম ভাঙে উথমীর। নড়েচড়ে ওঠে আশেপাশে তাকায় সে। কিন্তু তেমন কাউকেই নজরে পড়ে না তার। মিফসা নামটি উথমীর হলেও সহসা তাকে এ নামে কেউ ডাকে না। হয়তো অন্য কাউকে ডাকছে এই ভেবেই পুনরায় রিক্সা খোঁজায় মনোযোগ দেয়। এগিয়ে আসে একটি রিক্সা। জিজ্ঞেস করে,“কই যাইবেন আপা?”

“বাস স্ট্যান্ডে, যাবেন?”

“না যামু না।”

না শব্দটিতেই বিরক্ত হলো উথমী। যাবে না-ই যখন তাহলে জিজ্ঞেস করতে এলি কেনো? যত্তসব।

“এই মিফসা, কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোমায় শুনতে পাচ্ছো না?”

বাক্যগুলো এবার কাছাকাছি থেকে আসতেই চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকায় উথমী। ললাটে ভাঁজ পড়ে তার। পরিচিত মুখশ্রী দেখতেই কেঁপে ওঠে বুক। স্তব্ধ, বিমূঢ়, হতবাক দৃষ্টিতে একনাগাড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পল্লব ঝাপটিয়ে আশেপাশে তাকায়। সন্তর্পণে শ্বাস নিয়ে পুনরায় তাকায় সম্মুখে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির পানে। নিশ্চিত হয় যে ভুল কিছু সে দেখছে না। ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত করে বলে ওঠে,“বর্ষ?”

অধরে হাসি ফোটে ওঠে বর্ষর। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠে,“আজ অনেকদিন পর দেখা হলো আমাদের তাই না? রাস্তার ওপাশ থেকেই তোমাকে ডাকছিলাম কিন্তু তুমি তো শুনছিলেই না।”

কথাটায় কিছুটা অপ্রস্তুত হয় উথমী তবে বিপরীত পাশের মানুষটিকে তা বুঝতে দেয় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৃত্রিম হেসে বলে,“হ্যাঁ অনেকদিনই। তিন বছর চার মাস পনেরো দিন পর।”

মুহূর্তেই যেনো বর্ষর অধরের হাসিটা বিলীন হয়ে সেখানে ঠাঁই পায় মলিনতা। আমতা আমতা করে শুধায়,“বছর, মাস, দিন সব মনে আছে এখনো?”

“না থাকার তো কথা নয়। উথমী কখনো সময় ভুলে না। নিজের সঙ্গে অন্যের করা অন্যায় ভুলে না।”

এমন একটি কথা যেনো কিছুতেই মেয়েটির থেকে আশা করেনি বর্ষ। ধীরে ধীরে নিজেই যেনো ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে সে। কপালের ঘাম বুড়ো আঙুলের সাহায্যে মুছে পুনরায় বললো,“বাড়ি ফিরছিলে?”

“হ্যাঁ, তা আপনি? এদিকে কী মনে করে?”

“এই কলেজে আমার ভাগ্নি পড়ে, এবার ফার্স্ট ইয়ারে। বেতনের রিসিটে কী যেনো একটা সমস্যা হয়েছে। দুলাভাই তো দেশে থাকেন না ওদিকে আপাও অসুস্থ। তাই আমাকেই আসতে হলো।”

“ওহ।”

“মিফসা!”

কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তিত কণ্ঠস্বর শুনে আড়চোখে তাকায় উথমী। কিন্তু নিরুত্তর থাকে। বর্ষ বলে,“কাছেই একটা ক্যাফেটেরিয়া আছে। একটু বসবে? প্লিজ।”

কী উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না উথমী। মন চাইছে তার প্রস্তাবে সায় দিতে আবার মস্তিষ্ক বারবার সাবধান করছে,“একদম যাবি না উথমী।”

তার এই দোটানার মধ্যেই গলার স্বর আরেকটু নরম করে পুনরায় বর্ষ বললো,“প্লিজ মিফসা, না করো না। অল্প কিছুক্ষণের জন্য না হয়?”

এবার আর না করতে পারলো না উথমী। মনের কথাকে প্রাধান্য দিয়ে রাজি হলো সে‌। হয়তো মনের কোণে এখনো কোথাও পুষে রেখেছে মায়া। তার সম্মতিতে খুশি হলো বর্ষ।

দুপুরের এই সময়ে এদিকটায় মানুষের ভিড় থাকে খুব কম। শহরের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা ক্যাফেটেরিয়াগুলো জমজমাট থাকে সকালে এবং বিকেল থেকে রাত অবধি। বর্ষর পিছুপিছু ভেতরে প্রবেশ করে একপাশের ফাঁকা টেবিলে বসলো উথমী। বাম পাশের বিশাল কাঁচের দেয়াল থাকায় খুব স্পষ্টভাবেই দেখা যায় বাইরের দৃশ্য। ভেতরের বেশিরভাগ চেয়ার-টেবিল পড়ে আছে ফাঁকা। যাও দুয়েকটা ভরা সেখানেও আবার কম বয়সী সব ছেলে-মেয়ে। সেসব পর্যবেক্ষণ করে সামনে তাকাতেই অপ্রস্তুত হলো উথমী। সম্মুখে বসা বর্ষ স্থির চাহনিতে তাকিয়ে এতক্ষণ ধরে তাকেই দেখছিল।

ছেলেটির চাহনিতে বিরক্ত হলো উথমী। তাড়া দিয়ে বললো,“যা বলার দ্রুত বলুন।”

“ফেরার এতো তাড়া কীসের?”

“মেয়েদের জীবনে অনেক নিয়ম-কানুন থাকে, সেসবই তাদের মেনে চলতে হয়। তাদের জন্য বাড়ি ফেরারও একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে।”

“একসময় আমাদের দুজনের সম্বোধনটা তুমি ছিলো। অথচ আজ সেই তুমি থেকে চলে এলে আপনিতে? আমি এতোটাই অপরিচিত হয়ে গেলাম?”

“সেই একসময় এখন অতীত। তুমি সম্বোধন করা মানুষটিও অতীত। অতীত নিয়ে আমি অতো ঘাঁটি না। অতীতে কাকে কী সম্বোধন করেছি সেসবও না।”

আহত হলো বর্ষ। পাংশুটে মুখে বললো,“আমি ভালো নেই মিফসা।”

হৃদয়ে বয়ে যাওয়া ধ্বংসাত্মক ঝড় যেনো মুহূর্তেই শান্ত হয়ে গেলো। অশান্ত চোখের মণি থেমে গেলো। মৃদু হাসলো উথমী। শীতল কণ্ঠে বললো,“স্বাভাবিক। বেঈমানরা কখনো ভালো থাকতে পারে না।”

“মিফসা!”—-কণ্ঠস্বরে আকুলতা।

সেই আকুলতা আজ আর উথমীর মনে নাড়া দিতে পারলো না। আজ তার মন অনেক কঠোর। আবেগ, অনুভূতি অনেক আগেই সে নিরবে নিভৃতে বিসর্জন দিয়েছিল খোলা আকাশের নিচে। পুষে রাখা তার শুদ্ধ ভালোবাসা রূপ নিয়েছিল ঘৃণায়। একটা সময় এই ছেলেটিকে কতটাই না ভালোবাসতো উথমী নামক মেয়েটি! তার আড়াই বছরের ভালোবাসায় বুঁদ হয়েছিল সে। অথচ দিনশেষে তার থেকেই প্রথম ধোঁকা পেয়ে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিল মেয়েটা। বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল ভালোবাসা নামক শব্দটির উপর থেকে। এখন সবই অতীত। সামনে বসে থাকা ছেলেটি শুধুই তার প্রাক্তন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উথমী। ব্যাগের ভেতরে অনবরত বাজতে থাকা মুঠোফোনের শব্দে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। মোবাইলটা বের করে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করা নাম্বারটি দেখে ভেতরে খেলে যায় প্রশান্তি। কল রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে ভেসে এলো অপরাধী কণ্ঠস্বর,“স্যরি উথমী, আমি মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই মোবাইল সাইলেন্ট ছিলো। আপনি যে কল দিয়েছেন তা একদম দেখতে পাইনি।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

“ঠিক আছে?”

“হ্যাঁ।”

“রাগ করেননি?”

“না।”

“কলেজ থেকে বেরিয়েছেন?”

“হ্যাঁ।”

কয়েক সেকেন্ড নিরবতা চললো। তারপর আমতা আমতা করে তৈমূর পুনরায় বললো,“আসলে আমি আসতে পারছি না, কাজের প্রেশার একটু বেশি।”

“সমস্যা নেই, আমি একাই চলে যেতে পারবো। চিন্তা করবেন না।”

“না না, একা আসার প্রয়োজন নেই। দিনকাল ভালো নয়। কয়েকদিন আগে না আপনি বাবার বাড়ি যেতে চাইলেন? তখন তো যাওয়া হলো না। এককাজ করুন, কলেজ থেকে সোজা ওখানে যান। অফিস শেষে আমি ওখান থেকেই আপনাকে নিয়ে সোজা বাড়ি ফিরবো।”

“মাথা কী খারাপ হয়ে গিয়েছে? অফিস শেষে এখানে এসে তারপর আবার নিজের বাড়িতে যাবেন? এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বাচ্চা নই যে বাড়ি ফিরতে পারবো না। চিন্তা করবেন না।”

“যা বলেছি তাই করুন। আমি পারলে আপনার কী? একদম পাকামো করবেন না। বাপের বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমি কিন্তু আপনার বাবাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করবো।”

“আর আপনার মা?”

“আম্মাকে আমি না হয় জানিয়ে দিবো, রাখছি।”

নিজের কথা শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিলো তৈমূর। স্ত্রীকে কিছু বলার মতো কোনো সুযোগই আর দিলো না।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)